ঝিলমিল রোদ্দুরে পর্ব-৬৩

0
247

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৬৩]
~আফিয়া আফরিন

কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। ঝিলমিল সবেমাত্র ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরেছে। এই সময় সাধারণত কেউ আসে না। সে দরজার বাইর ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ উত্তর ভেসে এলো, ‘ভাবি আমি।’

‘আমি কে?’
ওপাশের কন্ঠটা নিশ্চুপ। ঝিলমিলের প্রশ্ন শুনে দ্বিধায় ভুগছে। ঝিলমিল কি প্রশ্নটা তাকে জিজ্ঞেস করল নাকি নিজেকে? হাসান মাথা চুলকাল। কিছুতেই নার্ভাস হওয়া যাবে না। অনেক কষ্টে বেশি যথাযথ সাহস সঞ্চয় করে এসেছে। আজ আর কিছুতেই কিছু হটা যাবে না।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ভাবি আমি হাসান।’
ঝিলমিল দরজা খুলে দিল। হাসান মৃদু হাসল। কীভাবে যে কথা শুরু করবে? তাছাড়া রোদ্দুর বাড়িতে নেই, এই সময় এখানে আসাটা কতটা ঠিক হলো এটা ভাবছে এখন!
ঝিলমিল বলল, ‘ভাইয়া আপনি? রোদ্দুর তো বাড়ি ফেরে নাই এখনও।’

‘হ্যাঁ আমি জানি… আমি আসলে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।’

‘আমার সাথে? কোনো সমস্যা হয়েছে? আচ্ছা আপনি ভেতরে এসে বসুন।’ এই বলে ঝিলমিল দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। হাসান এসে একটা চেয়ারে বসল। মনের মধ্যে কথাগুলো যত সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল ততটাই এলোমেলো হচ্ছিল।
বলল, ‘আসলে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলতে চাইছিলাম। রোদ্দুরকে তো বলার প্রশ্নই আসে না। ভাবলাম, আপনাকে বলি। আজ যখন কথাটা বলতে এসেছি তখন বলেই ফেলি, তাইনা?’

‘হ্যাঁ বলুন।’

‘ভাবি, রাগ করবেন না তো? মানে, আপনাদের ফ্যামিলির মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইছি…’

‘ওয়েট ওয়েট, আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। ভাইয়া আপনি প্লিজ আমাকে ক্লিয়ার করে বলেন। আমাদের ফ্যামিলি এখানে কোথা থেকে এলো?’

হাসান নিঃশ্বাস চেপে বলে ফেলল, ‘আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইওর সিস্টার!’
কথাটা শোনামাত্র ঝিলমিল একটা ধাক্কা খেল। সে ভেবেছিল, রোদ্দুরের বিষয়ে হয়ত কিছু বলতে এসেছে। কিন্তু এই ছেলে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে চলে এসেছে।
ঝিলমিল বলল, ‘ভাইয়া আমার তো একটা বোন, বয়সে বড়। ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

হাসান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘তানিশা!’
ওহ আচ্ছা, এই ব্যাপার। ঝিলমিল নিজের মনে কিছুক্ষণ ভাবল, তানিশার সাথে ওর পরিচয় আছে সামান্য। এই পরিচয় থেকে প্রেম? এখন আবার বিয়ে? খুব একটা খারাপ নয় তবে এ সম্পর্কে রোদ্দুর ভালো বলতে পারবে।
ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের সম্পর্ক কতদিনের?’

‘সম্পর্ক?’ হাসান মনে হয় আকাশ থেকে পড়ল।

ঝিলমিল পুনরায় বলল, ‘হুমম, আপনাদের সম্পর্ক কতদিনের? বাড়িতে বোধহয় কেউ জানে না তাইনা? জানলে অবশ্য আমি কোনো না কোনোভাবে জানতে পারতাম।’

‘আসলে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, সেভাবে চেনাজানাও নেই। সেইবার আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন টুকটাক আলাপ হয়েছিল। আর সেখান থেকেই….’ হাসান মাথা চুলকাল।

ঝিলমিল চোখ পাকিয়ে বলে, ‘প্রেম?’

