ঝিলমিল রোদ্দুরে পর্ব-১৯+২০+২১

0
455

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-১৯]
~আফিয়া আফরিন

সানিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোদ্দুরের গমনপথে তাকিয়ে রইল। ওকে দেখেও এভাবে ইগনোর করে অন্য একটা মেয়েকে নিজের বাইকের পেছনে নিয়ে উড়াল দিল। আশ্চর্য! সানিয়া রাগ লাগল ভীষণ। অধিকারবোধ এমন একটা বিষয় যা যখন ত খাটানো উচিত তখন আমরা হেলাফেলা করি, দাম দিই না। আর যখন আমরা অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসে তখন অধিকারবোধ খাটানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সানিয়ার হয়েছে সেই দশা। রোদ্দুর তাকে সবসময় সবক্ষেত্রে একটা শাসনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে রাখত, ঘুরেফিরে সেটাই এখন ঠিক মনে হচ্ছে। তানভীর একদম ওর মত না। ওই ছেলেটা সবসময় সবকিছু আবেগ, অনুভূতি ঠাট্টার ছলে নিয়ে হেসে উড়িয়ে দেয়। আর রোদ্দুর, সে সম্পর্কের প্রতিটি পর্যায়কে সম্মান করত।
সানিয়া এতদিন ভেবে নিয়েছিল, যেভাবেই হোক রোদ্দুরকে কনফেস করার চেষ্টা করবে‌। সাময়িক রাগ থেকে আর কতদিন দূরে থাকবে? সে না হয় ভুল করেই একটা ভুল করে ফেলেছে, তার শাস্তি আর কতটা কঠিন হবে! কিন্তু আজ এই মেয়েটাকে রোদ্দুরের সাথে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নতুন গার্লফ্রেন্ড কি? এত্ত তাড়াতাড়ি?
.
রোদ্দুর ঝিলমিলকে নিয়ে রাতের খাবার খেয়েই বাড়ি ফিরল, সাড়ে দশটার পর। ঝিলমিলের মনমেজাজ এখন ফুরফুরে। ঘুরে এসে, বাহিরের হাওয়া বাতাস গায়ে লাগিয়ে শান্তি লাগছে। কোনোরকম ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে এসে সরাসরি কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাড়িতে ফোন করে দাদির সাথে কথা বলছিল।
দাদি হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘বলেছিলি, বিয়ে করবি না আমার দাদুভাইকে। এখন? এখন তো ঠিকই ঘুরতে যাস। স্বামীর আদর সোহাগে চেহারাই পাল্টে গেছে।’

ঝিলমিল ভুরু কুঁচকে বলল, ‘একদম বাজে কথা বলবে না। এখানে এসে যে কী মুশকিলের মধ্যে আছি আমি, যা বলার মত নয়। ছোট চাচ্চুকে বলো না, আমাকে এসে নিয়ে যেতে! একা একা যাওয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

‘কেনো রে? ওখান থেকে চলে আসবি কেনো? প্রথম প্রথম একটু মুশকিল হবেই, ও সবার’ই হয়। তাই বলে নিজের স্বামীকে ছেড়ে চলে আসবি? ব্যাটা মানুষকে শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয়। তবে আশেপাশে বেড়াজাল তৈরি করতে হয় না। তুই ওখানেই থাক। দাদুভাই যখন আসবে, তখন ওর সাথে আসবি এবং ও চলে গেলে তুই’ও যাবি। বিয়ের পর পুরুষ মানুষের একা থাকতে নেই, বউ ছাড়া……’ উনি সব ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কথা বলতে লাগলেন। ঝিলমিল চোখমুখ খিচে, কানে হাত দিল। তারপর আরেক হাতে দ্রুত স্পিকার অফ ছিল। ভাগ্যিস রোদ্দুর আশেপাশে নাই, শুনে ফেললে মানসম্মানের আর কিছু বাকি থাকবে না। দাদির ভয়ানক কথা থেকে বাঁচার জন্য সে ঘুমানোর ভান করে ফোন কেটে দিল। সত্যিই অবশ্য ঘুম পেয়েছে। গতদিনের মত আজও মাঝখানে ব্যাড়িকেড দিয়ে ও একপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
রোদ্দুরের চায়ের নেশা আছে। চা না হলে ওর চলেই না। এতক্ষণ রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল। এসে দেখল ঝিলম শুয়ে পড়েছে। সে নিজেও ল্যাপটপ’টা নিয়ে একপাশে বসে পড়ল। চায়ের কাপটা রেখে দিল পাশের ছোট্ট টেবিলে। অনেকটা সময় নিয়ে একধ্যানে কাজ করে গেল। হঠাৎ ফোনের টিং টিং আওয়াজ মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করল। রোদ্দুর বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নাম্বার থেকে কয়েকটা মেসেজ এসেছে। সে মেসেজ গুলো
পড়তে আরম্ভ করল—
‘তোমার সাথে আজকে একটা মেয়েকে দেখলাম। ও তোমার কে হয়?’
‘প্লিজ আনসার মি রোদ্দুর।’
‘আমি ভুল করেছি, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। বাট তুমি আমার সাথে চিট করছ! ইটস্ নট ফেয়ার। আমি কোনোভাবেই মানব না এসব।’
‘তুমি আমার সাথে সময় করে একটু দেখা করো। আমি আমার না বলা কথাগুলো বলতে চাই, প্লিজ। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। আই রিয়্যালি লাভ ইউ!’
রোদ্দুরকে কেউ বলে দিল না, কিন্তু মেসেজের এবং কথাবার্তার ধরন দেখে সে বুঝতে পারল এটা নিশ্চিত সানিয়া। আজ তো দেখেছিল, ঝিলমিল সাথে থাকা ছাড়াও সে কথা বলত না। আর বলছে ক্ষমা চাওয়ার কথা? ক্ষমা তো অনেকবার করে ফেলেছে, তার ফলও পেয়েছে। আর কতবার ক্ষমা করবে? এখন তো ক্ষমা করার কোন চান্স নেই। ক্ষমা করলেও, জীবনে ফিরিয়ে আনার কোনো অপশন নেই। অবশ্য সে দ্বিতীয়বার এই ভুল করতেও চায় না। রোদ্দুর সানিয়ার মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না, ফোন ভাইব্রেট করে কানে হেডফোন গুঁজল।
ওইদিকে সানিয়া ফোন দিতেই আছে। বোধহয় নিজের কাছে পণ করেছে, রোদ্দুর যতক্ষণ না ফোন রিসিভ করবে ততক্ষণ ওকে জ্বালাতেই থাকবে। ফোনের কাঁপুনিতে ঝিলমিলের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওইদিকে রোদ্দুরের ধ্যানজ্ঞান এইদিকে নেই। ঝিলমিল ঘুমের ঘোরে ফোন হাতে নিল, ভাবল নিজের ফোন ভাইব্রেট করতেছে। রিসিভ করে কানে তুলতেই ভেসে এলো, ‘এতক্ষণ যাবত ফোন করছি কোনো গুরুত্ব দিচ্ছো না। এতটাই গুরুত্বহীন হয়ে গেছি আমি তোমার জীবনে? নতুন কাউকে পেয়ে এখন আমাকে ভুলে গেছ? আমি তোমার এই ব্যবহার একদম নিতে পারছি না। তুমি প্লিজ আমার সাথে দেখা করো। তোমার সাথে আমার কথা আছে। আমি কিছু কথা বলতে চাই, মন দিয়ে শুনো। সেইদিনের ঘটনার পর তুমি আমাকে কথা বলার কোন সুযোগ’ই দিচ্ছো না। মানুষ তো ফাঁ’সির আসামিকেও তার শেষ ইচ্ছে পূরণের সুযোগ দেয়। আর…..’
তৎক্ষণাৎ ঝিলমিল বুঝতে পারল, এটা রোদ্দুরের ফোন। সে দ্রুত ফোন কেটে দিল, তারপর ফোনটা রেখে উঠে বসল। পাশে তাকিয়ে রোদ্দুরকে দেখল। কাজে এতটাই মত্ত যে আশেপাশে কী ঘটছে তার কোন খেয়ালই নাই।
ঝিলমিল বলল, ‘তোর ফোনের আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল, অথচ তুই নিশ্চিন্তে বসে আছিস?’

