#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২৭]
~আফিয়া আফরিন
রোদ্দুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ঝিলমিল ওর চোখের দিকে তাকাল না, যেনো কিছু ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। তবে রোদ্দুর খোলাসা করল বিষয়টা। বলল, ‘আমি চা খাওয়ার কথা বলতে চাইছিলাম। তুই যে কোথা থেকে কি ভেবে বসে আছিস কে জানে!’
ঝিলমিল এতক্ষণ চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চা আমরা একটু আগে খেয়েই এসেছি। আবার কেনো?’
‘এটা নেশা, আমাকে ঘন্টায় ঘন্টায় চা দিলেও কোনো আপত্তি নেই। বাই দা ওয়ে, গেলাম চা বানাতে। খাবি?’
ঝিলমিল উপর নিচ মাথা নাড়াল। রোদ্দুর রান্নাঘরে যেতেই ওর ফোন বেজে উঠল। ঝিলমিল হাতে নিয়ে দেখল, ওদের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। তাই রিসিভ করে কথা বলল। ওপাশ থেকে একজন রোদ্দুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই ঝিলমিল বলে দিল, ‘ও চা বানাচ্ছে রান্নাঘরে।’
তারপর তো একটা ছোটখাটো হৈচৈ পড়ে গেল। বলাবলি করছিল, ‘আমরা আমাদের স্বামীদের দিয়ে সামান্য কিছু করাই নাই, অসুস্থ থাকলেও জীবনে বলি নাই এক গ্লাস পানি এনে দাও। আর তুই সেখানে ওকে দিয়ে চা বানাচ্ছিস?’
ঝিলমিল বোকার মত বলে বসল, ‘ও তো রান্নাও করে। সকাল, দুপুর এবং রাতেরটাও। তাতে কি হয়েছে?’
ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঝিলমিলের কথাবার্তা শুনেই একেকজনের আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!
.
ওকে যেহেতু রোদ্দুরের সাথেই থাকতে হবে, তাই মাহমুদ সরকার অর্থাৎ ঝিলমিলের বাবা এখানকার কলেজের ট্রান্সফার করিয়ে দিয়েছেন। এতদিন তো বাড়িতে থাকার কারণে কলেজে যাওয়া হয় নাই, একটাও ক্লাস করা হয়নি অথচ পরীক্ষা নাকি সামনের সপ্তাহে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে রোদ্দুর নিজেই আগ্রহের সহিত বলল, ‘যাবি নাকি আজকে কলেজে? ক্লাস না করিস, অন্ততপক্ষে ঘুরে আয়। দেখে আয় আর সবার সাথে পরিচিত হয়ে আয়। পরীক্ষার সময় হুট করে গিয়ে উপস্থিত হলে, কেমন একটা দেখায় না!’ ঝিলমিলের কাছেও কথাটা যথার্থ বলে মনে হলো।
রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর দেরি হয়ে যাবে না?’
‘একটু তো হবে তবে সেটা সামলে নিব। তুই গিয়ে রেডি হয়ে নিচে আয়। আমি ওয়েট করছি।’
রোদ্দুর আর ঝিলমিলের শিডিউল মেলা অসম্ভব। ঝিলমিলের একটায় ছুটি আর রোদ্দুর ছাড়া পায় পাঁচটায়। বাসা থেকে কলেজ অনেক বেশি দূরে নয়, রোদ্দুর রাস্তাঘাট ভালো করে চিনিয়ে দিল যাতে পরবর্তীতে একা চলাফেরা করতে সমস্যা না হয়। ঝিলমিলের কিছু হচ্ছে না, যত টেনশন সব রোদ্দুরের। একদিকে অফিসের সময় পার হয়ে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে ঝিলমিলকে একা ছাড়ার ভরসা পাচ্ছে না। ‘কি করবে কি করবে’ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল এখানেই তার এক ফ্রেন্ডের বাসা। রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ ফোন করে তাকে আসতে বলল। ওর নাম রুনা। মেয়েটা এসে পৌঁছাতেই সে ঝিলমিলকে ওর দায়িত্বে রেখে দ্রুত চলে গেল।
ঝিলমিল বলল, ‘ও যে আপনাকে ডেকেছে আমার জানা ছিল না। অযথা মানুষকে প্যারা দেয়। আমার সমস্যা হবে না, আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। আমি দেখি একটা ক্লাস করার চেষ্টা করি।’
রুনা বলল, ‘ক্লাস করো সমস্যা নাই তবে রোদ্দুর যেহেতু তোমাকে দেখে রাখতে বলেছে তাই এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি না। তুমি তোমার ক্লাসে যেতে পারো কেনো সমস্যা নেই। তার আগে আমায় তোমার ফোন নম্বরটা দিয়ে যাও, যাতে তোমায় খুঁজে পাই।’
ঝিলমিল মুখ কালো করে ফেলল। ভেবেছিল, রোদ্দুর চলে গেলে একা একাই সবটা এনজয় করতে পারবে। কিন্তু তার সুযোগ কোথায়? জুটিয়ে দিয়ে গেছে না একজনকে! ঝিলমিল ওর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় ভাবছিল। কিন্তু এতো ফেবিকলের মত সেঁটে আছে।
ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল, ‘আপু আপনি কি বিয়ে করেছেন?’
‘হুঁ। কেনো?’
‘ভাইয়া আপনাকে খুঁজবে না?’
