ঝিলমিল রোদ্দুরে পর্ব-৪৪+৪৫

0
322

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪৪ ও ৪৫]
~আফিয়া আফরিন

খানিক লজ্জায় ঝিলমিলের চোয়াল জুড়ে লালচে আভাস দেখা গেল। বড়দের কাছে শুনেছিল, একজনের সাথে আরেকজনের কথা বা কাজ হুটহাট মিলে যাওয়া মানে তাদের মনের মিল রয়েছে।
ঝিলমিলের চোখেমুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠল। গতকাল রাতেও রোদ্দুরকে ফোন করতে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে রোদ্দুর তাকে ফোন করেছে। আর যখন ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছে, তখন ওপাশ থেকেও সে ভালোবাসার কথা বলে দিয়েছে।
ঝিলমিল কাঁপা কাঁপা হাতে রিপ্লাই দিল, ‘অপেক্ষা করতে হবে না। তুই বাড়ি চলে আয়।’
রোদ্দুর বোধহয় ওর মেসেজের অপেক্ষায় ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল। তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিল, ‘বাড়ি চলে এলে কি কাঙ্খিত জিনিস পাব?’

‘সেটা তো সময় বলবে, তুই চলে আয়।’

‘আমি চেষ্টা করব।’
ঝিলমিল আর কোনোকিছু বলল না। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করল। তারপর উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে অনেকক্ষন পর্যন্ত আয়নায় নিজেকে দেখল। নিজের ভেতর অদ্ভুতরকম আনন্দ অনুভূতি হচ্ছে। হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে, কলিজা ধুকপুক করছে; উফফফ বলে বোঝানো যাবে না এই অনুভূতি। আনন্দে ভেসে গিয়ে ঘরের মধ্যে দু’লাইন গান গেয়ে চারিপাশ ঘুরতে ঘুরতে একধাপ নাচ শেষ করল। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে মানুষের যে অবস্থা হয়, ওর ঠিক সেই অবস্থা হয়েছে। অবশ্য সে নিজেও তো নতুন করে প্রেমে পড়েছে। একটা ঝগড়াটে মানুষের কাজের, বাচনভঙ্গির, ব্যক্তিত্বের, ভালোবাসার, ভালোলাগার, অসভ্যতার, অভদ্রতার আর গম্ভীর চাহনির। ঝিলমিল চোখ বুজল। দীর্ঘদিন পর তার কল্পনায় সেই কল্পমানব ভেসে উঠল রোদ্দুর হয়ে। মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকে ঝিলমিল। যান্ত্রিক ফোনে রোদ্দুরের কাছ থেকে পৌঁছানো শব্দগুলো হৃদমঞ্জিল ছুঁয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে হস্তক্ষেপ করছে। বুকের মধ্যে মহামূল্যবান রত্নের মত সাজিয়ে রেখে দিল কথাগুলো। নিজের মনের কথা তাকে জানিয়ে দিল শব্দহীন খামে ভরে। সে মানুষটা আসুক, শব্দহীন সে খামে বহুত শব্দের উদ্ভাবন ঘটাক।

ঝিলমিল মাত্রাতিরিক্ত খুশি ছিল। তবে এ আনন্দটুকু বেশিক্ষণ রইল না। নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নাস্তা করে সকলের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিল। পরিকল্পনা করেছে পুরো শহর ঘুরে দেখবে আজ ওরা। বড় চাচা অবশ্য আজকের জন্য বাড়ির গাড়িটা ব্যবহার করতে বলেছেন। প্রথমে শপিংয়ে, তারপর পার্কে, দুপুরে বাহিরে খাওয়া-দাওয়া করে এরপর গেল সিনেমা হলে। সেখান থেকে বের হলো সন্ধ্যার খানিকটা আগে। বাড়ির কাছাকাছি এসে মনে পড়ল তারা ফুচকা খেতে ভুলে গিয়েছে। তাই তড়িঘড়ি করে আবার ছুটল ফুচকার দোকানে।
পথিমধ্যে রোদশী বলল, ‘ভাই, কী মিস করতে যাচ্ছিলাম আমরা। সবাই মিলে একসাথে বের হয়েছি, আর ফুচকা না খেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। এটা মনে হয় আমাদের সাথে এই প্রথম ঘটল তাই না?’

