#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩৬]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিল যতটা ব্যথা গেল, তারচেয়ে বেশি চমকে গেল। তার গোলাপ ফুলের মত চকচকে চেহারায় মালিন্য স্পর্শ করল। কলজে মোচড়ানো ব্যথা নিয়ে করুণ মুখে উঠে দাঁড়াল। বিষাদী চোখেমুখে বলল, ‘তুই এত নিষ্ঠুর! এইভাবে ফেলে দিলি আমাকে?’
রোদ্দুর ঝিলমিলের ভুল শুধরে দিয়ে বলল, ‘ফেলে দিই নাই ছেড়ে দিয়েছি।’
‘আমি পড়ে গেলাম তো। আমার চাচা-চাচি তো এত নিষ্ঠুর নয়। তাদের ঘরে এই জাঁদরেল? বিশ্বাস হয় না। আমি শিওর তোকে কুড়িয়ে পেয়েছে। অসভ্য অভদ্র কোথাকার! তুই আর আমার ধারেকাছেও আসবি না। দশ হাত দূরে থাকবি। দরকার হলে আমি এই ঘরের মধ্যে দাগ টেনে তোকে আর আমাকে আলাদা করব, হুহ!’ ঝিলমিল ক্ষেপে কথাগুলো বলল।
রোদ্দুর সামনাসামনি মাথা ঝাঁকালেও মনে মনে বলল অন্য কথা, ‘ভাগ্য যাদের এক করে দেয় তাদের আলাদা করা তোর মত পুঁচকের কাজ নয়। তোর দ্বারা কোমড় বেঁধে ঝগড়া করাই মানায়। তুই তোর কাজ কর আমি এভারেস্ট জয় করতে যাই আমি বউয়ের মন জয় করতে যাই।’
রোদ্দুরের সাথে যাই হয়ে যাক না কেনো, এখানে এসে ঝিলমিল নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। ওইখানে দমবন্ধ করা একটা অবস্থা হয়ে গেছিল। এইজন্যই বুঝি বলে, বিয়ের পর মেয়েদের আসল ঘর হচ্ছে স্বামীর ঘর! দু’জনের বিয়ে হয়েছে ঠিক’ই কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়া হয়ে ওঠে নাই পুরোপুরি। রোদ্দুর তাও বুঝতে চেষ্টা করে কিন্তু ঝিলমিল যখন বুঝতে যায়, রোদ্দুরের কথাবার্তার মাত্রা উপলব্ধি করতে যায় তখন মনে পড়ে সানিয়ার কথা। সেটা আর সহ্য হয় না।
রোদ্দুরের অস্বস্তির পরিমাণ বাড়ছিল। বিষন্ন এবং দুঃখ জড়ানো সময়গুলো কাটতে চাইছিল না। কেমন যেনো মনমরা লাগছিল সবকিছু। ঝিলমিলকে ছাড়া তার এমন একটা মুহূর্ত হবে, কল্পনাও করতে পারে নাই। সেখানে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডাও জমতো না। পিছুটানের শেকলে বাঁধা পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। অস্থির এবং বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রাতে ঘুমাতে যেত কিন্তু চোখে ঘুমের কোনো রেশ মাত্র ছিল না। তখন নির্ঘুম রাতে ভাবতে বসতো সানিয়ার কথা। জীবনের প্রথম প্রেম, ভালোলাগা তবে কোনোভাবেই ভালোবাসা নয়। ভালোবাসা সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে। সানিয়া অসম্ভব সুন্দরী ছিল; কথাবার্তায়, কাজেকর্মে সবদিকে পটু। তবে নিজের অনুভূতি খুব সহজে প্রকাশ করত না অর্থাৎ চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। ওইদিন যদি তানভীরের বিষয়টা নিয়ে ও বাড়াবাড়ি না করত তবে আজ রোদ্দুর হয়তো তার সাথেই থাকতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসহ্য মনে হলেও তখন তা মেনে নিতে হতো।
এইদিকে ঝিলমিল হচ্ছে দিলখোলা ধরণের মানুষ। মনের ভেতর দুঃখ, কষ্ট, হাসি, আনন্দ চেপে রাখতে পারে না। কান্নার প্রয়োজন পড়লে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। রাগ, দুঃখ সব উজাড় করে দিবে। রোদ্দুর’ও তাই চায়। সে রেগে ঝগড়া করুক, দুঃখ পেয়ে সুখ খুঁজতে আসুক, কষ্ট প্রকাশের জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি করুক, অনুভুতির ডানা মেলে দিক, ভালোবাসায় দিশেহারা হয়ে যাক। ঝিলমিলকে এইভাবেই মানায়, বেশি মুডি হলে ওকে বড্ড অচেনা মনে হবে, দূরের মানুষ মনে হবে।
ঝিলমিল পাশে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত নগরীর অঘোষিত রাজকুমারীর মুখের দিকে চেয়ে রোদ্দুরের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। দীর্ঘশ্বাসের কারণটা অজানা রয়ে গেল। রোদ্দুর বালিশে হেলান দিয়ে গালে হাত রেখে তার সামনে থাকা অপরূপা মেয়েটার দিকে সম্মহিতের মত তাকিয়ে রইল। তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি এলে যেমন সব হারিয়ে তা আনন্দে দিগ্বিদিক হারিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, সব ভুলে যায় রোদ্দুরের অবস্থাও এমন হলো। একটা ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তার সবদিক এলোমেলো করে দিল। রোদ্দুরের ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে একটুখানি ছুঁইয়ে দিতে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেও ওই রূপকে না ছুঁয়ে থাকতে পারল না। তার দৃষ্টিতে ছিল হাজার বছরের তৃষ্ণা, বুকে জমাট বাঁধা ভালোবাসা। মনের শাসন বারণ অমান্য করে তীব্র নেশায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওর দু’চোখের পাতায় দীর্ঘ চুমু খেল।
.
ঝিলমিলের প্রতি রোদ্দুরের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা সে একবার প্রকাশ করে দিয়েছে। কিন্তু ঝিলমিলের দিকে থেকে হ্যাঁ/না কিছুই আসে নাই। কিন্তু রোদ্দুর বলেছে, সে অপেক্ষা করবে। তবে উপর উপর ঝিলমিলের সাথে যে ফাজলামি করে, তা না করলে তার শান্তি লাগে না ইদানিং। আজ’ও অফিসে যাওয়ার আগে রেডি হয়ে একটা আকাম করে গেল। ঝিলমিল তখনও ঘুম থেকে উঠে নাই অথচ রাতে ঘুমিয়েছে কত আগে! রোদ্দুর তাকে ডেকে দিয়ে গেছে এবং গায়ের উপর থেকে কম্বলটাও সরিয়ে দিয়েছে। ঝিলমিল বিরক্তবোধ করলেও কিছু বলল না, পাত্তাও দিল না। রোদ্দুর বেড়িয়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর উঠে বসল। ঘরের জানালা দরজা খুলে দিল। ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকতেই খিদে টের পেল। পেটের মধ্যে চো চো করছে। ঝিলমিল দেখল, টেবিলে খাবার রেডি করাই আছে। ঢাকনা তুলে দেখল, পাউরুটি এবং জেলি। মুখ বেজার করে রুটিতে পরপর দুটো কামড় দিতেই মনে হলো সেটা মুখের মধ্যে জ্বলে উঠল। হাঁসফাঁস করতে করতে ঝিলমিল মাথায় দু’টো থাবড়া মেরে বলল, ‘এটা কোন কোম্পানির জ্যাম, এত ঝাল কেনো?’
ঢকঢক করে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে পর্যবেক্ষণ করে দেখল, এটা আসলে কোনো জ্যাম না। এটা গুঁড়া মরিচ দিয়ে কিছু একটা বানিয়েছে। নিশ্চয়ই রোদ্দুরের কাজ! রাগে, দুঃখে, হতাশায় ঝিলমিলের নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। কিন্তু চুলগুলো’ও ঘোড়ার লেজের মত একটুখানি হয়ে গেছে, তাই যার রাগ তার উপর’ই ঝারার সিদ্ধান্ত নিল। ফোনটা হাতে নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে টাইপিং করল, ‘অ্যাই রোদ্দুরের বাচ্চা!’
রোদ্দুর ওর মেসেজের অপেক্ষাতেই ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল বোধকরি। সে তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিল, ‘আই এম ওয়ান এন্ড অনলি আহসানুল সরকার রোদ্দুর। আই হ্যাভ নো বাচ্চাকাচ্চা।’
‘তুই এতো খারাপ কেনো? ঠিক আছে, আজকে এটা করলি না। দেখিস তোর সাথে আমি কি করি!’
