#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪২]
~আফিয়া আফরিন
রোদ্দুর খুব মনোযোগ সহকারে চিরকুটে চোখ বোলাচ্ছে। তেমন কিছু নেই তবে ওর নাম লেখা কয়েকবার, তারপর কাটাকুটি করা। নিচের লাইনে আবার লিখেছে, রোদের মতোই তেজ দেখায়। আমার সাথে এত তেজ গিরি দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না।
রোদ্দুর কাগজটার এ’পাশ ও’পাশ উল্টে দেখল। পেছন দিকের কোণায় আবার লেখা রয়েছে, ‘কী করে যে বলব?’ তারপর কয়েকবার ওর নাম লেখা। ব্যস আর কিছু নাই।
রোদ্দুর ঝিলমিলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, ‘এসব কি? পড়াশোনা বাদ দিয়ে আবার নাম মুখস্থ করছিস নাকি?’
ঝিলমিল চমকে তাকাল। রোদ্দুরের তো এই প্রশ্ন করার কথা নয়। বোকার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে রোদ্দুর পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কিরে? এসব কি? মুখে কথা নাই কেনো?’
ঝিলমিল আন্দাজে বলল, ‘কই কি?’
রোদ্দুর চিরকুটটা ওর চোখের সামনে মেলে ধরল। ঝিলমিল যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এটা ওই চিরকুট না যেটার কথা সে ভাবছিল, এটা আলাদা, অন্য একটা। ঝিলমিল মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘ধুর এসব কিছু না। ক্লাসের মধ্যে তোকে ইচ্ছেমত থাবড়াতে ইচ্ছে করছিল। সেখানে তো আর তা সম্ভব নয়, তাই এইভাবেই মনের খায়েশ মিটিয়েছি।’
‘তোর প্রেমিকা ছিল না আশেপাশে? আমার বদলে উঠে দু’টো থাবড়া দিতি।’
কী এক প্রেমিকার জালে ফেঁসে গেছে। যত চায় এড়াতে, ততই জেঁকে বসে। ঝিলমিল রোদ্দুরের কথায় মনোযোগ না দিয়ে বইয়ের দিকে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ বাদেই বাড়ি থেকে তিন্নি ফোন করল। ওর সাথে ঘন্টাখানেক বকবক করল। বেচারার খুউব মন খারাপ। সে এমন একটা সময়ে ছাড়া পেয়েছে, যখন অন্য সবাই ব্যস্ত। কেউ নিজেদের সংসার রেখে তৎক্ষণাৎ আসতে পারছে না।তার বড় দুই বোন বাচ্চাকাচ্চার স্কুল আর পড়াশোনার জন্য আটকে গেছে। রোদশীর শাশুড়ি অসুস্থ, তাই সে কিছুদিন পর আসবে বলেছে। এইদিকে ঝিলমিল আর রোদ্দুর, দু’জন তো একসাথে ফেভিকলের মত আটকে আছে। তিন্নির সাথে কথা শেষ করে ঝিলমিল রোদ্দুরকে বলল, ‘তুই কি আর ছুটি পাবি না? চল না, আমরা এক সপ্তাহের জন্য ঘুরে আসি। আপু আর কয়দিন থাকবে? ওরে দেখি না কতদিন। প্লিজ, ছুটি নিয়ে নে।’
রোদ্দুর দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে রেখেই বলল, ‘হুম, অফিস তো তোর শ্বশুরের। দু’দিন পর তাই আমাকে ছুটি দিবে। আমি গিয়ে বলব, আব্বাজান আপনার একমাত্র বউমা আমাকে ছুটি দিতে বলেছে। দয়া করে যদি আমার ছুটি মঞ্জুর করতেন, তবে আপনার বউমা বাধ্য থাকত! কী তাই বলব গিয়ে?’ রোদ্দুর এইবার ঝিলমিলের দিকে তাকাল।
ঝিলমিল বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘তোর জন্য আমিও আটকে গেলাম। ধুর, ভালো লাগে না কিছু।’
ঝিলমিল মন খারাপ করে উঠে গিয়ে জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। রোদ্দুর ভাবল, কী করা যায়? বউয়ের এসব আবদার মেটাতে গেলে তো তাকে চাকরি-বাকরি ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে হবে। ভেবে ভেবে একটা উপায় অবশ্য বের করল। তবে তা বাস্তবায়ন করতেও দু’দিন সময় লাগবে। ঝিলমিলকে তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না, পরিকল্পনার পরিবর্তন’ও হতে পারে না। তখন তো আর ম্যাডামের চেহারার দিকে তাকানোই যাবে না, মুখটা একদম বাংলার পাঁচের মত করে রাখবে।
রোদ্দুর ঝিলমিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে উঁকি নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাউকে দেখছিস নাকি?’
‘না। কাকে দেখব আবার?’
‘দেখার মানুষের অভাব আছে? তোর গার্লফ্রেন্ড আবার তোর টানে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে কিনা কে জানে?’
