#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-১৭]
~আফিয়া আফরিন
বাসস্ট্যান্ড পৌঁছানোর আগেই রোদ্দুরের সাথে ওসমান খন্দকারের দেখা হলো। রোদ্দুর অবশ্য উনাকে খেয়াল না করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। উনি নিজেই রোদ্দুরকে ডাকলেন, ‘অ্যাই তুমি আমাদের নতুন চেয়ারম্যান সাহেবের ভাতিজা না? হুমমম…..? এত তাড়াহুড়া করে কোথাও ছুটছ? তা শুনলাম তোমার’ই নাকি বিয়ে হয়েছে। কী করলে বলো তো? বিয়ে করলে অথচ আশেপাশের মানুষজন জানল না। চুপিচুপি এই শুভ কাজটা সেরে ফেলার পেছনে রহস্য কি? তোমাদের আগে থেকে কোনো কাহিনী ছিল নাকি?’
রোদ্দুর থেমে গেল এবং ওনার কথা শুনে ওর ভ্রু জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে গেল। রোদ্দুর পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কোনোকিছু না জেনে আগাম কথা বলছেন কেনো?’
‘আগাম কথা কেন হতে যাবে? চার পাঁচ জন লোক বলাবলি করছিল। তা করবেই তো। তোমার বাপ-চাচার ঠাট-বাট কি কোনো অংশে কম? তার উপর তুমি আবার তাদের বংশের একমাত্র ছেলে। তাই একটু সন্দেহ হচ্ছে। দেখো বাবা, তোমার চাচারা কিন্তু তোমায় সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারে। এগুলা তো ইদানিং ডালভাত। বড় শহরে থাকো, সব তো তোমাদের জানাই আছে।’ তিনি আফসোসের সুরে কথাটা বললেন।
রোদ্দুরের কপালে পরপর কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। এই লোক চায় কি? নামডাক শুনেছে অনেকবার, তাদের বাড়িতে দাদু বেঁচে থাকাকালীন খুব আনাগোনা ছিল। তারপর তো রোদ্দুরের পড়াশোনা’সহ সবকিছু ঢাকাতেই, তাই উনার সাথে খুব একটা আলাপ পরিচয় নেই।
রোদ্দুর বলল, ‘আমার বাবা আমায় যথেষ্ট পড়াশোনা করিয়েছেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। আমার মনে হয় না, আমার পূর্বপুরুষের এসব সম্পত্তি আমার কোনো কাজে আসবে। আসছি কেমন? আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল। আপনি আমাকে সেইভাবে চিনেন না, তবুও আমার কথা ভাবলেন দেখে আরও ভালো লাগল। তবে আসি, আবার এলে আপনার সাথে একসাথে বসে চা খাব এবং আমার বাপ-চাচাদের মতলব শুনব।’
রোদ্দুরের কথাটা অপমানজনক ছিল নাকি সে ভালোর উদ্দেশ্যে বলেছে, ওসমান খন্দকার তা ঠিক বুঝতে পারলেন না। তাই কোন প্রতিক্রিয়া ব্যাতীত নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালেন।
.
রোদ্দুর যে ঘরে নেই, এটা কারোর’ই জানা ছিল না। সন্ধ্যার দিকে ওর খোঁজ পড়ল। নাই…. নাই… কোথাও নাই! ছোটো চাচ্চু ফোন করলেন, রোদ্দুর ফোন রিসিভ করল না। বাড়ির সবাই ভেবে নিল, হয়তো বাহিরে কোথায় গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে। রোদ্দুর এলো না তবে ওর একটা মেসেজ ঠিকই এলো। তখন সবাই বুঝতে পারল যে, পাখি খাঁচা ছেড়ে ফুড়ুৎ!
শিমু এসে ঝিলমিলকে বকাবকি করতে লাগলেন, ‘নিশ্চয়ই তুই কিছু বলেছিস? তোর আসলে স্বভাবটাই খারাপ। একদম কারো ভালো সহ্য হয় না।’
ছোট চাচ্চু সকলকে থামিয়ে বললেন, ‘আরে ভাবি থামেন আপনারা। রাগারাগী করছেন কেনো? রোদ্দুর তো বলল, ওর অফিস আছে। যাওয়ার প্রয়োজন ছিল তাই চলে গেছে। ঝিলমিলের সাথে চেঁচামেচি করে লাভ নাই। আমি কাল ওকে গিয়ে দিয়ে আসব। এই পাখিকেও খুব শীঘ্রই খাঁচায় বন্দী করতে হবে।’
যেই বলা সেই কাজ। ঝিলমিল ঢাকা যেতে আপত্তি করল না। ছোট চাচ্চুর কথায় সুরসুর করে রাজি হয়ে গেল। সকাল সকাল বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছাল। যাওয়ার সময় সকলেই এক রোখা কণ্ঠে তাকে হাজারখানেক সাবধান বাণী শুনিয়ে দিল। ঝিলমিল মনে মনে ভাবল, ‘যাক বাবা, কিছুদিন হোক আর যতদিন’ই হোক; এদের নজরদারি তো আর আমাকে সহ্য করতে হবে না।’
তারপর রওনা দিল। ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বাজে নয়টা। এই সকাল বেলাতেও ভীড়ের মাঝে পা রাখার জো নেই। সেখানে যেখানে গাড়ি আটকে পড়ে, ছাড়ার কোনো নামই নেই। রোদ্দুরের বাসায় পৌঁছাতেই সাড়ে দশটা। রোদ্দুরকে পাওয়া গেল না, গেট লক করা। নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। ছোট চাচ্চু চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘ইশশশ, দেরি করে ফেলেছি রে। তুই ওয়েট কর, আমি রোদ্দুরের সাথে ফোনে কথা বলি।’
‘আচ্ছা।’
ছোট চাচ্চু রোদ্দুরের সাথে ফোনে কথা বলে ঝিলমিলকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলে নিচে নামলেন। ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে এলেন, চাবি নিয়ে। ঝিলমিল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চাবি কোথায় পেলে?’
