#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২২]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিল অনবরত দৌড়াচ্ছে, রোদ্দুর’ও ওর পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ঝিলমিলের কাছাকাছি এসে বলল, ‘আরে দাঁড়া। এইভাবে অন্ধকারের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করলে পা পিছলে পড়ে এইবার কোমড় ভাঙ্গবি।’
ঝিলমিল তবুও শুনল না, দৌড়াতে থাকল। রোদ্দুর এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল, ‘চুপচাপ হাঁটতে থাক।’
একটা অদ্ভূত বিষয়, ওদের মধ্যে আগেও একটা সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে আগেও বহুবার, অগণিতবার একে অপরের হাত ধরেছে। কিন্তু এইবার ঝিলমিলের হাত ধরে রোদ্দুরের কেমন যেনো লাগল, আগে কখনো এমন হয় নাই তো। এইবার কেনো? রোদ্দুর আড়চোখে মুঠোবন্দী হাতের দিকে তাকাল, সবই তো ঠিকঠাক তবে এমন আশ্চর্য রকম মনে হলো কেন? সে হাত ছেড়ে দিল, আগের অনুভূতিতে ফিরে এলো। পরীক্ষা করার জন্য আরেকবার ঝিলমিলের হাত ধরতে চাইল, কিন্তু ধরল না। ধরবে কীভাবে? হাত ধরার ছুতো খুঁজে পেল না।
ওরা বাড়ি এসে পৌঁছাতেই হুলুস্থুল কাণ্ড পড়ে গেল। যত যাইহোক বাড়ির বউ প্রথমবার এসেছে বলে কথা! ঝিলমিল বিরক্তিতে নাক কুঁচকে বলল, ‘অনেক ঠান্ডা বাহিরে, আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছো না কেন? ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছি।’
রিমঝিম এগিয়ে এসে বলল, ‘এইতো ভাবি চলে এসো। তোমাদের জন্য ছোটোখাটো একটু আয়োজন করলাম। তুমি আমার একমাত্র ভাবি বলে কথা! তোমার আদর সবার আগে।’
ঝিলমিল মুখ ভেংচাল। মনে মনে বলল, ‘ভানের জলে ভাসিয়ে দিয়ে আবার আদর দেখানো হচ্ছে।’
ঘরে গিয়ে বাকিদের সাথে দেখা হলো। মা-বাবা, চাচা-চাচী, দাদি সকলের সাথে কুশল বিনিময় হলো।
দাদি বললেন, ‘আহারে মাইয়াডার মুখটা শুকাইয়া এইটুকু হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়া একদমই হয় নাই তাইনা? কই আমার দাদুভাই কই? তারে দেখতেছি না কেন?’
রোদ্দুর নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। তানিশা গিয়ে ওকে ডেকে আনল।
দাদি তার একমাত্র আদরের নাতির উদ্দেশ্য বললেন, ‘দাদুভাই, বউয়ের যত্ন নিচ্ছো না? সেদিন শুনলাম কীভাবে জানি পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।’
ঝিলমিল ইশারায় বোঝাল, রোদ্দুর’ই তাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। তারপর বানিয়ে বানিয়ে মেজো চাচীকে যে আরও কত কথা বলল তার ছেলের সমন্ধে।
রোদ্দুর শুধু ভাবছে, ‘যেই আমি বাড়ি ফিরি রাত্রের বেলা, সেই আমি ওর জন্য মানবিকতার কারণে বাড়ি ফিরি অফিস শেষ করেই। ভাবি, বেচারা একা একা কি করে থাকবে? নতুন শহর, নতুন পরিবেশ; থাক আমি একটু স্যাক্রিফাইজ করি। আর এই বহুরূপী কীভাবে ফাঁসাচ্ছে আমায়। শালা ভালো মানুষের দাম নাই জগতে। ধুরু, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না আমায়। আসলাম কেন এখানে? চলে যাব, চলে যাব।’ রোদ্দুর কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
সেদিন রাতে ঝিলমিল আগেভাগেই গিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। না হয় ঘরের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হবে। ঝিলমিলের মনে হলো, অনেকদিন পর সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে। ঘরজুড়ে কেমন আপন আপন ঘ্রাণ! ঝিলমিল পুরো ঘর এলোমেলো করে, কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াল। বারান্দায় গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বাদে একটা অন্ধকার ছায়া দেখতে পেল, আচমকা মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগেও এই ঘরের জানালায় কেউ ঠকঠক করত। ভয়ে হাত পা শিটিয়ে গেল ওর। তবুও ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। ও দেখতে চায়, কে এই লোক? তার সাথে কীসের শত্রুতা? এত বছর য়ে গেছে, কখনো এই বাড়িতে এইরকম উপদ্রবের সৃষ্টি হয় নাই। তবে এইবার কেনো? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে। ঝিলমিল কাউকে সন্দেহ’ও করতে পারছে না। সে দেখতে থাকল।
অবয়ব’টা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। উপর থেকে স্পষ্ট মুখটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওটা যে একটা ছেলেমানুষ সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ঝিলমিল ভাবল, নিচে গিয়েই ধরবে। উপরে থেকে সে কিছুই করতে পারবে না। এখান থেকে চেঁচামেচি করলে বাড়ির মানুষ আসার আগে ওই ব্যাটা পালাবে। ঝিলমিল দৌড়ে নিচে নামল। চুপিচুপি সদর দরজা খুলে গেল। বাড়ির পেছন দিকে যেতেই পায়ের সরসর আওয়াজ ভেসে এলো। ঝিলমিল ফের বাড়ির মধ্যে গেল এবং বড়সড় একটা লাঠি নিয়ে ফিরে এলো। বিড়ালের মত চুপিচুপি সামনের দিকে এগোতে লাগল। খুব কাছেই ছায়ামানবকে দেখতে পেল। ঠাস করে যেইনা পেছন থেকে মাথায় একটা বাড়ি দিতে যাবে, ওমনি সে সামনের দিকে ফিরে লাঠিটা ধরে ফেলল।
ঝিলমিল অবাক হয়ে তাকাল। যেই এন্টারটেইনমেন্ট নিয়ে এসেছিল, তার সবটাই মূর্ছা গেল। ছায়া মানবের পরিবর্তে যে রোদ্দুরকে দেখতে পারবে এটা কল্পনাও করতে পারে নাই। রোদ্দুর’ও ওকে দেখে অবাক!
জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি পাগল? তোর মাথার তার ছেঁড়া? মারামারি করতে আসছিস কোন দুঃখে? এক্ষুনি তো দিতি মাথা ফাটিয়ে। আশ্চর্য।’
‘তুই কি করছিস এখানে এত রাতে? আমি তো চোর ডাকাত ভেবে এসেছিলাম। আর তোকে না উপর থেকে দেখে চোরের মতোই মনে হচ্ছিল।’
‘তুই কি পাহারাদার? ঘুম বাদ দিয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছিস?’ রোদ্দুর কোমড়ে দু’হাত গুঁজে প্রশ্ন করল।
ঝিলমিল উত্তর দিল, ‘আমার কথা বাদ দে। তুই কি করছিস তাই বল? কে আছে আর এখানে? বাই দা ওয়ে, তোর সেই গার্লফ্রেন্ডকেও কি ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছিস? ও নিশ্চয়ই এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে। আর তুই চুপিচুপি এসেছিস প্রেম করতে তাইতো! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।’
এই বলে ঝিলমিল আশেপাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগল। রোদ্দুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ওর কর্মকাণ্ড। একটু আগে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ওর হাত থেকে ঘড়িটা নিচে পড়ে গিয়েছিল। সেটাই এতক্ষণ ধরে খুঁজছিল। কিন্তু ঘড়ি খুঁজতে এসে যে এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা কে জানত!
রোদ্দুর ঝিলমিলকে বলল, ‘ঘরে যা কাউকে পাবি না।’
‘আমি কিন্তু বাড়ির সবাইকে বলে দিব।’ মুখ কালো করে বলল ঝিলমিল।
‘আচ্ছা বলিস, এখন চল।’
ঝিলমিল সুর টেনে চেঁচাল, ‘নাআআআআ। আমি যাব না। আমি দেখব তোর গার্লফ্রেন্ডকে।’
রোদ্দুর ঝিলমিলকে হাত ধরে টেনে উঠাল। তারপর ওর হাত ধরেই ঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেল।
ঝিলমিল হেলেদুলে পুনরায় বলল, ‘তুই কেনো তোর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছিস?’
রোদ্দুর ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেনো হিংসা হচ্ছে?’
ঝিলমিল ওখানেই ঠাস করে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে তাকাল। নিমিষেই চোখমুখ কুঁচকে অদ্ভূত একটা ভঙ্গি করল। এক ঝটকায় রোদ্দুরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি কেন হিংসা করব? যা তো তুই। ছ্যাহহ, কি না কি গার্লফ্রেন্ড তাকে আবার আমি হিংসা করব। আমি? আমি…..? হোয়াই?’
এই বলে ঝিলমিল আর দাঁড়াল না, উল্টো পথে হনহন করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল। রোদ্দুর হেসে আপনমনে বলল, ‘পুরোদস্তুর পাগল কোথাকার!’
.
সকাল সকাল ঝিলমিল উঠে শিউলিকে ডাকতে গেল। শিউলির জানা ছিল না ঝিলমিল এসেছে। সকাল সকাল ওকে দেখে একদম অবাক! এগিয়ে এসে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাবি এসেছেন? কী যে আনন্দ লাগতেছে। আসেন, আসেন এই প্রথম আমার বাড়িতে এলেন।’
ঝিলমিল মুখ কালো করে বলল, ‘তুই’ও?’
শিউলি ওর কথা পাত্তা দিল না, হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর মা’কে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে গেল। শিউলির মা রোমেনা এসে ঝিলমিলকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন। বললেন, ‘কি গো আম্মাজান? একাই বেরাতে এসেছ, জামাই এলো না কেন?’
ঝিলমিল লাজুক হেসে বলল, ‘না আন্টি। আমি এমনিই শিউলির সাথে দেখা করতে এলাম। ও কোথায় গেল? একটূ ডেকে দেন। নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসি।’
‘আচ্ছা যাও। অ্যাই শিউলি, এদিকে আয়। আর তুমি শোনো মা, ওর সাথে সরাসরি আমাদের এখানে চলে আসবে। সকালের নাস্তাটা আমাদের সাথেই খেতে হবে কিন্তু। জামাইকে নিয়ে এসো। বিয়ের পর এখনও একবার’ও দেখলাম না।’
ঝিলমিল বলল, আচ্ছা আন্টি। আপনি আমাদের বাড়ি যায়েন।’
তারপর শিউলি আর ঝিলমিল বেড়িয়ে গেল। সকাল থেকে বের হওয়ার পর যে দেখে সেই জিজ্ঞেস করে, কিরে জামাই কই? কিরে বিয়ের দাওয়াত কবে দিবি? মেয়ে মানুষের বিয়ের পরে জামাই ছাড়া চলাফেরা করা উচিত নয়, মানুষের বাজে নজর লাগে। আরে, নতুন বউ যে। কী খবর?
উফফফফ— ঝিলমিল শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেল। আশেপাশে সবাই পরিচিত, তার উপর বড়ো চাচা চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাদের বাড়ির পরিচিতি আরও বেড়েছে। তাই যেই দেখে সেই উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে ঝিলমিল, জামাই কই রে?’
একপর্যায়ে ঝিলমিল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমাকে দেখো। আমাকে কি পছন্দ হয় না? এত জামাই জামাই করো কেন? জামাই দিয়ে কি করবা? দেখার এত শখ হলে বাড়ি গিয়ে দেখে আসো।’
ওরা হেসে বলে, ‘ওমা! এতদিন তোকে বলেছি নাকি? বিয়ের পর আমরা আমাদের মেয়েকে একটু জামাইয়ের সাথে একসাথে দেখতে চাইব না? বুঝি রে বুঝি, লজ্জা পাচ্ছিস। যা বাপু, যেখানে যাচ্ছিস যা।’
ঝিলমিল অসহায় দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকাল। তাকিয়ে লাভ নেই। সেও তখন থেকে ভাবি ভাবি করে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পর পর বলছে, ‘বাসর রাতের গল্প শোনাও ভাবি। আমিও বিয়ে করব, তাই আগে থেকে শুনে রাখছি।’
ঝিলমিল যখন চোখ গরম করে তাকায় তখন শিউলি চুপ করে তারপর আবার শুরু করে। সময়টা এই ভাবেই কাটল। সারা পাড়া সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরল দুপুর নাগাদ।
বাড়ি গিয়ে দেখতে পেল মা দাদিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। ওনার আজকে একটা এপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। ঝিলমিল বায়না ধরল সেও যাবে।
শিমু বলল, ‘এইবার একটু সংযত হ মা। বিয়েশাদী হয়েছে, এখনও এইরকম লম্ফঝম্প করলে মানুষ কি বলবে বল তো? দু’দিন পর তো তোর শাশুড়ি আমার কাছে বিচার বসাবে। তখন কি করব?’