রোদ্দুরের এসব বাঁকা কথায় ঝিলমিলের মাথা সবসময় গরম হয়ে যায়। তবে এখন সে হেসে ফেলল। শুধু চোখমুখ জুড়ে হাসি খেলে গেল, মুখে কিছু বলল না। রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘হাসছিস কেনো?’
‘তোর কথা শুনে।’
‘হাসির মতো কোনো কথা বলেছি আমি? যেটা সত্যি সেটাই বললাম।’
‘ওটা তো আমি আর আমার বান্ধবী মিলে দুষ্টুমি করছিলাম। বাড়িতে থাকতে শিউলিকে নিয়েও এইরকম দুষ্টুমি করেছি। সাইফুল ভাই আছে না? তাকে চিনিস?’
রোদ্দুর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম। তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো রাস্তায়। সম্ভবত তোকে পছন্দ করত।’
‘আরে ওসব কিছুই না। বাড়িতে একবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, এইটুকুই। ওরে যে কতবার আছাড় খাওয়ালাম! আরেকবার তো এমন ধাক্কা দিয়েছিলাম যে ঠান্ডায় পানিতে পড়ে কুপোকাত হয়েছিল। উনি বুঝত আমরা এসব করছি, কিন্তু কিছু বলত না।’
রোদ্দুর মুখ কালো করে উত্তর দিল, ‘তা বলবে কেন? বললে কি আর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারে? ভালো ভালো। এসবই হচ্ছিল। ঠিক আছে, যা ইচ্ছে হয় তাই কর। আমার কি? আমি কে? আমি কেনো এখানে আছি? তুই’ই বা আছিস কেনো? যা যা, তোর ওই পেয়ারের সাইফুল ভাইয়ের কাছে যা।’
ঝিলমিল কপাল চাপড়াল। একটু আগে পর্যন্ত ছিল প্রেমিকা এখন আবার সাইফুল ভাইকে নিয়ে পড়েছে। কোন দুঃখে যে এই ব্যাটাকে সাইফুল ভাইয়ের ইতিহাস শোনাতে গিয়েছিল কে জানে?
কিছুদিন পর্যন্ত রোদ্দুরের যেরকম পর পর একটা ব্যবহার ছিল, এখন আর সেটা নেই। আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। ওর ঠিক নাই, শুধু গিরগিটির মতো রূপ বদলায়। এইতো এখন আবার মুখ ফিরিয়েছে সাইফুল ভাইয়ের কথা শুনে। ঝিলমিল ছেড়ে দিল, একটু পর নিজেই আবার আসবে ভাব জমাতে।
.
মাঝখানে কিছুদিন ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। রোদ্দুরের কাজের ব্যস্ততা যেমন ছিল, তেমনি বাসা পরিবর্তনের ঝামেলাও ছিল। ঝিলমিল এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে কখনো পড়ে নাই তাই ওর কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিরক্তিকর কাজ হলো এই বাসাবাড়ি পরিবর্তন করা। দু’টো দিনেই অতীষ্ঠ হয়ে উঠল। নতুন বাসায় এসে কোথায় কি রেখেছে কিছুই মনে পড়ছে না, এত জিনিসপত্রের মধ্যে দরকারি জিনিস খুঁজেও পাচ্ছে না।
রোদ্দুর মনে মনে বলল, ‘এইবার মজা বুঝবা চান্দু। আমার সাধের বাসা আমাকে দিয়ে ছাড়িয়েছ না, করো করো এইবার সব নিজেই করো। যা ইচ্ছে হয়, যেভাবে ইচ্ছে হয়।’
বাড়তি এই কাজের জন্য রোদ্দুর সময় পাচ্ছে না একটুখানি সময় নিজেকে দেওয়ার জন্য। তাই আজ ঝিলমিলখে সব ঠিকঠাক করতে বলে, নিজে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে ভালো লাগছে, আলাদা রিফ্রেশমেন্ট। সে নিশ্চিত, ঝিলমিল পাঁচ মিনিট পার হতে না হতেই ফোন করা শুরু করে দিবে। রোজকার মত সেই একই কথা, কোথায় আছিস? কার সাথে? বাড়ি ফিরবি কখন? আমার একা একা ভালো লাগছে না। নতুন বাসাটা কেমন অদ্ভুতুড়ে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।
রোদ্দুর অবশ্য বিরক্তবোধ করে না। শুধু আগুনে ঘি ঢেলে ঝিলমিলকে রাগিয়ে দেয়। কাজের ব্যস্ততার জন্য সাইফুলের কথাটা ভুলে গিয়েছে, এই শান্তি।
ঝিলমিল অবশ্য আজ রোদ্দুরকে ফোন করল না। বাসায় কথা বলতে বলতে যতটুকু পারল গুছিয়ে রাখল। গত দুইদিন ধরে তো এসব’ই করছে, মাথা ধরে গেছে একদম।
বিছানায় বসতেই কলিংবেল বেজে উঠল, রোদ্দুর এসেছে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। রোদ্দুর দ্রুত গলায় বলল, ‘এখন সাতটা বাজে। দশ মিনিটের মধ্যে নিজে রেডি হয়ে কাপড়চোপড় রেডি করে ফেল। বাড়ি যাব।’
কী কারণ কিংবা বিস্তারিত কোনোকিছুই ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল না। বাড়ি যাওয়ার কথা শুনেই সে খুশি। একদম ১০ মিনিটে সবকিছু রেডি করে ফেলল। তারপর বেরিয়ে পড়ল।
পথিমধ্যে রোদ্দুরকে বলল, ‘আমরা যে বাড়ি যাব এটা কি কেউ জানে?’
