জোৎস্না রাতে তুমি আর আমি পর্ব-০৮

0
2

#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি — [৮]
লেখনীতে;- #রুদ্রিকা_বেদী

গাড়ি এসে থেমে ঢাকা শহরের একটি আবাসিক বিল্ডিংয়ের সামনে। দ্যূতি এখানেই সাবলেট থাকে। আরুশ গাড়ি থামিয়ে দ্যূতির দিকে ফিরে চাইল। সারাদিনের ক্লান্তিতে দ্যূতি ঘুমিয়ে পরেছে। তার করা খোঁপা প্রায় খুলে আসতে বসেছে। দ্যূতির চুলগুলো মুখের উপর খেলা করছে। তারমধ্যে আরুশের চোখ যেয়ে আটকিয়েছে দ্যূতির ভ্রুয়ের উপর কেটে যাওয়ার দাগটায়। আরুশ মুগ্ধ নয়নে দ্যূতিকে দেখছে। আরুশ হয়তো অনেক করে চাচ্ছে সময়টা যেন এখানেই থমকে দাঁড়িয়ে যাক। দ্যূতিকে দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা আরুশের সারা জীবনেও মিটবে না।

আরুশ অনেকক্ষণ দ্যূতির দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে বসল। দীর্ঘ শ্বাস মনে মনে ভাবল,

__”চিন্তা করো আমার নূর! তোমাকে আমি তাড়াতাড়িই নিজের করে ফেলব!”

আরুশ দ্যূতিকে জাগাবে কিভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। আসল কথা দ্যূতিকে জাগিয়ে তোলার কোনো ইচ্ছা নেই তার মাঝে। আরুশ দ্যূতির দিকে এগিয়ে গেল। নিজের হাতের তর্জনী দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিতে লাগলো অতি সাবধানে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই সব শেষ!

দ্যূতি নড়ে উঠলো। আরুশ ঝটপট নিজের সিটে আগের মতো করে বসল। দ্যূতি আস্তে আস্তে করে চোখ সব কিছু একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল অস্পষ্ট চোখে। দ্যূতির চোখ আরুশের উপর পরতেই দ্যূতি লাফিয়ে উঠে!

__”আপনি এখানে কি করছেন?”

আরুশ এক মুহুর্তের জন্য হকচকিয়ে যায়। তারপর নিজেকে সামলিয়ে তোলে। দ্যূতির দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

__”আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”

দ্যূতির মনে পরে ওর পায়ে ব্যাথা আর আরুশই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ঘুমের রেশ সবে মাত্র কাটলো বলে সব মনে পরেছে। দ্যূতি ছোট করে ঢোক গিলে সোজা হয়ে বসে। সামনে তাকিয়ে উত্তর দেয়,

__”সরি! আসলে ভুলে গিয়েছিলাম আমি যে আপনার সাথে রয়েছি!”

আরুশ দ্যূতির কথা শুনে কোনো উত্তর দিলো না কিন্তু মনে মনে বিড়বিড় করল,

__”হ্যাঁ! আমার বেলায় সব ভুলতে হয়!”

দ্যূতির হঠাৎ চোখে পরে গাড়ি তার বাসার নিচে এসে থেমেছে। দ্যূতির বিরক্তিকর চাহনি মুহূর্তেই হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। দ্যূতি আরুশের পানে একবার তাকিয়ে বলে,

__”ধন্যবাদ আমাকে আবার বাসায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য!“

আরুশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

__”কেন? তুমি কি ভেবেছিলে,আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতাম?”

দ্যূতি আরুশের কথার কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ হেসে দরজা খুলে নামতে যাবে তখনই আরুশ দ্যূতির দিকে ঝুঁকে এসে দরজা ফের লাগিয়ে দিলো। দ্যূতি যেন স্তম্ভিত হয়ে তাকালো আরুশের চোখের পানে। কিছুক্ষণের জন্য দুইজনই হারিয়ে গেলো। দ্যূতির বুকের ভিতর হঠাৎই কম্পিত হয়ে উঠল। দ্যূতি আরুশকে দুই হাতের জোর ধাক্কায় নিজের সামনের থেকে সরিয়ে দিয়ে কঠিন কন্ঠে বলল,

__”কি হচ্ছে টা কি?”

আরুশও যেন এইবার খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পরল। এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা ভিজিয়ে বলল,

__”তোমার পায়ে লেগেছে! তুমি একা যেতে পারবে না! আমি ছেড়ে দিচ্ছি!”

__”কোনো দরকার নেই মিস্টার আরুশ চৌধুরী! আমি যেতে পারবো! এমনিতেই আমার পায়ের ব্যাথা আগের থেকে কমেছে! সো নো নিড ইউর হেল্প এবং এখন পর্যন্ত যা হেল্প করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ!”