‘না। তোমার ভাইয়া এই মুহূর্তে বাসায় নেই।’
‘ওহ।’ ঝিলমিল হতাশ ভঙ্গিতে উত্তর দিল। তারপর ভেতরে এসে ওর ডিপার্টমেন্ট খুঁজে বের করল। ক্লাসের খোঁজ করে গিয়ে দেখল, কেউ নেই সেখানে। এইদিকে রুনাকেও একটা রং নম্বর দিয়ে এসেছে। নীচে নামল খুব সাবধানে। করিডোরে রুনাকে দেখে ওইদিকে গেল না। ক্যাম্পাসের মাঠ, ক্যান্টিন ভনভন করে ঘুরতে লাগল। গিয়ে এক পলক রুনাকেও দেখে এসেছে। ওই বেচারী আশেপাশে তাকিয়ে ঝিলমিলকে খুঁজছে। ঝিলমিল নিজের ফোনটা বন্ধ করে রাখল। রোদ্দুর যেকোনো মুহূর্তে উল্টাপাল্টা নম্বর দেওয়ার অপরাধে ফোন করে ধমকাতে পারে। এখন এই পরিবেশে কারো ধমক খেতে ইচ্ছে করছে না। ঝিলমিল আবারও উপরে গিয়ে পরীক্ষার রুটিন দেখে এলো। সে স্টুডেন্ট হিসেবে আহামরি নয়, সবসময় ভালো/খারাপের মাঝামাঝি অবস্থান করে। আজ পর্যন্ত যত পরীক্ষা দিয়েছে, কখনো পরীক্ষা নিয়ে টেনশন কাজ করে নাই। আজও রুটিনে দেখল, একদিনে দু’টো করে পরীক্ষা। তাতে কী? পরীক্ষার আগের দিনটুকু তো আছেই।
ঝিলমিল দেখল একটা বাজার সাথে সাথে সবাই নিজেদের ক্লাসরুম থেকে নিচে নামছে, অর্থাৎ এই সময় ছুটি হয়ে গেছে। সে নিজেও কলেজ থেকে বের হলো। ফোন অন করে রোদ্দুরকে মেসেজে করল, ‘আমি এখন বাসায় যাচ্ছি।’ কললিস্ট চেক করে দেখল রোদ্দুর ইতোমধ্যে কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছে। সে আর ব্যাক করল না। সোজা বাড়ির করে হাঁটতে লাগল। একটু আগে রোদ্দুরের সাথে আসার সময় রাস্তা ভালো করে মুখস্থ করে নিয়েছে। রোদ্দুর বলে দিয়েছে, রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বললেই ডিরেক্টর বাসায় পৌঁছে দিবে। কিন্তু ঝিলমিলের রিকশায় চড়তে মন চাইল না। ও হাঁটতে লাগল, আশেপাশে তাকিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা উপলব্ধি করতে করতে প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
সে সময় রোদ্দুরের ফোন এলো। ঝিলমিল ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রোদ্দুর কড়া গলায় বলল, ‘কোথায় তুই?’
‘এইতো বাড়িতে চলে এসেছি।’
‘তুই রুনাকে ভুলভাল নম্বর দিয়েছিস কেনো? তারপর আবার নিজের ফোনটাও অফ করে রেখেছিস। নিজেকে কি ভাবিস বল তো? পাগল বানিয়ে ছাড়বি একদম। আচ্ছা, এই ফাজলামিগুলো করে তুই ঠিক কি পাস?’
ঝিলমিল আনন্দিত স্বরে বলল, ‘মজা পাই, আনন্দ পাই, মানসিক শান্তি পাই।’
রোদ্দুর হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ‘এখন সোজা বাসায় গিয়ে, কোথাও বের হবি না। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসছি। বাই দা ওয়ে, ক্লাস করেছিস?’
‘না, ঘুরে বেড়ালাম।’
‘বাহ! প্রথম দিনেই? ভালোই।’
রোদ্দুরের সাথে কথা বলতে বলতে ঝিলমিল বাড়ি পৌঁছে গেছে। ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে নিল। খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই, রোদ্দুর রান্নাবান্না করে রেখেই যায়। ঝিলমিল আজ নিজে কিছু করার চেষ্টা করল। যেহেতু রোদ্দুর তাকে আলসে বলে, কুঁড়ে বলে তাই উচিত নিজেকে প্রমাণ করা। বাড়িতে থাকতে কখনোই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় নাই। হয়তো কখনো কখনো চা বানিয়েছে কিন্তু এর বাহিরে অন্যকিছুতে সে পটু নয়।
আজ একটা পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চরম হতাশ হয়ে নিজেকে নিজেই কুঁড়ে উপাধি দিয়ে দিল। বলল, ‘ঝিলমিল তুই শুয়ে বসে জমিদারগিরি করেই দিন কাটা। তোকে দিয়ে অন্তত রান্না বান্না হবে না। ওটা রোদ্দুরের দায়িত্ব, ও ঠিক করে নিবে। তুই শুধু চুপচাপ গিলে যা।’
রোদ্দুর বাড়ি ফেরার পর ঝিলমিলের উল্টাপাল্টা কাজের জন্য কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করল। কিন্তু সে ওসব কানেই নিল না। প্রতিবারের মত এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিল।
এরপর থেকে ঝিলমিল রোজ ক্লাসে যাতায়াত করে। তিন/চারদিনের মধ্যে তার বন্ধু-বান্ধব’ও জুটে গেছে। রোদ্দুর প্রতিদিন একটা বাজার দশ মিনিট আগে ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়। ওর সে সময়ে ব্রেক টাইম বলে বেশ সুবিধা হয়েছে। ঝিলমিনের ছুটি হলে ওকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে তারপর আবার নিজে উল্টোদিকে রওনা হয়। এটা যে রোদ্দুরের জন্য একটু কষ্টকর হয়ে গেছে, বেশ ভালোই বুঝেছে সে। পরীক্ষার আগে পরেই যা সমস্যা, তারপর তো আর ক্লাসে যাবে না; যাওয়ার প্রয়োজন’ও নেই।
আজ এই প্রথম এখানে এসে সে ক্লাস বাদ দিয়ে মাঠে বসে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল আর আজকেই রোদ্দুরের নজরে পড়ে গেল। সে শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বাড়িতে যখন থাকে, তখন বোধহয় ঠোঁটের আগায় পিস্ত’ল নিয়ে চলাফেরা করে। কেউ কিছু বললেই সাথে সাথে ঠাস্ ঠাস্। আর এখন? কথা বলছে না যেনো মধু ছড়াচ্ছে। সাথে আবার দু’টো ছেলেও আছে। রোদ্দুরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে কিনা এই মেয়ের জন্য কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এখানে এসেছে ওকে পাহাড়া দেওয়ার জন্য আর ও ওইদিকে অন্যদের সাথে হেসে হেসে গল্প করছে! রোদ্দুরের সহ্য হলো না, কিছু বলতেও পারল না। ঝিলমিলের সাথে সেরকম কথাও হলো না, মুখটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে রাখল।
সন্ধ্যায় ঝিলমিল রোদ্দুরের উদ্দেশ্য বলল, ‘তোর কি কিছু হয়েছে? মন খারাপ? গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি? মুখ এইরকম বাঁদরের মত করে রেখেছিস কেনো?’
‘মানুষের মত হাসতে পারি না তাই বাঁদরের মত মুখ করে রেখেছি। এতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
ঝিলমিল ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘কেনো রে? মানুষের হাসি দেখলে কি হিংসা হয়?’
