ঝিলমিল_রোদ্দুরে পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
398

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩৩]
~আফিয়া আফরিন

রোদ্দুর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ঝিলমিলের দিকে। ওর মাথার কাছে বসে আলতো করে কপালে হাত রাখল। কিছুক্ষণ মন দিয়ে ওকে দেখল। কত কালের পরিচিত অথচ ঝিলমিলের গালে যে একটা তিল আছে, সেটাও আজ অবধি খেয়াল করে নাই। ও আগে থেকেই একটু কায়দা করে কথা বলা চটপটে, হাসিখুশি ধরণের মেয়ে। কিন্তু ইদানিং স্বভাবে একটু ন্যাকামিও চলে এসেছে। অবশ্য রোদ্দুর খেয়াল করে দেখেছে, সেই ন্যাকামিটা শুধুমাত্র তার বেলাই খাটে; অন্য কারো ক্ষেত্রে নয়। আর তেজ? সেটা তো মায়ের পেটে থাকতেই রপ্ত করেছে। রোদ্দুর অনিমিখ চেয়ে দেখছিল; ওর ঘুমন্ত মুখটা, টানা টানা চোখ, ঠোঁট! প্রতিটা মানুষের’ই একটা নিজস্ব ধরন থাকে, ও বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আচমকা ‌ ঝিলমিল চোখ মেলে তাকাল। তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘এইখানে কি করিস তুই?’

রোদ্দুর দপ করে নিভে গেল। মনের মধ্যে যা একটু রোমান্টিকতা উঁকি দিচ্ছিল, তা এক দৌড়ে ছুটে গেল। মাথা চুলকে বলল, ‘কিছু না।’

‘তো বসে আছিস কেনো?’

‘আশ্চর্য! আমি বসতে পারব না? পুরো বিছানা তো নিজে দখল করে রেখেছিস কিছু বলেছি?’

ঝিলমিল উঠে বসে বালিশে হেলান দিয়ে বলল, ‘এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? না বলবি না কিন্তু, আমিও তোকে অনেকবার চা বানিয়ে খাইয়েছি‌।’

‘ও ঋণ শোধ করতে হবে?’
কথার মাঝখানে মা ঢুকল ঘরে চা নিয়ে। ঝিলমিলের সাথে তাকে কথা বলার স্পেস দিয়ে রোদ্দুর বেরিয়ে পড়ল। তিনি অবশ্য বলছিলেন, ‘আমি তো তোদের জন্য চা নিয়ে এলাম। তুই যাচ্ছিস কোথায়? তোর যেতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি।’
রোদ্দুর তা শোনে নাই, ছোট চাচ্চুর সাথে দেখা করবে বলে বেরিয়ে পড়ল।
ঝিলমিল তার মা’কে জিজ্ঞেস করল, ‘কারা এই কাজ করেছে কোন খোঁজ পাওয়া গেছে কি মা?’

‘জানাই তো আছে কার কাজ এসব, প্রমাণ’ও আছে। রোদ্দুর পুলিশের হাতে কথাবার্তা বলেছে। সন্ধ্যায় ওই বাড়িটা ঘেরাও করা হবে নাকি শুনলাম।’

‘রোদ্দুর? ও এসবের মধ্যে কি করে? পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দিক। সবকিছুতে নাক গলাতে কে বলেছে ওকে? তোমরা মানা করো নাই ওকে? আমি তো ওখানে গিয়ে বুঝেছি ওরা কতটা ক্ষতিকর! এইরকম একটা পরিস্থিতি…. উফফফ, বর্ণনা করতে পারব না। দরকার পড়লে ওর হাত-পা ধরে ওকে আটকাতে হবে। তবুও ওখানে যেতে দেওয়া যাবে না, আমি যেতে দিব না।’ ঝিলমিল শেষের কথাটা বলল জোর দিয়ে।

‘সবাই মানা করেছিল, কিন্তু ও ধোনে আমাদের কারো কথা? সারাজীবন নিজে যা ভালো বুঝে এসেছে তাই করেছে। এইবার তো তুই আছিস! দুনিয়ার কোনোকিছুর সাথে রোদ্দুরের সাথে তোর সম্পর্কের তুলনা চলে না। তুই একটু বলে দেখিস! তোর কথা ও ফেলবে না।’

ঝিলমিল হেসে বলল, ‘তুমি বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে হাস্যকর কথা বললে মা। রোদ্দুর শুনবে আমার কথা? তাহলেই হয়েছে!’
মায়ের সাথে ঝিলমিলের আরও অনেক গল্প হলো। চেহারায় এতক্ষণ যে মলিনতা ছিল নিমিষেই উবে গেল। তবে মনের মধ্যেকার বিষন্ন ভাবটা এখনও কাটে নাই। তাই ছাদে উঠল। ওখানে গিয়ে হাসানকে দেখতে পেল রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল। ঝিলমিল এগিয়ে এসে বলল, ‘ভাইয়া ভালো আছেন? আপনি এখানে আসার পর থেকে বাড়িতে কী এক ঝামেলা শুরু হলো। আপনার খেয়াল’ই রাখা হলো না ঠিকঠাক মত।’

‘আরে কী বলে! আপনাদের খুঁজে পাওয়া গেছে এটাই অনেক। আপনার বর তো পাগল হয়ে গেছিল।’

ঝিলমিল দুষ্টুমি করে বললেন, ‘ইশশ, পাগলা গারদে ভর্তি করালেন না কেনো?’

‘এই পাগল সেই পাগল না কিন্তু! মানে ওর কী অবস্থা হয়েছিল, আমি আপনাকে ছোটো করে বর্ণনা করি।’

‘হুমমম… শুনি একটু!’