বলে দ্যূতি নেমে গেল। আরুশ এই বার আর নামল না। দ্যূতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেট দিয়ে ভিতরে বিলিন হয়ে গেলো। দ্যূতির ভিতরে ঢুকতেই আরুশ গাড়ি স্ট্যাট করল। তারপর নিজের ফোন দিয়ে শিহাবের নাম্বারে কল করল। দুইবার রিং হতেই শিহাব ফোন তুলল। অপর পাশ থেকে ঘুমন্ত কন্ঠে শিহাব বলল,

__”হ্যালো!”

__”মিস্টার আদ্রিত মজুমদারের সঙ্গে আমার কালকের এ্যাপোইনমেন্ট ফিক্স কর!”

__”কিন্তু কেন!” শিহাবের ঘুম যেন উড়ে গেলো!

__”তোকে যা করতে বলেছি তাই কর বেশি প্রশ্ন করিস না!”

__”কিন্তু এতো রাতে কিভাবে?”

__”যেভাবেই হোক ফিক্স কর নাহলে তোর চাকরি আমি ফিক্স করে দিবো বলে দিলাম!”

আরুশের কথা শুনে শিহাব ঢোক গিলল। আরুশ কল কেটে দিলো। কালকেই কিছু একটা করতে হবে!
.
” 𝓜𝒐𝒋𝒖𝒎𝒅𝒂𝒓 𝓔𝒍𝒊𝒕𝒆 𝓤𝒎𝒑𝒊𝒓𝒆”
এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আরুশের ব্ল্যাক SUV কার। গেটের কাছে আসতেই,গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান আরুশকে স্যালুট ঠুকল। আরুশ গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ানের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে ভিতরে চলে আসলো। শিহাব অনেক কষ্ট করে এ্যাপোইনমেন্ট জোগাড় করেছে। ” 𝓜𝒐𝒋𝒖𝒎𝒅𝒂𝒓 𝓔𝒍𝒊𝒕𝒆 𝓤𝒎𝒑𝒊𝒓𝒆” বর্তমান মালিক আদ্রিত। বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে সেখানে ওদের কম্পানির এক ব্রাঞ্চে আদ্রিত ইন্টার্ন হিসেবে চাকরি করেছে তারপর দেশে ফিরে কম্পানির সম্পূর্ণ হাল ও ধরেছে।

অফিসটা ভীষণ সুন্দর করে ডেকোরেট করা। আরুশ পা দিতেই তার চোখ কেড়েছে প্রত্যেকটা কোণা। আরুশ রিসেপশনে যেয়ে দাড়াতেই একজন মধ্য বয়স্ক ছেলে আরুশ অভিবাদন জানিয়ে বলল,

__”হাউ মেই হেল্প ইউ স্যার?”

__”মিস্টার মজুমদারের সঙ্গে আমার এ্যাপোইনমেন্ট আছে এখনের! উনার সাথেই দেখা করবো!”

__”ওয়ান মিনিট স্যার!”

রিসেপশনে থাকা ছেলেটা হেসে অপেক্ষা করতে বলল। আরুশ দাঁড়িয়ে আশেপাশে লক্ষ্য করতে লাগলো।

__”ইয়েস স্যার! ইউ হ্যাভ অ্যান এ্যাপোইনমেন্ট!”

বলে ল্যান্ড ফোন তুলে কাকে কল করে বলল,

__”তাড়াতাড়ি রিসেপশনে আসো! স্যারের সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। উনাকে নেয়ে যাও!”

বলে ল্যান্ড ফোন রেখে দিয়ে আরুশের দিকে তাকালো। আরুশ সব শুনেছে তাই রিসেপশনিস্ট আর পুনরাবৃত্তি করল। কিছুক্ষণ পর একজন পিয়ন গোচের লোক আরুশকে নিয়ে তিনতলায় চলে গেল সেখান থেকে আদ্রিতের কেবিন দেখিয়ে পিয়ন টি চলে আসলো। আরুশ কেবিনের দরজার নক করল।