পাশ থেকে নীলিমা বললেন, ‘না গো। আমার ওত-শত অভিযোগ নাই। আমরা তো ওকে আগে থেকেই চিনি। তোমার’ও যেমন মেয়ে আমার’ও তো মেয়ে। এখন আবার সম্পর্ক এককাঠি উপরে উঠে গেছে।’
‘এই আহ্লাদে আহ্লাদেই তোমরা ওকে বাঁদর বানিয়েছ।’
অবশেষে ঠিক হলো, দাদির সাথে মা ঝিলমিল আর রোদ্দুর যাবে। সেই মোতাবেক বাড়ির গাড়িতে করে রওনা হলো। সামাদ ডাক্তারের হাসপাতাল খুব একটা বেশি দূরে নয়। পনেরো মিনিটের মাথায় ওরা পৌঁছে গেল। দাদির চেকআপ শেষে ঝিলমিল কাগজপত্র গুলো চেম্বার থেকে আনতে গেল। ঝিলমিলের পিছে পিছে রোদ্দুর’ও এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই একটা ডাক্তারকে দেখিয়ে ঝিলমিল বলল, ‘সুন্দর না?’
‘কী?’
‘এইতো এই ডাক্তারটা।’
রোদ্দুর নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল, ‘হুম, সুন্দর।’
ঝিলমিল আরেকদিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল, ‘উনিও সুন্দর, দেখ দেখ।’
‘আমি ছেলেমানুষ দেখে কি করব? তুই দেখ।’
ঝিলমিল একটা তুড়ি বাজিয়ে বলল, ‘দেখতেছিই তো।’ রোদ্দুর ওর কথাবার্তায় কান না দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে এলো। তারপর বাহিরে বেরিয়ে আসতেই শিমু বললেন, ‘হয়েছে তোদের? এত দেরি হলো? মাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছি। বয়স হয়েছে না, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না। আয় তোরা, এইবার রওনা দিই।’
ঝিলমিল বলল, ‘ডাক্তার দেখছিলাম মা। কী যে সুন্দর দুইটা ডাক্তার দেখলাম। ওরে বিয়ে না করলে আমি ওদের মধ্যে একজনকে নির্ঘাত বিয়ে করে ফেলতাম।’
শিমু কথাটা জাস্ট শুনল। চোখ গরম করে তাকিয়ে ঠাস করে চড় মারল। রোদ্দুর পাশ থেকে বলল, ‘একটায় হবে না, আরেকটা।’
.
.
.
চলবে…….
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে 🖤 [পর্ব-২৩]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিল কটমট করে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। সুযোগ পেলে বোধহয় ঘাড় মটকে দিত।
শিমু বললেন, ‘চল বেয়াদব।’ ঝিলমিল আর কোনো কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। রোদ্দুর পেছন থেকে দৌড়ে পাশে এলো। ফিসফিস করে বলল, ‘খুব লেগেছে বুঝি? আহারে থাক কষ্ট পাস না। কান্নাকাটি করবি নাকি? গালটা তো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। ডাক্তারকে ডাকব নাকি চিকিৎসা করার জন্য? ডাকি আচ্ছা! ওওওওও ডাক্তার বাবু, কোথায় আপনি?’
ঝিলমিল গমগমে গলায় বলল, ‘তোকে তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি।’
রোদ্দুর ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘আমাকে কেন দেখবি? তোর তো উচিত ডাক্তারদের দেখা। তুই বরং ওদেরকেই দেখতে থাক। তোর ওই দুই চোখে দেখতে সমস্যা হলে আমাকে বলিস, একটা চশমা কিনে দিয়ে চারচোখা বানিয়ে দিব।’
ঝিলমিল চোখেমুখে বিরক্তি মিশিয়ে তাকাল। তারপর বাড়ি ফিরে তুমুল চেঁচামেচি শুরু করে দিল। বাড়িতে তার সাথে নাকি একের পর এক শুধু অন্যায় করা হচ্ছে। প্রথমত, জোর করে বিয়ে দেওয়া হলো। দ্বিতীয়ত, ভার্সিটিতে ট্রান্সফার। এই বাড়ির মানুষ নাকি তাকে বাড়িতে আর রাখতেই চাচ্ছে না। সবাই এসে কত করে বোঝাল, কিন্তু ঝিলমিলের এক কথা— এই বাড়িতে তাকে কেউ ভালোবাসে না।
দাদি বললেন, ‘তোর এখন জামাই আছে, জামাইয়ের ভালোবাসা পেলেই তো হলো। বাকিদের ভালোবাসা দিয়ে আর কি করবি?’
রোদ্দুর ফিসফিস করে বলল, ‘ডাক্তারদের ভালোবাসা পেলেই হবে, বাড়ির মানুষের ভালোবাসা দিয়ে তুই কি করবি?’
ঝিলমিল দেখল ওর অনুভূতি কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। এদিকে কাল তানিশার বার্থডে, ও আর রিমঝিম মিলে প্লানিং করছে কীভাবে কি করবে। ঝিলমিল ওদের মাঝে থেকেও বোরিং ফিল করে উঠে দাঁড়াল। রোদ্দুরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজায় ঠকঠক করে বলল, ‘আসব?’
রোদ্দুর দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি এই অধমের ঘরে পা দিয়েছেন। কী সৌভাগ্য আমার! আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। এসে আমাকে উদ্ধার করুন ম্যাডাম।’
‘ফাজলামি করিস না, আমি একটা কথা বলতে এসেছি।’
‘ডাক্তারের ব্যাপারে?’ রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল।
ঝিলমিল ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘নাহ। তানিশার বার্থডে’তে ওকে একটু সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি। ভাবলাম, তোকে বলি মানে আমার প্ল্যানে তুই’ও সামিল হ।’
রোদ্দুর একমুহূর্ত ভেবে বলল, ‘আচ্ছা বল কী করতে চাচ্ছিস?’
ঝিলমিল মুখ ঝামটে উত্তর দিল, ‘আশ্চর্য তোকে বলব কেনো আমি কি করতে চাচ্ছি? নিজের প্লানিং নিজের কাছেই থাকুক। হুহ, আসছে আমার সাথে প্লানিং করতে!’
রোদ্দুর থতমতো খেয়ে গেল। সে হা হয়ে বোকার মত বলল, ‘তবে এসেছিস কেনো?’
‘আমার ইচ্ছে!’
