ঝিলমিল রোদ্দুরে শেষ পর্ব

0
772

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [অন্তিম পর্ব]
~ আফিয়া আফরিন

বছর পাঁচেক পর—
___________
রাইয়ান একাকি ছোটাছুটি করছিল, আজ ওর আনন্দের দিন। আনন্দ অবশ্য আরও কিছুদিন আগে থেকেই তবে আজ একটু বেশিই। গ্রামের বাসায় যাবে, অন্যান্য কাজিনদের সাথে দেখা হবে। রাইয়ানের কাছে তো দেখা হওয়া বড় ব্যাপার না, তার কাছে বড় ব্যাপার হচ্ছে— খালামনির ছোট্ট বাবুটার দাঁত উঠেছে কিনা এটা দেখা।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে, মা আর কিছু বলবে না। এমনিতেই মা একটু… না অনেকটা রাগী, তবে মন ভালো থাকলে কিছু বলে না। আজ বাবাও বাসায়, ঘুম থেকে উঠার পর দেখা হয় নাই। এখন বাবার সাথে দেখা করতে গেলে নির্ঘাত ধরে বেঁধে বুঝিয়ে খেতে বসিয়ে দিবে। আর যদি খেতে ভালো না লাগে তাহলে মা পিঠের উপর কয়েক ঘা বসিয়ে দিবে। তারচেয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করাই ভালোই।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গেলে হাসান চাচ্চুর সাথে দেখা হয়ে গেল। হাসান রাইয়ানকে কোলে তুলে নিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘এই সাতসকালে ছাদে কি কাজ আব্বাজান? কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’

‘তুমি কুথায় গিয়েছিলে?’

হাসান কপাল চাপড়ে বলল, ‘যাদের বউ আছে, তাদের শান্তির বাতাস খেতে ছাদে যাওয়া প্রয়োজন। তুমি এতকিছু বুঝবে না। তুমি যখন বিয়ে করবে, তোমার যখন বউ হবে তখন বুঝবে।’

‘আমার বউ কবে হবে?’ ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করল রাইয়ান।

হাসান হো হো করে হেসে বলল, ‘তোমার বাবা-মা’কে জিজ্ঞেস করতে হবে।’

‘বাবা-মা কি বিয়ে কলেছে?’

‘হ্যাঁ করেছে তো। তুমি জানো না?’

‘কেনো কলেছে? আমি তো দেখি নাই। আমাকে কেনো বিয়ে কলতে নিয়ে যায় নাই? ওলা একা একা বিয়ে কলেছে। তুমিও তাই কলেছ। আমি তো বিয়ে দেখি নাই, দেখব এট্টু।’

‘বাবা, তুমি নিজে বিয়ে করে নিজের বিয়ে দেখো।’
রাইয়ান হাসানের কোল থেকে নেমে গেল। চোখ গোল গোল করে তাকাল। এই তাকানোর ভঙ্গিমা পেয়েছে ওর মায়ের কাছ থেকে।
রাইয়ান বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে বাবাকে গিয়ে বলি আমি বিয়ে করব।’ হাসানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইয়ান দৌড় দিল। হাসান হেসে নিজের ঘরে ঢুকল।
তানিশাকে সে বছর’ই বিয়ে করেছিল। এখন এইখানেই থাকছে, রোদ্দুরের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে। রাইয়ান প্রায় সময় তাদের কাছে চলে আসে, আবোলতাবোল বকবক করে আবার চলে যায়। মায়ের বকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচতে চলে আসে। পরক্ষণেই বলে, ‘আমি যাই। মাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না।’
বয়স এইবার তিন হলো। রোদ্দুরের থেকে কোনো অংশে কম নয়। মাথার চুল, ভুরু কুঁচকে তাকানো, কথা বলা সবখানেই সে বাপ কা ব্যাটা!
.
রোদ্দুর একটা বৃহৎ পরিকল্পনা করেছিল। যার খুব সামান্য অংশ ঝিলমিলকে জানিয়েছিল। আর বাকিরাও সময়ের তালে ধীরে ধীরে জেনেছে। তাদের যে বাড়িটা ছিল, যেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই জায়গাটা তো বড় চাচ্চুর থেকে চেয়ে নিয়েছে। তখন তাদের মধ্যে সামান্য মনোমালিন্য হলেও পরবর্তীতে তা মিটে গেছে; বিশেষ করে তানিশার বিয়ের পর।
সেই জায়গায় রোদ্দুর একটা হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। চেয়েছিল, এমন কিছু একটা করবে যেটা পরিবেশের উন্নতি বা ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
আমাদের দেশে গ্রাম্য এলাকায় অনেক মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, তাদের কথা মাথায় রেখে রোদ্দুরের এই পরিকল্পনা। এবং নাম দিয়েছে, ‘রেহানা খাতুন হাসপাতাল লিমিটেড’। দাদির ইচ্ছে পূরণ করেছে তাকে স্মরণ করার মাধ্যমে। এই একজন মানুষ যার ভূমিকা তাদের সকলের জীবনে অনির্বচনীয়।
আজকে দুপুরের পর সেই হাসপাতালের উদ্বোধন। সেই প্রস্তুতি চলছিল। গতকাল রাতে অফিসের কাজে ঘুমাতে দেরি হয়েছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। সেই তখন থেকে শুরু হয়েছে ঝিলমিলের ক্যাঁচক্যাঁচানি, এখনও থামে নাই। এতক্ষণ শুধুমাত্র রোদ্দুরের উপর রাগ ঝাড়ছিল আর এখন রাইয়ানের উপর।
রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে রোদ্দুরের উদ্দেশ্য আরেকবার বলল, ‘রাইয়ান ঘুম থেকে উঠেই ঘর ছেড়েছে। নিশ্চয়ই তানিশার ওখানে। তুই একটু দেখবি প্লিজ। আমি। ওর নাস্তা রেডি করেছি। ওকে খাওয়াতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়।’

