ঝলসে যাব জানি পর্ব-০৫

0
197

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_5
#ইয়াসমিন_খন্দকার

রূপকথা নিত্যদিনকার মতো আজও বেরিয়ে পড়েছে টিউশনি করানোর জন্য। যদিও তার পারিবারিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল তবুও সে শখ করেই টিউশনি পড়ায়৷ রূপকথার খুব ভালো লাগে বাচ্চাদের পড়াতে। সে পড়াশোনা শেষ করেও একজন শিক্ষকই হতে চায়। এসব মনে করে নিজমনেই হাসল সে। জীবনে এখনো অনেক আগানো বাকি।

মাঝরাস্তায় হঠাৎ কেউ তার রাস্তা আটলে ধরলো। রূপকথা বিরক্ত হয়ে সামনে তাকাতেই বরফের মতো জমে যায়। অবাক স্বরে বলে ওঠে,”তুমি!”

আহনাফ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার রূপের দিকে। মেয়েটা কি করে এত নির্দয় হতে পারলো তার উপর। রূপকথা ক্ষেপে গিয়ে বললো,”সামনে থেকে সরে দাড়াও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“এত নিষ্ঠুর হয়ো না রূপ, আই নিড টু টক উইক ইউ।”

“কিন্তু আমার তোমার সাথে কথা বলার কোন আগ্রহ নেই।”

আহনাফ নাছোড়বান্দা। রূপের পথ আটকে বলে,”আমি যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম জানতে তুমি?”

“হ্যাঁ, জানতাম।”

রূপের শীতল জবাব। যা আহনাফের জ্বালা আরো বাড়িয়ে দিলো।

“সব জেনেও আমার সাথে দেখা করতে গেলে না? তোমার কি একবারও জানতে ইচ্ছা করল না আমি কেমন আছি? কেন গেলে না রূপ?”

“প্রয়োজন মনে করিনি তাই।”

রূপের একটার পর একটা শক্ত জবাব আহনাফের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। আচমকা আহনাফ একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো। হাটু গেড়ে বসে পড়লো রূপকথার সামনে। রূপকথা হতবাক হয়ে বলল,”আরে এ কি করছ তুমি?! ওঠো বলছি।”

আহনাফ ওঠে না। বসেই থাকে। রূপকথার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমি মানছি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়। তার বিনিময়ে আমি ক্ষমাও চাচ্ছি। তোমার যা শাস্তি দেয়ার তুমি আমাকে দিতে পারো, তবু আমার উপর এভাবে রাগ করে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকো না রূপ, তোমার অবহেলা আমায় ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।”

আহনাফের এমন কথা শুনে রূপকথার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। রূপকথা হাসি থামিয়ে বলে,”একটা কথা কি জানো আহনাফ, মানুষ কোন কিছু খুব সহজে পেয়ে গেলে তার মূল্য দিতে জানে না। এই যেমন, তুমি আমাকে খুব সহজেই পেয়ে গেছিলে, তাই আমাকে টেকেন ফর গ্যান্টেড ভেবে নিয়েছিলে। তাই আমার মূল্যায়ন করো নি। আমাকে নিয়ে সওদা করতেও দুবার ভাবোনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এতটা স্বস্তা নই। তুমি একবার প্রপোজ করাতেই তোমার সাথে রিলেশনে গিয়েছিলাম ভালোবাসি বলে। অন্ধের মতো ভালোবেসেছি তোমায়। তোমার সব অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছি। কারণ আমি ভাবতাম দিনশেষে তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু তুমি আমার সেই ধারণাও ভুল প্রমাণিত করলে। নিজের বন্ধুর প্ররোচনায় আমাকে নিয়ে এরকম কুৎসিত শর্ত দিতেও দুবার ভাবলে না…আমার এখন তোমার প্রতি শুধু একটাই অনুভূতি আর সেটা হলো ঘৃণা।”