‘ডুপ্লিকেট চাবি ম্যানেজ করেছি ম্যানেজারের কাছ থেকে।’ তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন, ঝিলমিল’ও পিছু পিছু গেল। সারাজীবন নিজের বাড়িতে ছিল, তাদের বাড়ি’ও ছিল বিশাল। এখন এই ঘরে ঢুকে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবচাইতে ছোট্ট ঘরে সে উপস্থিত হয়েছে। বিরক্তি নিয়ে আশেপাশে তাকাল। ধুর, এই ঘুপচি ঘরে তাকে থাকতে হবে এখন থেকে! এমনিতে সব ঠিকঠাক, রোদ্দুর যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন; এটা আগে থেকেই জানা আছে। তবে এই ছোট্ট ঘরটা যা সুন্দর করে সাজিয়েছে, তাতে ঝিলমিল তার চরম শত্রুর প্রশংসা মুখে না করলেও মনে মনে করতে বাধ্য হলো।
ছোট চাচ্চু ঝিলমিলকে বললেন, ‘তুই থাক এখানে। ঘুরেফিরে সব দেখ। আমি কিছুক্ষণ বাদে আসছি।’
নতুন জায়গা, তবুও ঝিলমিলের ততটা অস্বস্তি হলো না; কখনো কোথাও হয় নাই। সে পরিস্থিতির সাথে খুব ভালো করে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তাই খুশিমনে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মনোয়ার সরকার চলে যাওয়ার পর ঝিলমিল ঘুরে ঘুরে ঘরের প্রতিটা কোণা পর্যবেক্ষণ করল। তাতে আর সময় লাগল, মাত্র দশ মিনিট। বাকি সময় কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে উঁকি মারল। ওমা! এটা রান্নাঘর নাকি মুরগির খোপ? তাদের এলাকার সাবুর মায়ের মুরগির গুলোও তো এর থেকে তিনগুণ।
নাহ, এখানে তো বেশিদিন থাকা যাবে না। দমবন্ধ হয়ে যাবে স্রেফ। গতবছর একবার ঢাকা এসেছিল, তার ছোট মামার বাসায়। কিন্তু রোদ্দুরের এখানে কখনোই আসা হয় নাই, এইবার’ই প্রথম। তাও আবার সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে গেছে এক লহমায়।
ছোট চাচ্চু ফিরে এলেন হাতে কতকগুলো খাবারের প্যাকেট নিয়ে। ঝিলমিলকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই খেয়ে নিস। আর শোন, রোদ্দুরের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করবি না। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই বাড়িতে ফোন করবি। আর হ্যাঁ, রোদ্দুরের সাথে তখন ফোনে কথা হয়েছিল ও আমাকে ওয়েট করতে বলেছে। তোর কথা এখনও জানে না। আমার তো আর অপেক্ষা করার সময় হচ্ছে না, আমি আসছি। ও এলে তোকে দেখে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে।’
ছোট চাচ্চুর চলে যাওয়ার কথা শুনে ঝিলমিলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে মানা করল না, হাসিমুখেই বিদায় দিল। এরপর ফিরে এসে আর কিছুই করার নেই। চারিপাশ স্তব্ধ, নিরব; থেকে থেকে দূর থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। সকাল সকাল উঠার কারণে ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। ঝিলমিল বালিশে হেলান দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আবছা আবছা কীসব স্বপ্ন দেখল, সেসব কিছুই মনে নেই। এরইমধ্যে আর ঘুম ভাঙ্গল না। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। ঝিলমিল ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল। সকাল না রাত; বোঝার চেষ্টা করল। আচমকা মনেও পড়ল না সে কোথায় আছে। আবার কলিংবেল বেজে উঠল। ঝিলমিল উঠে গেল। ও’পাশ থেকে রোদ্দুরের গলার আওয়াজ ভেসে এলো।
‘ছোট চাচ্চু…….।’
ঝিলমিল গিয়ে দরজা খুলে দিল। রোদ্দুর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ঘুমাচ্ছিলে নাকি? আমি তো…..’
এটুকু বলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীর দিকে চোখ পড়ল। কোথায় ছোট চাচ্চু? কোথায় কে? ঝিলমিলকে দেখে সে এতটা অবাক হলো যে কথা বলতেই ভুলে গেল। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলল, ‘তুই এখানে? কখন এসেছিস? আবার কখন যাবি?’
ঝিলমিল এমনি এমনি রোদ্দুরের সাথে রাগারাগী করে না। কথাবার্তার ধরণ কী অভদ্র ছেলেটার! আসতেই পারল না এখন পর্যন্ত, আবার চলে যাওয়ার কথা বলছে। জীবনে আর কতবার বিরক্ত হবে? এত বিরক্ত হতে হতে এখন নিজের প্রতি রাগ লাগে। তাই সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ আমি এখানে। আজকে এসেছি এবং ছোট চাচ্চুর সাথে এসেছি। এখান থেকে আপাতত কোথাও যাচ্ছি না, কিছুদিন থাকব।’
‘মানে কী? তূই এখানে কীভাবে থাকবি?’
‘তুই যেভাবে থাকিস সেভাবেই থাকব।’
রোদ্দুর গলার টাই’টা ঢিলা করে সেটা খুলে একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘অসহ্য, অসহ্য। ছোট চাচ্চু কোথায়? চলে গেছে? তোকে রেখে গেল কেনো আর নিয়েই বা এলো কেনো? আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি সবার কর্মকাণ্ডে।’ তারপর নিজ মনেই কীসব কীসব গজগজ করে বলে গেল। ঝিলমিল কিছু বুঝল না। রোদ্দুর পুনরায় বলল, ‘তুই কি এখানে সত্যি থাকবি?’
‘মিথ্যা থাকা যায় বলে আমার জানা নেই।’
‘ঠিক আছে। এখানে থাকতে হলে ভদ্রভাবে থাকতে হবে। অবশ্যই আমার কথা মেনে চলতে হবে। অবশ্য আমি সবসময় বাসায় থাকি না, তাই তোর মুখটা আমার বেশি দেখতে হবে না। অচেনা শহর, বাসা থেকে বের হবি না। তুই হারায়ে গেলে তার দায় আমি নিতে পারব না। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা আমি আমার বেড শেয়ার করে অভ্যস্ত নয় তাই তুই…..’
রোদ্দুরকে কথা শেষ করতে দিল না ঝিলমিল। নিজে বলল, ‘বেড শেয়ার করতে অভ্যস্ত না হলে হলে আবার সেদিনের মত বারান্দায় থাকিস। সমস্যা কোথায়?’