‘না, ওয়ান সাইড লাভ!’
ঝিলমিল সব কথা শুনল, বুঝল। কিন্তু তার তো কিছু বলার নেই। তানিশা তার চাচাতো বোন হলেও, বড় চাচার সাথে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এসব কথা তাদের বলা যাবে না। ঝিলমিল এতকিছু হাসানকে বলল না। রোদ্দুরের সাথে সে কথা বলবে, এইটুকু বলে দিল।
রোদ্দুর সবটা শুনল রাতে। বড় চাচা তো বোধহয় রোদ্দুরের নামটাও শুনতে পারেন না। এমনিতে হাসান ভালো ছিল, সবদিক দিয়ে পারফেক্ট… কিন্তু রোদ্দুরের কিছু করার নেই। একটা হতাশা মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলল।
.
বড় চাচা বাদে সবার খবর’ই ঠিকঠাক। কয়েকমাসে সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে ফেলেছে, আগের শোকটা সকলেই কেটে উঠেছে। একমাত্র বড় চাচার সাথেই রোদ্দুরের কোনো কথা নেই, এছাড়া চাচী, তন্বী আপু, তিথি আপু, তিন্নি আপু, তানিশা সকলের সাথেই যোগাযোগ রয়েছে। ওরা আবার সবাই একত্রিত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। আগে তো তাদের মেলবন্ধনের জন্য বাড়িটা ছিল, তাই সবাই একসাথে একত্রিত হতে পেরেছে। এখন সম্ভব কিনা কে জানে? হয়ত কিছু সময়ের জন্য সম্ভব হবে তবে আগের মত রাতের পর রাত জেগে সেই আড্ডা হবে না।
সময় আর সম্পর্ক একই রশীতে বাঁধা। সময়ের সাথে সাথে বোধকরি এমনিই করে পাল্লা দিয়ে সম্পর্কটাও এগিয়ে যায়! সময় চলে গেলে যেমন ফিরে পাওয়া যায় না তেমনিই কিছু সম্পর্ক হারিয়ে গেলেও ফিরে পাওয়া যায় না। তখন শুধু দীর্ঘশ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস!
রোদ্দুর অবশ্য ঝিলমিলকে মানা করে প্রতিটা পদে পদে এইরকম আপসেট হতে। বেশ হাসিমুখে বিপক্ষে থাকা সকলকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলে, ‘ধুর ছাই! কী হবে মানুষের কথায় কান দিয়ে? আমার জীবন, আমার সবকিছু; তো আমি কেনো অযথা কারো কথা শুনে নিজেকে দোষারোপ করব? জীবন আর কয়দিনের? আমার কাছে বেঁচে থাকার একটা অপশন সেটা হচ্ছে, আমার আপন মানুষগুলোর সাথে ভালো থাকা। ব্যস, আর কী চাই আমার? মানুষের বাজে মন্তব্য শ্রবণ করে আমি কেনো দিনশেষে আমার প্রেসার বাড়াব?’