‘তুই কি কাউকে জানিয়েছিস?’
ঝিলমিল মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। রোদ্দুর উত্তর দিল, ‘তাহলে কেউ জানে না।’
‘ভালো হয়েছে। আমাদের দু’জনকে দেখলে সবাই কতটা সারপ্রাইজড হয়ে যাবে একবার ভাব! আমার তো ভীষণ মজা লাগতেছে। তিন্নি আপু আছে, কাল নাকি আপুও আসবে। উফফফ, সবাই মিলে আবার কতদিন পর!’ উচ্ছাসিত ভঙ্গিতে বলল ঝিলমিল।
‘আসছে সেলিব্রেটি! কী এমন হয়ে গেছে যে ওনাকে পেলে সবাই লাফালাফি করবে। আমাকে দেখ। আমি আগে থেকে বাড়ি গেলেই সবাই আমাকে নিয়ে মাতামাতি করে। এইবার’ও তাই করবে, দেখে নিস।’
‘না আমি চোখ বন্ধ করে থাকব। মানুষের আলগা পিরিত দেখতে পারব না। আসলে তুই অনেকদিন পরপর যাস তো, তাই সবাই একটু দেখানোর জন্য তোর সাথে নাটক করে। আসলে তোর প্রতি মন থেকে কারো ভালোবাসা নেই। কী আর করবে? এখন একমাত্র ছেলে বলে তো ছেলেও দিতে পারে না, লোকে খারাপ বলবে না। তাই তোকে চুপচাপ সহ্য করে নেয়, মাঝে মাঝে ওই একটুআধটু ভালোবাসা দেখায়। আমি সব সময় সবার কাছাকাছি ছিলাম, তাই তোর থেকে আমার প্রতি ভালোবাসা এমনিতেও বেশি হবে ওমনিতেও বেশি হবে। আমার ওত লোক দেখানো ভালোবাসার শখ নাই।’ ঝিলমিল মুখ ঝামটে বলল।
রোদ্দুর ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। দুইজনের এই তর্কাতর্কির মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল। শীতের প্রকোপটা মোটামুটি কমে এসেছে, তবে এইখানে ভালোই ঠান্ডা। রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত চেপে ধরল। এখানে এলেই আগেরকার ভয়াবহ স্মৃতিটা মনে পড়ে। ঝিলমিলকে আর কোনোভাবেই হারাতে চায় না সে। আঁকাবাঁকা পথঘাট বেরিয়ে বাড়ি পৌঁছাল দু’জন। রাস্তা থেকেই উত্তরের বারান্দায় তিন্নিকে দেখতে পেল ঝিলমিল। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠল। ঝিলমিলকে দেখামাত্র তিন্নিও উচ্ছ্বাসে চেচিয়ে উঠল। আশেপাশের বাসার থেকে কয়েকজন উঁকিঝুঁকি মারল, কাহিনী কি দেখার জন্য। যখন দেখল এটা মসলা বিহীন সাধারণ একটা ঘটনা, তখন আবার নিজেদের বাড়ি চলে গেল।
তিন্নি নিচে নেমেই হুড়মুড় করে এসে ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ইশশশ, মেয়েটা একদম আগের মতই আছে। কতদিন পর দেখলাম, বল তো!’ তারপর রোদ্দুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আর তুই? তুই তো দেখি দিনকে দিন সুন্দর হচ্ছিস। বাব্বাহ, বিয়ের বাতাস ভালোই লেগেছে তোর গায়ে।’
রোদ্দুর হাসল, লাজুক হাসি। তৎক্ষণাৎ হাসিটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলে। এই বয়সে এইরকম লাজুক হাসি মানায় না।
ওরা ভেতরে যেতেই সকলে হৈ হৈ করে উঠল। রোদ্দুর মাত্র একটু শান্তিমত বসতে পারল। এই কয়েকদিনে তার উপর দিয়েও প্রচুর ধকল গেছে। সবার সাথে কথাবার্তা শেষে তিন্নি ওদের টেনে নিয়ে ছাদে এলো। রোদ্দুর বলল, ‘তোমরা যাও, আমি আব্বুর সাথে দেখা করে আসছি।’
ওরা সকলে একটা পাটি বিছিয়ে বসে পড়ল। চাঁদের আলো খুব প্রকোট নয়। রিমঝিম ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে কিছুটা দূরে রেখে দিল। তারপর এসে ঝিলমিলের পাশে বসল।
তিন্নি জিজ্ঞেস করল, ‘তো বল ঝিলমিল, ভাইয়াকে ছাইয়া বানিয়ে তোর কেমন অনুভূতি হচ্ছে? আমি যখন প্রথম তোদের বিয়ের খবরটা শুনলাম, আমার তো পুরো অ্যাডভেঞ্চারের মতো লেগেছিল। ভেবেছিলাম তোরা দুইটা হয়ত চুপিচুপি প্রেম করছিস। পরে রিমঝিমের থেকে জানতে পারি, একরকম জোর করেই তোদের বিয়ে হলো। এখন কি অবস্থা? সংসার জীবন কেমন লাগছে?’