‘এখানে তোর কোনো ভাঁওতাবাজি চলবে না।’
‘আপাতত কিছু চালাতেও চাচ্ছি না। তোর কথা শেষ তো! এইবার আমার শর্তাবলী শুনে রাখ, যেহেতু আমি তোকে দয়া করে বিয়ে করেই ফেলেছি তাই…’
রোদ্দুর ঝিলমিলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল, ‘তুই আমাকে দয়া করে বিয়ে করেছিস? হাসালি! হাসতে হাসতে আর সত্যি কথা মুখে আসছে না। আমি তোর মত গাধীকে বিয়ে না করলে তোর জীবনেও বিয়ে হতো? কে তোকে বিয়ে করত? একটা মানুষ আমাকে দেখাতে পারবি তুই? পারবি না, পারবি না।’
ঝিলমিল কোমরে হাত গুঁজে বলল, ‘কবুল প্রথম আমি বলেছি তাই বিয়ে আমি আগে তোকে করেছি। এত বড় বড় কথা বলিস না। ছিল তো গার্লফ্রেন্ড একটা। গেল কেন? হুম? তোর এই ত্যাড়ামি আর বাড়াবাড়ি স্বভাবের কারণে না কেউ থাকবে না।’
রোদ্দুর’ও এক রোখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার অতীতে কেউ না কেউ তো ছিল। তোর ছিল? ভেবে দেখ কেনো নাই। কারণ তোর এই দজ্জালরূপী পিশাচিনী স্বভাব।’
ঝিলমিলও কোমর বেঁধে নেমে পড়ল ঝগড়ায়। ঝাড়ি মেরে বলল, ‘আমি পিশাচিনী? ঠিক আছে, একবার যখন এসেই পড়েছি তখন পদে পদে তোর মুন্ডু মটকাবো। তখন বুঝবি, আমাকে এসব আজেবাজে কথা বলার স্বাদ।’
রোদ্দুর হেসে বলল, ‘সময়ে সব দেখা যাবে। কে কাকে মটকায় আর কাকে আস্ত রাখে?’
‘আমিও তাহলে সময়ের অপেক্ষায় থাকলাম। এখন কাজের কথা বলি। তুই তো মনে হয় একাই রান্নাবান্না করিস, এখন আমি যেহেতু তোকে দয়া করে নিজের গলায় ঝুলিয়েছি তাই একবেলার রান্না আমি করে দিব, নো প্রবলেম। আর হ্যাঁ, এই বাড়ির সব কাজ তুই করবি। এতদিন যেহেতু করে এসেছিস, বাদবাকি দিনগুলোতেও করতে পারবি।’
রোদ্দুর সরু চাহনি নিক্ষেপ করে সবগুলো কথা শুনে কোনোরূপ বাক্যব্যয় না করে ফ্রেশ হতে চলে এলো। ফ্রেশ হয়েই বাইরে বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল মনে মনে বলল, ‘এই কাঠখোট্টা স্বভাবের কারণে এই ছেলের গার্লফ্রেন্ড বেচারা ওর কপালে টেকে নাই আর শেষমেষ আমাকে ওর গলায় ঝুলতে হয়েছে।’
রোদ্দুর বেড়িয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর আবার কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। নিশ্চয়ই, রোদ্দুর এসেছে। কিছু একটা ফেলে গেছে নয়ত বাইরে যাওয়ার মত ঘুরে গেছে। ঝিলমিল দরজা খুলে দিল। রোদ্দুরের বদলে সেখানে হাসানকে দেখতে পেল। গতবার হাসান ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। উনি রোদ্দুরের সাথে ঝিলমিলদের বাড়ি ঘুলতে এসেছিল। সেই থেকে টুকটাক পরিচয়।
হাসান ঝিলমিলকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে! তুমি ঝিলমিল না? অনেক বড় হয়ে গেছ তো। কেমন আছো? ঢাকা কবে এলে?’
ঝিলমিল হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিল। হাসান ফের জিজ্ঞেস করল, ‘রোদ্দুর কোথায়?’
‘জানিনা। বাইরে চলে গেল।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো। কতদিন থাকবে?’
ঝিলমিল নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল, ‘আমার মত মুক্তোর গলায় যেহেতু ওই বাঁদর ঝুলে পড়েছে, তাই ঠিক বলতে পারছি না কতদিন থাকব এখানে!’
হাসান বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে কী? বুঝলাম না।’
ঝিলমিল ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। ওদের বিয়ের দিন থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত সব! ঘটনা শুনে তো হাসান স্তব্ধ, হতবাক, হতভম্ব! বিড়বিড় করে বলল, ‘সম্পর্ক বদলে গেল একটি সিগনেচারে!’
.
.
.
চলবে……
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন
হাসান দ্বিধায় পড়ে গেল। ঝিলমিলের কথা আসলেই সত্যি না মিথ্যা, বুঝতে পারল না। তবে ও তাকে মিথ্যা কথাই বা বলবে কেনো? হাসান হেসে ঝিলমিলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো বাইরে। রোদ্দুরকে ফোন করে জানতে পারল, ও আর সৌভিক চার রাস্তার মোড়েই আছে। হাসান দ্রুত পা চালাল সেইদিকে। মিনিট দশেক হাঁটতেই ওদের দু’জনকে একসাথে দেখতে পেল। চুপি চুপি পেছন থেকে গিয়ে হামলা চালাল। রোদ্দুর বলল, ‘আরে তোর ফাজলামির স্বভাব আজও গেল না। বাড়ি থেকে কবে এলি?’
হাসান হেসে বলল, ‘মাম্মা, আমার কথা বাদ। নিজের কথা বলো।’
‘আমার কথা কি বলব? এইতো দেখতেই পাচ্ছিস, জোস আছি।’
হাসান রোদ্দুরের কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘ইয়েস জোস তো থাকবাই, এখন তো তোমার জোস থাকার’ই দিন। তো কাহিনী কতদিন থেকে চলছিল? আমার কিছুই জানতে পারলাম না।’
‘কীসের কাহিনী?’ রোদ্দুর অবুঝের মত প্রশ্ন করল। সৌভিক’ও ওর দিকে জিগাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হাসান রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিয়ে করলি জানালি না?’
আচমকা বিয়ের কথা শুনে রোদ্দুর বিষম খেল। হাতের চা’ও সৌভিকের গায়ে ছলকে পড়ল। সে দু’কদম লাফ দিয়ে পেছনে সরে গেল। অবাক হয়ে বলল, ‘ভাই! তুই বিবাহ করেছিস? এই তোর শালী আছে?’
হাসান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন গিয়ে ঝিলমিলকে দেখলাম। দেখে তো পুরাই অবাক! তারপর আবার ওর মুখ থেকে তোদের বিয়ের কাহিনী শুনে আশ্চর্যের শেষ ধাপে চলে গেছি। হঠাৎ বিয়ে করলি?’
রোদ্দুর বলল, ‘হুমম, হঠাৎ’ই।’
‘কি কারণে?’
