#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২০
এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলেন। ‘পুষ্পা’ ভঙ্গিতে গলার নিচে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে অপূর্ব ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলাম। পরক্ষণেই দ্রুতবেগে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন তিনি। একদম নিজের ঘরে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। নতজানু হয়ে বসে রইলাম। দরজার ছিটকিনি তুলে দিলেন। পড়নের শার্ট খুলে ফেললেন। টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন। এবার মুখশ্রী আড়াল করে লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলাম। ‘অপূর্ব ভাই আমাকে কোলে নিয়েছেন’ – আমি তো হার্ট অ্যাটাক করব। কিছুসময় পর বেরিয়ে এলেন তিনি। পড়নে টাওয়াল ছাড়া কিছু নেই। একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি বাড়ছে। প্রথমবার তাকে এবারে দেখছি। তিনি ট্রাউজার আর টি শার্ট পড়লেন। মোগলাই পরোটা নিয়ে এসেছেন। কাগজে মোড়ানো প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে। খেয়ে নে আরু।”
অস্বাভাবিক ভাবে চমকে গেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “আপনি আমার কথা শুনবেন না?”
ক্রিম ব্যবহার করতে করতে বললেন, “আপাতত শুনতে চাই না। যেদিন সবকিছু থেকে মুক্তি পাবো, সেদিন শুনব।”
মাথায় বাজ পড়ল। ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে গেলাম অপূর্ব ভাইয়ের কাছে। নিজের দিকে ঘুরিয়ে আয়নার সাথে চেপে ধরলাম। মাত্রাতিরিক্ত রেগে গেছি। কলার টেনে বললাম, “সমস্যা কী তোর? বিয়ে করে বাঁচিয়েছিস বলে নিজেকে মহান মনে করছিস। আমি তোর পা ধরেছিলাম, ‘আমার বিয়ে করুন, আমাকে বিয়ে করুন’ বলে? তাহলে বিয়ে করেছিলি কেন? আমার মতো কচি মেয়ে দেখে নিজেকে সামলাতে পারিসনি।”
হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “বুঝেছি জ্বর বেড়েছে। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছিস। মোগলাই পরোটা খেয়ে, ওষুধ খেয়ে ঘুমা। কালকে আমাদের যেতে হবে।”
অপূর্ব ভাই আমাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন। খেতে বসলেন। খেতে খেতে বললেন, “ব্যাপারটা খুলে বল। কী হয়েছিল?”
তার হাত থেকে পরোটা নিয়ে মুখে পুড়ে দিলাম। চিবুতে চিবুতে বললাম, “কী আর হবে? আপনার বোকা বোন। আমার চেয়ে বড় বোকা বোন আপনার। আমাকে এসে বলে, ‘প্রেগন্যান্ট হলাম কীভাবে?’ কী বলব? আমি বলেছি ‘একটা ছেলে একটা মেয়েকে হামি দিলে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়।’ ব্যাস অমনি ধরে নিল পিয়াসের বাচ্চা। মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম, “যেমনি তার ভাই তেমনি বোন।”
আরও কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। দুহাত মুখে গিয়ে ঠেকল। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। আধ খাওয়া পরোটা বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে ছুটে গেলাম। বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। ইদানীং পূর্বের তুলনায় ঘনঘন বমি হচ্ছে। জ্বরে অবস্থায় আরও কাহিল করেছে।
__
সময় তখন বিকেল তিনটা। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি আমি ও অপূর্ব ভাই। বারোটার দিকে এসেছি। ভিড় থাকার কারণে দেরি হচ্ছে। এসিস্ট্যান্ট ডাক পাঠালো আমাদের। অপূর্ব ভাই ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। এক চেয়ার টেনে আমাকে বসিয়ে অন্য চেয়ার টেনে নিজের বসলেন। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। আমি মাথার ওড়না টেনে ঘোমটা ঠিক করলাম। কোনো রিপোর্ট নেই। ডাক্তার সাহেব নিজেই প্রথম মুখ খুলেন, “তা অপূর্ব, আমি তোমাকে কিছু টেস্ট লিখে দিবো। সেগুলো করার পর রিপোর্ট দেখে অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাবো।” অতঃপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ইদানীং তোমাকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় মায়ের গঠন ভালো হয়। তোমার উল্টো হচ্ছে। দেখে মনে হয় রক্তশূন্যতায় ভুগছ। প্রেগন্যান্সি টেস্ট করেছিলে?”