ঝিলমিল একটু ভেবে বলল, ‘বুঝতে পারছি না। রোদ্দুর কেমন তা তো তোমরা ভালো করেই জানো।’
তিন্নি বলল, ‘রোদ্দুর আমাদের কাছে যেরকম, তোর কাছে তো আর সেইরকম না তাইনা? তোর কাছে তো নিজেকে আলাদাভাবেই প্রকাশ করবে।’
‘আমার কাছে তো আলাদা মনে হয় না।’ পরক্ষণেই গমগমে গলায় বলল, ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু আলাদা আছে বটে। মানে ভীষণ অভদ্র, ফাজলামি করতে করতে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়।’
তিন্নি মুখে এক গাল হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ওহ আচ্ছা। এখন তো টুকটাক দুষ্টুমি, অভদ্রতামি আর অসভ্যতামি হবেই। তুই আবার এইটাকে এত বড় করে দেখছিস? পাগলী মেয়ে…..’
বলতে বলতে রোদ্দুরের উপস্থিতি ঘটল। আড্ডা জমার সুযোগ মিলল না। নিচ থেকে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি শুরু করল। প্রথমবার ‘না’ করে দিয়েছিল, কিন্তু বড় চাচা যখন ডাকতে এলো তখন সুড়সুড় করে একেকজন নিচে নেমে গেল। অনেকদিন পর খাওয়ার সময় এত গল্পগুজব হলো। খাবে কি, এরা নিজেদের পেটের কথা বলেই কুল পাচ্ছে না।
সকলে হেসে বলাবলি করছে, ‘আমরা আজ নিজেদের কথা বলে পেট ফাঁকা করে নিই, তারপর না হয় খাবার খাব। এখন ভরা পেটে খেতে পারছি না তো।’ বলেই হো হো করে হাসি। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকদিন পর তানিশার মুখেও হাসি ফুটল।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতে হতে অনেক রাত হলো। যে যার মত নিজেদের ঘরে চলে এলো। ঘুমের সময় ঝিলমিলের সাথে রোদ্দুরের আর আলাদাভাবে কথা হলো না। দু’জন দু’দিক ফিরে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলা ঝিলমিলের ঘুম ভাঙ্গল, খুটখাট শব্দে। ঘুম ভেঙ্গে রোদ্দুরকে দেখতে পেল, সে রেডি হচ্ছে। ঝিলমিল ঘড়ির দিকে তাকাল, ভোর সাড়ে পাঁচটা। ভাবুক দৃষ্টিতে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। তার এইদিকে হুঁশ নেই। ঝিলমিল উঠে বসে বারুদের মত ঝলসে উঠা খিটখিটে সুরে বলল, ‘এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস?’
রোদ্দুর ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অফিস আছে না? এজন্যই তো রাতে এসেছিলাম, আর এখন ফিরছি।’
ঝিলমিল আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তুই যে চলে যাবি আমাকে তো আগে বলিস নাই। কয়েকটা দিন ছুটি নিয়ে আসতে পারলি না? একটুখানি সময়ের জন্য এসে কি হলো? তোকে এই সকালে কিছু যেতে দিবে ভেবেছিস?’
‘কাল রাতেই মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। কিছু করার নেই। তুই কিছুদিন থেকে যা। যখন যাওয়ার ইচ্ছে হবে তখন আমাকে ফোন করিস, আমি এসে নিয়ে যাব।’
‘মানে তোকে আমি অন্য কোন কারণে ফোন করতে পারব না আর?’ গলা উঁচু করে বলল ঝিলমিল।
রোদ্দুর ঘুরে তাকাল। ঠোঁটের আগায় মৃদু সজীব হাসি, চোখজুড়ে চকচকে দৃষ্টি। ঝিলমিলের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ নম্র কণ্ঠে বলল, ‘যখন ইচ্ছে তখন ফোন করিস। এখন আসছি। এখানে একটু ভালোভাবে চলাফেরা করিস, সাবধানে থাকিস। একা একা বাড়ির বাহিরে বের হওয়ার কোনো দরকার নেই। সবাই তো আছেই, সময় মন্দ কাটবে না।’
ঝিলমিলের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, ‘সময় মন্দ কাটা অথবা ভালো কাটা এত দূরেই থাক, তোকে ছাড়া সময় কাটবে কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ।’ কিন্তু বলা হলো না। রোদ্দুর বিদায় নিয়ে চলে গেল। ও চলে যাওয়াতে ঝিলমিলের এত খারাপ লাগল, যা বলার মত নয়। লম্বা একটা দূরত্ব হবে, রোদ্দুর সহজে এখানে আসবে না আর। যাওয়ার আগে কী সুন্দর আদুরে কণ্ঠে কতকগুলো উপদেশ দিয়ে গেল। সবসময় যদি এইরকম হাসিমুখে থাকে, এইরকম স্বচ্ছ আর টলটলে সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে যেকোনো মুহূর্তে ঝিলমিল ওর বুকের মধ্যে মথিত শ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে তার মনের কথাটা বলে আত্মসমর্পণ করে ফেলবে এক লহমায়।
.