‘অনেক কাহিনী। আমি পরে বলব তোদের।”
সৌভিক বলল, ‘কাহিনী বাদ দে। তুই আগে বল, তোর কি শালী আছে। ভাই আমি আজও সিঙ্গেল। তোরা শালা শালী ছাড়া বিয়ে করে আমাকে প্রতিবার বঞ্চিত করিস। আমি আর তোদের দলে নাই।’
হাসান আর সৌভিক দু’জনেই ফুসুরফুসুর করতে লাগল। রোদ্দুর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ভাবল, এখন তার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। যত যাইহোক না কেন, ঝিলমিল একা আছে। এমনিতেই অচেনা শহর, অচেনা জায়গা তার উপর রাত হয়েছে। রোদ্দুর নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই বাড়ি ফেরার তাড়না অনুভব করল। চলেই যাচ্ছিল, সেই সময় সৌভিক পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল।
‘ওই দ্যাখ দ্যাখ, আজকে কত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। এমনি দিন ওকে ঠেলেঠুলে বিদায় করা যায় না। আর আজ? ব্রো, দিস ইজ দ্যা পাওয়ার অফ বিবাহ। আমি যে কেন এখনো সিঙ্গেল ম’র’ছি, আল্লাহ ভালো জানেন। একদিন হুট করে বিয়ে করে ফেলব, তারপর না আর তোদের পাত্তাও দিব না। চিনব’ই না তোদের। জানব’ই না, জীবনে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব ছিল। যা যা, চলে যা। আর আসতে হবে না।’
সাধারণত এই সময়টাই বাড়িতে রোদ্দুরের কোন কিছু করার থাকে না। যার কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথেই সময় কাটায়। এখন বাড়ি ফিরে এসে রাতের এত বড় সময়টা সে কাটাবে কি করে সেটা ভেবেই পাচ্ছে না। ঝিলমিল তো আছে ওর নিজের মত,কী থেকে কী করছে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
রোদ্দুর রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল। ভদ্রতার খাতিরে ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘চা খাবি?’
‘তুই বানাবি? তাহলে খাব না, অসম্ভব।’
‘ভালো হলো। কষ্ট করে আমাকে আবার বাড়তি চা বানাতে হবে না। আমি তো জাস্ট ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম।’ বিড়বিড় করে বলল রোদ্দুর। তারপর নিজেই রান্নাঘরে কিছুক্ষণ খুটুর খুটুর করে চা বানাল, রাতের রান্না’ও হালকার উপর সেরে নিল। ঝিলমিলের সাথে এরইমধ্যে আর কোনো কথা হলো না। যদিও রোদ্দুরের কাজকর্মের প্রতিটা ধাপ সে স্বচক্ষে অবলম্বন করেছে এবং খাবারে কোনোকিছু যেমন অতিরিক্ত লবণ বা মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে দিচ্ছে কিনা সেটাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে।
রোদ্দুর যে কোনোকিছু ভুলে যাওয়ার পাত্র নয়, তা ঝিলমিলের খুব ভালো করেই জানা আছে। সেদিন চায়ের মধ্যে চিনির বদলে লবণ মেশানোর বদলা সে ঠিকই নেবে, কোনো ভুল নেই।
রাতে ঘুমানোর সময় যেহেতু অন্য কোনো ওয়ে নেই, তাই দু’জন মাঝখানে একটা কোলবালিশ রেখে ব্যাড়িকেড দিয়ে দু’পাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। রোদ্দুরের যেহেতু সকালে অফিস তাই সে আগেভাগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল, উঠে প্রতিদিনের মতোই নিজের কাজকর্ম সেরে তৈরি হয়ে নিল। সে চলে যাচ্ছে; প্রথমত, এটা ঝিলমিলকে বলতে হবে দ্বিতীয়ত, গেট লাগাতে হবে।
তাই ঝিলমিলকে ছাড়া ছাড়া ভাবে দু’টো ডাক দিল। সে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।’
‘ডিস্টার্ব আমি তোকে করছি না, তুই আমাকে করছিস। আচ্ছা এত কথা বলার সময় নাই, আমি অফিস যাচ্ছি। দরজা বাহির থেকে লক করে রেখে যাচ্ছি। যদিও তৌর বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, তবুও একটা চাবি আমি টেবিলের উপর রেখে দিলাম। কেউ ডাকাডাকি করলে দরজা খোলার প্রয়োজন নেই।’
রোদ্দুরের যেটুকু বলার প্রয়োজন ছিল, ও সেইটুকু বলে বেরিয়ে গেল।
ঝিলমিল ঘুম থেকে উঠল আরোও অনেকক্ষণ বাদে। উঠেই সর্বপ্রথম বাড়িতে কথা বলল। তারপর ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে উঁকি মারল। ক্ষুধায় পেট চিন চিন করছিল। যাক, রোদ্দুর তাও সকালের নাস্তা তো রেডি করে দিয়ে গেছে। ঝিলমিল ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর সে ঘুম থেকে উঠবে অনেক দেথ করে আর ওর হাসব্যান্ড মুখের সামনে খাবার তুলে ধরবে। রোদ্দুরের সাথে অবশ্য তার স্বপ্নের মানুষের কোনো মিল নেই, তারপর’ও এই একটা দিকে সামান্য মিল পেয়ে শরীরটা ঝড়ঝড়ে লাগল। সে অবশ্যই ঘরে বসে থাকার পাত্রী নয়। ছাদে উঠে গেল। ওখানে একটা মেয়ের সাথে আলাপ হলো। মেয়েটা বয়সে ঝিলমিলের থেকেও অনেকটা ছোট, কথা বলে তাই জানতে পারল। আরও জানল, মেয়েটা বিবাহিত। ওর হ্যাজবেন্ডের সাথে এখানেই থাকে এবং ঝিলমিলের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে’ই থাকে। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। ছাদ থেকে নামার সময় ওই মেয়েটা বলল, ‘ভাবী বিকালে ছাদে আসবেন কিন্তু, গল্প করব।’
আর কথায় সম্মতি জানিয়ে ঝিলমিল নিচে নেমে এলো। ও ঘরে এসে খুটুর খুটুর করতে লাগল। তাদের ওই শহরটাই সুন্দর ছিল, একদম নিরিবিলি, ঘর থেকেই বের হলেই চেনা-পরিচিত কত মুখ! এখানে কেউ নেই। অন্তত মন খুলে কথা তো বলতে হবে নাকি। আর রোদ্দুরকে দেখলে মোটেও ভালোভাবে দু’টো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ও মুখটাকে সবসময় গম্ভীর করে রাখে। মনে হয়, দুনিয়ার সব বৌঝা ওর ঘাড়ে। সে ওসব বোঝা সামলাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সে চেহারা খানা দেখলে আর মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা আসে না। ও যেভাবে ঝাড়ি দিয়ে দিয়ে কথা বলে, ঝিলমিল’ও তাই করে।
সারা দুপুর ঝিলমিল ইউটিউবে কিছু রান্নাবান্নার ভিডিও দেখল। রোদ্দুর যে কী রাঁধে আর কী খায় তা ও নিজেও জানে না। সেসব রান্নার কোনো ছিরি নাই। কাল রাতে খেয়ে সে তো ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। বিদেশি মানুষের মত ঝাল লবণ, মশলা ছাড়া কোনোরকম রান্না।