রাইয়ানকে ডাকতে হলো না, সে দৌড়ে এসে তার বাবার কোলে চড়ল। রোদ্দুর হেসে বলল, ‘আমার বাবাটা কোথায় গিয়েছিল?’

‘মল্লিং ওয়াকে।’ রাইয়ান বলল নিরীহ কণ্ঠে।
রোদ্দুর হেসে উঠল। ছেলে পুনরায় বলল, ‘বাবা, আমি বিয়ে কলতে চাই।’ আচমকা রোদ্দুর বিষম খেল। রাইয়ানকে কোল থেকে নামিয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে বলল, ‘কি বললে বাবা?’

‘আমি বিয়ে কলব। তোমলা সবাই বিয়ে করেছ। তুমি কেনো বিয়ে করেছ? আমাকে বলো নাই কেনো? আমি বিয়ে দেখব।’

রোদ্দুর বলল, ‘বাবা বিয়ে করলে একটা বউ পাওয়া যায়। আর বউয়েরা কেমন হয় জানো? তুমি যে ডরিমোন দেখো, ডরিমোনের মধ্যে জিয়ান আছে না? বউয়েরা ওর মত হয়। জিয়ান যেমন গান গেয়ে সকলের মাথা খারাপ করে দেয়, বউ সেইরকম চেঁচাতে চেঁচাতে সকলের মাথা খারাপ করে দেয়। তাই বউ এবং বিয়ে, দু’টো থেকেই সাবধান। বুঝেছ?’
রাইয়ান মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং বাবার কথা শেষ হতেই বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল। ওমন সময় ঝিলমিল ঘরে ঢুকল। রাইয়ানকে দেখে বলল, ‘এসেছ? এইবার ঘুরে এসে তোমার সব বাঁদরামি আমি বের করব। ইদানিং পাখা গজিয়েছে তাইনা? ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না? বাঁদর ছেলে কোথাকার!’

রাইয়ান সরল গলায় বলল, ‘ওদেল লেজ আছে বাট আমাল তো লেজ নেই মা।’

‘এত পাকা পাকা কথা বলতে হবে না তোমাকে। তুমি খেতে এসো। আমি খাইয়ে দিব। তারপর ঘরটা গোছাব, পারো তো শুধু সব এলোমেলো করতে। তুমি তোমার তানিশা খালামনির কাছে যাবে, সে তোমাকে রেডি করে দিবে।’
আজ একটা মজার দিন বলেই হয়ত রাইয়ান অন্যান্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল।
ঝিলমিলের এখন আগের মত অফুরন্ত সময় নেই। রাইয়ানের দিকে পুরোটা সময় দিতে হয়, ছেলেটা একটু বেশি দুষ্টুমি করে। সারাদিন ওকে নিয়েই কেটে যায়। তারপর রোদ্দুর যখন বাড়ি ফিরে, রাইয়ানের তখন আর মাকে প্রয়োজন হয় না।
বিছানা গুছিয়ে ঝিলমিল রোদ্দুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা আজ রাতে ফিরে আসব তো তাইনা?’

‘থাকতে চাচ্ছিস?’

‘না না, তোর ছেলেকে নিয়ে কোথাও গিয়ে শান্তি পাই আমি? আর ফিরেই আসব, সবার সাথে সাময়িক সময়ের জন্য দেখা হবে, কথা হবে, এইতো অনেক। আবার থাকব কি?’