‘ওমা আমি আবার কি করলাম?’
‘কিচ্ছু করিস নাই শুধুমাত্র আমায় আপ্যায়ন করার জন্য মরিচের জ্যাম বানিয়ে রেখে গেছিস। খুব ভালো করেছিস। অনেক মজা করে খেয়েছি। তোর আপ্যায়নে আমি আপ্লুত। এরপর আমি তোকে কীভাবে আপ্যায়ন করব, তাই ভাবতেছি।’ ঝিলমিল একনাগাড়ে টাইপিং করল।
রোদ্দুর একা একাই হো হো করে হেসে উঠল। খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মাথায় এই দুষ্টু বুদ্ধিটা উঁকি দিল। তাই ঝটপট রান্নাঘরে গিয়ে পানি গরম করে তাতে কৌটার সবটুকু গুঁড়া মরিচ ঢেলে, একটা স্পেশাল পাউডারের সাহায্য বানিয়ে ফেলল টুকটুকে লাল গুঁড়া মরিচের জ্যাম।
রোদ্দুর রিপ্লাই দিল, ‘কত কষ্ট করে তোর জন্য বানালাম। আর তুই এভাবে বলছিস? আমার প্রতিভার দাম’ই দিলি না। পৃথিবীতে আর কোনো হাজব্যান্ডকে দেখেছিস বউয়ের জন্য এত ভাবে? কষ্ট করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্পেশাল খাবার রেডি করে রাখে। দেখেছিস বল, দেখেছিস কখনো?’
‘না, এইবার দেখে নিলাম এবং শিখেও নিলাম।’ হাত থেকে ফোন রেখে ঝিলমিল ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগল, কীভাবে রোদ্দুরকে জব্দ করা যায়। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পেল না। থাক, আজকের দিনটা যাক। পরে ভেবে দেখবে। ঝিলমিলের মনে পড়ল, সামনের সপ্তাহে রায়হান ভাইয়ের বিয়ে; সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, কেনাকাটা করতে হবে। ইয়েস….. মিশন রোদ্দুরের পকেট কাটা!
.
সন্ধ্যার পর রোদ্দুর বাড়ি ফিরতেই ঝিলমিল ওর হাতে বড়সড় একটা লিস্ট ধরিয়ে দিল। রোদ্দুর বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?’
‘পড়াশোনা পারিস না? পড়ে দেখ।’
লিস্টটা হাতে নিয়েই রোদ্দুরের ভুরু কুঁচকে গেল। এমন এমন সব জিনিস, যার নাম জীবনেও শোনে নাই।
রোদ্দুর ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এগুলো কি আজিব আজিব নাম? শাড়ি ব্ল্যাক ঠিক আছে কিন্তু মাইসোর সিল্ক ব্ল্যাক কি? এগুলার নাম’ই তো শুনলাম না কোনোদিন। আমি তো রং বলতে সাদা, কালো, গোলাপী, হলুদ, সবুজ, নীল, লাল এগুলোকেই বুঝি কিন্তু এখানে লিপস্টিকের কি কালার লিখেছিস এটা? রেভলন ফ্রস্ট কি?’
তাকে বড্ড হতাশ দেখাল। এছাড়াও ঝিলমিল আরও অনেককিছুই লিখেছে, হাতেগোনা দুই একটা নাম রোদ্দুর শুনেছে; বাকিগুলো…. হতাশ, সে আসলেই হতাশ।
ঝিলমিল বলল, ‘তোকে বুঝতে হবে না। আমাকে শপিংয়ে নিয়ে চল, আমি সব চিনিয়ে দিচ্ছি।’
‘হুঁ। এটাই বাকি আছে এখন। এমনভাবে আরেকজনের বিয়ের জন্য শপিং করছিস যেন নিজের বিয়ে! নিজের জন্য কিছু বাকি রাখ।’
‘সেসব নিয়ে তোকে এখন ভাবতে হবে না। এখন আমাকে এসব কিনে এনে দে।’
‘আমি যদি দোকানে গিয়ে এই লিস্ট দেখাই তবে দোকানদার কি আসলেই আমাকে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ভাববে? মানে, এই জিনিসগুলো আদৌ আছে পৃথিবীতে? আমাদের দেশে? গোলাপি শাড়ি, লাল লিপস্টিক, লাল শ্যাডো-ফ্যাডো আনলে হয় না।’
ঝিলমিল চোখ নাক মুখ একসাথে কুঁচকে বলল, ‘ইয়ে…. ছিঃ। তোর ড্রেসিং সেন্স এত বাজে। তুই যেভাবে বললি ওইভাবে সাজলে আমাকে পুরো জোকারের মত লাগবে।’
‘শোন.. আমি বলি তোকে, বোঝার চেষ্টা কর। তুই যেসব সাজগোজের জিনিসের নাম উল্লেখ করেছিস সেসব দিয়ে সাজলে তোকে জোকার জোকার লাগবে। তুই তো একটা মানুষ নাকি! তো এসব ডাইনোসর না মাইসোর এসব পড়বি কেনো?’
ধুর, এই গাধাকে বোঝানোর কোনো মানেই হয় না। ঝিলমিল হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কঞ্জুস কোথাকার! কিচ্ছু লাগবে না আমার। তোর কিছুই কিনে দিতে হবে না। আমি তোর বন্ধুর বিয়েতেও যাব না, কোথাও যাব না। অসহ্য একটা। আমি বিগত কত বছর যাবত সাজগোজ করে আসছি, আমি জানিনা আমাকে কেমন দেখাবে! উনি আসছে বর্ণনা দিতে।’
রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বলল, ‘আমি যে তোকে মনে মনে কল্পনা করেছি।’
ঝিলমিল এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে রোদ্দুরের বুকে ধাক্কা মেরে বলল, ‘যাহ।’
রোদ্দুর ইচ্ছে করে বিছানায় উল্টে পড়ে গিয়ে বুকে হাত রেখে বলল, ‘আয়হায়, বউয়ের জ্বালা বড় জ্বালা।’
.
পরদিন ঝিলমিল ক্লাসে গেল। গতকাল থেকে রোদ্দুরের সাথে আর কথা হয় নাই। রাগ করে আছে, ব্যাডা রাগের মর্ম বুঝুক একটু। ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরল’ও একা একা। বাড়ি ফিরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজের এলোমেলো কাপড়-চোপড় গুলো গুছিয়ে রাখল। সব কাজ শেষে ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল। বাড়িতে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখনও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। উঠে বসল, রোদ্দুর এখনও বাড়ি ফেরে নাই। ঝিলমিল ফোন হাতে নিয়ে ফোন করতে যেতেই মনে পড়ল, ওর সাথে তো কথাই বলবে না তবে আর ফোন করবে কেনো? আবার কখনো সে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে না, আজ অনিয়ম বলে একটু চিন্তাও হচ্ছে। ঝিলমিল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এইদিক থেকে রাস্তার একাংশ দেখা যায়। ঝিলমিল ঠোঁট উল্টে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। একবার ঘড়ির দিকে তাকায় আরেকবার রাস্তায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে একটা মেসেজ পাঠাল।
মেসেজটা এইরকম, ‘বাড়িতে কখন আসবি? কে যেনো এসেছিল তোর খোঁজ করতে।’
মানে সে ভাঙবে তবুও মচকাবে না। রোদ্দুর অবশ্য মেসেজের রিপ্লাই দিল না। এইদিকে ঝিলমিল এইবার থাকতে না পেরে ফোন’ই করল। কিন্তু কয়েকবারেও সে ফোন রিসিভ করল না। পাল্লা দিয়ে ঝিলমিলের চিন্তার পরিমাপ’ও বাড়তেছে। এমন কারো অর্থাৎ রোদ্দুরের সাথে যাদের সম্পর্ক তাদের ফোন নম্বর’ও নে যে ফোন করে খোঁজখবর করবে।
রোদ্দুর ওকে একা প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাহিরে যেতে মানা করে দিয়েছে। কিন্তু ঝিলমিল ঘরের মধ্যে বসে থেকে টেনশনে আর মাথা ধরাতে পারবে না। অলরেডি মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। ও ঘর লক করে চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। লিফটের অপেক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে সোজা মিনিট দশেকের মাথায় চৌরাস্তার মোড়ে চলে এলো। বেশিরভাগ সময় ও এখানেই থাকে বন্ধু-বান্ধবের সাথে। কিন্তু আজ তার টিকির সন্ধান’ও পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতেও ফোন করছে না, নির্ঘাত সকলে টেনশন করবে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে, ফোন করে নয়টা নাগাদ ঝিলমিল বাড়ি ফিরে এলো। এইবার সত্যিই মাথা ঘুরাচ্ছে ভনভন করে, টাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানা নেই। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির সে। এমনিতেই পত্রিকায়, ফোনে নিউজে কত আজেবাজে খবর দেখে। এখন এই দুঃসময়ে সেসব মাথায় উঁকি মারছে। ঝিলমিল আবার ফোনে ডায়াল করল কিন্তু এইবার ফোনটাই অফ।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, বেশ রাত হওয়ার পর ঝিলমিলের মনে হলো এখন বাড়িতে জানানো উচিত। তাড়াহুড়ো করে ফোন করতে যেতেই হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। ওমনি ঝিলমিল ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দরজার দিকে দৌড় দিল। কোনোকিছু চিন্তাভাবনা না করেই দরজা খুলে দেখল রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে। স্বপ্ন না সত্যি ঝিলমিল বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। সে এগিয়ে গিয়ে রোদ্দুরের বুকে আঁছড়ে পড়ে কান্না করে দিল।
.
