জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-১৮

0
541

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৮

রান্না পারিস না, পড়াশোনা পারিস না, নিজের চরিত্র সামলাতে পারিস না, স্বামীকে সামলাতে পারিস না, বাচ্চাও সামলাতে পারবি না। তাহলে কেন আমাকে ফাঁসালি?”

আমি মাথা তুলে অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি পূর্বের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। পুনরায় মাথা নিচু করে নিলাম। কী করব আমি? কিছু বুঝতে পারছিনা। সবাই আমার সাথে এমন আচরণ কেন করছে, আদৌ আমি এইসবরের প্রাপ্য? আমিও গলা তুলে বললাম, “নিজেকে কী মনে করেন আপনি? ধোয়া তুলসী পাতা? আপনার যেমন নিজের উপর বিশ্বাস আছে, আপনি এমন কাজ করেনি। তেমনি আমিও এমন কাজ করিনি?”

“তাহলে আমি করে বাচ্চা তোর পেটে দিয়ে এসেছিলাম?”

“তাহলে আর কে করবে? আপনি একমাত্র পুরুষ, যার সাথে আমি মনে খুলে কথা বলেছি। একঘরে থেকেছি‌। এমন তো নয়, সেদিন রাতে এইসব করেছিলাম, এখন নিজের দোষ ঢাকতে আমার দিকে আঙুল তুলছেন।”

আমি বোধহয় একটু বেশিই বলেছি। দুঃসাহসিকতার কাজ করে ফেলেছি, তার শাস্তি আমাকে পেতেই হতো? পরক্ষণেই নিজের গালে দহনে পরিণত হল। পুড়ে উঠল জায়গাটা। আপনাআপনি হাত গিয়ে ঠেকল গালে। টলটলে চোখজোড়া বড্ড অশান্ত যে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। অগ্নিরুদ্ধ তার দৃষ্টি। গাল চেপে বললেন, “শোন, কান খুলে শুনে রাখ। আমার জীবনের তোর মতো মেয়ের জায়গা নেই। নিজের কুকর্ম ঢাকতে আমার নামে বলা শুরু করলি। আমি এটা কখনোই মেনে নিবো না। ভেবেছিলাম তোর সাথেই থাকব আজীবন। তোর সন্তান-কে অ্যা’ব-শন করিয়ে তোকে আপন করে নিবো। কিন্তু তুই তো মানতে নারাজ।
আমি ছুঁয়েছি বলে তোর শরীরে ফোস্কা পড়েছে তাই না, দাঁড়া।”
বলেই হাত ধরে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন নিচে। সরে আসতে নিলে জোরপূর্বক ধরে রাখলেন। তার বলিষ্ঠ শরীরের কাছে আমি ক্ষুদ্র। ভিজে জবুথবু হয়ে গেলাম। ঠান্ডায় কুপোকাত, ঠকঠক করে কাঁপছি। ওড়না ঠিক করে দাঁড়ালাম। ভেজা অবস্থায় অস্বস্তি লাগছে। ছলছল চোখে বললাম, “প্লীজ ছেড়ে দিন।”

হাত ছেড়ে দিলেন। চলে গেলেন ঘরে। আমি ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। জামা কাপড় নেই এখানে। কীভাবে চেঞ্জ করব? বাইরে বের হতে ভয় লাগছে। আমি উঁকি দিলাম ঘরে। অপূর্ব ভাই নেই। বারান্দা থেকে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। বোঝা গেল সিগারেট ধরিয়েছেন তিনি। আলতো মাথা নাড়িয়ে নিলাম। কাবার্ড হাতরে টপস্ প্ল্যাজু নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে গেলাম। জামা কাপড় পাল্টে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ঝড়োহাওয়া বইছে। খোলা জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। বৃষ্টি আসার লক্ষণ। আমার শীত যেন এবার আকাশ স্পর্শ করল। দ্রুত এগিয়ে জানালার কাঁচ তুলে দিলাম। কম্বল সরিয়ে বসে থাকলাম। অতিবাহিত হল কিছু অপ্রিয় মুহূর্ত। কাশি শব্দ শোনা গেল। বাইরের আবহাওয়া অনুযায়ী ঠান্ডা লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অপূর্ব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই, তবুও বারান্দার দরজার কাছে গেলাম। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাইরের দিকে মুখ তার। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “ভেতরে আসবে না? বৃষ্টি আসবে যে।”

তিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। বন্ধ চোখজোড়া। এতক্ষণ পর তার মস্তিষ্ক সচল হল। দ্রুত চোখ মেলে তাকাল। তার দৃষ্টিতে বিস্মিত ভাব বিদ্যামান। আমাকে প্রত্যাশা করেননি বোধহয়। ঠুলতে ঠুলতে পাশ ঘেঁষে ঘরে চলে গেলেন। আমি এগিয়ে গেলাম। বারান্দার রেলিংয়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি যেখানে দাঁড়ানো ছিল ঠিক সেখানে। খ্যাচ খ্যাচ শব্দ পেলাম। আমি পুরোপুরি অবজ্ঞা করে দাঁড়িয়ে থাকলাম ঝড়োহাওয়াতে। ভেজা চুল হতে বিরতিহীনভাবে জলকণা পতিত হচ্ছে। ভিজে গেছে জামার পেছনের দিকটা। হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করল। বারান্দার রেলিংয়ের উপর পড়ে ছিটকে আসছে ভেতরে। কম্বলের উপরেও ঠান্ডা লাগছে। বেশ কিছুটা ভিজে গেছে। ঘরে ঢুকার জন্য পা বাড়ালাম। দরজা বন্ধ। অপূর্ব ভাই দরজার ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়েছেন। তখন ‘খ্যাচ খ্যাচ’ শব্দ দরজা বন্ধ করার জন্য হয়েছিল। তখন পাত্তা না দিয়ে বড্ড ভুল করেছি। ধাক্কা দিলাম বেশ কয়েকবার। প্রতিক্রিয়া নেই। এদিকে বৃষ্টির ধাঁচ বেড়ে চলেছে। ভিজে গেছি। তখন জানালার পর্দা টেনে দেওয়ার ফলে ভেতরের কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কী করব, ভেবে পেলাম না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। দেয়াল ঘেঁষে বসলাম। এত শীত কেন লাগছে? কাল রাত ছাদে পার করে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, সর্দি কাশি লেগেছে। এখন আরেক ঝামেলা। বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে গেলাম। কম্বলটা আঁকড়ে ধরে রাখলাম। ঠকঠক করে কাঁপছি। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ক্লান্তিরা ঘিরে ধরেছে। দেয়ালে মাথা রেখে জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন বিছানায় আবিষ্কার করলাম। ডাক্তার পাশেই বসে আছেন। কালকে রাতে কথা মনে হানা দিতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। এঁরা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। উঠে বসার চেষ্টা করলাম। ডাক্তার কেন এনেছে? কালকে রাতে শা’স্তি দিয়ে মন ভরেনি বুঝি? ডাক্তার এনে দেখাচ্ছে আমার যত্ন নিতে পারে। আমি কখনও আপনার এই ব্যবহার ভুলব না অপূর্ব ভাই। কখনো নয়। ডাক্তার আমাকে দেখে হাসল একটু। বিচলিত হয়ে বলে, “এই মেয়ে উঠছ কেন? শুয়ে থাকো। তুমি যথেষ্ট দূর্বল।”

‘শুয়ে থাকলেই কি দূর্বলতার সমাপ্তি ঘটবে ডাক্তার সাহেব? চারপাশে পরিবেশ আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছে দিন-দিন। আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি না।’ কথাগুলো আনমনে প্রকাশ করলাম। মুখে বললাম, “আমি ঠিক আছি।”

ডাক্তার সাহেব হেসে বললেন, “এখনকার তুমি আর আগের তুমির ভেতরে আকাশ-পাতাল তফাৎ। বুঝেছ? ঠিক আছে বললেই কি ঠিক হওয়ার যায়।
দেখো তো অপূর্ব কোথায় গেল? সেই ভোর ছয়টায় বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এখন দশটা সতেরো। এইভাবেই বসে আছি। তোমার জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত আমাকে যেতে দিবে না।”

