#টক_ঝাল_মিষ্টি (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বিয়ের প্রথম দিন শাশুড়ী মা রুমঝুমের হাতে সোনার এক জোড়া বালা পড়িয়ে দিয়ে, তার হাত ধরে বললেন,“তোমাকে বড় শখ করে ছেলের বউ করে নিয়ে আসছি৷ আমার ছেলেকে কখনো কষ্ট দিও না।”
শাশুড়ী মায়ের এই কথা প্রথমদিনই রাখতে পারলে না রুমঝুম। বাসর ঘরে সে শাশুড়ী মায়ের কথাকে অগ্রাহ্য করে নিজের স্বামীকে কষ্ট দিলো। বাসর ঘরে যখন রুমঝুমের স্বামী কঠিন গলায় বললো,“আমার থেকে স্বামীসুলভ আচরণ আশা করবে না। আমি তোমাকে আমার অর্ধাঙ্গিনীরূপে কখনো মানতে পারবো না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।”
রুমঝুমের স্বামী অর্থাৎ সুফিয়ান ফরাজি ভেবেছিলো তার এই কথা শুনে তার নববিবাহিতা স্ত্রী কান্না করে দিবে। অন্তত মন খারাপ করে বসে থাকবে। কিন্তু না। সুফিয়ানকে অবাক করে দিয়ে রুমঝুম তার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। সুফিয়ান হতবাক দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমঝুম সুফিয়ানের চোখে চোখ রাখে। সুফিয়ান বিষ্ময়ের সুরে বলে,“আপনি আমার গালে থাপ্পড় মারলেন?”
“জ্বী।”
রুমের মুখে এমন স্পষ্ট জবাব পেয়ে সুফিয়ান প্রচন্ড রেগে যায়। সে রাগান্বিত গলায় বলে,“আপনার সাহস তো কম নয়। আপনি বাসর ঘরে নিজের স্বামীর গায়ে থাপ্পড় মারলেন?”
“বাহ। এক মূহুর্তে স্বামী হয়ে গেলেন?”
রুমের এমন ব্যঙ্গত্বক কথা সুফিয়ানের রাগ দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয়। সে কঠিন গলায় বলে,“আমি মজা করছি না।”
“আমিও আপনার সাথে মজা করছি না। তাছাড়া আমাদের মাঝে মজা করার মতো তেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই মজা করার প্রশ্নই আসে না।”
রুম প্রতি কথার জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেওয়ায় সুফিয়ান একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে সুফিয়ান শান্ত গলায় বলে,“আপনি কাজটি ঠিক করলেন?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। অন্যায়ের সাথে রুমঝুম সন্ধি করে না। তাই আমি যা করেছি ঠিকই করেছি।”
এই কথা শুনে সুফিয়ান অবাক হয়ে যায়। সে হতভম্ব গলায় বলে,“অন্যায়? এখানে অন্যায় কে করলো?”
“অবশ্যই আপনি।”
রুমঝুমের তৎক্ষনাৎ জবাবে সুফিয়ান ঘাবড়ে যায়। সে সেই মূহুর্তে কথা খুঁজে পায় না। তবে পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“দেখুন আমি কোন অন্যায় করিনি। আমার উদ্দেশ্য যদি অন্যায় করা হতো তাহলে আমি আপনাকে সত্যিটা না বলে বরং সংসার করে যেতাম। কিন্তু আমি তেমনটা চাই না। আপনার সাথে যেহেতু আমার বিয়ে হয়েছে সেহেতু আপনার সত্যিটা জানার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তাই আমি সত্যিটা বলছি। আমার পক্ষে আপনাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আমি এই বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু আমার মায়ের জন্য করতে বাধ্য হয়েছি। আমার আসলে কোন উপায় ছিলো না।”
“বুঝলাম। আপনার মায়ের জন্য আপনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন। আপনি অন্য একজনকে ভালোবাসেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু…।”
“কিন্তু?”