.
.
চলবে…….
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব- ৩৭ ও ৩৮]
~আফিয়া আফরিন
ঝিলমিলের এমন অবস্থা দেখে রোদ্দুর ভয় পেয়ে গেল। থতমত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে? এমন করছিস কেনো?’
ঝিলমিলের কান্না তখনও বন্ধ হয় নাই। তৎক্ষণাৎ রোদ্দুরের কথার উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ বাদে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘তুই কোথায় গিয়েছিলি? আমি অনেকবার তোকে ফোন করেছিলাম। তুই কেনো ফোন রিসিভ করিস নাই? জানিস কতটা চিন্তায় ছিলাম। চৌরাস্তার মোড় থেকেও ঘুরে এসেছি। ভেবেছিলাম তুই তো সবসময় ওখানেই থাকিস, তখনও থাকবি বোধহয়!’
রোদ্দুর ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘সো সরি। আর কক্ষনো হবে না। আজ আসলেই একটু দেখলি করে ফেলেছি….’
‘একটু না, অনেক বেশি।’
‘হ্যাঁ অনেক বেশি। আসলে গিয়েছিলাম একটা কাজে। তুই যখন ফোন করেছিলি তখন ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন রিসিভ করতে পারি নাই। পরে ব্যাক করতে গিয়ে দেখলাম ফোনে চার্জ না থাকার কারণে ফোন অফ হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম, এতদূর এসেই যখন পড়েছি তখন কাজগুলো সেরে যাই। বিশ্বাস কর, এত দেরি হবে আমি জানতাম না।’
ঝিলমিল দু’হাতে নিজের চোখ মুছে বলল, ‘ঠিক আছে। আর কখনো এমন করবি না।’ তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। রোদ্দুর ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। সে পুরো ঢাকা শহর ঘুরে এলো ঝিলমিলের আবদার পূরণ করতে। তখন কীসব শাড়ি চুরির নাম বলেছিল, সেসব খুঁজতে তো যথেষ্ট সময় লাগে নাকি! ঝিলমিল অবশ্য এসব দেখে আগ্রহ প্রকাশ করল না, সে রোদ্দুরকে ফিরে পেয়েছে এতেই অনেক।
মানুষ একবার হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া যায় না— কথাটা ঝিলমিল ভালো করেই জানে। আজ রোদ্দুর যখন ফিরে আসছিল না, ফোন ধরছিল না তখন ঝিলমিলের মনের মধ্যে তুফান বয়ে যাচ্ছিল। হারানোর ভয়, যন্ত্রণা সবকিছুর মিশ্র অনুভূতি। তারপর রোদ্দুরকে যখন দেখল মনে হলো, তার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত মানুষটাকে সে খুঁজে পেয়েছে। একদা স্বপ্নে দেখেছিল রাজপুত্রকে যে ঝিলমিলকে সব অবসাদ থেকে বাঁচাতে এসেছে, ওর জীবনের সব না পাওয়া বরবাদ করতে এসেছে; আজ রোদ্দুরকে তাই মনে হলো। তবে ভুল নয়। ওই হয়তো তার সেই রাজপুত্র, যাকে স্বপ্ন দেখত; যাকে নিয়ে হাজার হাজার স্বপ্ন সাজাতো, স্বপ্ন বুনত। রাতে শোয়ার পর ঝিলমিল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের উপর থেকে কয়েক টন ওজনের পাথরটা নেমে গেছে, এখন বেশ হালকা লাগছে।
.
উসমান খন্দকার ভেবেছিলেন, তাকে এরা বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। কিন্তু এত উকিল, এত নোটিশেও কোনো কাজ হচ্ছে না। একটা মামলার জায়গায় তার নামে আরও ছয়টা মামলা হয়েছে। যাকে বলে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়েছে। আরেকটু সাবধান থাকলে হয়ত আজ তাকে এখানে থাকতে হতো না! সেদিন কোনোরূপ পরিকল্পনা ছাড়াই ঝিলমিলকে কিডন্যাপ করেছিল। পথে একা পেয়েছে, লোকজন দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর তানিশাকে এত তাড়াতাড়ি তুলে আনা উচিত হয় নাই। যেহেতু সব হুট করেই করা হয়েছে, তাই ফেঁসে গেছে। তারপরও নিজের উপর একটা আত্নবিশ্বাস ছিল, এই যাত্রায় পার পেয়ে যাবে। ওদের এখান থেকে সরানোর সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। এখন চার দেওয়ালের একটা বদ্ধ কামড়ায় বসে কপাল চাপড়াচ্ছেন। তার ছেলেদের’ও ধরেছে, ওরা বাহিরে থাকলে যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু এখন একদম নিরুপায়। হাপিত্যেশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। ক্ষমতা হারিয়ে অন্ধ হয়ে ফজলুল সরকারকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ওদের মনে ভয় ঢোকানোর জন্য বাড়ির পেছন দিক দিয়ে যাওয়ার পথে যে ঘরটায় খুব সহজে নিজের বাগে আনা যায়, লোক লাগিয়ে তাই করেছিল। বেশ অনেকবার ঝিলমিলের ঘরের জানালায় ঢিল ছুঁড়েছে, ঠকঠক করেছে। ভয় তো পেল না উল্টো পুলিশে জানান দিল। তারপর ভাইয়ে ভাইয়ে ঝামেলা লাগানোর জন্য’ও একেকজনকে একেক রকম কথা বলেছে।
এইতো গত সপ্তাহেও মাহমুদ সরকারকে সামনে পেয়ে বলেছিল, ‘কী হে ভাইসাব, ভালো তো? শরীর স্বাস্থ্যের কি খবর? আপনাদের ভাইয়ের জন্য আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগে। আপনারা তো পড়ে আছেন সেই বাপের আমলের ব্যবসা নিয়ে ওইদিকে বড় ভাই কি করছে দেখুন। তিনি তো নিজের সব গুছিয়ে নিচ্ছে আবার আপনাদের সম্পত্তিও সব তার দখলে। ভাই.. দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারছেন? ওরা ভালোভাবে সব আমাদের আয়ত্তে নিয়ে নিবে শেষে দেখা যাচ্ছে আপনি আঁটি হয়ে গড়াগড়ি করছেন।’
এইতো এভাবেই ভালোই চলছিল দিনকাল। অদ্ভুতভাবে সব ছাড়খাড় হয়ে গেল। তার এতদিনের পরিকল্পনা, পোষা কতকগুলো সাঙ্গপাঙ্গরা; সব হাতের নাগালের বাইরে। তবে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ওই বাড়ির কোনো মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিবেন না। তাকে যেমন সবাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিয়েছে, তিনিও সেভাবে সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিবেন।
তানিশা মামাবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। ঝিলমিল তো এখানে থেকে চলে গিয়েই বেঁচেছে তবে তার দিকে মানুষের বাঁকা দৃষ্টির অবসান এখনও ঘটে নাই। সাবরিনা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। চিন্তায় চিন্তায় প্রেসার হাই করে ফেলেছেন। এখনও পর্যন্ত তানিশার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় নাই। রেহানা খাতুন সবদিক বিবেচনা করে বললেন, ‘দেখো, তোমরা যদি মেয়ের বিয়ে দিতে পারো। আমি এর থেকে ভালো কোনো উপায় দেখছি না। একমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই ওর উপর থেকে এই কালো দাগ ঘুঁচবে।’
উনার কথাটা ঠিক আছে, কিন্তু তানিশা এখনও অনেক ছোটো। ওর বিয়ে দেওয়াটা এখনই দেওয়া ঠিক হবে কিনা, সেটা নিয়ে মোটামুটি সবাই দ্বিধাগ্রস্ত। তার উপর এলাকায় যে কাহিনী রটে গেছে, সেখানে ভালো পাত্র পাওয়া সহজ হবে না। বাড়ির সব মানুষের মাথায়’ই এই একটা বিষয় বোঝার মত চেপে আছে। তানিশা সেখানে নিশ্চুপ। এই বিষয়ে ভালো/মন্দ কিছুই বলে না। শিমু ফোন করে ঝিলমিলকে বলছিলেন এসব কথা। ঝিলমিল শুনে বলল, ‘আমি যে তানিশাকে এখানে এনে রাখব, সেই ব্যবস্থাও নাই। আচ্ছা, এখনই বিয়েশাদীর কথা ভাবতে হবে না। আমি দেখছি কী করা যায়। এমনিতেই রোদ্দুর বলছিল, এই বাসাটা চেঞ্জ করবে। তাড়া দিলে হয়ত গুরুত্বের সহিত নিবে ব্যাপারটা। তারপর ওকে কিছুদিন আমার সাথে এখানে রাখব।’
