ঝিলমিল রোদ্দুরে পর্ব-৪৯

0
345

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৪৯]
~আফিয়া আফরিন

রোদ্দুর হা করে তাকিয়ে একেকজনের দৌড় প্রতিযোগিতা দেখল। ঝিলমিল নিজেও হতভম্ব। একবার খোলা দরজার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পুরো ঘরের চোখ বোলাচ্ছে। আর কেউ আছে? রোদ্দুর দু’কদম এগিয়ে এলো। পর্দার আশপাশ সরিয়ে দেখল, ঘরের কোণাকুণিতে উঁকি দিয়ে দেখল; নাহ আর কাউকে দেখা গেল না।
ঝিলমিল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তার বিস্মিত ভাব এখনও কাটে নাই। রোদ্দুর কী করবে বুঝতে না পেরে ঘরের দরজা গিয়ে লাগিয়ে দিল। এদের কয়েকদিনের অত্যাচারে সে সত্যিই অতিষ্ঠ। ঝিলমিলের পাশে এসে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তুই বরং শাড়ি গয়না চেঞ্জ করে ফেল। কতক্ষণ আর এভাবে বসে থাকবি? ওরা যা শুরু করেছে। এর আগেরবার তো তুই ভিলেনের রোল প্লে করেছিলি। মনে আছে? আমাকে সারারাত শীতের মধ্যে বারান্দায় আটকে থাকতে হয়েছিল। বাই দা ওয়ে, এইবার ঐরকম কোন পরিকল্পনা আছে নাকি?’

ঝিলমিল ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে নেতিবাচক জবাব দিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘তুই না বললি, এসব চেঞ্জ করতে।’ ঝিলমিল জবাব দিল।

‘ওহ হ্যাঁ। তো উঠে কোথায় যাচ্ছিস? গায়ের গয়নাগাটি তো এখানে বসেও খোলা যায়। তোকে তো আমি উঠে চলে যেতে বলি নাই।’

ঝিলমিল ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল, ‘আয়না না দেখে সম্ভব না। ওরা কীভাবে কীভাবে যেনো কানের দুল চুলের সাথে পেঁচিয়ে দিয়েছে। তারপর শাড়িতে কতকগুলো সেফটিপিন, উফফফ বিরক্তিকর। এমনিতেই সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত লাগছে, তার উপর আবার এসব!’

রোদ্দুর এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি কি হেল্প করব?’

ঝিলমিল খোঁপার ফুল ও কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘লাগবে না। তুই’ও চেঞ্জ করে নে। আমি দেখি কতদূর কী করা যায়।’
রোদ্দুর খুক খুক করে কয়েকবার কাশল। সরে গেল না, ঝিলমিলের পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। তার জানামতে, বাসর রাত তো এমন বোরিং হয় না। ঝিলমিল একাই লেগে পড়েছে সাজসজ্জা অপসারণ করতে। এমন হয় কখনো? এটা তো বরের দায়িত্ব। কোথায় গয়নাগাটি খোলার ছুঁতোয় অলক্ষ্যে ওকে ছুঁয়ে দিবে! রোদ্দুর ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। চুলের ক্লিপগুলো খুলতে ঝিলমিল রীতিমতো যুদ্ধ করছে। রোদ্দুর নিজ দায়িত্বে এগিয়ে গেল। ঝিলমিলের হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই ওর চুল থেকে একে একে ক্লিপগুলো খুলে দিল। এতক্ষণ সে চুপ থাকলেও এইবার একটু সরে গিয়ে বলল, ‘হয়েছে, আর লাগবে না।’

‘বেশি বুঝিস সবসময়। হয়েছে আবার কী? আমি তো দেখতে পাচ্ছি এখনও কিছুই হয় নাই। হাত ভর্তি চুড়ি। আচ্ছা এসব তোকে কে পড়তে বলেছে? অযথা সময় নষ্ট।’ রোদ্দুরের কন্ঠে বিরক্তিকর ভাব স্পষ্ট।

ঝিলমিল কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি কি করব? ওরাই তো জোর করে এসব পড়িয়ে দিল। আমি কত করে না বললাম, কথাই শুনল না আমার‌।’