বিকাল হতেই পাশের বাড়ির ভাবীর কথা রক্ষার্থে ছাদে উঠল। তাকে দেখতে পেল না, কিন্তু মোটামুটি অনেকেই আছে। কিছুক্ষণ পর উনিও এলেন। ওর নাম ইলা, ঝিলমিলের সাথে একদিনেই কেমন বেশ খাতির জমে গেল। অবশ্য এটা ওর জন্য ভালোই হলো, বাড়িতে তানিশা আর রিমঝিম ছিল; সময় কীভাবে কেটে যেতো টের’ই পাওয়া যায় না। এখানে ওদের বয়সী একজনকে পেয়ে মন্দ হয় নাই। ওনার হ্যাজবেন্ডের’ও ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঝিলমিল সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে দেখল, রোদ্দুর চলে এসেছে। এতক্ষণ রেগে বোম হয়ে গেছে, ঝিলমিলকে না দেখতে পেয়ে। অচেনা জায়গায় কোথায় চলে গেল, বুঝতে পারছিল না। ফোনটাও ঘরে রেখে গেছে। রোদ্দুর যেই বাইরে খুঁজতে যাবে, ওমনি ঝিলমিল চলে এসেছে।
রোদ্দুর ওকে সরাসরি ধমক দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী সমস্যা তোর? অপরিচিত জায়গায় কোথায় গিয়েছিলি? চিনিস তুই এখানকার কিছু? ফোন সাথে থাকে না কেনো? সারাদিন তো বকবক করতে থাকিস, এখন চুপ কেনো। বল?’
ঝিলমিল ভড়কে গেল। রোদ্দুর এইভাবে চেঁচামেচি করতে পারে, কিংবা রাগ করতে পারে, এটা ধারণার বাইরে ছিল। এমনিতে সাধারণ রাগারাগীর সাথে ও অভ্যস্থ, কিন্তু এটা এইবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে গেছে। ঝিলমিল উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। রোদ্দুর ফের চেঁচামেচি শুরু করল, ‘তোর কিছু হলে তার দায় সব আমার নিতে হবে। আমি পারব না এসব। যদি এখানে একা থাকতে ভালো না লাগে তাহলে প্লিজ বাড়িতে চলে যা। আমাকে জ্বালাস না, একটু শান্তিতে থাকতে দে। সারাদিন পর বাড়ি ফিরে এসব অত্যাচার আর সহ্য হয় না।’
ঝিলমিল এইবার’ও কিছু বলল না। মন খারাপ করে রোদ্দুরের সামনে থেকে চলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আসলেই তো, রোদ্দুর এত দায় কেনো নিবে? ওর তো কোনো প্রয়োজন’ই ছিল না, অযথা আসছে। আজ রোদ্দুরের কথা শুনে নিজেকে সত্যি ফেলনা মনে হলো। মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল।
.
ঝিলমিলকে এভাবে রাগারাগী করে রোদ্দুরের মনেও অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। বকাঝকা একটু বেশী’ই হয়ে গেছে। রোদ্দুর দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এলো। ঝিলমিলকে দেখতে পেল, মন খারাপ করে রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। এমনিতেই তো সে গাম্ভীর্যতা ছাড়া কথা বলতে পারে না। নিজের মনেই মাঝে মাঝে ভাবে, তার মুখ থেকে কি ধমকাধমকি ছাড়া বেরোয় না! আশ্চর্য।
গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে ঝিলমিলের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নে। আর সরি।’
ঝিলমিল রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। রোদ্দুর ফের বলল, ‘কি হলো? নে।’
‘খেতে চাই নাই তো।’
‘না চাইলি। আমি দিচ্ছি তাই চুপচাপ নিবি।’ রোদ্দুর ঝিলমিলের হাতে জোর করেই চায়ের কাপটা দিল। ঝিলমিল সেটা রেলিংয়ের উপর রেখে আবারও সামনে তাকাল। রোদ্দুর বলল, ‘আসলে আমি সরি। তোকে তখন ওভাবে বলা আমার উচিত হয় নাই। আসলে বাড়ি এসে দেখলাম তুই নাই, ফোন করে দেখি ফোনটা বাড়িতে ফেলে গেছিস। অচেনা শহর, অচেনা পরিবেশ, যেখানেই যাস চিনে বাড়ি আসতে পারবি কিনা বুঝতে পারছিলাম না।’
ঝিলমিল ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘ওকে।’
রোদ্দুর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ঘুরতে যাবি? চল, কোথাও থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’
‘ইচ্ছে নেই।’
‘তোর ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই? বিশ্বাস করতে বলিস এই কথা? আধা ঘন্টার মাথায় রেডি হয়ে নে। আর কোনো কথা চলবে না।’
ঘুরতে যেতে আসলেই ঝিলমিলের বাঁধা নেই। সে তো সর্বক্ষণ ঘোরাফেরার চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু একটু আগে যেহেতু রোদ্দুর ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বকাবকি করেছে, তাই সামান্য ইগো তো দেখানো যেতেই পারে! তবে রোদ্দুরের ভেতর অপরাধবোধটুকু জাগ্রত ছিল, বিধায় অনেক অনুনয় বিনয় করে ঝিলমিলকে রাজী করাল। সে অবশ্য মনে মনে খুশি হলো, এটাই তো চাচ্ছিল। তারপর রোদ্দুরের সাথে বেরিয়ে পড়ল।
অচেনা একটা শহর, পাশেই দীর্ঘদিনের পরিচিত একটা মানুষ; কিন্তু তাকে ঠিক উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। যাবে কীভাবে? সে তো অনুভূতি থেকে জনম জনম দূরের মানুষ।
চাঁদনি রাত! একটা জমিদার বাড়ির উঠোন, চাঁদের আলোয় আলোকিত চারিপাশ। না আলাে না আঁধার এমন এক রহস্যের মায়াজাল আবদ্ধ করে ঘিরে রেখেছে। চাঁদের আলােয় চিকচিক করে দূর থেকেই সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন এবং পুরো বাড়িটা। বাড়ির পেছনে বাঁশবনে মৃদু বাতাসে পাতার শব্দ ভেসে আসছে, ওপাশে চাঁদ যেনো কোলাকুলি করছে মাটির বসুধায়। এত সুন্দর! এত নিরিবিলি! ঝিলমিল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। তার দু’চোখ বোধহয় অন্তরে কোন মাধুর্যের ছোঁয়ায় পুলকিত হয়ে উঠেছে। ঝিলমিলের খুব ইচ্ছে করল, চাঁদের আলো ছুঁয়ে দিতে; সামান্য সময়ের জন্য স্পর্শ করতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়, অতঃপর এই অসম্ভব বায়না করতে ইচ্ছে করছে খুউব করে। কার কাছে করবে? রোদ্দুরের কাছে? কখনোই না।
একটু বাদেই ওরা ওই জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রোদ্দুর বাড়ির দিকে পা বাড়াল না। ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরও ঘুরবি?’