‘ঠিক আছে, যা ভালো বুঝিস।’
ঝিলমিল ফোন রেখে দিল। ওখানে থাকাকালীন মানুষের ওই চোরা দৃষ্টিটা ওকেও ভুগিয়েছিল খুব। এমনও হলো যে ভরা মজলিসে গিয়েছে তারমধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইশশশ রে, তোদের সাথে কি হলো এটা? কতগুলো দিন আটকে ছিলি বল তো। মানুষ কত নিষ্ঠুর। আহারে, ছোটো ছোটো বাচ্চা মেয়েগুলোকেও ছাড় দিল না।’
তখন বড্ড লজ্জায় পড়তে হতো। ঝিলমিলের ওই মুহূর্তে মনে হতো, মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর সে টুপ করে মাটির নিচে ঢুকে পড়ুক।
রোদ্দুর বাড়ি ফিরতেই ওকে যা বলার দরকার ছিল, ততটুকু বলল। এই বাড়িটা আসলেই একজন মানুষের জন্য। ঝিলমিলের মাঝে মাঝেই দমবন্ধ থাকে। না ঠিকমতো হাঁটাচলা করা যায়, না নিঃশ্বাস ফেলা যায়। এই এইটুকু বাসার জন্য ওই বাড়ি থেকে এখনও কেউ এসে এক রাত থাকতে পারে নাই।
রোদ্দুর বলল, ‘দু’দিন বাদে রায়হানের বিয়ে। সে কাল থেকেই আমাদের সাথে শুরু করবে হল্লা, প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। ওর বিয়ের পর যদি হয়। আর এখন তো হবেও না, মাসের মাঝামাঝি চলছে। সামনের মাস ছাড়া সম্ভব হবে কি?’
‘ঠিক আছে, কিন্তু এখন তো আমরা বাসা দেখে রাখতে পারি। সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে যখন উঠা লাগে তখন উঠে পড়ব।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। কাল বের হবো। আজ রাত হয়ে গেছে। এই রাতে আর বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। তোর কথা মেনে নিয়েছি, তুই এখন আমার একটা কথা শোন। এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া।’
‘হুমম, এটাই তো আমার ডিউটি। সন্ধ্যা থেকে কয় কাপ হলো খেয়াল আছে?’
রোদ্দুর ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে ‘নেতিবাচক’ জবাব দিল। ঝিলমিল হাতের কর গুনে গুনে উত্তর দিল, ‘ছয়বার…. এই সাত হবে।’
রোদ্দুর সোজা হয়ে বসে বলল, ‘হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলব নাকি?’
‘সরি, আমি পারব না। এখন তোকে চা দিয়ে আমি কম্বলের তলায় ঢুকব। এই বছর শীত যাচ্ছে না কেনো জানিনা। কী যে ঠান্ডা বাবাগো। এই ঠান্ডার মধ্যে তুই আমাকে দিয়ে বারবার পানি নাড়াচ্ছিস, এই কাজ সেই কাজ! উফফফ, কোথায় ভেবেছিলাম বিয়ের পর শুধু চিল আর চিল। এখন দেখছি খেটে মরা ছাড়া উপায় নাই। আমি বলেই না এখনও আছি নাহয় তুই যে মানুষ তোর কাছে কেউ দু’দিনও টিকতে পারত না।’
ঝিলমিলের কথা শুনে রোদ্দুর বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, ‘আমি যে একজনের ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করছি তাতে কিছু না! আর উনি সামান্য দু’কাপ চা বানিয়েই ক্লান্ত।’
.
রোদ্দুর নিজের কথা রাখল। পরদিন ঝিলমিলকে নিয়ে বের হলো বাড়ি দেখতে। ওর ভার্সিটির কাছাকাছি একটা বাড়ি পছন্দ করে সেখানেই কথাবার্তা বলে ঠিক করল। ঝিলমিলের’ও পছন্দ হয়েছে। অন্তত মুরগির খোপ থেকে তো রেহাই পাবে।
দিন কাটতে কাটতে খুব তাড়াতাড়িই সময় চলে এলো। আবীরের বিয়ের বন্দোবস্ত শুরু হয়ে গেছে। আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদ্দুর আর ঝিলমিল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। বাড়ি ফিরল মাত্র। সকাল থেকে এত মানুষজনের মধ্যে থেকে ঝিলমিলের মাথা ধরেছে। তাই বাড়ি ফিরেই ধপাস করে শুয়ে পড়েছে।
রোদ্দুর ওর পাশে বসে বলল, ‘মাথা টিপে দিব?’
‘লাগবে না।’
‘দিই… নয়ত পরে বাড়ি গিয়ে সবার কাছে নালিশ করবি তোমাদের ছেলে আমার একটুও যত্ন করে না। একটুও খেয়াল রাখে না। এমনিতেই তো আমার নামে দুর্নামের শেষ নাই। যেচে পড়ে আবার কেনো কাঁধে দোষ নিব বল তো!’
ঝিলমিল বলল, ‘ওহ আচ্ছা। বাড়ির মানুষের কথা ভেবে মাথা টিপে দিচ্ছিস। আর দু’দিন আগে বললি, ভালোবাসিস… কী কী যেনো? সব শুধু মুখের কথা তাইনা?’
রোদ্দুর নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘উহুঁ, ফাও ফাও কথা রোদ্দুর বলে না। আমি তো তোর জন্য’ই অপেক্ষা করছি। দেখা গেল, ভালোবাসার দাবি নিয়ে আমি একাই এগিয়ে গেলাম আর তুই মুখ ফিরিয়ে বসে রইলি।’
‘ভালোবাসলে প্রত্যাখ্যান হওয়ার ভয় বিসর্জন দিতে হয়।’
রোদ্দুর ভুরু কুঁচকে তাকাল ঝিলমিলের দিকে। ও মনে হচ্ছে, দিনকে দিন ভালোবাসা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে।
সে ঝিলমিলের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করল, ‘কি বলতে চাইছিস তুই?’
ঝিলমিল কোনো কথা বলল না। রোদ্দুরের হাত টেনে নিয়ে নিজের কপালে রেখে চোখ বুঁজল। রোদ্দুর আলতো হাতে কপালের দু’পাশে ম্যাসাজ করে দিল অনেকক্ষণ পর্যন্ত।
ঝিলমিল রোদ্দুরের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর লাগবেনা। থ্যাংক ইয়ু। ঘুমাব, বাতি নিভিয়ে দে। আলো চোখে লাগছে।’
রোদ্দুর মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর জীবনটাই কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল। আগে কখনো এইভাবে কারো হুকুম তামিল করা পছন্দ’ই করত না। ওর যেটা ভালো লাগত, যেটা পছন্দ সেটাই করত। আর এখন ঝিলমিলের পছন্দের অগ্রাধিকার’ই বেশি। এইতো অফিসের কিছু কাজ ছিল, অন্যসময় হলে বাতি জ্বালিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত। কিন্তু এখন যখন ঝিলমিল একবার বলে দিয়েছে ওর ঘুম পেয়েছে বাতি নিভিয়ে দিতে হবে, রোদ্দুর তা এক ঝটকায় মেনে নিয়েছে।
ভাবটা এইরকম, ‘আপনি বলতে থাকুন মহারানী আপনার জন্য এই বান্দা সর্বদা হাজির।’
একটা সুন্দর সকাল। চকচকে সূর্যের রশ্মি চকচকে রূপালী এবং স্বর্ণের বিভিন্ন রং ছড়িয়ে দেওয়া, পাখির মৃদু কিচিরমিচিরে ভরপুর আনন্দময় সকাল। প্রতিদিনের মত আজও রোদ্দুরের ঘুম আগে ভাঙ্গল। তবে আজ তাড়াহুড়ো নেই, ছুটির দিন। রোদ্দুর অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করল। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঝিলমিলকে ডেকে বলল, ‘অ্যাই আজ তোর ডাইনোসর সিল্ক পড়ার দিন, তাড়াতাড়ি উঠে পড়।’
ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ বলল, ‘আমি ঠিক সময় উঠে পড়ব। তুই আমাকে বিরক্ত করিস না।’
রোদ্দুর ডাকাতের মত হো হো করে হাসতে লাগল। সেই হাসির আওয়াজে ঝিলমিলের ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল। সে চোখ কচলে উঠে বসল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘পাগল নাকি? এভাবে হাসছিস কেনো?’