এমনিতেই ভার্সিটিতে ওই দৃশ্যটা দেখার পর রোদ্দুরের মেজাজ গরম এখন আবার ঝিলমিলের কথা শুনে রাগে ব্রক্ষতালু জ্বলে যাচ্ছে। ঝিলমিলের দিকে আগুন চোখে তাকালেও কিছু বলল না। রোদ্দুরের এমন রাগ ঝিলমিল বেশ উপভোগ করছিল। আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ‘আচ্ছা আজ তোর মুড অফ কেনো? গার্লফ্রেন্ডের সাথে বুঝি অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে? থাক মন খারাপ করিস না। তুই আমাকে আবার ওর ফোন ধরিয়ে দিতে পারিস, আমি কথা বলে তোদের দু’জনের ঝামেলা মিটিয়ে দিতে পারি।’
রোদ্দুর একটা চেয়ার টেনে ঝিলমিলের মুখোমুখি বসল। রোদ্দুরকে এগিয়ে আসতে দেখে ঝিলমিল পিছু হটল। এই ছেলেকে একদম বিশ্বাস হয় না, যেকোনো মুহূর্তে ঘাড় ধরে মটকে দিতে পারে।
তবে রোদ্দুর তা করল না। বেশ ভদ্র এবং শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড বা অন্যকিছু সম্পর্কে তোকে এত ভাবতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে। বাহিরে তো ভালোই দেখি, বাড়ি ফিরলে কি মাথার তার ছিঁড়ে যায়? আর আরেকটা কথা, কথায় কথায় সানিয়ার কথা তুলবি না। ওর সাথে একসময় আমার সম্পর্ক ছিল কিন্তু এখন নেই….. নেই মানে নেই। আর যাই করিস না কেনো, নেক্সট কখনো ওর নাম আমার সামনে নিবি না। আই ক্যান’ট স্ট্যান্ড ইট। আই হেইট হার।’
ঝিলমিল শুনল, চুপ করে রইল। রোদ্দুর যে কথাটা সিরিয়াস ভাবে বলেছে, এটা বোঝার মত বোধবুদ্ধি তার রয়েছে। রোদ্দুরের দিকে তাকাল, একটু আগে ঠিকঠাক ছিল এখন যেনো মুহূর্তের মধ্যেই কাঠিন্যের মুখোশ পড়ে ফেলেছে।
.
পরের দিন’ও একই ঘটনা। রোদ্দুর রীতিমতো রাগে কাঁপতে লাগল। তবে নিজে বুঝতে পারল না, সে হঠাৎ ঝিলমিলের ব্যাপারে এতটা পজেসিভ হয়ে গেছে কেনো? শুধুমাত্র বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন বলেই! হতে পারে, এই নশ্বর পৃথিবীতে কতই তো অবিনশ্বর ব্যাপার ঘটে। রোদ্দুরের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হচ্ছে। ঝিলমিলকে অন্যকারো সাথে হেসে কথা বলতে দেখেই নিজের ঠান্ডা জেদ আর শীতল রাগ যে মেরুদন্ড বেয়ে তিরতির করে নেমে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছে। এখন ওই মেয়েটাকে কি করা উচিত? একটা থাপ্পর মেরে কি বলবে, ‘কেনো আরেকজনের সাথে তোর এত হাসিমুখে কথা বলতে হবে? যত হাসি সব আমার জন্য তুলে রাখা উচিত। অথচ তুই সবসময় করিস উল্টোপাল্টা। মানুষের সামনে গম্ভীর মুখে বসে থাকা উচিত ছিল, অথচ তুই এখানে হাসি থামাতে পারছিস না।’
কিন্তু রোদ্দুর তো আর জোর করে নিজের জন্য ঝিলমিলের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে না। কিন্তু যেটা করতে পারবে সেটা তো করবেই। মন-মেজাজ খিঁচিয়ে আছে, এই কনকনে শীতেও মাথা গরম। এই মেজাজ সহজে ঠিক হবে না। ভেবেছিল নিজেকে সামলে ঝিলমিলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হবে এবং দু’টো ধমক মারবে এসব বেয়াদবির জন্য। তার আগেই ঝিলমিল বেরিয়ে এলো। রোদ্দুরকে গেটের সামনে দেখে মুখ কালো করে এগিয়ে এসে বলল, ‘কখন এসেছিস? একটা ফোন করবি না? আমাকে একাও যেতে দিবি না, নিজেও দেরি করে আসবি! তো কখন এলি? আজ ফোন করলি না যে?’
রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত চেপে ধরল এবং এক ঝটকায় ওকে টান দিয়ে গেটের বাহিরে নিয়ে এসে বলল, ‘তোর চেহারা দেখার ইচ্ছে হচ্ছে না আমার।’
.
.
.
চলবে…….
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২৮]
~আফিয়া আফরিন
আচমকা রোদ্দুরের এমন কথা শুনে ঝিলমিল অবাক হলো বটে! বারবার কারণ জিজ্ঞেস করার পর’ও তার উত্তর পাওয়া গেল না। চুপচাপ বাক্যব্যয় না করে নিজের দায়িত্ব পালন করল। ঝিলমিল মন খারাপ করে বাড়ি চলে এসেও কিছু মুখে তুলল না। তার উপর অকারণে কেউ রাগ করে থাকলে সেটা ভালো লাগে না। রোদ্দুর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবে তারপর ওর থেকে রাগের কাহিনী শুনবে! কিন্তু সন্ধ্যায় ফেরার পরেও রোদ্দুরের মুখটা কালো হয়ে রইল। ঝিলমিলের অন্যদিনের মত ফাজলামি করল না। বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই আমার উপর কেনো রাগ করে আছিস বলবি প্লিজ। আমার জানামতে, আমি কিন্তু উল্টাপাল্টা কিছু করি নাই। তুই বলেছিস, ভদ্র হয়ে থাকতে আর আমি তো তাই ছিলাম।’
রোদ্দুর কিছু বলল না। কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে এসে ফোন নিয়ে বিছানায় হেলান দিল। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে ঝিলমিল পুনরায় বলল, ‘আমি তোকে কিছু বলছি।’
রোদ্দুর সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনের মধ্যে দিয়ে বলল, ‘হুঁ?’
‘তাকা আমার দিকে। একটা কথা বলেছি। কানে গেছে?’
‘কি কথা?’
ঝিলমিল নিজের রাগটুকু সামলে বলল, ‘মুখ কালো করে রেখেছিস কেনো? কেউ আমার উপর রাগ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না। আর অকারণে রাগ করে থাকলে তো চরম বিরক্ত লাগে।’
‘তোর কি মনে হয় আমি তোর উপর রেগে আছি?’
‘হুম…. মনে হয়।’
‘আমি তোর উপর রেগে থাকব কেনো? তুই নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছিস, ক্লাস করছিস, মোটামুটি পড়ালেখা করছিস, সবদিকে খেয়াল রাখছিস, দায়িত্ব পালন করছিস, ক্লাস শেষে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছিস; তবে আমি রাগ কেনো করব? সব তো ঠিকই আছে।’ শেষের কথাটুকু রোদ্দুর একটু ঠেস মেরেই বলল। ঝিলমিল বুঝতে পারল কিনা কে জানে! সে রোদ্দুরের পাশে বসে বলল, ‘সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তোর মুড ঠিক নেই। বল না কি হয়েছে? তখন আমাকে কেনো বললি, আমার মুখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না?’