ঝিলমিলের কথা শুনে রোদ্দুরের মনোযোগ ভাঙ্গল। সে হেডফোন খুলে বলল, ‘হুঁ? কিছু বললি?’

ঝিলমিল ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেকক্ষণ যাবত তো ফোন বাজছে। কথা বলার হলে কথা বলে নে, নয়তো ফোন অফ করে রাখ। তোর ফোনের আওয়াজে আমার কেন ঘুম ভাঙবে? বিরক্তিকর। এত কার সাথে পিরিতি যে রাতবিরাতে ফোন করতে হবে?’

রোদ্দুর বলল, ‘আচ্ছা সরি।’
তারপর সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, আননোন নাম্বারটা। সানিয়া একেক সময় একেক নাম্বার থেকে ফোন করে। রোদ্দুর ফোন অফ করে দিল। তারপর উঠে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঝিলমিল তখনও বসে আছে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। রোদ্দুর তা খেয়াল করে ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে? শুয়ে পড়।’

‘তোর কাহিনী দেখতেছি। কথা না বলে ফোন অফ করে রাখলি কেন?’

‘তেমন কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কল নয়।’

‘তাহলে এত রাতে কেন ফোন দিচ্ছিল?’ ঝিলমিলের প্রশ্ন।

রোদ্দুর বলল, ‘এটার উত্তর তো যে ফোন দিচ্ছিল, সে বলতে পারবে। আমি কীভাবে বলব।’

‘কে ফোন দিচ্ছিল?’

‘আননোন নাম্বার থেকে কেউ ফোন দিচ্ছিল। আমি জানি না।’ এটুকু বলে রোদ্দুর পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেল অথবা ঘুমের ভান করল। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় অনেকক্ষণ ঝিলমিলের ঘুম এলো না। অযথা জেগে এপাশ ওপাশ করল। তারপর সংখ্যা উল্টোদিক থেকে গুণতে শুরু করল। পঞ্চাশ, ঊনপঞ্চাশ, আটচল্লিশ, সাতচল্লিশ, ছেচল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ….’ একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
গতদিনের মতো আজও রোদ্দুর অফিসে যাওয়ার আগে ঝিলমিলকে সাবধান করে দিয়ে গেল। ঝিলমিল বলল, ‘আমি তো কোথাও যাই না। শুধু ছাদে যাই। গতকাল’ও তাই গেছিলাম।’

‘ওহ আচ্ছা। কিন্তু সেখানে একা কি করিস? এরচেয়ে বাড়িতে বসে থাকা বেটার না?’

‘আমি মোটেও একা থাকি না। পাশের বাসার ভাবি আছে তো। তার সাথেই গল্প করি।’

রোদ্দুর কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘ভাবি? পাশের বাসার? হাউ ইজ ইট পসিবল? আমি এতদিন যাবত এখানে থাকি, আমার সাথে কারো পরিচয় হলো না। আমি কাউকে চিনলাম না, আমার কোনো ভাবি হলো না। আর তুই দুইদিনে ভাবি পাতিয়ে ফেলেছিস! আজিব তো। যাইহোক, সাবধানে থাকিস। ছাদ পর্যন্ত ঠিক আছে, কারো বাসায় যাওয়ার দরকার নেই।’

‘ওটা আমার ব্যাপার, তুই বুঝবি না। যা তো, বের হ। তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে না।’ ঝিলমিল নিজেই রোদ্দুরকে ঠেলেঠুলে বিদায় করে দরজা লাগিয়ে দিল।
রোদ্দুর বাহিরে দাঁড়িয়ে ভাবল, সারা দুনিয়া খুঁজলেও এর মত একটা পাওয়া যাবে না। আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছে, বাহ।
.
ঝিলমিল সকালে টুকটাক করে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কাজ করল। তেমন কিছু না, বিছানা গুছিয়ে রাখল শুধু। এখানে দুই/তিনদিনের মধ্যে নিজেকে চেষ্টা করেছে মানিয়ে নিতে। তবে, রোদ্দুর যে তাকে গতকাল চলে যেতে বলেছে সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় নাই। চলে যাওয়ার কথা বাড়িতে বলাই যায় না, বললেই আগুন লেগে যায়। সবাই চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, ‘কী হচ্ছে ঝিলমিল? রোদ্দুর ওখানে একা আছে, আর তুই ওর বউ হয়ে এখানে চলে আসবি? তোকে এখানে আমরা কয়দিন থাকতে দিব? বেশি হলে দশদিন। এরপর আর এখানে থাকতে পারবি না বাপু।’
এখন ঝিলমিল কি করবে? কোথায় যাবে? সবদিক থেকে বিপদে পড়ে গেছে। বিয়েটা করেই তো মুসিবত। বিয়ে না করলে, তার বাপের বাড়ি তার’ই থাকত। সে নিজেই ‘ধুর ছাই ধুর ছাই’ করে কপাল চাপড়াল।
দুপুরে কোনোরকম রান্না করল। শিউলি ফোন করে জানাল, পরীক্ষার ডেট দিয়েছে আগামী মাসে। এখানে না আসুক, অন্তত পড়াশোনা করা শুরু করে দিক।
আজ বাদে কাল পরীক্ষা, অথচ ঝিলমিল এখনও বই ধরেও দেখে নাই। তাতে অবশ্য সমস্যা হয় না। পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে যদি পাশ করা যায়, তাহলে মানুষ কেনো কষ্ট করে আগে থেকে পড়বে?
পরীক্ষার পাশাপাশি অন্য একটা চিন্তাও ঝিলমিলের মাথায় ঘোরাফেরা করছিল। সেটা হচ্ছে, গত রাতে রোদ্দুরের কাছে ফোন দিয়েছিল কে? ফোন দিয়েও উদ্ভট কথা বলছিল। তাদের দু’জনের বিয়ে হলেও এখনও কেউ সেটা মন থেকে মেনে নিতে পারে নাই। দু’জনেই দু’দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। সেই অনুপাতে, ঝিলমিলের’ও উচিত নয় রোদ্দুরের এই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামানো। কিন্তু ওই যে কৌতুহল! তা দমিয়ে রাখবে কি করে? রোদ্দুর জিজ্ঞেস করলেও হয়ত বলবে না…. বলবেই না। উল্টো আরও ধমক দিয়ে বলবে, ‘সবকিছু এত জানতে চাস কেনো? তোর গোবরপড়া মাথায় পড়াশোনা’ই ঢোকে না, অন্য বিষয় তো দূরেই থাক।’