ঝিলমিল মনে করিয়ে দিল, ‘আমরা তো আইসক্রিম’ও খাই নাই।’
আইসক্রিমের কথা শুনে তানিশা আর রিমঝিম হৈ হৈ করে উঠল।
ফুচকার দোকানে এসে ঝিলমিলের মনে পড়ল, আরও আগে মানে গতবছর এখানে একটা ছেলের সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিল। তানিশাকে ফিসফিস করে বলল, ‘মনে আছে ওই ছেলেটার কথা যে আমাদের পিছু নিয়ে প্রায় বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল?’

তানিশা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম হুম… মনে থাকবে না আবার। কী যন্ত্রনা করেছিল! প্রথমে এলো, আমাদের সাথে ভদ্র মানুষের মত কথাবার্তা বলল.. ওমা, তারপর দেখি ফোন নম্বর চায় তাও বাবা-মায়ের। এরপর হোয়াটসঅ্যাপ, এই সেই কতকিছু।’
ওদের দু’জনকে ফিসফিস করতে দেখে বাকিরাও এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাদের রেখে তোরা কি বিড়বিড় শুরু করেছিস? আমাদের’ও বল, আমরাও একটু হাসাহাসি করি।’
ঝিলমিল তখন ওদেরকেও বলল। রোদশী হেসে বলল, ‘বিয়ের আগে এসব কত হয়েছে। যখন কলেজে গেছি, ভার্সিটিতে গিয়েছি; অহরহ এসবের সম্মুখীন হয়েছি। এখন স্বামী ছাড়া কেউ দেখি ফিরেও তাকায় না। সবাই কেমনে বুঝে যায় যে, আমরা বিবাহিত?’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রোদশী সকলের দিকে তাকাল। তিন্নি এক মুহুর্ত ভাবনাচিন্তা করে বলল, ‘আরে ওরা সবক্ষেত্রে বোঝে না। আর সবাই তো পিছে পিছে ঘোরে না। যারা সবসময় অন্যের পিছনে ঘুরঘুর করে, ওরা বুঝেই যায় কাকে পটানো সম্ভব আর কাকে সম্ভব নয়! ধুর বাদ দে এসব। তোদের খাওয়া শেষ না? বাড়ি যেতে হবে। আম্মাজান অলরেডি একবার ফোন করে ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে।’
ফুচকা খাওয়া শেষে আইসক্রিম হাতে নিয়ে সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল বাড়ির মূলফটকে। ঝিলমিলের মনে যে আনন্দের ধারা বইছে সেটা তার চোখে এমন এক পট্টি বেঁধে দিল যে পথঘাট কিছুই চোখে দেখল না। প্রবেশমুখে দরজার সাথে ওড়না আটকে গেল, ঝিলমিল খেয়াল করল না। এগিয়ে যেতে হঠাৎ টান পড়ল। পেছন ফিরে বিরক্তি প্রকাশ করে জোরসে ওড়না টান দিতে গেলে সে নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পাথর, ইট বিছানো পথ, বেশ ভালো রকম ব্যথা পেল। তিন্নি এগিয়ে এসে ওকে টেনে তুলল। বলল, ‘তুই কি কখনোই একটু দেখেশুনে চলাফেরা করতে শিখবি না? দেখছিস তো এই রাস্তাটা মেরামত করা হচ্ছে, তবুও ছোটাছুটি করছিস কেনো? ব্যথা বেশি পেয়েছিস?’
পরক্ষণেই সে খেয়াল করল ঝিলমিলের কপালের দিকে খানিকটা কেটে গেছে। তিন্নি ঝটপট ওকে ঘরে নিয়ে গেল। কপালের ক্ষতস্থান দ্রুত ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিল। হাতে পায়েও সামান্য কেটে গেছে। তিন্নি‌ সেসব’ও ড্রেসিং করে দিল। আবার রাগে গজগজ করতে লাগল এইসব আকাম করার জন্য। ঝিলমিল চুপ করে আছে। এই মুহূর্তে তার কথা বলা মানে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া।
তিন্নি চলে যাচ্ছিল। ওই সময় রোদ্দুরের ফোন এলো। সে দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল, ‘কে ফোন করেছে? রোদ্দুর? তাহলে আমাকে দে আমি কথা বলি। তোর নামে একটু বিচার দিই। তোকে শাসন না করলে একদম হবে না। তুই খুব ফাজিল হয়ে গেছিস। দু’দিন পর বাচ্চাকাচ্চা হলে ওদের নিয়ে এইরকম করবি নাকি? তাহলে তো আমার ভাইয়ের জন্য রিস্ক বেচারা বউ সামলাবে নাকি বাচ্চাকাচ্চা? দে ফোন দে, আমি কথা বলব।’