রোদ্দুর থমথমে গলায় বলল, ‘তোর ইচ্ছের সাথে আমার কি সম্পর্ক? আজব একটা মানুষ তুই! কখন কি বলিস, নিজেও জানিস না। যা, যেভাবে ইচ্ছে হয় সেভাবে কর। দয়া করে আমাকে জ্বালাতে আসিস না, হাত জোড় করে বলছি। আমি তোর কোন প্ল্যানে নেই, ইভেন কোন কিছুতেই নেই।’
ঝিলমিল কিছু বলল না, চুপচাপ চলে গেল। ছাদে এসে মনে হলো, চিলেকোঠার ঘরটা তো ফাঁকাই থাকে এই ঘরে একটা ছোটখাটো করে আয়োজন করা যেতে পারে; বাড়ির কাউকে না বলে। অর্থাৎ ঝিলমিল তানিশাকে ছোটখাটো একটা সারপ্রাইজ দিবে।
সেই মোতাবেক সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল। দোকান থেকে ফুল, লতাপাতা’সহ আরও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এলো। বাড়ি ফেরার সময় আচমকা সাইফুলের সাথে দেখা হলো। ঝিলমিল পাস কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল কিন্তু সে ডাক দিল, ‘ঝিলমিল দাঁড়াও।’
ঝিলমিল দাঁড়াতেই সাইফুল এগিয়ে এসে পুনরায় বলল, ‘কেমন আছো? অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। এখন তো এখানে আর থাকছ না তাইনা?’
ঝিলমিল মুখে জবাব দিল না, মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ/না দুই ভঙ্গিতে অস্পষ্ট জবাব দিল।
সাইফুল ফের বলল, ‘বিয়েটা তাহলে করেই ফেললে?’
‘হুঁ।’
‘জানতাম না। দুইদিন আগে শুনলাম, তাও মানুষের মুখে মুখে। এখন কি ঢাকা থাকছ রোদ্দুরের সাথেই?’
‘হ্যাঁ ওখানেই আছি।’
‘ওহ। কবে এসেছে এখানে?’
ঝিলমিল দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল, ‘গতকাল এসেছি এবং আগামীকাল চলে যাব।’
‘এসে দুই দিনও মায়ের বাড়ি বেড়াবে না? এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কেনো? আরো কিছুদিন থেকে যাও। মোড়ের মাথায় নতুন নতুন দোকান বসছে, কিছুদিন পরেই মেলা। সেসব না দেখেই চলে যাচ্ছো। তোমার বর দেখি তোমাকে একদম স্বাধীনতা দেয় না।’
ঝিলমিল সুন্দর করে হেসে বলল, ‘আসলে আমার বরের কাজকর্মের প্রেসার আছে তো এজন্য চলে যাচ্ছি। অন্য কারো মত সে আবার গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে না। আমাকে ছাড়া বোরিং ফিল করবে, তাই সব ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। এখন বিয়েশাদী করেছি, বরকে ছাড়া আমারও থাকতে মন চায় না। এখানে তো জীবনের কতগুলো বছর পার করলাম, এইবার বরং একটু বরের সাথে জীবন পার করি। আচ্ছা সাইফুল ভাই, আমি আসছি। বরকে না বলে বের হয়েছি তো টেনশন করবে।’
ঝিলমিলের কথা শুনে সাইফুলের মুখটা কালো হয়ে গেল। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে নিজের রাস্তায় এগিয়ে গেল। একটু আগে সাইফুলকে বলা কথাগুলোর জন্য নিজের গালি ঠাস ঠাস করে দুটো অদৃশ্য চড় মারল। হুহ, বর? ছাতার মাথা!
বাড়ি ফিরে ঝিলমিল কোনোদিকে না তাকিয়ে, কারো সাথে কথা না বলে সোজা চিলেকোঠার ঘরের দিকে রওনা হলো। যাওয়ার পথে অবশ্যই নিজের ঘর থেকে কাঁ’চি, গ্লু’সহ বিভিন্ন প্রয়োজনে জিনিসপত্র নিয়ে নিল। তারপর একমনে নিজের কাজ করতে লাগল। এসব ঠিকঠাক করতে গিয়ে বুঝল, যত তাড়াতাড়ি সব কমপ্লিট হয়ে যাবে ভেবেছিল তত তাড়াতাড়ি কিছুই হবে না। তবে রাত বারোটার আগে কমপ্লিট হলেই হয়!
.
সন্ধ্যার পর পর ঢাকা থেকে বাড়ির বাকিরা চলে এলেন। ফজলুল সরকারের এইদিকে ফেলে যাওয়া অনেক কাজ, তার দিনের পর দিন অন্য জায়গায় সময় কাটানো একদমই সম্ভব নয়। ফিরতি পথেই কত মানুষের সাথে দেখা হলো, সবাই কাজের কথা বলছিল। ওসমান খন্দকার এই কয়েক বছরে যে কী রাজকার্য্য উদ্ধার করেছে, তিনি ভেবে পান না। কোন কাজ গোছানো নেই, যেখানেই হাত দেন সেখানেই এলোমেলো। তাকে সবটা নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। তিনি অবশ্য যথেষ্ট গুণী মানুষ, যথেষ্ট সচেতন; অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাই দায়িত্বের সাথে সবটা সামনে নিয়েছেন। ওসমান খন্দকার একটু গোলমাল লাগানোর চেষ্টা করছে, এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে কিছু করছেন না, মানুষ দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার চেষ্টা করছেন। অবশ্য তাদের বাড়ির মানুষদের সাবধান থাকাই শ্রেয়, কখন কোন দিক দিয়ে কার কি ক্ষতি হয়ে যায় বলা তো যায় না!
বাড়ির সবাই বসার ঘরে বসে এসব নিয়েই আলোচনা করছিল। বড় চাচা বললেন, ‘রোদ্দুর কোথায়? বাড়ির সবাই এখানে ও একলা ঘরে বসে আছে কেন? ডেকে নিয়ে আসো। ছেলেটা বোধহয় দিনকে দিন ঘরকুনো স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে।’
বাবার কথা শুনে তানিশা গেল রোদ্দুরকে ডাকতে। গিয়ে দেখল রোদ্দুর কানে হেডফোন গুঁজে ল্যাপটপে অনুবরত টাইপিং করছে, নিশ্চিত অফিসের কাজ। তবুও তানিশা সামনে এসে ডাকল, ‘ভাইয়া….আইমিন দুলাভাই।’
রোদ্দুর ওর দিকে তাকিয়ে হেডফোন খুলে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বল।’
‘বসার ঘরে সবাই তোমাকে ডাকছে। চলো।’
‘কেনো? আমার জানামতে আগামীকাল তোর বার্থডে। আজ সবাই একত্রিত হয়ে কি করছে?’