ঝিলমিলের চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠে। সে মনে মনে ঠিক এইরকম একটা মানুষ চেয়েছিল। ওর এই আত্নবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, সৎ সাহস, যত্ন, সততা, সম্মানবোধ, উদার মনোভাব কিংবা প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা— সবটাই ঝিলমিলকে বেঁধে রেখেছে।
দু’জনের মধ্যেকার বোঝাপড়া ভালো। এই যে দু’জন মানুষ, দু’প্রান্তের; ওরা কখনও ভেবেছিল এক হবে? একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলবে? এত ঝড়ঝাপ্টা দু’জন হাতে হাত রেখে পাড়ি দিবে?
কিচ্ছু ভাবে নাই… ভুল করেও ভাবে নাই। কিন্তু তাদের ভাগ্যে এটাই লেখা ছিল যা একমাত্র দাদি বুঝতে পেরেছিলেন। ঠিক এই কারণেই ওরা দাদির প্রতি একটু বেশিই অনুগ্রহী!
হাসানের সাথে রোদ্দুরের দেখা হয় প্রতিনিয়ত, কিন্তু রোদ্দুর নিজের দিকটা খোলাসা করার পর থেকে সে আর নিজে থেকে কিছু বলে নাই। হয়ত বলবে না, নিজের কষ্ট চাপা দিতে শিখে যাবে।
এখন তো সবাই ঢাকাতেই আছে যার যার মত। ঝিলমিল যেহেতু একা চলাফেরা করতে শিখে গেছে, তাই সে প্রায় মায়ের কাছে যায়। শাশুড়িরূপি মেজো চাচির সাথে দেখা করে আসে। রোদ্দুরের তো সবসময় যেতে পারে না, সপ্তাহে একদিন গিয়ে দেখা করে আসে।
এইতো জীবন— কিছুটা সুখ আবার দুঃখের মিশ্রন! দুঃখ বলতে যেটা সেটা হচ্ছে, ঝিলমিলের মাঝেমাঝে রোদ্দুরের উপর রাগ হয় এর/ওর সাথে কথা বলার কারণে। ঝিলমিল যত মানা করবে সে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। রোদ্দুরের কথা হচ্ছে, ‘তোকে তো আমি বলেছিলাম আমার শর্ত মানতে, তুই মানিস? শর্ত কমাতে কমাতে চুমুর পরিমাণ মাত্র পাঁচটা করে ফেললাম। তুই এত কঞ্জুসের কঞ্জুস, যে নিজের বরকে সারাদিনে মাত্র পাঁচটা চুমু খেতে কিপটেমি করিস।’

ঝিলমিল ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। তবে রোদ্দুর এখন আর ভুলেও রাগারাগী করার মত কিছু করে না। তবুও যদি কোনো কারণবশত তার একমাত্র আদরের বউ রাগ করে বসে, তবে রোদ্দুর ঠিক মানিয়ে নেয় নিজের মতো করে।
.
সুখানপুরে ফজলুল সরকার একাই রয়ে গেছেন যেহেতু এখানেই তার সব কাজকর্ম। বাকিরা দুই জায়গায়’ই যাতায়াত করেন।
বাড়িটা ওইভাবেই পড়ে আছে। রোদ্দুর আসছে না বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। সে যে কি পরিকল্পনা আঁটছে মনে মনে, কে জানে? পুলিশ এখনও উসমান খন্দকারের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। এত তীক্ষ্ণ সতর্কতার পরেও সে যে কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে সেটাই বা কে বলতে পারে? তবে সরকার পরিবারের প্রতিটি মানুষের সতর্কতার জন্য তার খোঁজ পাওয়া জরুরী। কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আবার যে কোনো পরিকল্পনা করবে না তার নিশ্চয়তা নেই।
আজ মনোয়ার সরকার এসেছেন বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। তাকে পাওয়া গেল, ক্লাবে। বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। মনোয়ার সরকার গিয়ে তার সামনের চেয়ারটা দখল করে বসল।
তিনি খেয়াল করে বেশ খড়খড়ে গলায় বললেন, ‘কি ব্যাপার? হঠাৎ তুই এখানে?’

‘ঘুরতে এলাম।’

‘এখানে ঘুরে দেখার মত কোন জায়গা আছে?’