ঝিলমিল অনুরোধ করে বলল, ‘না বলো না প্লিজ। অযথা আমার বকা খেতে হবে। এমনিতেই কথা বলো, কিন্তু আমার কথা কিছু বলতে হবে না।’
তিন্নি সরু চোখে তাকিয়ে ফোন নিল। রিসিভ করে রোদ্দুরের সাথে কিছুক্ষণ বকবক করল। অবশ্য কথা শেষ করল এই বলে যে, ‘তোর বউকে সামলে রাখিস। যেভাবে ছোটাছুটি করে একদম নাগালের বাইরে চলে যায়‌। দিন যত যাচ্ছে ও মনে হয় ততই ছোটো হচ্ছে।’
তারপর ঝিলমিলকে কথা বলতে বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল রোদ্দুরের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলল না। দু’টো কথা বলে ফোন রেখে দিল। কপাল জুড়ে চিনচিনে ব্যথা। বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঁজতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন নিজেকে একটা ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করল। মাথাব্যথা— মাথার মধ্যে মনে হয় কেউ সুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছে। চোখ মেলে ভালো করে তাকাতে পারছিল না। সে সময় ঝিলমিলকে খাওয়ার জন্য ডাকতে শিমু ঘরে এলেন। অসময় মেয়েকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে কি হয়েছে?’ বলতে বলতে তিনি ঝিলমিলের কপালে হাত রেখে চমকে উঠলেন।
আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।’ ঝিলমিল রা করল না। সেই শক্তিটুকু তার শরীরে নেই। শিমু দ্রুত উঠে জলপট্টির ব্যবস্থা করলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ভীষণ যত্নে মেয়ের কপালে একটা রুমাল ভিজিয়ে দিয়ে রাখলেন। অনেকক্ষণ বাদে তাপমাত্রা যখন একটু নিয়ন্ত্রণে এলো তখন শিমু উঠে অল্প একটু খাবার নিয়ে এলেন। ঝিলমিল তো খাবেই না। জোরাজুরি করে তিনি খুব সামান্যই খাওয়াতে পারলেন। তারপর একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে শুয়ে দিলেন। তিনি যাওয়ার সময় ঝিলমিল মায়ের আঁচল টেনে ধরে বলল, ‘আজ এখানেই থাকো, আমার কাছে‌।’

তিনি আলতো করে ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোর বাবাকে বলে আসছি মা।’
ঝিলমিল মাথা নাড়াল বহুত কষ্টে। আজকের ব্যথাটা যে তাকে এতদূর পর্যন্ত ভোগাবে কল্পনাই করতে পারে নাই। হঠাৎ মনে পড়ল, কিছুক্ষণ বাদে রোদ্দুর হয়তো ফোন করবে। নিজের অসুস্থতার কথা তাকে বলতে ইচ্ছে করল না। তাই বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে ছোট্ট করে একটা মেসেজ পাঠাল।
—’বাড়ি ফিরেছিস নিশ্চয়ই? খেয়ে-দেয়ে সুন্দর করে ঘুমিয়ে পড়। আমার একটু মাথাব্যথা করছে, তাই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। বেঁচে থাকলে কাল কথা হবে।’
জ্বরের কথা শুনে তিন্নি, রোদশী ওরাও উপরের উঠে এলো। ঝিলমিলের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল, কিন্তু সে বিশেষ কোনো কথা বলল না। হুঁ/হ্যাঁ করে জবাব দিয়ে গেল।
শোয়ার সময় শিমু ফিরে এলেন। ঝিলমিলের কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, আগের চেয়ে জ্বর কিছুটা কম। ঘরের বাতি নিভিয়ে আজ মেয়ের কাছেই শুয়ে পড়লেন। ঝিলমিল’ও অনেকদিন পর মাকে কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের বেলা অনেকবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হয়েছে কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করে গেছে।
যেহেতু গতকাল রাতেই ঝিলমিলের অসুস্থতার খবর সবাই জেনে গিয়েছিল তাই সকাল সকাল মাহমুদ সরকার ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছেন। তিনি চেকআপ করে জানালেন, ‘তেমন গভীর কিছু হয় নাই। আঘাতটা যেহেতু কপালে লেগেছে তাই সেটার ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়েছে। সেই ব্যথা থেকে জ্বর। আমি কিছু ওষুধ পত্র লিখে দিচ্ছি, সেসবেই দু’দিনের মধ্যে সেড়ে উঠবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
তেমন গভীর কিছু হয় নাই শুনে সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ডাক্তার যে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তোমার পাশে থেকে সবটাই দেখভাল করলেন। দুপুরের পর ঝিলমিল যখন ঘুমে তখন রোদ্দুরের ফোন এলো। শিমু রোদ্দুরের ফোন দেখে রিসিভ করলেন এবং ঝিলমিলের অসুস্থতার কথাও বললেন। রোদ্দুর খানিকটা অবাক হলো এবং পাশাপাশি একটু রাগ’ও হলো। গতকাল থেকে জ্বর অথচ ঝিলমিল নিজে থেকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না? আবার রাতে মেসেজ দিয়ে বলছে, মাথাব্যথা করছে! রোদ্দুর ঘড়িতে সময় দেখে নিল। বসে বসে কিছুক্ষণ হিসেব কষে নিল, তার কতদিনের ছুটি জমা আছে। বেশিরভাগ অফ ডে রোদ্দুর জমা করে রেখে দেয়। এইখানে থাকাকালীন যেহেতু অন্য কোন কাজ নেই, তাই ছুটির দিনগুলো নষ্ট করে না। সেই মোতাবেক অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিল। এইবার ঝিলমিল যে কয়েকদিন বাড়িতে থাকতে চায় থাকবে, সাথে সে নিজেও থাকবে। ফেরার সময় আর ওর কোনো টালবাহানা চলবে না। দরকার হলে রোদ্দুর ওকে বগলদাবা করে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
সন্ধ্যার আগে সে সরাসরি অফিস থেকেই ওই ফর্মাল ড্রেসে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাড়ি গিয়ে পৌঁছাল আটটা নাগাদ। রোদ্দুরের আসার খবর’ও কারো জানা ছিল না। সে ঝিলমিলের কথা জিজ্ঞেস করলে তিন্নি হেসে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দ্যাখ দ্যাখ, বউ পাগল ব্যাটা কেমন বউয়ের অসুখের কথা শুনে চলে এসেছে। আরে ভাই, আমরা ছিলাম তো। আমাদের উপর একটু ভরসা রাখতে পারতিস। আমরা কি ওর অযত্ন করছিলাম নাকি?’

