ঝলসে যাব জানি পর্ব-০১

0
401

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিজের হবু বর হিসেবে ভার্সিটির ইংরেজি প্রফেসরকে দেখে চমকে উঠবো আমিয়া। তার সামনে বসে থাকা প্রফেসর শুভ্রর অপেক্ষাও একই রকম। আমিয়া তাকালো তার বাবা আশরাফ শরীফের দিকে। বুঝতে বেগ পেতে হলো না এটা তারই বুদ্ধি। নিজের বন্ধুর এই ভদ্র সভ্য ছেলের গলায় তাকে ঝুলিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমিয়ার যে এমন ভদ্রলোক একদম পছন্দ নয়, তার পছন্দ হলো বাউন্ডুলে স্বভাবের ছেলে। যাকে সে নিজের ভালোবাসা দিয়ে ভালো করার স্বপ্ন দেখে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখন তার মতলব কিভাবে এই বিয়ের কথাটা এখানেই থামিয়ে দেয়া যায়। আশরাফ শরীফ আমিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”কেমন লাগল আমার পছন্দের ছেলেকে?”

আমিয়া মনে মনে বলে উঠলো,”জঘন্য।”

কিন্তু সামনাসামনি তো আর এভাবে বলা যায়না। তাই মেকি হেসে বললো,”তোমার পছন্দই আমার পছন্দ বাবা। কিন্তু আমি যে এখনই বিয়ে করতে চাইছি না, আগে নিজের পড়াশোনা শেষ করতে হবে আমায়।”

আশরাফ শরীফ কিছু বলতে যাবেন তখনই শুভ্রর বাবা শামসুর চৌধুরী বলে ওঠেন,”এটা কোন সমস্যাই না। আমাদের বাড়ির বউরাও পড়াশোনা করতে পারে। এই তো আমার বড় ছেলের বউও এসেছে৷ ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখো না, ও যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিল তখন ওর সাথে আমার বড় ছেলের বিয়ে হয়। বিয়ের পর মাস্টার্স কমপ্লিট করে এখন ও বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বউদের চাকরি করা নিয়েও আমাদের কোন আপত্তি নেই। তাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।”

শামসুর চৌধুরীর বড় ছেলের বউ অদিতি বলে উঠলেন,”হ্যাঁ, আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই ভীষণ উন্নত চিন্তা-চেতনার মানুষ। এমন শ্বশুরবাড়ি পাওয়া প্রত্যেকটা মেয়েরই স্বপ্ন। তুমি নিশ্চিন্তে আমার দেবরকে বিয়ে করতে পারো।”

আমিয়া আবারো জোরপূর্বক মেকি হাসে। সে তো এখানকার কাউকেই বোঝাতে পারছে না তার মনের কথা। সে যেমন জীবনসঙ্গী চায়, শুভ্র একদম তার বিপরীত। গোটা ভার্সিটিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জন্য সে পরিচিত। কোন স্ক্যান্ডালের সাথে জড়িত নয়। উত্তম চরিত্রের অধিকারী বলা যায়। ব্যবহারও বেশ নম্র-ভদ্র। এক কথায় বলা যায়, মিস্টার পার্ফেক্ট। এমন কাউকে বিয়ে করে আমিয়া কি করবে? সে তো এই লোকের কোন কিছুই শোধরাতে পারবে না, বলতে গেলে শোধরানোর প্রয়োজনই পড়বে না।

আমিয়া চায় এমন কাউকে বিয়ে কর‍তে যার জীবন হবে অগোছালো, যে হবে প্রচণ্ড বেপরোয়া, যে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না। নিজের মতো চলে। ডিসিপ্লিন নামক শব্দটা যার ডিকশিনারিতে নেই। এমন কাউকে বিয়ে করে নিজের ভালোবাসা দিয়ে তার জীবন বদলে দিতে চায়। শুদ্ধ ভাষায় বলতে গেলে,এটাকে একটা এডভেঞ্চার হিসেবে নিতে চায় সে।

আমিয়া একবার শুভ্রর পানে তাকালো। তার দৃষ্টি নিচে। নিতান্তই ভদ্রলোক বলে কথা! আমিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,”কোন মতেই আমি এই ভদ্রলোককে বিয়ে করবো না।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ভার্সিটির গণরুমে আজো বসেছে তাসের তথা জুয়ার আসর। আর তাতে অংশ নিয়েছে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের কিছু কর্মী। মূল খেলা এখন জমে উঠেছে। এই খেলার একদিকে রয়েছে বাপ্পী হোসেন, প্রভাবশালী ছাত্রনেতার ভাগ্নে। আর তার বিপরীতে রয়েছে আরহাম চৌধুরী দূর্জয়। যার নিজের পরিচয় সে নিজেই। খেলার একপর্যায়ে দূর্জয় মুখে সি*গারেট গু*জে লাইটার টা জ্বালায়। বিদঘুটে হেসে বলে,”অনেক তো হলো টাকার সওদা। এবার নতুন কিছুর সওদা করি।”

বাপ্পী হোসেন হেসে বললো,”বল, কিসের সওদা করতে চাস?”

