#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩০]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিল একদম হতবাক হলে গেল। এইরকম কথার প্রত্যুত্তরে যে কি বলতে হয় তার জানা নেই। ঝটপট ফোনটা কেটে দিল। রোদ্দুর’ও এইখানে, ফোনটাও লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল; ও শুনেছে কিনা কে জানে? ঝিলমিল আড়চোখে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। নাহ, সে তার নিজের কাজে ব্যস্ত এইদিকে মনোযোগ নেই। একবার ফোন হাতে নিচ্ছে আরেকবার ল্যাপটপে টাইপিং করছে। হয়তো শুনে নাই কিংবা খেয়াল করে নাই। তবুও ঝিলমিলের মনের ভেতর খুঁতখুঁতে ভাবটা রয়েই গেল। রোদ্দুর কথাটা শুনে ফেললে চরম বেইজ্জতির একটা কান্ড ঘটবে।
ঝিলমিলকে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে দেখে রোদ্দুর দৃষ্টি তার ল্যাপটপে রেখেই জিজ্ঞেস করল, ‘কথা শেষ এত তাড়াতাড়ি?’
ঝিলমিল চমকে তাকাল। কোনোরকম বলল, ‘হুম, নেটওয়ার্কের সমস্যা।’
‘ওহ আচ্ছা। কাল তো শেষ পরীক্ষা, গিয়ে পড়তে বস। পড়াশোনায় এত হেলাফেলা করা ঠিক না। কী পড়িস আর কী যে পরীক্ষা দিস, কে জানে?’
‘তোকে এতকিছু ভাবতে হবে না। তুই নিজে এত পড়াশোনা করে কোন বিদ্যাসাগর মহাশয় হয়েছিস?’
‘ঠিক আছে…. আমি যখন কিছু হতে পারি নাই তবে তুই কিছু হয়ে দেখা!’ রোদ্দুর ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল।
ঝিলমিল ভেংচি কাটল, ‘আমার এত শখ নেই।’ এরপর ঝিলমিল চলে গেল ওখান থেকে। রোদ্দুরের সাথে কথা বলে জাস্ট এইটুকু শিওর হতে চেয়েছিল যে দাদির বলা কথাটা। ও শুনেছে কিনা। নিশ্চয়ই শুনে নাই, শুনলে অবশ্যই এর পরিপ্রেক্ষিতে হাজারটা আজেবাজে কথা বলে ফেলত যার সত্যিকার অর্থে কোনো দাঁড়ি কমা থাকত না।
ঝিলমিল ওই ঘরে যেতেই রোদ্দুরের মনে দাদির কথাটা ঘুরঘুর করতে লাগল। একটু আগে তিনি যেটা বললেন, তার মানে কী? ‘স্বামী থাকলে সঙ্গে, শীত লাগে না অঙ্গে’— বড্ড গভীর কথা! রোদ্দুর এই কথাটা নিজের দিকে টেনে নিল, বউ থাকলে সঙ্গে শীত লাগে না অঙ্গে। কিন্তু তার বউ সাথে থাকা সত্ত্বেও শীতে ঠকঠক করে কাঁপার কাহিনী কি? নাহ, সব ছেড়েছুড়ে এটা বুঝতে হবে। কিন্তু বুঝতে বুঝতে আবার না শীত’ই চলে যায়! শীত চলে গেলে আবার সামনের শীতের জন্য ওয়েট করতে হবে।
.
আজ ঝিলমিলের শেষ পরীক্ষা ছিল। এমনিতে রোদ্দুর পরীক্ষার মধ্যে একদিন’ও নিতে আসে নাই, আজ এসে হাজির। ঝিলমিল ভেবেছিল, বান্ধবীদের সাথে একটু সিনেমা দেখতে হলে যাবে। রোদ্দুর তো একদম’ই যেতে দিবে না। ওকে বলতেই বলল, ‘একা? না না, কিছুতেই না। অসম্ভব!’
এতদিক থেকে যেহেতু রোদ্দুর না বলেই দিয়েছে, তো ঝিলমিলের আর কিছু বলার থাকে না। সে মন খারাপ করে বাড়ি চলে এলো। রোদ্দুর যাওয়ার আগে বলে দিয়েছে, সে ফিরে এসে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে।
কিন্তু তবুও ঝিলমিলের মন খারাপ। বাড়ি থাকতে একমাত্র শিউলি ছিল, ওর সাথে ওদের পাড়া পুরোটা ঘুরে বেড়িয়েছে। এইখানে তাও যেই কয়টা বান্ধবী জুটল; ঝিলমিল শিওর রোদ্দুরের জন্য একজনের সাথেও সম্পর্ক টিকবে না। ওরা কী সুন্দর প্রতিদিন ঘুরতে বের হয়, ঝিলমিলের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুর উপায় নাই। আহা! কী লয়াল সে! কী হবে ওই দয়ালের জন্য এত লয়াল সেজে? ঝিলমিলের হাঁকডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখন।
.
রোদ্দুর অবশ্য নিজের কথা রাখল। সন্ধ্যার পর ঝিলমিলকে নিয়ে বের হলো। কিছুটা পথ যেতেই ঝিলমিলের সাথে ওর মামাতো ভাইয়ের দেখা হয়ে গেল। ওরা এখানেই থাকে, কিন্তু এতদিন দেখা হয় নাই। সে ঝিলমিলকে দেখেই ‘ঝালমুড়ি’ ‘ঝালমুড়ি’ করতে করতে এগিয়ে এলো। অনেকদিন বাদে মামাতো ভাইকে দেখে ঝিলমিল’ও খুশি হয়ে গল্প করতে লাগল। রোদ্দুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটাকে তার চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছে না। আবার ঝিলমিলকে ঝালমুড়ি সম্বোধন করছে। কত্ত বড় সাহস!
ঝিলমিল নিজেই পরিচয় করিয়ে দিল, ‘ও রাকিব, আমার বড় মামার ছেলে। তুই তো চিনিস? আমাদের ওখানে গিয়েছিল কয়েকবার, তাও অনেক আগে। মনে আছে?’
রোদ্দুর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘হুম মনে আছে।’ তারপর রাকিবের সাথে করমর্দন করে মুখে প্লাষ্টিক হাসি ঝুলিয়ে কথা চালিয়ে গেল। কিন্তু ও যে বারবার ঝিলমিলকে ঝালমুড়ি সম্বোধন করছিল, এটা তার পছন্দ হচ্ছিল না। আশ্চর্য! আস্ত একটা মানুষকে কেনো ঝালমুড়ি বলতে হবে? ও কি ঝালমুড়ি?
রোদ্দুর বলেই ফেলল, ‘ভাই তোমার মনে হয় ঝালমুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে? আমি ওইদিকে একটা ঝালমুড়ির দোকান দেখে এসেছি। চলো, ওখান থেকে তোমাকে ঝালমুড়ি খাইয়ে আনি। চলো, চলো। কোনো বারন শুনব না আমি।’
তারপর ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি। আমরা আসছি।’ ঝিলমিল থতমত খেয়ে গেল। রোদ্দুর রাকিবকে একপ্রকার জোর করেই ঠেলেঠুলে নিয়ে গেল। ঝিলমিল ওখানে দাঁড়িয়েই কপাল চাপড়াতে লাগল। এই ছেলেটা ছোটো বেলা থেকেই এমন হিংসুটে। ওর নিজের জিনিসে কারো দখলদারিত্ব সহ্য করতে পারে না।
‘এক মিনিট, এক মিনিট!’— ঝিলমিল নিজের মনেই ভাবতে লাগল, রোদ্দুর তার নিজের জিনিসের ভাগ কাউকে দিতে চায় না। তবে এর সাথে তার কী সম্পর্ক? শুধুমাত্র বউ বলেই!
উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই ওদের আসতে দেখতে পেল। রোদ্দুরের মুখে শয়তানি হাসি আর রাকিবের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। সে ঝালে হাঁসফাঁস করতেছে। রাকিব কোনো কথা বলার অবকাশ পেল না। শুধুমাত্র ঝিলমিলকে বলল, ‘আজ আসি। তোমাদের সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। আমাদের বাড়ি যেও।’
ঝিলমিল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। রাকিব চলে গেলে সে রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি করেছিস ওর সাথে? এমন পাগলের মত হাঁপাচ্ছে কেনো?’
‘ঝালমুড়ি খাওয়ালাম। যত যাইহোক শালা বলে কথা!’
‘ফাজিল কোথাকার! বাঁদর ছেলে একটা! এত পাজি কেন তুই?’
রোদ্দুর কলার নাচিয়ে বলল, ‘আমি এমন’ই। এমন’ই সহ্য করতে হবে। এসব মামাতো, খালাতো ফুফাতো, চাচাতো ভাইদের সাথে রংঢং আমি একদম পছন্দ করি না।’
ঝিলমিল হালকা করে ওর পিঠে কিল মেরে বলল, ‘অ্যাহ আসছে! উনার সব কথা যেনো আমায় মেনে চলতে হবে। যত্তসব! বাড়ি যাব, নিয়ে চল। ঠান্ডার মধ্যে কিছু ভালো লাগছে না।’
‘তোর ওই মামাতো ঝালমুড়ি ওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসব?’
ঝিলমিল চোখ গরম করে তাকিয়ে একটা ধমক দিল রোদ্দুরকে। রোদ্দুর প্রতিবারের মত সেসব পরোয়া না করে বাইক স্টার্ট দিল। অর্ধেক পথ যেতেই হাসান ফোন করে ওদের বাসায় যেতে বলল। রোদ্দুর তাই তাড়াহুড়ো করে ঝিলমিলকে লেনের মাথায় নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি যা। আমি একটূ পর ফিরে আসছি।’
ঝিলমিল ফেরার পথে হঠাৎ রাস্তায় ওই মেয়েটাকে লক্ষ্য করল, যার সাথে তার হাসপাতালে দেখা হয়েছিল। ওর ভাষ্যমতে, রোদ্দুর ওর বয়ফ্রেন্ড আর রোদ্দুরের ভাষ্যমতে, এককালে ওর সাথে সম্পর্ক ছিল কিন্তু এখন আর নেই। ওর মেয়েটার নামটা জানা হয় নাই। আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কি বলবে না, ভাবতে ভাবতেই ওর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। ঝিলমিলকে দেখেই ওই মেয়েটা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। অদ্ভূত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই মেয়ে! তুমি এখানে কি করছ? এখানে তো রোদ্দুর থাকে, তোমার কাজ কি? তোমাকে বলেছি না রোদ্দুরের কাছ থেকে ১০০ হাত দূরে থাকবে।’
ঝিলমিল বেশ ইনোসেন্ট মুখ করে বলল, ‘আমি দূরে থাকতে চাইলেও ও তো দূরে থাকছে না আপু।’
‘তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কে? তোমাকে তো এর আগে কখনো দেখি নাই। রোদ্দুরের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?’
ঝিলমিল বলেই ফেলল, ‘এর আগে কীভাবে দেখবেন? এর আগে কি ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল? কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে, তাই এত ঘনঘন আমাদের দেখতে পাচ্ছেন।’
ঝিলমিলের কথা শুনে সানিয়া মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল। প্রথমেই তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ঝিলমিল পুনরায় বলল, ‘আসলে বিয়েটা হঠাৎ হলো তাই আপনাদের জানানোর সুযোগ পায় নাই। ঠিক আছে, নো প্রবলেম। খুব শীঘ্রই অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনা চলছে, আপনার পক্ষ থেকে আপনার দাওয়াত রইল। চলে আসবেন কিন্তু। আচ্ছা আপু, ঠিকানা জানেন? আমি বলি, আপনি লিখে নেন।’
সানিয়া সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘শাট আপ। হাউ ডেয়ার ইউ! রোদ্দুরের সম্পর্কে এত বাজে কথা কীভাবে বলো তুমি? আই লাভ হিম!’
‘বাট হি ডাস’নট লাভ ইউ। কাউকে আমাদের বিয়ের খবর জানানোর ইচ্ছে ছিল না। নজর লেগে গেলে সমস্যা হবে। কিছু মানুষের দৃষ্টি তো আবার শকুনের মত। ভেবেছিলাম একেবারে বাচ্চাকাচ্চা হলে তোমাদের জানাব। তখন তো তুমি খালামণি… সরি সরি ফুপি হবে। তোমার একটা দায়িত্ব আছে না? বাই দা ওয়ে, আমাকে আমার হাজব্যান্ডের জন্য রাতের রান্না করতে হবে। আসি কেমন? টাটা। আর হ্যাঁ, আমার হাজব্যান্ডকে ডিস্টার্ব করো না প্লিজ আপু।’ ঝিলমিল হেসে বলল। সানিয়ার চাহনিটা দেখার মত ছিল। ও বোধহয় ঝিলমিলকে বাগে পেলে গপাগপ চি’বিয়ে খেয়ে ফেলবে। ঝিলমিল আড়ালে গিয়ে হাসতে হাসতে কুলকিনারা খুঁজে পেল না। রোদ্দুর বাড়ি এলে ওকেও সবটা বলল এবং মেয়েটার নামটাও জেনে নিল।
ঝিলমিল বলল, ‘আমাকে কিন্তু ব্রেকআপের কাহিনী শোনাতে হবে। আর এটাও বলবি, ওমন রাক্ষুসীর প্রেমে পড়লি কীভাবে?’
‘ধুর, এসব ভালো লাগে না। জীবনে সবচেয়ে বড় একটা ভুল করেছিলাম এই আপদটাকে ডেকে এনে।’
‘প্যারা দিত বুঝি খুব?’
‘মাঝে মাঝে প্রচুর।’
‘ব্রেকআপ কেনো করলি?’
‘ব্রেকআপ না করলে তোকে বিয়ে করতে পারতাম?’
‘উল্টো কথা বলবি না। তুই মনে হয় আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছিলি। সত্যি করে বল! আমি শুনব।’
রোদ্দুর সত্যি কথাটা চেপে গেল। যা গেছে তা গেছেই, ওসব ফালতু কথা নিজের মধ্যেই থাকুক; জনে জনে বলে বেরিয়ে নিজের ইমেজ নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।
.
ঝিলমিল এখন রেগুলার ক্লাস করছে। ক্লাস করছে বলা ভুল, ভার্সিটি যাচ্ছে। সেখানে গেলেই যে ক্লাস করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তো আর নেই। যাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে, মন চাইলে ক্লাস করছে আবার ফিরে আসছে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে, যেটার সাথে কিছু কাগজপত্র লাগবে। এই মুহূর্তে ঝিলমিলের কাছে সেসব নেই, বাড়ি আছে সেগুলো। অথচ খুব জরুরী দরকার, কাল লাস্ট ডেট। ঝিলমিল জানত বিষয়টা কিন্তু ওর মনেই ছিল না। নিজের গা ছাড়া ভাবের জন্য নিজেকেই মনে মনে জুতোপেটা করল। আজকে রোদ্দুরের’ও সময় হবে না, ওর ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। হঠাৎ’ই সিদ্ধান্ত নিল, সে একাই বাড়ি ফিরবে। কাগজপত্রগুলো নিয়ে ছোট চাচ্চুর সাথে রাতের মধ্যেই ফিরে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রোদ্দুরের সাথে যেহেতু যাওয়া আসা হয়েছে, তাই রাস্তাঘাট মোটামুটি চেনা। এখান থেকে বাসে উঠলে সোজা তার শহরে নামিয়ে দেয়। ঝিলমিল তাই করল। তৎক্ষণাৎ রওনা হলো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এই প্রথম, একা একা এতদূরের যাত্রা। ভয় বা চিন্তা কোনোটাই হচ্ছে না। রোদ্দুরকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল, ‘আমি এই মুহূর্তে বাসে আছি, বাড়ি যাচ্ছি। আমার কিছু জরুরী কাগজপত্র লাগবে, সেসব নিয়েই ফিরে আসব।’
পরপর বেশ কয়েকটা মেসেজ পাঠাল। নিজের এই যাত্রাটা বেশ ভালো উপভোগ করছিল। বাড়িতেও ফোন করে জানাল না, হঠাৎ গিয়ে চমকে দিবে সকলকে।
রোদ্দুরের মিটিং শেষ হতে হতে সাড়ে তিনটা পেরিয়ে গেল। নিজের কেবিনে এসে ফোনটা অন করতেই একেরপর এক মেসেজ এসে ঢুকল। সেসব সিন করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ! তৎক্ষণাৎ ফোন করল ঝিলমিলকে। ঝিলমিল ফোন রিসিভ করতেই ধমক মেরে বলল, ‘তোর সাহস তো কম না। একা একা কেনো গিয়েছিস? আমাকে আগে বললে আমি একটা ব্যবস্থা করতাম।’
‘কিছু হবে না। আমি যেতে পারব। এইতো প্রায় পৌঁছে গেছি। আর পনেরো/বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব। আমি বাড়ি গিয়ে ফোন করছি, রাখি এখন।’ ঝিলমিল ফোন রেখে দিল। রোদ্দুর ছোট চাচ্চুকে ফোন করে বলে দিল, তিনি যেনো বাসস্ট্যান্ড উপস্থিত থাকেন। তিনি দোকানে ব্যস্ত ছিলেন তাই বললেন, ‘আচ্ছা আমি দোকানের এই ছেলেটাকে পাঠাচ্ছি।’
তবুও রোদ্দুর নিশ্চিন্ত হতে পারল না। ঝিলমিলকে আবার ফোন করে বাসের নামটা শুনে নিল এবং হেল্পারের সাথে কথা বলে ঝিলমিলকে যেনো ঠিক জায়গায় নামিয়ে দেয়। উনার সাথে কথাবার্তা বলে নিশ্চিত হলো। এইদিকে ছোট চাচ্চুর সাথেও সমানতালে ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আরে আমি রবীনকে অনেকক্ষণ আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো পৌঁছে গেছে।’
রোদ্দুর সবাইকে ফোন করে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। হেল্পারের ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিল। উনাকে ফোন করে জানতে পারল, ঝিলমিলকে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে।
রোদ্দুর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ পর ঝিলমিলকে ফোন করল। ওর ফোন বন্ধ পেল। এই মেয়ে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে ফোনটাই অফ করে রেখেছে। রোদ্দুর আর ছোট চাচ্চুকে বিরক্ত করতে চাইল না। সে আরও একঘন্টার মত অপেক্ষা করে বাড়িতে ফোন করল। মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল, ঝিলমিল এখনও যায় নাই।
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৭২৩
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩১]
~আফিয়া আফরিন
রোদ্দুর মাথা চুলকাল। সেই কখন বাস থেকে নেমেছে অথচ এখনও বাড়ি যায় নাই! সে আরেকবার ফোন করল, এখনও ফোন অফ। তখন ছোট চাচ্চুর ফোন এলো। তিনি রোদ্দুরকে বলল, ‘রবিন তো এইমাত্র ফিরে এলো। ঝিলমিলকে নাকি দেখতে পায় নাই।’
রোদ্দুর চিন্তিত স্বরে বলল, ‘বাড়িতে ফোন দিলাম, ওরা বলল ঝিলমিল নাকি এখনও বাড়ি পৌঁছায় নাই।’
‘দেখ.. পথের মধ্যে কোনো বন্ধু-বান্ধব পেয়ে হয়তো গল্প জুড়ে দিয়েছে। ফোন দিয়েছিলি?’
‘হুম ফোন অফ করে রেখেছে। তুমি এখন বাড়ি যাবে তো? ওকে রাস্তায় দেখো অবস্থা বাড়িতে, আগে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় মারবে। একদম আক্কেল ছাড়া একটা মেয়ে। এখান থেকে গেছেও আমাকে না বলে। মানে কী বলব আমি? একদম অশান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’
ছোট চাচ্চু হেসে বললেন, ‘চিন্তা করিস না। আমি দেখছি।’
রোদ্দুর ফোন রেখে আরও কয়েকবার ঝিলমিলকে ফোন করল, কিন্তু এইবারও ফোন অফ। রাগে রোদ্দুরের কপালের শিরাগুলো পর্যন্ত দপদপ করে উঠল। নাহ, এই মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে। কিছুতেই কথা শোনে না, কাউকে মানে না। কবে যে মানুষ হবে কে জানে! রোদ্দুর অফিস থেকে বের হলো।
.
ঝিলমিলের আসার কথা শুনে বাড়ির সবাই খুশি হয়েছে। কিন্তু ও এখনও বাড়ি আসছে না কেন, তাই বুঝছে না। মেজো চাচি তানিশাকে বললেন, শিউলিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে। তানিশা সেখান থেকে ফিরে এসে খবর দিল, ঝিলমিল ওখানে নেই। ব্যস, ফের সকলের টেনশন শুরু। এইদিকে রোদ্দুর বারবার ফোন দিচ্ছে। ছোট চাচ্চু নিজে বাসস্ট্যান্ড গিয়ে দেখে এলেন, কোথাও ঝিলমিলের টিকি দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোরা কি আমাদের সাথে ফাজলামি করছিস? ঝিলমিল একা কেনো আসবে? আর যদি পোঁছে যায়, তবে এখনও বাড়ি আসছে না কেনো? প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।’
ঝিলমিল এখনও বাড়ি ফেরে নাই, সন্ধ্যা হয়ে গেছে এটা শুনে রোদ্দুরের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল। ওর ফোনটাও বন্ধ। কী করবে দিকদিশা খুঁজে পেল না। বন্ধুদের সাথে ছিল, ওর চিন্তিত ভাব দেখে হাসান বিভিন্নভাবে শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। যখন রাত হয়ে যাচ্ছে অথচ ঝিলমিলের খোঁজ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রোদ্দুর ওই রাতেই বাইক চালিয়ে হাসানকে সাথে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এখানে বসে থেকে অযথা টেনশন করার চেয়ে বাড়ি যাওয়া ভালো। অন্তত সকলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিছু তো একটা করা যাবে!
এর আগে তো বাড়ি এসে ঝিলমাল চিলেকোঠার ঘরে হারিয়ে গিয়েছিল, এইবার পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো; আশেপাশে তাদের চেনা-পরিচিত যত জায়গা ছিল সবখানে খোঁজ নেওয়া হলো কিন্তু ঝিলমিল কোথাও নাই। শুধুমাত্র তাদের এক পরিচিত দোকানদার বলল, সে বিকালে ঝিলমিলকে বাসস্ট্যান্ডে দেখেছে।
এটুকু শিওর হলো যে সে এই পর্যন্ত এসেছে। তাহলে এলাকাতেই আছে। কিন্তু একবার বাড়ি আসবে না কিংবা ফোন করে ভালোমন্দ জানাবে না? সবাই ঝিলমিলের দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষেপে গেল। এতক্ষণ সকলের মধ্যে একটা চাপা টেনশন ছিল, হয়ত ঝিলমিল ঠিকঠাক মত স্ট্যান্ডে নামতে পারে নাই কিন্তু এখন তো তা খোলাসা হয়ে গেল। মাহমুদ সরকার রেগে আছেন ভীষণ। ওরা বাহিরে খোঁজখবর করে না পেয়ে বাড়িতে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করতে লাগল। ঝিলমিল এলে তো ওকে এখান দিয়েই ঘরে যেতে হবে। তখন সবার মুখোমুখি হলে তো এই দায়িত্বহীনতার জবাব ওকে দিতেই হবে! ঝিলমিল এলো না তবে রোদ্দুর এলো। বাড়ির সবাই মিলে আবার বের হলো। রোদ্দুর কোনোকিছু ছাড় দিল না; নদীর পাড়, খাল পাড়, উত্তরের শেষ প্রান্তের জঙ্গল, শিউলিদের বাড়ি, সম্ভাব্য সকল জায়গা সবকিছুতে চিরুনি তল্লাশি চালাল।
অবশেষে বলল, ‘আমাদের একবার পুলিশ স্টেশনে যাওয়া উচিত। আমরা তো এতক্ষন ওকেই দোষারোপ করে যাচ্ছি। চলো একবার।’
যেই বলা, সেই কাজ। কিন্তু সেখানে তো একদিন পার না হলে কেস হাতে নিবে না। বড় চাচা যেহেতু পরিচিত মুখ, তাই তারা দেখবেন বলে জানাবেন। ওরা বাড়ি ফিরে এলো অনিশ্চিয়তার মাঝে। রোদ্দুর ভেবেছিল, ঝিলমিলকে হয়তো দেখবে! কিন্তু এই ভাবনা অবাস্তব রয়ে গেল।
ওরা বাড়ি ফিরার পর শিমু যখন শুনল, ঝিলমিলের নিখোঁজ হওয়ার জন্য থানায় ডায়েরি করতে হয়েছে তখন অঝোরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। কেউ তাকে কোনোরূপ শান্ত্বনা দিয়ে থামাতে পারল না। সে রাতেই থানার ওসি বাড়ি এলেন। রোদ্দুরের কাছ থেকে সব ইনফরমেশন নিলেন এবং সেই হেল্পারের ফোন নম্বরটাও নিয়ে রাখলেন। সারাটা রাত কেটে গেল এই জিজ্ঞাসাবাদে। সকালের আলো ফুটল, বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই। এক তুড়িতে এই বাড়ির মানুষগুলো যেনো হাসতে ভুলে গেছেন। দাদি প্রার্থনা করছেন, অমঙ্গল কিছু যেনো না হয়! মাহমুদ সরকার’ও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। মেয়ের শোকে এই দিনের স্পষ্ট আলোতেও চোখে অন্ধকার দেখে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
থানা থেকে ঝিলমিলের লাস্ট লোকেশন ট্র্যাক করা হয়েছে, তার বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ওর লোকেশন দেখাচ্ছে। রোদ্দুর ছুটল ওদিকেই, ওর সাথে হাসানও রয়েছে। এই দুঃসময়ে হাসানকে পাশে পেয়ে রোদ্দুরের সুবিধাই হয়েছে। অনেক করা কিংবা চিন্তাচেতনার বিষয় সে পরিবারের মানুষের সাথে শেয়ার করতে পারে না কিন্তু ঠিকই সেসব বন্ধুদের সাথে নির্দ্বিধায় শেয়ার করে।
নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে ওরা ঝিলমিলকে খুঁজে পেল না কিন্তু ওর ফোনটা ওখানে ঘাসের মধ্যে পেল বন্ধ অবস্থায়। পুলিশ যা ভাবার ভেবে নিয়েছে কিন্তু রোদ্দুরের অবস্থা হলো দেখার মত! নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। মন-মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা উঁকি দিচ্ছে। ভুলক্রমে যদি ঝিলমিলের কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজের কাছে নিজে মুখ দেখাবে কি করে? ঝিলমিলের পাগলামীগুলো চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠছে। নাহ, ওকে ছাড়া তার জীবন চলবে না। রোদ্দুর হন্যে হয়ে গেল। পুলিশ, প্রশাসন কিংবা বাড়ির কারো উপর এই মুহূর্তে ভরসা করে সবটা ছেড়ে দিতে পারছে না। তাদের আশেপাশে শত্রুদের অভাব নেই। হতে পারে কেউ শত্রুতামি করে ঝিলমিলকে তুলে নিয়ে গেছে। মন কিছুতেই মানতে চাইছে না, বিশ্বাস করতে চাইছে না; ঝিলমিলকে পাওয়া যাচ্ছে না। এইতো সারাক্ষণ ছটফট করতে থাকা মেয়েটা কোথায় কাবু হলো?
সরকার বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। শিমু এত লোক নাতে না পেরে ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তাকে সামলাতে হচ্ছে, শাশুড়িকে সামলাতে হচ্ছে— বাড়ির সবাই হিমশিম খাচ্ছে। একে তো তারাও চিন্তায় অস্থির, তার উপর এই অবস্থা। সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, কে কোথায় আছে, কী করছে কারো জানা নেই।
আরেকটি বিভীষিকাময় সন্ধ্যা নেমে এলো। রোদ্দুর হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এমন একটা সময় এলি! তুই ফিরে যা দোস্ত। এখানে অযথা….’
হাসান তৎক্ষণাৎ রোদ্দুরের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমি তোর অবস্থা বুঝতে পারছি, তোদের বাড়ির পরিস্থিতি একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছি। যতদিন পর্যন্ত ভাবিকে খুঁজে না পাওয়া যাবে তোর সাথে আমি এখানেই আছি।’
রোদ্দুর আলতো করে মাথা নাড়াল। আঁধারে ছেয়ে যাওয়া খোলা আকাশের দিকে তাকাল। তার ভেতর এমন এক মানসিক যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে যে সে কাউকে কিছু বোঝাতে পারছে না। ইচ্ছে হচ্ছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে। এতটা অবসন্ন কখনোই উপলব্ধি করতে পারে নাই। সেই রাতটা এভাবেই কেটে গেল। দু’টো রাত মেয়েটা নেই। আশ্চর্য! অবিশ্বাস্য! কিছুতেই যেনো বিশ্বাস হয় না। মনে হচ্ছে, একটা দুঃস্বপ্ন… ঘুম ভাঙ্গলেই সব কেটে যাবে। ঝিলমিলকে নিয়ে আবার একটা সুন্দর দিন শুরু হবে। কিন্তু তা হয় না আর। সময় কেটে যায়… রাত পেরিয়ে যায়… ঘন্টা মিনিট সব চলে যায় কিন্তু অপেক্ষার অবসান ঘটে না।
সকাল সকাল আবার আরেক কান্ড ঘটল। এই ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। তানিশার যেহেতু পরীক্ষা চলছে তাই ওকে শত ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও কলেজে যেতে হয়। আজও তাই গিয়েছিল। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফিরে আসছিল না দেখে বাসা থেকে ফোন করা হয়েছিল, কিন্তু ওর ফোন অফ। এই দুঃসময়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবা উচিত নয় তবে তাদের মাথায় সেই বাজে চিন্তাটাই এসেই ভর করল। সেদিন ঝিলমিলকে যেভাবে খোঁজা হয়েছিল, ওকেও হন্যে হয়ে খোঁজা হলো। খুঁজে পাওয়া গেল না। ফজলুল সরকারের হঠাৎ মনে পড়ল, উসমান খন্দকারের সাথে শত্রুতা আছে; মনমালিন্য চলছে। উনি শত্রুতার বশবর্তী এই কাজ করতে পারেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশে জানালেন। তদন্তের মোড় ঘোরার কারণে প্রশাসন প্রথম থেকে কেসটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলেন এবং দু’দিন সময় নিলেন।
বাড়ির দু’দুটো মেয়ে নিখোঁজ হলে সেই বাড়ির পরিস্থিতির কথা মুখে বর্ণনা করা যায় না। পরশু থেকে যে আহাজারি শিমুর ছিল এখন সেটা সাবরিনার’ও। নীলিমা রিমঝিমকে সর্বদা নিজের সাথে রাখছেন। বাইরে যাওয়া তো দূরে থাক, রুমের দরজায়’ও পা রাখতে দিচ্ছেন না। কী কান্ড শুরু হলো। সবার মুখে মুখে এক কথা!
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ পাড়ার মোড় থেকে ফেরার সময় রোদ্দুর লোকমুখে শুনতে পেল, দুই/তিনদিন থেকে এ পাড়ায় নতুন কিছু মানুষজনের আনাগোনা বেড়েছে। ওদের বেশিরভাগই নাকি উসমান খন্দকারের লোক। রোদ্দুর জানতে চাইল, ‘ওই লোকগুলো কোথায় থাকছে কিংবা কোন জায়গায় তাদের আনাগোনা বেশি?’
উনারা উত্তর দিতে পারল না, একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। দেখেছে তাদের কিন্তু তারা কোথায় থাকছে বা কী করছে এই সম্পর্কিত কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। রোদ্দুর ঘটনাটা মস্তিষ্কে রেখে দিল, এখন এটাই প্রমাণ। এই দুইদিন শুধুমাত্র পুলিশের উপর ভরসা করে বসে ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। মন্টু মামার বাড়ি উসমান খন্দকারের বাড়ির ওইদিকে। রোদ্দুর উনার কাছেই ছুটে এলো। জিজ্ঞেস করল, ‘এই কয়েকদিন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে কিনা?’
উনি উত্তর দিলেন, ‘মামা সন্দেহজনক বলতে তেমন কিছু দেখি নাই। কিন্তু আপনি যেহেতু বলতেছেন, আমি ওই পাড়ার পৌড়বাড়িতে ওদের আনাগোনা করতে দেখেছি বেশ কয়েকবার। বিশেষ করে উসমান খন্দকারের বড় ছেলেকে।’
রোদ্দুর ঠিক করল, হাসানকে সাথে নিয়ে সে একলাই ওইদিকে যাবে। পুলিশ তাদের মত তদন্ত করতে থাকুক, রোদ্দুর এই বিষয়টা দেখে আসবে। হাসানকে তার সাথে নিয়ে উসমান খন্দকারের বাড়ির আশেপাশে নজর রাখল। রাত প্রায় নয়টা নাগাদ রোদ্দুর পেছনের রাস্তা দিয়ে উনার বড় ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখল। রোদ্দুর দেরি করল না, তৎক্ষণাৎ হাসানকে নিয়ে ওইদিকে রওনা দিল। ওদের পৌড়বাড়িটা ওদিকেই। পায়ে হেঁটে রওনা দেওয়ার কারণে বেশ খানিকটা সময় লাগল।
বিশাল বড় বাড়ি। ছোটোবেলায় শুনেছিল, এটা নাকি এখানকার একসময়কার জমিদারের বাসস্থান ছিল। উসমান খন্দকারের দাদা সে আমলে জমিদারের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এই বাড়ি দখল করে নিয়েছে। বাড়ির সামনে কয়েকজন পাহাড়াদার রয়েছে।
হাসান ফিসফিস করে বলল, ‘এই বাড়ির ভেতর কি আমাদের ঢুকতে দেবে?’
‘মনে হয় না। তুই খেয়াল করে দেখ, এই রাতের বেলা এই বাড়িতে কতকগুলো পাহারাদার। তারপর এমনিতেই অন্যসময় ভেতরটা থমথম করে, এই মুহূর্তে অনেক মানুষজনের সমাগম; বুঝতে পারলি?’
হাসান হালকা সুরে মাথা নাড়ল। রোদ্দুর ওকে নিয়ে খুব সাবধানে বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে এলো। এই রাতের বেলায় তারা একা এত মানুষের সাথে খালি হাতে যুদ্ধ করতে পারবে না, চোরাই পথে এ পথ পাড়ি দিতে হবে। বনজঙ্গল পার হতেই পেছনের একটা ঘর থেকে গমগমে গম্ভীর কণ্ঠে কারো ভাসা ভাসা আওয়াজ ভেসে এলো, ‘আমরা আমাদের মত চেষ্টা করতেছি….. পুলিশের বাপ’ও কিছু করতে পারবে না… ক্ষমতা? হাহা! এইবার সব আমাদের দখলে হবে। দু’জনে কাজ না হলে পুরো বাড়ি খালি করে দিব… দেখে নিচ্ছি। আমাদের হেফাজতে যখন আছে, তখন চিন্তার কারণ নাই সাহেব।’
হাসান আর রোদ্দুর একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। রোদ্দুরের নিকোষ আঁধারের মত কালো হয়ে যাওয়া মুখ খানিতে একটু আলোর আভাস দেখা গেল। মাথার উপর দিয়ে সশব্দে বাজ পাখি উড়ে গেল। রোদ্দুর নিঃশব্দে, বিড়ালের মত পা টিপে টিপে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৬০৪
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩২]
~আফিয়া আফরিন
দরজা জানালা বন্ধ একটা ঘরে বোঝার কোন উপায় নেই। গত দুইদিন ধরে ঝিলমিল এভাবেই পড়ে রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই পর্যন্ত কেউ তার সাথে দেখা করতে আসে নাই। ঝিলমিল বুঝতে পেরেছে, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। সেদিন বাস থেকে নেমে সোজা বাড়ির দিকে আসছিল। মনে আনন্দ, উল্লাস, প্রথম একা এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার কারণে নিজেকে ভীষণ সাহসী মনে হচ্ছিল। পথে হঠাৎ অচেনা একজনের সাথে দেখা। ঝিলমিলকে ওর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করছিল। সে সেসবের উত্তর দিতে দিতেই পেছন থেকে একজন নাকে টিস্যু পেপার চেপে ধরল। ব্যস, তারপর আর কোনোকিছু মনে নেই। হঠাৎ একসময় জ্ঞান ফিরে নিজেকে এখানে আবিষ্কার করে। ওরা এমন কিছু একটা দিয়েছে যার কারণে বেশিরভাগ সময় অচেতন অবস্থায় থাকতে হয়। যখন একটু জ্ঞান ফেরে তখন সব অন্ধকার, মাথার ভেতরটা চিনচিন করে, পেটের ভেতর গাইগুই করে, সারা শরীর মুষড়ে পড়ছে। সম্ভবত ওষুধের প্রভাব কাটতে শুরু করেছে, অনেকক্ষণ যাবত চেতনায় রয়েছে। কিন্তু শব্দ করার শক্তি নেই। মন এবং মস্তিষ্ক বাঁচার জন্য কিছুই করছে না। বাড়ির কথা মনে পড়ছে, কী হওয়ার ছিল আর কী হয়ে গেল, রোদ্দুরের কথা মনে পড়ছে! আচ্ছা ওরা কি ঝিলমিলকে খুঁজছে?
প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। খুদায় পেটের মধ্যেও জ্বালাপোড়া করছে। ঝিলমিল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হলো। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে একটু আগাতেই কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে মৃদু শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। হাতে ব্যাথা পেয়েছে তবুও কীসের সাথে এভাবে ধাক্কা খেল তা দেখার জন্য ফের হাত বাড়িয়ে দিল। আবিষ্কার করল একটা মানুষের অবয়ব। তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে নিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। এটা কোথায় এসে পড়েছে সে? সামনে থাকা এই মানুষটা কে? অন্ধকারের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠার পরও ঝিলমিল আর সাহস করতে পারল না চোখ খোলার। ওখানেই দাঁড়িয়ে অনবরত কেঁদে চলছে আর আল্লাহকে ডাকছে। কোনোভাবে যদি অলৌকিক কিছু ঘটে! আচমকা শুনতে পেল একদিক থেকে সামান্য শব্দ ভেসে আসছে। শুকনো পাতায় মানুষ হেঁটে গেলে যেমন সরসর আওয়াজ হয় ঠিক সেইরকম। বিপদে যা পড়ার তা তো পড়েছেই, আর বিপদের তোয়াক্কা করে কী লাভ? এরচেয়ে বড় বিপদ আর হতে পারে না। ঝিলমিল যতটুকু সম্ভব গলা বাড়িয়ে বলে উঠল, ‘আশেপাশে কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প মি।’
আওয়াজটা এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেলেও পরক্ষনে দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। ঝিলমিলের মনে হলো, তাকে বাঁচানোর জন্য হয়ত কেউ ছুটে আসছে! কিন্তু তা কি করে সম্ভব?
রোদ্দুর আর হাসান মাত্র যে কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, তা যেখান থেকে এসেছে ওরা ওই দেওয়ালের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। রোদ্দুর সাবধানে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ঘরের জানালা খুঁজে বের করল। সেখানে ঠকঠক করতেই আওয়াজ অনুসরণ করে ঝিলমিল ওখানে এসে দাঁড়াল। রোদ্দুর বলল, ‘কে? আওয়াজটা কি এখানে থেকেই এলো?’
ঝিলমিলের কী যে হয়ে গেল, সে বাচ্চাদের মত ফোঁপাতে শুরু করল। রোদ্দুরখে ঠিকই চিনতে পেরেছে, তারমানে ও এসেছে! এখন দুনিয়ায় যাই হয়ে যাক না কেনো, ঝিলমিল আর ভয় পাবে না। সে তার জীবনের বিশ্বস্ত মানুষটাকে খুঁজে পেয়েছে।
কোনোরকম কান্না চেপে ভেজা গলায় বলল, ‘রোদ্দুর!’