‘না না, আমি তা বলতে চাই নাই।’

তিন্নি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, তুই কি বলতে চেয়েছিস তা আমরা ভালো করছি বুঝেছি। এইবার যা, ঝিলমিল তোর ঘরেই আছে। মনে হয় ঘুমাচ্ছে। একটু দেখা দে গিয়ে। আমি শিওর, তোকে দেখলে এক নিমিষেই ওর অসুখ-বিসুখ দৌড়ে পালাবে।’
রোদ্দুর দেরি করল না, ওদের কথায় কান দিল না; এক দৌড়ে ঘরে এলো। হুমমম…. ঝিলমিল ঘুমাচ্ছিল। কপালে ব্যান্ডেজ, চেহারায় মলিনতা, মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। রোদ্দুর ওর দিকে এগিয়ে গেল। পাশে বসে কপালে হাত রাখল। জ্বর এখনও আছে তবে তা খুব সামান্যই।
হঠাৎ স্পর্শে ঝিলমিল নড়েচড়ে উঠল। একটু চেপে গিয়ে ঘুমের মধ্যে রোদ্দুরের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘উমমমম, ঠান্ডা।’

রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘ঠান্ডা বেশি লাগছে।’

‘হুম।’
রোদ্দুর উঠে পাতলা কম্বলটা ভালো করে ওর গায়ে টেনে দিল। তারপর পাশে বসে মনে করল, একদিন দাদি বলেছিলেন স্বামী থাকলে সঙ্গে শীত লাগে না অঙ্গে। ডাহা মিথ্যা কথা! তা না হলে রোদ্দুর ঝিলমিলের কপালে হাত দেওয়ার সাথে সাথেই ঠান্ডা বলে হাত সরিয়ে দিবে কেনো?
সামান্য দ্বিধা নিয়ে রোদ্দুর দাঁড়াতে নিলেই হাতের সাথে লেগে পাশে থাকা পানির গ্লাসটা পড়ে যায় এবং পানি’ও তার গায়ে পড়ে। রোদ্দুর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ধুর, এসব অশান্তি তো ভালো লাগে না।’ রোদ্দুর তীক্ষ্ণ মেজাজে আলমারির সামনে এসে দাঁড়াল। আলমারির দ্বার উন্মুক্ত করে চোখমুখ কুঁচকে শার্ট দেখতে লাগল। একটাও যুতসই মনে হচ্ছে না কারণ এগুলো অনেক আগের। প্রতিবার ঢাকা থেকে আসার সময় নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়েই আসে, তবে এইবার ফিরেছে একদম খালি হাতে। অনেকগুলো শার্ট প্যান্ট হাতড়ে আপাতত কাজ চালানোর মতো কাপড় পেয়েই গেল।
এরই মধ্যে ঝিলমিলের ঘুমটাও ভেঙ্গে গেছে। ঘরের মধ্যে খুটখাট আওয়াজ শুনে সে উঠে বসেছে। রোদ্দুরকে দেখতে পেল। কিন্তু ও সত্যি এসেছে নাকি জ্বরের ঘোরে ভুলভাল দিচ্ছে, তা বুঝতে পারল না। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তো তাকেই দেখছিল। এটাও বোধহয় স্বপ্ন। রোদ্দুর কোথা থেকে আসবে? ও নিশ্চয়ই অফিস থেকে ফিরে চৌরাস্তার মোড়ে বন্ধুদের সাথে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ঝিলমিল তাকিয়ে রইল। রোদ্দুর কাপড় বের করছে, তারপর আলমারি বন্ধ করছে। নাহ, স্বপ্ন কখনো এতটা বাস্তব হতে পারে না। তার মন মানছে না, একদম মানছে না। উগ্র আগ্রাসীরূপে জানান দিচ্ছে, এটাই বাস্তব রোদ্দুর।
ঝিলমিল খানিকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুই? ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? তোর তো এখানে থাকার কথা নয়।’