মনোয়ার সরকার হেসে বললেন, ‘আপনার খবর নিতে এসেছি। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গেলেন কেনো? মা কি বলেছিলেন ভুলে গেছেন? আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছেন? এমন কি কথা ছিল? রোদ্দুর আপনার হাঁটুর বয়সী আর তার উপর রাগ করে বসে আছেন? কত জমিজমা পড়ে রয়েছে, সেসব চেয়েছে সে? শুধুমাত্র বাড়িটাকে রাখতে বলেছে। আপনার ভাগের অঢেল জমিজমার কাছে ওই বাড়িটা একদমই নগণ্য।’
ফজলুল সরকার কিছু বললেন না। বেশি কিছুদিন যাবত একটু একটু করে নিজের ভুল বুঝতে পারছেন। তবে মনের ভেতরের অহংবোধের কারনে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না, সবার সাথে মিলতে পারছেন না। জীবন তো অল্প কয়েকদিনের, নিজের মানুষদের সাথে এত রাগ-অভিমান করে কি হবে?
.
উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মেঘের ভেলা… আরেকটু হলেই বোধহয় নিচে অবস্থান করা মানুষগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে। ধরতে গেলেই হাতের মুঠো ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে। সবুজ বন-পাহাড়, ঘাসের বুনো গন্ধ, অচেনা ফুলগুলোর মনামাতানো গন্ধ মেখে সে হেঁটে বেরাচ্ছে। তারপর… বেশ কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে ঝিলমিলের হাতটা কেউ শক্ত করে ধরল। প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে সেই মানুষটার দিকে ঝিলমিল ফিরে তাকাল না, তবুও স্পর্শ খুব চেনা… খুব আপন। এই যে পাহাড়ের এক কিনার দিয়ে ছুটে চলছে, হেলতে দুলতে পথ পাড়ি দিচ্ছে, তুলোর মত ভেজা নরম মেঘগুলো ছুঁয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে; কিন্তু তার একটুও ভয় হচ্ছে না, একটু সংকোচ হচ্ছে না। কারণ সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে রোদ্দুর তার সাথে আছে, পাশে আছে!
রোদ্দুর হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। আমরা ফিরব না?’
প্রশ্নটা বোধহয় সে নিজেকেই করেছিল কারণ উত্তরটাও নিজেই দিল, ‘চল, ফিরে যাই।’

ঝিলমিল নীরব থাকল। বসন্ত বাতাস যেভাবে নিজে ছুটে চলছে, ঝিলমিলকেও নিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন স্বপ্ন আবেশে মন হারিয়ে আবার রোদ্দুরের ডাকে মন ফিরে পাচ্ছে। সন্ধ্যায় পাহাড়ের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া কুয়াশাগুলো যে এক জাদুকরী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, তা স্বপ্নের চেয়েও স্বপ্নময়। ঝিলমিল আবেশে চোখ বুজে রোদ্দুরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আচ্ছা তোর কি প্রেমের অনুভূতি জাগছে না?’

রোদ্দুর বলল, ‘সেটা না রুমে গেলে…’

ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ ঘুরে তাকাল। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ‘আরে, আমি প্রকৃতিপ্রেমের কথা বলছি।’

‘ওহ আচ্ছা… ওটা তো সবসময়ই থাকে। তবে আপনার প্রতি প্রেমটা থেকে থেকে জেগে উঠে।’

‘সবসময় যদি প্রকৃতিপ্রেম থাকে তবে এত যাই যাই করছিস কেন?’

রোদ্দুর চোখ টিপে উত্তর দিল, ‘কারণ এখন তোর প্রতি প্রেমটা উতলে উঠেছে।’

ঝিলমিল রোদ্দুরের বুকে হাত দিয়ে বলল, ‘তাই? আমি কিন্তু প্রেম থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি, কখন না কখন আবার ফেঁসে যাই। আমার ফেঁসে গেলে হবে বল তো? আমার সংসার সামলানোর দায়িত্ব আছে… কত কাজ! সময়ে অসময়ে তোর মত আমার প্রেম পেলে চলবে? এত প্রেম পেলে তো প্রেমে পাগল হয়ে যাব।’
রোদ্দুর ব্যথাতুর ভঙ্গিতে হাসল। বলল, ‘এত ভয়?’