নক পরতে ভিতর থেকে একটা আদেশ আসলো,

__”কাম ইন!”

আরুশ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। আদ্রিত ল্যাপটপে কি দেখছিলো। আরুশকে ভিতরে আসতে দেখে তার মুখে চওড়া হাসি ফুটল।

__”আসো! আসো!”

বলে সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলো বসার জন্য। আরুশ সেখানে বসলো। আদ্রিত আর আরুশ হাত মিলিয়ে আদ্রিত বলল,

__”কি খবর? কাজ কেমন চলছে শুনি?”

আরুশ মুচকি হেসে বলল,

__”এখন পর্যন্ত তো সব ঠিকই আছে! কাজও ভালো যাচ্ছে!”

__”যাক! তা বলো কি বলবা! দাঁড়াও! তার আগে বলো কি খাবে?”

__”কিছু খাবো না ভাইয়া! আপনার কাছে পার্সোনাল বিষয়ে কথা বলতে এসেছি!”

আদ্র খানিকটা অবাক হলো। আরুশ পার্সোনাল কথা বলতে এসেছে নির্ঘাত কোনো গুরুতর বিষয়। আদ্র আরুশের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল,

__”কি কথা?”

আরুশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভারি কন্ঠে বলল,

__”আমি তোমার শালিকাকে পছন্দ করি! বিয়ে করতে চাই!”

__”কি বললে?”

আদ্র খেয়াল করতে পারেনি এমন ভান করে আবার জিজ্ঞেস করল। আরুশ বলল,

__”আমি সত্যি বলছি!”

আদ্র যেন কোনো ঘোরে চলে গিয়েছে এমন ভাবে আরুশের দিকে তাকিয়ে আছে। আরুশ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আদ্রর সামনে তুড়ি মেরে বলল,

__”আর ইউ ওকে?”

__” দ্যূতিকে পছন্দ করো এইটা কি দ্যূতি জানে?”

__”না!” নিরশ কন্ঠে বলল আরুশ।

__”তুমি জানো পিউকে পটাতে আমার কতো বছর লেগেছে? ওকে পটিয়ে ওর পরিবারকে পটাতে কতো বছর লেগেছে?”

আরুশ মাথা নাড়িয়ে না জানালো। আদ্র হেসে বলল,

__”পাক্কা ছয় বছর! চার বছর তোমার আপুর জন্য আর বাকি দুই বছর তার পরিবারের জন্য! দ্যূতিও সেম ওর বোনের মতো! আর তুমি পিউকে চেনো না!”

__”এর মধ্যে আবার আপু কোথা আসলো?”

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আরুশ। আদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরুশ কাছে এসে দাঁড়ালো। ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

__”পিউ সবসময় আছে, ছিল এবং থাকবে! দ্যূতি পিউয়ের কথা মতোই সব কাজ করে! এমন কোনো কাজ নেই যেখানে ও পিউয়ের কাছে জিজ্ঞেস করে না! তোমাদের ওখানে চাকরি করে সেটাও পিউই করতে বলেছে !”

আরুশের মুখে একদম হাসি ফুটে উঠল।

__”তাহলে তো ভালো। আপুকে বলেই হয়ে যাবে!”

আদ্র আরুশের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।

__”ভাই তুমি পিউকে চেনো না! তোমার কাছে তো ওর পজিটিভ সাইড ব্যাখ্যা করেছি সবসময় তাই এইটা মনে হয়! পিউ সহজে কোনো কিছুতেই ইম্প্রেস হয়না তাই আমি বলছি তুমি আগে দ্যূতিকে বলো। ও যদি রাজি থাকে তাহলে পিউও রাজি আপনাআপনি হয়ে যাবে!”

আরুশ কোনো উত্তর দিলো না। সত্যিই এখন তার দ্যূতিকেই জানাতে হবে।

__”একটা কাজ করো! দ্যূতিকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাও । এবং সুযোগ দেখে মনের কথা বলে দিয়েও!”

আরুশ উঠে দাঁড়ালো। চিন্তা গ্রস্থ হয়ে বলল,

__”সমুদ্র…..?”

চলবে…….