রোদ্দুর ঘুরে তাকাল। এতক্ষণ বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা চোখেমুখে হাসি খেলে গেল। সে দ্রুত গলায় বলল, ‘আমি কাপড় চেঞ্জ করে দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।’
ঝিলমিলের সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না রোদ্দুর এসেছে। বারবার প্রশ্ন জাগছে, কেনো এলো? ওর ভাবনার মাঝেই কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক সেজে রোদ্দুর বেড়িয়ে এলো। ঝিলমিলের পাশে বসে বলল, ‘কেমন লাগছে এখন?’

ঝিলমিল মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ঠিকঠাক। কিন্তু তুই কখন এসেছিস আর কেনো?’

রোদ্দুর মুখটা বেজার করে বিবর্ণ ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার একটা বউ আছে, একটু উচ্ছন্নে চলে গেছে। যাইহোক ব্যাপার না। কিন্তু সে যে অসুস্থতার মধ্যে পড়ে গেছে সেটা আমাকে বলে নাই। আমি জানতে পেরেছি আমার শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে। আমি আমার বউয়ের উপর ভীষণ রেগে আছি আমাকে সত্যি না বলল জন্য। কিন্তু ওর যেহেতু এখন অসুখ, তাই কিছু বলব না। পরে দেখে নিব।’

‘তাহলে তুই সত্যিই এসেছিস?’

‘হুমমম…. বলেছিলাম তো একা একা ভালো লাগছিল না, মন টিকছিল না।’

ঝিলঝিল পুনরায় বলল, ‘আগে তো একাই ছিলি, বিয়ের আগে।’

‘আমাকে প্রশ্ন করলি নাকি নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলি? বলেই তো দিলি, বিয়ের আগে। তখন থেকেছি একরকম, এখন আর ইচ্ছে করে না। বিয়ের পর বুঝলাম, বউ ছাড়া আসলেই জীবন অচল।’
ঝিলমিল খিলখিল করে হেসে উঠল। খেয়াল করল, একটু আগে পর্যন্ত উঠে বসতে পারছিল না। উঠলেই মাথা যন্ত্রণা করে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর এখন? শুধু যে বসে আছে তা নয়, কথাও বলছে আবার হিহি করে হাসছে। ঝিলমিলের হাসি শুনে রোদ্দুর বলল, ‘এতো হাসাহাসি করিস না। এমনিতেই শরীর খারাপ, আমি এসে তোর ঘুম নষ্ট করে দিলাম। আচ্ছা, আমি উঠছি। তুই বিশ্রাম কর।’
রোদ্দুর উঠে চলে যাচ্ছিল। ঝিলমিল হাত ধরে আটকালো। বলল, ‘আমাকে নিয়ে চল। ঘরে বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছে না।’
রোদ্দুর তাই করল। ঝিলমিলের হাত ধরল এবং তাকে নিয়ে বসার ঘরে এলো। তিন্নি একপলক এসে ঝিলমিলের কানে কানে বলে গেল, ‘ভাই আমি বুঝতে পেরেছি এই কয়েকদিন তোর শরীরে ভিটামিন রোদ্দুরের অভাব ছিল। রোদ্দুর আসা মাত্রই কেমন তিড়িং বিড়িং করে উঠেছিস। বল না, চুমুটুমু দিয়ে কি ভিটামিনের অভাব পূরণ করে দিয়েছে?’
ঝিলমিল ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর রোদ্দুরের দিকে তাকাল, ও কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝার জন্য। ওরা রোদ্দুরকেও ক্ষ্যাপাতে একবিন্দু ছাড় দিল না।
সে রাতের আগেই ঝিলমিলের জ্বর নেমে গেল। মাথাব্যথা খুব সামান্য থাকলেও, সেটা সহ্য করা যায়। রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময় সকলে মিলে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল, গল্পগুজব করল। তারপরেও হৈ-হুল্লোড় হচ্ছিল, এগারোটা বাজতেই তিন্নি আপুর হাজব্যান্ড ফোন করল এবং তারা কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এইদিকে সকলে মিইয়ে গেল। আড্ডা ভঙ্গ করে যে যার ঘরে ফিরে এলো। ঘরে এসে ঝিলমিল এলোমেলো চুলগুলোয় চিরুনি চালাচ্ছিল। রোদ্দুর ওর পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার কাঙ্খিত জিনিসটা?’