হাসান বলতে শুরু করল, ‘যখন শুনল, অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আপনি বাড়িতে পৌঁছান নাই তখন তো ইচ্ছেমত বকাঝকা। আক্কেল ছাড়া বেয়াক্কেল…. ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সারা শহর খুঁজেও আপনাকে পাচ্ছিল না, বারবার বাসা থেকে নেতিবাচক উত্তর আসছিল; তখন রোদ্দুর আমাকে সাথে নিয়ে সোজা চলে এলো। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে আপনাকে খোঁজে নাই। মাঝরাতে সবাই যখন বাড়ির মধ্যে চিন্তায় অস্থির, তখন রোদ্দুর একা একা বেরিয়ে গেছে। তারপর আপনার ফোন পাওয়া গেল…. মানে এসব আর মুখে বলে প্রকাশ করা যাবে না।’
ঝিলমিল মনে মনে ভাবল, বাঁদরটা তার জন্য এত চিন্তা করে? বাব্বাহ! অতি ভক্তিও মাঝেমাঝে চোরের লক্ষন মনে হয়।
ঝিলমিল নিচে নেমে সবার সাথে দেখা করে এলো। মাহমুদ সরকার এখন সুস্থবোধ করছেন। ঝিলমিলের সাথে কথা হওয়ার পর বেশ প্রশান্তি বোধ করছেন।
বাবার সাথে কথা বলে, তানিশার সাথে দেখা করে এলো। বড়রা যেহেতু বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছে, তাই বাইরে গেল না। রোদ্দুরকে দরকার ছিল, ওকে ঘরে কোথাও খুঁজে পেল না। ফোনটাও তার কাছে নেই, কোথায় কে জানে! পুনরায় ঘরে ফিরে এলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ বাদেই রোদ্দুর ঘরে এলো। ঝিলমিল ওর ফোনটা ওর কাছ থেকে চেয়ে নিল।
ঝিলমিল খুব নিরীহ গলায় বলল, ‘তোর ফোন যে নিলাম, তোর ওই এক্স-ফেক্স আবার ফোন করবে না তো? আমি কথা বলতে পারব না। ওর সাথে কথা বলতে গেলে, ভালো কথা বের হবে না।’

‘তোকে কথা বলতে হবে না।’ রোদ্দুর শার্ট চেঞ্জ করছিল। ঝিলমিলের মনোযোগ ফোনে ছিল। সে গ্যালারি ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখছিল। কিন্তু ইনবক্স কিংবা ফাইল দিঘির জলের মত টলটলে পরিষ্কার। ওতে সন্দেহজনক কিচ্ছু নেই। ঝিলমিলের হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। এমন কাহিনী বলতে গেলে বড় আকারের একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। ভাগ্যিস রোদ্দুর গিয়েছিল! রোদ্দুরের দিকে একবার তাকাল। ওকে ‘থ্যাঙ্কস’ জানানো হলো না। হাসান ভাইয়ার কাছে শুনেছিল, তাকে খুঁজে না পেয়ে রোদ্দুর কী পরিমাণ টেনশনে ছিল। অন্তত সামান্য একটা ‘থ্যাঙ্কস’ সে ডিজার্ভ করে।
রোদ্দুর ঘর ছেড়ে বের হতে গেলেই ঝিলমিল পিছু ডাকল, ‘শোন! কোথায় যাচ্ছিস? পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দে, তুই ছোটাছুটি করবি কেনো?’

‘ওনারা একা সব সামলাতে পারবে না।’

‘আচ্ছা! তুই এমন কি হয়ে গেছিস যে তোকে ছাড়া তারা তাদের কাজে সফল হবে না? চুপচাপ ঘরে বসে থাক।’

রোদ্দুর এগিয়ে এসে বলল, ‘কোনো জরুরী কথা আছে? আমাকে দ্রুত বের হতে হবে?’

‘তুই কোনো প্রেসিডেন্ট না যে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তোর সাথে কথা বলা যাবে না? আমি তোকে এই মুহূর্তে ডেকেছি, এরচেয়ে জরুরী আর কি? আমি তোকে ফালতু আলাপ করার জন্য নিশ্চয়ই ডাকি নাই।’
বাব্বাহ…. এই মেয়ের মুখ তো আর মুখ না, একদম আগ্নেয়গিরি! দুনিয়া উল্টে যাবে তবুও ঝিলমিলের কথার ধার কমবে না। রোদ্দুর করুণ মুখে ওর পাশে এসে বসল। রোদ্দুরের চেহারায় এমন মলিনতা দেখে ঝিলমিলের মায়া হলো। ওর সাথে যতই ঝগড়া কাটাকাটি করুক, সত্যি অর্থে কষ্ট দেওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছেও ঝিলমিলের নেই। সে রোদ্দুরের হাত ধরে বলল, ‘আমি তোকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না। ওমন পরিত্যক্ত একটা জায়গা, যদি বিপদ-আপদ হয়ে যায়?’

‘হলে হবে, তাতে তোর তো কিছু না। বিপদ হলে আমার হবে, যা হওয়ার আমার’ই হবে। তবে তোর একটা লাভ আছে? আমার যদি কিছু হয়ে যায় তোর জীবন থেকে মূল ভিলেন চরিত্রটা ভ্যানিশ হয়ে যাবে।’
রোদ্দুর কীভাবে কথাটা বলল? ঝিলমিল তৎক্ষণাৎ ওর মুখ চেপে ধরল। ইশারায় এমন কথা বলতে মানা করল। নিমিষেই চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল। রোদ্দুর তা খেয়াল করল। পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘আমি গেলে তোর কি বল?’

‘চিন্তা হবে।’ ঝিলমিল মাথা নিচু করে জবাব দিল।

‘শুধু চিন্তা? আর কিছু না? বল…..’
ঝিলমিল কি বলবে? ওর বুকের মধ্যে যে উত্তাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা রোদ্দুরকে দেখাবে কি করে? রোদ্দুর বুঝবেই বা কি করে? বলল, ‘আমার ভালো লাগে না। যাস না প্লিজ।’

‘যাওয়া না যাওয়া তো পরের ব্যাপার। আমি কারণটা জানতে চাচ্ছি! আচ্ছা, তাকা আমার দিকে।’
ঝিলমিল এতক্ষণ মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। এইবার রোদ্দুরের দিকে তাকাল। রোদ্দুর ওর চোখে চোখ রেখেই বলল, ‘শহরে এত আলো ঝলমল, এত যানজট, এত আওয়াজ অথচ কিছুই আমার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করছে না। কানের আশপাশ দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে কিন্তু মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে না। আমার মস্তিষ্ক তখন শুধু একজন মানুষকে খুঁজে বেরাচ্ছে। আমি…..’

