ঝলসে যাব জানি পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
359

#ঝলসে_যাব_জানি
#Last_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই এক বছরে শুধু দিন বদলায় নি। সবার জীবনও অনেকাংশে বদলে গেছে৷

শুভ্র-আমিয়ার সম্পর্ক এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। শুভ্রর কেয়ারিং এবং ভালোবাসার জন্য তার প্রেমে পড়ে গেছে আমিয়া। শুধু তাই নয়, তাদের এই ভালোবাসার ফসল হিসেবে তাদের সন্তানও আসতে চলেছে এই পৃথিবীতে। আমিয়া বর্তমানে গর্ভবতী, চার মাস চলছে। শুভ্র এখন আমিয়াকে আগের থেকেও বেশি চোখে হারায়৷ আর সংসারের সকল সদস্য তো যেন আমিয়াকে আরো আগেই আপন করে নিয়েছে। সব মিলিয়ে আমিয়া নিজের জীবনে অনেক বেশি সুখী।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রূপকথার জীবনও চলছে তার আপন গতিতে। পড়াশোনা শেষ করে এখন সে বর্তমানে সে একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করছে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে৷ তবে এই এক বছরে তাকে আর দূর্জয় নামক ব্যক্তিটির মুখোমুখি হতে হয়নি। দূর্জয় আর তার সামনে আসেনি। ব্যাপারটা ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রূপকথা। সর্বশেষ দূর্জয়ের বন্ধু সাগরের মাধ্যমে জেনেছিল দূর্জয়ের বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে তার বাবার কোম্পানির দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

দূর্জয়ের আগের জীবন সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছে সে সাগরের থেকে। দূর্জয়ের মা-বাবার ভালোবাসার বিয়ে ছিল। কিন্তু দূর্জয় যখন তার মায়ের পেটে ছিল তখনই দূর্জয়ের বাবা অন্য একটা নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। দূর্জয়ের জন্মের কয়েক বছর পর দূর্জয়ের মা এই বিষয়টা জানতে পারেন৷ তিনি তার স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন তাই এই সত্যটা মেনে নিতে না পেরে তিনি নিজেকে শে*ষ করে দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই দূর্জয়ের জীবন বদলে যায়। দূর্জয়ের দাদার জন্য তার বাবা নিজের প্রেমিকাকে পরে আর বিয়ে করতে পারে নি। কিন্তু দূর্জয়কেও তিনি মেনে নিতে পারেন নি। বাবার কোন দায়িত্বই ঠিক ভাবে পালন করেন নি। দূর্জয় ছোট থেকেই পিতা-মাতাহীন ভাবে অনাদরে বেড়ে উঠেছে। যার কারণে তার জীবনটা এমন হয়ে উঠেছে। এসব কথা শুনে দূর্জয়ের প্রতি ভীষণ মায়া হয় রূপকথার। সে বুঝতে পারে দূর্জয়ের এত অগোছালো জীবনের জন্য আসলে দায়ী তার পরিস্থিতি। কোন মানুষ তো নিজ থেকে খারাপ পথে বা বাড়ায় না। পরিস্থিতি তাকে খারাপ করে তোলে।

রূপকথা আজ স্কুল শেষে তার একজন ছাত্রীকে টিউশনিতে পড়াতে যায়৷ সেখানে বৃষ্টির জন্য বেরোতে অনেক দেরি হচ্ছিল। রূপকথার বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে আসে।

ছাত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা গলিতে ঢুকতেই রূপকথা বুঝতে পারে কেউ তাকে ফলো করছে। তার ভীষণ ভয় করে। এজন্য সে দ্রুত হাটতে শুরু করে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ তার হাত টেনে ধরে। রূপকথা ভয়ে মিইয়ে যায়৷ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামনে থেকে কেউ বলে ওঠে,”নিজের ভালো চাইলে ওর হাতটা ছেড়ে দে..”

“আবে কে তুই? আমার শিকারকে ছেড়ে দিতে বলছিস এত স্পর্ধা তোর!”

দূর্জয় রাগী মুখ নিয়ে এগিয়ে এসে লোকটির কাছে এসে জোরে একটা লাথি মারে। লোকটা পড়ে যেতেই লোকটার উপরে উঠে তাকে মারতে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রূপকথা বলে ওঠে,”ছেড়ে দিন ওনাকে। লোকটা মরে যাবে।”

দূর্জয় তবুও থামে না। লোকটা জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত প্রহার করে যায়। জ্ঞান হারানোর পরপরই উঠে দাঁড়ায়। রূপকথা দূর্জয়ের দিকে একটা রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”হাতে লেগে থাকা রক্ত গুলো মুছে ফেলুন।”

দূর্জয় রুমালটা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয়৷ রূপকথা খানিক হেসে বলে,”এক বছর থেকে এভাবেই আড়ালে থেকে আমায় সাহায্য করে চলেছেন তাই তো?”