‘আমাকে বলছিস?’ ঝিলমিল প্রশ্ন করল।

‘হুমম।’

‘কী সেটা?’

‘আমিও জানতে চাই সেটা কী! তুই বলেছিলি আমি এলে আমাকে আমার কাঙ্খিত জিনিসটা বুঝিয়ে দিবি।’
ঝিলমিলের হাত থেমে গেল। দেনাপাওনার হিসাব তো রোদ্দুরের সাথে রয়েছেই! ঝিলমিল ফের চুলে চিরুনি চালাল। সেই দুপুরে গোসল করেছে, চুল বেঁধে রাখার কারণে এখনও ভেজা।
বলল, ‘বল কি চাস?’

রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘যা চাই তা পাব? দিবি?’

ঝিলমিল চরম অপ্রসন্ন হয়ে বলল, ‘আগে তো চেয়ে দ্যাখ।’

রোদ্দুর গা ঝাড়া দেওয়া একটা বুক ফুলানো দম নিয়ে সরাসরি বলল, ‘তোকেই চাচ্ছি।’
ঝিলমিল বাকরুদ্ধ হলো। বুকে অনুরণন তুলে দেওয়া হৃদপিন্ডের ধুকপুক শব্দে আরক্ত হয়ে উঠছিল সমস্ত শরীর। রোদ্দুর এইভাবে আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া একটা কথা বলবে, ধারণা ছিল না। ঝিলমিল নিজেকে সামলে নিল। হাতের চুরি দুটো খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘আমি তো একটা সাধারণ মানুষ। আমাকে নিয়ে কি করবি? তারচেয়ে অন্য কিছু চাইতে পারতি।’