বিকালে আবারও ছাদে গেল। পাশের বাসার সেই ভাবির সাথে দেখা হলো, গল্পগুজব হলো। রোদ্দুর বাড়ি ফেরার আগেই ঝিলমিল ফিরে এলো, নয়তো ফিরে এসে আবার চেঁচামেচি শুরু করবে। কে শুনবে এত কথা!
.
দু’দিন হয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে রোদ্দুরের দেখা হচ্ছে না। ওরাও ফোন করছে না, কী হয়েছে কে জানে? রোদ্দুর দুপুরে হাসানকে ফোন করেছিল, ও ফোন রিসিভ করল না। বাকিদেরও কোন খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। এইদিকে ওই সময় ঝিলমিলকে বাড়িতে একলা রেখে নিজে বের’ও হতে পারছে না। যথেষ্ট বড় একটা রাত, একা একা করবেই বা কী? অবশ্য রোদ্দুর থাকলেও যে কিছু করে তা নয়, এমনিতেই বকবক করতে করতে মাথা খায়‌।
তবে আজ একটু চৌরাস্তার মোড় যাওয়া প্রয়োজন। ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ও একা থাকতে পারবে কিনা কিছুক্ষণের জন্য?

ঝিলমিল তড়িৎ গতিতে বলল, ‘কেনো? কেনো? তুই কোথায় যাবি?’

‘বাহিরে যাইতাম একটু কাজ আছে।’

‘কাজ? আবার কাজ? আমি একা একা রাতে থাকতে পারব না, সেখানূ যেই কাজ করতে যাবি আমাকেও নিয়ে যা। আমিও যাব, কাজ দেখব।’

রোদ্দুর হতাশ হয়ে বলল, ‘থাক, আমিই যাব না।’

‘সত্যি করে বল তো কোথায় যাবি? আমার আসলেই সন্দেহ হচ্ছে। গতকাল রাতেও কেউ ফোন করল, তারপর তুই ফোনটাই অফ করে রাখলি। তোর হাবভাব ভালো লাগছে না কিন্তু। আমি কিন্তু শাশুড়ি মা’কে ফোন করে বলে দিব তোর কাহিনী।’

‘আরে…. তোকে আমার বাইরে যাওয়ার কথা বলাই ভুল হয়েছে। একটু চুপ থাক প্লিজ। এত বকবক যে করিস সারাদিন, তোর মাথাব্যথা করে না? উফফফ, তোর কথা শুনলে স্রেফ আমার মাথা ভনভন করে।’

‘তোর যে সস্তা মাথা, এইজন্য কথায় কথায় ভনভন করে।’ ঝিলমিল ভেংচি কেটে বলল। দু’জনের বাকবিতন্ডার মাঝেই হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। ঝিলমিল আর রোদ্দুর দু’জনেই চুপ করে দরজার দিকে তাকাল। রোদ্দুর উঠে দরজার দিকে আগাতে নিলেই ঝিলমিল বাচ্চাদের মত দৌড়ে গিয়ে বলল, ‘অ্যাই অ্যাই আমি দরজা খুলব।’
এরপর সে দরজা খুলে সামনে কাউকে দেখতে পেল না। দু’পা বাইরে এসে দাঁড়াতেই কয়েকজন ঘিরে ধরল। উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম ভাবি!’
.
.
.
চলবে……

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২০]
~আফিয়া আফরিন

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিদের দেখে ঝিলমিল একদম থ বনে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই ওর ঠোঁটে কোণে লেগে থাকা সামান্য হাসি বিস্তৃত হয়ে এলো। হাসান হাস্যোজ্জ্বল স্বরে বলল, ‘আমাকে তো চিনতে পেরেছেন ভাবি? বাকিদের সাথেও আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা সবাই রোদ্দুরের বন্ধু। বন্ধু তো বিয়ের কথা আমাদের এতদিনেও নিজের মুখে জানাল না। তাই জেনে নিজেরাই চলে এলাম। আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?’
ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। ওরা এসে একে ঘরে প্রবেশ করল। রোদ্দুর’ও এমন অসময়ে বন্ধুদের দেখে অবাক! ওদের একেকজনের হাতে চকোলেট, ফুলের তোড়া, কেক আরও বিভিন্ন জিনিসপত্র। ওরা ভীষণ ইনোসেন্ট মুখ করে রোদ্দুরকে কংগ্রাচুলেট করল। রোদ্দুর এখনও বিস্ময়ের ভাবটা কাটাতে পারে নাই, এরইমধ্যে ওরা কেক’সহ যাবতীয় অনেককিছু বের করে সাজিয়ে ফেলেছে। আদিয়াত বলছিল, ওর নাকি সময় হবে না বেশিক্ষণ। তাই রায়হান’ও তাড়া দিল। বলল, ‘তুই আর ভাবি মিলে কেক কাট দোস্ত। আমরা তো বিয়েতে ছিলাম, বিয়েও খেলাম না, আপাতত কেক খাই।’

ঝিলমিল তো এক পায়ে খাড়া। রোদ্দুর কী ভাবছে জানা নেই, তবে তার কাছে পুরো বিষয়টা দারুণ লেগেছে। তার উপর আবার ছেলেগুলো কী কিউট করে ‘ভাবি’ সম্মোধন করছে, এটা আরও বেশি জোস!
অবশেষে রোদ্দুর কেক কাটল, ঝিলমিলের হাত ধরে। ওইদিকে হাসান আর সৌভিক হাততালি দিতে দিতে সমস্বরে গাইতে লাগল, ‘রোদ বন্ধুর বিয়ে, টোপড় মাথায় দিয়ে। হৈ হৈ হৈ হৈ, আমাদের বন্ধু গেল কই? আসো সবাই নাচি, প্রাণ খুলে বাঁচি। তাক ধুমা ধুম তা, বিয়ে করে স্বর্গে যা।’

ঝিলমিলের সাথে একমাত্র হাসানের’ই ভালোভাবে পরিচয় ছিল। হাসান যে হাস্যরসিক টাইপের মানুষ এটা জানাই ছিল। কিন্তু ওই ছড়াটা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। রোদ্দুর অনেক অনুনয় বিনয় করল, ওদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তার সম্ভব হলো না। বিদায়কালে রোদ্দুর রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। ঝিলমিল ওদেরকে বারবার বলে দিয়েছে, ‘ভাইয়া আপনারা কিন্তু অবশ্যই আবার আসবেন।’ ওরা তাতে সায় জানাল।
সবাইকে বিদায় দিয়ে রোদ্দুর বাড়ি ফিরতেই ঝিলমিল বলল, ‘দেখ দেখ, তোর বন্ধুরা কত ভালো! ওদের দেখে জীবনে ভালো কিছু শিখতে পারলি না। তুই তো শুধু জানিস, কথার দাড়ি কমায় ধমকাতে।’

‘হ্যাঁ। আমি এমন’ই।’