‘তো? ভয় লাগবে না? একবার যে পিরিতের কাঁঠালের আঠা লেগেছে, সেটাই তো ছোটাতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার যদি সেই আটা আবার লাগে, তাহলে তো আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠল। রাত হয়ে যাচ্ছে, তাই ফিরে যাচ্ছিল। গতকাল তারা থানচি এসেছে। এটা রোদ্দুরের অফিস ট্যুর, পাঁচদিনের জন্য। শহরের যানজট ঠেকিয়ে, ব্যস্ততা পার করে, পারিবারিক কোলাহল থেকে বের হয়ে সবুজের সংস্পর্শে এসে মনটা ভালো হয়ে গেছে।
ঝিলমিল বলে দিয়েছে, ‘যতদিন এখানে আছি ততদিন অন্যকোনো কথা হবে না… শুধু তুই আর আমি। এর বাইরে আমরা অন্য কাউকে চিনি না, জানিও না। ওকে?’
রোদ্দুর’ও ডিল কনফার্ম করে দিয়েছে।
স্বপ্নের সময় কিংবা সুখের সময়গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়। এখানে আসার পর কীভাবে কীভাবে যে পাঁচটা দিন কেটে গেল, বুঝতেই পারল না। বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ঝিলমিল ঠোঁট উল্টে বলল, ‘এখানে আসলে আমরা কি করলাম?’

ঢাকা ফিরে আসার পর কিছুদিন আলস্য ভঙ্গিতে কাটল। সময় গড়াতে গড়াতে ঠিক একবছরের কাছাকাছি এসে ঠেকল।
কীসের একবছর? এইতো এই আদর, মায়া আর ভালোবাসার সম্পর্কের একবছর।
ঝিলমিল আগেরদিন রাতেই জানিয়ে দিয়েছে, ‘আমার জন্য সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করবি কিন্তু।’

রোদ্দুর তা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘বাবারে, এক পাগলের সাথে একবছর কাটিয়ে দিচ্ছি এটা উপলক্ষ্যে আমাকে গিফট দেওয়া উচিত সম্ভব হলে আমাকে একটা নোবেল দিস।’

‘আচ্ছা? তবে এক মাথা পাগলের সাথে একবছর কাটানো উপলক্ষ্যে আমিও তো কিছু ডিজার্ভ করি।’
রোদ্দুর ঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজতে এখনও কিছুটা সময় বাকি আছে। ঝিলমিলকে নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়তে হয়। অবশ্য কোথায় যাবে কিংবা কি কারণে বাইরে যাচ্ছে, তা বলল না।
ঠিক দশ মিনিট সময় দিল ঝিলমিলকে, রোদ্দুরও তৈরি হয়ে নিল। তারপর সাড়ে এগারোটা নাগাদ দু’জনে বের হলো। ঝিলমিল অনেকবার জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘উফফফ, এত কথা বলিস কেন? সারাজীবন কথা বলে বলে তেজপাতা করে দিলি, এখন চুপ থাক।’

‘আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘চুউউউপ!’
ঝিলমিল চুপ করল না, বকবক করেই গেল। রোদ্দুর যেখানে এসে থামল, এটা একটা রেস্টুরেন্ট। ঝিলমিল নেমে বলল, ‘এখানে কি কাজ?’