‘সবই তো আছে…. মানুষ দরকার, নিজস্ব।’
রোদ্দুরের এই সামান্য কথায় ঝিলমিলের ভেতরে যে কী হয়ে যাচ্ছে, তা সে বুঝবে না। দম খিচড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ভেতরটা ছটফট করছে। পেছন থেকে ধীরে ধীরে একটা শক্ত, উষ্ণ, পুরুষালি হাত গ্রাস করল তার কোমল হাতটাকে। হৃৎপিণ্ড ছলকে উঠল! অদ্ভুত অনুভূতিতে আত্মহারা হয়ে ঝিলমিল পরপর কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলল।
ওর আত্মা শুদ্ধ কাঁপানো গলায় রোদ্দুর ফের বলল, ‘একটা নিজস্ব মানুষ হলে সব পাওয়া যায়…. সব। তখন দুনিয়া হাতের মুঠোয় থাকে, না পাওয়ার হিসেব থাকে না, চাওয়ার সীমা থাকে না। তুই হবি আমার সেই নিজস্ব মানুষ?’
ঝিলমিলের কানের কাছে রোদ্দুরের নিঃশ্বাসের হলকা প্রবলভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার নড়াচড়া করার মত ক্ষমতাটুকু নেই। রোদ্দুর যেনো এক লহমায় তাকে বশ করে ফেলেছে। জড়বস্তুর মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরের কথা শুনে যাচ্ছে। রোদ্দুর তার ডান কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে তীব্র অনুরাগে বলতে শুরু করে, ‘সেদিন চলে গেলাম না? বিশ্বাস কর, আমার মনটা এখানে রেখে গেছি। শুধুমাত্র কাজের দায়ে পড়ে বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। অফিসে বসে ভাবছিলাম, কী হবে এসব করে যদি দিনশেষে বাড়ি ফিরে তোকে না দেখি! অভ্যাস হয়ে গেছে, ভীষণ বাজে অভ্যাস। বের হতে পারছি না আমি। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, তোকে দরকার। তোকে আমার ভীষণভাবে প্রয়োজন, আমার মানসিক শান্তির জন্য। ভালোবেসে কখন আমার জানা নেই, তবে হঠাৎ করে হয়েছে। বলেছি, অপেক্ষা করব। করেছি এবং এখনও করছি। এইবার আমার কাঙ্খিত জিনিসটা আমার চাই।’
রোদ্দুর থামল। উত্তরের আশায় ঝিলমিলের দিকে তাকাল। ঝিলমিল অনবরত কাঁপছিল। রোদ্দুর এমনভাবে কথাগুলো বলল যে সে নিজের মস্তিষ্কে সাজিয়ে রাখা সবকিছু জট পাকিয়ে ফেলল। মাথা ঘুরছে ভনভন করে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। বলতে তো পারল না কিছুই উল্টো ওর হাতের বন্ধন ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করল। রোদ্দুর এমনভাবে হাত ধরেছে যে ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই।
ঝিলমিল কীভাবে যেনো বলে উঠল, ‘হাত ছাড়।’
ব্যস, ওর এক কথায় রোদ্দুর হাত ছেড়ে দিল। যতটা কাছে এসেছিল ঠিক ততটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এতগুলো কথা বললাম শুধুমাত্র এই কথা শোনার জন্য? হাহা, আমার বোঝা উচিত ছিল সবার মনোভাব এক নয়। আমি কাছে গেলেই কেউ যে আগ বাড়িয়ে বরণ করে নিবে, তা তো নয়। বাই দা ওয়ে, আই এম এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট।’
এইটুকু বলে রোদ্দুর আর অপেক্ষা করল না, ওই ঘরে ছেড়েই বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এলো। রোদ্দুরকে কয়েকবার ডাকল, কিন্তু সে সাড়াশব্দ দিল না। রোদ্দুর এইভাবে চলে যাবে, ভাবতেও পারে নাই সে। অলক্ষ্যে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বিছানার এক কোণায় বসে ফোন হাতে নিয়ে রোদ্দুরকে মেসেজে করল, ‘আমাকে তো কিছু বলার সুযোগ দিলি না। সরি, প্লিজ আয়।’

রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিল, ‘অসুস্থ শরীরে এত ধকল ঠিক না। আর বেশি রাত জাগিস না। ঘুমিয়ে পড়।’
ঝিলমিল মেসেজটা দেখে ফোন রেখে দিল। কী করে বোঝাবে নিজেকে? রোদ্দুর যা যা বলছে ঝিলমিলের কাছে সবকিছুর উত্তর’ই পজেটিভ। তবে সে ওই মুহূর্তে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে নাই। রোদ্দুরের ওইরকম দানবীয় স্পর্শ তার ভেতরটা এলোমেলো করে দিয়েছিল। ভালো/মন্দ জ্ঞান সব কিছু সময়ের জন্য নাই হয়ে গিয়েছিল। ঝিলমিল বালিশে মাথা রাখলেও ওর ঘুম হলো না। সারারাত এপাশ ওপাশ করল। উঠে বারান্দায় গিয়ে হাঁটাহাঁটি করল। ফোন হাতে নিয়ে রোদ্দুরকে ফোন করতে চাইল কিন্তু সে ঘুমিয়েছে ভেবে আর ফোন করা হয়ে উঠল না।
অন্যদিকে রোদ্দুরের মাথা এতটাই গরম হয়ে গিয়েছিল যে সে মাথা ঠান্ডা করার জন্য সারারাত ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাহ, আর যাবে না ভালোবাসার দাবি নিয়ে। বিয়ে যেহেতু করেছে, শুধু দায়িত্বটুকু চুপচাপ পালন করে যাবে।
.
সকাল সকাল ঝিলমিল রোদ্দুরকে খুঁজতে বের হলো। রোদ্দুর বসার ঘরে বড় চাচার সাথে গম্ভীর মুখে কথাবার্তা বলছিল। ঝিলমিল করুণ মুখে গিয়ে পাশে দাঁড়াল। রোদ্দুর দেখলেও পাত্তা দিল না। ঝিলমিল একটু দূর থেকে কয়েকবার ‘সরি’ বলল, কানে ধরল; কিছুতেই কাজ হলো না। সে কথা বলবে কি? ফিরেও তাকাচ্ছে না। ঝিলমিল অনেকভাবে চেষ্টা করল, সবার মধ্যে থেকেও আলাদাভাবে রোদ্দুরকে বোঝানোর— আর ও বোঝার চেষ্টাও করল না। রোদ্দুর অবশ্য ঝিলমিলের সাথে কথা না বললেও দায়িত্ব হিসেবে ওর খেয়াল রাখতে ভুলছে না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যখন সবার সাথে এসে বসল তখন রোদ্দুর রিমঝিমকে বলল, ‘ম্যাডামরে গিয়ে জিজ্ঞেস কর তো, ওষুধপত্র খেয়েছে কিনা।’