‘তাহলে তোকে আমায় সারাজীবন এইভাবেই সহ্য করতে হবে? এমন কাঠখোট্টা, মাথামোটা, বদমেজাজি, নাক উঁচু, অহংকারী, দাম্ভিক, উদ্ভট একটা ছেলের সাথে সারাজীবন ভাবাই যায় না।’

‘সহ্য করতে পারলে কর, আর না করতে পারলে….’ রোদ্দুর থেমে গেল। ঝিলমিল কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? পুরো কথা শেষ কর।’

‘কিছু না, এতকিছু ভেবে বলি নাই। এমনি কথার কথা। তুই যে একলা আমার কথা বলছিস, তুই নিজে কি? ঝগড়ি কোথাকার! পান থেকে চুন খসলেই তো আসিস কোমড় বেঁধে ঝগড়া করতে।’

ঝিলমিল দু’পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি ঝগড়া করি?’
রোদ্দুর সেইভাবেই দু’পা পিছে সরে গেল। হেসে বোঝানোর চেষ্টা করল, হ্যাঁ ঠিক এইভাবেই তুই পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে আসিস। ঝিলমিল সেটা বুঝতে পেরে ফুঁসে উঠল বঙ্গোপসাগরে উতলে ওঠা ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের মত। পাশ ফিরতে নিলেই আচমকা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল পেছন দিকে অর্থাৎ রোদ্দুরের উপর। হঠাৎ ওকে নিয়ে তাল সামলাতে না পেরে রোদ্দুর নিজেও পড়ে গেল। বিষয়টা এমন হলো যে, দু’জন নিজেদের গোপনে চুপিচুপি প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ চলে আসায় দু’জন দু’দিকে পালাতে গিয়ে ফের নিজেদের কাছে চলে এসেছে অজান্তেই।
রোদ্দুর থ! ঝিলমিল কী হলো এখনও বুঝতেই পারল না। যখন’ই বোধগম্য হয়েছে যে সে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে তখন দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ওড়নার সাথে পা পেঁচিয়ে আবারও ধপাস! আগেরবার রোদ্দুরের উপর পড়ার কারণে ব্যথা পায় নাই, কিন্তু এইবার রোদ্দুর উঠে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়ে দিল।
এমন একটা পরিস্থিতিতে হাসা উচিত নয় তবুও রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠল। সে নিজেও পড়ে গিয়ে পিঠে, কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু হাসির ছলকে নিজের ব্যথার কথা ভুলে গেল।
ঝিলমিল কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘একজন অসহায় মানুষকে এভাবে হাসাহাসি করা কোন মানবিকতার পরিচয় বলতে পারিস?’

‘ওহো সরি সরি। মুখ ফসকে হাসি বেরিয়ে গেছে বিশ্বাস কর। নে উঠ এখন। এভাবে শুকনো মাটিতে মানুষ যে পরপর দু’বার আছাড় খায় তা তোকে না দেখলে জানতাম না।’
রোদ্দুর হাত বাড়িয়ে দিল ঝিলমিলের উঠার জন্য। ঝিলমিল হাত না ধরেই উল্টো বলল, ‘তুই একটা স্বার্থপর।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, এখন উঠে আয়।’
ঝিলমিল উঠতে গিয়ে বুঝতে পারল ব্যথাটা সে বেশ ভালোভাবেই পেয়েছে। রোদ্দুরের সাহায্যে উঠে বসে ফোন করল বাড়িতে। সবার কাছে কান্নাকাটি করে নালিশ করল, ‘তোমাদের ছেলে আমাকে ফেলে দিয়েছে। মনে হয় কোমড়টা এইবার ভেঙ্গেই গেল।’
রোদ্দুর নির্বিকার ভঙ্গিতে সব শুনছিল। ঝিলমিলের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ও বলল, ‘আমি তোকে ফেলে দিয়েছি? আমার জন্য এখনও আস্ত আসিস। যদি সরাসরি আগেই মেঝেতে পড়তি তবে হাড় হাড্ডি একটাও খুঁজে পাওয়া যেত না।’

‘তোর জন্য’ই তো। তুই কথা বলতে আসিস কেন? আমাকে কেনো বলিস, আমি ঝগড়া করতে আসি!’

রোদ্দুর হেসে বলল, ‘তখন তো জাস্ট মুখে বলেছি এইবার তো প্রমাণ আমি পেয়েই গেলাম সাথে তুই নিজেও দেখলি। প্লিজ এখন কিছু বলিস না। নিজের দোষটা স্বীকার করে নে।’
ঝিলমিল কিছু বলল না, একবার ফুঁসে উঠে পড়ে গিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না এইবার আবার ফুঁসে উঠলে কী থেকে কী যে হয়ে যায়!
.
সুখানপুর ছোটোখাটো একটা মফস্বল শহর হলেও বেশ উন্নত, সবদিক থেকেই। মনোয়ার সরকার কিছুদিন আগে ঝিলমিলের ঘরের জানালায় ঠকঠক করার বিষয়টা পুলিশে জানিয়েছিলেন। আজ হাতে কাজ না থাকায় খোঁজ নিতে এলেন। অফিসার কামরুল হাসান জানালেন, ‘খোঁজখবর করলাম, কিছু পাই নাই তো। সম্ভবত এলাকার কিছু ছ্যাঁচড়া চোর-বাটপারের কাজ। তবুও আমরা বিষয়টা নজরে রেখেছি। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ’ও করা হয়েছে, দেখা যাক কী হয়।’
ইদানিং ওসমান খন্দকার চুপ করে গেছেন, অথচ তিনি চুপ থাকার মানুষ নয়। মনে মনে কোনো ছক কষছেন কিনা কে জানে? মনোয়ার সরকার চায়ের দোকানে এসে তার খোঁজ করা অজ্ঞাত মানুষের খোঁজ নিল। আশ্চর্য, তিনি এসেছিলেন আরও বেশ কয়েকবার। তাকে বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি বাড়িতে যাবেন না। তার একটাই কথা, মনোয়ার সরকারের সাথে তিনি এখানেই দেখা করবেন অথবা পথেঘাটে কখনো যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়! তবে বাড়িতে কিছুতেই যেতে পারবেন না। উনি সেই আগুন্তকের খোঁজ করে বেরাচ্ছেন। যখন তিনি উপস্থিত থাকেন না, তখন তার উপস্থিতি ঘটে!