‘কথা বলবি না। এখন থেকে আগামী দশমিনিট চুপ করে থাকবি।’
রোদ্দুর ঝিলমিলকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। ওকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ বেঁধে দিল। ঝিলমিল দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কিছু বলতে গেলেই, রোদ্দুর ঠোঁটে হাত চেপে চুপ করিয়ে দিল।
তারপর লিফটে করে নিয়ে এলো ছাদে। বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। ঝিলমিল অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেল।
যখন বারোটা বাজল তখন রোদ্দুর ওর চোখের বাঁধন ঢিলা করে দিয়ে এক হাতে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া এবং অন্য হাতে ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে কেক নিয়ে ঝিলমিলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। ঝিলমিল চোখের বাঁধন সরাতেই অবাক… পুরো থ বনে গেল। হেসে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। ফুলটা হাতে নিতেই রোদ্দুর বলল, ‘আমাকে বরবাদ করে দেওয়ার একবছর পূর্ণ হলো। আশা করি বেঁচে থাকার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমার জীবনে থাকবেন এবং এভাবেই আমাকে বারবার করে যাবেন।’
ঝিলমিল কি বলবে বুঝতে পারছিল না। আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছিল। সে যেদিকে তাকায় সেই দিকেই লাল সাদা বেলুন এবং ফুলের ছড়াছড়ি। মাঝে কিছু গোল্ডেন টাচ’ও দেওয়া হয়েছে। মাঝের টেবিলে ছোট্ট একটা বাটিতে পানির মধ্যে তাজা গোলাপ ফুল ভাসছে। আশেপাশে ছোট ছোট এবং সুগন্ধি ক্যান্ডেল।
নরম উষ্ণ ফেয়ারি লাইটে অপূর্ব রহস্যময় লাগছে সবটা। ঝিলমিল রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাগলের পাগলামী সহ্য করতে করতে মাথা থেকে এত দারুন একটা আইডিয়া বেল হলো, বাহ!’
একদিকে ফটো কোলাজ করা হয়েছে। ঝিলমিল সেদিকে এগিয়ে গেল, হাত বুলাল। ফের রোদ্দুরের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল, তাদের পুরোনো মুহুর্তগুলো! কত্ত স্পেশাল ছিল সব, কত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ, কত গল্প!

রোদ্দুর এগিয়ে এসে নিজের দু’হাতের বেষ্টনীর ভেতর ঝিলমিলকে জড়িয়ে তার কপালে আলতো করে চুমু খেল। গভীর আবেগ ও ভালোবাসায় একে অপরের চোখে চোখ রেখে দুজনকে কিছুক্ষণ অনুভব করল।
ঝিলমিল সলজ্জ হেসে বলল, ‘আমাকে এইভাবেই তোর ভালো/মন্দ, বিশ্বাস/অবিশ্বাস, লাভ/ক্ষতি, রাগ/অভিমান, ভালোবাসা/মন্দবাসার মধ্যে সারাজীবন রেখে দিস। আমি তোর বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পথ চলার সঙ্গী হতে চাই।’

ওরা দু’জন একসাথে কেক কাটল। গ্রাউন্ডের রোমান্টিক সফট মিউজিক চালু হয়েছে। এইদিনের প্রথম গিফট হিসেবে রোদ্দুর তাকে হাতে লেখা একটা বিশেষ চিঠি উপহার দিল। বলল, ‘উহুঁ এখন নয়… যখন নিজেকে একলা মনে হবে বা অনেক বেশি মনখারাপ লাগবে তখন পড়িস।’
ঝিলমিল মাথা নাড়ল। তবে একটা দ্বিধা রয়েছে— রোদ্দুর থাকাকালীন কখনও একলা মনে হবে না, মনখারাপ হবে না; তাই হয়তো চিঠিটাও খুলে দেখা হবে না।

দু’জনের এই বিশেষ মুহূর্তের মধ্যে তিথি, রোদশী, তানিশা, রিমঝিম আর হাসান প্রবেশ করল। রোদ্দুর যখন আজকের দিনের এই পরিকল্পনা করেছিল, তখন তাদেরও ইনভাইট করেছে। তিথি দেশে এসেছে সপ্তাহখানেক আগে, ঝিলমিএর সাথে তার এখনও দেখা হয় নাই; আজ দেখলে ব্যাপক খুশি হবে। হাসানের বিষয়টা রোদ্দুর সবাইকে জানিয়েছে তবে তানিশা হয়ত এখনও জানে না।
ঝিলমিল তাদের দেখে আরও একধাপ অবাক হলো। ওদের সাথে হৈহৈ করছিল। হাসান রোদ্দুরের দিকে এগিয়ে এলো। মনখারাপ করা কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত, তোর একবছর হলো। আমার কবে হবে?’