ঝিলমিল রোদ্দুরকে বাকি কথা বলতে দিল না। ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে নিজে বলল, ‘যে মানুষটাকে তোর মস্তিষ্ক খুঁজে বেড়াচ্ছিল, সেই মানুষটার অনুরোধ রাখবি না?’
রোদ্দুর হালকা চালে মাথা দোলাল। পিছুটান, মায়া খুব খারাপ জিনিস। তারচেয়েও খারাপ চোখের চাহনি। এইতো এই মেয়েটা এতক্ষণ রাগী চোখে, রাগী গলায় কথা বলছিল। অথচ এখন তার চাহনিতে বিষন্নতা স্পষ্ট…. করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার অনুরোধ করছে, রোদ্দুর তা ফেরাবে কি করে? সৃষ্টিকর্তা পুরুষ মানুষকে তুলনামূলক শক্ত সামর্থ্য বানালেও, এই একটা দিকে ভেজা মাটির মত নরম করে দিয়েছে। এই মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এই যে আবদার, ভীষণ আদুরে লাগছে। জীবনে এমন করে আর কেউ করেছে কখনো? কখনো হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ এইভাবে বাঁধ দিয়েছে?

ঝিলমিল রোদ্দুরের চেহারা দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। বেশি কিছু বলারও সাহস পাচ্ছে না। যদি আবার রেগে যায়? কিন্তু সে তো এইবার দুঃখে কেঁদে ফেলবে। ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, ‘তুই কি চলে যাবি?’

রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সেই উপায় রেখেছিস তুই? আমি যাব না ওখানে প্রমিজ। তবে আমাকে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে যেতে হবে। সেখানে তো যেতে পারি?’
ঝিলমিল মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। তারপর বলল, ‘ফিরতে ক’টা বাজবে?’

‘আটটার মধ্যে চলে আসব।’ এইটুকু বলে রোদ্দুর ঝিলমিলের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। রোদ্দুর যাওয়ার পর ঝিলমিল উঠে গিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। নিজের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ভাবতে লাগল…. রোদ্দুরের জন্য এত মন খারাপ, এত চিন্তা কেনো তার? বিয়ে হলেই কি এইরকম হয়? যখন তাদের বিয়ে হয়েছিল তখন দু’জনের পরিস্থিতি অদ্ভুত ছিল। কেউ মানতে পারছে না, পরিবারের সদস্যরা চির শত্রুকে চিরতরে মিলিয়ে দিতে চাচ্ছে। তারপর ঢাকা থাকা অবস্থায়’ও রোদ্দুরের সাথে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ দিকে যাচ্ছিল। দাদি একদিন বলেছিল, ‘পুরুষ মানুষের সংসারে মন সহজে লাগে না। একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নে। বাচ্চা এমন একটা জিনিস, যে শক্ত করে বেঁধে রাখে।’
কিন্তু ঝিলমিলের এই কথাটা পছন্দ হয় নাই। বউয়ের প্রতি মন না থাকলে তার বাচ্চার প্রতি টান আসবে কি করে?
.
রোদ্দুর এই যাত্রায় ঝিলমিলকে দেওয়া কথা রাখতে পারল না। এইজন্য অবশ্য তার বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই। অপরাধীদের যে ধরা গেছে, এটাই অনেক। সবাইকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। রোদ্দুর বাড়ি ফিরে এলো। একে একে যখন সব ধরা পড়েছে তখন নাটের গুরু ধরা পড়তেও খুব বেশি সময় লাগবে না। রোদ্দুর ফিরে এসে ঝিলমিলের খোঁজ করতেই দেখল, ও ঘুমিয়ে আছে। এই অসময়ে ঘুমাতে দেখে ডেকে তুলল। ঝিলমিল রেগে গেল। কিছু বলতে যাবে ওমনিই রোদ্দুর পকেট থেকে দুটো চকোলেট বের করে হাতে ধরিয়ে দিল। ব্যস, হাসি ফুটে গেল তার মুখে। রোদ্দুর বলল, ‘আজকে সারাটা দিন ঘরের মধ্যে নতুন বউয়ের মত করে পড়ে ছিলি। এখন আয়, বসার ঘরে সবাই আছে।’

রোদ্দুর ঝিলমিলের হাত ধরে নিয়ে এলো। বাড়ির বড়রা সবাই উপস্থিত ছিল এবং কোনো জরুরী বিষয়ে সিরিয়াস মুখ করে কথাবার্তা বলছিল। ঝিলমিল আর রোদ্দুর ঘরে ঢুকতেই সকলে হঠাৎ একসাথে চুপ করে গেল।
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫৭১