‘তা শুনবে কেন? একচুয়ালি ওদের মেইন শত্রুতা আমার সাথে। আমাকে কিছু করতে পারছে না বলে তোকে টার্গেট করেছে। আমার জীবনের বাঁকে বাঁকে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে।’

‘মানে কী?’
রোদ্দুর ঝিলমিলের পাশে মুখ কালো করে বসে পড়ল। গালে হাত দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘কিছুনা।’
ঝিলমিল যতই রোদ্দুরের কাছ থেকে পালানোর জন্য পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে, রোদ্দুর ততই কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য, তার ক লজ্জা করে না? এইভাবে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকার মানে কি? সারাজীবন তো দেখেছেই। বিগত কিছুদিন দেখে নাই বলে কি এইভাবে তা সুদে আসলে শোধ করতে হবে? ঝিলমিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বলে রোদ্দুর বলল, ‘তোর আবার কি হলো? তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? সবার মত তুই’ও আমার সাথে নতুন করে শত্রুতামি শুরু করলি নাকি? তাড়াতাড়ি কর।’
ঝিলমিল অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। কানের দুলটা কীভাবে যেনো চুলের সাথে পেঁচিয়ে গেছে। ঝিলমিল মুখ ঘুরিয়ে রোদ্দুরের শান্ত মুখটা দিকে তাকাল এক বুক দ্বিধা নিয়ে। এখন যদি রোদ্দুর একটু হেল্প করত! কিন্তু সে তো বাচ্চাদের মত পা ছড়িয়ে করুণ মুখে বসে আছে।
ঝিলমিল জানত, সে এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়বে। তখন অনেকবার বলেছিল, ওরা কেউ কোন কথা শোনে নাই। তিন্নি চুপি চুপি কানে কানে বলেছিল, ‘আরে তুই এত চিন্তা করছিস কেন? এগুলো কি তোর দায়িত্ব নাকি? যার দায়িত্ব সে নিজ আগ্রহে সব খুলে নিবে।’
তৎক্ষণাৎ ঝিলমিলের কান গরম হয়ে এসেছিল। আর এই মুহূর্তে যে কেনো এসব অশ্লীল কথাবার্তা মাথায় আসছে কে জানে? রোদ্দুর বুঝে গেলে কী লজ্জার ব্যাপার হবে, ছিঃ!
ঝিলমিল কোনোকিছু না ভেবে চুলগুলো একপাশ থেকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল‌। মাত্র কিছু সেকেন্ড অতিবাহিত হলো, সে মৃদুস্বরে ‘উফফ’ করে চিৎকার দিয়ে উঠল। রোদ্দুর সহসা ঘুরে তাকাল। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’
ঝিলমিলের মুখে কিছু বলতে হলো না। ওর চোখমুখ খিঁচিয়ে কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে যা বোঝার বুঝে গেল। রোদ্দুর এক পলকেই চুলগুলো পিঠের পিছন দিকে সরিয়ে দিল। স্পষ্ট দেখতে পেল, কানের লতির অংশটুকু র’ক্তা’ক্ত।
সে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘কিচ্ছু হয় নাই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’ মনে মনে সেই বিউটিশিয়ানদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে টিস্যু নিয়ে এসে আলতোভাবে র’ক্তা’ক্ত স্থানে চেপে ধরল। চিনচিনে একধরণের ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ঝিলমিল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ের শখ তার এই জন্মে ঘুচে গেছে। কত কী পরিকল্পনা করে রেখেছিল? প্রত্যেক বিবাহবার্ষিকীতে একবার করে বউ সাজবে। এখন মনে হচ্ছে, না থাক আর দরকার নাই। আমি আগে বেঁচে থাকি, তারপর সব।
ব্যথার পরিমাণ কিছুটা কমে এলে রোদ্দুর ধীরে ধীরে ওই অংশটুকু ড্রেসিং করে দিল। তারপর নিজ দায়িত্বে ওর হাতের চুড়িসহ যাবতীয় গয়নাগাটি খুলে দিল। ঝিলমিল চোখ বুজে ব্যথা সহ্য করে গেল। আর ইচ্ছে হলো না রোদ্দুরকে বলতে, ওকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলতে‌। এমনিতেই সারাদিন তার উপর দিয়েও প্রচুর ধকল গেছে, তার উপর আবার এসব অত্যাচার। এই এক রাতকে ঘিরে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে। রোদ্দুরের’ও আছে…. অবশ্যই আছে, এইজন্য’ই এত তাড়াহুড়ো করছে তখন থেকে! ঝিলমিলের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। রোদ্দুরকে এভাবে মুখ ভার করা অবস্থায় দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছিল না। সে তো রোদ্দুরের সে চাহনি দেখতে চেয়েছিল— সেদিন রাতের মত সে মাদকে পূর্ণ হওয়া শীতল চোখ দু’টো দিয়ে অনিমেষ তার দিকে চেয়ে থাকবে। হৃদয় ছোঁয়ানো সে দৃষ্টিতে ঝিলমিলের সারা পৃথিবী থমকে যাবে। ওই দু’চোখের চাহনিতেই রোদ্দুর ব্যগ্রভাবে আরেকবার বলবে ভালোবাসার কথা। দুজনের মধ্যে ভালোলাগা অথবা মন্দ লাগা যাই থাকুক না কেনো চোখের ভাষায় তা নিরবে প্রকাশ পাবে। ঝিলমিলের ভাবনার ছেদ পড়ল রোদ্দুরের কথায়, ‘এখন কি আর ব্যথা আছে?’ ঝিলমিল মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। রোদ্দুর পুনরায় বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই গিয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে আয়।’ এই বলে সে নিজেই আলমারি থেকে ঝিলমিলের কাপড়-চোপড় বের করে হাতে ধরিয়ে দিল।