‘হুমমম, কাল আমারও অফিস আছে।’ কথা বলতে বলতেই রোদ্দুর ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এলো। সংসার সামলাতে গিয়ে য়েয়েটা বেশ হিমশিম খেয়ে গেছে। একা হাতে এতগুলো কাজ করার অভ্যাস ছিল না বলে, প্রথম প্রথম প্রায় সবকিছু গুলিয়ে ফেলত। এখন আর সমস্যা হয় না।
চুলগুলো ঘাড়ের উপর লুটোপুটি খাচ্ছিল। রোদ্দুর সুন্দর করে বেঁধে দিল। বলল, ‘গরমের মধ্যে কি দরকার?’

ঝিলমিল হেসে বলল, ‘এইজন্য’ই।’

‘কি জন্য?’

‘এইতো কখন তোর চোখে পড়বে আর তুই এসে যত্ন করে একটা খোঁপা করে দিবি, তার অপেক্ষা করছিলাম। আমার এতদিক দেখার সময় আছে? তোদের বাপ-ছেলের যন্ত্রণায় বাঁচি না।’

‘আর আমরা বাপ-ছেলে যে তোকে বিরক্ত না করতে পারলে বাঁচি না।’

‘তুই তো আগের ভাগীদার, এখন নতুন করে আরেকজন জুটেছে।’ ঝিলমিল বলল হাসি মিশ্রিত কণ্ঠে।
রোদ্দুর তার পেছন পেছন রান্নাঘর পর্যন্ত এলো। ক্যাবিনেটে হেলান দিয়ে অযথাই বকবক করতে লাগল আর ঝিলমিল নিজের কাজ সারল। বেশিক্ষণ সময় নেই, দ্রুত রেডি হলো। ওখানে আজ সবাই আসবে— বড় চাচা-চাচী অবশ্য আগে থেকেই ওখানে। বাকিরাও হয়ত রওনা দিয়ে দিয়েছে। শুধুমাত্র ঝিলমিলের দেরি হয়ে যায়… প্রতিবার’ই।
.
ওরা সুখানপুর পৌঁছাল বিকালের একটু আগে। সেই যে চলে গেল, তারপর ঝিলমিলের আর আসা হয় নাই। অথচ তার জীবনের ২১ বছর এখানে অনায়াসে কাটিয়ে দিয়েছিল। ২১ বছর পর যখন সব ধুলিসাৎ হলো এক নিমিষেই, বাড়িটা চলে গেল, মানুষটা চলে গেল; প্রাকৃতিকভাবে ঝিলমিলের টান’ও চলে গেল। রোদ্দুরকে প্রায় আসতে হতো, রাইয়ান একটু বড় হওয়ার পর ওকে নিয়েও বেশ কয়েকবার এসেছিল।
ঝিলমিল এসেই প্রথম শিউলির খোঁজ করছিল। ও বাড়িতে নেই, শ্বশুরবাড়ি। সব কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে, অচেনা লাগছে। পাঁচটা বছরে আশেপাশের পরিবেশেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের মত গাছপালার সমাহার নেই, সব শূণ্য।
রোদশী এলো কিছুক্ষণ পরে। রাইয়ানের খুশি দেখে কে? সে তো এসেছেই বাবুর জন্য।
সবাই নিজেদের মতো সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। রোদশীর একটা মেয়ে একটা ছেলে। ছেলেটা তো একদম ছোট্ট, সাত মাস চলছে। সেদিন ঝিলমিলের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে বলছিল, বাবুর দাঁত উঠছে। তারপর থেকে রাইয়ান সেই দাঁত দেখার জন্য অস্থির।
বাবু ঘুমাচ্ছে, এরইমধ্যে সে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতগুলো দেখার চেষ্টা করছে। আর বলছে, ‘বাবুল দাঁত অলধেক কেনো? আমাল তো পুলা দাঁত আছে। ওল সব দাঁত নাই কেনো?’
রোদশী ওকে এটা সেটা বোঝাচ্ছে। তারপরের সময়টা অনুষ্ঠানের আয়োজনেই কেটে গেল। সবাই আলাদা হয়ে যাওয়ার পর দেখাসাক্ষাৎ খুব কম হয়। আগে যেমন সচরাচর হার হামেশা কথাবার্তা বলত, বড় চাচার সাথে ওই ঘটনার পর সেইরকম কথাও হয় না। এখন অনেকটা দূরের মানুষ বলে মনে হয়, সহজ হতে পারে না।
সম্পর্কের এই টানাপোড়েন জীবনের স্বাভাবিক অংশ। দুজন মানুষের ভাবনা, চাওয়া-পাওয়া, ব্যক্তিত্ব সবসময় একরকম হয় না… হতে পারে না। ফজলুল সরকার হয়ত প্রথমদিকে রোদ্দুরের সিদ্ধান্তটাকে সম্মান এবং আন্তরিকতার সাথে নিতে পারে নাই বলেই আজ সমাধান হয়েও হচ্ছে না।
.
বেশ অনেকদিন পর বোনেদের সাথে দেখা হয়ে ঝিলমিলের সময়টা ভালো কাটল। সবাই তো এখন নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত, কারো সময়’ই হয় না দু’দন্ড স্থির হয়ে দু’টো কথা বলার।
রাইয়ানকে সারাক্ষণ রোদ্দুর’ই নিয়ে ছিল। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দিতে প্রায় দশটা বাজল। গাড়িতে উঠেই ঝিলমিল হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসেছিল। রাইয়ান কোলে, রোদ্দুর ওকে নিজের কাছে নিয়ে বলল, ‘ঘুম ধরেছে? তাহলে একটু ঘুমিয়ে নে।’