‘সবাই গল্প করছে। বাবা বলল তোমাকে ডেকে নিয়ে আসতে। তুমি নাকি বিয়ের পর বউয়ের আঁচলের তলায় সবসময় লুকিয়ে থাকো। আমাকে বলেছে, ওরে কান ধরে টেনে নিয়ে আয়।’
তানিশার কথা শুনে রোদ্দুর তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বড় চাচা এই কথা বলেছে? ও মাই গড! আমার বিরুদ্ধে আমার বাড়িতেই কীসব ষড়যন্ত্র চলছে। আচ্ছা এই কথাটা কি বাড়ির সকলের সামনে বলেছে?’
তানিশা হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে ভাই হ্যাঁ। তোমার আব্বু-আম্মুও উপস্থিত। এমনকি দাদিও আছে। আরও যে কীসব কথা বলছে, তা শুনলে তুমি মিনি হার্ট অ্যাটাক করবে।’
বাড়ির সবাই? তারমানে ঝিলমিল’ও ওখানে রয়েছে? ওহ নো, তার মানসম্মান! গেল যে গেল, সব গেল। বাড়ির ছোটোবড় সকলের সামনে ইদানিং খুব করে তার প্রেস্টিজ পাংচার করে দেওয়া হচ্ছে। সবাই মিলে প্রতিযোগিতা লাগল কিনা কে জানে! রোদ্দুরের ঝিলমিলের কথা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, কিন্তু ছোটো বোনগুলো যা পাজির পাজি; ওরা নির্ঘাত এটা নিয়ে মজা করবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে তানিশার সাথে বসার ঘরে এলো।
বড় চাচা রোদ্দুরকে দেখে খবরাখবর জিজ্ঞেস করলেন। রোদ্দুর আলতো হেসে হবে প্রশ্নের জবাব দিয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগল। ঝিলমিলকে কোথাও দেখতে পেল না, তারমানে ও নেই এখানে। একটু আগের কথাগুলোও শোনে নাই। যাক বাবা, জোর বাঁচা গেল।
দাদি খেয়াল করলেন রোদ্দুরের আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকানোর বিষয়টা। আপন মনে তিনি বললেন, ‘আজকের যুগের পোলাপানের মতিগতি বুঝিনা। দুইদিন আগেই বিয়ে করব না বিয়ে করব না বলে কীঈঈ চেঁচামেচি, বাবাগো বাবা! আর এখন বউকে দেখছে না বলে মুখটা একটুখানি করে দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশে খুঁজেও দেখছে। আরে হতচ্ছাড়া, আমরা কি তোদের খারাপ চাই নাকি? বিয়ে করে তো সুখেই আছিস।’
ঝিলমিলের খোঁজ পড়ল কিছুক্ষণ বাদে। মাহমুদ সরকার নিজেই মেয়ের খোঁজ করলেন। তখন বাড়ির সবার নজরে এলো, ঝিলিমিলকে অনেকক্ষণ যাবৎ তারা কেউ দেখে নাই। শিমু ভেবেছিল, হয়তো রোদ্দুরের সাথেই রয়েছে; বাকিরাও তাই ভেবেছে। ফোন করেও ওকে পাওয়া গেল না, ফোন অনবরত বেজে যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। রিমঝিম ওই ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখল ফোনটা ঘরেই ফেলে গেছে। সবার তো চিন্তা ধরে গেল, রাত হয়ে গেছে এরমধ্যে মেয়েটা কোথায় গেল? কোন বিপদ আপদ হলো না তো?
রোদ্দুর’ও চিন্তিত হয়ে আশেপাশে তাকাল। একটু আগে যে এসেছিল জন্মদিনের কথা বলতে, এরপর ঝিলমিলের সাথে আর দেখাও হয় নাই ওকেও আর কোথাও দেখতে পায় নাই।
এখন বাড়ির সবাই তাকে প্রশ্ন করছে, ‘বিয়ে করেছিস আর বউয়ের কোন খোঁজ রাখবি না? আশ্চর্য! তুইও জানিস না ঝিলমিল কোথায়? এটা কেমন কথা রোদ্দুর? দায়িত্ববোধ কি সব পানি দিয়ে গিলে খেয়েছিস? এখানে বাড়িতেই এই অবস্থা, ওখানে তো একলা থাকিস; কী করিস কে জানে? ঠিকঠাক মত ওর কেয়ার করিস তো?’
রোদ্দুর কী বলবে ভেবে পেল না। ঠিক এই কারণেই ওখানে ঝিলমিলকে চোখে চোখে রাখে, বাহিরে যাতায়াত করতে দেয় না একা একা। কিন্তু এখানে যেহেতু বাড়িতে সবাই আছে, আর এখানকার সবাই ওর আপনজন, পরিবেশটাও পরিচিত; তাই সেইভাবে গুরুত্ব দিল না। কিন্তু বাড়ির সবাই যেভাবে ওকে দোষারোপ করছে, তারপর তো কিছুই বলার থাকে না।
ছোট চাচ্চু বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তো এতসব কথা বলে লাভ নেই। আমি বাহিরে দেখছি। হয়ত শিউলিদের বাড়িতে থাকতে পারে, আগেই নেগেটিভ ভাবার প্রয়োজন নেই তো। ও তো প্রায় ওখানেই চলে যায়। আমি দেখছি। তোমরা বাড়িতেই ভালো করে খুঁজে দেখো। রোদ্দুর তুই’ও ভালো করে খুঁজে দেখ।’
শিমু তো প্রায় চিন্তায় চিন্তায় প্রায় পাগল হয়ে গেছে। মেয়েটাকে চড় মারার জন্যও আফসোস করলেন। সবাই যে যার মত ঝিলমিলকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।
রোদ্দুর হন্তদন্ত হয়ে সোজা ছাদে উঠল। পুরো ছাদে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখেও ঝিলমিলকে পেল না। এইবার সত্যি সত্যি তার’ও টেনশন হচ্ছে। এই রাতের বেলা মেয়েটা যাবে কোথায়? এখানে তো আর পাশের বাড়ির ভাবী নেই। টেনশনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে আচমকা অন্ধকারে পা ফসকে গেল। চোখ পড়ল বা’দিকে চিলেকোঠার ঘরে। ওখান থেকে অর্থাৎ ভেজানো দরজার নিচ দিয়ে আলোর রেখা ভেসে আসছে। রোদ্দুর উঠে এসে ওই ঘরেই উঁকি দিল। এতক্ষণ যার জন্য বাপ চাচারা মিলে তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করল, সেই মেয়েটাকে এই ঘরেই দেখতে পেল। রোদ্দুর গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেল। ঝিলমিল উল্টো দিক ফিরে চেয়ারে দাঁড়িয়ে বেলুনগুলো দেওয়ালে সেট করছিল। রোদ্দুর খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই বেয়াদব!’