ফজলুল সরকার’ও এলাকার বিভিন্ন কাজেকর্মে, বিভিন্ন মিটিং নিয়ে ইদানিং ব্যস্ত সময় পার করছেন। বাড়ির ব্যবসা-বাণিজ্যের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বাকি ভাইয়েরা। সবাই একসাথে থাকার ফলে কখনো কিছু নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি হয় নাই। তাদের অন্দরের অবস্থাও একই রকম। সবাই মিলেমিশে, নির্ঝঞ্ঝাট ভাবেই এতকাল সংসার করে আসছে। আজ হঠাৎ মাহফুজ সরকার কিছু বিষয় নিয়ে মন খারাপ করলেন। তাদের পারিবারিক ব্যবসার এইদিক পছন্দ হচ্ছে না, এটা অন্যকারো কাছে বিক্রি করে দেওয়া উচিত, এটা ঠিক হচ্ছে না, ওটা ঠিক হচ্ছে না; নানান মনোমালিন্যের সৃষ্টি হলো। বড়ভাই যেহেতু বাড়িতে নেই তাই সকলেই তার কথা চুপচাপ শুনে গেলেন। প্রত্যুত্তর করলেন না, ফজলুল সরকার এসে সামলাবে সব।
ছেলেরা ব্যবসা-বাণিজ্য ভাগাভাগি চায়, নিজেদের অংশ বিক্রি করে অন্যকিছু করতে চায়— রেহানা খাতুনের কানে এখনও এই সংবাদ পৌঁছায় নাই। শুনলে তিনি নির্ঘাত তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ছাড়বেন। আজ ব্যবসায় ভাগ চাচ্ছে, দু’দিন পর বাড়ি ভাগের জন্য উঠে পড়ে লাগবে। তখন বলবে, ‘আমরা নিজেদের আলাদা আলাদা অ্যাপার্টম্যান্ট চাই। বউ বাচ্চা নিয়ে নিজেদের মতো করে থাকব।’
কখনোই সম্ভব নয়। এটা অনেক আগের বাড়ি, পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন করে। পুরাতন হয়ে গেছে, তবে বছর বছর বাড়ি রং করা হয়; এছাড়াও বিভিন্ন জিনিসপত্রের পরিবর্তন ঘটে যার ফলে কখনো পুরাতন বলে মনে হয় নাই। বাড়ির মেয়ে-বউয়েদের আবার এত অভিযোগ নেই, বরং তাদের একসাথে থেকে থেকে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে এখন আর একলা একলা কিছুতেই সময় কাটতে চায় না। শনিবার আবার তানিশার জম্মদিন, সে বায়না ধরেছে বাড়ির সবাইকে নিয়ে এইবার জমজমাট করে বার্থডে সেলিব্রেট করবে। সেক্ষেত্রে রোদ্দুর আর ঝিলমিলকেও দরকার, ওরা ছাড়া অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ। তানিশা সরাসরি ঝিলমিলকে ফোন করল। বলল, ‘আপু কবে আসবা?’

ঝিলমিল ওপাশ থেকে উত্তর দিল, ‘আর আসব না রেএএ।’

‘ওমা কেনো কি হয়েছে?’

‘পা ভাঙ্গছে আমার। সব দোষ ওই ব্যাটার। তুই জানিস ও কি করছে…….’ ঝিলমিল ননস্টপ রোদ্দুরের দোষ বলতে লাগল। ওর কথা শেষ হলো না, মুখ’ও ব্যথা হলো না। অথচ তানিশার মাথা ঘুরতে লাগল ভনভন করে। রোদ্দুরের শুধু আজকের দোষ না, ও জন্মের পর থেকে কি কি খারাপ করে এসেছে সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেছে। তানিশা পেট ব্যথার দোহাই দিয়ে কোনোরকম ওর বার্থডের খবর দিয়ে ফোন রেখে দিল।
.
রোদ্দুর সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে এসে দেখল, আজ ঝিলমিল ঘরেই আছে। সে গলার টাই খুলতে খুলতে বলল, ‘কিরে আজ তোর পাশের বাসার ভাবি কই?’

ঝিলমিল থমথমে মুখে জবাব দিল, ‘ভাবি আছে ঠিকই কিন্তু আমি নাই।’

‘তুই’ও তো আছিস। এইতো আমি দেখতে পাচ্ছি।’

‘আমার পায়ে ব্যথা। আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না।’

রোদ্দুর কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ওমা! পায়ে ব্যথা? আমি তো ভাবছি এসব ছোটোখাটো ব্যথা তোকে কাবু করতে পারে না।’
ঝিলমিলের কণ্ঠশূণ্য। সারাদিন যে কীভাবে কেটেছে, এটা রোদ্দুর না দেখলেও আন্দাজ করে নিল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, যেটা যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই আছে। অর্থাৎ ঝিলমিল সকালের পর থেকে কিছুই মুখে তোলে নাই। রোদ্দুর একমুহূর্ত কিছু ভেবে ওর জন্য খাবার রেডি করল। তারপর ঘরে গিয়ে বলল, ‘খাওয়া-দাওয়া করিস নাই যে? একদম’ই উঠতে পারিস নাই?’

‘উঠেছি তো। কিন্তু বেশি হাঁটাহাঁটি করলে পায়ে টান লাগে‌। খাই নাই, কারণ ইচ্ছে করে নাই।’
রোদ্দুর আর কথা প্যাঁচাল না। ঝিলমিলকে একটুখানি খাইয়ে দিয়ে রেডি হতে বলল, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ঝিলমিলের কাছে ডাক্তার বড় কথা নয়, সে বাহিরে ঘুরতে পারবে এটাই বড় কথা। তৎক্ষণাৎ সবকিছু চনমনে হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলল, ‘আমার পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে, তুই দ্রুত রেডি হ।’

রোদ্দুর স্বভাবসুলভ তার শাসনের কণ্ঠে বলল, ‘তুই’ও একটা মানুষ, কীভাবে পারিস গিরগিটির মত বদলে যেতে! এইতো খেতে গিয়েও ক্যা কু করলি, আর এখন?’

‘তুই প্লিজ সবকিছু বোঝার চেষ্টা করিস না। সবকিছু বোঝার যোগ্যতা তোর নাই।’
রোদ্দুর চুপ করে বাইরে এসে দাঁড়াল। মিনিট দশেক যেতেই ঝিলমিলের মেসেজ এলো। ‘আমাকে এসে নিয়ে যা। আমি কীভাবে যাব?’

রোদ্দুর মেসেজ পেয়ে মনে মনে বলল, ‘হুমমম, তোর বাপ তো আমারে মাসে মাসে বেতন দিয়ে রাখছে।’
রোদ্দুর উঠে গেল। দরজায় ঝিলমিল ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত ধরে বলল, ‘আয়।’
ঝিলমিল খোঁড়াচ্ছিল। ওখান থেকে লিফট পর্যন্ত যেতেই আর আগাতে পারল না। রোদ্দুর বলল, ‘নে আমার কাঁধে ভর দে। আর কি করবি? আমার জীবন জ্বালিয়ে খাওয়া ছাড়া তোর কাজ আছে তাই।’

ঝিলমিল সটান দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘যা যাবই না। এভাবে বললি কেনো?’

‘ঘাট হয়েছে আমার। ভুল হয়েছে তোকে কিছু বলা। মাফ কর, বাপ। সরি সরি, হাজারবার সরি। এইবার আয়, তোকে আর কিছু বলব না প্রমিজ। আমি কিন্তু কথা দিলে কথা ভঙ্গ করি না।’

ঝিলমিল চুলগুলো পেছন দিকে ঝাড়া দিয়ে একহাতে গায়ের চাদরটা টেনে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’
ওরা দু’জন সন্ধ্যা সাতটায় এসে পৌঁছাল। সেখানেও রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত ধরে ধরে নিয়ে গেল। রোদ্দুর ঝিলমিলকে ভেতরে পৌঁছে দিয়ে নিজে ওয়েটিং রুমে এসে বসল।
ওইদিকে একটা বুড়ো ডাক্তার ঝিলমিলের পা চেক করছিল। প্রথমেই বুড়োটার হাবভাব ভালো ঠেকছিল না। কিন্তু, নিজের ধারণা ভুল হবে ভেবে চুপ করে গেল। কিন্তু সেই ডাক্তার যখন পা থেকে হাত স্পর্শ করছিল বাজেভাবে তখন ঝিলমিল আর চুপ করে থাকতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে বলল, ‘আপনার হয়েছে আংকেল?’