ঝিলমিল সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বাবু ঘুমাবে না। অথচ বাবুর মায়ের ঘুম ধরেছে। তুই তাকে কোলে না নিয়ে বাবুকে কোলে নিলি?’
রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ হেসে উঠল। বাবার দেখাদেখি রাইয়ান’ও নিজের দাঁত কেলিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল।
রোদ্দুর ঝিলমিলকে বলল, ‘দু’জনকে এখান কি করে সামলাব বল তো?’

‘আমি কি জানি? তোর ব্যাপার।’ বলে আবার হেলান দিল। রোদ্দুর অবশ্য আর কথা বলল না। ঝিলমিল টায়ার্ড, ওর বিশ্রামের প্রয়োজন। এখন কথা বললে কথা বাড়বে… রোদ্দুর আলতো হাতে ভীষণ যত্ন মিশিয়ে ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ঝিলমিল তো ঘুমিয়ে পড়ল সাথে রাইয়ান’ও। আর রোদ্দুর? সে একজনকে আগলে নিজের বুকের ভেতর রাখল, আরেকজনকে নিজের বাহুবন্ধনে!
নিজেকে পুরোদস্তুর সার্থক এবং সম্পন্ন মানুষ মনে হচ্ছে। তার সব আছে, সর্বপরী একজন সুখী মানুষ সে!
পরিবারের সুখ কেবল অর্থ দিয়ে আসে না; এটি স্নেহ, ভালোবাসা, সমঝোতা এবং মানসিক সমর্থন দিয়ে তৈরি হয়।
সংসার জীবনে রোদ্দুরের ভূমিকা ঝিলমিলের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। প্রায় সবাই মনে করে, বাচ্চা পেটে ধরে মা নিজেই বাচ্চার সমস্তটা পেয়ে গেছে। হ্যাঁ, ঠিক আছে মায়ের সাথে দুনিয়ার কোনোকিছুর তুলনা হয় না। কিন্তু বাবার ভূমিকা ফেলে দিলে চলবে?
রাইয়ান দুনিয়াতে আসার খবরটা রোদ্দুর যখন পেয়েছিল তখন সে অফিসে, নিজের খুব জরুরী কাজ নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ঝিলমিল ছিল তার ক্লাসে। ক্লাস শেষে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় তখন তাকে এমআই রুমে নিয়ে চেকআপ করালে ডাক্তার সু’খবর দেয়। ঝিলমিলের অবস্থা জানানোর জন্য ওর এক বান্ধবী রোদ্দুরের কাছে ফোন দিয়েছিল তখন এই খবরটাও জানিয়েছে।
এমন একটা মুহূর্তে, এমন একটা খবর… রোদ্দুরের বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে কিছুটা সময় কাটিয়েছে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। নিজের গোছানো কাজগুলোও এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। কতৃপক্ষকে বলে সেদিনটা ছুটি নিল। কোনো কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বাড়ি এসে ঝিলমিলকে দেখেই মনে হলো, পৃথিবীর সব সুখ সে তার মধ্যে পেয়েছে। মন ও মস্তিষ্ক বারবার তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তুলে ধরছিল। ঝিলমিল জানতে চেয়েছিল, সে কতটুকু খুশি? রোদ্দুর মুখ ফুটে বলতে পারে নাই, তৎক্ষণাৎ ঝিলমিলকে জড়িয়ে ধরে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছিল।
ওর কপালে একটা প্রগাঢ় চুমু এঁকে বলেছিল, ‘আর কিচ্ছু চাই না আমি।’
এরপর অন্তরের শান্তি, সম্পর্কের উষ্ণতা, আত্মতৃপ্তি, ছোট ছোট মুহূর্তের আনন্দ এবং স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার মাধ্যমে দুনিয়াতে রাইয়ানের আগমন ঘটে।
একটি নতুন জীবনের সূচনা; যা স্নেহ, ভালবাসা এবং আশার প্রতীক। রাইয়ান হয়েছিল লালচে রঙের… সারা শরীর কোমল। হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো কী ছোট, রোদ্দুর প্রথম অবস্থায় কোলে নিতেও ভয় পেত। যদি হাত কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যায়? ছেলেটা সারাদিন শুধু ঘুমায়, আর কোনো বিষয়ে অস্বস্তিবোধ করলে তখন কাঁদতে কাঁদতে গলা ফাটিয়ে ফেলে।
রোদ্দুর যখন বাবুকে কোলে নেয়, পুরোটা সময় সে তার শরীর থেকে আসা মিষ্টি ঘ্রাণের প্রশান্তি অনুভব করে। এতো চমৎকার… এত প্রশান্তির যে দুনিয়ার সব ব্রান্ডের পারফিউম হার মানিয়ে দেয়।
