ঝরা পাতা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
339

(#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে)

#ঝরা_পাতা #দ্বিতীয়_পর্ব (শেষ পর্ব)

মা তার অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সব মেনে নেন। এর মধ্যে আমার জন্ম হয়। তিনি শুধু আমাকে জন্ম দিয়েছেন, ভালোবাসা আর হয় নি। জোর খাটিয়ে অনেককিছু করার পরেও নানা-নানী ভাবতেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মা স্বেচ্ছায় মন থেকে মেনে নিবে। কিন্তু, তা আর হয়ে ওঠে নি।

আমার জন্মের পর মায়ের বিতৃষ্ণা আরো বাড়তে লাগলো। বিশেষ করে এখন তিনি একজন মা, এটা কোনোভাবেও মেনে নিতে পারছিলেন না। তার মেজাজ এতটাই খিটমিটে হয়ে গিয়েছিল যে, নানা-নানী তাকে কিছু বলতে সাহস পান নি। তখনই মা আমাকে ত্যাগ করেন। বাবাকে ত্যাগ করেন। ছ’মাস বয়সী আমাকে তখন নানী নিজের কাছে নিয়ে নেন।

হাঁটা শিখা হয়েছিল বাবার হাত ধরে। তার কাছেই ছিল আমার শত আবদার। ভালোবাসা, যত্ন-স্নেহ বলতে আমি বাবাকেই বুঝি। দিনে ঘুরাঘুরি করার পরেও রাতে আমি বাবাকেই খুঁজতাম। কেন জানি মায়ের আশে-পাশে কখনো ভিড়তাম না। অবুঝ মনে হয়তো বুঝতাম, মা আমাকে দেখলে খুশী হবে না।

আমার যখন কিছুটা বুঝ হলো, তখন থেকেই দেখে আসছি বাবা-মায়ের মধ্যে অনেক দূরত্ব। দিনে দেখা হলেও একে-অপরের সাথে কোনো কথা বলতেন না। কোনোদিন হয়তো বাবা দু’একটা কুশল বিনিময় করতেন, কিন্তু মা একবারও না তাকিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে যেতেন।

একই বাড়িতে থাকার পরেও মা কখনো আমার প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। আর এই বিষয়টি নানী ভয়ে সবসময় নানার থেকে আড়াল রেখেছেন।

নানা মারা গেলেন আমার সাত বছর বয়সে। আমি তার যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি। তখন কষ্ট কি জিনিস তা বুঝি নি। মায়ের অভাব, উপেক্ষাও বুঝি নি। সারাক্ষণ নানা-নানী ও বাবার ছায়াতলে থাকতাম। নানার মৃত্যুর পর চিত্র পাল্টে গেলো। এখন মায়ের কথার উপরে কথা বলার সাহস কেউ পায় না। যাচ্ছেতাই দূর্ব্যবহার করেন। বিশেষ করে বাবার সাথে ইচ্ছাকৃত ঝগড়া তার বেড়ে গেলো। কোনো কারণ ছাড়াই বাবাকে অপমান করতেন। চোখের সামনে দেখলেই অপদস্ত করার চেষ্টা করতেন। বাবা সে জন্য এমনভাবে চলতেন, যেন ভুল করেও মায়ের সম্মুখে তাকে পড়তে না হয়।

এর একবছর পর নানীও মারা যান। বাবা তখন অন্য জায়গা খুঁজে নিলেন। এক ভোরে বাবা আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি থেকে বের হলে এলেন। আমি সেদিন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। আজকের পর মায়ের রাগী চেহারা আমাকে দেখতে হবে না। মা আমায় বাবাকে তুলে অপমান করতে পারবে না। আমার পড়াশোনা নিয়ে হাসি-বিদ্রুপ করতে পারবে না। আজ থেকে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন।

বাবা বরাবরই আমাকে আগলে রেখেছেন। প্রথমে তিনি দিনমজুর হিসেবে বিভিন্ন কাজ করতেন। রান্নাটাও সামলাতেন। আমাকে কখনোই কোনো বিষয়ে চাপ দেন নি। পড়াশোনার ব্যাপারেও নয়। তাই আমিও পড়াশোনায় মন বসাতে পারি নি।

রাতে বাবা আমার পাশে বসে থাকতেন। আমি কী পড়ি না পড়ি তা আগ্রহের চোখে দেখতেন। বাবাকে ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ। পড়ার ভান করে আমিও কতক্ষণ বসে থাকতাম। পরীক্ষার ফলাফল আসলে বুঝা যেত আমার পড়ার মান কেমন। বাবা কখনো তা নিয়ে রাগ করেন নি। খারাপ ফলাফল দেখেও মুখে হাসি ধরে রাখতেন। তবে তার চোখে আমি স্পষ্ট বিষাদের চিহ্ন দেখতে পেতাম। সেসবে আমি মাথা ঘামাতাম না।

সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর হঠাৎ একদিন বাবার ব্যবহৃত সিন্দুকে একটি কাগজ দেখতে পাই। খুব যত্নে রাখা এই কাগজটটি আমার পরিচিত। বাবাকে প্রায় আগে কাগজটি ধরে রেখে বসে থাকতে দেখতাম। তাতে যা লেখা ছিল, তা পড়ে আমার মাথা যেন ঘুরে গেল।

