ঝলসে যাব জানি পর্ব-১৫

0
176

#ঝলসে_যাব_জানি
#Part_15(বিয়ে স্পেশাল)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

হালকা রঙের একটা মেরুন লেহেঙ্গা পড়ে নিজ কক্ষে অবস্থান করছে আমিয়া। আজ তার বিয়ে। একটু পরেই গায়ে হলুদ। গত তিনদিন থেকে নিজের বাবার কঠোর নজরদারিতে আছে সে। বিচক্ষণ আশরাফ শরীফ এক মুহুর্তের জন্যেও তাকে একা ছাড়ছে না। সবসময় আশেপাশে কেউ না কেউ রয়েছে৷ তাই আমিয়া চাইলেও কিছু করতে পারছে না। বাধ্য মেয়ের মতো সবটা মেনে নিতে হচ্ছে।

তবে আজ তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই আমিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজ সে যেকরেই হোক পালাবে। অন্তত একবার শেষ চেষ্টা করবে যাতে কোন ভাবে এই বিয়েটা আটকানো যায়। আমিয়া এমন ভাবনার মাঝেই রূপকথা এসে তার পাশে বসে। আমিয়াকে উদাসীন দেখে বলে,”মন খারাপ করে আছিস কেন? তোকে তো বলেই ছিলাম আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। তাই আসতে দেরি হলো। তবে এখন থেকে তোর বিয়ের সব রিচ্যুয়ালে আমি থাকব।”

আমিয়া মলিন হাসে। তবে রূপকথাকে দেখে সে মনে একটা আশার আলো খুঁজে পায়। রূপকথাই এখন এইরকম পরিস্থিতিতে তাকে সাহায্য কর‍তে পারবে।

আমিয়ার মামী একটা হলুদ শাড়ি নিয়ে এসেছে তাকে পড়ানোর জন্য। আমিয়া চুপচাপ সেই হলুদ শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। এরপরই সবাই গায়ে হলুদের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমিয়ার পাশে তখন কেবল ছিল রূপকথা। আমিয়া এই সুযোগে রূপকথাকে বলে,”রূপ, তুই আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবি? আমার বন্ধুত্বের দোহাই, এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহায্য হবে।”

আমিয়ার কাতর স্বর। রূপকথা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তবুও জিজ্ঞেস করে,”বল, কি সাহায্য চাস তুই।”

আমিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমি একবার শেষবারের মতো দূর্জয়ের সাথে দেখা করতে চাই। তুই একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”

রূপকথা বিস্ময় নিয়ে বলে,”আজ তোর বিয়ে আর তুই…”

“প্লিজ..রূপ। তুই আমাকে এই সাহায্য টুকু কর। এটাই আমার তোর কাছে শেষ চাওয়া। আর কোনদিন তোর কাছে আমি কিছু চাইব না।”

“কিন্তু আমি কিভাবে…”

“তুই শুধু কোনভাবে আমার বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দে। আমি একবার সামনাসামনি দূর্জয়ের সাথে কথা বলতে চাই। ব্যস, এটুকুই। নাহলে যে আজীবন আমার আফসোস থেকে যাবে।”

রূপকথা আমিয়ার এমন করুণ আবদার আর ফেলতে পারে না। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়ে বলে,”ঠিক আছে, আমি দেখছি কি করা যায়।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
গায়ে হলুদের পালা শেষ হয়ে কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়। বিয়ের সময় প্রায় ঘনিয়ে আসছে। এরইমধ্যে আমিয়াকে পার্লারে নেওয়ার সময় হয়ে আসে। আমিয়ার বাবা তার মামাতো বোনকে আমিয়ার সাথে পাঠাতে চাইলেও রূপকথা সেধে বলে,”আঙ্কেল…আমি যাই আমিয়ার সাথে?”

আশরাফ শরীফ বলে ওঠেন,”তুমি তো আমাদের গেস্ট। তুমি কেন শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবে। তুমি এখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করো।”

রূপকথা আবেদন জানিয়ে বলে,”আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন আঙ্কেল। আমি আমিয়াকে দেখে রাখব।”