রাইয়ান যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিল তখন তার হাসি, কান্না, হাত-পায়ের নড়াচড়া, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা; তার বাবা-মায়ের মনে আবেগের ঝড় তুলত। রোদ্দুর যতটুকু সময় ঘরে থাকত, ততক্ষণ ছেলেকে নিয়েই পড়ে থাকত। সারাদিন খাটাখাটুনির পর ঝিলমিলের যেনো একটু শান্তিমত ঘুম হয়, তাই রাতের বেশিরভাগ সময়টা রাইয়ানকে নিজের কাছে রাখত; ওকে নিয়ে জেগে থাকত।
খাওয়ানোর সময় যখন রাইয়ান খেতে চাইত না তখন রোদ্দুর এমন সব অঙ্গভঙ্গি করে ওকে হাসাতো, যা একটা সময় পর রাইয়ানের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোদ্দুরকে প্রচুর জ্বালায়… তবে এই যন্ত্রণায় শেষ সীমাহীন ভালোবাসা এবং জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজে পায়!
.
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের প্রায় একটা বাজল। ঘরের দরজায় পা রাখার সাথে সাথে রাইয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এই রাত হলেই ছেলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
ঝিলমিল কোনোরকম একটু ফ্রেশ হয়ে এসে রাইয়ানকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে রাক্ষস আর পরীর গল্প শোনাতে লাগল। এই রূপকথার গল্পগুলো সে নিজের মায়ের কাছে যতটুকু না শুনেছিল, তার থেকে বেশি শুনেছিল দাদির কাছে। দাদির কথা মনে পড়লে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। তার আদরের একমাত্র নাতির ছেলেটাকে দেখলে কীরূপ প্রতিক্রিয়া হতো, তা কল্পনা করতে গিয়েও পারে না। ওই অংশটুকু ঝাপসা থেকে যায়।
দাদির খুব ইচ্ছে ছিল, ওদের একটা পরিপূর্ণ সংসার দেখে যাওয়ার। হয়ত পূর্ণ হয় নাই তবে তিনি মনে থেকে খুশি ছিলেন। নিজ ভাবনা থেকে হয়তোবা কল্পনাও করতে নিয়েছেন।
ঝিলমিল খুব ধীরে রাইয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তারও ঘুম আসছে। দাদির কথা মনে পড়লেই সে স্বপ্নে ভেসে আছে। কথাবার্তা বলে, খোঁজখবর নেয়, তার ছেলেদের অকাজের জন্য বকাবকি করে, বউদের খবর নেয়। হেসে হেসে বলেন, ‘দ্যাখ দ্যাখ, আমার ছেলের বউয়েরা আমার চেয়েও বুড়ো হয়ে গেছে। এই বয়সে আমি এমন ছিলাম নাকি?’
সবশেষে ঝিলমিলের সাথে মনখুলে কথা বলেন— ব্যস এইতো! আর কীসের কষ্ট? কীসের অভাববোধ?
.
একেকটা সকাল আসে নিত্যনতুন ব্যস্ততা নিয়ে। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে, শান্ত সময়গুলো কেমন যেনো তাদের ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছে। এত ব্যস্ততা আগে তো ছিল না।
ঝিলমিল সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নাস্তার আয়োজন করে। নাস্তার সময়টা বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যেই কেটে যায়, চা বানাতে বানাতে রাইয়ানের কান্নাকাটি শুরু হয়। আবার দৌড়ে যেতে হয়।
রোদ্দুর থাকতে থাকতেই যতটুকু কাজ সেরে ফেলা যায়, ততটুকু সেরে ফেলে। কারণ পরে রাইয়ানের জন্য কোনো কাজ ঠিকভাবে করা যায় না।
রোদ্দুর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নিচে গিয়ে হয়তো মনে হয় দরকারি কোনো ফাইল নিতে ভুলে গেছে, আবার তাড়াহুড়ো করে বাসায় আসতে হয়। এই তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে সকালের শান্ত সময়টা কোথায় যেনো মিলিয়ে যায়!
মাঝেমধ্যে মা-শ্বাশুড়ি আসে, সপ্তাহখানেক বেরিয়ে চলে যায়। বাড়িতে কেউ আসা মানেই রাইয়ানের আনন্দ।
দুপুরে কাজের মধ্যে ফোন বেজে উঠল। ঝিলমিল গিয়ে ফোন রিসিভ করল। রোদ্দুর ফোন করেছে। সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, ‘রাইয়ান কোথায়?’