.
.
চলবে…..
#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪৩]
~আফিয়া আফরিন
রোদ্দুরকে ছাড়া ঝিলমিলের সময় যতটা বোরিং কাটবে ভেবেছিল, ততটা বোরিং কাটছে না। আবার সবার সাথে থাকার ফলে যতটা ভালো কাটার কথা ছিল, ততটা ভালোও কাটছে না।
সকালের নাস্তা সেরে তিন্নি সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তানিশা কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না। বাইরে গেলেই লোকে নানারকম কথা বলে। আর কথা না বললেও ওদের তাকানোর ভঙ্গি ওর পছন্দ হয় না। তিন্নিকে এ কথা বলতেই সে ধমক দিয়ে বলল, ‘আমি থাকতে তুই ভয় পাচ্ছিস? আবারও বলছি, ওদেরকে বলতে দে। আমরা তো ওদের মুখ চেপে ধরতে পারব না। তুই যদি নিজের জায়গায় ঠিক থাকিস, তবে সারা দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেলেও কিছু যায় আসবে না।’
তানিশাকে ভরসা জোগাল সবাই। ওকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড় এসে বসল। এরইমধ্যে রোদশী ফোন করে জানাল, সে আর আধাঘণ্টা পর আসছে।
ওরা যখন ছোটো ছিল, তখন তো রোদ্দুর’ও ছিল সাথে। তবে তখন তানিশা ছিল না, সে একটু বেশিই ছোটো ছিল। এই নদীর পাড় ঘেঁষে বড় হওয়া। রোদ্দুর একমাত্র ভাই বলে সকলের’ই আদরের ছিল। ওদের সামনে রোদ্দুরকে কেউ ফুলের টোকাও দিতে পারত না। এইদিকে ঝিলমিল ছিল তার সমবয়সী প্রায়। সবসময় তক্কে তক্কে থাকত, কীভাবে রোদ্দুরকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেওয়া যায়। প্রথম যখন রোদ্দুর সাঁতার জানত না, তখন তো প্রায় জীবন যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। ঝিলমিলকে সেবার সকলে বকাবকি করেছিল। বিশেষ করে তিথি আপু, রোদ্দুর আবার তার ভীষণ আদরের; ছোটো থেকে বড় করেছে না!
তীরে বসে নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ডোবাতে ডোবাতে স্মৃতিচারণ করতে ভালো লাগছিল। হালকা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তিন্নি এসে বসল ঝিলমিলের কাছাকাছি। ওর বিয়ের পর তো এই প্রথম সরাসরি দেখা তাদের। এই সেই কাহিনীর জন্য কথা বলার সুযোগ’ই পাচ্ছে না। আজ সকাল সকাল অবশ্য বাড়ির সবার সাথে কথা হয়েছে, ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। রোদ্দুর আর ঝিলমিল রাজি থাকলে কারো দিক থেকে কোন সমস্যা হবে না।
তিন্নি তাই জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ রে, রোদ্দুর যে চলে গেল আবার কবে আসবে? আমরা সবাই আছি, ও ঝটপট চলে গেল কেনো? ব্যাটা দিনকে দিন কঞ্জুষ হয়ে যাচ্ছে। শালী বলে আমরা কি ট্রিট চেয়েছি? নাকি বলেছি, দুলাভাই আমাদের সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাও। ঝড়ের গতিতে এসে আবার ওভাবেই দৌড় দিল।’
‘আমিও জানতাম না, ও চলে যাবে। সকালে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি, সাহেব রেডি হচ্ছেন।’
‘তোর সাহেবকে বলে দিস, এসব করে লাভ হবে না। আমরা ট্রিট চাই। বিয়ের খাওয়াতে কোনো ছাড় দিব না।’
‘তোমরা বলো। আমার কথা কি শুনবে? আমি যা বলি তাই ধুর ছাই করে ফেলে দেয়।’ ঝিলমিল হাই তুলতে তুলতে বলল।
‘ওইটুকু না হলে ছেলে মানুষের ওয়েট থাকবে নাকি? সবসময় সব কথা মেনে নিলেও হয় না। মাঝেমধ্যে ফেলে দিতে হয়। যাইহোক, এখন বল নতুন পরিবেশ নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে পেরেছিস তো? রোদ্দুর কিন্তু ছেলে হিসেবে ভালো। ওর বিরুদ্ধে তুই কোনো অভিযোগ করতে পারবি না। জানিস’ই তো, আগে থেকেই ও কতটা দায়িত্ববান। অন্ততপক্ষে নিজের কথা ভেবে হলেও সে তার দায়িত্ব পালন করবে।…..’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল প্রশংসা। রোদ্দুর এই করেছে, রোদ্দুর সেই করেছে, কত কথা! অথচ ঝিলমিলের ভাষ্যমতে, সে একটা শিষ্টাচার বিহীন মানুষ। কথায় কথায় নিজে কাছে চলে আসবে নয়তো ঝিলমিলকে টেনে নিয়ে আসবে। এটুকু বোঝে না যে, এতে তার হার্টবিট কি পরিমাণ বেড়ে যায়।
তিন্নি আপুকে থামানোর জন্য ঝিলমিল বলল, ‘না না আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রোদ্দুর সবদিক খেয়াল রাখে, সামলে রাখে। ও আসলেই দায়িত্ববান, নিষ্ঠাবান, সৎ।’
তিন্নি সুন্দর করে হাসল। রোদশী বাড়ি পৌঁছে তিন্নির কাজে ফোন করতেই ওরা তড়িঘড়ি করে ছুটল। বাড়ি ঢুকতেই ঝিলমিলের ফোন বেজে উঠল। সে দেখল, রোদ্দুর ফোন করেছে। রোদশীর সাথে কোনোরকম প্রাথমিক আলাপ সেরে ছাদে উঠল। ফোন রিসিভ করতেই রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘কি খবর? কি করিস?’