‘এমনিই কথার কথা, ভুলে বলে ফেলেছি।’
রোদ্দুরের কথাবার্তার ধরণ অন্যদিনের তুলনায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। ঝিলমিল আর কথা বাড়াল না। যে স্বেচ্ছায় কিছু বলতে চায় না, তাকে জোরাজুরি না করাই ভালো। আবার হিতে বিপরীত হয়ে গেলে সমস্যা। ঝিলমিল রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়’ও এলো না, চুপচাপ শুয়ে থাকল। রোদ্দুর ওর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরে এসে বলল, ‘জমিদারের মত অসময়ে শুয়ে আছিস কেন? খেতে আয়।’
‘আমি খাব না।’ ঝিলমিল মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল।
‘ঠিক আছে। খেলে খাবি আর না খেলে নাই। আমি এত বারবার অনুরোধ করতে পারব না। মানুষের এতই রংঢং! না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি দেখতে পারব না। যখন বলি তখন কথা শোনে না, পরে কিছু বললে দেখিস। তখন কিছু শোনার জন্য আমি বসে থাকব না।’ রোদ্দুর একা একাই আবোলতাবোল কীসব বকবক করতে লাগল। ঝিলমিলের হাসি পেলেও হাসল না। উঠে গায়ে চাদর পেঁচিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হু হু করে বাতাস আসছে। ঝিলমিল চাদরটা ভালো করে টেনে জড়িয়ে নিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে কাছে কোথাও৷ আকাশের চাঁদ তারারাও স্তব্ধ হয়ে একইভাবে তাকিয়ে আছে ঠান্ডা দৃষ্টিতে। একমাত্র প্রকৃতিতে বাতাস’টাই যেনো চলমান। বাতাসের শনশন শব্দ ভেদ করে পাশে বাঁশবাগানের বাঁশের পাতার আওয়াজ ভেসে আসছে। শহরের এই প্রান্ত থেকে আবার পেঁচার ডাক’ও ভেসে আসছে। অন্য সময় হলে ঝিলমিল ভয় পেত, কিন্তু এখন ভয় লাগছে না। ঠাঁয় এখানেই দাঁড়িয়ে আছে রেলিংয়ে কপাল ঠেকিয়ে।
ঝিলমিলকে ঘরে দেখতে না পেয়ে রোদ্দুর বারান্দায় খোঁজ করতে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই রাতে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে। ভেতরে আয়। চন্দ্রবিলাশ পরে করলেও চলবে। সামনে পরীক্ষা।’
ঝিলমিল নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার কথা কারো না ভাবলেও চলবে। এই গুরুদায়িত্ব আমি কারো উপর অর্পণ করি নাই।’
‘বাজে বকিস না, ভেতরে আয়।’
ঝিলমিল পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কেনো শুনব আমি তোর কথা?’
‘কেনো শুনবি না?’
‘শোনার ইচ্ছে নেই।’
‘উফফফ, এত ত্যাড়ামি করিস কেনো? সোজাভাবে কথা বলতে পারিস না?’ রোদ্দুর চরম বিরক্ত।
‘তুই এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছিস কেনো? মনে হচ্ছে, তুই পাশের বাড়ির আন্টিদের সাথে কথা বলছি। এত জেরা, এত প্রশ্ন! তোর কাছে ওইসব আন্টিরাও ফেল।’
রোদ্দুর মাথা চুলকে ভেতরে চলে গেল। ঝিলমিল মুখ টিপে হাসল। সে আরোও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, রোদ্দুরের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। ওর উপর যেমন রাগ দেখাল, ঠিক সেইরকম ঝিলমিল’ও একটূ রাগ দেখাল। যদিও খুব খিদে পেয়েছে। দুপুরেও কিছু খাওয়া হয় নাই আবার রাতেও না। শোবার ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো দেখে সেটা অফ করে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। এখানে এসে আলো জ্বলাতেই যেটা যেরকম ছিল, সেটা সেইরকম’ই দেখতে পেল। আশ্চর্য! তারমানে রোদ্দুর’ও কিছু খায় নাই। ঝিলমিল বিড়বিড় করতে করতে পাশ ফিরতেই চমকে উঠল। পেছন দিকে ফিরে চোখ বুঁজে ফেলল এক লহমায়। রোদ্দুর এখানে কি করে? কীভাবে এলো? তাহলে ঘরে কে? সে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে আবারও এইদিকে ফিরল। রোদ্দুর বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত বেঁধে চোখ ছোটো ছোটো করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ঝিলমিল ফাঁকা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে?’
কথাটা বলতে গিয়ে নিজের কথাই গলায় আটকে গেল। কেশে এবং হিঁচকি তুলে বিতচ্ছিড়ি অবস্থা হলো। রোদ্দুর একগ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘সাবধানে!’
ঝিলমিল এক ঝটকা ওর হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ‘তুই এখানে কি করিস?’
‘দেখলাম একটু আগে এক শাকচুন্নী মামদো ভূত বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসছে। ভাবলাম, কোথায় না কোথায় যাচ্ছে! তাই পিছু নিলাম। এসে দেখি শাকচুন্নীর খিদে পেয়েছে।’
ধরা পড়ে গিয়ে ঝিলমিল আর কিছু বলার অবকাশ পেল না। রোদ্দুর নিজেই খাবার বেড়ে দিয়ে ঝিলমিলকে খাওয়ার ইশারা করল। ঝিলমিল বসলে রোদ্দুর’ও উল্টোপিঠে বসল। ঝিলমিল খাচ্ছে না দেখে বলল, ‘খেয়ে নিন জমিদার সাহেবা। আপনার জন্য এই অধম আমিও না খেয়ে অপেক্ষা করছি। আপনি খাবার মুখে তুললে তারপর আমিও মুখে তুলব। নিন, প্লিজ।’
ঝিলমিল কটমট করে তাকিয়ে খেতে লাগল। এমনভাবে খাবার চাবাচ্ছে মনে হয়, খাবার নয়; সে আস্ত রোদ্দুরকেই চাবাচ্ছে।
ঝিলমিলের এমন অবস্থা দেখে রোদ্দুর মুচকি মুচকি হাসছিল। আর ঝিলমিল? তার ওই হাসি দেখে অন্তর শুধু জ্বললই না, অন্তর পুড়ে খাক হয়ে গেল।
.