ঝিলমিল নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি তো ঘুরতে চাই নাই। তুই না জোর করে নিয়ে এলি। এখন ঘোরাঘুরির বিষয়টা তোর উপর ডিপেন্ড করে। আমি আবার কিছু বলতে গেলেই উড়ে আসবি। তারচেয়ে থাকুক…..।’
‘তুই কি সোজাভাবে কথা বলতে পারিস না?’
ঝিলমিল চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘আমি তো সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে আছি। একটু আগের কথাটা কি গলা বাঁকা করে বলেছি। এইতো এখন সোজা, একদম স্ট্রেইট! ঠিক আছে?’
রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকে উঠে বসল। স্টার্ট দিয়ে ইশারায় ঝিলমিলকে উঠে বসতে বলল। ঝিলমিল বসতেই রোদ্দুরের সাথে আচমকা সানিয়ার চোখাচোখি হয়ে গেল।
.
.
.
চলবে……
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন
হাসান দ্বিধায় পড়ে গেল। ঝিলমিলের কথা আসলেই সত্যি না মিথ্যা, বুঝতে পারল না। তবে ও তাকে মিথ্যা কথাই বা বলবে কেনো? হাসান হেসে ঝিলমিলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো বাইরে। রোদ্দুরকে ফোন করে জানতে পারল, ও আর সৌভিক চার রাস্তার মোড়েই আছে। হাসান দ্রুত পা চালাল সেইদিকে। মিনিট দশেক হাঁটতেই ওদের দু’জনকে একসাথে দেখতে পেল। চুপি চুপি পেছন থেকে গিয়ে হামলা চালাল। রোদ্দুর বলল, ‘আরে তোর ফাজলামির স্বভাব আজও গেল না। বাড়ি থেকে কবে এলি?’
হাসান হেসে বলল, ‘মাম্মা, আমার কথা বাদ। নিজের কথা বলো।’
‘আমার কথা কি বলব? এইতো দেখতেই পাচ্ছিস, জোস আছি।’
হাসান রোদ্দুরের কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘ইয়েস জোস তো থাকবাই, এখন তো তোমার জোস থাকার’ই দিন। তো কাহিনী কতদিন থেকে চলছিল? আমার কিছুই জানতে পারলাম না।’
‘কীসের কাহিনী?’ রোদ্দুর অবুঝের মত প্রশ্ন করল। সৌভিক’ও ওর দিকে জিগাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
হাসান রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিয়ে করলি জানালি না?’
আচমকা বিয়ের কথা শুনে রোদ্দুর বিষম খেল। হাতের চা’ও সৌভিকের গায়ে ছলকে পড়ল। সে দু’কদম লাফ দিয়ে পেছনে সরে গেল। অবাক হয়ে বলল, ‘ভাই! তুই বিবাহ করেছিস? এই তোর শালী আছে?’
হাসান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন গিয়ে ঝিলমিলকে দেখলাম। দেখে তো পুরাই অবাক! তারপর আবার ওর মুখ থেকে তোদের বিয়ের কাহিনী শুনে আশ্চর্যের শেষ ধাপে চলে গেছি। হঠাৎ বিয়ে করলি?’
রোদ্দুর বলল, ‘হুমম, হঠাৎ’ই।’
‘কি কারণে?’
‘অনেক কাহিনী। আমি পরে বলব তোদের।”
সৌভিক বলল, ‘কাহিনী বাদ দে। তুই আগে বল, তোর কি শালী আছে। ভাই আমি আজও সিঙ্গেল। তোরা শালা শালী ছাড়া বিয়ে করে আমাকে প্রতিবার বঞ্চিত করিস। আমি আর তোদের দলে নাই।’
হাসান আর সৌভিক দু’জনেই ফুসুরফুসুর করতে লাগল। রোদ্দুর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে ভাবল, এখন তার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। যত যাইহোক না কেন, ঝিলমিল একা আছে। এমনিতেই অচেনা শহর, অচেনা জায়গা তার উপর রাত হয়েছে। রোদ্দুর নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই বাড়ি ফেরার তাড়না অনুভব করল। চলেই যাচ্ছিল, সেই সময় সৌভিক পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল।
‘ওই দ্যাখ দ্যাখ, আজকে কত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। এমনি দিন ওকে ঠেলেঠুলে বিদায় করা যায় না। আর আজ? ব্রো, দিস ইজ দ্যা পাওয়ার অফ বিবাহ। আমি যে কেন এখনো সিঙ্গেল ম’র’ছি, আল্লাহ ভালো জানেন। একদিন হুট করে বিয়ে করে ফেলব, তারপর না আর তোদের পাত্তাও দিব না। চিনব’ই না তোদের। জানব’ই না, জীবনে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব ছিল। যা যা, চলে যা। আর আসতে হবে না।’
সাধারণত এই সময়টাই বাড়িতে রোদ্দুরের কোন কিছু করার থাকে না। যার কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথেই সময় কাটায়। এখন বাড়ি ফিরে এসে রাতের এত বড় সময়টা সে কাটাবে কি করে সেটা ভেবেই পাচ্ছে না। ঝিলমিল তো আছে ওর নিজের মত,কী থেকে কী করছে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
রোদ্দুর রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল। ভদ্রতার খাতিরে ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘চা খাবি?’
