ঝলসে যাব জানি পর্ব-০৬

0
197

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_6(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“আজ তোর এনগেজমেন্ট আমিয়া। আমি শুভ্রর বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। আশা করি, তুই আর এটায় কোন ব্যাঘাত ঘটতে দিবি না।”

নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে থমকে গেলো আমিয়া। কিছুক্ষণ আগেই ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেছে সে। তার মধ্যেই যে এমন কিছু শুনতে হবে সেটা ভাবতে পারেনি। আজই দূর্জয়ের সাথে কথা বলল সে। দূর্জয় তার কাছে ভালোবাসার পরীক্ষা চাইল ভালোবাসার৷ আর এখন এ কোন নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি সে। আমিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। তার বাবার অবস্থা একইরকম। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে একবারে স্থির। আমিয়া প্রতিবাদী সুরে বলে উঠল,”আমি তোমার কথা মানতে বাধ্য নই বাবা। তোমাকে তো আমি বলিনি এমন কথা দিতে। আমি এই এনগেজমেন্ট করতে পারবো না।”

“তুই আমার উপর মুখ চালাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ। আমার মতের বিরুদ্ধে আমি কিছু হতে দেবো না।”

“খুব বড় হয়ে গেছিস। বাবার কথার মূল্য নেই কোন?”

“তোমার কাছেও তো আমার কোন মূল্য নেই বাবা। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তো দেখে আসছি তুমি সবসময় নিজের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছ। আমার বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু তুমি আমাকে যেতে দিলে না। এখন আবার জোর করে আমার বিয়েও দিতে চাচ্ছ। তোমার জন্য নিজের আর কত স্বপ্ন আমি বিসর্জন দেব?”

আশরাফ শরীফ হতবাক হয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন। তারই মেয়ে তার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছে, ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না। তিনি আবারো জোর দিয়ে বললেন,”আমি সব এরেঞ্জমেন্ট শুরু করে দিয়েছি। যথাসময়ে শুভ্ররা চলে আসবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।”

“আমি তৈরি হবো না। আমি এই এনগেজমেন্ট করতে রাজি নই।”

“এটাই তাহলে তোমার শেষ কথা?”

“হ্যাঁ।”

দৃঢ় কন্ঠে বলে আমিয়া। আশরাফ শরীফ আর রাগারাগিও করেন না, কোন প্রতিবাদও করেন না। চুপচাপ সোফায় এসে বসে পড়েন। তার বুকের বা-পাশে হঠাৎ করেই ভীষণ ব্যথা অনুভূত হয়। এমনিতেই তিনি হার্টের পেশেন্ট। এত চেচামেচি করায় অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠল।

হঠাৎ করেই তিনি বুক চেপে প্রবল আর্তনাদ করে উঠলেন। আমিয়া ভয় পেয়ে গেলো। ছুটে গিয়ে বাবার পাশে বসে বললো,”কি হয়েছে বাবা? তুমি ঠিক আছ তো? এমন করছ কেন হঠাৎ?”

তিনি কোন জবাব দিলেন না। আমিয়ার ভয় বাড়লো। সে আর সময় নষ্ট না করে তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন দিলো। তিনি দ্রুতই আসবেন জানালেন। আমিয়া তাদের বাড়ির দারোয়ানের সাহায্যে কোনরকমে বাবাকে রুমে নিয়ে গেলো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ডাক্তার এসে কিছুক্ষণ আশরাফ শরীফকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,”তোমার বাবার হার্টের অবস্থা একদম ভালো না। এযাত্রায় বেঁচে গেছেন তবে বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যেতে পারত। তুমি খেয়াল রেখো যেন ওনাকে আর কোন স্ট্রেস নিতে না হয়।”