রিমঝিম চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বউ, তুমি জিজ্ঞেস করো।’

‘তুই যা, তাহলে বিকালবেলা আইসক্রিম খাওয়াব।’
আইসক্রিমের কথা শুনে রিমঝিম অবশ্য রাজি হলো। দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে রোদ্দুর উঠে চলে গেল। ঝিলমিল’ও পিছু পিছু দৌড়াল। তারপর পেছন থেকে ওর হাতের ফোনটা ছো মেরে নিয়ে পুনরায় ফিরে এলো। এখন বুঝুক ঠেলা! অন্তত ফোনটা নেওয়ার জন্য তো ঝিলমিলের সাথে কথা বলতেই হবে।
ঝিলমিল ফোনটা নিয়ে অফ করে লুকিয়ে রাখল। রোদ্দুর ওর ঘর, ঝিলমিলের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেল না। ঝিলমিল যেখানে যেখানে থাকছে, সে সমস্ত জায়গাগুলোও ভালো করে পরখ করছে। সে যখন রান্নাঘরে গেল, রোদ্দুর’ও পিছু পিছু গেল। রোদ্দুরকে হঠাৎ এমন সময় রান্নাঘরে দেখে বড় চাচি হেসে বললেন, ‘কিরে? তোকে তো আমি এই জীবনে কোনদিন রান্নাঘরে দেখলাম না। আজ হঠাৎ? বউয়ের টানে টানে চলে এসেছিস বুঝি। তো কি করবি? রান্না করবি নাকি ওর কাজে হেল্প করবি?’
তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। ঝিলমিল’ও মুখ টিপে হাসল। রোদ্দুর আর ফোনের কথা উল্লেখ করল না, চলে গেল।
ঝিলমিল মনে মনে বলল, ‘দেখব, আর কতক্ষন কথা না বলে থাকতে পারিস।’
সন্ধ্যার পর রোদ্দুর টিভি নিয়ে বসল, ফোন নেই তো আর কী করবে? ঝিলমিল অনেকবার ওর আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে গেল। ফোনটা এমন জায়গায় রেখেছে যে ঘুণাক্ষরেও খুঁজে পাবে না।
ঝিলমিলের অবশ্য রোদ্দুরের ফোন লুকিয়ে রেখে কোনো কাজ নেই। ফোন লক করা থাকে সবসময়, চাইলেও কোনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারবে না। শুধুমাত্র ওকে দিয়ে কথা বলানোর জন্য, এই উপায় অবলম্বন করা। সন্ধ্যার পর ঘরে গিয়ে ফোনটা বের করল। উল্টাপাল্টা পাসওয়ার্ড দিয়ে অনেকক্ষন চেষ্টা করল লক খোলার, পারল না। ঠিক তখন রোদ্দুরের প্রবেশ ঘটল ওই ঘরে। আচমকা রোদ্দুরকে দেখেই ঝিলমিল ফোনটা বালিশের নিচে চালান করে দিল। রোদ্দুর এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, ‘সর এখান থেকে।’

ঝিলমিল ফিচলে হেসে বলল, ‘অবশেষে কথা বললি তো!’

‘ফোনটা দিয়ে দে।’ রোদ্দুরের কথায় গাম্ভীর্যতার টান।

ঝিলমিল বলল, ‘দিয়ে দিব। তার আগে বল, তুই আমার কথা শুনবি। গতকাল তো….’
গতকালের কথা রোদ্দুর আর শুনতেই চায় না। তাই সে নিজেই ঝিলমিল পাশ কাটিয়ে বালিশের নিচে হাত দিল। ঝিলমিল ওর হাতে চেপে ধরল বলল, ‘না না দিব না।’
দু’জনের মধ্যে একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। রোদ্দুর অবশেষে তার ফোনটা উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হতে যেতেই পেছন থেকে ঝিলমিল বলল, ‘আই থিঙ্ক আই এম ইন লাভ উইথ ইউ!’
.
.
.
চলবে….