পরদিন ঝিলমিলের ভার্সিটি পৌঁছাতে রোদ্দুরের বেশ দেরি হলো। পথিমধ্যে তানভীরের সাথে দেখা হয়েছিল। ফের বিরক্তিকর সব কথাবার্তা বলছিল। তার কথার সারমর্ম একটাই ছিল, সানিয়া যতই রোদ্দুরের নামে মুখে বুলি ফুটাক না কেনো, সে যেকোনো মূল্যে সানিয়াকে পুনরায় রোদ্দুরের থেকে ছিনিয়ে নিবে।
মূর্খের কথা শুনে রোদ্দুর মনে মনে হাসে। সানিয়ার অবস্থান বর্তমানে তার জীবনের কোথাও নেই। যেটুকু শূন্যস্থান ছিল ততটুকু ঠিকই ভরাট হয়ে গেছে, কারো জন্য কোনোকিছু থেমে থাকে না। তবে ঝিলমিলের ব্যপারটা এখনও তার কাছে অস্পষ্ট। রোদ্দুর নিজেও চায়, বিষয়টা দ্রুতই খোলাসা হোক; নিজেদের আয়ত্ত্বে আসুক।
আজ ঝিলমিলকে একলাই দেখল রোদ্দুর। আশেপাশে তাকাল কোথাও সাঙ্গপাঙ্গদের দেখা পেল না। রোদ্দুরকে দেখে ঝিলমিল দৌড়ে এগিয়ে এলো। বলল, ‘কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছিস? এতো দেরি কেনো? এখন আমি যদি তোর জায়গায় হতাম, তাহলে তো চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতি।’
‘ওরা কই?’
‘কারা?’
‘যাদের সাথে সবসময় হিহি/হাহা/হুহু/হুআআআ করে হাসতে হাসতে ড্যাঙড্যাঙ করে কথা বলিস। আজ দেখতে পাচ্ছি না।’
রোদ্দুর কথাটা বলল একটু বাঁকা ভাবে। ঝিলমিলের ইজ্জতে লাগল। সে কি ড্যাঙড্যাঙ করে কথা বলে? এগুলা আবার কি অভদ্র ধরণের কথাবার্তা! ওরা ক্লাসমেট, তাই টুকটাক কথা বলতেই হয়। সে তিক্ত স্বরে বলল, ‘এভাবে বলতে পারিস না। তুই যখন তোর বন্ধুদের সাথে কথা বলিস, তখন আমি এসব বলি?’
‘কিছু বলার মত সুযোগ পাস না তাই বলিস না।’
ঝিলমিল কোমড়ে দু’হাত গুঁজে বলল, ‘আচ্ছা? তুই খুব সুযোগ পাচ্ছিস?’
‘সুযোগ না পেলে এমনি এমনি বলব? যাইহোক বেশি কথা বললে অযথা কথা বাড়বে। রিকশায় তুলে দিচ্ছি, সোজা বাড়ি যাবি। তারপর গিয়ে পড়তে বসবি। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে তোর বাপ-চাচা আমায় কথা শোনাবে তা কিন্তু আমি মানব না। বলবে, বিয়ের পর তোর রেজাল্ট খারাপ হলো নিশ্চয়ই তোর স্বামী তোকে বাড়ির সব কাজ করাইছে; পড়াশোনা করতে দেয় নাই।’
রোদ্দুরের কথা শুনে ঝিলমিল রাস্তার মধ্যেই ওর পিঠে দু’ঘা দিয়ে দিল। রোদ্দুর অসহায় গলায় বলল, ‘ছিঃ এসব কী অত্যাচার! তোর মাকে জিজ্ঞেস করে দেখিস তো সে তোর বাপের উপর এইরকম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে কিনা!’
‘একদম বাজে কথা বলবি না। এখন তোর সময় নষ্ট হচ্ছে না। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছে যা।’
ঝিলমিল রোদ্দুরের হাতে খামচি মেরে বলল, ‘যাহ কঞ্জুস কোথাকার!’ রোদ্দুর ঝিলমিলকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও রওনা দিল। এই মেয়ে যেভাবে খামচা’খামচি করে দু’দিন পর তো আর তার পাত্তা পাওয়া যাবে না। রোদ্দুর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আফসোসে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করল।
.
ঝিলমিল বাড়ি পৌঁছে কিছুক্ষণ বই ঘাঁটাঘাঁটি করল। পড়ায় মন বসছিল না, তাই শিউলির সাথে কথা বলে কিছু সময় পার করল। তারপর বাড়ির সবার সাথে কথাবার্তা বলল।
দাদি বেশ খুশি খুশি গলায় জানতে চাইলেন, ‘কিরে নাতনি, সংসার কেমন যাচ্ছে?’
‘সেই সেই একদম হেব্বি! তুমি এসে দেখে যাও।’
‘না বাপু, তোর সংসার তুই কর। আমার নাতির দিকে একটু খেয়াল রাখিস। ওর তো আবার জ্বরের ধাত আছে, কথায় কথায় ঠান্ডা লাগে। সন্ধ্যায় বাহিরে যেতে দিবি না, সাবধানে থাকতে বলবি।’
দাদির কথায় ঝিলমিল সায় জানাল। ‘সংসার’ শব্দটা অদ্ভুত শোনাল। মা-চাচিদের ক্ষেত্রে ঠিক আছে, কিন্তু ঝিলমিলের মনে হচ্ছে তার সাথে সংসার যায় না। বড় চাচির মত গুণী মানুষ, মেজো চাচির মত সহ্য ক্ষমতাশীল মানুষ, মায়ের মত সহজ-সরল মানুষের সাথে সংসার যায়। কিন্তু সে তো উড়নচণ্ডী, অতিরিক্ত খামখেয়ালি, মাঝেমধ্যে নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়ে যায়। সেখানে রোদ্দুর কীভাবে সহ্য করবে ওকে? বা কীভাবে ভাববে সারাজীবন একসাথে থাকার কথা? সে যাইহোক ঝিলমিল এতকিছু নিয়ে চিন্তা করছে না, যখন যা হবে দেখা যাবে।
রোদ্দুর বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। রোদ্দুরকে দেখেই ঝিলমিল মুখ কুঁচকে ফেলল। রোদ্দুর অবশ্য আজ কোনো বাকবিতন্ডার মধ্যে গেল না। কাজের প্রচুর চাপ যাচ্ছে ইদানিং, তাই ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল। ঝিলমিল এতদিনে একটা কাজের কাজ করল। এক কাপ চা বানিয়ে রোদ্দুরের সামনে হাজির করল। রোদ্দুর হেসে ধন্যবাদ জানাল। তারপর নিজের বই নিয়ে বসল, আগামীকাল পরীক্ষা। ঝিলমিলের হঠাৎ মনে হলো, এই বয়সে কিংবা এই সময়ে সে তার স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছে। এই ব্রেইন নিয়ে বড়জোর একটা সংসার সাজাতে পারবে কিন্তু পড়াশোনা অসম্ভব।
তাও যতটুকু দরকার ততটুকু পড়ল। তারপর উঠে গিয়ে রাতের খাবার রেডি করল। টেবিলে সবকিছু সাজানোর পর রোদ্দুরকে ডাকতে এলো। বলল, ‘খেতে আয়।’
রোদ্দুর আলস্য ভঙ্গিতে খাটে হেলান দিয়ে বলল, ‘প্যারা লাগে।’
‘আরে আয়, আজ সব রান্না আমি করেছি।’
রোদ্দুর উঠে বসে মেরুদন্ড সোজা করে বলল, ‘সিরিয়াসলি? এটা কি সারপ্রাইজ ছিল নাকি? মানে তুই? আমি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছি না। জমিদার কন্যা আজ রান্না করেছে, ওয়াও! বাই দা ওয়ে, খেতে পারব তো? আই মিন, খাওয়ার যোগ্য হয়েছে?’