আমিয়া চুপসে গেল। এমন কিছু মোটেই আশা করেনি সে। ডাক্তার চলে যাওয়ার কিছু সময় পর আশরাফ শরীফ কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। আমিয়া তার পাশে গিয়ে বসতেই আশরাফ শরীফ বললেন,”তোর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয় রে মা। তুই ছাড়া যে এখন আমার এই দুনিয়ায় কেউ নেই। এইজন্যই তো তোকে ওত দূর বিদেশে পাঠাতে চাই নি। আর তুই এনিয়ে অভিমান পুষে রেখেছিস।”

আমিয়া তার বাবার গলা জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। আশরাফ শরীফ বলতে থাকেন,”আমার শরীর এখন একদম ভালো যাচ্ছে না আমিয়া। আমার মনে হয় আমি আর বেশিদিন..”

“বাবা..প্লিজ এমন কথা বলো না। আমার কষ্ট হচ্ছে শুনতে।”

“আমি বেশি কিছু চাই না। শুধু নিজের মৃত্যুর আগে তোকে সুখী দেখে যেতে চাই। শুভ্র শামসুরের ছেলে। শামসুর,আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু। শুভ্রকেও আমি ছোট থেকে দেখে আসছি। ভীষণ ভালো ছেলে ও। আমি জানি ও তোকে সুখে রাখবে। নির্দ্বিধায় ওর হাতে তোকে তুলে দিয়ে আমি চিন্তামুক্ত হতে পারব। একজন বাবা যা করেন তার মেয়ের ভালোর জন্যই করে। তুই আর এই এনগেজমেন্টে না করিস না মা। এই এনগেজমেন্টটা হয়ে গেলে আর কয়েক মাস পরেই তোদের চারহাত এক করলেই আমার শান্তি।”

আমিয়া যেন অকুল পাথারে পড়ল। তাকে আবেগ এবং বিবেকের দ্বন্দে জর্জরিত হতে হলো। অশ্রু বিসর্জন দিল খানিক নীরবে। এই মুহুর্তে দূর্জয়ের কথা মনে পড়লো। ছেলেটাকে ভালোবাসে সে। কিন্তু নিজের বাবার এই পরিস্থিতিতে সেই ভালোবাসাটা মূখ্য নয়। তাই বাবার কথা মেনে নিতে হবে তাকে। আমিয়া মাথা নামিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,”তোমার সিদ্ধান্তে আমি রাজি বাবা। তুমি ওনাদের আসতে বলো।”

আশরাফ শরীফ যেন দুশ্চিন্তামুক্ত হলো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~
বেশ ঘরোয়া ভাবেই আংটি বদলের আয়োজন করা হয়েছে৷ আমিয়াদের তরফ থেকে তার তেমন কোন নিকটাত্মীয় আসেনি। এই শহরেই তার মামা থাকেন। তিনি সপরিবারে এসেছেন। আর শুভ্রর মা-বাবা,ভাই-ভাবি এবং কিছু নিকটাত্মীয় এসেছে।

শুভ্র এখানে এসেছে থেকে আমিয়ার দেখা পায়নি। চাতক পাখির মতো আমিয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। তার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বোধহয় আগমন ঘটলো আমিয়ার। একটি পিংক কালারের গাউন এবং তার সাথে ম্যাচিং গহনা পড়ে নিচে নেমে আসতে লাগল আমিয়া। শুভ্রর পরণে কালো চারুকাজ করা পাঞ্জাবি এবং পাজামা। সে অপলক তাকিয়ে রইল আমিয়ার দিকে। মেয়েটার মুখে হাসি নেই। বিষন্ন লাগছে। শুভ্র বুঝল না এই বিষন্নতার কারণ। বাবার কাছে তো শুনল ও এই বিয়েতে মত দিয়েছে। তাহলে এভাবে মন খারাপ করে থাকার কি মানে?