‘ঢং’ বিরবির করে উচ্চারণ করলাম। আ’ঘাত করার সময় মনে থাকে না, উগ্র ব্যবহার করার সময় মনে থাকে না। লোক দেখাতে ডাক্তার এনে বসিয়ে রেখেছে। ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। আমি বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম। খাঁ খাঁ রোদ্দুর। ঝাঁজালো তার তাপ। এত বেলা অবধি অচেতন হয়ে পড়ে ছিলাম। গায়ের ভেজা জামাকাপড় পাল্টে দিয়েছে কেউ। অন্য একটা টপস্ পড়নে। কে পাল্টেছে? তৎক্ষণাৎ তুর হুরমুড়িয়ে প্রবেশ করল। তুরের দৃষ্টি আমার চোখে লাগল। তার ভাইয়ের করা অবহেলাগুলো ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে বোন-কে। কিন্তু এটা অন্যায়। তুর পাশে বসে বলে, “আমার ভাইটা এই মিষ্টি ভাবীটার প্রেমে পড়েছে দেখতে পারছি।”

তাচ্ছিল্য করে বললাম, “হ্যাঁ, প্রেমে পড়ার নমুনা আমার অসুস্থতা।”

“ধ্যাত, তিনটার দিকে তোর জ্বর এসেছিল। প্রচণ্ড জ্বর। ভাইয়া মাথায় জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামিয়েছে। ভোরে ডাক্তার নিয়ে এসেছে। এতক্ষণ পরেও যখন তোর জ্ঞান ফিরল না, একটু আগে বের হল ওষুধ কিনতে।”

সেই সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেল। অপূর্ব ভাইয়ের দেখা নেই। ওষুধ কিনতে গিয়ে নিজেই না ওষুধ হয়ে গেছে। বিকেলের দিকে জ্বর একটু বাড়ল। বমি হল দু’বার। ওয়াশরুমে চোখ পড়তেই গতকালের ভিজিয়ে রাখা জামা কাপড়গুলো দেখতে পেলাম। ধোঁয়া হয়নি। আমি দ্রুত জামা কাপড় কেচে ধুয়ে বের হলাম। ছাদে যাওয়ার সাধ্য নেই। বারান্দায় মেলে দিলাম। অপূর্ব ভাই তখন বাড়ি ফিরলেন। গতকাল রাতে রান্না করা খিচুড়ি আর চিংড়ির মাছের ভুনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ পড়তেই চোখাচোখি হল। দৃষ্টি লুকিয়ে ফেললাম। তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পূর্বেই মাথা ঘুরে উঠল। দেয়াল ধরে ভারসাম্য বজায় রাখার পূর্বেই লুটিয়ে পড়লাম বিছানায়। অপূর্ব ভাই ধরলেন। তড়িগড়ি করে বিছানায় সোজা করে শুয়ে দিলেন। গ্লাস এগিয়ে দিলেন। নিজ হাতে পানি খাওয়ালেন।
গত রাতের ঘটনা মনে হানা দিতেই সরে এলাম। বালিশে মাথা রেখে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লাম। কোনো কথা নেই। একটু আগে মনে পড়লে পানি খেতাম না। তিনি খাবারের থালা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে, খেয়ে নে। সারাদিন কিছু খাসনি কেন? জ্বরের সময় না খেয়ে থাকতে নেই।”

বালিশ মুঠোবন্দী করে বললাম, “ক্ষুধা নেই।”

“জ্বর বাড়বে আরু, খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিস। তোর প্রেগন্যান্সি চলছে, সব ধরনের ওষুধ তোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এতে বাচ্চা ও মা দুজনেই ক্ষতি। তাই দেরি হয়েছে।
ডাক্তার বলেছে, তোর কিছু টেস্ট করতে। আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি মাস্ট, বাচ্চার পজিশন জানতে। ভাবছি করাবো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাতে টাকা নেই। কি-যে করি।”

সারাদিনের অভিমানের মাঝে বাচ্চার কথাটা ভুলে গেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। আমাকে খেতে হবে। বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। অপূর্ব ভাই জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন। এখন কি আবার চলে যাবেন কাজে?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]