ঝিলমিলের এহেন অভিযোগে রোদ্দুর ব্যাথিত হলো। সে দুঃখী এবং উদাস মুখে বলল, ‘এসব পাগল ছাগলের অপবাদ তুই দিতে পারলি আমাকে? আমি কত ভদ্র, কত ইনোসেন্ট!’
ঝিলমিল হেসে বলল, ‘আর একটা কথা বললে মাইর খাবি।’
তাই রোদ্দুর আর কথা বলার রিস্ক নিল না। ঝিলমিলকে তাড়া দিয়ে নিজেও উঠে পড়ল। ওই বাড়িতে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আজকে বিয়ের অনুষ্ঠানে আদিয়াত থাকছে না। ওর মামা শ্বশুর অসুস্থ, তাই যেতছি হয়েছে ওখানে। রোদ্দুর ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতেই ফোন বেজে উঠল। সৌভিক ফোন করেছে। রোদ্দুর রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, ‘মামা, আজকে তো সেই একটা প্ল্যান করেছি। রাতে আমাদের এইখানেই থাকবি তো নাকি!’
রোদ্দুর মাথা চুলকে বলল, ‘হবে না হয়তো। আমার স্বাধীন জীবন, একলা জীবনের ইতি ঘটেছে ভাই। অন্য একদিন থাকব।’
সৌভিক চেঁচিয়ে বলল, ‘ঠিক এইজন্য’ই আমি বিয়ে করি না। শালা তোরা বিয়ে করে সব চেঞ্জ হয়ে গেছিস। কবে জানিনা আমাদের নামগুলো’ও ভুলে বসে থাকিস। ভালো ভালো, বেশ ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। চালিয়ে যা দোস্ত তবে মাঝে মাঝে এই অধমদের একটু মনে করিস। এতে তোর যথেষ্ট মঙ্গল হবে।’ সৌভিক ফোন রেখে দিল। রোদ্দুর ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে দেখল ও এইদিকেই তাকিয়ে আছে। তাই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফোন কানে ঠেকিয়ে অযথা বলল, ‘আরে ভাই বিয়ের পর বউ ছাড়া দুনিয়ার কিছু ভালো লাগে না। সব নিরামিষ, সব অন্ধকার। বউ হচ্ছে আলোর জগত। বিয়ে কর, তারপর বুঝতে পারবি। বিয়ে ছাড়া বউয়ের মর্ম বোঝার মত মহাপুরুষ এখনও তুই হতে পারিস নাই।’
রোদ্দুরের কথা শেষ হতেই সে ফোন নামিয়ে রাখল। ঝিলমিল গালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তুই কি বিবাহ বিশারদ? সবাইকে যে জ্ঞান দিয়ে দিয়ে বেড়াচ্ছিস, নিজের জ্ঞান আছে তো? বউ আলোর জগত! বউয়ের মর্ম! বাহ কত কথা, তুই নিজে এসব বুঝিস?’
রোদ্দুর এক দৌড়ে ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এলো। ওর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে থুতনিতে হাত রেখে বলল, ‘বুঝি। তুই চাস তোকে বোঝাই? তাহলে সরাসরি বল। এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি দরকার?’
ঝিলমিল আপ্রাণ চেষ্টা করল রোদ্দুরের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর, কিন্তু পারল না। যত আলগা হতে নিচ্ছে ততই রোদ্দুর ওকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। ঝিলমিল বলল, ‘সুযোগ পেলেই এমন অভদ্রতামি করিস কেনো?’
রোদ্দুর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘কারণ আমি অভদ্র আর এই উপাধি তুই আমাকে দিয়েছিস।’
‘আচ্ছা তুই অনেক ভালো, এখন আমাকে ছেড়ে দে।’
‘জি না।’
রোদ্দুর এইবার একপাশে ঘুরিয়ে ঝিলমিলকে ওর সামনাসামনি দাঁড় করাল। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। ঝিলমিলের পক্ষে ওভাবে তাকানো অসম্ভব। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, বুকের মধ্যে স্বজোরে দুপ্পুরদাপ্পুর আওয়াজ হচ্ছে। রোদ্দুর ওর থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে মুখ উপরে তুলল। ঝিলমিল চোখ গরম করে তাকাল। রোদ্দুর চোখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘ওসবে কোনো লাভ হবে না।’
তবে মুখে একটা কথা জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি?’
‘হুমমম…. বল।’ নত মস্তকে বলল ঝিলমিল।
‘আগে আমার দিকে তাকা।’
‘এভাবেই বল, শুনছি আমি।’
‘উহুঁ।’
ঝিলমিল তাকাল। রোদ্দুর বলল, ‘সেদিন যখন আমার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আমার জন্য এত টেনশন কেনো করছিলি? উমমম… একদম চোখ নামাবি না। আমার চোখে চোখ রেখে উত্তর দে। আমি জানতে চাই। যে মানুষটাকে সহ্য করতে পারিস না, সে হারিয়ে গেলেই বা তোর কী?’
ঝিলমিল নিঃশ্বাস চেপে বলল, ‘আমি কখন বলেছি তোকে আমার সহ্য হয় না। আর…. আর….’
‘আর কী?’
ঝিলমিল কথা বলবে কি? রোদ্দুর বারবার তাকে অপ্রস্তুত করে দিচ্ছিল। যেই কথা মুখে আসে সে কথা ওভাবেই আবার ভেতরে চলে যায়। রোদ্দুরের জন্য কেনো এত চিন্তা হয়েছিল, সেটা তো ওইসময় ভেবে দেখে নাই! এখন ভাবতে গিয়ে গোলমাল পেকে যাচ্ছে।
ঝিলমিল উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘একজন মানুষ হিসেবে আমার সার্বিক দায়িত্ববোধ আছে না! যেহেতু একসাথে থাকি সেক্ষেত্রে আমার উচিত তোর খোঁজখবর রাখা এবং খোঁজখবর নেওয়া।’
রোদ্দুর হেসে বলল, ‘মনে হচ্ছে বইয়ের পড়া আমায় মুখস্থ শুনাচ্ছিস।’
‘এখন তোর দেরি হচ্ছে না? তখন তো আমার সাথে তাড়াহুড়ো করলি। আমি গিয়ে রেডি হই, আমার সময় লাগবে তো। এরপরে আর কখন যাব আমরা?’
রোদ্দুর ফের এক হাতের সাহায্যে ঝিলমিলের মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে এনে বলল, ‘প্রসঙ্গ ঘুরাস না। আমার প্রশ্নের উত্তর দে।’
ঠিক এই সময় ঝিলমিলের ফোনটা বেজে উঠল। ওরা দু’জন একইসাথে ফোনের দিকে তাকাল। রোদ্দুরের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। সে ঝিলমিলকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ফোনটা তোকে বাঁচিয়ে দিল, আজ ছেড়ে দিলাম।’
ঝিলমিল যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিক করল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল শিউলি ফোন করেছে। মনে মনে সহস্রাধিকবার ওকে ধন্যবাদ জানাল।
এরপর তো ঝিলমিলের রোদ্দুরের সাথে কথা বলতে, কোথায় যেতে অস্বস্তি হবে; তারচেয়েও বেশি লজ্জা করবে। আজকে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিল আর ভাবছিল। উফফফ, এই ছেলেটা মাঝেসাঝে এত পাগলামী করে না! ঝিলমিলের মেকআপের শেষ প্রলেপটা মুখে লাগাতেই রোদ্দুর ঘরে প্রবেশ করল। ওকে দেখে তৎক্ষণাৎ মাথা নামিয়ে অন্যকাজে হাত দিল অর্থাৎ কিছু করার নেই তাই জিনিসপত্রগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিল।
রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘শেষ?’
‘হুম।’
তারপর সে বলল, ‘তোকে ডায়নোসর শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে।’
ঝিলমিল হাসতে গিয়েও হাসি চেপে গেল। ও বোধহয় এই শাড়িকে সারাজীবন ডায়নোসর শাড়ি হিসেবেই উল্লেখ করে যাবে। ঝিলমিল এতক্ষণ রোদ্দুরের দিকে তাকায় নাই। তবে সে যখন গেট লক করছিল তখন একবার চোখ তুলে তাকিয়েছে। তাতেই বুকের মধ্যে হৃদপিন্ড ১০৪ ডিগ্রী এঙ্গেলে লম্ফঝম্প করা শুরু করে দিয়েছে। নতুন বউয়ের মত লজ্জা লাগছে। আশ্চর্য, চোখ দু’টোর কি সমস্যা হলো? ওর দিকে তাকাতে পারছে না কেনো!
বিয়ে বাড়িতে মোটামুটি সবাই ঝিলমিলের অচেনা। সে অবশ্য রোদ্দুরের সাথে সাথেই রয়েছে। মাঝেমধ্যে তার ডায়নোসর শাড়ি সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
রোদ্দুর ঝিলমিলকে বলল, ‘তুই একটু এখানে বোস, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
ঝিলমিল বসল না, আশেপাশে চক্কর দিল। কিছুদূর আগাতেই রোদ্দুরকে দেখতে পেল কার সাথে যেনো কথা বলছে। একটা মেয়ে, দু’জন কী হেসে হেসে কথা বলছে। ঝিলমিল চোখ ছোট ছোট করে ওখানেই দাঁড়িয়েই পড়ল।
আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওমা! ওর চেহারা কী গ্লো করছে। অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার কারণে চেহারা এত চকচক করছে। অথচ আমার সাথে যখন কথা বলে তখন মনে হয় ওকে কেউ জোর করে নিমপাতার রস খাইয়ে দিয়েছে। এসব দেখার জন্য আমি এখানে এসেছি নাকি? এসব তো সহ্য হচ্ছে না।’
পরক্ষণেই আবার নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘এসব কেনো তোর সহ্য হচ্ছে না। তুই তো রোদ্দুরকে ভালোবাসিস না যে অন্যকারো সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে তোর হিংসে হবে। বিয়ে হয়েছে বলে, নিয়ম রক্ষার্থে, থাকতে হবে বলে ওর সাথে থাকিস। কুল ডাউন, হিংসে হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওর জীবন আছে, ওটা ওর মত করে উপভোগ করতে দে।’
নিজের মনের এই কথাটা নিজের’ই মানতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। হঠাৎ মনে হলো, রোদ্দুরের জীবনে কোনো জায়গা নেই তার। যতই ভালোবাসা দেখাক না কেনো, সব সাময়িক। তাছাড়া একজনকে ভালোবেসে অন্যজনের সাথে হেসে কথা বলবে কেনো?
রোদ্দুর এসে দেখল ঝিলমিল খারাপ করে বসে আছে। রোদ্দুর বলল, ‘আয় তোকে ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।’
‘লাগবে না।’
‘কেনো? একা একা বসে থাকবি?’
‘হুমম…. একই ভালো।’
ঝিলমিলের উঠতে হলো না। যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিল রোদ্দুর সে নিজেই এগিয়ে এলো। ইনি হচ্ছে, রোদ্দুরের বন্ধু রায়হানের ওয়াইফ মোহনা। রোদ্দুর তার সাথে ঝিলমিলের পরিচয় করিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল। ঝিলমিলের সাথে অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার গল্প জমে গেল। পরবর্তীতে কথা বলার জন্য একে অপরের ফোন নম্বরটাও নিয়ে রাখল।
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সন্ধ্যা নাগাদ শেষ হয়ে গেল। ঝিলমিলকে একা রাখবে না বলেই রোদ্দুর আজ বন্ধুদের সঙ্গ দিতে পারছে না। তাই অনুষ্ঠান শেষ হতেই ঝিলমিলকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
পথিমধ্যে ওকে বলল, ‘কফি খাবি?’
‘খাওয়া যেতেই পারে।’
রোদ্দুর একটা কফিশপের সামনে বাইক পার্ক করল। ঝিলমিলকে নিয়ে ভেতরে যেতেই সানিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল। ও কফিশপ থেকে বের হচ্ছিল। সানিয়াকে দেখে ঝিলমিলের মুখে হাসি ফুটল আর রোদ্দুরের কপালে পরপর কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। সানিয়া ঝিলমিলছর আপাদমস্তক পরখ করে বলল, ‘ভালোই!’
ঝিলমিল হেসে বলল, ‘হুম.. ভালো তো হবেই। আপনার ভাইয়ার পছন্দে কেনা শাড়ি। ভালো না হয়ে যাবে কোথায় বলেন তো আপু?’
সানিয়া দাঁত কিড়মিড় করে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। বলল, ‘বিয়ে করে ফেলেছ। এত তাড়াতাড়ি আমাদের সম্পর্কের ইতি টানবে কখনও ভাবতেই পারি নাই। তাও কিনা বিয়ের খবরটা তোমার বউয়ের মুখ থেকে শুনতে হলো।’
রোদ্দুরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঝিলমিল নিজেই বলল, ‘ও আসলে অনেক লাজুক তো। কীভাবে নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখে বলবে? আমি তো ওর বউ, তাই আমিই বলে দিলাম। আপনাকে তো বলেছি, মন খারাপ করবেন না। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম দাওয়াত আপনিই পাবেন। আপনার কি খাবার পছন্দ বলেন তো? সেটাই মেনুতে রাখব।’
সানিয়া ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল। ঝিলমিল আফসোসের সুরে বলল, ‘ইশশ আমার না হওয়া সতীনটা!’
রোদ্দুর হেসে উঠল সাথে ঝিলমিল’ও। ওরা কফি খেয়ে দু’জন রাজ্যের গল্প করে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অবশ্য ভালোই রাত হয়েছে। কারণ ফেরার পথে জ্যামের মধ্যে প্রায় দেড় ঘন্টা আটকে ছিল। এমনিতেই আবহাওয়া ঠান্ডা কিন্তু এত গিজগিজ করা মানুষের মধ্যে গরমে ঝিলমিল প্রায় ঘেমে গিয়েছিল। বূলা বারোটা নাগাদ করা মেকআপ তখন উঠতে উঠতে প্রায় নাই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কফিশপে বসে সে আবার ফোনেয ক্যামেরা দেখে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে।
রোদ্দুর বারবার বলেছে, ‘এই জিনিসটা তো পেটেই চলে যাবে, আর দিস না। পরের জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখ।’
‘কেনো? শেষ হয়ে গেলে আবার কিনে দিবি।’
রোদ্দুর কানে ধরেছে, সে আর এসব কেনাকাটার মধ্যে নাই। জীবনে কোনোদিন এত শপিং করে নাই। শুধুমাত্র প্রথম যখন স্যালারি পেয়েছিল, তখন বাড়ির সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করেছিল তাও সেসব ছিল সহজ-সরল। ঝিলমিলের লিষ্টের মত ডাইনোসর না, রেভলন ফ্রস্ট’ও না।
বাড়ি ফিরে দেখল কারেন্ট নাই। এইদিকে জেনারেটর এর কী যেনো সমস্যা হয়েছে, তাই সেটাও অফ। এখন সাততলায় উঠতে হবে সিঁড়ি ভেঙে। রোদ্দুর তো এক লহমায় উঠে গেল। ঝিলমিল আর পারল না। এক কদম সামনে আগায় তো আরেক কদম থেমে যায়। একবার তো হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
অবশেষে দরজা পর্যন্ত আসতে পারল। হৃদপিন্ড এখনও ধুকপুক করছে। ঘরে গিয়ে সোজা ধপাস করে বসে পড়ল। রোদ্দুরকে বলল, ‘তুই এত নিষ্ঠুর! এভাবে আমাকে রেখে চলে এলি?’
‘তো তোকে কি আমি কোলে করে নিয়ে উঠতাম? তাহলেই তো ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বলতি, তুই এত অভদ্র কেনো!’
ঝিলমিল ওর হাতের ব্যাগটা তুলে রোদ্দুরের দিকে ছুঁড়ে ফেলল। রোদ্দুর সহসা তা ক্যাচ করল। ব্যাগ হাতড়ে সে লিপিষ্টিক টা বের করল। ঝিলমিল দেখে বলল, ‘এসব তোর ইউজ করার জিনিস না, রেখে দে।’
‘আরে দেখছি তো।’ তারপর উল্টেপাল্টে পুনরায় বলল, ‘এই জিনিস যে খাবারের সাথে পেটে যায়, পেট খারাপ হয় না?’