‘বেশি কথা না বলে খেতে আয়।’
ঝিলমিল আগে আগে গেল। রোদ্দুর সত্যিই অবাক হয়েছে। ঝিলমিল যে রান্নাবান্নার ধারেকাছেও কখনও যায় নাই, এটা তার জানা আছে। আরেকটু অবাক হলো তখন, যখন দেখল ঝিলমিল সত্যি সত্যি রান্না করছে তাও বিভিন্ন রকম আইটেম।
ঝিলমিল চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বস।’ তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ওড়নায় টান পড়ল। ঝিলমিল অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘আহা! ওড়না ধরে টানাটানি করিস কেন? এগুলা আবার কি ধরণের অসভ্যতামি? ছাড় বলছি!’
.
.
.
চলবে…….
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-২৯]
~আফিয়া আফরিন
পেছন থেকে রোদ্দুরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঝিলমিল ঘুরে তাকাল। ওমা! রোদ্দুর তো তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওড়না ধরে কীভাবে টানাটানি করবে? তারপর নিজের ওড়নার দিকে তাকাতেই দপ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। চেয়ারের সাথে ওড়না আটকে গেছে। হতভম্ব হয়ে জিভ কাটল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ওড়না ছাড়িয়ে সামনে এগোতেই ফের ওড়নায় টান পড়ল। ঝিলমিল কয়েকবার টেনেও ওড়না ছাড়াতে পারল না। ঘুরে তাকিয়ে দেখল এইবার সত্যি সত্যিই রোদ্দুর ওড়না টেনে ধরেছে।
ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’
‘যেটা করি নাই সেই দোষ এতক্ষণ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হলো। তাই এইবার করেই ফেললাম….’
ঝিলমিল আশ্চর্য হলেও বলল, ‘আচ্ছা, এখন ছাড়।’
রোদ্দুর ছাড়ল না। উল্টো ওকে টেনে নিজের কাছেই নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘উহুঁ। ছাড়ব না।’
‘মানে কী? এভাবে ধরে রাখবি কেনো?’
‘যাতে ফসকে যেতে না পারিস। ইদানিং খুব বেশিই তিড়িং বিড়িং করছিস।’ রোদ্দুর ঝিলমিলের ওড়নার প্রান্তদেশ নিজের হাতে গুটিয়ে বলল।
ঝিলমিল ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তাই? কেনো হিংসে হয় বুঝি? জ্বলে?’
‘হুম।’
‘নিজেও তো একটা প্রেম করছিস, তখন বলেছি আমি কিছু? নিজের প্রেম করলে সমস্যা নাই। আর কারো সাথে দু’দন্ড কথা বললেও সমস্যা। আমার বন্ধু-বান্ধবের সাথে আমি কথা বলতেই পারি, তোর এত জ্বলে কেনো?’
রোদ্দুর ঝিলমিলের ওড়না আরেকটু টান দিয়ে বলল, ‘কেনো জ্বলে জানি না। কিন্তু এরচেয়ে আর বেশি জ্বালানোর চেষ্টা করিস না যেনো, তাহলে কিন্তু….’
‘কিন্তু কী?’
‘তুই নিজেও জ্বলে’পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবি।’
ঝিলমিল সহজ গলায় বলল, ‘আমি এত জ্বলি না, কাউকে দেখে আমার মনের মধ্যে এত হিংসেও হয় না। আমি অতি সাধারণ এবং সহজ সরল মানুষ! কারো সাতে-পাঁচে থাকি না।’
‘কিন্তু আমি থাকি।’ রোদ্দুর জেদি গলায় বলল। তারপর ঝিলমিলকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে এলো। ঝিলমিল সরে যেতে চেয়েও সরতে পারল না। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, ‘ছিঃ, এগুলা কী ধরণের অভদ্রতামি? এত ফাজিল তুই জানতাম না তো।’
‘তো এখন জেনে নে।’
ঝিলমিল আতংকিত বোধ করল। এই পাগলের কি হয়েছে কে জানে? এমন পাগলামি কেনো করছে? সে পরপর কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলল। রোদ্দুর ওর অনেক কাছে অবস্থান করছে, ওর নিঃশ্বাস’ও তার চোখ মুখে আঁছড়ে পড়ছে। আর এমনভাবে আটকে ধরেছে, ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই; এমনকি নড়াচড়া করারও সুযোগ নেই। এইভাবে কখনো কারো সংস্পর্শে এতটা আসে নাই, যার কারণে কেমন একটা দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। ওইদিকে রোদ্দুর ঝিলমিলের এই অবস্থা দেখে ফিচলে হাসি চোখমুখে ফুটিয়ে তুলেছে। ঝিলমিলের অবস্থা হয়েছে আচমকা শিকারির সামনে পড়ে যাওয়া তাপড়াতে থাকা নিরীহ কোনো প্রাণী।
রোদ্দুর ওকে ছাড়ত না যদি ঝিলমিল না বলত তার পরীক্ষার কথা। পড়াশোনার কথা বলতেই ছেড়ে দিল। নিজে বলল, ‘খেয়ে-দেয়ে তারপর গিয়ে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা পড়াশোনা করবি।’
ঝিলমিল মুখে কিছু বলল না, ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।
রোদ্দুর তার কত চেনা! এতদিন এমন মনে হয় নাই, আজ কেমন যেনো লাগছে। খাওয়ার সময়ও ঝিলমিল কোনোরকম তাড়াহুড়োর উপর খেয়ে উঠে পড়েছে। ভুল করেও একবার রোদ্দুরের চোখে দিকে তাকায় নাই। খাওয়া শেষ হতেই এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে কম্বলের নিচে বই নিয়ে বসে পড়েছে। মনেপ্রাণে খুব করে চাইছে, রোদ্দুর যেনো তাড়াতাড়ি ঘরে না আসে।
একটু আগের ওই ঘটনার পূর্বেও রোদ্দুরের সাথে একটা সহজ সম্পর্ক ছিল। ঢাকায় আছে বেশ কিছুদিন, একবারের জন্যও রোদ্দুরকে অচেনা মনে হয় নাই কিংবা তার আনইজি ফিল হয় নাই। কিন্তু আজ মাথা ঘুরছে! সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে গেলে শশুর বাড়ি এলে মানুষের যেমন অনুভূতি হয়, ওর’ও তাই হচ্ছে। বুকের মধ্যে দামামা বাজছে, ধুকপুক করছে।
ঝিলমিলের চাওয়া পূরণ হলো না। রোদ্দুর কিছুক্ষণ বাদেই ঘরে ঢুকল। ঝিলমিল ওর উপস্থিতি টের পেলেও চোখ তুলে তাকাল না। মাথার মধ্যে কোন পড়া ঢুকছে না, একটু আগের ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে সজোরে। এত অশান্তি ঝিলমিলের কখনোই লাগে নাই। সারা রাতটা ওইরকমেই কাটল, ঝিলমিল ঘুমাতে পারল না। ভোরের দিকে একটু যা চোখ বুঁজে এলো, কিন্তু পাত্তা দিল না। যেহেতু পরীক্ষা, তাই দ্রুত যেতে হবে।
রোদ্দুরের পাশাপাশি চলতেই কেমন একটা লাগছিল। যখন ভার্সিটিতে এসে পৌঁছাল এবং রোদ্দুর দৃষ্টি সীমার বাহিরে গেল; তখন ঝিলমিল এতক্ষণের চেপে রাখা নিঃশ্বাস উজাড় করে দিল।
.