আচমকা এরকম কণ্ঠস্বর শুনে ঝিলমিল ভয় পেয়ে চমকে উঠল। ঘুরে তাকাতে গিয়ে পা কাঁপার ফলে ঠাস করে পড়ে গেল। তবে পুরোপুরি মেঝেতে পড়তে পারল না, তার আগেই রোদ্দুর ধরে ফেলল। ঝিলমিল চোখ, নাক, মুখ কুঁচকে পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল, কিন্তু শূন্যে ভেসে আছে এটা উপলব্ধি করতেই ভয়ে আরো সিটিয়ে গেল। নির্ঘাত ভূত বাবাজি!
হঠাৎ, চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই রোদ্দুরের সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো। আশ্চর্য, এটা কীরকম বুকের ভেতর আনচান করা অনুভূতি! ঠিক আনচান না, মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড ধরাস ধরাস করে লাফাচ্ছে; কারেন্ট শক খাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে। ওর ছোঁয়াতেই কেনো এই অদ্ভুত অনুভূতিটা হচ্ছে— প্রশ্নটা রোদ্দুর নিজের কাছেই তুলে রাখল!
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২৪]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিল শূন্য ভাসমান অবস্থায় চোখ পিটপিট করে তাকাল। রোদ্দুরকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ! ও কেমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ অপ্রস্তুত বনে গেল, পরপর কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলল। নড়াচড়া করছিল ওই মুহূর্তে দরজা থেকে হাঁক করে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ওহ সরি সরি, আমি একদম বুঝতে পারি নাই তোমরা এখানে তাও এভাবে! আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। কিচ্ছু দেখি নাই হ্যাঁ কিচ্ছু দেখি নাই।’
রোদ্দুর পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল রিমঝিম দু’হাতে চোখ ডেকে উল্টো দিকে পা বাড়িয়েছে। সে হতভম্বের মত ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। সেই সময়’ই ঝিলমিল বলে উঠল, ‘ছাড় আমাকে।’
রোদ্দুর’ও ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিতেই ঠাস। ও মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে খেতেই বলল, ‘আল্লাহ এই বংশের সবকটা মানুষ নিষ্ঠুর। আমি একা ভালো মানুষ কাকে কি দোষ দিব?’
রোদ্দুর হাত বাড়িয়ে দিল, ঝিলমিল সেই হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল। দু’হাতে কোমড় বেঁধে রোদ্দুরের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করল, ‘আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তুই আমাকে বারবার ডিস্টার্ব করিস? দেখতেই পাচ্ছিস একটা কাজ, তবে কেনো পেছন থেকে ওভাবে চেঁচালি? তোর সেই পেত্নী মার্কা কণ্ঠ, তাতে তো যে কেউ ভয় পাবে!’
‘তোকে এখন আমি কিছু বলব না। সোজা বাড়ির মানুষের হাতে তুলে দিব। যা ইচ্ছে তাই করবে, যা ইচ্ছে তাই বলবে।’
এরপর রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত ধরল এবং মাঝপথে কোনো থামাথামি ছাড়া ওকে সোজা নিচে নামিয়ে নিয়ে এলো। তানিশা একটু আগে এসে যেহেতু সকলকে বলেছে, ঝিলমিল চিলেকোঠার ঘরেই ছিল; তাই সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে। ঝিলমিল দেখল সবাই ওর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল। সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে? আমি কি কিছু করেছি? তোমরা সবাই আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?’
মাহমুদ সরকার নিজে এগিয়ে এসে মেয়ের উদ্দেশ্য বললেন, ‘তুমি তো কখনোই কিছু করো না। যা করার আমরাই তো করি প্রতিবার, এইতো চিন্তায় চিন্তায় মর’ছিলাম। এখানেই যাও যাই করো না কেন, আমরা বাড়িতে এতগুলো মানুষ উপস্থিত আছি, বলে গেলে কি হয়? আর ফোন কেন সাথে থাকে না? মানুষ এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কেনো হয়? কই, তোমার মত অন্যকেউ তো এমন করে না। তুমি একাই, একটা মানুষ’ই সারা দুনিয়ার মানুষকে প্যারায় রাখতে সক্ষম।’
ঝিলমিল বুঝল, অবস্থা খুব সিরিয়াস; না হয় বাবা কখনো এভাবে কথা বলে না। কখনো সামান্য রাগারাগী’ও করে না। এইজন্য’ই তো মা বলে, তোর বাপ আহ্লাদ দিতে দিতে তোকে মাথায় তুলছে।
একটু আগে ঝিলমিল জন্য অকারনে রোদ্দুরকে বকাবকি করায় শিমু ভীষণ আফসোস করে বললেন, ‘আমার মেয়েটাই মত নষ্টের গোড়া। সবকিছুর মূলে সবসময় ওকেই পাওয়া যায়। ওকে আমি আজ পর্যন্ত বোঝাতে পারলাম না। যখনই শাসন করতে গেছি তখনই মা বলেছে, থাক ছোট মানুষ কিছু বলো না। ওরে জিজ্ঞেস করো ওই কি এখনো ছোট আছে? এই বয়সে এসব ফাজলামি মানায়? যত্তসব কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে!’
আর কেউ কিছু বলল না। যে যার মত নিজেদের ঘরে এবং নিজেদের কাজে চলে গেল। সকলে যাওয়ার পরে ঝিলমিল মুখ কালো করে সোফায় বসে পড়ল। রোদ্দুর ওখানেই ছিল। ঝিলমিলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ফোনটা সাথে রাখলেই হয়।’
সে মুখ ঝামটে উত্তর দিল, ‘তোর মত আমার ফোনে সারাক্ষণ মেসেজ আসে না। রাত বিরাতে কেউ ফোন করে বলেও না; নানানানা তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমাদের এতদিনের সম্পর্ক তুমি এক নিমিষেই ভুলে যেতে পারো না।’
রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিভির রিমোট’টা নিজের দখলে নিয়ে বলল, ‘ওহ আচ্ছা, তো কেমন লাগল?’
‘আমি না এসব পরোয়া করি না। তোর চাচি সারাজীবন’ই আমার গুষ্টি উদ্ধার করে এসেছে।’ কুশন কভারটা নিজের কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসে পুনরায় বলল, ‘অ্যাই তুই কবে যাবি?’
‘যাব, যাব।’ রোদ্দুর দায়সারা উত্তর দিল।
‘কবে যাবি?’