ওয়াশরুমে গিয়ে ঝিলমিলের আরেক দশা হলো। ব্লাউজের হুক খুলতে গিয়ে নিজের সাথে একরকম যুদ্ধ চালাল। আজকের এই সময়টা এত বাজে কাটবে, কল্পনাও করতে পারে নাই। কান্না পাচ্ছে খুউব। শেষপর্যন্ত যুদ্ধ শেষ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
ঝিলমিল বের হতেই রোদ্দুর ঘড়ির দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঝিলমিল’ও তাকাল। ওমা! চারটে বাজে। আঁতকে উঠল ঝিলমিল। এত সময় কখন পেরিয়ে গেল?
রোদ্দুর বুক থেকে ভাঁজ করা হাত দুটো স্থিরচিত্তে আলগা করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘নে রাতের অর্ধেকটা পার হয়ে গেল। একটু পর ভোরের আলো ফুটল বলে। আর কী? ঘুমিয়ে পড়।’
রোদ্দুর বোধহয় এই কথাটা বলার অপেক্ষাতেই ছিল। ঝিলমিলকে বলা শেষ, তার দায়িত্ব’ও শেষ। এরপর চুপচাপ বিছানায় একপাশে শুয়ে পড়ল এবং চোখ বুঁজে ঝিলমিলকে বলল, ‘বাতি নিভিয়ে দে।’
ঝিলমিলের মন খারাপের স্তর এইবার সর্বনিম্নে নেমে গেল। সে বাতি নিভিয়ে রোদ্দুরের পাশে শুয়ে পড়ল। ও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ঝিলমিল ঠিকই রোদ্দুরের শান্ত নির্ভাবনার চোখ দুটো দেখে বুঝেছে, রোদ্দুরের অভিমান। ঝিলমিলের ঘুম এলো না। সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত রোদ্দুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তারপর একসময় আযান দিল, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। ঝিলমিল উঠে গেল। বাড়ির সবাই এখনও ঘুম…. অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছে না!
ঝিলমিল মনমেজাজ ঠিক করতে রান্নাঘরে গিয়ে কড়া করে এক কাপ চা বানাল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বিয়ের আমেজ এখনও যায় নাই, বাড়িঘর সাজানো। তবে নিজের মনেই হচ্ছে না, বিয়ের অনুষ্ঠানটা তার হলো। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ বিরক্তিকর একটা পরিস্থিতি। সব রাগ গিয়ে পড়ল বোনেদের উপর। কিন্তু ওদের উপর রাগ করাটাও সমীচিন নয়।
অস্থির মনে ঝিলমিল আবারও রোদ্দুরের পাশে এসে বসল। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ও আলতো করে রোদ্দুরের মাথায় হাত রাখল… তারপর দীর্ঘসময় নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
সকালের আলো যখন আরেকটু প্রকোট হলো, তখন আরেকবার ঘর ছেড়ে বের হতেই বড় চাচিকে দেখতে পেল। তিনি ঝিলমিলকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, ‘ওমা! নতুন বউয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল এত তাড়াতাড়ি?’
ঝিলমিল মাথা নাড়াল। তারপর উনি রোদ্দুরের কথা জিজ্ঞেস করলেন, ঝিলমিল অল্প কথায় জবাব দিল।
এই বাড়িতে তার আসলে কোনো কাজকর্ম নেই, আগে থেকেই। মা-চাচিরা সব করে আসছেন, ওদের বোনদের দিয়ে কখনোই রান্নাবান্না বা অন্যকোনো কাজ করায় নাই। তাই ঝিলমিলের রান্নাঘরে থেকেও অভ্যস্ত নয়‌ বড় চাচি সকালের নাস্তার আয়োজন করেছেন, ধোঁয়ায় ঝিলমিলের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আধঘন্টার মাথায় রান্নাঘর থেকে দৌড়ে পালাল।
ওখান থেকে বের হতেই তিন্নির সামনে পড়ল। তিন্নি ঝিলমিলকে দেখেই পাকড়াও করল।
‘কীরে কীরে? এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়েছিস? আমি তো ভেবেছিলাম, আজ তোদের দু’টোকে আমি হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও পাব না। বাই দা ওয়ে, রাত কেমন কাটল? নিশ্চয়ই ঘুম আসিস নাই। ওপস সরি, ঘুম আসিস নাই নাকি তোকে ঘুম আসতে দেয় নাই?’ তিন্নি চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