নত গলায় বললাম, “হ্যাঁ। কিট দিয়ে করেছিলাম। লাল দাগ দেখেছিলাম। মা বলেছে, পজেটিভ।”
স্বাভাবিক গলায় বললেন, “একদাগ না-কি দু’দাগ?”
“খেয়াল করা হয়নি। মনে নেই ঠিক।”
ডাক্তার সাহেব কিছু ভেবে তার এসিস্ট্যান্ট ডেকে বললেন, আয়া-কে ডাকতে। তারপরে আমাকে বলেন, একটু পর আবার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করবে। এবার আমি যা যা বলব, তার উত্তর দাও। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে তোমার কেমন লাগে। সব বলো।”
চেয়ারে হেলান দিলাম। মাথা ঘুরছে এখনও। থেমে থেমে বললাম, “মাথা ঝিম দিয়ে থাকে, বমি-বমি ভাব হয়, বমিও হয়। পেট কেমন ফুলে থাকে, ক্ষুধা লাগে না।”
ডাক্তার সাহেব পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “পিরিয়ড চলছে?”
ওড়না আঁকড়ে ধরলাম। মাথা নিচু করে নিলাম। এর উত্তর কীভাবে দিবো। লজ্জা, অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। অপূর্ব ভাই তার হাতটা আমার হাতের উপর রেখে বললেন, বল।
সায় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, “না, দু-তিন মাস ধরে অফ।”
আয়া অনুমতি নিয়ে আসলেন। ডাক্তারের কথামতো প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে গেলাম। এক এক করে দুইবার দু’টো কিট দিয়ে টেস্ট করলাম। লাল দাগ। একটা দাগ ফলাফল পজেটিভ। সেখান থেকে ফিরে আসতে পারলাম না। আরেক দফা বমি করে দিলাম। শরীরটা ভেঙে পড়ল। ডাক্তার কিছু বললেন না, আলট্রাসাউন্ড আর ব্লাড টেস্ট দিল। এক্স-রে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাচ্চার চিন্তা করে দিলেন না। টেস্ট করে বাড়িতে ফিরলাম। আগামীকাল পাঁচটায় রিপোর্ট দিবে।
পার্কে এসে বসেছি। অপূর্ব ভাইয়ের কাছে বাচ্চাসুলভ আবদার রেখেছি। তিনি একবার নাকোচ করলেও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। ছোটো ছোটো বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে অদূরে। আমি খেলতে চাইছি। অপূর্ব ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বললাম, “জানেন অপূর্ব ভাই, এর আগে কখনো নিজেকে এতটা দূর্বল লাগেনি। অসুস্থ থাকলেও পুরো এলাকা চষে বেড়িয়েছি। কিন্তু এবার আর জোর পাইনা। বাচ্চা পেটে থাকলে মানুষ চাঙ্গা হয়ে যায় আর আমি দূর্বল হয়ে যাই। আপনার সেই কথাটা সত্যি না হয়ে যায়।”
অপূর্ব ভাই চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “কোন কথা?”