দূর্জয় অবাক হয়ে রূপকথার পানে তাকায়। রূপকথা বলে,”অবাক হচ্ছেন কেন? আমি এতটাই বোকা না যে, কিছু বুঝতে পারব না। আমার এই স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা থেকে শুনতে করে আমার সব অসুস্থতায় আমার খেয়াল রাখার ব্যবস্থা তো আপনিই করেছিলেন। এমনকি আজকের ঘটনার মতো আর কতবার এভাবে আপনি আমায় সেইফ করেছেন। আমি কিন্তু সবটাই জানি।”

দূর্জয় বলে ওঠে,”তোমাকে নিরাপদে রাখা আমার দায়িত্ব।”

রূপকথা বলে,”কেন? আমি আপনার স্ত্রী বলে?”

দূর্জয় এবার একদম চুপ হয়ে যায়। বলার মতো কিছুই আর সে খুঁজে পাচ্ছে না। রূপকথা দূর্জয়ের অনেক কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হয়ে বলে,”যদি স্বামীর সকল দায়িত্ব এভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে স্বামীর অধিকারও তো দেখাতে পারেন, তাইনা?”

“মানে?”

রূপকথা বলে,”আমি এই বিয়েটা এখন মেনে নিয়েছি। এক বছর আগে যেই সম্পর্কে আমরা বাধা পড়েছিলাম সেটাকে অগ্রাহ্য আমরা কেউই করতে পারব না। কারণ সম্পূর্ণ ইসলামি নিয়ম মেনে আমাদের বিয়ে হয়েছে।”

“তোমাকে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু মেনে নিতে হবে না রূপকথা। তুমি চাইলে..আমরা ইসলামি মতে এই সম্পর্কের ইতিও টানতে পারি।”

রূপকথা খানিক রেগে বললো,”কিন্তু আমি এমনটা চাই না। বাড়ি থেকে আমায় ক্রমশ বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এজন্য আজ আমি স্কুলে আসার সময় বাড়িতে বলে এসেছি যে আমি বিবাহিতা!”

“এটা কেন করলে তুমি?!”

“ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। এখন আপনি আমার সাথে আমার বাসায় চলুন। বাড়ির সবাই আমার স্বামীকে দেখতে চেয়েছে। তারা চায় এবার সামাজিক অনুষ্ঠান করে আমাদের বিয়েটা দিতে।”

রূপকথাকে এত স্বাভাবিক ভাবে এসব কথা বলতে দেখে দূর্জয় অবাক হয়ে বলে,”কিন্তু তুমি তো আহনাফকে ভালোবাসো? তাহলে আমাকে কিভাবে বিয়ে করবে তুমি?”

রূপকথা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না দূর্জয়। আহনাফ আর এই পৃথিবীতে নেই। ওর অস্তিত্ব রয়েছে শুধুই আমাদের স্মৃতিতে। আর কারো অপেক্ষায় সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া এটা শুধু গল্পেই মানায় বাস্তবে নয়৷ বাস্তবে আমাদের সবাইকে নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে একটা মেয়েকে। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। এখন যদি আমি আজীবন একা থাকি তাহলে শেষ বয়সে একাকীত্ব আমায় ঘিরে ধরবে৷ আমি সেটা চাইনা। আমি জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত উপভোগ করতে চাই। বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। এর মাধ্যমে আরো নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এই বিয়ে থেকে বঞ্চিত থাকা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কারণ এই বিয়ের মাধ্যমেই একজন নারী মাতৃত্বের সুখ অনুধাবন করে। আর যারা বলে, কাউকে মনে রেখে আজীবন একা থাকতে হবে তারা হয় অতি আবেগী আর নাহয় বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। এই সমাজে একা একটা মেয়ের আজীবন অবিবাহিতা থাকা অভিশাপের মতো। এসব কিছু চিন্তা ভাবনা করেই আমি জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি কি এই সিদ্ধান্তে আমার পাশে থাকবেন?”

দূর্জয় মৃদু হেসে বলে,”অবশ্যই।”

রূপকথা চিন্তামুক্ত হয়৷ দূর্জয় রূপকথার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”কিন্তু আরেকবার ভেবে নাও। আমার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কি সবদিক চিন্তা ভাবনা করেছ? আমার জীবনটা কিন্তু বড্ড অগোছালো। আমার জীবনে এলে তোমায় ঝলসে যেতে হবে।”

“#ঝলসে_যাব_জানি কিন্তু আমি ঝলসে যেতে প্রস্তুত আপনার প্রণয়ে।”

দূর্জয় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই এক বছরে মেয়েটার খেয়াল রাখতে রাখতে কখন যে প্রেমে পড়ে গেছে সেটা নিজেও বুঝতে পারে নি। আজকের দিনটা যেন তার কাছে পুরো স্বপ্নের মতো। যেখানে তার ভালোবাসার মানুষটা নিজে থেকে তার কাছে ধরা দিতে চাইছে। দূর্জয় রূপকথাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার কপালে ভালোবাসার আলতো পরশ এঁকে দিয়ে বলে,”সারাজীবনের জন্য তোমার হাত ধরতে চাই। কখনো এই হাত ছেড়ে যেও না। প্রতি মুহুর্তে ঝলসে আঙ্গার হও, তবুও তুমি আমার রও।”

The End