ঝিলমিল মনমরা কণ্ঠে বলল, ‘তোমরা আমার সাথে কথাই বলো না। তোমরা য করেছ কাল! যেই হারে একেকজন ঘর থেকে ইঁদুরের মত বের হলে… কী আর বলব?’

‘দেখতে চেয়েছিলাম তোরা কী কী করিস? তারপর রোদ্দুর যখন তোর দিকে এগিয়ে গেল তখন মনে হলো, থাক ভাই এরা ছোটো ভাই-বোন। বিবেকের কাছে পরাজিত হয়ে চলে এসেছি। বল না, কী কী করলি তোরা? ভাই তোকে কি দিল?’ তিন্নি একথা বলে ঝিলমিলের থুতনিতে হাত রেখে মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে ফের বলল, ‘দেখি চুমুর দাগ-টাগ রয়ে গেছে কিনা?’ তার কাঙ্খিত জিনিসটা খুঁজে না পেলেও ঝিলমিলের কানের লতিতে ব্যান্ডেজটা চোখে বলল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এখানে কি হয়েছে? কামড়ের দাগ নাকি? এম্মা…. তাই বলে এইভাবে? মানুষ এত নিষ্ঠুর!’
ঝিলমিল একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। যা ইচ্ছে হয় বলতে থাকুক, সে কিচ্ছু বলবে না।
তিন্নি ফের গালে হাত দিয়ে বলল, ‘সিরিয়াসলি বিশ্বাস’ই হচ্ছে না। তাই বলে তোরা এইভাবে কামড়াকামড়ি করবি? মানে গড় অনুযায়ী মানুষের জীবন থেকে অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলে যা হয় আর কী!’