দূর্জয় তখনো উল্টেপাল্টে দেখছে তাসের পাতাগুলোকে। এভাবে বিচক্ষণের মতো দেখতে দেখতে বলে,”গোলাম, বিবি, কাজি।”

“মানে?”

দূর্জয় একটা বিবি কার্ড তুলে নিয়ে বলে,”চল, আজ এটাকে নিয়েই সওদা করি।”

“ঠিক বুঝলাম না।”

“এই বার যদি তুই জিতিস তাহলে আমার বন্ধু আহনাফের গার্লফ্রেন্ড তোর আর যদি আমি জিতি তাহলে তোর গার্লফ্রেন্ড একরাতের জন্য আহনাফের।”

বাপ্পী হোসেন চেচিয়ে উঠে বললো,”দূর্জয়!”

দূর্জয় মুখে চিরাচরিত হাসি ঝুলিয়ে বলে,”এত হাইপার হচ্ছিস কেন? নিজের উপর বিশ্বাস নেই তোর? দেখ আহনাফকে। ও তো এত রিয়্যাক্ট করছে না।”

বাপ্পী তাকালো আহনাফের দিকে। তাকে একদম শান্ত, স্থির লাগছে। অথচ তারও এতক্ষণে বাপ্পীর মতোই প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ ছিল। আহনাফ বাপ্পীর অবাক মুখশ্রী দেখে বলে,”আমার বিশ্বাস আছে নিজের বন্ধুর প্রতি। আমি জানি, ও তোকে হারিয়ে দেবে। এজন্য আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না। এখন তুই যদি কাপুরুষের মতো খেলা ছেড়ে উঠে যাস সেটা তোর সমস্যা।”

বাপ্পীর মাথায় জেদ চেপে বসলো। সে বসলো পড়লো। বসেই দূর্জয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আমি রাজি তোর প্রস্তাবে। চল খেলা শুরু করি।”

তাদের খেলা শুরু হয়। প্রথম দিকে বাপ্পী এগিয়ে যায় খানিকটা। কারণ সে শুরুতেই নিজের তাবড় তাবড় কার্ডগুলো ব্যবহার করে।

এটা দেখে আহনাফের পাশে দাঁড়ানো তার কিছু বন্ধু হতাশ হয়। সাগর আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলে,”তোর কি একটুও ভয় হচ্ছে না? তুই কেন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলি না?”

আহনাফ বলে উঠলো,”তুই শুধু দেখে যা.. আমার বিশ্বাস দূর্জয়েরই জয় হবে।”

খেলাটা অনেকটাই বাপ্পীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছিল। বাপ্পী বাঁকা হেসে বলে,”এবার হার মেনে নে, দূর্জয়। আর এই যে, সুপুরুষ আহনাফ। তোর গফকে রাতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত থাকিস। অনেকদিন কোন নতুন শরীরের স্বাদ পাই না। আজ রাতটা বোধহয় ভালোই সুখকর হবে আমার জন্য।”

এমন সময় দূর্জয় সহাস্যে বাপ্পীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এই নে, আমার ট্রাম্পকার্ড।”

বাপ্পী হতাশ হয়ে যায়। এখান থেকে যেন পুরো খেলাটা একদম ঘুরে যায়। যেই বাপ্পীর জয় একপ্রকার নিশ্চিত ছিল সে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে এবং দূর্জয় দূর্দান্ত কামব্যাক করে। সর্বশেষ চাল দিয়ে দূর্জয়ই জিতে যায়। বাপ্পী নতজানু হয়ে বসে ছিল। অপমানে, গ্লানিতে তার চোখ লাল হয়ে গেছে। আহনাফ বাপ্পীর সামনে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,”তোর মা**লটাকে আজ রাতে পাঠিয়ে দিস আমার কাছে। বিশ্বাস কর, তোর থেকে বেশি মজা দিতে পারবো।”

বাপ্পী রাগী চোখে আহনাফের দিকে তাকায়৷ আহনাফ একদম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে যায়। দূর্জয় যাওয়ার সময় বাপ্পীকে বলে যায়,”আশা করি তুই গেমের শর্তটা পালন করবি।”