ঝিলমিল ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমাকে ফোন করে ছেলের খোঁজ করা হচ্ছে? রাইয়ান তানিশার কাছে।’

‘ওহ আচ্ছা… আমি তো আসলে মনে মনে বউকেই খুঁজি। ফর্মালিটি মেইনটেইন করে ছেলের খোঁজ করছি।’ রোদ্দুর হেসে উঠল। রোদ্দুরের হাসির আওয়াজে ঝিলমিলও হেসে উঠল।
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করছিস?’

‘ভাবছিলাম!’

‘কীসের কথা?’

‘তোর কথা।’

ঝিলমিলের কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে। বলে, ‘আমার কথা? কেনো?’

‘তোর কথা ভাবছি কারণ তুই না থাকলে দিনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর সবসময় তোকে ভাবলে মনে হয়, তুই পাশেই আছিস।’

‘পটাতে চাচ্ছিস?’

রোদ্দুর বেশ খোশমেজাজে বলল, ‘নিজের জিনিস… আমারই থাকবে। পটিয়ে কি লাভ? তবে এটা সত্যি যে তোর কথা ভাবলে, মনটা ভালো হয়ে যায়।’
ঝিলমিল একটু লজ্জা পেল। সেটা আবার রোদ্দুর ওপাশ থেকে, ওকে না দেখে বুঝেও গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘লজ্জায় টমেটো হয়ে গেছিস তাইনা?’

ঝিলমিল কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ‘আমার বহুত কাজ আছে। তোর আজাইরা বকবক শোনার মত সময় নাই। রান্না করছি। ফোন রাখি।’

‘একদম না, একদম না। ফোন রেখে দিলে আমি সোজা তোর মনের ঘরে ঢুকে পড়ব। তখন বের করবি কি করে?’

ঝিলমিল এপাশ থেকে ঝলমলে হাসিটা উপহার দিয়ে বলল, ‘বাহ! প্রেমে পড়লি নাকি? কথাবার্তা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। কাহিনী কি, খোলাসা করে বল তো?’

রোদ্দুর আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘প্রেম? সে তো আমি রোজ’ই একজনের প্রেমে পড়ি। হৃদয় যে কত্ত দ্রুত লয়ে ধ্বনিত হয়, তা বুঝাব কী করে? হঠাৎ হঠাৎ এই রহস্যময় পৃথিবীটা এত সুন্দর মনে হয়!’

‘তা প্রেমের জ্বালে ফাঁসিয়ে দিল কে শুনি?’

‘আছে একজন! যার সাথে একটুখানি কথা বললে আমার কঠিন মুহূর্তটাকেও অসাধারণ মনে হয়। তার চোখে চোখ রাখলে, আমার সময় ওখানেই থেমে যায়। মাঝেমধ্যে সে যখন আমার কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, সে সময়ে তারমধ্যে লজ্জা এবং মিষ্টি অনুভূতির মিশ্রণ ঘটে।’

‘এহে, বুড়ো বয়সে কী ভীমরতি! দিনে দিনে কি আপনার বয়স কমছে?’