ঝিলমিল সহজ গলায় উত্তর দিল, ‘কি আর করব? আপু এসেছে। ওদের সাথেই আছি। তুই কোথায় এখন? বাড়িতে?’
‘বাড়িতে বসে থাকার জন্য নিশ্চয়ই আমি অতদূর থেকে সকাল সকাল এখানে আসি নাই।’ রোদ্দুর কাঠকাঠ কণ্ঠে জবাব দিল।
ঝিলমিল মাথা চুলকে বলল, ‘ও হ্যাঁ তাইতো।’ আর বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না। নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হচ্ছিল। রোদ্দুর’ও ওপাশ থেকে কিছু বলছে না। চুপ করে থাকার জন্য ফোন করেছে নাকি? আজব।
ঝিলমিল বলল, ‘কি করছিস?’
‘অফিসে আছি, এখানে তো আর রান্নাবান্না করতে আসি নাই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চেক করছি।’
ঝিলমিল থতমত খেয়ে গেল। ছোট্ট করে বলল, ‘ওহ আচ্ছা।’
‘বাকিদের কি খবর? আসার সময় তো সবার সাথে দেখাও করে আসতে পারলাম না।’
ঝিলমিল জবাব দিল না। কী বোরিং বোরিং প্রশ্ন করছে। এসব শুনে সে কি করবে? কারো খোঁজ নেওয়ার থাকলে সরাসরি তার কাছে ফোন দিলেই হয়। ঝিলমিলের কাছে ফোন করে কেনো অন্যদের খোঁজ করতে হবে।
ঝিলমিল রেগে গেলেও শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আর কিছু বলবি? আমার অনেক কাজ আছে। ফালতু বকবক করার মত সময় নাই। ওদের সাথে দেখা না করে গেলেও কিছু হবে না। ওরা তোকে মিস করছে না। রাখছি।’
এই বলে ঝিলমিল ফোন রেখে দিল। ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে নিচে নামল। তানিশা ঝিলমিলের খোঁজ করছিল। দেখল, সামনে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছে নিজের ঘরে। তানিশা পিছু ডেকেও ওর সাড়াশব্দ পেল না। তারপর দরজার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করল। ‘আপু, আপু’ বলে সম্বোধন’ও করল কয়েকবার। ঝিলমিল ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমাকে একদম ডাকাডাকি করবি না। তোদের যা মন চায়, তাই কর। আমার ভালো লাগছে না এখন।’
তানিশা ঠোঁট উল্টিয়ে ভাবল, এর আবার কি হলো? একটু আগেই তো ঠিক ছিল, আমাদের সাথেই তো ছিল।
ঝিলমিল আর ঘর থেকেই বের হলো না। সবাই এসে ডাকাডাকি করে হতাশ হয়ে চলে গেল। মূলত মেজাজ খারাপ হয়েছিল রোদ্দুরের উপর। তারপর আর একবার ফোন’ও করল না। ঘরে বসে থেকেও ভালো লাগছে না। ওরা ডেকেছিল, অযথা জেদ করে গেল না। এখান গেলে আবার একেকজন মুখ ফিরিয়ে নিবে। ঝিলমিল সিদ্ধান্ত নিল, আবার যদি কেউ ডাকতে আসে তবে সে একটু বিরক্তবোধ করেই ঘর ছেড়ে বের হবে। মুখে বিরক্তির ছাপ থাকলেও মনে মনে খুশি’ই হবে। কিন্তু আর কেউ তাকে ডাকতে এলো না। ঘরজুড়ে পায়চারি করছে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে, ফেসবুকিং করছে কিন্তু সময় কাটছে না কিছুতেই। সব হয়েছে এই রোদ্দুরের জন্য। ও তখন ফোন না করলে এখন ঝিলমিলের মুড খারাপ হত না আর সে রাগ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকত না।
ঝিলমিল দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে সরাসরি দাদির ঘরে ঢুকে পড়ল। তিনি শুয়ে ছিলেন। ঝিলমিলের উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে বসলেন। ঝিলমিল দাদির পাশে বসল। দাদি বললেন, ‘কিরে তোর নাকি মনখারাপ শুনলাম? কি হয়েছে? সবাই ছাদে আর তুই ঘরে গিয়ে বসে কেনো?’