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩৪]
~আফিয়া আফরিন

আমাদের সমাজে জাজমেন্ট করার লোকের অভাব নেই, সে আমার কোনো দোষ থাকুক অথবা না থাকুক। দোষ না থাকলেও কোনোভাবে দোষী, আর দোষ থাকলে তো মাটির সাথে মেলাতে সময় লাগে না।
ঝিলমিল এতদিন অর্থাৎ দুটো দিন নিখোঁজ ছিল, কোথায় ছিল, কীভাবে ছিল, কার সাথে ছিল, কী অবস্থায় ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে তানিশাকে নিয়েও। তার উপর ও একটা অবিবাহিত মেয়ে! ভবিষ্যতে এইসব কাহিনীর জন্য ওর বিয়ে হবে কিনা এসব নিয়েও চিন্তা-ভাবনার শেষ নেই। তাদের এতই মাথাব্যথা! বাড়ির মানুষ ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নাই অথচ সকাল সকাল পাশের বাসার এক আন্টি এসে ঝিলমিলকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে, ‘কিরে তোদের গায়ে-টায়ে হাত দিয়েছিল? বাবা, কী কাহিনী। আজকালকার যুগ-জামানা খারাপ। তোদের নিয়ে কী যে টেনশনে ছিলাম। তাও ভালোভাবে ফিরে এসেছিস এই অনেক। থাক, এসব নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না। তোর তো বিয়ে হয়েছে, এসব কথা স্বামীকে যেনো গড়গড় করে বলে দিতে যাস না। আমার তো চিন্তা হচ্ছে, তানিশাকে নিয়ে। মেয়েটার কি হবে বলে তো? আহারে।’
এই আহারে, উহুরে শুনতে শুনতে ঝিলমিল বিরক্ত হয়ে গেল। গতরাতে বাড়ির সবাই মানুষের কথাবার্তা নিয়েই আলোচনা করছিল। তারা যে এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিবে না, তা তারা আগে থেকেই ধারণা করেছিল। কিন্তু ওদের সামনে প্রকাশ করে নাই। লাভ কি হলো? ঝিলমিল ঠিকই জেনে গেল। তানিশা এখনও নিজের ঘর থেকে বের হয় নাই বলে রক্ষা। কিন্তু কতক্ষন? এরা তো ছাড় দিবে না। কথা শোনানার জন্য এবং আলগা পিরিতের প্রলেপ লাগানোর জন্য টেনে হিঁচড়ে হলেও বের করবে।
এমনিতেই এসব নিয়ে নিজের মন-মেজাজ খারাপ, তারমধ্যে মানুষের এত কথা শুনতে কার ইচ্ছে করবে? শুধু ভদ্রতার খাতিরে মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। নয়তো কখনো এসব পরোয়া করে?
ঝিলমিল চেয়েছিল এই ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রাখতে। মানুষ যা বলবে তাই এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলবে। কিন্তু তার উপায় কোথায়? বাড়িতে এসে দাদিকে পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাতনিদের অবস্থা কেমন এখন?’
ঝিলমিলের মা ভীষণ ভেঙ্গে পড়লেন এসব শুনে। নীলিমা এসে বলল, ‘এসব বোধহয় এখনও রোদ্দুরের কানে পৌঁছায় নাই। যার বিয়ে তার হুঁশ নাই আর পাড়াপড়শির ঘুম নাই দেখলে দুনিয়া উলটপালট করে ফেলবে। সবকিছু মিলিয়ে ছেলেটাও ডিস্টার্ব। সকালে বলছিল, কাল ঢাকা ফিরে যাবে। ওর সামনে যেনো বাড়িতে ভুলেও এসব কথা না হয়। বাহিরের মানুষ যে যা বলে বলুক, বাড়িতে সবাই ঠিক থাকলেই তো হলো। তানিশা এখনও ভয় পেয়ে আছে। রিমঝিমকে বলেছি, ওর কাছাকাছি থাক সবসময়। ওই মেয়েটা যদি একবার এসব কথা শোনে ওর মনের অবস্থা কেমন হবে ভাবতে পারছ!’

ঝিলমিলের কাছে সব অসহ্য লাগছিল। ইচ্ছে করছে, সবকিছু ছেড়ে কোথাও চলে যেতে যেখানে মানুষের কোলাহল নেই! রোদ্দুর হাসানকে সকালবেলা বেরিয়েছে, সম্ভবত থানায় আছে। এই ঝামেলাটা মিটমাট করতে পারলেই স্বস্তি। মাথায় একটা বোঝা হয়ে চেপে আছে। ঝিলমিল ভেবেছিল, বাড়ি আসার পর শান্তি পেয়েছে। মনটা শান্ত হয়েছে। কিন্তু শান্তি তার কপালে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মা এসেছিল, কিন্তু সে একা থাকার কথা বলে এড়িয়ে গেছে। মা আর কী বলবে? হয়তো শান্ত্বনা দিবে দু’এক কথা বলে। আর এখন তো শান্ত্বনার বাণী শুনতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
রোদ্দুর বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পর। হাসানের কাজ ছিল, যাওয়ার তাড়া ছিল তাই ওকে বাহে তুলে দিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরেছে। বসার ঘর পার হওয়ার সময় কাউকে দেখল না। এমনিতে এই সময় বাবা-চাচারা বাসায় থাকে, সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডা বসে বাসায়। রোদ্দুর চা খাওয়ার জন্য’ই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। এই ঘরে কাউকে না দেখে হতাশ হয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ঘরে গিয়ে ঝিলমিলের দেখা পেল। সে এখন এই ঘরেই থাকছে‌। আগে তো রোদ্দুরের ঘরের আশেপাশে যাওয়ার’ই সাহস পেত না, আর এখন এখানে এসে রাজত্ব কায়েম করছে। রোদ্দুর যখন ঢাকা থেকে এখানে আসত তখন’ই এই ঘরের দরজা খোলা হতো বাদবাকি সময় সে নিজেই লক করে রাখত। মাঝে মাঝে মেজো চাচি গিয়ে পুরো ঘরটা পরিষ্কার করে দিতেন। রোদ্দুর ঘরে ঢুকতেই ঝিলমিল বেরিয়ে যাচ্ছিল। রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘কি হলো কোথায় যাচ্ছিস?’

ঝিলমিল কাটা কাটা কণ্ঠে জবাব দিল, ‘ব্যস্ত মানুষ তুই। এখন নিশ্চয়ই ফোনের মধ্যে ডুবে যাবি নয়তো অন্যকিছু করবি, আমি এখানে থেকে কী করব? আমার বোবার মত বসে থাকতে ভালো লাগবে না।’

‘থাক এখানেই। কাল তো চলে যাচ্ছি। তুই তো আরও কিছুদিন থাকবি এখানে। এখন অবশ্য সমস্যা নাই, সব সমস্যা মোটামুটি মিটেই গেছে। তবুও আরেকটু সাবধানে থাকার চেষ্টা করিস।’

ঝিলমিল ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘ও আচ্ছা চলে যাবি? ভালোই তো। আমাকে বলছিস কেন? আমি শুনে কি করব? আর আমি তো এখানেই থাকব। শশুর বাড়ি না আমার? দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেলেও তো শশুর বাড়িতেই থাকতে হবে। তুই যেনো খবরদার আমাকে আর নিতে আসিস না। আমি তোর সাথে যাব না। তুই গিয়ে একলা একলা থাক, মনমতো যা ইচ্ছে কর। বন্ধু-বান্ধব, আর কে কে যেনো আছে না? গল্প করিস, আড্ডা দিস। সম্ভব হলে ওদের সাথে ওখানেই থেকে যাস। বাড়িতে ফেরার কি দরকার? বাড়িতে আসিস কি জন্য? ঘুম? সেটা তুই ফুটপাতে বসে শুয়েও ঘুমাতে পারবি।’
ঝিলমিল এতগুলো বলে থামল। রোদ্দুর কিছুটা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঝিলমিলের কণ্ঠ শুনে মনে হয়, রাগ করে কথাটা বলছে। কিন্তু চেহারা আবার অন্য কথা বলে! রোদ্দুর বোঝার আগেই ঝিলমিল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল বুঝতে পারছিল না, কি করবে! অন্যসময় হলে শিউলিদের বাসা থেকে ঘুরে আসতো, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নানারকম লোকে নানারকম কথা বলছে।
গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে ছাদে এসে দাঁড়াল। চাঁদ তার রূপালি আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়েছে প্রকৃতি। আশেপাশে সবখানে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে আল্পনা আঁকছে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। শিশিরের শব্দ পাওয়া যায় কান পাতলে। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না— অথচ মনপ্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। উল্টোদিকে গেলে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদীটাও দেখা যাবে। ঝিলমিল পেছন ফিরতেই রোদ্দুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। আচমকা ভয় পেল। কখন যে বিড়ালের মত টিপে টিপে এসে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে! ঝিলমিল রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বলল, ‘ফলো করছিস? লাভ নেই।’