‘না আরেকটু বসুন, আপনার পায়ের আঘাত খুব গুরুতর। আরেকটু দেখতে হবে। বসুন দেখি।’
ঝিলমিল ফেল বসে পড়ল। চোয়াল শক্ত করে তক্কে তক্কে রইল কখন এই বুড়ো ভামটাকে একটু টাইট দেবে। উনি ফের পায়ের অযুহাতে হাতে হাত দিলেন। বললেন, ‘দেখি এখানে সমস্যা আছে কিনা? এসব ব্যথা খুব গুরুতর, সারা শরীর ছড়িয়ে পড়ে।’
ঝিলমিল চুপচাপ শুনে সাপের মত ফুঁসে উঠল। বা পায়ে ব্যথা, ডান পা এগিয়ে বুড়ো ব্যাটাকে একটা ফুটবলের মত কিক মারল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘শালা বুইড়া ব্যাটা এই বয়সে লুচ্চামি? বয়স কত হে? এক পা কবরে চলে গেছে, তারপর’ও ভন্ডামি যায় না। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।’
ঝিলমিল দু’কদম এগিয়ে গিয়ে বুড়ো ব্যাটার চুল টানতে টানতে বলল, ‘আমার কি চিকিৎসা করবি, আমি করব তোর চিকিৎসা। আয় আয়।’
ওইদিকে চেঁচামেচি বাহির পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ঝিলমিল’ও সে সময় বুড়োটাকে টানতে টানতে রিসেপশনে নিয়ে এলো। রোদ্দুর এমন বিরল দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কী হচ্ছে? এই বয়স্ক লোকটাকে কেনো এই পাগল টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসছে?
.
.
.

চলবে…..

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২১]
~আফিয়া আফরিন

রোদ্দুর এগিয়ে এসে ঝিলমিলকে থামাল। হাত ধরে চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘কি করছিস এখানে? এইভাবে সিন ক্রিয়েট করার মানে কি?’
তখন ঝিলমিলের পা পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে। অবশ্য এত গন্ডগোলের কারণে তারা কেনো এখানে এসেছিল সেটাই ভুলে গেছে। ঝিলমিল রোদ্দুরকে সবটা খুলে বলল। বুড়ো ডাক্তার তখন মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, প্রথম নিজেকে নির্দোষ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু ঝিলমিলের চোখ রাঙানির কাছে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নাই।
পুরো ঘটনা শুনে রোদ্দুরের মাথা গরম হয়ে গেল। মানুষ বিশ্বাস করে যাদের কাছে নিজের চিকিৎসা নিতে আসে আর তারা যদি ক্ষ্যাপা সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না। ঝিলমিলের শত খারাপ দিকের মধ্যে এই একটামাত্র দিক রোদ্দুরের ভালো লাগল। সবাই তো আর প্রতিবাদ করতে পারে না, চুপচাপ নিজের ব্যর্থতা ভেবে মেনে নেয়, চুপ করে যায়; কিন্তু ঝিলমিল যেভাবে লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো তা ব্যাখা করা অবর্ণনীয়।
তর্কাতর্কির বিষয়টা কখনোই ওর পছন্দ ছিল না। সে সরাসরি পুলিশে ফোন দিল। তারপর যেই না লোকটার সাথে একটু বোঝাপড়া করার উদ্দেশ্যে এলো ওমনি একটা নার্স ছুটে এসে অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘প্লিজ প্লিজ, এটা আমাদের হাসপাতালের রেপুটেশনের বিষয়। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, স্যার আসছেন। এই লোক আমাদের এখানকার ডাক্তার না, একজনের অনুপস্থিতিতে ওনাকে রাখা হয়েছে।’

রোদ্দুর বলল, ‘যাকে তাকে রেখে দিলেই হয়? আপনারা রক্ষা করার বদলে যদি ভক্ষক হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা এলাম সাধারণ একটা সমস্যা সমাধানে, সেখানে উল্টো আরও সমস্যা সৃষ্টি করলেন। এই আপনারা ডাক্তার? মানুষের সেবা করেন?’
কথাটা বলতে বলতেই রোদ্দুরের মনে পড়ল ঝিলমিলের পায়ের কথা। ওমা! এই মেয়ে তো দিব্যি হাঁটাচলা করছে। কিছুক্ষণ আগে তো ওই বুড়ো ব্যাটার সাথে ভালোই দোড়াদৌড়ি করল। রোদ্দুর এসে ঝিলমিলের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা কেনো যেনো এসেছিলাম এখানে?’

ঝিলমিল তড়িৎ গতিতে বলল, ‘কেনো আবার? পায়ের ডাক্তার দেখাতে।’ তারপর হঠাৎ নিজের পায়ের দিকে তাকাল। পা নাড়াচাড়া করে অবাক হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাসল। করিডোরে একটা চক্কর কেটে এসে বলল, ‘অ্যাই অ্যাই আমি হাঁটতে পারছি।’
রোদ্দুর প্রথমে মনে করেছিল, ঝিলমিল হয়ত তার সাথে গতকাল থেকে পা ব্যথা নিয়ে মশকরা করছিল তবে ওর চোখেমুখের উচ্ছ্বাস বলে দিল, সে মিথ্যা কথা বলে নাই।
পুলিশ এসে বুড়ো ব্যাটাকে অ্যারেস্ট করল এবং তাদের আশ্বস্ত করল। হাসপাতালের মেইন ডাক্তার এসে অনেকভাবে ক্ষমা চাইলেন, বিষয়টা গোপন রাখার কথাও বললেন। তারপর সবার শেষে নিজের একটা কার্ড দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ, যেকোনো প্রয়োজনে স্মরণ করবেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাদের সাহায্য করার জন্য। আর হ্যাঁ, আমি আবারও আজকের ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দুঃখিত!’
ঝিলমিলের কাছে ডাক্তারটাকে ভালোই লাগল। বেশ ভদ্র, শান্তশিষ্ট স্বভাবের। অন্যের করা মারাত্মক ভুলের জন্য নিজে কতবার ক্ষমা চাচ্ছেন! ঝিলমিল আর রোদ্দুর বাড়ি ফিরে এলো। এতক্ষণ হাসপাতালের ফিনাইল, ওষুধপত্রের গন্ধে মাথা ধরে গিয়েছিল। বারান্দায় এসে মিনিট দুয়েক দাঁড়াতেই শরীর জুড়ে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেল। ঝিলমিল কড়ি করে দু’কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এলো।
রোদ্দুর হেসে বলল, ‘আজ থেকে তো তাহলে তোর সাথে আই মিন আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলতে হবে। কোনো প্রকার উল্টাপাল্টা করা যাবে না। এমনিতেই এত বছর যাবত দেখে আসছি পান থেকে চুন খসলেই তোর চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় আর আজ তো লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললি। তুই কি আগে থেকেই এমন?’