“অপরিপক্ক বয়সে সন্তান ধারণ মৃত্যুর কারণ। আমার জীবন হয়তো ফুড়িয়ে এসেছে। এমনও হতে পারে সাত মাসের আগেই আপনার মুক্তি।”
নিজের সাথে গভীরভাবে আবদ্ধ করে নিয়ে বললেন, “বেঁচে থাকা আর গড়া খুব কঠিন। কিন্তু ভেঙে ফেলা আর মৃত্যু অনেক সহজ।
আর আমাকে মুক্তি দেওয়ার সাধ্য নেই তোর।”
বাড়িতে ফিরে ঘুম দিলাম। অপূর্ব ভাই কাজে গেলেন। দিন-দিন শরীরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এইটুকু শরীরে কত সমস্যা। ঘুম ভাঙল আটটার দিকে। ভাঙেনি বাধ্য হয়েছে একপ্রকার। ঘুমের মাঝে তীব্র বমি পেল। ওয়াশরুমে যাওয়ার ক্ষমতা হল না। মেঝেতেই ভরে ফেললাম। রক্ত বমি হল। বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকলাম। জ্বরের ওষুধ খাওয়া হয়নি। ডাক্তার বারণ করেছে। গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে বলেছে। আমি ঘর পরিষ্কার করে নিলাম দ্রুত। ক্লান্ত লাগছে শরীর। শাওয়ার নিয়ে বের হলাম। জামা কাপড় ভিজিয়ে রাখলাম বালতিতে। দেয়াল ধরে ধরে রান্নাঘরে গেলাম। পানি গরম করে মগে ঢেলে নিলাম। লেবুর রস মিশিয়ে ছাদে গেলাম। তুর ছাদে ছিল। আমাকে দেখামাত্র এগিয়ে এল। টুপ করে বাম চোখ থেকে পানি ঝরল। বাম চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরা না-কি বিষাদের কারণ। তুরের পাশে দোলনায় বসলাম। তুর ফোনে কথা বলছিল। আমাকে দেখে অন্যপাশে গেল। লেবুর পানি শেষ করলাম। তুর-কে বললাম, “মাথার চুলগুলো একটু বেনুণী করে দিবি?”
“তোর চুল ভেজা। শুকিয়ে নিক।”
“সমস্যা নেই, তুই করে দে। শুকিয়ে গেলে মনে হয় খরায় ধরেছে। ভিজা থাকলে মাথা ঠান্ডা থাকে।”
তুর প্রত্যুত্তর না করেই রাজি হল অবিলম্বে। আমার পিছু পিছু ঘরে গেল। মাথার দুপাশে বেনুণী করে দিল। আমি রান্নাঘরে গেলাম। আজ বিভিন্ন রকমের ভর্তা করব। ভাবলেই জিভ থেকে জল গড়াচ্ছে। আলু, ডিম, কাচা মরিচ, বেগুন সিদ্ধ দিলাম। বেগুন পু’ড়ে ভর্তা আমার পছন্দ নয়। কেমন পোড়া পোড়া লাগে। গরমে হাঁপিয়ে গেছি। তুর তখনও ঘরে বসে আছে। আমি ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে বললাম,
“আমাকে একটা আইসক্রিম খাওয়াতে পারবি। গরম শরীরে আইসক্রিম খেতে পারলে ভালো লাগত।”
তুর নাকোচ করে বলে, “তোর শরীরে এমনিতেই অনেক জ্বর। আইসক্রিম খেলে আরও বাড়বে।”
নোটটা ব্যাগে রেখে দিলাম। মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। একটা ডিমের পোঁচ করলাম। পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলাম। তোমরা কিন্তু খাবে না। আরুর স্পেশাল খাবার। হি! হি! হি!
পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ঘরে ছুটে এলাম। বিছানায় শুয়ে কাতরাতে লাগলাম। উদ্ভব খাবারের ফলে এই সমস্যা হয়েছে। পেটে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, এ সেই ব্যথা নয়, প্রতিমাসেই এই ব্যথার সমুখীন হতে হতো পূর্বে। সব ঝামেলা একসাথে জুটেছে। কিন্তু এখন এটা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তুর ঘরে গিয়ে পড়তে বসেছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]