‘একা ভালো লাগছিল না।’

‘বাবাহ! আগে তো একলাই ছিলি। তখন তো কোনো মানুষজন সহ্য করতে পারতি না।’

‘এখনও পারি না…. সবাইকে ভালো লাগে না। সবার সঙ্গ ঠিক উপলব্ধি করতে পারি না।’

‘আমি মানুষ হিসেবে ভীষণ বোরিং। আমার সঙ্গও উপলব্ধি করতে পারবি না। যারা মজা করে কথা বলে, তাদের সাথে কথা বলে শান্তি পাওয়া যায়। আমি এত রং রসিকতা জানিনা‌। আমি শুধু ঝগড়া করতে জানি।’

রোদ্দুর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তোর মন খারাপ?’

‘হুমমমম…. অনেক বেশি।’

‘কারণ?’ রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল।
ঝিলমিল রোদ্দুরের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল অজান্তেই। কাঁধে মাথা রাখল। আচমকা রোদ্দুরের হাত চলে গেল, ঝিলমিলের কাঁধে। ওকে খুব আলতো করে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে নিল।
ঝিলমিল বলল, ‘আমার জীবনটা কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল। যা হচ্ছিল সবটাই তো মেনে নিয়েছি। মনের সব দুঃখগুলোকে একটা কুঠুরিতে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম, যেনো সময়-অসময়ে তা মনের আনাচে কানাচে কিছুতেই ছড়িয়ে যেতে না পারে। একটা সামান্য ঘটনা… আমার কাছে খুব সামান্যই মনে হয়েছে; সেটাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মানুষ কী বানিয়ে ফেলছে। এখন নিজের’ই মনে হচ্ছে, মহাপাপ করে ফেলেছি। আমি এই মহাপাপের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই। এই বার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।’
ঝিলমিলের মুখে এই কথা শুনে রোদ্দুর ঠিকই বুঝতে পারল, সে কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল।
রোদ্দুর বলল, ‘তোর সাথে সবাই আছে, বাড়ি সবাই। কারো কথায় কান দেওয়ার কি দরকার? মানুষের জীবন কয়দিনের? বাঁচতে হলে একটু ভালোভাবেই বাঁচা উচিত, নিজের কথা ভাবা উচিত।’

আজ মনে হয় সে রোদ্দুরের ভেতরকার আরেকটা রূপ দেখতে পেল। ওর কথাটা ভীষণ অন্যরকম শোনাল, এতদিনের সাথে মিল নেই। অনেক আদুরে আর আহ্লাদে ভরপুর। ওর রাগচটা স্বভাবের পর এমন কথা শুনে ঝিলমিল সব কথারা বাঁধন হারা হয়ে গেল। সে রোদ্দুরের কাঁধে মাথা রেখেই বলল, ‘কিন্তু আমার যে ভালো লাগে না।’

রোদ্দুর এইবার ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এক জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই কি ভালোলাগার হয়ে থাকে? আমি তো একটা বিরক্তিকর মানুষ, সবসময় রাগ করি, ধমক দিই। আমাকে কি ভালো লাগে? আমি কি ভালোলাগার মত মানুষ? তাও তুই আছিস তো আমার সাথে! তুই তো বাড়ির সবার আদরের। বাইরের লোকের কথায় কি আসে যায়? তোর কোনো বিপদ-আপদে ওরা এগিয়ে আসবে না। ওরা তখন আগাবে যখন তোর দোষ ধরতে পারবে‌। তোর বাড়ির মানুষ সব পরিস্থিতিতে তোর পাশে থাকবে। তাই ভুলে যা তাদের কথা।’
ঝিলমিল জানে, মানুষের এসব কথা কানে তোলা মানে নিজেকে ছোট করার সুযোগ তাদের করে দেওয়া। সে সুযোগ না দিলে, কথার পিঠে দু’টো কথা শুনিয়ে দিলে, তাদের কখনো সাহস হতো না এসব বলার। কিন্তু মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে চুপ করে যেতে ইচ্ছে করে…. সব সময় কথা বলতে ভালো লাগে না, তর্কে জড়াতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু যে দোষের বোঝা তাকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই দোষের বিন্দু পরিমাণ ভাগের অংশীদার সে নয়।
সে কিছুটা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, ‘সবই ঠিক আছে, তবুও আমাকে ওসব বাজে কথা শুনতে হচ্ছে তো? মানুষের বাঁকা দৃষ্টি সহ্য করতে হচ্ছে!’

রোদ্দুর হঠাৎ করেই ওকে নিজের বাহুবন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলল। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দুনিয়ার সব কিছু ভুলে যা, মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেল। মনে কর কিচ্ছু হয় নাই। কোথাও কেউ নেই। এই যে পূর্ণিমা রাত, জোৎস্নার আলো— শুধু উপলব্ধি করে যা নিজেকে আর আমাকেও। প্রতি মুহূর্তে আমরা মনে হচ্ছে, আমি কী জ্বালায় ভুগছি। বুকের ভেতর যন্ত্রণায় ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি কেনো! কিন্তু এই কেনোর সঠিক উত্তর জানতে পারছি না। সবটা তোর জন্য। আমার ভেতরকার অসহনীয় হাহাকার, যন্ত্রণা, মায়াবী সত্ত্বা… সব মানে সব! আমার মনে হয়, আমি জীবনে প্রথমবারের মত ভালোবেসে ফেলেছি। প্রথমবার, হ্যাঁ প্রথমবার! আগে যেটা ছিল ওটাকে ভালোবাসা বলে না, ওটা আমার একরোখা জেদ। জেদ আর ভালোবাসা কখনোই এক আকাশে ঝলঝল করতে পারে না। কীভাবে বোঝাব, তুই আমার জন্য কী!’