এটা মায়ের লেখা। কি নিষ্ঠুরভাবে বাবাকে কটাক্ষ করে লিখেছেন! বাবাকে তিনি অযোগ্য মানুষ, অযোগ্য পিতা হিসেবে সম্বোধন করেছেন। আমাকে নিয়েও লিখেছেন, আমি অযোগ্য বাবার অযোগ্য কন্যা। আমার বেড়ে ওঠা হবে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। আর মৃত্যু হবে মানুষের পদতলে। বাবার পেশা, শিক্ষা, ব্যর্থতার পুরো অংশ তুলে ধরে মা হেয়-প্রতিপন্ন করেছেন। এই কদাচিত চিঠি পড়ে আমি যেন ভাষাহীন হয়ে গেলাম।

মা আমাদেরকে অপছন্দ করেন, এটা জানি। কিন্তু, এতো কুৎসিতভাবে ঘৃণা করেন, তা কখনো ভাবি নি। মায়ের ভাষ্যমতে আমরা এভাবেই নিম্ন শ্রেণীর কীট হয়ে জীবন কাটিয়ে দিবো।

বাবা এই চিঠির কী অর্থ বুঝেছেন, জানি না আমি। তবে এখান থেকেই আমি জেদি হয়ে ওঠলাম। ভবিষ্যতের জন্য চ্যালেঞ্জ নিলাম। পড়াশোনায় মন দিলাম। তারপর হঠাৎ করে পরীক্ষায় এতো ভালো ফলাফল আসায় বাবা যেন তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেদিন বাবার চোখে-মুখে দেখেছিলাম উচ্ছাসে ঘেরা আনন্দাশ্রু। বাবার খুশী যেন আমাকে দিগুণ উৎসাহিত করে তুললো।

বাবার একার পক্ষে আমার খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না বিধায় আমি পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করলাম।

এর মধ্যে মা কখনো যোগাযোগ করেন নি। কোনো খোঁজ নেন নি। আমিও বুঝলাম, মা আমাদের ছায়া পর্যন্ত দেখতে চান না। মাঝে মাঝে এসব দুশ্চিন্তায় পড়া থেকে মনোযোগ সরে যেতো। তখন মায়ের সেই চিঠিটা বের করে পড়ে নিতাম। চোখের সামনে একটা লাইন বারংবার ভেসে ওঠত,

“তুমি মূর্খ, তোমার মেয়েও হবে মূর্খ। তোমরা এই অন্ধ মূর্খতা থেকে বের হতে পারবে না।”

মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল আমার বহু বছর পর। তখন আমি বদলেছি, সময় বদলেছে। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বাবা চাইতেন, মায়ের সাথে যেন আমার একটাবার দেখা হয়। বাবা কখনো কিছু জোর করে আমার উপর চাপিয়ে দেন নি। মা’য়ের বিরুদ্ধেও কিছু বলেন না। এমনকি আমাকেও কখনো উস্কে দেন নি, মায়ের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে বলেন নি।

এ লড়াই ছিল সম্পূর্ণ একা আমার। ভেতর থেকে একা আমি নিজেই মায়ের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছি৷ নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছি। বাবা বলতেন,

” তিনি তোমার মা! তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করো না। তাকে হারানোর জন্য জেতার চেষ্টা করো না। তুমি যা করতে চাও, শুধু নিজের কথা ভেবে করো। এ পৃথিবীর কারো সাথে তোমার লড়তে হবে না। ”

বাবার শেষ চাওয়া এমন একসময় পূর্ণ হলো, যখন আমি মায়ের প্রতি রাগ-ক্ষোভ ভুলে গেলাম। উপলব্ধি করলাম, দোষটা আসলে মায়ের ছিল না। সেই সময়ে তিনি ছিলেন নিরূপায়। এতো সুন্দর ইতিবাচক মনোভাবের বাবাকে না পেলে আমি কোনোদিনও মা’কে ক্ষমা করতে পারতাম না। ভুলতে পারতাম না তার করা সমস্ত উপেক্ষা, অপমান।

মায়ের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম দু’টি সন্তান নিয়ে। তখন আমি আইনজীবী। যে অর্জন বাবার দেখে যাওয়ার কথা ছিল, তা আর হয়ে ওঠে নি। তাই বাবার কথা রক্ষার্থে আমি মায়ের সাথে দেখা করি।

মায়েরও তখন বেশ পরিবর্তন হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে৷ চোখে সেই তীক্ষ্ণ ভাব নেই। আমার এই সাফল্যের কথা শুনে মা অবাক হওয়ার চেয়ে বেশী খুশী হয়েছিলেন। যেটা আমি আশা করি নি। বহু বছর পর, না-কি জীবনে প্রথমবারের মতো মায়ের ঠোঁটের কোণে আমি হাসি দেখতে পেলাম। মায়ের সাথে আমার অতীত নিয়ে কোনো কথা হয় নি। যেটুকু কথা হয়েছে, তা কেবল বর্তমান অবস্থার।

বিদায় নেওয়ার সময় মা শুধু একটি কথা বললেন,
” তোমার জন্ম যদি আরো কয়েকটি বছর পর হতো! তবে হয়তো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। নিজের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখতাম। ”

মায়ের সাথে এটাই শেষ দেখা। আমাদের আর কথা হয় নি। উনার বর্তমান সংসারের কেউ পূর্বের কথা জানে না। শুধুমাত্র উনার জীবনসঙ্গী ছাড়া। তাই আমার কারণে উনাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হোক, তা আমিও চাই না। মা তার জীবনে ভালো আছেন৷ আমিও আমার এই জীবনে বড্ড ব্যস্ত।

সমাপ্ত।

#Samiha_Jannat