“ঠিক আছে, তবে যাও।”

~~~~~~~~~~~~~~~
পার্লার থেকে সরাসরি আমিয়াকে নিয়ে একটি কফিশপের দিকে রওনা দেয় রূপকথা। আমিয়ার পরনে তখন লাল রঙের এক বেনারসি শাড়ি এবং সাথে বিয়ে স্পেশাল মেকআপ। নববধূর সাজ একদম নজরকাড়া। তবে তার মুখের মলিন আভায় ভাটা পড়েছে সব সৌন্দর্য। রূপকথা আমিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে সে। অনেক বড় মুখ করে নিজের পিতৃ সমতূল্য মানুষটাকে কথা দিয়ে ফেলেছে রূপকথা যে, সে আমিয়াকে দেখে রাখবে। কিন্তু আদৌ সেই কথা রাখতে পারবে তো? আমিয়া যদি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।

নিজের ভাবনার মাঝেই আমিয়াকে গাড়ি থেকে নামতে দেখতে পায় রূপকথা। তারা ইতিমধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আমিয়া গাড়ি থেকে নামার সময় রূপকথা শুধায়,”ফিরে আসবি তো?”

আমিয়া বলে,”সবটা নির্ভর করছে আজ দূর্জয় এর উপর।”

আমিয়া এটুকু বলেই ক্যাফেতে প্রবেশ করে। একটু চোখ বোলাতেই ডান দিকের এক কোনে একটি টেবিলে দূর্জয়কে বসে থাকতে দেখে ব্যস্ত অবস্থায়। দূর্জয়কে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে ভীষণ বিরক্ত এবং রেগে আছে। আমিয়া একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আজই হয়তো আপনার এই বিরক্তির অবসান ঘটবে।”

দূর্জয়ের সামনে এসে সে বলে,”সরি, আমার জন্য মনে হয় অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন। আমার জন্য অনেক ভোগান্তি হলো বুঝি।”

দূর্জয় বিড়বিড় করে বলে,”তুমি পুরোটাই আমার জন্য আস্ত একটা ভোগান্তি।”

আমিয়ার কানে পৌঁছায় সে কথা। সে দূর্জয়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?”

দূর্জয় বিরক্তি নিয়ে বলে,”যতদূর শুনলাম আজ তোমার বিয়ে। বিয়ের পর সুখী হও এটাই চাই। আমার তরফ থেকে তোমাকে যা বলার আগেও বলেছি আবারো বলছি আমার তোমার প্রতি কিছু নেই।”

“একটুও অনুভূতি নেই আমার প্রতি?”

“না।”

দূর্জয়ের স্পষ্ট জবাব। আমিয়া স্লান হেসে বলে,”আমি আজ শেষ বারের মতো আপনার কাছে এসেছিলাম। আপনার কাছে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। আমি জানতাম, আপনি আবারো নাই বলবেন। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি আজ আপনাকে আর জোর করব না। নিজের ভাগ্যকেই মেনে নিবো। আমি এখন কিছুটা হলেও উপলব্ধি করছি যে আর যাইহোক জোর করে ভালোবাসাটা হয় না। আপনি ভালো থাকুন, সুখী হোন। কিন্তু আমার ভালো থাকার কারণ না হোন। আপনাকে ছাড়া সুখী হতে পারব কিনা, জানিনা। তবে দোয়া করবেন আমার জন্য।”

দূর্জয় এবার বেশ বিজ্ঞের মতো বলে,”এসব আবেগ মাথা থেকে দূর করো। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমার মতো ছেলেকে বিয়ে করে তুমি এমনিও সুখী হতে না। আমি এক বাউন্ডুলে, যার নিজের জীবনটা অগোছালো। আমার সাথে জীবন জড়ালে তুমিও আমার মতোই অগোছালো জীবন পেতে। তবে সবথেকে বড় কথা আমি তোমাকে ভালোবাসি না বা তোমার প্রতি আগ্রহ নেই। আর কোন কিছু না থাকলেও ভালোবাসা থাকাটা তো দরকার। যেটা আমাদের মাঝে হবার সম্ভাবনা নেই।”

“ঠিক আছে। ভালো থাকবেন। আমি চলি তাহলে?”

বলেই উঠে দাঁড়ায় আমিয়া। তার বুকের পক্ষে আর এই কষ্টের ভার বহন করা সম্ভব না। ফিরে আসার সময় শেষবারের মতো একবার পিছু ফিরে দূর্জয়কে দেখে নিলো। নিজের ভাগ্যের প্রতি আরেকবার অভিযোগ জানালো। যে মনে থাকে, সে ভাগ্যে থাকে না কেন!

~~~~~~~~~~~~~
বিয়ের আসরে শুভ্রর মুখোমুখি বসে আছে আমিয়া। শুভ্র ইতিমধ্যেই কবুল বলে দিয়েছে। এখন আমিয়ার পালা। সে কিছুতেই এই তিনটা অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত শব্দটা মুখে আনতে পারছে না, গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে নিজের মনের সাথে লড়াই করে বলে ওঠে,
“কবুল….কবুল..কবুল”

ব্যস, এরপর পুরো পৃথিবীটা তার কাছে ফ্যাকাসে হয়ে আসে। শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করে দূর্জয়ের দিকে তাকায়। ঐ লোকটা এখন আর তার নয়, কখনো ছিলোও না। চোখ খুলতেই শুভ্রকে দেখতে পায় সে। এই লোকটা আজ থেকে তার স্বামী। বৈধ এবং পবিত্র এক সম্পর্কের দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে। এখন এই ভবিতব্যকেই তাকে মেনে নিতে হবে। অন্তর ঝলসে গেলেও মনের উপর জোর খাটিয়ে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে এই সম্পর্ক টা!

to be continue…..