‘কেনো? তুই যাওয়ার জন্য এত উতলা হয়ে পড়েছিস কেনো? কাহিনী কী?’
‘সবকিছুতে কাহিনী খুঁজিস না। আমার এখানে ভালো লাগছে না, কেউ আমাকে ভালোবাসে না। বল, কবে যাবি? আমিও তোর সাথে চলে যাব।’
রোদ্দুর ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তাই নাকি? আমি তো ভাবছি তুই আর এখান থেকে সহজে যাবি না।’
ঝিলমিল একটু ভাব নিয়ে বলল, ‘স্বামীভক্ত হয়ে গেছি। ওসব তুই বুঝবি না। সবকিছু বুঝতে হলে তোকে বুদ্ধিজীবী হতে হবে।’
ঝিলমিলের কথা শুনে রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই? স্বামীভক্ত? প্লিজ এসব আজেবাজে কথা বলে লোক হাসাস না। বিয়ের পর তুই আমাকে প্রথম লবণ দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ালি।’
‘আরে এটাই তো ইউনিক। সব বউয়েরা তাদের স্বামীদের মিষ্টি জিনিস খাওয়ায়। মিষ্টির সাইড ইফেক্ট ভালো করেই জানিস। আমি না চাই না অকালে তোর ডায়াবেটিস হোক, সুগার বেড়ে যাক; তাইতো লবণ দিয়ে চা বানিয়েছি। এখন তুই বল, কয় শুনলে আমার মত স্বামীভক্ত আছে?’
রোদ্দুর আবারও হেসে বলল, ‘না একদম নেই। সারা দুনিয়াতে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তোর মত কাউকে পাওয়া যাবে না।’
ঝিলমিল জামার কলার নাচিয়ে একটু ভাব দেখিয়ে রোদ্দুরের গাল টেনে বলল, ‘এইরকম বউ পাওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।’
ঝিলমিল মুচকি হেসে চলে গেল। রোদ্দুর বিষন্ন মনে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগল। আহারে, তার জীবনটা; বড্ড সাধের জীবন। এই ডাকিনীর হাতে পড়ে শেষ হলো বুঝি!
.
চিলেকোঠার ঘরে ঝিলমিলের যতটুকু কাজ ছিল, রাত বারোটার আগে সবটুকু কমপ্লিট করে ফেলল। তারপর সকলে মিলে রাত ১২ টায় তানিশাকে উইশ করল, কেক কাটল। তারপর ঝিলমিল ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে দাদির ঘরে এলো। দাদি জেগেই ছিলেন। ঝিলমিলকে দেখে বললেন, ‘কিরে আমার এইখানে কাজ কি? ওই ঘরে যা।’
ঝিলমিল ধপাস করে শুয়ে পড়ল। বলল, ‘ওরে তো প্রতিদিন’ই দেখি। কতদিন পর তোমার কাছে থাকতে এসেছি।’
‘আমার কাছে থাইক্কা কাজ আছে? জামাইয়ের কাছে থাইক্কা লাভ হবে। শীতের মইধ্যে আরও তো গায়ের উপ্রে গিয়া শুয়ে থাকতে পারবি।’
ঝিলমিল অন্যদিক ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘ছ্যাহহহ এতসব বাজে কথা কীভাবে বলো তুমি? আমি এত বাজে মানুষ না যে মানুষের গায়ের উপর উঠে পড়ব। ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জার কথা।’
‘স্বামীর কাছে টেকে এসব লজ্জা? আরে বাপু, আমরাও তো বিয়েশাদী করেছিলাম তাই না একটু আধটু অভিজ্ঞতা তোদের সাথে বলাবলি করি। এখন যা দেখি, দাদু ভাইয়ের কাছে চলে যা।’
ঝিলমিল চোখ বন্ধ করে বলল, ‘না যাব না।’
‘কেনো রে? তোর লজ্জা করে! বিয়ের এতদিন পরেও যদি স্বামী লজ্জা না ভাঙ্গাতে পারে তাহলে তাকে আর কি বলার আছে?’
ঝিলমিল উঠে বসে পড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তুমি কিন্তু অনেক বেশি বাজে কথা বলছ। মোটেও অনেকদিন আমাদের বিয়ে হয় নাই। আর ওই ব্যাটা হচ্ছে একটা খাটাশ, ওর সাথে আমার জীবনেও বনবে না। সেখানে লজ্জা-শরম তো অনেক দূরেই থাক।’
তিনিও হেসে বললেন, ‘একটা বাচ্চা নিয়ে নে তখন দেখবি সব বনে গেছে। বাচ্চা আর বউ— দু’টোর টান’ই তখন দাদু ভাইয়ের বুকের মধ্যে তাড়পাবে। বুঝলি? তোরা আজকালকার যুগের ছেলে-মেয়েরা আমাদের কথা কি বুঝবি। আমরা কিন্তু তোদের খারাপ চাই না রে।’
ঝিলমিল খাট থেকে নেমে পড়ল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এই ঘর ছেড়ে দৌড় দিল। জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছে, আর দাদির কাছে থাকা যাবে না। কীসব উল্টাপাল্টা কথাগুলো বলে, শুনলে কান গরম হয়ে যায়। এরপর রোদ্দুরের সামনে দাঁড়ালেও দাদির উল্টাপাল্টা কথাগুলো মাথায় আসবে। ঝিলমিল অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল অন্ধকার করিডোর দিয়ে… হঠাৎ খাম্বার মত কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগল। কিন্তু ওটা খাম্বা ছিল না, র’ক্তে মাংসে গড়া মানুষ। এই রাতে এক কাপ চায়ের জন্য রোদ্দুরের মন আনচান করছিল, রান্নাঘর থেকে ঘুরেও আসলো কিন্তু চায়ের সরঞ্জাম কোথাও খুঁজে পেল না। আচমকা ঝিলমিলকে দেখে আশার আলো দেখতে পেল। কিন্তু ঝিলমিল ওকে দেখেই তিড়িং বিড়িং করে কয়েকটা লাফ দিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু তোর সাথে কিছুতেই থাকব না…. যাবোও না। যে যাই বলুক না কেন, আমি কোনো স্বামী-টামি বুঝি না।’
রোদ্দুর অবাক হয়ে বলল, ‘কি হয়েছে?’
‘নাআআআআআ, কিছু হয় নাই।’ ঝিলমিল চেঁচিয়ে উঠল।
রোদ্দুর এগিয়ে এসে ঝিলমিলের মুখ চেপে ধরল। ধমক দিয়ে বলল, ‘চুউউপ। আশেপাশের সবাইকে জাগাবি নাকি? কি হয়েছে সেটা বল চুপচাপ। তুই না একটু আগে ঘুমাতে গেলি, এখন আবার উঠে এলি কেন?’