‘একই সাথে বড় হয়েও আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করিস? জানা উচিত ছিল তোর।’
রোদ্দুর হালকা চালে মাথা নাড়ল। তারপর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি সত্যি পায়ে ব্যথা পেয়েছিলি নাকি….’
রোদ্দুরের কথা পুরোটা শেষ করতে দিল না ঝিলমিল। তার আগেই ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে নিজে বলল, ‘বিশ্বাস কর, এসব মিথ্যা না। সত্যিই আমার পায়ে এমন ব্যথা ছিল যে মরার মত অবস্থা হয়ে গেছিল। কীভাবে যে ভালো হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। আমি নিজেও অবাক!’
রোদ্দুর মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল। বুঝতে পারল, এটা দৌড়াদৌড়ির ফালাফল।
কিছুক্ষণ বাদে ঝিলমিল রোদ্দুরকে বাড়ি যাওয়ার কথা বলল। রোদ্দুর মনে হয় এখন বাড়ি যেতে রাজি না, তাই খুব একটা গুরুত্ব দিল। ‘দেখি’, ‘আচ্ছা আচ্ছা’, ‘যাবনি’ বলে কাটিয়ে দিল।
ঝিলমিলের মন খারাপ হয়ে গেল। রোদ্দুরকে রাজি করানোর অন্য উপায় তার জানা নেই। ও হ্যাঁ, একবার দাদিকে ফোন করা যায়। উনি বললে তাও যদি রাজি হয়! ঝিলমিল ঘড়িতে সময় দেখে নিল, এখানে রাত না হলেও ওখানে যথেষ্ট রাত হয়েছে। কাল সকালে রোদ্দুর যখন অফিসে যাবে তখন কথা বলতে হবে।
.
সকালে হঠাৎ ছোট চাচ্চুর আগমন ঘটল। কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল। রোদ্দুরকে দেখতে পেল না, নিশ্চয়ই চলে গেছে। বলেও যায় নাই একবার। ঘড়িতে সময় দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। অলসতা ঝাড়ার সময় পেল না, অনবরত কলিংবেল বেজেই চলছে। ঝিলমিল উঠে বিছানার কম্বল, বালিশ সরিয়ে ওড়না খুঁজে বের করে দৌড়াল। এপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

ওপাশ থেকে ভরাট গলায় কেউ একজন বলল, ‘দরজা খোল, আমরা এসেছি।’
ঝিলমিল উঁকি দিয়ে লুকিং গ্লাসে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেল না, যতটুকু দেখল ততটুকু ঝাপসা। ঝিলমিল দরজা খুলবে কিনা বুঝতে পারছিল না। আরেকটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘ঝিলমিল আমরা, তোর চাচা চাচি।’
ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে সালাম দিল। বড় চাচা, বড় চাচি এবং তাদের সাথে ছোট চাচ্চুও এসেছে। ও কিছুটা অবাক হয়ে বলল, ‘হঠাৎ তোমরা সবাই এখানে? আমাকে তো আগে বলো নাই।’

ছোট চাচ্চু বললেন, ‘আগে বলি নাই বলে তুই আমাদের এতক্ষণ দরজায় ওয়েট করাবি? সেই কখন থেকে কলিংবেল বাজাচ্ছি, তোকে ফোনও করেছি কয়েকবার। কি করছিলি? ঘুমাচ্ছিলি তাই না। রোদ্দুর চলে গেছে অফিসে?’

ঝিলমিল নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ চ-চলে গেছে, আসলে আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই আমি খেয়াল করিনি।’
ঝিলমিল সবাইকে বসার জায়গা করে দিল। যেটা করছে সেটাতেই অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে, আগে কখনো এইরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয় নাই! সাবরিনা এগিয়ে এসে বললেন, ‘ঢাকায় এসেছি একটা কাজে, আমার বোন আছে না একটা ও একটু অসুস্থ তাই ওকে দেখতে এসেছি। তোর মা বাবাও আসতে চেয়েছে, কিন্তু যেহেতু তানির জন্মদিন আর তোরা ওখানে যাবিই তার আর এলো না। আমি ভাবলাম ঢাকায় যখন এসেছি তখন তোর নতুন সংসারটাও দেখে যাই। কি মন দিয়ে সংসার করছিস তো?’ উনি ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। ও কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে ইতিবাচক জবাব দিল।
ছোট চাচ্চু জানালেন তার এখানে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি ঝিলমিলের ট্রান্সফার নিয়ে এখানে এসেছেন। এখানেই যেহেতু ওকে থাকতে হবে, তবে পড়াশোনাটাও এখানেই হোক। ওদের ওখানকার কলেজে সামনের মাসে পরীক্ষা আর এখানে সামনের সপ্তাহেই পরীক্ষা।
ঝিলমিল মুখটা কালো করে ফেলল। এমনিতেই পড়াশোনা থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চায়, ততটাই সবাই মিলে তার দিকে ঠেলে দেয়। ওরা সকলে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ঝিলমিল বারণ করল। যত যাইহোক, মেনে নিক অথবা না মেনে নিক— বড় চাচি যখন একটু আগে তার সংসার কথাটা উল্লেখ করেছে তবে তার এই সংসার থেকে সে কি করে মেহমানদের না খাইয়ে বিদায় করে! দাদি বলতেন, খালি মুখে চলে গেলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। ঝিলমিল যেতে দিল না, কিন্তু তাদের তাড়া ছিল। তাই সে ঝটপট গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলো সকলের জন্য। চা খেতে খেতে সাবরিনা বললেন, ‘ঝিলমিল তুই’ও আমাদের সাথে চল। তোর ছোট চাচ্চুর সাথে চলে আসিস। তারপর সবাই মিলে একসাথে সন্ধ্যার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিস।’

‘কিন্তু রোদ্দুর যে বলল, ও যাবে না বাড়িতে।’

‘ধুর, ও কথা কে শোনে? ওর কথার দাম আছে? আমাদের বাড়ির বউ যেতে চেয়েছে, আমরা তার কথাই শুনব।’
ঝিলমিল খুশি হয়ে গেল। তারপর রেডি হয়ে তাদের সাথে রওনা দিল। প্রথমেই বড় চাচির বোনের বাসায় যাওয়া হলো। ঝিলমিলের সাথে ওনাদের আগে থেকেই বেশ ভালো পরিচয় আছে, একসময় খুব যাওয়া-আসা হতো। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর হাসপাতালে গেল। ওরা কেবিনে গেলেও ঝিলমিল করিডোরে বসে রইল। হঠাৎ একটা মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো এবং পেছন থেকে কোনো সম্বোধন বিহীন ডাক দিল, ‘এই মেয়ে শোনো!’

ঝিলমিল ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটা বলল, ‘তুমি রোদ্দুরের কে হও?’

ঝিলমিল পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনি কে?’

‘আমি কে সেটা তো তোমার জানার প্রয়োজন নেই। তুমি বলো, রোদ্দুর তোমার কে হয়? ইদানিং তোমার সাথে ওকে খুব বেশি দেখতে পাচ্ছি। অন্য একটা ছেলে মানুষের সাথে এত রঙ-তামাশা কীসের?’