‘তুই বানাবি? তাহলে খাব না, অসম্ভব।’
‘ভালো হলো। কষ্ট করে আমাকে আবার বাড়তি চা বানাতে হবে না। আমি তো জাস্ট ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম।’ বিড়বিড় করে বলল রোদ্দুর। তারপর নিজেই রান্নাঘরে কিছুক্ষণ খুটুর খুটুর করে চা বানাল, রাতের রান্না’ও হালকার উপর সেরে নিল। ঝিলমিলের সাথে এরইমধ্যে আর কোনো কথা হলো না। যদিও রোদ্দুরের কাজকর্মের প্রতিটা ধাপ সে স্বচক্ষে অবলম্বন করেছে এবং খাবারে কোনোকিছু যেমন অতিরিক্ত লবণ বা মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে দিচ্ছে কিনা সেটাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে।
রোদ্দুর যে কোনোকিছু ভুলে যাওয়ার পাত্র নয়, তা ঝিলমিলের খুব ভালো করেই জানা আছে। সেদিন চায়ের মধ্যে চিনির বদলে লবণ মেশানোর বদলা সে ঠিকই নেবে, কোনো ভুল নেই।
রাতে ঘুমানোর সময় যেহেতু অন্য কোনো ওয়ে নেই, তাই দু’জন মাঝখানে একটা কোলবালিশ রেখে ব্যাড়িকেড দিয়ে দু’পাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। রোদ্দুরের যেহেতু সকালে অফিস তাই সে আগেভাগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল, উঠে প্রতিদিনের মতোই নিজের কাজকর্ম সেরে তৈরি হয়ে নিল। সে চলে যাচ্ছে; প্রথমত, এটা ঝিলমিলকে বলতে হবে দ্বিতীয়ত, গেট লাগাতে হবে।
তাই ঝিলমিলকে ছাড়া ছাড়া ভাবে দু’টো ডাক দিল। সে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।’
‘ডিস্টার্ব আমি তোকে করছি না, তুই আমাকে করছিস। আচ্ছা এত কথা বলার সময় নাই, আমি অফিস যাচ্ছি। দরজা বাহির থেকে লক করে রেখে যাচ্ছি। যদিও তৌর বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, তবুও একটা চাবি আমি টেবিলের উপর রেখে দিলাম। কেউ ডাকাডাকি করলে দরজা খোলার প্রয়োজন নেই।’
রোদ্দুরের যেটুকু বলার প্রয়োজন ছিল, ও সেইটুকু বলে বেরিয়ে গেল।
ঝিলমিল ঘুম থেকে উঠল আরোও অনেকক্ষণ বাদে। উঠেই সর্বপ্রথম বাড়িতে কথা বলল। তারপর ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে উঁকি মারল। ক্ষুধায় পেট চিন চিন করছিল। যাক, রোদ্দুর তাও সকালের নাস্তা তো রেডি করে দিয়ে গেছে। ঝিলমিল ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর সে ঘুম থেকে উঠবে অনেক দেথ করে আর ওর হাসব্যান্ড মুখের সামনে খাবার তুলে ধরবে। রোদ্দুরের সাথে অবশ্য তার স্বপ্নের মানুষের কোনো মিল নেই, তারপর’ও এই একটা দিকে সামান্য মিল পেয়ে শরীরটা ঝড়ঝড়ে লাগল। সে অবশ্যই ঘরে বসে থাকার পাত্রী নয়। ছাদে উঠে গেল। ওখানে একটা মেয়ের সাথে আলাপ হলো। মেয়েটা বয়সে ঝিলমিলের থেকেও অনেকটা ছোট, কথা বলে তাই জানতে পারল। আরও জানল, মেয়েটা বিবাহিত। ওর হ্যাজবেন্ডের সাথে এখানেই থাকে এবং ঝিলমিলের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে’ই থাকে। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করল। ছাদ থেকে নামার সময় ওই মেয়েটা বলল, ‘ভাবী বিকালে ছাদে আসবেন কিন্তু, গল্প করব।’
আর কথায় সম্মতি জানিয়ে ঝিলমিল নিচে নেমে এলো। ও ঘরে এসে খুটুর খুটুর করতে লাগল। তাদের ওই শহরটাই সুন্দর ছিল, একদম নিরিবিলি, ঘর থেকেই বের হলেই চেনা-পরিচিত কত মুখ! এখানে কেউ নেই। অন্তত মন খুলে কথা তো বলতে হবে নাকি। আর রোদ্দুরকে দেখলে মোটেও ভালোভাবে দু’টো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ও মুখটাকে সবসময় গম্ভীর করে রাখে। মনে হয়, দুনিয়ার সব বৌঝা ওর ঘাড়ে। সে ওসব বোঝা সামলাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সে চেহারা খানা দেখলে আর মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা আসে না। ও যেভাবে ঝাড়ি দিয়ে দিয়ে কথা বলে, ঝিলমিল’ও তাই করে।
সারা দুপুর ঝিলমিল ইউটিউবে কিছু রান্নাবান্নার ভিডিও দেখল। রোদ্দুর যে কী রাঁধে আর কী খায় তা ও নিজেও জানে না। সেসব রান্নার কোনো ছিরি নাই। কাল রাতে খেয়ে সে তো ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। বিদেশি মানুষের মত ঝাল লবণ, মশলা ছাড়া কোনোরকম রান্না।
বিকাল হতেই পাশের বাড়ির ভাবীর কথা রক্ষার্থে ছাদে উঠল। তাকে দেখতে পেল না, কিন্তু মোটামুটি অনেকেই আছে। কিছুক্ষণ পর উনিও এলেন। ওর নাম ইলা, ঝিলমিলের সাথে একদিনেই কেমন বেশ খাতির জমে গেল। অবশ্য এটা ওর জন্য ভালোই হলো, বাড়িতে তানিশা আর রিমঝিম ছিল; সময় কীভাবে কেটে যেতো টের’ই পাওয়া যায় না। এখানে ওদের বয়সী একজনকে পেয়ে মন্দ হয় নাই। ওনার হ্যাজবেন্ডের’ও ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঝিলমিল সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে দেখল, রোদ্দুর চলে এসেছে। এতক্ষণ রেগে বোম হয়ে গেছে, ঝিলমিলকে না দেখতে পেয়ে। অচেনা জায়গায় কোথায় চলে গেল, বুঝতে পারছিল না। ফোনটাও ঘরে রেখে গেছে। রোদ্দুর যেই বাইরে খুঁজতে যাবে, ওমনি ঝিলমিল চলে এসেছে।
রোদ্দুর ওকে সরাসরি ধমক দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী সমস্যা তোর? অপরিচিত জায়গায় কোথায় গিয়েছিলি? চিনিস তুই এখানকার কিছু? ফোন সাথে থাকে না কেনো? সারাদিন তো বকবক করতে থাকিস, এখন চুপ কেনো। বল?’