‘এই বাড়ির সবাই ডেঞ্জারাস, এটা আমি বিয়ের পর বুঝতেছি। এতদিন বুঝি নাই। তুই আমাকে নিয়ে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হবি। আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকব না। তারপর বাবা আমাকে কোন না কোন ভার্সিটিতে ভর্তি করাইছে, সেখানে নাকি আবার সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। আমার পড়াশোনা আছে, বইখাতা নিয়ে একেবারেই চলে যাব। আমি যদি আর আসি কখনো এই বাড়িতে!’
‘একটা কাজ করতে পারবি?’
‘বল.. তোর কাজ করতে করতেই তো জীবন যাবে।’
‘এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া!’
‘এতকাল শুধু শুনে এসেছিলাম, এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা বলুন জাহাপনা, এই রাত-বিরাতে আপনার আর কি কি আবদার রয়েছে?’
‘আপাতত এক কাপ চা। কিন্তু প্লিজ, লবণ-মরিচ চায়ে দিস না। আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। চা ছাড়া ঘুম ধরবে না সহজে।’
ঝিলমিল ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ঠিক আছে।’
এরপর ঝিলমিল কোনরূপ ঝামেলা ছাড়া, রোদ্দুর এর উপর অসীম দয়ামায়া দেখিয়ে খুব সুন্দর এবং যত্ন সহকারে এক কাপ চা বানিয়ে আনল। রোদ্দুর অবশ্য প্রশংসা করতে কার্পণ্য করল না।
.
ঝিলমিলের সারারাত ঘুম হলো না। এপাশ ওপাশ করে রাত কাটল। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নিজের কাপড়চোপড়, বই খাতা সব গুছিয়ে নিল। বইপত্র গোছাতে গোছাতে বইয়ের মধ্যে থেকে টুপ করে একটা চিরকুট পড়ে গেল। ঝিলমিল সেটা হাতে নিয়ে পড়ে হেসে উঠল। গতবছর শর্মি আপুর বিয়ের আগেরদিন এই চিরকুটটা সে ঝিলমিলকে দিয়ে গিয়েছিল রোদ্দুরকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ঝিলমিলের তো মনেই ছিল না। আহারে বেচারী! মনে মনে যাকে পছন্দ করল, তার নাগাল’ও পেল না। কিন্তু চিরকুট’টা ঠিকই রয়ে গেছে। ঝিলমিল ওটা ওভাবেই বইয়ের মাঝে রেখে দিল। যদিও এখন এটা রোদ্দুরকে দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, তবুও সুযোগ পেলে দেখাতে হবে! আর শর্মি আপুর’ও কিছুদিন পর বেবি হবে, তার’ও নিশ্চয়ই রোদ্দুরের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই!
ঝিলমিল সবকিছু গোছগাছ করে নিচে নামল। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি একটু শিউলির সাথে দেখা করে আসছি। কেউ যেনো আমার খোঁজ না করে।’ ঝিলমিল বের হতেই মূল ফটক থেকে হঠাৎ দেখতে পেল রোদশী এবং তার হাজব্যান্ড আসছে। ঝিলমিল দৌড়ে গেল, এক ছুট্টে বোনকে জড়িয়ে ধরল।
আনন্দিত স্বরে বলল, ‘আপুউউ….. আপ্পুউ, কতদিন পর! তুমি আসবে আমাকে আগে জানাও নাই কেনো? একটু হলেই তো আমি চলে যাচ্ছিলাম।’
রোদশী হেসে বলল, ‘ধুর পাগলী! আমি তোকে যেতে দিলে তো তারপর যাবি? তোর ভাইয়ার তো সময় মেলে না। বিয়ের পর তোর আর রোদ্দুরের সাথে দেখাও করতে পারে নাই। তাই দু’দিন ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।’
রোদশীর হাজব্যান্ড ফারহান বলল, ‘তোমাকে দেখলাম দু’দিন আগে মনে হচ্ছে কত্ত ছোটো ছিলে। আর এখন বিয়ের পর দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় হয়ে গেছ। কী আশ্চর্য! শালীর বিয়ে খাওয়ার সৌভাগ্য হলো না আমার।’
‘আচ্ছা আসুন ভাইয়া, বাড়ির ভেতরে আসুন। এরপর আপনার শাশুড়ি যদি দেখে তার বড় জামাইকে আমি বাহিরে দাঁড়া করিয়ে রেখে গল্প শুরু করে দিয়েছি, তাহলে নির্ঘাত আমার পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙ্গবে।’
ওরা বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করল। হৈ-হুল্লোড়ের ধুম পড়ে গেল। ঝিলমিলের আর যাওয়া হলো না। ভালো-খারাপের মাঝে তব্দা খেয়ে পড়ে রইল। ওইদিকে রোদ্দুর নাচতে নাচতে দুলাভাইয়ের সাথে নদীর পাড় গেল মাছ ধরতে। মা-চাচিরা সবাই মিলে পিঠা পুলি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ঝিলমিল ঘরে বসে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। রোদশী এসে পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর বল, সংসার জীবন কেমন কাটছে?’
ঝিলমিল হাই তুলে উত্তর দিল, ‘ভীষণ বোরিং।’
‘কেনো? এমন তো না যে তোর সাথে অপরিচিত কারো বিয়ে দেওয়া হয়েছে তাও ধরে বেঁধে। রোদ্দুর যথেষ্ট ম্যাচিউর, ওর বোধবুদ্ধি জ্ঞান হাজার গুণে ভালো। আর তাছাড়াও রোদ্দুর কিন্তু মানুষের মন বুঝতে পারে। তোর হয়ত মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। ব্যাপার না, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর রোদ্দুর যেহেতু আছে এবং তুই ওর সাথে আছিস তাই আমরাও তোকে নিয়ে একদম চিন্তিত নই। মা যে কী নির্ভার হয়েছে বলার মত না। সবসময় আমাকে তোর কথা বলে। বাড়ির বাকিরাও খুব খুশি দেখলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাবে মেজো চাচি হয়ত মনক্ষুণ্ণ হবে, কিন্তু তাকেই সবচেয়ে বেশি আনন্দিত মনে হচ্ছে।’
রোদশী রোদ্দুরের কত যে প্রশংসা করল, তার ইয়ত্তা নেই।
ঝিলমিল চুপচাপ সব শুনে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘সারা দুনিয়া খুঁজে আমি ওর মত বজ্জাত পাব না।’
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা —১৭৭৯