‘বয়স একটি সংখ্যা মাত্র! ২০ এ হোক অথবা ৮০ তে, আমার ভালোবাসার কোনো হেরফের হবে না। না মানে, না! আজও যেমন ভালোবাসি, আগেও সেইভাবেই ভালোবেসেছি, ভবিষ্যতেও বাসব। এই ভালোবাসা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বারবে, ডালপালা গজাবে; কিন্তু কখনো কমবে না।’
ঝিলমিল মুচকি মুচকি হাসল। চুলায় রান্না করে যাচ্ছে এই দোহাই দিয়ে, ফোন কেটে দিল।
প্রিয় মানুষের কাছ থেকে এইটুকু ভালোবাসা পাওয়া মানেই মনে হয় ‘আমি কত্ত স্পেশাল!’ রোদ্দুর প্রতিবারই নিজের কর্মকাণ্ডের দ্বারা ঝিলমিলের আত্নবিশ্বাস বাড়িয়ে এসেছে।
ভাবনায় ইতি টানল সে। এইবার সত্যিই রান্না করা তরকারি পুড়ছে, পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। সে দৌড়ে গেল।
.
রোদ্দুর ফিরে এলো সন্ধ্যা নাগাদ। রাইয়ান আর ঝিলমিল ঘরে বসে গল্প করছিল। তার কতশত গল্প, এইটুকু মানুষ; জীবন থেকে মাত্র তিনটা বছর পার করেছে, এরইমধ্যে তার কত গল্প! ঝিলমিল শোনে আর মুচকি মুচকি হাসে।
রাইয়ান বলে, ‘মা এটা কি? ওটা কি? এটা এমন কেনো? বাঁকা কেন, সোজা কেনো? এটার রং এমন কেনো?’
তার কত প্রশ্ন। ঝিলমিল মনোযোগ দিয়ে শুনে সবকিছুর উত্তর দেয়। তবুও রোদ্দুরের সাথে রাইয়ানের সম্পর্ক বেশি ভালো। ওকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?
সে নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে উত্তর দেয়, ‘বাব্বা, বাব্বা!’
তখন রোদ্দুর আড়চোখে তাকায়, ঝিলমিলের দিকে। সে যে লুচির মত ফোলে তা দেখলেই বোঝা যায়।
রোদ্দুর ছেলের কানে কানে বলে, ‘আব্বাজান, বাবাকে ভালোবাসলে চুপ করে থাকো। বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে, তোমার মায়ের ভালোবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত করে দিও না। জানো, সে কী জিনিস! বাবারে বাবা, তাকায় কীভাবে? দেখলেই তো ভয় লাগে। ওর ভয়ে যেভাবে থাকি ওই ভয় যদি ছোটো বেলায় স্কুলের টিচারদের পেতাম তবে জীবনে কী যে করে ফেলতাম!’
রাইয়ান কিছু বোঝেনা, তবুও সে হি হি করে হাসে।

রোদ্দুর রাইয়ানের জন্য চকোলেট এবং ঝিলমিলের জন্য একগোছা ফুল নিয়ে এসেছে। প্রতিদিন না, তবে প্রায় সে এই কাজটা করে। ঝিলমিলের ভাষ্যমতে, গোলাপ এবং ভালবাসা দুটো জিনিস খুব স্পেশাল। গোলাপ সবসময় দিতে নেই, আকর্ষণ কমে যায়। ভালোবাসা সবসময় প্রকাশ করতে নেই, মূল্য কমে যায়।
দু’জনকে দু’জনের জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে রোদ্দুর ঝিলমিলের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘এইবার আমার পাওনা…?’

ঝিলমিল রাইয়ানের দিকে তাকাল। সে তার চকোলেট নিয়ে ব্যস্ত। অলক্ষ্যে রোদ্দুরের গালে একটা চুমু খেল। রোদ্দুর মনখারাপ করা কণ্ঠে বলল, ‘মাত্র?’

‘তো? একটাই বেশি।’

‘আমাকে দশটা দিলেও বেশি মনে হবে না।’ এই বলে রোদ্দুর নিজেই এগিয়ে এসে ঝিলমিলের ঠোঁটে একটা চুমু খেল। তারপর চোখে, মুখে, কপালে অজস্র! ঝিলমিল বলল, ‘ইশশ, রাইয়ান আছে। অসভ্যতামি করিস কেনো?’

‘তো?’

‘লজ্জা শরম একদম নাই, তাইনা?’

‘লজ্জা শরম দিয়ে আমি কি করব? তাই বিসর্জন দিয়েছি। যত লজ্জা, তত সাজা। নির্লজ্জ হয়ে যদি একটু বেশি আদর পাওয়া যায়, তবে আমার নির্লজ্জ হতে আপত্তি নেই।’