ঝিলমিল ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘উফফফ চুপ করো আপু।’ তারপর সে নিজের ঘরের দিকে চলল। যাওয়ার পথে মা-বাবার ঘর থেকে তর্কাতর্কির আওয়াজ কানে ভেসে এলো। মনে হয়, কোনো বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কোতুহলী হয়ে শুনতে ইচ্ছে করল কিন্তু এটা অন্যায় বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তবে যে শুনল, ততটুকু বুঝল না। কীসের যেনো ঝামেলার কথা বলছে। বড় চাচার কথা উঠল বেশ কয়েকবার। কী জানি, ভাই ভাইয়ের মধ্যে কীসব হচ্ছে— আবার মিটমাট হয়ে যাবেক্ষণ।
.
বাড়ি ভর্তি এখনও মেহমান। সকাল দশটা বাজতেই বাচ্চাদের চেঁচামেচি, দুষ্টুমি, হৈ-হুল্লোড়ে বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। ঝিলমিল অপেক্ষা করছিল রোদ্দুরের ঘুম ভাঙ্গার জন্য। এতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমানোর কী দরকার? প্রায় বারোটা বাজতে চলল। উঠবে, কথাবার্তা বলবে, প্রয়োজন পড়লে ধমকাবে; তা না করে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঝিলমিল গিয়ে ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল, ‘অ্যাই অ্যাই, ঘুম থেকে উঠ। এতক্ষণ কেনো ঘুমাচ্ছিস?’

রোদ্দুর ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল, ‘আমার ঘুম আমি ঘুমাচ্ছি, তোর সমস্যা কি তাতে? তোর প্রয়োজন পড়লে তুই’ও ঘুমিয়ে থাক। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।’

‘এমন করছিস কেনো?’

‘ভাল্লাগছে তাই।’ রোদ্দুর চোখ বুঁজে জবাব দিল।

‘উঠে পড় প্লিজ। আমি একা একা কি করব?’

রোদ্দুর এইবার পরিপূর্ণভাবে চোখ মেলে তাকাল। বলল, ‘কেনো? তোর পেয়ারের বোনেরা আজকে কোথায়? যা, তাদের কাছে যা। আমার এখানে কাজ কি? এসেছে এই সাতসকালে আমাকে বিরক্ত করতে‌।’

‘সাতসকাল? এখন বারোটা পার হয়ে গেছে।’
রোদ্দুর ঘড়ির দিকে তাকাল। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তাতে কি? আমার কাছে এখন সাতসকাল।’

‘তুই আমার সাথে এমন করছিস কেনো? আমি কি করেছি?’ ঝিলমিলের কণ্ঠটা করূণ শোনা গেল।
রোদ্দুর নিজের হাতটা ঝিলমিলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘কিচ্ছু করিস নাই। সব দোষ আমার। কাল আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি, এই যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে পারব না। তুই গেলে তৈরি হয়ে থাকিস।’

‘আমি যাব তো।’
রোদ্দুর আর কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে টি-শার্ট একটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো। এরপর সকলের গল্পের, হাসিঠাট্টার মধ্যেমণি হলো রোদ্দুর। এই রাতের পর এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে বলে কমবেশি ছোটোবড় সবাই তাকে ইচ্ছেমত পঁচালো। রোদ্দুর সেই যে দুপুর নাগাদ বেরিয়েছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত’ও ওর খোঁজ পাওয়া গেল না। ঝিলমিলের মনে হলো, বিয়ের থেকেও বিয়ের পরবর্তী দিনটা সামলানো কঠিন।
বোনেরা, ভাবিরা সবাই বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অযথা একটা কথা বলে নিজেরাই হাসাহাসি করে, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করে না। ঝিলমিলের তখন মনে হয়, তার পায়ের নিচের মাটি দু ফাঁক হয়ে যাক আর সে সটান করে মাটির নিচে ঢুকে পড়ুক।
পরবর্তী সময়টা খুব বোরিং কাটল। রোদ্দুরের জন্য ছাদে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় কাটল; কিন্তু তার কোনো খোঁজ নাই। বন্ধুদের নিয়ে কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে?
ঠিক আছে, ঘরে বউ ফেলে শুধু ঘোরাঘুরি? আজকে আসুক ব্যাটা, উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে ঝিলমিল। কোমড় বেঁধে নামবে এইবার। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কথায় বলে না, ছেলে মানুষকে বেশি বাড় বাড়তে দেওয়া উচিত না। এরা উড়াউড়ি পছন্দ করে‌। অতিরিক্ত উড়তে গেলে ডানা দু’টো কেটে ফেলতে হয়। ঝিলমিল তাই করবে।
সে নিজের চুলগুলো সামনে এনে হাতে পেঁচিয়ে মনে মনে বলল, ‘আজকে তুমি বুঝবা চান্দু, কত ধানে কত চাল!’
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৯৭১