বাড়ির সবাই ঝিলমিল আর রোদ্দুরের বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছিল। তখন তো শুধুমাত্র কোনরকমে বিয়ে হয়ে গেছে, আত্মীয়-স্বজন কাউকে খবর দেওয়া হয় নাই। হুট করে যেই শুনেছি সেই অবাক হয়ে গেছে। ঝিলমিল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুদিন সময় পাবে। সবাই চাচ্ছে তখন অনুষ্ঠান করতে। আবার রোদ্দুরের কথাও চিন্তাভাবনা করা লাগছে, তার’ই তো সমস্যা। ছুটি ম্যানেজ করতে পারে কিনা কে জানে! অন্ততপক্ষে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যও তো সময় দরকার। রোদ্দুরের তো এখানে আসার মত অতটুকু সময়েরও বালাই নেই। আর এখান থেকে উনারা গিয়ে যে একটু আলাপ-সালাপ করবেন, ওখানে সেই জায়গাটুকুও নেই। তাও যেভাবেই হোক কথাবার্তা তো বলতেই হবে। একবার যখন বিয়ের কথা উঠেছে তখন অনুষ্ঠান করে ফেলাই ভালো, নয়তো পরে আর হয় না। তানিশা আর রিমঝিম এখনই প্ল্যানিং শুরু করে দিয়েছে। তারা কি পড়বে, কীভাবে ঘর সাজানো হবে, কয়দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান হবে, মেনুতে কি কি থাকবে, ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু ঝিলমিলকে অনেক মিস করছিল। ও থাকলে সবটা একা হাতেই সামলে নিতে পারত। রোদশীর বিয়ের সময়ও তো সবার শাড়ি-গয়না ও চয়েস করে দিয়েছিল। এইবার তো তার নিজেরই বিয়ে, নিজে পটের বিবি সেজে সবাইকে খাটাবে। হুহ!
.
আজ সকালেই রোদ্দুর ঝিলমিলকে বলে দিয়েছে, পরীক্ষা শেষ হলে যেন সাবধানে ফিরে আসে। তার সময় হবে না নিতে যাওয়ার। ঝিলমিল তাই পরীক্ষা শেষেই ফিরে এসেছে। রোদ্দুর ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে।
অনেকদিন ছাদে যাওয়া হয় না। গোসল করে তাই চুল শুকানোর জন্য ছাদে উঠল। এখানে আসার পর ওই একজনের সাথেই আলাপ হয়েছিল, যে পাশের বাসার ভাবি নামে পরিচিত। ঝিলমিল আজ তাকে দেখতে পেল না। ইচ্ছে করলে বাসা থেকে ডেকে আনা যায় কিন্তু সামান্য ছাদে আসার জন্য ঝিলমিলের মন তাতে সায় দিল না। ও নিজেই এ’মাথা ও’মাথা ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরল। রাতে যেহেতু একদম’ই ঘুম হয় নাই তাই শুয়ে পড়ল এবং ঘুমিয়েও গেল।
— ঝিলমিলের বিয়ে হচ্ছে। পাত্র কে সে জানে না এমনকি বাড়ির মানুষ’ও জানে না। রোদ্দুরের সাথে তো একবার বিয়ে হয়েই গেছে, আবার কেনো বিয়ে হচ্ছে? ওইতো রোদ্দুরকে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ কাপড়চোপড়ে ঘুরে বেড়াতে। ঝিলমিল রোদ্দুরকে কাছে ডাকল কিন্তু ও এলো না। বলল, ‘তুই তো একবার বারণ করেছিস তবে আবার ডাকছিস কেনো?’
ঝিলমিল ধিরে ধিরে মাথা নাড়ল। ‘না’ ‘না’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।
ঝিলমিলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসতেই রোদ্দুরকে দেখতে পেল। রোদ্দুর পাশ থেকে পানির বোতলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাজে স্বপ্ন দেখেছিস? নে পানি খা।’
ঝিলমিল পানি খেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক’টা বাজে?’
‘উমমম… সাড়ে সাতটা বাজল।’
‘আমি এতক্ষণ ঘুমালাম? তাইতো মাথা ব্যথা করছে। কখন এসেছিস?’
‘অনেকক্ষণ আগেই এসেছি।’
‘আমাকে ডাকতে পারলি না?’