‘ছিঃ, কী বাজে কথাগুলো বলে।’
রোদ্দুর হাসল, রাইয়ানের জন্য অসভ্যতামির শেষ সীমা পর্যন্ত যেতে পারল না। ঝিলমিল যাবে না, তাই রাইয়ানকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল।
.
সংসার জীবন মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়। ছোটো বেলায় মা-চাচীদের দেখার পরেও ঝিলমিল কল্পনাই করতে পারে নাই, সেও একদিন ভালোভাবে তার সংসার সামলাবে। তার সাথে এখন কিছু মানুষের জীবন, আবেগ এবং দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে।
প্রকৃতি শান্ত, চারিপাশ নিস্তব্ধ, পুরো পরিবেশে এক ধরনের রহস্যময় সৌন্দর্য বিস্তার করছে— ঝিলমিল জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবছিল সব। ঘুম আসছে না, তো কি করবে? পাশেই তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষ আরামসে ঘুমাচ্ছে।
এই মুহূর্তে রোদ্দুরেরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঝিলমিলকে বলল, ‘জেগেএ আছিস যে এখনও? রাত দু’টো বাজছে।’

ঝিলমিল ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘ঘুম ধরে না তো। তুই’ও আয়। দেখ কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। আজ মনে হয় জোৎস্না রাত।’
রোদ্দুর উঠে এলো। ঝিলমিলের পাশে বসল। আজ সত্যিই জোৎস্না রাত, চাঁদের আলো মাটিতে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। দূরে কোথাও থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। চারিদিকে কোনো কোলাহল নেই, প্রকৃতি নিজেও ঘুমাচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ।
ঝিলমিল রোদ্দুরের কাঁধে হেলান দিল। রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত নিজের হাতের আজলায় নিয়ে এলো। সারাদিন বাদে একটুকু প্রশান্তি খুব দরকার। মুখে কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন নেই; একে অপরের চোখের ভাষা, ছোঁয়া, ভালোবাসার গভীরতা দিয়ে খুব সহজেই সময়টা উপভোগ করতে পারে।
রোদ্দুর হাসিমুখে বলল, ‘দিনের শুরু এবং রাতের শেষ প্রহরে তোকে পেলে জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই।’

ঝিলমিল লাজুক হেসে রোদ্দুরের হাতে চুমু খেয়ে বলল, ‘তুই আমার সবকিছু!’
ছোট্ট ছোট্ট এই মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত আসে। এরজন্য প্রয়োজন হয় না কোনো জাঁকজমকের… প্রয়োজন পড়ে আন্তরিকতা ও সময়ের দেওয়ার প্রচেষ্টা।
একটি ব্যস্ত দিনের শেষে দু’জন বসে একটা কফির মগে চুমুক দিয়ে গল্প করছে, বিভিন্ন মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করছে।
এই সম্পর্কের গল্পটা সুন্দর… এরা শুধু দায়িত্বের খাতিরে একে অপরের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস নয়, দু’জন মানুষের একইসাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার গল্প।
এমনই সুখের সময়ের মধ্যে রাইয়ানের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। ঝিলমিল থতমতো খেয়ে দৌড়ে গেল। রোদ্দুর বিমর্ষ মুখে বলল, ‘এই ছেলে বোধহয় তোর আর ভাগিদার দুনিয়ায় আসতে দিবে না।’
কপাল চাপড়ে নিজেও বিছানায় চলো। বলল, ‘অ্যাই ওরে বিয়ে দিয়ে দে তো। আমার আর বউয়ের রোমান্টিক সময়ে খুব জ্বালায়। বিয়েশাদী করে বউকে ইচ্ছেমত জ্বালাক, দেখার বিষয় না।’
ঝিলমিল হাসল।
রোদ্দুর পুনরায় বলল, ‘আব্বাজান বিয়ে করবেন?’

রাইয়ান তৎক্ষণাৎ মাথা বলল, ‘না, না।’
ঝিলমিল আর রোদ্দুর দু’জনেই হো হো করে হেসে উঠল। এইতো সংসার জীবন যা একসঙ্গে গড়ে তোলা একটি সুখের আশ্রয়স্থল। অনেক ত্যাগ, সমঝোতা, ধৈর্য্য, মায়া-মমতা, আদর ও ভালোবাসার মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয় এই ঘর… এই সংসার!
.
.
.
সমাপ্ত।

বেশ অনেকদিন চলমান ছিল এই গল্পটা। আপনাদের ভালোবাসায় এতদূর লেখার সাহস করতে পেরেছি। অনেক অনেক ভালোবাসা রইল। আর আজকের অন্তিমে লগ্নে এসে ছোট্ট একটা মন্তব্য করে যাবেন, ধন্যবাদ।

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ৩২৮৩

নোট: (রোমাঞ্চকর এবং অ্যাডভেঞ্চার জনরার আমার প্রথম ই-বুক, ‘দ্যা ডেইজ অব ম্যারিয়ানো’ পড়তে বা কাউকে গিফট করতে চাইলে ঝটপট অর্ডার করে নিতে পারেন।
ই-বুক কেনার লিংক:
https://link.boitoi.com.bd/GTnH)