বলেই রূপকথা আর এক পলকও না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেটে স্থান ত্যাগ করে। আহনাফ রূপকথার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে,”তুমি মুখে যতো যাই বলো, আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। আমি তোমাকে নিজের থেকে দূরে থাকতে দেব না রূপ। তোমার সব মান অভিমান ভাঙাবোই, আমাদের মধ্যকার এই দূরত্ব ঘোচাবোই!”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আজ প্রথম ভার্সিটিতে পা রাখলো দূর্জয়। এসেই মুন্না, সাগরদেরকে নিয়ে ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে। ক্যান্টিনের নিয়মের কোন পরোয়া না করে সবার সামনে সিগারেট ধরালো। কিছু স্টুডেন্ট আড়চোখে দেখিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। গোটা ভার্সিটির সবাই দূর্জয় ও তার গ্যাংকে চেনে। তাই কারো সাহস নেই এদের সাথে পাঙ্গা নেবার। তাই সবাই বিরক্ত হলেও কিছু বছর পারলো না। দূর্জয় হঠাৎ বলে উঠলো,”আহনাফটা কোথায় রে? ওকে তো সকাল থেকে দেখছি না।”

মুন্না বলে উঠলো,”ওর কথা আর কি শুনবি! ও তো নিজের প্রিয়তমার মান ভাঙাতে ব্যস্ত।”

দূর্জয় বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললো,”এই আহনাফ আবার কবে থেকে ঐ মেয়েকে এত পাত্তা দেয়া শুরু করল। আগে তো শুধু আছেই এমন ভাব নিয়ে থাকত।”

সাগর বলে,”যখন কোন কিছু আমাদের কাছে থেকে তখন আমরা তার মূল্য দিতে পারি না। দূরে চলে গেলেই তার মর্ম বুঝতে পারি।”

দূর্জয় সাগরের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,”এসব সব ভাওতাবাজি! মেয়ে মানুষকে এত মাথায় তুললে নেই। তাদের স্থান পুরুষদের পায়ের নিচে। মাথায় তুললেই উঠে নৃত্য শুরু করবে।”

সাগর ফুসে ওঠে দূর্জয়ের কথা শুনে। আচমকা বলে বসে,”এত বড় বড় কথা বলিস না! দেখা যাবে তুইও কোনদিন কোন মেয়েকে এমন মাথায় তুলে নাচলি!”

সাগরের কথা শুনে হাসতে শুরু করে দিলো দূর্জয়। ভীষণ বিদঘুটে সেই হাসি। কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলল,”দূর্জয়কে তোরা এখনো চিনে উঠতে পারিস নি! আমি আর যাই হোক কোন মেয়ে মানুষের জন্য এত বিচলিত হয়ে উঠবো না। মেয়ে মানুষে আমার এলার্জি আছে জানিস না? দেখেছিস আমাকে কোনদিন কোন মেয়ের পাশে ঘুরঘুর করতে?”

সাগর বলে,”সেটা অবশ্য দেখিনি। কিন্তু তোর অলক্ষ্যে যে একটা মেয়ে তোকে ভালোবেসেছে সেটা কি তুই জানিস?”

দূর্জয়ের উজ্জ্বল মুখে হঠাৎ আমাবস্যা নেমে এলো। একটা মেয়ে ভালোবেসেছে তাও আবার তাকে! এ যেন অবিশ্বাস্য! সে তো আহনাফের মতো সুদর্শন নয়, নিজেকে পরিপাটি করে রাখে না। সবসময় অগোছালো ভাব তার মাঝে। তার চালচলনও যথেষ্ট অশালীন। এত এত খুতের মাঝেও কোন মেয়ে তাকে পছন্দ করল জানতে বড় ইচ্ছা হচ্ছে। তাই তো সে জিগ্যেস করে বসলো,”কে সেই মেয়ে?”