বাপ্পী হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। ওরা চলে যাবার পর বাপ্পির চেলা মান্না তাকে বলে,”বস, আমি আসিফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি? উনি নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবে। উনি তো আপনার মামা হন।”

বাপ্পী রেগে বলে,”একদম না। আমি চাই না, এসব সাধারণ বিষয়ে মামাকে জড়াতে। নাহলে মামার কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমার বিষয়টা আমিই হ্যান্ডেল করতে পারবো।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আহনাফ হলরুম থেকে বাইরে আসতেই তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় তার প্রেমিকা রূপকথা। এসেই আহনাফের কলার চেপে ধরে। আহনাফ শান্ত গলায় বলে,”কলার ছাড়ো।”

রূপকথা চেচিয়ে বলে ওঠে,”নাহ, ছাড়বো না। কি পেয়েছ কি তুমি আমায়? কোন সাহসে তুমি আমায় সওদায় দাঁড় করালে? আমি কি তোমার কাছে কোন খেলনার বস্তু।”

“রূপ, এখানে অনেক মানুষ দেখছে। কোন সিনক্রিয়েট করো না।”

“সিনক্রিয়েট আমি করছি না সিনক্রিয়েট করছ তুমি। ব্যাস, অনেক হয়েছে আমি আর থাকবো না তোমার সাথে রিলেশনে। তুমি তোমার বন্ধু দূর্জয়ের কথায় খুব উঠাবসা করো তাই না? এখন ঐ দূর্জয়কেই গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াও। আমার সাথে আর কথা বলতে আসবে না।”

বলেই হনহন করে চলে যায়। আহনাফ চাইলে রূপকথাকে আটকাতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টাই করে না। দূর্জয় একটা কাঠি দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে আহনাফের সামনে এসে বলে,”ভাবি আবার রাগ করলো নাকি?”

আহনাফ কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়।

“এ আর নতুন কি।”

“তবে যাই বলিস, ভাবির তেজ আছে ভালোই।”

“এই তেজের জন্যই তো ওকে আমার এত পছন্দ।”

দূর্জয় হেসে বলে ওঠে,”এইসব তে*জ দিয়ে বা*লডা ফেলাবে। ঘুরে তো আসতে হবে তোর কাছেই।”

~~~~~~~
রূপকথা ভীষণ রেগেমেগে তার প্রিয় বান্ধবী আমিয়াকে ফোন লাগায়। আমিয়া এমনিতেই শুভ্রর দেখতে আসার বিষয়টা নিয়ে রেগে ছিলো। পাত্রপক্ষ চলে যাবার পর থেকে ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। এমন সময় ফোনে কল আসায় বিরক্ত হলো। ফোনটা রিসিভ করে ভীষণ রাগী গলায় বললো,”আমার মুড ভালো নেই। কল রাখ জলদি।”

রূপকথাও রেগে বললো,”হ্যাঁ, তোদের কারো তো মুড ভালো থাকে না। একজন আমায় নিয়ে সওদা করছে আরেকজন আমায় রাগ দেখাচ্ছে। কোথায় যাব আমি?”

আমিয়া এবার একটু নরম হয়ে বলে,”কি হয়েছে রূপ? আহনাফ ভাইয়ার সাথে আবার কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?”

রূপকথা আমিয়াকে সব ঘটনা খুলে বলে৷ সব শুনে এবার আমিয়ারও ভীষণ রাগ হয়। সে বলে ওঠে,”এবার তুই কিছুতেই সহজে আহনাফ ভাইকে ক্ষমা করে দিবি না। এই লোক তো এখনো আগের মতো আছে..ভেবেছিলাম তোর মতো সুন্দরী মেয়ের ভালোবাসা পেলে বদলে যাবে কিন্তু…”

রূপকথা নরম সুরে বলে,”আহনাফ এত খারাপ নয়। ও তো ওর ঐ শয়তান বন্ধু দূর্জয়ের সাথে মিশে এত খারাপ হয়েছে। ঐ কথায় আছে না,সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

দূর্জয়ের নাম শুনতেই আমিয়ার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এলোমেলো গোঁফ, মুখভর্তি দাঁড়িওয়ালা সেই শ্যাম পুরুষের কথা। তীব্র হয় বুকের স্পন্দন। আনমনেই সে বলে দেয়,”দেখবি ঐ আরহাম চৌধুরী দূর্জয়কেও কেউ নিজের ভালোবাসা দিয়ে সঠিক পথে ফেরাবে।”
To be continue…..