ঝিলমিল থমকে গেল অনেকটা। হুঁশ হতেই সরে দাঁড়াল। রোদ্দুর’ও ঝিলমিলের এই পরিবর্তন টের পেয়ে নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে দিল। ঝিলমিল কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি নিচে যাচ্ছি।’
রোদ্দুর মাথা নাড়াল‌। ঝিলমিল চলে গেল। রোদ্দুর কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ঝিলমিল যেই আশ্চর্যজনক বাঁধনে তাকে বেঁধে ফেলেছে ঠিক সেই বাঁধনে ঝিলমিলকে বেঁধে ফেলার জন্য সে অপেক্ষা করবে…. অপেক্ষা করতেই হবে তাকে।
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫১৪

#ঝিলমিল_রোদ্দুরে🖤 [পর্ব-৩৫]
~আফিয়া আফরিন

রোদ্দুর বরাবর’ই তার কাজের প্রতি খুব অনুগত। স্কুল জীবন অথবা কর্ম জীবন যেখানেই হোক না কেন, সজ্ঞানে কখনোই ফাঁকিবাজি করে নাই। এই কাজ কাজ করে বাড়ি আসার পরে না খুব একটা। এই কাজের জন্য নিজের বাড়ি-ঘর ছেড়ে, মা-বাবা, আপনজন ছেড়ে পড়ে আছে। আজ ঢাকা ফিরে যেতে হবে, কেনো যেনো যেতে ইচ্ছে করছে না। ঝিলমিলকে এখানে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছে না তারচেয়েও বড় কথা তার ঝিলমিলকে রেখে যেতেই ইচ্ছে করছে না। ওইদিকে গতকাল ওয়ান এন্ড অনলি শশুর মশাই বলে দিয়েছেন, ‘তোর যখন কাজের তাড়া আছে, তুই বরং যা। ঝিলমিল কিছুদিন আমাদের এখানেই থাকুক। ওর তো এখন পরীক্ষা শেষ, পড়াশোনা এমনিতেও করতে চায় না; তারচেয়ে বাড়িতে মায়ের কাছে থাকুক কিছুদিন।’
রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ হেসে সায় জানিয়েছিল। শশুর মশাইকে বোঝাবে কি করে, তার বুকের ব্যথা? ইশশশ, এ মানুষগুলো কোনোদিন তাকে বুঝবে না। শশুর বাড়ি থেকে এত কষ্ট পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে…. নাহ একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে। সবসময় দেখে এসেছে শশুর বাড়িতে জামাইরা থাকে আদরে, আহ্লাদে, সকলের চোখের মণি হয়ে। রোদ্দুর মনে হচ্ছে, এই বাড়ির ছেলে হয়ে যতটা আদর পেয়েছে জামাই হিসেবে এখনও পায় নাই। পাবে কি করে? বিয়েটাই তো হয়েছে কোনোরকম!
রোদ্দুর দাদির কাছে গিয়ে ইয়া বড় অভিযোগের ঝুলি খুলে বসল, ‘তোমরা শুধু আমাকে মুখে মুখেই ভালোবাসো। একটা বিয়ে দিলে দায়সারাভাবে। আমি এসব মানব না। তুমি আর তোমার ছেলেরা মিলে আমার সাথে বেইমানি করেছ। এই বাড়ির নাতজামাই হিসেবে মান্য করো না আমকে। যে যেভাবে পারছে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। কিছু একটা হলে এমনকি তোমার পান থেকে চুন খসলেও তুমি “রোদ্দুর” বলে চেঁচিয়ে উঠছ! বলো আমাকে, মানে হয় এসবের? আমার সাথে কি এসব অন্যায় হচ্ছে না?’
তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘তোমরা তো আমাকে পাত্তা দেও না সাথে আমার বউ’ও দেয় না। এমন ভাব করে মনে হয়, চেনে না। ছিঃ, জীবনে কোনোদিন ভাবতে পারি নাই এতটা পাত্তা হীনতায় ভুগব আমি।’
দাদি রোদ্দুর কথা শুনে দফায় দফায় হাসলেন। রোদ্দুর রেগেমেগে চলে গেল।

দিন এতটাই ছোটো, কীভাবে যে সময় চলে যাচ্ছে বোঝাই যায় না। রোদ্দুর যেতে চেয়েছিল সন্ধ্যার পর, তাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডি করে রাখল। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর একবার ঝিলমিলের সাথে দেখা হয়েছিল মাত্র, কোনো কথা হয় নাই। এই দুপুর পর্যন্ত মহারাণী কোথায় রয়েছেন কে জানে? কাল রাতের কথাগুলো কীভাবে যে নিয়েছে! রোদ্দুরের জানামতে, সে খারাপ কিছু বলে নাই। কিছুদিন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, নিজের অনুভূতির সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করেছে বলা চলে কিন্তু এখন সেসব দ্বিধা-ফিধা উড়ে গেছে। মনের মধ্যে যা ছিল, তা সৎভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে। তাই বলে ঝিলমিলকে আড়ালে লুকিয়ে থাকতে হবে? ওর খোঁজে ছাদে গেল, চিলেকোঠার ঘরে গেল একবার এসে রান্নাঘরেও উঁকি দিল, কোথাও পেল না।
রিমঝিমকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঝিলমিল কোথায় বলতে পারিস?’

‘হুমম… আমরা তানিশার ঘরে আছি। কেনো ভাইয়া কিছু বলবে?’

‘ঝিলমিলকে ঘরে পাঠিয়ে দে।’

‘আপু যাবে না মনে হয়।’

রোদ্দুর খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, ‘মানে কি? কি সমস্যা ওর?’

রিমঝিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানিনা।’
তারপর রোদ্দুর নিজেই ওই ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজায় নক করে কয়েকবার ঝিলমিলকে ডাকল। ঝিলমিল ওপাশ থেকে বলল, ‘কি হয়েছে? চেঁচামেচি করছিস কেনো? ধীরে সুস্থে কথা বলা যায় না?’