‘এমনিই আমার ভালো লাগছে না।’
দাদি হেসে বললেন, ‘বুঝি বুঝি। দাদুভাই চলে গেছে বলে ভালো লাগছে না তাই তো!’
ঝিলমিল মাথা নিচু করে বলল, ‘তুমি তো ঠিকই বুঝেছ, তোমার দাদুভাই তো বোঝে না।’
‘ওরে পাগলি, না বললে বুঝবে কীভাবে? ফোন করেছিস, কথা বলেছিস? খোঁজখবর নে, তাহলে তো বুঝবে তোর মনের খবর।’
‘ফোন দিয়েছিলাম তো, কিন্তু আমার খোঁজ নিবে কি? সে অন্যদের খোঁজ নিয়েই হুঁশ পাচ্ছে না। আমার খুব বিরক্ত লাগে। এটা কার সাথে বিয়ে দিলে বলো তো?’
দাদি হাসলেন। খাটের পাশে ছোট টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলেন। তারপর বললেন, ‘সংসার ধর্মটা বড্ড আজব, বুঝলি। মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয় সবকিছুর সাথে। আর মেয়ে মানুষের জীবন তো ভাই বড় আশ্চর্যের। এইযে সময় দিতে পারল না আর তুই’ও সেটা মেনে নিতে পারছিস না। এক পক্ষকে একটু ত্যাগতিতিক্ষা করতে হয়। আজ তুই ছাড় দিলি কাল দাদুভাই দিবে। দু’জন এক বন্ধনে বাঁধা পড়েছিস, এই বন্ধন টিকিয়ে রাখতে হবে রে পাগলি।’
ঝিলমিল দাদির কথার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে। তিনি পুনরায় বলতে শুরু করলেন, ‘ওই যে তোরা কী যেনো বলিস না? ও হ্যাঁ, ইগো। সম্পর্কের মধ্যে এই জিনিসটা রাখতে নেই। এই ছোট্ট শব্দটা অশনী ঝড়ের মতো সবকিছু তছনছ করার জন্য সর্বদা তীব্র দাপটে মুখিয়ে থাকে। সেটা বোঝার বা দেখার মতো দিব্যজ্ঞান এখনো তোদের হয় নাই। তোর এখনও কিশোরী চপল মন। অস্বাভাবিকভাবে অস্থির হয়ে থাকবে, এটা তো স্বাভাবিক। তুই কথায় কথায় বেচুইন অনুভব করবি, পাগলামি করবি।’ দাদির কথা শুনে ঝিলমিল অতল ভাবনায় ডুবে গিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়াতে লাগল। চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়েছে সে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রবলভাবে জানান দিচ্ছে, এক্ষুনি এবং এই মুহূর্তে তার রোদ্দুরকে ফোন করা উচিত।
‘যা গিয়ে তোর সোয়ামির সাথে কথা বলে আয়, তাহলে মনটা ভালো লাগবে।’ চট করে দাদির কন্ঠে সংবিৎ ফিরে ফিরে পেতেই ঝোড়োগতিতে উঠে দাঁড়াল। দাদির মুখপানে চেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি আসছি।’
ওই ঘর ছেড়ে বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরে আসার সময় হঠাৎ হাতের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ঝলঝল করে রোদ্দুরের নামটা ভাসতে দেখে মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ ফোন রিসিভ করল। লজ্জিত, অপ্রস্তুত এবং উৎকণ্ঠিত মনটা খোলসে ঢেকে বলল, ‘হুঁ?’
রোদ্দুর ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কি মনখারাপ নাকি?’
‘না তো। কে বলল?’
‘বলবে আর কে? আমাকে তো রীতিমতো রাগারাগী করা হচ্ছে। ওরা তো অলরেডি চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছে। তুই কি এখনও ঘরের মধ্যে?’
‘না। কে কি বলেছে?’
