#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪
আলো আমার, আলো ওগো
আলো ভূবন ভরা।
আলো নয়ন ধোঁয়া আমার, আলো হৃদয় হরা।
নাচে আলো নাচে ও-ভাই আমার প্রাণের মাঝে,
বাজে আলো বাজে ও-ভাই হৃদয়বীনার মাঝে।
গানের সুর ধরতে ধরতে রুটির জন্য ময়দা মাখার চেষ্টা করছি। পানির পরিমাণ অতিরিক্ত দিয়ে ফেলেছি। এতগুলো রুটি বানালে খাবে কে? সেটাই ভাবছি। মৃদু তাপে তাভা বসিয়েছি চুলায়। অন্য চুলায় সবজি ভাজি। মামুনি এলেন। আমি আটা নিয়ে বসে থাকতে দেখে বললেন, “পানি যখন বেশি দিয়েছিস। একটা কাজ কর, ডিম আর সাধারণ কিছু সবজি কুঁচি করে আটার ভেতরে দিয়ে দে। তারপরে গোলা রুটি বানিয়ে ফেল। অপুর পছন্দ।”
উপায় নেই, বাধ্য হয়ে গোলা রুটির ব্যবস্থা করলাম। মামুনি চলে গেছেন। গোলা রুটির আটা রেখে ভাজিতে নাড়া দিলাম। যদি ভালো না-হয়, একটু টেস্ট করে দেখা যাক। একটু বাটিতে তুলে নিলাম। ঠান্ডা করে মুখে দিলাম। ঝালে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বেসিন থেকে কুলি করলাম। কখনো চুলার কাছে আসিনি, এবার বুঝে নে আরু। আচ্ছা আমরা ঝাল লাগলে চিনি খাই, যদি চিনি তরকারিতে দিয়ে দেই। তাহলে কেমন হবে? নিশ্চয়ই ভালো। সেই উপায় অবলম্বন করলাম। টেস্ট করে দেখলাম, কোনোরকম খাওয়া যাবে।
গোলা রুটি বানাতে লাগলাম। একপাশের মোটা তো একপাশে চিকন হচ্ছে। গোল হচ্ছেনা। চিকন দিক পুড়ে গেছে, মোটা দিক কাঁচা।
প্লেটে সাজিয়ে ঘরে নিয়ে গেলাম। অপূর্ব ভাই সেভ করছে। যাওয়ার সময় ঘুমে দেখেছিলাম। দেয়াল ঘড়িতে আটটা ছাড়িয়ে। আমি খাবার টেবিলের উপর রেখে পর্দাগুলো সরিয়ে দিলাম। অপূর্ব ভাই আড়চোখে তাকিয়ে নিজের কাছে মনোযোগী হলেন। দাঁড়িগুলোতে তাকে মাত্রারিক্ত সুন্দর লাগে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনাকে দাঁড়িতে ভালো লাগে। সেভ করলে ফাঁকা ধান ক্ষেতে অবশিষ্ট খরকুটোর মত লাগবে।”
অপূর্ব ভাই সেভ করা বাদ দিয়ে বললেন, “তাহলে বলছিস সেভ করব না?”