সুফিয়ান জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম খুব শান্ত গলায় বলে,“যেই মূহুর্তে আপনি এই বিয়ের আসরে বসেছেন সেই মূহুর্ত থেকে আপনার এই বিয়েকে সম্মান জানিয়ে মেনে নেওয়া উচিত ছিলো। আমি মানছি আপনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন। কিন্তু এটা বিয়ে। কোন ছেলেখেলা নয়। যেই বিয়ের দায়িত্ব নিতে আপনি পারবেন না সেই বিয়ে কেন করবেন আপনি? যখন আপনি বিয়ে করার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তখন আপনার অতীতের পিছুটান ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। আপনি বাসর ঘরে নিজের স্ত্রীকে বলছেন তাকে আপনি কখনো মেনে নিতে পারবেন না। হাউ ফানি? এখানে কি সার্কাস চলছে? আমাকে জোকার মনে হয়? যে বিয়ে করে নিয়ে আসলাম, এখন একটা বুঝ দিয়ে তাকে ঘরের এককোনে ফেলে রাখবো। স্যরি এত দূর্বল ভাবলে চলবে না। আমি মোটেও তেমন নই। আমার নীতিতে যেটা সঠিক সেটা সঠিক। যেটা ভুল সেটা ভুল। আপনি যদি আমাকে মেনেই না নিতে পারেন তবে আপনার এই বিয়ে করাটা ছিলো ভুল সিদ্ধান্ত। আর যখন বিয়ে করে নিয়েছেন তখন অতীতকে অতীতে ফেলে দিয়ে না আসাটা আপনার ভুল। কিন্তু যেখানে আমি জড়িয়ে আছি সেখানে ভুল করা যাবে না। ভুল করলে শা স্তি পেতে হবে। যেটা আমি আপনাকে দিলাম।”
সুফিয়ান রুমঝুমের কথা যত শুনছে তত অবাক হচ্ছে। সারাজীবন জেনে এসেছে, নতুন বউরা একটু শান্ত থাকে। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারে না। সেখানে এই মেয়ে এত স্পষ্টভাষায় এত কঠিনভাবে কথাগুলো বলে দিচ্ছে। সুফিয়ান সত্যি ভীষণ অবাক হলো। সুফিয়ানের এই বিষ্ময়ের মাঝে রুমঝুম বললো,“আমি সবার মতো নই। যে স্বামী বিয়ের পর মানবে না সেটা শুনে কান্না করে বিছানা ভিজাবো। স্বামীর জন্য বিছানা ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে শোবে। স্যরি সম্ভব নয়। এসব আমার সাথে যায় না। তাই আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আপনার যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমার কোন সমস্যা নেই।”
এই কথা বলে রুমঝুম সত্যি বিছানার ফুল সরিয়ে সেখানে শুয়ে পড়লো। সুফিয়ান রুমের কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখে রুম শান্ত গলায় বলে,“আপনার এই বিয়ে করার আগে নিজের মাকে বোঝানো উচিত ছিলো। যদি বুঝিয়ে থাকেন তবে যখন দেখলেন আপনি ব্যর্থ হচ্ছেন তখন এই বিয়ে করার আগে নিজেকে এই বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা উচিত ছিলো।”
এই কথা বলে রুমঝুম ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে নেয়। সুফিয়ান হতভম্ব চোখে এখনো রুমকে দেখে যাচ্ছিলো। সেই মূহুর্তে তার ফোনটি বেজে উঠলো। সুফিয়ানের বন্ধু নিয়াজ ফোন দিয়েছে। সুফিয়ান ফোনটা ধরে কানে নিতে নিয়াজ বলে উঠলো,“সব বলেছিস? ঐ মেয়ে এখন কান্না করছে বুঝি? দেখ ঘাবড়ে যাস না। ঐ মেয়েকে নরম গলায় কান্না করতে বারণ কর৷ তাকে বোঝা, সবই নিয়তি। একটা সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নিয়াজের এসব কথা শুনে সুফিয়ান বিরক্ত হয়। সে বিরক্তির গলায় বলে,“এই মেয়ে মোটেও তেমন মেয়ে নয়। কান্না তো দূর এক বিন্দু মন খারাপ করলো না। উল্টো আমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।”
“কী!”
নিয়াজ অবাক হয়ে গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে সঠিক শুনলো তো। তাই আবারও জিজ্ঞেস করে,“সত্যি ভাই? ঐ মেয়ে তোর গায়ে হাত তুলেছে?”
“হ্যাঁ। শুধু তাই? যেভাবে কথা বলছিলো। তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে, এ মেয়ে তো? মেয়েদের মধ্যে যে মিষ্টি ব্যপারটা থাকে এরমাঝে সেটা নেই। পুরোটাই টক-ঝাল।”
এই কথা বলে সুফিয়ান বিস্তারিত বলে। এসবের মাঝে রুমঝুম বলে উঠে,“ঘুমের মাঝে এভাবে বিরক্ত করবেন না। ফোনে কথা বলতে মন চাইলে বাহিরে গিয়ে বলুন। আমার ঘুম নষ্ট হলে হাতের পর পাও উঠে যেতে পারে।”
রুমের এমন ঠান্ডা মাথার হুমকি শুনে সুফিয়ান ফোন রেখে যায়। মনেমনে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে,“শুধু টক-ঝাল, এর মুখে তো জন্মের সময় কেউ মিষ্টি দেয়নি। যখনই মুখ খুলে তখনই তেঁতো কথা বের হয়।”
সুফিয়ান নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে। সে হতাশায় মেঝেতে বসে পড়ে। সে হতাশ গলায় বলে,“এই মেয়ের যা হাব, ভাব দেখলাম তাতে তো মনে হয় না এই মেয়ে কয়েক মাস পর আমাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হবে। তাহলে আমার কী হবে? আমার জীবন, আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা। সব শেষ। মা গো এ তুমি আমায় কোন বিপদে ফেললে।”
সুফিয়ান বিরবির করে একমনে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো। রুমঝুম শান্ত এখনো সজাগ। সে সুফিয়ানের বিরবির করা কথাগুলো শুনতে পায়। তাই শান্ত গলায় বলে,“অন্যায় না করলে মুক্তি পেয়ে যাবেন।”
সুফিয়ান অন্যমনস্ক থাকায় রুমের কথা ভালোভাবে বুঝতে পারে না। সে অবাক হয়ে ভাবে,“এই কথাটি আমাকে বলেছে নাকি ঘুমের মাঝে কথা বলছে?”
সুফিয়ান রুমের ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস আছে ভেবে কথাটিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। সে মেঝেতে বিছানায় করে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে তার এবং স্নেহার পুরনো ছবিগুলো দেখছিলো।
’
’
চলবে,