ঝিলমিল বোঝার চেষ্টা করল, এই মেয়েটা কে? রোদ্দুরের সাথে নিশ্চয়ই কোনো না ভাবে সংযুক্ত, তা না হলে ঝিলমিলকে চেনার কথা নয়। হতে পারে ফ্রেন্ড, নাহ ফ্রেন্ড হলে এত অধিকার কেনো দেখাবে?
সে সুন্দর করে হেসে জবাব দিল, ‘আমার রঙ-তামাশা করতে ভালো লাগে। তোমার ভালো লাগে না? তুমিও করবে নাকি রঙ-তামাশা?’

‘এত বাজে কথা কীভাবে বলো? বেহায়া কোথাকার! তোমাকে লাস্ট একটা কথা বলি, রোদ্দুর ইজ মাই বয়ফ্রেন্ড। ওর সাথে কাউকে আমি টলারেট করব না। সো, রোদ্দুরের কাছ থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।’
এরপর মেয়েটা ঢ্যাংঢ্যাং করলে চলে গেল। ঝিলমিল সহসা রোদ্দুরের কাছে মেসেজ দিল, ‘তোর গার্লফ্রেন্ড কয়টারে?’
সাথে সাথে রোদ্দুরের রিপ্লাই এলো না। ঝিলমিল ফোন ব্যাগে রেখে রোগীকে দেখতে গেল। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর হঠাৎ রোদ্দুরের ফোন বেজে উঠল। এই প্রথম… বিয়ের পর.. না প্রথম না, এর আগেও ফোন করেছিল কিন্তু ঝিলমিল কখনো ফোন করতে পারে নাই। বেশিরভাগ কথা তার সাথে মেসেজেই হয়।
ঝিলমিল ফোন রিসিভ করতেই রোদ্দুর বলল, ‘কোথায় তুই? আবার কি পাশের বাসার ভাবির সাথে গল্প করতে গেছিস?’

ঝিলমিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘না তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি। তুই’ও চলে আয়। একসাথে গল্প করি।’

‘সত্যি করে বল, কোথায় তুই?’

‘তার আগে তুই সত্যি করে বল, তোর গার্লফ্রেন্ড কয়টা? আজ একজনের সাথে দেখা হয়েছিল। তুই কি রানিং প্রেম করিস? আয়হায়, এটাকে কি বলে জানিস? এটাকে বলে পরকীয়া। ছিঃ ছিঃ, বংশের নাক কাটবি নাকি!’

রোদ্দুর বিরক্ত হয়ে বলল, ‘যাতা কথা বলিস না ঝিলমিল। তুই কোথায় সেটা বল?’

‘হাসাপাতালে এসেছি।’

‘মানে কি? কেনো? আমার সাথে হেঁয়ালি করছিস?’

‘না। হাসপাতালে মানুষ কেনো আসে বল?’

‘চিকিৎসা করাতে।’ রোদ্দুর জবাব দিল।

ঝিলমিল পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘আর কী?’

‘কী? তুই বল। ফাজলামি করলে থাপড়ে গাল লাল করে দিব বেয়াদব। বাড়ি ফিরে এসব অশান্তি আমার পছন্দ হচ্ছে না।’ রোদ্দুর রেগে গেল।

ঝিলমিল আগুনে ঘি ঢেলে বলল, ‘কেনো রে? অশান্তি কেনো? বাড়ি ফিরে এসে আমাকে দেখতে পাচ্ছিস না বলে কি মন খারাপ? মিস করছিস? ওয়াও, ইন্টারেস্টিং!’
রোদ্দুরের তো বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। শুধুমাত্র ঝিলমিল কোথায় আছে, এটা জানার জন্য এত বকবক করতে হচ্ছে এবং এত কথা শুনতে হচ্ছে। সে মাথা ঠান্ডা রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘এইবার বল, কোথায় আছিস। মিস যখন করছি বুঝতেই পারছিস তবে দ্রুত বল, গিয়ে দেখে আসি তোকে।’ মনে মনে অবশ্য উল্টো কথা বলল, ‘তোকে থাপড়িয়ে আসব জাস্ট একবার বল কোথায় আছিস তুই।’

ঝিলমিল এইবার সত্যি কথাই বলল। চাচা-চাচি এবং ছোট চাচ্চুর কথা বলল। রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হলো। বাড়ির বড়রা আছে, তাই ঝিলমিলকে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু ওর উপর রাগ সর্বোচ্চ ছাড়িয়েছে, বিরক্তিকর একটা! হাসপাতালে গিয়ে ঝিলমিলের সাথে চোখাচোখি হতেই সে চোখ রাঙ্গাল। ঝিলমিল দাঁত কেলিয়ে হাসল। সবার সাথে দেখা হওয়ার পর ছোট চাচ্চু বাড়ি যাওয়ার কথা বললেন। রোদ্দুর গাইগুই করে জবাব দিল, ‘এইবার আর যেতে যাচ্ছি না। দেখি সামনের সপ্তাহে যাওয়ার চেষ্টা করব।’
বড় চাচা এসে ধমক দিলেন। তখন রোদ্দুর আর নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারল না। বাড়ি যেতে রাজি হলো। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝিলমিলকে সাথে করে বাড়ি এসে ব্যাগপত্র গোছাল। একটা কথাও বলল নাই, ঝিলমিল যা বলল তাতেই চোখ গরম করে তাকাল। ঝিলমিল ওর সেই রূপ থেকে বলল, ‘পুরো গরুর মত দেখাচ্ছে তোকে। এইভাবে তাকাস না প্লিজ, তাহলে নির্ঘাত তোর ব্রেকআপ হয়ে যাবে। এমনিতেই তোর যা গার্লফ্রেন্ড, বাবারে কী ঝগড়ি! কথাবার্তার কী ছিরি। পারলে আমাকে গিলে খেত।’

‘ওহ হ্যাঁ জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি, তোর সাথে কি সানিয়ার দেখা হয়েছিল?’

‘অত নামধাম আমি জানিনা। এটা কি সেই মেয়েটা যে সেদিন রাতে তোকে ফোন করে আবোলতাবোল কীসব বলছিল।’

‘আমাকে কি বলছিল না বলছিল সেটা তুই কীভাবে শুনলি? আর কীভাবে জানলি ওটা একটা মেয়ে?’

ঝিলমিল নির্বিকারভাবে বলল, ‘ফাস্টে আমি ফোন রিসিভ করছিলাম।’

রোদ্দুর বিস্ময়ে হা হয়ে বলল, ‘মানে কী? আমার ফোন নিয়ে তুই কথা বলেছিস?’
ঝিলমিল কিছু বলল না। নিজের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে গেল। রোদ্দুর’ও দরজা লক করে নিচে নেমে এলো। সারা রাস্তা আর ঝিলমিলের কাছ থেকে জবাব পাওয়া গেল না। বলল, ‘পরে বলব। এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।’ রোদ্দুর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইল। ঝিলমিল নড়েচড়ে আশেপাশে তাকিয়ে চারিদিকের দৃশ্য অবলোকন করেছিল।
ওরা যখন সুখানপুর এসে পৌঁছাল তখন প্রায় আটটা বাজে। বাস থেকে নেমেই রোদ্দুরকে ছাড়িয়ে ঝিলমিল সোজা রাস্তা ধরে দৌড় দিল। যেতে যেতে খোলা প্রকৃতিতে হাঁকডাক ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা মা, আমাকে বাঁচাও। আমি এক জাঁদরেলের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছি।’
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা —১৮৬৭