কাকতালীয় ভাবেই ঠিক সেই সময়েই আমিয়া প্রবেশ করলো ক্যান্টিনে। মুন্না আমিয়াকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বেশ খানিকটা চেচিয়েই বলে উঠল,”আরে ঐ তো সেই মেয়ে!”

মুন্নার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূর্জয় তাকালো আমিয়ার দিকে। আর তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো।

“আরে এইটা তো সেই মেয়েটা যার সাথে..”

আর কিছু ভাবতে পারলো না দূর্জয়। মুন্না কথাটা জোরে বলায় ক্যান্টিনে উপস্থিত সবারই দৃষ্টি আমিয়ার দিকে। আমিয়া নিজেও অবাক। দূর্জয় আচমকা উঠে দাঁড়ালো। শক্ত হলো তার চোয়াল। ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গেলো আমিয়ার দিকে। বেশ জোরেই তার হাত চেপে ধরে বাইরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেলো যে আমিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ পেল না। আমিয়াকে জোরপূর্বক টেনে বাইরে এনে তার হাত ছাড়লো দূর্জয়। আমিয়া তখনো অবাক দৃষ্টিতে দূর্জয়কে দেখছে। দূর্জয় বেশ রাগত স্বরে আমিয়াকে শুধালো,”পছন্দ করো আমায়?”

আমিয়া থতমত খেলো। তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দিতে পারলো না। দূর্জয় বেজায় বিরক্ত হয়ে পুনরায় শুধালো,”কি হলো চুপ আছ কেন? আমার প্রশ্নের জবাব কই?”

আমিয়া কিঞ্চিৎ সাহস দেখিয়ে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ালো। দূর্জয় কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে অতঃপর বিদ্রুপের হাসি হাসলো। বলে ফেলল,”এই দিন দেখাও বাকি ছিল?! আরহাম চৌধুরী দূর্জয়, যার ভয়ে পুরো ক্যাম্পাস কাপে তাকে কিনা তুমি পছন্দ করো?!”

“হ্যাঁ, করি।”

” তা কি দেখে আমায় পছন্দ করলে শুনি? আমার টাকা পয়সা দেখে?”

আমিয়া বিরক্ত হলো এমন প্রশ্নে। তার নিজের বাবাও একজন ধনী ব্যক্তি। তার এতটা খারাপ সময় আসে নি যে টাকা দেখে কাউকে পছন্দ করতে হবে। অর্থের লোভ তার নেই। দূর্জয়ও এছাড়া আর কোন কারণ খুঁজে পেল না তাকে ভালোবাসার মত। ছোট থেকেই নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছে যে আশেপাশের সবাই তাকে ঘৃণা করেছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বর্তমানে ভার্সিটিতেও সবার উপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ছেলেরা তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভয় পায় আর মেয়েরা তো এক হাত দূর থেকেও তার দিকে তাকানোর সাহস পায়না। এমনই ইমেজ তৈরি করেছে সে নিজের। আর সেখানে এই মেয়ে কিনা তাকে পছন্দ করে!

আমিয়াকে আবারো চুপ দেখে দূর্জয় বলে ওঠে,”যদি আমার সম্পদ দেখে আমায় ভালোবেসে থাকো তাহলে বলে দেই, এসব কিছু আমার নয় আমার বাবা আজিজুল চৌধুরীর। আর তার সম্পদের এক কানাও তিনি আমাকে দেবেন না, দিলেও আমি নেব না। তাই আমাকে ভালোবাসার ভুল করো না।”

আমিয়া এবার আর চুপ থাকতে না পেরে বলে,”আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। আপনি ধন সম্পদের মালিক হন বা খালি পকেটে থাকুন সেটা আমার কাছে ম্যাটার করে না।”

দূর্জয় বলল,”আমায় ভালোবাসলে তার পরীক্ষা দিতে হবে। তবেই আমি তোমাকে নিয়ে ভেবে দেখব। পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো।”

বলেই সে স্থান ত্যাগ করলো।

to be continue…..