“আপনার ইচ্ছা, আপনার দাঁড়ি।”
তিনি থেমে গেলেন। ওয়াশরুমে দিকে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে বেরুলেন। টেবিলের উপর থেকে খাবার নিয়ে খেতে বসলেন। আমি অন্যদিকে ফিরে রইলাম। আজকে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়লাম। অপূর্ব ভাই রুটি দেখিয়ে বললেন, “এটা কোন দেশের মানচিত্র আরু? সাইন্সের স্টুডেন্ট হয়ে জিওগ্ৰাফিতে এত এক্সপার্ট কেমনে হলি।”
রুটির এপিঠ ওপিঠ দেখিয়ে পুনরায় বললেন, “তা ঐ দেশে বুঝি কয়লার খনি বেশি? কয়লার কারণে কালো হয়ে গেছে।”
কিছু উচ্চারণ করলাম না। কালরাতে চুলে বেণুনি করে ঘুমিয়েছিলাম। বেণুনি খুলতে ব্যস্ত হলাম। তিনি জবাব না পেয়ে বললেন, “দেখেই মনে হচ্ছে, খাওয়া যাবেনা। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নিবো। নতুন চাকরি। চাকরিটা চলে গেলে কিছু করার থাকবেনা।”
অনুরোধের সুরে বললাম, “প্রথমবার বানিয়েছি, একটু খেয়ে দেখুন।”
“প্রথমবার করেছিস, এরজন্যই সাহসে কুলাচ্ছে না। ঠিক আছে, একবার খেয়ে দেখছি।”
আমি মনে মনে অঢেল খুশি হলাম। অপূর্ব ভাই খাওয়াতে ব্যস্ত হলেন। রুচি ছিঁড়ে টুকরো করে স্বল্প ভাজি মিশিয়ে মুখে দিলেন। আমি চেয়ে রইলাম তার কথার অপেক্ষায়। চিবিয়ে বললেন, “ভালো।”
তার এই ভালো বলা আমাকে উৎসাহিত করতে, তা বুঝতে বোধগম্য হল। তার মুখের ভঙ্গিমা দেখেই বুঝা গেল স্বাদ। পানি খেয়ে বললেন, “ভাজি কেমন যেন ঝাল মিষ্টি। কেমন জানি স্বাদ। এমন কেন?”
আমি বললাম, “ঝাল হয়েছিল। তাই দু চামচ চিনি দিয়েছি। তাই স্বাদ এমন।”
অপূর্ব ভাই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন। দু’হাতে মুখ চেপে ধরলেন। বমির ভঙ্গিমা করে ছুটে গেলেন ওয়াশরুমে। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এলেন। করুন স্বরে বললেন, “তরকারিতে ঝাল হলে চিনি দেয় কে শিখিয়েছে তোকে?”
“আমার ঝাল লাগলে মিষ্টি খেতাম। মিষ্টি নেই তাই ‘মিষ্টিজাতীয়’ চিনি দিয়েছি।”
অপূর্ব ভাই ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “তোর মাথার তার ছিঁড়ে গেছে আরু, আমি ভাবতেই পারিনি তোর সাথে বাকি দিনগুলো কীভাবে পার করব?
তরকারিতে ঝাল, লবণ বেশি হয়ে গেলে আটা দলা করে দিতে হয়, পেঁয়াজ কুচি করে দেওয়ার যেতে পারে, আলু সেদ্ধ করে দেওয়ার যায়।
চিনি দেওয়া যায়, তোর থেকে জানতে পারলাম।”
আটার দলা, পেঁয়াজ কুচি, আলু সেদ্ধ দেওয়া যায়। এগুলো কী রান্না করার সময় দিবো না-কি রান্নার শেষে? আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই, এগুলো কি রান্নার সময় দিবো।”
অপূর্ব ভাই বিরক্তকর চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে তুলে নিয়ে নাও। রান্নার যখন শুরু করবি, তখন কি তুই জানবি লবণ বা ঝাল বেশি হবে?”
“তাহলে কখন দিবো।”
“যখন তুই দেখবি, ঝাল বেশি হয়েছে।”
“সবগুলো একসাথে দিব, না-কি আলাদা-আলাদা?”
অসহায় কণ্ঠে বললেন, “একসাথে-ও নয়, আলাদা-ও নয়। যেকোনো একটা দিবি। হয় পেঁয়াজ কুচি, নয় আটার দলা, নয় আলু সিদ্ধ। তবে আটার দলা দিলে কিছুক্ষণ পর তুলে নিতে হবে।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আজ থেকে এই উপায় অবলম্বন করব।
_
বিদ্যালয়ের দরজা অতিক্রম করার পূর্বেই ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। বিয়ের পর আজ প্রথম বিদ্যালয়ে এসেছি। তা-ও অপূর্ব ভাইয়ের ধমকাধমকিতে। আমি দ্রুত পা চালালাম। তুর আমার চেয়ে অনেকটা সামনে। অনেকদিন অনুপস্থিত থাকার পর আজ প্রথম বিদ্যালয়ে পা রেখেছি। জড়তা কাজ করছে। আমায় পড়নে টপস্ আর প্ল্যাজু। হিজাব বিহীন ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা। আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠলাম। স্যার-কে ইতোমধ্যে ক্লাসে ঢুকতে দেখলাম। তুর এখনও ক্লাস অবধি পৌঁছায় নি, তবে কাছাকাছি। আমি চঞ্চল পায়ে কাছাকাছি পৌঁছাতেই কোনো মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়লাম। কিন্তু কোনো মানুষ নজরে আসছে না। তাহলে কি আমার দৃষ্টিভ্রম ছিল। হাতের কনুইয়ের দিকটা ছিলে গেছে বোধহয়। ডান হাঁটুতেও একটু লেগেছে। ঘাড় কাত করে করে পাশের ফাঁকা ক্লাসে তাকাতেই তন্বি-কে নজরবন্দি হল। অগ্নি তার দৃষ্টি। আমাকে পলকে ছাইতে রুপান্তরিত করতে সক্ষম। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “এই স্কুলে তুই শান্তিতে কীভাবে থাকিস, আমিও দেখতে চাই।”
বলেই আড়াল হয়ে গেল। তুর ছুটে এলো। আমাকে টেনে তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। পোশাক ঝাড়া দিয়ে বলে, “ব্যথা পেয়েছিস?”
মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে জবাব দিলাম, “না।”
পুনরায় প্রশ্ন করল, “তাহলে পড়লি কীভাবে, কিছু তো দেখছি না। শুকনা জায়গা।”
তন্বি নেই আশেপাশে। আমারও মন ভালো নেই। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললাম, “স্যার ক্লাসে গেছেন। দেরি হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চল।”
“হম, চল।”
বলেই পা চালালাম। ক্লাসে স্যার রোল কল করছিল। ‘আট’ বলতেই বাইরে থেকে ‘ইয়েস স্যার’ বললাম। ক্লাসের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হল। অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেল। হাসার চেষ্টা করলাম। গম্ভীর গলায় বললেন, “এতদিন আসো নি কেন? আজকে এসেছ, ড্রেস নেই আবার লেট। ড্রেস কোথায়? আমার ক্লাসে স্কুল ড্রেস ছাড়া আসতে বারণ করা আছে।”
ড্রেস তো আছেই, সক্ষয়। কিন্তু আমার ড্রেস আমারই পড়ার অনুমতি নেই। মাথা নিচু করে রইলাম। স্যার তুর-কে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন। আমাকে দাঁড়াতে বললেন। বেতের চার ঘা দিলেন কষে, অতঃপর অনুমতি দিলেন। আমি একদম পেছনে বেঞ্চিতে বসলাম। ইতোমধ্যে তুর সেই বেঞ্চিতেই বসেছে। অশ্রু মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার বোর্ডে ত্রিকোণমিতি অঙ্ক করছেন। সবাইকে খাতায় তুলতে বললেন। আমি খাতা বের করে তুলতে লাগলাম। কলম ধরতে পারছি না। রক্তিম হয়ে গেছে। কনুইতে জ্ব’লছে, যার ফলে একটুও সম্ভব হচ্ছে না। আধ পৃষ্ঠা লিখে রেখে দিলাম। আমি ধীরে ধীরে হাতা সরিয়ে নিলাম। ছিলে গেছে, রক্ত দেখা যাচ্ছে। আরু হাঁ হুতাশ করে বলে, “ইশ্! দেখে হাঁটবি না, কতটা ছুলে গেছে।”
পানি বের করল ব্যাগ থেকে। হাতের কনুই স্পর্শ করতেই জ্বলে উঠল। চাপা গলায় আর্তনাদ করলাম। স্যারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি থমথমে গলায় ধমক দিলেন, “পেছনের দুজন দাঁড়াও।”
আমরা দু’জন একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে উঠে দাঁড়ালাম। তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, “এমনিতেই দেরি করে এসেছ, বোর্ডে লেখা দিচ্ছি। না লিখে কথা বলছ। বেরিয়ে যাও ক্লাস থেকে।”
আমি নতজানু হয়ে বললাম, “স্যরি স্যার। আর কথা বলব না। এবারের মতো মাফ করে দিন।”
“যদি আর নাইবা বলো, তাহলে এতক্ষণ কথা বলছিলে কেন?”
তুর ফট করে বলে, “স্যার, তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে আরু হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। ছিলে গেছে অনেকটা। সেটাই দেখছিলাম।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]