শুভ্রর ভাবি অদিতি উঠে গিয়ে আমিয়ার পাশে দাঁড়ালো। আমিয়ার মামি তাকে ধরে নিচে এনেছে। অদিতি আমিয়ার কাছাকাছি গিয়ে মৃদু হেসে বলল,”বাহ, কি সুন্দরী লাগছে তোমায়। আমার দেবরজী তো আজ তোমার রূপের মায়ায় ডুবে যাবে।”

আমি মেকি হাসলো। একবার শুভ্রর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। শুভ্রর বড় ভাই শাহিন তাকে উঠতে বললো। শুভ্র উঠে দাঁড়ালো। আমিয়া ও শুভ্রকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো আংটি বদলের উদ্দ্যেশ্যে। শুভ্র খেয়াল করছে আমিয়া একবারও তার দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অদিতিরও নজরে এলো ব্যাপারটা। সে বলল,”এত লজ্জা পাচ্ছ কেন বোন? তাকাও একবার আমার দেবরজির দিকে..দেখো তোমার সাথে দৃষ্টি মেলানোর অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে সে।”

আমিয়া সহসা মাথা তুলে তাকালো না। একটু সময় নিয়ে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে নিলো। সবাই তাড়া দিতে লাগলো আংটি বদলের জন্য। মনে অনেক দ্বন্দ নিয়ে আমিয়াকে আংটি পড়িয়ে দিলো শুভ্র। আমিয়াও কাপা কাপা হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো সম্পূর্ণ নিজের মনের বিরুদ্ধে। মনে মনে বললো,”একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের নামে আংটি পড়া ভীষণ কষ্টের অনুভূতি। ভেতর থেকে যে ঝলসে যাচ্ছি আমি।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আহনাফ অনেক চেষ্টা করেও সারাদিনে রূপকথার মান ভাঙাতে পারে নি। শেষ অব্দি আহনাফের জ্বালায় বিরক্ত হয়ে রূপকথা টিউশনি পড়িয়ে এসে সেই যে নিজের বাসায় ঢুকেছে আর বের হয়নি। আজ এমনকি ভার্সিটিতেও যায়নি। ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। আহনাফ সেই তখন থেকে তার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। আকাশ অন্ধকার, একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। কিন্তু রূপকথার কোন দেখা নেই৷ সে আর কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করবে? বিরক্ত হয়ে সিগারেট ধরালো আহনাফ। আকাশ বেয়েও বৃষ্টি নামলো। আহনাফের সিগারেট নিভে গেল বৃষ্টির পানিতে। ভিজে যেতে লাগল পুরো শরীর। সে অসহায় চোখে একবার রূপকথার বাসার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল করল তার মাথায় আর পানি পড়ছে না। কেউ ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে তার মাথায়। আহনাফের মনে আশার সঞ্চার হলো। তবে কি রূপ এসে দাড়িয়েছে তার পাশে। প্রবল আশা নিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই আহনাফের মন ভেঙে গেল। কারণ রূপ না দূর্জয় দাঁড়িয়ে ছাতা হাতে নিয়ে। আহনাফ মলিন কন্ঠে বলল,”ও তুই!”

“কেন কি ভেবেছিলি? তোর দেমাগী প্রেমিকা আসবে?”

“একদম বাজে কথা বলবি না রূপের নামে। আজ তোর জন্য রূপ আমার উপর রাগ করে আছে!”

“তুই একটা সামান্য মেয়ের জন্য আমায় এভাবে বলছিস?”

“সামান্য মেয়ে নয়,রূপ আমার ভালোবাসা।”

দূর্জয়ের কন্ঠে হঠাৎ চাপা কষ্টের দেখা মিলল।

“হ্যাঁ, তোর ভালোবাসা তো রূপ। আমি কে তোর? সামান্য বন্ধু। আমাকে কি কেউ ভালোবাসিস না তোরা? এক মা-ই আমাকে ভালোবাসত। সেও আমাকে ছেড়ে গেল। বাবার তো আমার প্রতি কোন ভালোবাসাই ছিল না। সমাজের সবার চোখে খারাপ ছেলে আমি। এক বন্ধুদেরই আপন ভাবতাম। তারাও পর করে দিচ্ছে!”

to be continue…..