‘খেয়ে দেখ, হয় কিনা!’
‘স্বাদ কেমন?’
‘টেস্ট কর।’
রোদ্দুর ঝিলমিলের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘করব? সত্যি?’
‘হুম, করতে পারলে কর।’
রোদ্দুর ঝিলমিলের কাছাকাছি এগিয়ে এসে ফের জিজ্ঞেস করল, তারপর আবার…. আবারও। ঝিলমিল বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল। ঝিলমিল রোদ্দুরের উসখুস করা দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। সে তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে রোদ্দুর সামনে এসে ওর চুলগুলো মুঠোবন্দী করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘অসভ্য, অভদ্র কোথাকার! এত বাজে হয়ে গেছিস ছিঃ। তোর সাথে থাকাই তো রিস্ক।’
.
.
.
চলবে…..
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩৯]
~আফিয়া আফরিন
রোদ্দুরের ঝিলমিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল, ‘এভাবে তেড়ে এলি কেনো?’
‘তুই বলিস কেনো বাজে কথা? অসভ্য ছেলে কোথাকার!’
‘কিচ্ছু বলি নাই আমি। যেটা বলেছি সেটা দিনের আলোর মত ফকফকা, পরিষ্কার। তুই কিনা কি মাইন্ডে নিলি, ছিঃ। অভদ্রতামি আমার মধ্যে না, তোর মনের মধ্যে। ভালো হ, ভালো হ ঝিলমিল। ভালো হইতে পয়সা লাগে না। বাই দা ওয়ে, তুই কি ভেবেছিস বল তো?’ রোদ্দুর ঝিলমিলের দিকে তাকাল।
ঝিলমিল বিছানা থেকে বালিশ তুলে নিয়ে একেরপর এক রোদ্দুরের গায়ে ছুঁড়ে মারল। ইচ্ছেমত রাগে গজগজ করতে লাগল।
রোদ্দুর বলল, ‘ঠিক আছে, তুফান থামা প্লিজ। কিছু বলা লাগবে না তবুও আমার উপর এত অত্যাচার চালাস না। যা, গিয়ে ফ্রেশ হ। অন্ধকারের মধ্যে যে তান্ডব লীলা শুরু করেছিস, আলো জ্বললে কী করবি কে জানে?’
রোদ্দুর ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফ্রেশ হয়ে বসল। হাতমুখ ধুয়ে আসার পর মাইন্ড’ও ফ্রেশ লাগছে।
ঝিলমিল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রোদ্দুর চেঁচিয়ে বলল, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে ওখানে একা একা কি করিস? দরজা খুলে রেখেছিস কেনো? হু হু করে বাতাস ঢুকতেছে।’
‘তুই বাতাস খা। আমি তোর আশেপাশেও ঘেঁষব না। অভদ্র কোথাকার! মানুষ এত খারাপ হয়, জানা ছিল না।’
রোদ্দুর এসে ঝিলমিলের পাশে দাঁড়াতেই ঝিলমিল সরে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রোদ্দুর বলল, ‘পৃথিবীর সব মানুষ’ই এইরকম খারাপ।’
‘উহুঁ, মোটেও না।’
‘অবশ্যই, আমি তোকে বিষয়টা এক্সপ্লেইন করি ওয়েট…’
ঝিলমিল রোদ্দুরকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর কোনো এক্সপ্লেইন শুনতে চাই না। তোর কাছ থেকে বাঁচার জন্য এইখানে এসে দাঁড়িয়েছি। তুই’ও পিছু পিছু চলে এসেছিস! এত বউয়ের আঁচল ধরা স্বভাব ভালো না।’
‘জীবনের থেকে অর্ধেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর বউ পেলে যা হয় আর কী!’ রোদ্দুর হাসতে হাসতে বলল। তারপর পুনরায় বলল, ‘আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, পরে ঠান্ডা লাগবে। ঘরে আয়।’
রোদ্দুর চলে গেল। ঝিলমিল পিছু পিছু গিয়ে বারান্দায় দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফের দাঁড়াল। যতটা না রোদ্দুরকে এড়াতে চেয়েছে তার থেকেও বেশি চায় নিজেকে বুঝতে। নিজেকে নিয়ে সে ভীষণ সংকীর্ণ বোধ করছে। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে নিজের অনুভূতিকে খোঁজার চেষ্টা করল। ইদানিং কেমন কেমন যেনো লাগে! রোদ্দুরের খুব কাছে পাশে, হুটহাট হাত ধরা, ওর কথাবার্তা শুনলে মুখে যতই রাগ করুক না কেনো; মনের মধ্যে ভীষণ দুর্বলতা অনুভব করে। ঠান্ডা লাগছিল বলে ঝিলমিল ঘরে চলে এলো। এক পলকের জন্য বায়ে তাকাল দু’টো অন্তর্ভেদী শীতল দৃষ্টিতে। দেখতে লাগল ওই ঘুমন্ত মানুষটাকে। কী নিষ্পাপ চাহনি, একদম ছোট্ট বাচ্চাদের মত। কোথায় সেই ক্ষিপ্র চালনার দাপুটে স্বভাব, কোথায় বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার একাগ্রচিত্তের দুষ্টু স্বভাব? ঝিলমিল একদৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কেমন লজ্জায় গাল দুটো টাকা টমেটোর মত লাল টুকটুকে হয়ে এলো। আপনাআপনি দৃষ্টি নত হলো। সে এগিয়ে গিয়ে রোদ্দুরের গায়ে ভালো করে কম্বলটা দিয়ে নিজেও অপরপাশে শুয়ে পড়ল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে রোদ্দুরের একটা বিষয় নজরে এলো। একটা লোক ছোট চাচ্চুর খোঁজে আসত, রোদ্দুরের সাথে তার দেখা হয়েছিল তখন সে বলেছিল, কেউ একজন ছোট চাচ্চুর সাথে দেখা করতে চায়। রোদ্দুর লোকটার ফোন নম্বর, ঠিকানা রেখেছিল। ছোট চাচ্চুকে বলে নাই এই ভেবে যে, এমনিতেই তাদের শত্রুর শেষ নাই। এই লোক কে না কে, কী মতলবে এসেছে! উনি তো একটা লোকালয়ের ঠিকানা দিয়েছেন, রোদ্দুর সিদ্ধান্ত নিল আজ যাবে সেখানে। তবে ঝিলমিলকে এ কথা বলতেই সে’ও বায়না ধরল, তাকে নিয়ে যেতে হবে। অগত্যা বেলা বারোটার আগে আগেই রওনা দিতে হলো।
এটা একটা ছোটোখাটো গ্রাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা বেজে গেল। রোদ্দুর ওই লোকটাকে ফোন করেছিল, তিনি বলে দিলেন ঠিক কোথায় আসতে হবে।
সেখানে পৌঁছে ওরা অনেক মানুষজন দেখতে পেল। একটা বাড়ি, সেই বাড়িটাকে ঘিরে শুধু মানুষজনের আনাগোনা।
ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কি মানুষ মা’রা গেছে নাকি?’
‘তাইতো মনে হচ্ছে। ওয়েট, আমি ওই লোকটাকে একটা ফোন দিই।’ রোদ্দুর পকেট থেকে ফোন বের করতেই একটা মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো, ঠিক মেয়ে না মহিলা বলা চলে। ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি মনোয়ার ভাইয়ের বাড়ি থেকে এসেছেন?’
ঝিলমিল রোদ্দুরের দিকে তাকাল। রোদ্দুর উত্তর দিল, ‘জি।’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝতেই পারছেন এটা ম’রা বাড়ি। কতদিন আগে থেকে ভাইকে খবর পাঠানো হচ্ছে, অথচ এমন একটা দিনে তিনি আপনাদের পাঠালেন যে যে মূল ভূমিকায় ছিল উনি মা’রা গেলেন। যাইহোক, আসুন আমার সাথে।’
রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাব?’
তিনি হেসে বলল, ‘চিন্তার কারণ নেই। আপনারা জানতে চান না, কেনো আপনাদের ডাকা হয়েছে। আচ্ছা ভালো কথা, মনোয়ার ভাই আপনাদের কে হয়?’