ব্যস আর কী! রোদ্দুর’ও চিনতে ভুল করল না তার প্রতীক্ষিত মানুষটাকে। তার বুকের ভেতর কী যেন একটা নড়েচড়ে উঠল। এতক্ষণ আটকে রাখা নিষ্ঠুর নিঃশ্বাস, জমানো কষ্ট সবটা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে হালকা করে নিল। হাসান’ও বুঝতে পেরেছে, হেসে সে রোদ্দুরের কাঁধে চাপড় দিল। রোদ্দুরের মনে হলো, এতক্ষণ পাগলাটে মাথাটা এইবার ঠিক হয়েছে। মন শান্ত হয়েছে এইবার। ধীরে ধীরে বুকের মধ্যেকার অসহ্য জ্বলুনিতে এক ফোঁটা… মাত্র এক ফোঁটা পানির ছিটা পড়েছে।
সে কোনোরূপ ভূমিকা বিহীন বলল, ‘তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি এখানেই আছি। এই জানালা ভাঙ্গার ব্যবস্থা করছি। প্লিজ ঝিলমিল, কিছুক্ষণ ওয়েট কর।’
এইদিকের এই জানালাগুলো কাঠের তৈরি। রোদ্দুর খেয়াল করল, এগুলো খুব বেশি মজবুত নয়। একটু কসরত করে চেষ্টা করলেই ভেঙ্গে যাবে, তারপর শিকগুলো খুলে ফেললেই হয়ে গেল। কিন্তু যতটা সোজা ভেবেছিল এটা মোটেও ততটা সোজা ছিল না। পালাক্রমে দুই বন্ধু চেষ্টা করে খুব সামান্য নড়াতে পারল। তবে শিকগুলো খুলে ফেলল সহজেই। রোদ্দুর ওখানেই দাঁড়িয়ে হাসানকে বলল, ‘লাঠি জাতীয় কিছু নিয়ে আয়, সেটা দিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখি।’
জানুয়ারি মাসের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে ওরা ব্যস্ত নিজেদের উদ্ধারে। ঠান্ডা কোথায় পালিয়েছে কে জানে! হাসান চলে যেতেই রোদ্দুরের তানিশার কথা মাথায় এলো। সে ঝিলমিলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর সাথে কেউ আছে নাকি একা?’
ঝিলমিল পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কেউ থাকার কথা আমার সাথে?’
রোদ্দুর তানিশার কথা বলল। ঝিলমিলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কী হচ্ছে তাদের সাথে এসব? হঠাৎ একটু আগের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু ও এই আঁধারে সামনে আগানোর সাহস পেল না। স্ট্যাচু হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন জানালাটা ভাঙ্গতে পারবে!
জানালার একটা পাট খুলতেই ঝিলমিল রোদ্দুরের কাছ থেকে ফোনটা চেয়ে নিল। সেটার আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সারা ঘরে আলো ছড়িয়ে তানিশাকে চোখে পড়ল। তারমানে তখন ওর সাথেই ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। ঝিলমিল দ্রুত গিয়ে ওর হাতের আর মুখের বাঁধন খুলে দিল। তানিশা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে! রোদ্দুরকে জানাতেই ওর বুকের উপর থেকে আরেকটা ভারী পাথর নেমে গেল।
ঝিলমিল এই জানালা দিয়ে নিজে অনেক কষ্টে বের হতে পারবে কিন্তু তানিশা কি করবে? ওর জ্ঞান ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। তখন হাসান বলল, ‘আমি সামনে একটা টিউবওয়েল দেখেছিলাম। ওখান থেকে পানি নিয়ে আসছি।’
যেই বলা সেই কাজ। তবে গিয়ে দেখল টিউবওয়েল ব্যবহার না করতে, না করতে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে; ঝং ধরে গেছে ওতে। তবে পাশে একটা ছোট্ট পুষ্কনীর মত দেখতেই সেখান থেকে নিজের রুমাল ভিজিয়ে এনে ঝিলমিলের কাছে দিল। সে পানি তানিশার চোখেমুখে পড়তেই ওর জ্ঞান ফিরে এলো। ঝিলমিলকে দেখে অঝোরে কান্না করে দিল। কিন্তু এখন আবেগ প্রকাশের সময় নয়। রোদ্দুর তাড়া দিতেই ওরা দু’জন জানালার দিকে এগিয়ে এলো।
তানিশা একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ওর ওষুধের প্রভাব এখনও কাটে নাই। কী করছে না করছে, নিজেও বুঝতে পারছে না। ঝিলমিলের পক্ষে ওকে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব হলো, ততটুকু করল। রোদ্দুর ওপাশ থেকে তানিশাকে ধরতেই ঝিলমিল বেরিয়ে এলো। বের হওয়ার সময় ভাঙ্গা জানালার কোণার সাথে হাত কেটে গেল, পিঠে লাগল, ঘাড়ে লাগল। বের হয়ে আসতে পেরেছে এটাই শান্তি, ব্যাথাটা পরোয়া করল না। রোদ্দুরের মুখোমুখি দাঁড়াতেই রোদ্দুর শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল। এক হাত গালে ঠেকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছিস?’
ঝিলমিল চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘হুমম।’
তারপর কী হলো, আবার হারানোর ভয় তাকে চেপে ধরল। আর সে রোদ্দুরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কিছু বলল না, অবুঝ বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল। রোদ্দুর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, ‘বাড়ি চল। সবাই অপেক্ষা করছে।’ রাতের ঠান্ডায় কাঁপছিল ঝিলমিল। রোদ্দুর ওর জ্যাকেটটা খুলে দিল। হাসান ছোট চাচ্চুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, তারা ফিরছে। ঝিলমিলের ছিল বিধ্বস্ত অবস্থা, আর তানিশা এতটাই মুমুর্ষ ছিল যে ওর বোধবুদ্ধি খোয়া গেছিল। রোদ্দুর দু’জনকেই আগলে রেখেছে। খুব সাবধানে কোনোরূপ ঝামেলা ছাড়াই ওরা ওই পৌড়বাড়ি পার হলো। দূর থেকে বাইকের হেডলাইট চোখে পড়তেই হাসান বলল, ‘ওইতো চাচ্চু চলে আসছে।’
হাসান যে ফোন করে তাকে আসতে বলেছে, রোদ্দুরের জানা ছিল না। আর এই রাতের বেলা হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। ছোট চাচ্চু এসেছে, রোদ্দুরের বাবা এসেছে; ওরা তাদের সাথেই রওনা দিয়ে দিল।
.
ঝিলমিল নিজের অবস্থা যতটুকু করুণ মনে করেছিল, বাড়ি এসে দেখল বাড়ির পরিস্থিতি আরও বেশি করুণ এবং জটিল। মা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বাবাও উঠে এসেছেন। ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। বড় চাচা-চাচির’ও একই অবস্থা। দাদি পর্যন্ত আহাজারি করতে লাগলেন। এই করতে করতেই রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেল। বড় চাচা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা কি শুরু করেছ, বাচ্চাগুলো এসেছে ওদের একটু বিশ্রাম করতে দাও। দেখো একেকজনের চেহারার অবস্থা! আমাদের বাড়ির মানুষগুরোল উপর দিয়েও কম ধকল গেল না, সব কাহিনী পরে শুনব। যাও তোমরা সবাই যে যার ঘরে গিয়ে বসো।’
ঝিলমিল নিজের ঘরে যেতে নিলে রোদ্দুর বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আমার ঘরে আয়। কথা আছে।’ ঝিলমিল নিঃশব্দে ওর পিছু পিছু চলে এলো। রোদ্দুর প্রথমেই ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে ঝিলমিলের হাতে কাঁধে ব্যান্ডেজ করে দিল। তারপর বসল ওর মুখোমুখি। মনের ভেতর জিজ্ঞেস করার জন্য অনেক কথাই ছিল কিন্তু ঝিলমিলের মনের অবস্থা ভালো না। তাই সাধারণ কথাবার্তা শুরু করার জন্য জিজ্ঞেস করল, ‘মাথাব্যাথা কমেছে এখন? ভালো লাগছে?’
ঝিলমিল মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল। হ্যাঁ নাকি না বলল রোদ্দুর কিছুই বুঝল না। রোদ্দুর কিছু বলার মত খুঁজে পাচ্ছে না। মননে হচ্ছে, ঝিলমিল যথার্থই নতুন মানুষ।
‘বাড়ির সবাই যা টেনশন করছিল বলার মত নয়। মনে হচ্ছিল উৎকণ্ঠায় সবার আত্মা গলায় এসে ঠেকেছে। প্রথমে তুই তারপর তানিশা। আচ্ছা বলতে পারিস ওরা কারা ছিল? দেখেছিস কাউকে? একটু পর থানায় যাব। ওসির সাথে কথা বলে ব্যাপারটা খোলাসা করতে হবে।’
ঝিলমিল নিঃশব্দ রইল। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাথার ভেতর চিনচিনে ব্যথাটা বিরক্ত করছে খুব। তবুও রোদ্দুরকে বলল, ‘না কাউকে চিনি না। যতদিন ওখানে ছিলাম, ততদিন একটা মানুষের চেহারাও দেখি নাই। আর কিছু জিজ্ঞাসা করিস না, আমার ভালো লাগছে না।’
‘ঠিক আছে ঘুমিয়ে থাক।’ রোদ্দুর উঠল। তার বহুত কাজ বাকি আছে। তার আগে বড় চাচার সাথে কথা বলতে হবে। বিষয়টা যে তাদের সাথে শত্রুতামি করে করা হয়েছে এটা বোঝা গেছে। রোদ্দুর ঝিলমিলের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করল। জ্বর আছে তবে হালকা। ঘরের আলো নিভিয়ে বের হলো। বসার ঘরেই তাদের পেয়ে গেল। মাহমুদ সরকার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঝিলমিলের কি অবস্থা?’
রোদ্দুর মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে ঠিক আছে। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমরা কি ঝিলমিল আর তানিশার কথা পুলিশকে এখন’ই জানাব। আমার মনে হয়, আজকের দিনটা অন্তত গোপন রাখা ভালো।’
বড় চাচা বললেন, ‘কেনো? হঠাৎ গোপন রাখার কথা বলছ?’
‘কারণ আছে। আমি তো গিয়েছিলাম ওইদিকে। অনেক সন্দেহজনক বিষয় আমার চোখে পড়েছে। প্রথমত, আমি আপনাদের বলি; আমি তাদের কিছু ভাসা ভাসা কথা শুনতে পেয়েছি। দু’জনকে আটকে যদি কোনো কাজ না হয় তবে চৌদ্দ গুষ্টি তুলে আনব…. এই টাইপের। এখন পুলিশ কতটুকু আমাদের সহায় হবে, তা জানা নেই। তাই আমি জানাতে মানা করলাম।’ রোদ্দুর কথাটা বলে বড় চাচার দিকে তাকাল তার উত্তরের আশায়। তিনি বললেন, ‘সবই বুঝেছি। তোমার কথাও ঠিক আছে। কিন্তু পুলিশকে না জানালে হবে? এখন যে ওসি আছেন, ওনার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো। ওনাকে বাসায় ডেকে নিয়ে এসে সমস্তটা খুলে বলি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বাড়িতেও আমার সেফ না।’
রোদ্দুর মাথা নেড়ে সায় জানাল। সে আরেকবার ঝিলমিলকে দেখে এলো অথচ কাল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই মেয়েকে সামনে পেলে নির্বুদ্ধিতার জন্য ইচ্ছেমত বকে দিত, কষে কয়েকটা থাপ্পড়’ও দিত। গত রাত পর্যন্ত বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করছিল কষ্টগুলো। সবসময় সামনাসামনি থাকা একটা মানুষ হারিয়ে গেলেই কী এত কষ্ট হয় নাকি সেই মানুষটার সাথে মনোজগতের কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় বলেই এত কষ্ট! রোদ্দুরের জানা নেই। জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এ কেমন সম্পর্কের টানাপোড়েন?
ওসিকে ফোন করতেই তিনি চলে এলেন। তার সাথে কথাবার্তা বলে পরিকল্পনা সাজানো হলো। এই সময় উসমান খন্দকার’সহ তার ছেলেপেলে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। কাউকে পাওয়া যাবে না তাদের পরিকল্পনার ভেস্তে যাবে। তাই ঠিক করা হলো, সন্ধ্যার পর ওরা ওই পৌড়বাড়িতে যাবে পুরো ফোর্স নিয়ে।
রোদ্দুরের বদ্ধ বাড়িতে ভালো লাগছিল না,সে বের হয়ে সোজা নদীর পাড় চলে এলো। আগে বাড়িতে এলে এখানে প্রচুর আসা হতো আর ছোটোবেলা তো বোধহয় এই নদীর বুকেই কেটেছে। নদীর কলকল ছলছল ধ্বনি হু হু করা অস্থির মনকে এক নিমিষেই স্থির করে দেয়। স্থির হলেও মনের মধ্যেকার বিষন্নতা কাটল না। ওর মনে হলো, সে একটা দায়িত্বহীনতার কাজ করছে। এই মুহূর্তে তার উচিত ঝিলমিলের পাশে থাকা। তাই আবার বাড়ির দিকে ছুট দিল। ঝিলমিল এখনও ঘুমাচ্ছে। আগে কখনো ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখা হয় নাই, প্রয়োজন’ও বোধ করে নাই। তবে আজ দেখল, পলকহীন অনেকক্ষণ। মনে পড়ে না, জীবনের এতটা সময় আর কারো দিকে এইভাবে তাকিয়ে ছিল কিনা। ইশশশ ঝিলমিল জেগে থাকলে নিশ্চয়ই বলত, ‘তুই একটা ক্যাবলাকান্ত রে! এইভাবে মানুষ নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকে? ছ্যাহহহহ!’
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৭৬৫