‘বের হয়ে আয়।’ ঝিলমিল ঘর থেকে বের হতেই রোদ্দুর পুনরায় বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’

‘কোথায়?’

‘ঢাকা।’

‘ওহ আচ্ছা। কখন যাবি?’

রোদ্দুর চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল, ‘এখন এবং এই মুহুর্তে।’

ঝিলমিল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে বলল, ‘এখন কেনো? মাত্র দু’টো বাজতে চলেছে। না খেয়ে কোথায় যাবি আজব! এই খা খা রোদের মধ্যে তোকে বের হতে দিবে কেউ? খেয়েদেয়ে রেস্ট কর, তারপর সন্ধ্যার পর যাস।’

‘আমি কিন্তু সত্যি চলে যাব ঝিলমিল।’

‘তো যা…. আমি কি বাঁধা দিয়েছি? সাবধানে যাস। আর হ্যাঁ, ঠান্ডার মধ্যে সন্ধ্যার পর বাহিরে…..’

রোদ্দুর হাত উঠিয়ে ঝিলমিলকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বলল, ‘থাক, আপনাকে এত দরদ দেখাতে হবে না। এতদিন তো আপনি ছিলেন না, আমি নিজেরটা নিজেই দেখেছি। এখনও পারব। দয়া করে আমাকে যে জ্ঞানটা দিলেন ওটা নিজে আয়ত্ত্ব করুন। আপনার সাথে আমার আর হয়ত দেখা হচ্ছে না কারণ আমি ঢাকা ফিরে গেলে, বেঁচে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে এই বাড়ি পা রাখব না। আসি, আল্লাহ হাফেজ।’
ঝিলমিল ওর কথা শুনে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
রোদ্দুরের এত রাগ হলো যা বলার মত নয়। কেউ জানে না, কোনোদিন জানতেও পারবে না পৃথিবীপৃষ্ঠের চেয়েও বড় ভূমিকম্প তার ভেতরে হয়েছিল। রোদ্দুর কাউকে কিছু না বলে দুপুর নাগাদ বেরিয়ে পড়ল।
ঝিলমিল দুপুরে খাওয়ার সময় রোদ্দুরকে অনুপস্থিত দেখে খোঁজ করতে ঘরে গেল। গিয়ে দেখল ওর ঘর লক করা। ঝিলমিল আশেপাশে খুঁজে দেখল, কোথাও পেল না। রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা জানো রোদ্দুর কোথায়? ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

বড় চাচি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললেন, ‘বাব্বাহ! আজকাল রোদ্দুরকে চোখে হারানো হচ্ছে বুঝি খুব। একটু আগেই তো দেখলাম ওইদিকে, খুঁজে দেখ।’

‘আমার মনে হয় ও চলে গেছে। আজকে না ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল।’

নীলিমা ঝিলমিলের কথা শুনে এগিয়ে এসে বললেন, ‘না বলে চলে যাবে তাই? আমাকে তো সকালেও বলল সন্ধ্যার পর যাবে। ওর ঘরে গিয়ে দেখ, শুয়ে আছে বোধহয়। যা গিয়ে ঢেকে নিয়ে আয়, সবাই খেতে বসেছে।’

ঝিলমিল ধীর কণ্ঠে বলল, ‘ওর ঘর তো লক করা দেখলাম। আচ্ছা দাঁড়াও, আমি ফোন দিয়ে দেখি। তোমাদের ছেলের ইদানিং ঢং বেড়েছে, কথায় কথায় রাগ করে মানে এমন রাগ যে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। কিছু বলতে পারো না অভদ্রটাকে?’

বড় চাচি ঝিলমিলের থুতনিতে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা কি বলব? আমাদের সাথে কি এর রাগ-অভিমান করে নাকি। করে তোর সাথে, ওর বউয়ের সাথে। তুই’ই বলিস আবার বলতে বলতে এত বলিস না যে বিরক্ত হয়ে যায়।’
ঝিলমিল কোনো কথা না বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদ্দুরকে ফোন দিল। পরপর কয়েকবার ফোন করার পরেও সে ফোন রিসিভ করল না। অনেকক্ষণ বাদে একটা টুংটাং আওয়াজে একটা মেসেজ এলো। ঝিলমিল দেখল রোদ্দুর লিখেছে, ‘কারো ফোন রিসিভ করার মত সময় আমার কাছে নাই। কথা বলতে চাচ্ছি না, সময় নাই। ব্যস্ত আছি। দয়া করে আপনার শাশুড়ি মা’কে বলে দিয়েন তার একমাত্র ছেলে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করার মানুষ দুনিয়াতে ওই একজনে’ই আছে।’
ঝিলমিল মেসেজের রিপ্লাই দিল না আর ফোন’ও করল না। সবাইকে জানিয়ে দিল, রোদ্দুর ফিরে গেছে।
রোদ্দুর আর ঝিলমিলের মাঝে মান-অভিমানের পর্ব বাড়ল বৈ কমল না। ঝিলমিল তো আর ফোন করলই না রোদ্দুর’ও করল না। তবে ঝিলমিলের’ও এখানে মন টিকছে না। কিছু করারও নেই তার। গতকাল তানিশা চলে গেছে ওর মামা বাড়িতে। ঝিলমিলের আলস্য সময় কাটছে। সেদিন রাতে রোদ্দুরের বলা কথাগুলো মনে দরজায় খুব করে হানা দিচ্ছে।
ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কেমন? ঝিলমিল জানা নেই। ছোট্ট এই জীবনে নিজের আপনজন ছাড়া কাউকে ভালোবাসে নাই, প্রয়োজনও পড়ে নাই। কিন্তু রোদ্দুর যে বলল ভালোবাসার কথা! ওর অবর্তমানে ওর প্রতি ভেতর থেকে দমবন্ধ করা একটা টান অনুভব করছে; এ মানসিক সংযুক্তিকে কি ভালোবাসা বলা যায়! ভালোবাসা এতই সহজ? এত তাড়াতাড়ি হয়ে যায়? না না, সম্ভব নয়। রোদ্দুরের সাথে তো আগে অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল। তার ভাষ্যমতে ভালোবাসা ছিল না কিন্তু ঝিলমিলের ভাষ্যমতে ভালোবাসা না থাকুক, প্রেম তো ছিল। রোদশী আপুর বিয়েতে এসেও গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে পারছিল না বলে কী উতলা হয়ে উঠেছিল। ওর জন্য একটা আংটিও কিনেছিল, যদিও সেটা বর্তমানে ঝিলমিলের কাছেই রয়ে গেছে।
তাও খারাপ লাগছে। সেই খারাপ লাগা থেকেই রোদ্দুরের কাছে মেসেজ পাঠাল, ‘আমাকে নিয়ে যা।’

রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিল, ‘কাউকে নিয়ে আসা আমার ডিউটি না। আপনার আব্বাজান আমাকে বেতন দিয়ে রাখে নাই। যদি আসার প্রয়োজন মনে করেন, তবে আপনার বাসায় আপনার জন্য অনেক অভিভাবক আছে তাদের কাউকে বলে সাথে নিয়ে চলে আসেন।’
হুম… এটা তো ঝিলমিলের মাথায়’ই ছিল না। ছোট চাচ্চুকে বললে, সাথে সাথে দিয়ে আসবে‌। কিন্তু বলাটাই তো রিস্ক। এমনিতেই বিয়ের পর কী অদ্ভুত অদ্ভুত কথার সম্মুখীন হয়েছে, এখন যদি আবার শোনে রোদ্দুরের ওখানে যাওয়ার জন্য তার মন কেমন কেমন করছে; তবে তো আর রক্ষা নাই। এখন বেলা তিনটা বাজে। ঝিলমিল মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমার ইমারজেন্সি ঢাকা যেতে হবে। খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাসগুলো মিস হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি আজ আমার ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?’

শিমু রাজি হলেন না। তার কথা হচ্ছে, গেলে কাল সকাল সকাল যাবি। এটা যাওয়ার একটা সময় হলো? কিন্তু ঝিলমিল কোনো বাঁধা বারণ শুনল না, সে যাবেই। ছোট চাচ্চুকে রাজি করাল। বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিল। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিল। যানজটের কারণে ওখানে পৌঁছাল সন্ধ্যার পর। রোদ্দুর তখন বাড়ি নেই। ছোট চাচ্চুকে যখন বাড়ি ফিরতেই হবে, তাই ঝিলমিল তাকে পাঠিয়ে দিয়ে দরজায় অপেক্ষা করতে লাগল। নিশ্চয়ই চৌরাস্তার মোড়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ায় ব্যস্ত সে। গেলেই পাওয়া যাবে কিন্তু ঝিলমিলের যেতে ইচ্ছে করল না। সে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরকে ফোন করল। রোদ্দুর ফোন রিসিভ করল। ঝিলমিল বলল, ‘বাসায় এসেছিস?’

‘না।’

‘কখন আসবি?’

‘কেনো কোনো দরকার ছিল?’

‘দরকার? উমমম…. ছিল তো একটু।’ ঝিলমিল দুষ্টুমির ছলে বলল।

‘বল।’

‘আগে বাড়ি ফিরে যা। তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ ওয়েট করছে।’

‘দেরি হবে।’

ঝিলমিল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফফফ কত দেরি করবি? আমি এখানে কতক্ষণ পর্যন্ত ওয়েট করছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেল। এতদিন তো ছিলি খুব রাগ করে এখন ফিরে আসার পরেও বাহিরে দাঁড়া করিয়ে রাখবি?’

‘তুই এখানে? কখন এসেছিস?’ রোদ্দুর বিস্ময় চেপে প্রশ্ন করল। ঝিলমিল রোদ্দুরকে সবটা বলতেই সে দ্রুত অর্থাৎ দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল। দরজা খুলে দিল। ঝিলমিল ঘরে ঢুকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো ঘর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। সব ঠিকঠাক দেখে বলল, ‘আমি আবার অপরিষ্কার পছন্দ করি না। ঘরবাড়ি ঠিক করে রাখার জন্য ধন্যবাদ।’

রোদ্দুর বলল, ‘তুই আসবি আমাকে আগে বলিস নাই কেনো?’

‘বলতে হবে কেনো? এই ঘরের অর্ধেক দাবিদার আমি নিজেও, সেই অধিকারে যখন তখন নিজের ঘরে আসতেই পারি। তোর অনুমতির কি দরকার?’

‘সেটা বলি নাই। কাল-পরশু আমি নিজে গিয়েই তোকে নিয়ে আসতাম। সামনের সপ্তাহে রায়হানের বিয়ে।’

ঝিলমিল আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, ‘ওয়াও! ঠিক সময়ে এসেছি। নিজের বিয়ে খাওয়ার তো সৌভাগ্য নাই তাই অন্যজনের বিয়ে খেয়ে মনে প্রলেপ লাগাই।’
বলতে বলতে ঝিলমিল বারান্দায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। পথে হঠাৎ খাটের কোণার সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নিলেই রোদ্দুর ধরে ফেলল। এক লহমায় ওকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে পারল। ঝিলমিল ভেবেছিল ও পড়েই গেছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির জোর বাড়ল। তারপর নিজেকে এভাবে আবিষ্কার করে ঝপ করে ওর চেহারায় আঁধার ঘনিয়ে এলো। সে টানটান হয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ছাড় আমাকে।’ বলে নিজের কাছে মনে হলো সে বাংলা সিনেমার ডায়লগ পেটাচ্ছে। তাই পুনরায় বলল, ‘এভাবে ধরে রেখেছিস কেনো আমাকে? পড়লে ব্যথা আমি পাব। তোর কি?’

রোদ্দুরের অপূর্ব ওষ্ঠ্যদ্বয়ে মায়াজাল বিছানো হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘আমার কিছু না?’

‘না। হাত সরা। তুই আমার ধারেকাছেও আসবি না।’ রোদ্দুরের দু’হাতের বাঁধনে চটপট করতে করতে বলল ঝিলমিল।

রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে ছেড়েই দিই?’

‘হুমম… বলছি তো।’

‘ঠিক আছে।’ এই বলে রোদ্দুর ঝিলমিলকে ছেড়ে দিল। আর সাথে সাথে সে শূণ্যে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে মেঝেতে ঠাস করে পড়ে গেল।
.
.
.
চলবে…….
কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৬৪৫