‘হুঁ? পরে আবার চেঁচাবি তোর আরামের ঘুম হারাম করার জন্য।’
‘না, অসময়ে ঘুমালে আমার মাথা ব্যথা করে।’ ঝিলমিল উঠে দাঁড়াল। গিয়ে বারান্দায় দরজা লাগিয়ে দিল। কথা বলতে ইচ্ছে করল না বলে চুপচাপ থাকল নয়তো এই কনকনে শীতের মধ্যে দরজা খুলে রাখার অপরাধে মাত্রই রোদ্দুরের সাথে একটা কথা কাটাকাটি হয়ে যেত।
কাল যেহেতু পরীক্ষা নাই, তাই রোদ্দুর ঝিলমিলকে নিয়ে বাহিরে বের হলো। আজ হেঁটে হেঁটেই চৌরাস্তার মোড়ে এলো। অন্যসময় বন্ধুদের দেখা পাওয়া যায়, আজ আর কাউকে দেখতে পেল না। ঝিলমিলকে সাথে নিয়েই ঘোরাঘুরি করল। ঝিলমিলের দিনগুলো এভাবেই কেটে যেতে লাগল। রোদ্দুরের সঙ্গ এখন আর খারাপ লাগে না বরং সেটা বেশ উপভোগ্য। পরীক্ষাগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে…. ঝিলমিল এক এক করে দিন গুণছিল, কবে সব শেষ হবে! যখন পরীক্ষা না থাকে কিংবা রোদ্দুর ফ্রি থাকে তখন ঝিলমিলকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।
ঝিলমিলের সকালটা শুরু হয়, সুন্দর ভাবে। রোদ্দুরের আগেই ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকালে উঠে খুব যত্ন করে কফি বানায়, তারপর রোদ্দুরকে ডেকে তুলে ওকে কফি দেয়। বলে, ‘উঠে পড়েন জমিদার মশাই। সকাল সকাল আপনার জন্য কফি হাজির। খেয়ে আমায় উদ্ধার করুন প্লিজ।’
‘ধন্যবাদ।’ রোদ্দুর’ও হেসে বলে। এরপর রোদ্দুর অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলে ঝিলমিলের পরীক্ষা না থাকলে বাড়ির কাজকর্ম সারে। ইদানিং রান্নাবান্না নিজেই করার চেষ্টা করে। ভালো/খারাপ নিয়ে রোদ্দুরের কখনোই কোনো অভিযোগ থাকে না। এই জিনিসটা ঝিলমিলের খুব ভালো লাগে। সে একটা নতুন জায়গায় নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছে, সেখানে কেউ ভুল ধরলে সাধারণত তার বিরক্ত লাগতো। বাড়ি থেকে ওর মা সেদিন ফোন দিয়ে খুব করে বুঝিয়ে বলছিলেন, ‘দ্যাখ মা, রোদ্দুর আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে যথেষ্ট ভালো ছেলে। একটু মানিয়ে নে, গুছিয়ে নে। তোকে নিয়ে আমার এত চিন্তা হয় যে বাপু, বলার মত না। দেখি তো, শুনি তো, শুধু নাকি ঝগড়া করিস। এইরকম কা’টাকাটি করলে সংসার হয় না রে মা। ভালোভাবে থাকিস কেমন! ছুটিছাটা পেলে চলে আসিস। তোরা ছিলি, এতদিন আমার ঘর ভর্তি ছিল। এখন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে, কাজ করতে গেলেও মন বসে না। রোদশীটাও সেই যে গেল, আর আসার নাম গন্ধ নাই। আর তুই তো রোদ্দুরকে ছাড়া একা আসতেও পারবি না। যাইহোক, এত ঘনঘন আসার দরকার নাই। আর নিজের দিকে খেয়াল রাখিস।’
ঝিলমিল মায়ের কথা মানার চেষ্টায় অবিরত। এতদিন তো নিজের মর্জি মতোই চলেছে, খুব যে ভালো কিছু জীবনে অর্জন করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। এইবার একটু নিজের মায়ের কথায়, নিজের পরিবারের মানুষের কথায়, বড়দের কথায় চলে দেখুক; ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড়া করায়।
.
রোদ্দুরের একটা বাজে স্বভাব হচ্ছে, সবকিছু গুছিয়ে রাখে কিন্তু গায়ের কাপড়চোপড়’গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দেয়। ঝিলমিলের এসব সহ্য হয় না। আজও রোদ্দুর এসে তাই করল। ঝিলমিল শান্তভাবে বলল, ‘এলোমেলো আমার পছন্দ না, আগেই বলে দিয়েছি। এমনিতেই এই কনকনে শীতের মধ্যে কাজের খেলায় বাঁচি না। তার উপর আবার তুই এত্ত জ্বালাস।’
‘তুই’ও দেখি আমার মায়ের মত ঘ্যানঘ্যান করিস। একটু বসে নিই, তারপর রাখবনি ঠিক করে। আমার কাপড়চোপড় কি তোকে ডিস্টার্ব করতেছে, আজিব!’
‘আমার দেখতে বিরক্ত লাগতেছে।’
‘চোখ বন্ধ করে বসে থাক।’
ঝিলমিল বিছানা থেকে কুশনটা নিয়ে রোদ্দুরের দিকে ছুঁড়ে দিল। রোদ্দুর সেটা ক্যাচ করে নিল। হেসে বলল, ‘এত সহজ না।’
‘ভাগ্যিস তুমি বাড়িতে থাকতি না। তোকে সহ্য করতে করতেই বাড়ির মানুষের এক জনম কেটে যেত। আমি শিওর ওরা পাগল হয়ে যেত তোর কান্ডকারখানায়। আর তুই তো….’
ঝিলমিলের ফোন বেজে ওঠায় সে চুপ করে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল দাদি ফোন করেছে। সে রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিয়ে কথাও বলতে লাগল আবার কাপড়চোপড় গোছাতে লাগল। রোদ্দুর এসে একপলক কথা বলে গেল। ঝিলমিল ধমক দিয়ে বলল, ‘তোকে ফোন করেছে? আমাকে ফোন দিয়েছে তাই আমি কথা বলব। তোর সাথে যখন কথা বলে, তখন আমি এমন পাজিগিরি করি?’
তারপর দাদিকে বলল, ‘তোমার নাতি এত জ্বালায় যা বলার মত নয়। এমন ভাব করে থাকে মনে হয়, কোন জমিদার! এইতো একটু আগে এসে সব কিছু মানে ওর কাপড়গুলো এলোমেলো করে রেখে দিয়েছে। এগুলা এখন আমায় গোছাতে হচ্ছে। শীতের মধ্যে এতকিছু ভালো লাগে? বাবারে, ঠান্ডায় কাঁপতেছি।’
‘অনেক ঠান্ডা বুঝি?’
‘তাছাড়া আবার কি? তারমধ্যে এমন এক জায়গায় আছি, এইখানের সামনে পেছনে খোলা জায়গা। দিনের বেলাতেও আমি জানালা খুলতেই পারি না বাতাসের অত্যাচারে। ওই সবদিক দিয়ে আমাকে প্যারায় রেখেছে।’
‘আরে এত ঠান্ডা কেনো লাগবে তোর?’
‘কেনো? আমি কি রোবট যে আমার ঠান্ডা লাগবে না!’
দাদি ওপাশ থেকে ফিচলে হাসি দিয়ে বললেন, ‘স্বামী থাকলে সঙ্গে শীত লাগে না অঙ্গে!’
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৬৫৭