ঝিলমিল ভড়কে গেল। রোদ্দুর এইভাবে চেঁচামেচি করতে পারে, কিংবা রাগ করতে পারে, এটা ধারণার বাইরে ছিল। এমনিতে সাধারণ রাগারাগীর সাথে ও অভ্যস্থ, কিন্তু এটা এইবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে গেছে। ঝিলমিল উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। রোদ্দুর ফের চেঁচামেচি শুরু করল, ‘তোর কিছু হলে তার দায় সব আমার নিতে হবে। আমি পারব না এসব। যদি এখানে একা থাকতে ভালো না লাগে তাহলে প্লিজ বাড়িতে চলে যা। আমাকে জ্বালাস না, একটু শান্তিতে থাকতে দে। সারাদিন পর বাড়ি ফিরে এসব অত্যাচার আর সহ্য হয় না।’
ঝিলমিল এইবার’ও কিছু বলল না। মন খারাপ করে রোদ্দুরের সামনে থেকে চলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আসলেই তো, রোদ্দুর এত দায় কেনো নিবে? ওর তো কোনো প্রয়োজন’ই ছিল না, অযথা আসছে। আজ রোদ্দুরের কথা শুনে নিজেকে সত্যি ফেলনা মনে হলো। মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল।
.
ঝিলমিলকে এভাবে রাগারাগী করে রোদ্দুরের মনেও অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। বকাঝকা একটু বেশী’ই হয়ে গেছে। রোদ্দুর দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এলো। ঝিলমিলকে দেখতে পেল, মন খারাপ করে রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। এমনিতেই তো সে গাম্ভীর্যতা ছাড়া কথা বলতে পারে না। নিজের মনেই মাঝে মাঝে ভাবে, তার মুখ থেকে কি ধমকাধমকি ছাড়া বেরোয় না! আশ্চর্য।
গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে ঝিলমিলের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নে। আর সরি।’
ঝিলমিল রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। রোদ্দুর ফের বলল, ‘কি হলো? নে।’
‘খেতে চাই নাই তো।’
‘না চাইলি। আমি দিচ্ছি তাই চুপচাপ নিবি।’ রোদ্দুর ঝিলমিলের হাতে জোর করেই চায়ের কাপটা দিল। ঝিলমিল সেটা রেলিংয়ের উপর রেখে আবারও সামনে তাকাল। রোদ্দুর বলল, ‘আসলে আমি সরি। তোকে তখন ওভাবে বলা আমার উচিত হয় নাই। আসলে বাড়ি এসে দেখলাম তুই নাই, ফোন করে দেখি ফোনটা বাড়িতে ফেলে গেছিস। অচেনা শহর, অচেনা পরিবেশ, যেখানেই যাস চিনে বাড়ি আসতে পারবি কিনা বুঝতে পারছিলাম না।’
ঝিলমিল ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘ওকে।’
রোদ্দুর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ঘুরতে যাবি? চল, কোথাও থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’
‘ইচ্ছে নেই।’
‘তোর ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই? বিশ্বাস করতে বলিস এই কথা? আধা ঘন্টার মাথায় রেডি হয়ে নে। আর কোনো কথা চলবে না।’
ঘুরতে যেতে আসলেই ঝিলমিলের বাঁধা নেই। সে তো সর্বক্ষণ ঘোরাফেরার চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু একটু আগে যেহেতু রোদ্দুর ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বকাবকি করেছে, তাই সামান্য ইগো তো দেখানো যেতেই পারে! তবে রোদ্দুরের ভেতর অপরাধবোধটুকু জাগ্রত ছিল, বিধায় অনেক অনুনয় বিনয় করে ঝিলমিলকে রাজী করাল। সে অবশ্য মনে মনে খুশি হলো, এটাই তো চাচ্ছিল। তারপর রোদ্দুরের সাথে বেরিয়ে পড়ল।
অচেনা একটা শহর, পাশেই দীর্ঘদিনের পরিচিত একটা মানুষ; কিন্তু তাকে ঠিক উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। যাবে কীভাবে? সে তো অনুভূতি থেকে জনম জনম দূরের মানুষ।
চাঁদনি রাত! একটা জমিদার বাড়ির উঠোন, চাঁদের আলোয় আলোকিত চারিপাশ। না আলাে না আঁধার এমন এক রহস্যের মায়াজাল আবদ্ধ করে ঘিরে রেখেছে। চাঁদের আলােয় চিকচিক করে দূর থেকেই সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন এবং পুরো বাড়িটা। বাড়ির পেছনে বাঁশবনে মৃদু বাতাসে পাতার শব্দ ভেসে আসছে, ওপাশে চাঁদ যেনো কোলাকুলি করছে মাটির বসুধায়। এত সুন্দর! এত নিরিবিলি! ঝিলমিল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। তার দু’চোখ বোধহয় অন্তরে কোন মাধুর্যের ছোঁয়ায় পুলকিত হয়ে উঠেছে। ঝিলমিলের খুব ইচ্ছে করল, চাঁদের আলো ছুঁয়ে দিতে; সামান্য সময়ের জন্য স্পর্শ করতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়, অতঃপর এই অসম্ভব বায়না করতে ইচ্ছে করছে খুউব করে। কার কাছে করবে? রোদ্দুরের কাছে? কখনোই না।
একটু বাদেই ওরা ওই জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রোদ্দুর বাড়ির দিকে পা বাড়াল না। ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আরও ঘুরবি?’
ঝিলমিল নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি তো ঘুরতে চাই নাই। তুই না জোর করে নিয়ে এলি। এখন ঘোরাঘুরির বিষয়টা তোর উপর ডিপেন্ড করে। আমি আবার কিছু বলতে গেলেই উড়ে আসবি। তারচেয়ে থাকুক…..।’
‘তুই কি সোজাভাবে কথা বলতে পারিস না?’
ঝিলমিল চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘আমি তো সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে আছি। একটু আগের কথাটা কি গলা বাঁকা করে বলেছি। এইতো এখন সোজা, একদম স্ট্রেইট! ঠিক আছে?’
রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইকে উঠে বসল। স্টার্ট দিয়ে ইশারায় ঝিলমিলকে উঠে বসতে বলল। ঝিলমিল বসতেই রোদ্দুরের সাথে আচমকা সানিয়ার চোখাচোখি হয়ে গেল।
.
.
.
চলবে……
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৬৭২