রোদ্দুর বেশ গম্ভীর গলায় বলল, ‘যেদিন হবে দেখা যাবে।’

‘ভাই তুই আমার অনুভূতি নিয়ে খেলিস না, প্লিজ। সবাইকে বলে দে। আর কতদিন সিঙ্গেল থাকব? তোদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘আমি তোর অনুভূতি নিয়ে খেলছে কীভাবে?’

‘এইতো আমার মনের অবস্থা বুঝেও ভাব দেখাচ্ছিস।’

রোদ্দুর বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করলেই তোর বিয়েশাদী ডিশমিশ। মনে রাখিস, এটা কিন্তু এখন আমার হাতেই আছে।’
হাসান ফ্যাকাসে হাসল। এত নিষ্ঠুর তার বন্ধু… এত নির্দয়? এই দয়ামায়াহীন মানুষের সাথে ঝিলমিলের মত মজাদার একটা মেয়ের একবছর কাটল কী করে?
ওরা সারারাত ওখানে কাটাল। হাসান অবশ্য চলে গিয়েছিল। যতটুকু মুহূর্ত ঝিলমিল নিজের জন্য চেয়েছিল ততটুকু পেয়ে গেছে, বাকি সময় তাই হাসি, মজা আর আড্ডায় কেটেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হলো। ওইসময় আর কি ঘুমাবে? একটু বাদেই রোদ্দুরকে অফিসে যেতে হবে। বাকি সময়টুকু ঝিলমিলের সাথে আবোলতাবোল বকবক করে ওকেও জাগিয়ে রাখল। এইতো একটা সুন্দর সময় কাটল, এই সম্পর্কেই দু’জন কথা বলছিল।
যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে রোদ্দুর দু’কাপ চা বানাল। বিয়ের পর থেকে ঝিলমিলের সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার এ টু জেড মনে আছে। পরদিন ঝিলমিল যে তাকে লবণ দিয়ে চা বানিয়ে খাইয়েছে, সেটাও ভুলে যায় নাই। আজ রোদ্দুর একই কাজ করল… জাস্ট মজা করে। ভালোবাসায় সম্পর্ক যেনো একঘেয়ে না হয়ে যায়, তাই টুকটাক রসিকতার দরকার আছে।
ঝিলমিলকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজে কোনোরকম খেয়ে বের হতে উদ্যত হলো। এখন না বের হলে ঝিলমিলের দৌড়ানি খেতে হবে। তবে দরজায় পা রাখতেই ভেতর থেকে ঝিলমিল চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই রোদ্দুর, এটা কি? তুই আমাকে লবণ দিয়ে চা বানিয়ে দিলি কেন? আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? দাঁড়া তুই, আমি আসতেছি।’

রোদ্দুর বিড়বিড় করে বলল, ‘ওহ নো! এই মহিলার ভালো হতেও সময় লাগে না, খারাপ হতেও সময় লাগে না।’
তারপর সে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ টাইপ ভাইব নিয়ে দৌড়ে পালাল। বাড়িতে এলে পরে কি হবে, তা পরে দেখা যাবে!
ঝিলমিল যখন দরজায় এসে দাঁড়াল, রোদ্দুর তখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। ঝিলমিল পিছু পিছু গিয়ে ডেকেও তার সাড়াশব্দ পেল না।
কোমড়ে হাত গুঁজে ফোঁসফোঁস করে বলল, ‘তুই এত অসভ্য… তোর সাথে ভালোভাবে কথা বলাই ভুল। আজকে তুই বাসায় আয়। সকাল সকাল আমাকে লবণ চা খাইয়ে মাথা নষ্ট করে দিয়েছিস! এত্ত মজা চা… এখন থেকে তোকে রেগুলার চা বানানোর দায়িত্ব দিব।’
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
অন্তিম পর্ব আগামীকাল অথবা তার পরদিন দিব, ইনশাআল্লাহ।
শব্দ সংখ্যা— ২৫৩২