‘তিন্নি আপু ফোন করেছিল। আমাকে বলছে, আমি নাকি তোর সাথে ঝগড়া করে তোর মন খারাপ করে দিছি। এখন তুই রাগ করে ঘরের মধ্যে গিয়ে বসে আছিস। আমি ভাবতেছি, আমি আবার তোকে কি বললাম? আচ্ছা, তুই কি আমার উপর রাগ করে আছিস?’ রোদ্দুর খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল।
ঝিলমিল হেসে বলল, ‘না। একদম না।’
‘তাহলে ওদের ওখানে যা। একা একা ঘরে বসে থাকতে চাইলে আমার সাথেই চলে আসতি। এখানে তো সবসময় একাই থাকিস, ওখানে এখন সবার সাথে আনন্দ ফুর্তি কর।’
সে ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু ওখানে সারাদিন একা একা থাকার পরেও দিনশেষে শান্তি পাওয়া যায়। রোদ্দুরের সাথে সামনাসামনি কথা বলা, ওকে দেখা কিংবা ওর সাথে ঝগড়া করা— রীতিমত ঝিলমিলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে; ছেড়ে থাকতেই ইচ্ছে করে না।
দু’জনের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ করা হলো। রোদ্দুর বলল, সে এখন একটু বের হবে। রাতে ফোন দিয়ে কথা বলবে।
ঝিলমিল ফোন রেখে খুশিমনে সামনের দিকে হাঁটা দিল। মনের মধ্যে যে মেঘের ঘনঘটা ছিল, তা এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। নাহ, আর একপক্ষীয় ইগো রাখা যাবে না। তাহলে মনের মধ্যে শুধু অশান্তি লাগে, মাথা ভার হয়ে থাকে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, সবকিছু বিরক্তিকর ব্যাপার মনে হয়।
ঝিলমিল ছাদে এসে দেখল, কোনোরকম সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ওরা পাটি বিছিয়ে বসে কী কী যেনো খেলছে। ঝিলমিল’ও যোগ দিল। ওকে আর কেউ কিছু বলল না।
ঝিলমিলের একটা ভালো স্বভাব হচ্ছে, সে খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। এতক্ষণ মনমালিন্য চলছিল, ওকে দেখে বোঝাই গেল না। ওদের মধ্যে সেই সবথেকে বেশি মজা করল। হাসিঠাট্টা সবকিছুতে ঝিলমিল এগিয়ে গেল। কে বলবে, এই মেয়ে একটু আগে রাগ করে ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে ছিল!
তিন্নি অবশ্য হেসে বলল, ‘ঝিলমিল, আমি তো তোকে দেখে অবাক হচ্ছি রে। নিশ্চয়ই রোদ্দুরের মাথা খেয়ে এসেছিস। তাই এত খুশি খুশি লাগছে।’
ঝিলমিল হেসে মাথা নাড়াল। ওর সাথে সাথে সবাই হেসে উঠল। ওরা অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে আড্ডা দিল। রোদ্দুর এরমধ্যে একবার ফোন করেছিল। যখন শুনেছে ঝিলমিল এখনও ওখানে আছে তখন বলেছে, ‘আচ্ছা, ঘরে গেলে তুই ফোন দিস।’
তো ঘরে যেতে যেতে প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। ঝিলমিল রোদ্দুরের ঘরেই এলো, এ ঘরে এলে ওর গায়ের সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইতস্তত বোধ করল। রোদ্দুর কি এখনও জেগে আছে? কাল তো অফিস, নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ফোন করতে বলেছিল তো। ফোন না করলেও খারাপ দেখায়!
নিচের ঠোঁটটা দাঁতের কামড়ে চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে রোদ্দুরের নম্বরে ডায়াল করল। তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দিয়ে রোদ্দুর ব্যাক করল। জোরসে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গল্পগুজব এত তাড়াতাড়ি শেষ তোদের?’
ঝিলমিল বলল, ‘অনেকটা দেরি হয়ে গেল। ভাবলাম, আবার ঘুমিয়ে পড়েছিস কিনা!’
‘ঘুম আসছিল না।’
‘কেনো? রাত তো অনেক হয়েছে।’
‘ওই আর কী! তোর ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়তে পারিস।’
এই উত্তরে কি বলতে হয়, ঝিলমিলের জানা নেই। সে ক্ষণে ক্ষণে অপ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। রোদ্দুরের সাথে কোনোরকম কথা শেষ করে মনে হলো, তাকে একটা কথা বলা হয় নাই অথচ ওই কথাটা বলা উচিত ছিল। পরক্ষণেই মনে হলো ভালোবাসা একটা গভীর বিষয়, এটা মুখে বলা যায় না; অন্তত তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারচেয়ে লিখে দেওয়া যায়, রোদ্দুর বরং সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে। ঝিলমিল বারবার মেসেজ লিখছে আর কেটে দিচ্ছে। কথা সাজাতে পারছে না। শেষে লিখে দিল, ‘আই লাভ ইউ!’ আবার ইংরেজিতে ভালো লাগছিল না বলে বাংলায় লিখল, ‘ভালোবাসি!’ তবুও পাঠাতে পারল না, কেটে দিল। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবল, থাক সকালে পাঠাব। তারপর সে শুয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙ্গল সকাল সকাল। ফ্রেশ হয়ে এসে ফোন হাতে নিতেই রোদ্দুরের একটা মেসেজ চোখে পড়ল। ওপেন করে দেখল সেখানে লেখা আছে, ‘তোকে ছাড়া ভালো লাগবে না জানলে আমি এখানে আসতাম না। কেমন জেনো সব ফাঁকা ফাঁকা, খালি খালি। তুই ছাড়া আমার জীবনটা যে ধূ ধূ মরুভূমি তা ভালো করেই বুঝতে পারছি। ভালোবাসার কথা তো আগেই বলেছি, তোর বোঝার অপেক্ষা শুধুমাত্র। কবে বুঝবি, কবে উপলব্ধি করবি জানিনা। বলেছিলাম, অপেক্ষা করব; তাই করছি। আই সে এগেইন “ভালোবাসি”।’
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৯৫০