‘আমাদের চাচ্চু।’ ঝিলমিল উত্তর দিল।
‘নিজের?’ উনি প্রশ্ন করল।
‘হুম।’
সে বলল, ‘আমাকে আধা ঘন্টা সময় দিন দয়া করে। আমি ভেতর থেকে একটু আসছি। আপনারা আমার সাথে আসুন।’
ঝিলমিল আর রোদ্দুর দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুগতে ভুগতে ওর পিছু পিছু গেল। তিনি একটা ছোট্ট ঘরে এনে ওদের বসাল। তারপর বলল, ‘আপনারা যাবেন না কিন্তু। একটু বসুন, আপনি আসছি।’
সে দ্রুত পায়ে চলে গেল। ঝিলমিল আর রোদ্দুর একে অপরের দিকে তাকাল। তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা! যিনি মা’রা গেছেন, তার সাথে ছোট চাচ্চুর কি সম্পর্ক? ওরা আর আবোল তাবোল ভাবনা ভেবে জল ঘোলা করতে চাইল না।
তিনি আধা ঘন্টার কথা বললেও, ১৫ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। ওদের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসল। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলেন, ‘আমার নাম শেফালী। যিনি মারা গেছেন তিনি আমার খুব কাছের একজন। সম্পর্কে খালাতো বোন, তবে নিজের না। উনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় ওনার ছেলেমেয়ে কেউ সাক্ষাৎ করতে আসে নাই। এই নিয়ে আফসোস ছিল। আপনারাই বলুন, একটা মানুষের তিনটে ছেলেমেয়ে অথচ কাউকে পাশে পেলেন না; আফসোস তো থাকবেই। জীবনে বহুত কষ্ট পেয়েছেন। প্রথম যেটা উনার সাথে খারাপ হলো, সেটা হচ্ছে ওনার বিয়েটা। আপনার চাচ্চুর সাথে ওনার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেসব বাড়িতে জানাজানি হওয়ার আগেই একরাতে তার বিয়ে হয়ে গেল। জোর করেই পরিবার থেকে বিয়ে দিয়েছে, প্রচুর কান্নাকাটি করেছে, বাঁধা দিয়েছে কিন্তু কাজ হয় নাই। সাধারণভাবেই মনোয়ার ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। লজ্জায় শেষ দেখাও করতে পারল না। আমাকে দিয়েই খবর পাঠিয়েছে। কাহিনী এখানে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হলো না। সুমি আপা নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করল। ওখানে সংসার শুরু করার পরেও মন পরে ছিল আরেক জায়গায়। স্বামীর বাড়িতে শান্তি পায় নাই। ওরাও প্রচুর অত্যাচারী ছিল। তাও দশটা বছর টিকে ছিল, এরইমধ্যে দুটো ছেলে একটা মেয়ে হয়েছিল। সুমি আপাকে যখন আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম তিনি তখন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। ওই বাড়ি থেকে বাচ্চাগুলোকে রেখে দিলেন। অর্থাৎ তাকে পাগল করে দেওয়ার জন্য তার শ্বশুরবাড়ির মানুষ সমস্ত ছক কষে রেখেছিলেন। দিনের পর দিন বাচ্চাগুলোকে না দেখতে পেয়ে কী একটা বাজে অবস্থা হয়ে গেল। মনোয়ার ভাইয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল, কিন্তু একা থাকার ফলে সেসব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার ধারণা, একজন মানুষকে ঠকানোর ফলে তার সাথে এসব হচ্ছে। নিশ্চয়ই মনোয়ার ভাই তাকে অ’ভিশা’প দিয়েছিলেন। এভাবেই দিন কাটছিল। সেই যে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লেন গতকাল তার সমাপ্তি ঘটল। অনেক কষ্টে আপনাদের ঠিকানা খুঁজে খবর পাঠিয়েছিলাম। অন্তত মৃ’ত্যুর আগে যদি শেষ দেখাটা করতে পারে। আপার ইচ্ছে ছিল, ক্ষমা চাইবে নিজের অপরাধের জন্য। কিন্তু সম্ভব হলো না, মানুষটা চলেই গেল। মানুষের যখন ভালোবাসা দরকার তখন ভালোবাসা পায় না, আর এখন সে চলে গেছে; ভালোবাসার দরকার নাই, সহমর্মিতার দরকার নেই তবুও মানুষ এসেছে একনজর দেখার জন্য। কান্নাকাটি করছে, তার সাথে কাটানো ভালো সময়গুলো মনে করছে, কী লাভ এসব করে? সময় থাকতে করে নাই, ফিরেও তাকায় নাই। মানুষের ধর্ম বুঝি এমনই! আচ্ছা, আপনাদের চাচ্চু কি এখনও আপর উপর রাগ করে আছে? উনি এলেন না যে?’
এতগুলো কথা বলে শেফালী নামের মহিলা রোদ্দুরের দিকে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে থামল।
ঝিলমিল আর রোদ্দুর এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এইবার নড়েচড়ে বসল। রোদ্দুর বলল, ‘উনি জানতেন না। যাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।’
ওরা ছোট চাচ্চুকে একটা অন্যরকম মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছিল। রোদ্দুর তার সাথে মিশেছে একদম বন্ধুর মত। কিন্তু কখনো মনের অন্দরে থাকা কথাগুলো তিনি কাউকে জানান নাই, ঘুণাক্ষরেও জানতে দেন নাই।
শেফালী নামের উনি হয়ত ভাবছিলেন, উনার কথা উপস্থিত ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। তিনি ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েই ঘর থেকে কিছু পুরোনো সাদাকালো ছবি, হাতে লেখা চিঠি নিয়ে এলেন।
ঝিলমিলের খুব বেশি খারাপ লাগল। একটা মানুষের হাতেগোনা কয়েক বছরের ছোট্ট জীবনে কত অজস্র দুঃখ থাকে। এই দুঃখগুলো চোখে দেখা যায় না, হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না, অনুভব’ও করা যায় না। ভীষণ ব্যক্তিগত এসব, নিজের ভেতর চেপে রাখতে রাখতে একসময় নিজের অনুভূতিই ভোঁতা হয়ে যায়, ম’রে যায়।
ঝিলমিল আর রোদ্দুর যেনো তার কথাগুলো অবিশ্বাস না করে এইজন্য তিনি বিভিন্ন প্রমাণপত্র দেখালেন। বলে দিলেন, ‘মনোয়ার ভাই যেনো কোনো দাবি না রাখে, কোনো অভিযোগ না রাখে। একটা মানুষ মা’রা গেছে, শেষ সময়ে ভীষণ আফসোস করেছিল, ওই সময়টাতেও কিছু করার ছিল না।’
কথাবার্তা শেষে ঝিলমিল আর রোদ্দুর উঠে গেল। এখানে এসে অনেক বড় একটা কাহিনী জানতে পেরেছে, যা জানার কথাই ছিল না তাদের। ফেরার পথে শেফালী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা মনোয়ার ভাই বিয়ে করেছিলেন তাইনা?’
ঝিলমিল বলল, ‘না। উনাকে একসময় বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চাচ্চু বলেছিল, বিয়েশাদী খুব প্যারার বিষয়। আর এসব প্যারা আমার ভালো লাগে না। তার অনিচ্ছাতেই বিয়ে হয় নাই।’
শেফালী বিষন্ন সুরে বলল, ‘ওহ।’
আহা, দু’জন মানুষের মধ্যে একসময় ভালোবাসা ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কাউকে কারো পাওয়া হলো না। একেকজন যোজন যোজন দূরে থেকে একে অপরকে মনে রেখেছে ঠিক। ভালোবাসা বোধহয় কিছু ক্ষেত্রে এমন’ই অদ্ভুত আর অবিনাশী। ঝিলমিল আর রোদ্দুর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওনার একটা কথা ঝিলমিলের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। ‘যখন মানুষের ভালোবাসার দরকার নাই, তখন ভালোবাসার অভাব হয় না। আর যখন দরকার তখন মানুষ ভালোবাসা পায় না।’
কথাটা তিনি ঠিকই বলেছেন। ওখান থেকে বের হওয়ার পর রোদ্দুরের’ও কেমন মুড অফ হয়ে গেছে, কথা বলে নাই। ঝিলমিলের’ও কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
সে ওই ভাবনায় মত্ত। ভালোবাসা হয়তো একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারছে। হৃদয়ের অনুভূতি, তার জন্য মনের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করা, কখনো কখনো দায়বদ্ধতা, আদর, মায়া, আবেদন, শ্রদ্ধাবোধ, শাসন, কৃতজ্ঞতা, মুগ্ধতা, সুখ-দুঃখ, একজনের প্রতি অপরজনের সম্মান— সবটাই তো ভালোবাসা। মনের মধ্যে বিষাদ ছুঁয়েছে আগেই তারপরও ঝিলমিলের মুখে বসন্তের ফুলের মত হাসি ফুটে উঠল।
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫৪০