টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-০৩

0
1

#টক_ঝাল_মিষ্টি (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

সারারাত চিন্তায় সুফিয়ানের ঘুম হলো না। সকালে উঠে রুমঝুম ঘরের বাহিরে বের হওয়ার আগে তার ডান হাতটি ধরে ফেলে সুফিয়ান। রুমঝুম কৌতূহলী চোখে সুফিয়ানের দিকে তাকাতে সুফিয়ান অনুরোধের গলায় বলে,“আমার আম্মা অসুস্থ। দয়া করে কিছু বলবেন না। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমি বাধ্য ছিলাম। আমি জানি আপনি আমার বাধ্যবাধকতা বুঝবেন না। তবুও বলছি দয়া করে আমার অনুরোধটা রাখুন।”

রুম জবাব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বাহিরে বের হয়। সুফিয়ান রুমের এমন ব্যবহারে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সেও ঘর থেকে বের হয়। সুফিয়ান বের হয়ে দেখে রুমকে পাশের বাসার এক ভাবী অন্যঘরে নিয়ে গেছে। সেখানের বিছানায় বসিয়ে তারা সবাই গল্প করছে। গল্প অবশ্য বাসর ঘর নিয়েই চলছে। সুফিয়ান মনেমনে ভীষণ ভয় পায়। রুম যদি রাতের ঘটনার সত্যি বর্ননা করে। সেই ভয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো সুফিয়ান। সেই মূহুর্তে শুনতে পায় পাশের বাসার ভাবী বলছে,“কি গো নতুন বউ, গোসল করোনি?”

এই প্রশ্নের জবাব রুমকে দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে অন্য এক ভাবী বলে,“আরে বুঝছেন ভাবী। আমরা হলাম পুরনো জামানা লোক। আমাদের বিয়ে হয়েছে সেই কবে, আমাদের সময় কত নিয়ম-কানুন ছিলো। এখন তো নেই। আজকালকার মেয়েরা অনেক মডার্ন। তাদের এসব গোসল করার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ এটা যে কতবড় একটি বিধান….।”
তার কথা শেষ করার পূর্বে রুম স্পষ্টভাষায় কন্ঠ কিছুটা নমনীয় করে বলে,“প্রথমে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আমি আপনাদের কথার মাঝে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু স্যরি আমার পক্ষে চুপ থাকা সম্ভব হলো না। বিধান হোক বা নিয়ম যাই হোক আপনাদের কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি। যেহেতু আমাদের মাঝে তেমনকিছু হয়নি সেহেতু আমি গোসল করার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“কি! তোমাদের মাঝে কিছু হয়নি? কেন? তোমার কোন সমস্যা আছে?”
এই মহিলার এমন কথা শুনে রুম প্রচন্ড পরিমান রেগে যায়। তবে নিজেকে সামলে নমনীয় কথায় বলে,“অর্ধেক কথা শুনে নিজের মনমতো বিবেচনা করে নেওয়া একটি মিথ্যের চেয়ে ভয়াবহ। সেজন্য আমি অনুরোধ করবো আমার কথাটি শেষ অব্দি শুনতে।”
রুমের এমন স্পষ্ট জবাবে ভাবীরা অবশ্য কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়। অন্যদিকে দরজার পাশে দাঁড়ানো সুফিয়ান ভয়ে শেষ। এই বুঝি রুম সব বলে দিলো। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রুম বলে,“যেহেতু আমাদের পারিবারিক বিয়ে সেহেতু আমরা নিজেদের চিনতে, জানতে সময় নিচ্ছি। স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্ক শুধুমাত্র চাহিদায় সীমাবদ্ধ নয়, এমন ভাবনা নিছকই ভ্রান্ত ধারণা। সেসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। একটা মানুষ আমাকে যদি নাই চিনে তাহলে সে আমাকে ভালোবাসবে কিভাবে? আমার বন্ধু না হয়ে উঠলে সে আমার চাওয়া বুঝবে কিভাবে? নারী হিসাবে আমি স্বামীর থেকে যে সময়, যে ভালোবাসা চাই সেটা তাকে বোঝানোর জন্য হলেও তাকে আমাকে চেনাতে হবে। আর আমি সেই সময়টা তার থেকে নিয়েছি। সেও মেনে নিয়েছে।
আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। আর হ্যাঁ সত্যি তাই, দিন বদলে গেছে। সবকিছু উন্নত হচ্ছে। আপনার ভাষায় মডার্ন। তাই আপনাদের উচিত মজার ছলে সেইসব প্রশ্ন না করা যা বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যক্তিগত কিছু মিন করে। ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্তিগত থাকা উচিত। এটাকে নিয়ে মজা নেওয়াও কোন বিধান বা নিয়মে নেই।”

রুমের এই কথাগুলো ভাবীদের পছন্দ নাহলেও দরজার পাশে দাঁড়ানো সুফিয়ানের খুব পছন্দ হয়। ভাবীরা তো এসব শুনে মনেমনে রুমঝুমকে অনেক বকা দিতে থাকে। রুমঝুম বুঝতে পেরে বলে,“বেয়াদব হলে যদি সত্যি কথা বলার সৎ সাহস পাওয়া যায় তবে বেয়াদব হওয়া দোষের কিছু নয়।”

সুফিয়ান এটা শুনে মনেমনে খুব হাসে। ভাবীরা মুখে না বললেও মনেমনে যে এই মেয়েকে ‘বেয়াদব’ পদবী দিয়ে দিয়েছে সেটা মেয়েটা বেশ ভালোভাবে বুঝেছে। সেজন্য এই কথাটি বললো।যেহেতু ভাবীদের সত্যি কথা বলেনি তাই সুফিয়ান সাময়িক সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে যায় যে রুম কাউকে কিছু বলবে না। তাই সে চলে যায়। নিয়াজকে ফোন দিয়ে বাড়ির ছাদে দেখা করতে বলে।
___

ইতিমধ্যে রুমঝুম অর্থাৎ নতুন বউ যে ‘বেয়াদব’ সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল। এই কথা রুমঝুমের বাবার বাড়ি থেকে দেখতে আসা মানুষের কানে যেতে সময় নিলো না। এসব কথা শুনে রুমঝুমের বন্ধু মুনতাহা তার সাথে আলাদা কথা বলতে আসে। শান্ত গলায় বলে,“তোকে আমি কি বুঝিয়েছিলাম? সবকিছু ভুলে গেলি। বলছিলাম না, এটা তোর বিয়ে। তুই নতুন বউ। এখানে তোকে শান্ত, নরম, ভদ্র হয়ে থাকতে হবে।”

“আমি কখন অশান্ত, অভদ্র আচরণ করলাম?”
রুম স্পষ্ট ভাষায় জিজ্ঞেস করে। মুনতাহা বিরক্ত হয়। সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“এই যে স্পষ্ট জবাব দিচ্ছিস। এটা সব জায়গায় চলে না। তুই কেন বুঝতে পারছিস না? এখানে তোকে সারাজীবন থাকতে হবে। যদি শ্বশুড়বাড়ির লোকজন তোকে অপছন্দ করে তাহলে তোকে তাড়িয়ে দিবে।”

“এমনিই চলে যেতে হবে।”
রুমের এই কথা শুনে মুনতাহা অবাক হয়ে যায়। মুনতাহা তার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকাতে রুম বলে,“যেখানে এমনি চলে যেতে হবে সেখানে কেন নিজের অস্তিত্বকে লুকিয়ে অন্য একজন মানুষের অভিনয় করে যাবো। যদি এখানে সারাজীবন থাকতেও হতো তাহলেও বা আমি কেন আমি যা নই তেমন অভিনয় করবো। স্যরি। আমি পারবো না। আমি যেমন আমাকে তেমনভাবেই সবাইকে মেনে নিতে হবে।”

“আচ্ছা। এসব ছাড়। আসল কথা বল, এখান থেকে চলে যেতে হবে মানে? তুই কি ভাইয়াকে ছেড়ে দিতে চাইছিস? তাহলে বিয়ে করেছিস কেন? তোকে আমি বিয়ে করার সময় ভাবতে বলছিলাম না?”

“ভেবেছি। আমার ছাড়ার ইচ্ছাও ছিলো না। আমি বিয়েকে মেনে নিয়েই বিয়ের আসর বসেছিলাম। কাউকে ঠকাতে বসিনি। যেটা তোর ঐ ভাইয়া করেছে।”

“মানে?”
মুনতাহার এই প্রশ্নে রুম গতকাল রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। এসব শুনে মুনতাহা বড় বড় চোখ করে রুমঝুমের দিকে তাকায়। সে বিষ্ময় নিয়ে বলে,“তাই বলে থাপ্পড়? স্বামী হয় তোর। স্বামী কথার মানে জানিস? এভাবে কেউ স্বামীর গায়ে হাত তোলে?”

“তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। সে স্বামী ছিলো। যতক্ষণ অব্দি সে মুখ দিয়ে এই কথাটি উচ্চরণ করেনি সে আমাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে কোনদিন মেনে নিতে পারবে না ততক্ষণ অব্দি সে স্বামী ছিলো। ঐ কথা উচ্চরণ করার পর থেকে সে আমার চোখে একজন প্রতারক।”
রুমের এই কথা শুনে মুনতাহা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে যা করেছে ভুল। মুনতাহা বলে,“সে তোকে ঠকাতে চাইনি বলেই তো মনের কথা জানালো। এখানে দোষ কোথায়?”

“ঠকানোর ইচ্ছা না থাকলে বিয়েই করতো না। সে বললো আমাকে কখনো স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে পারবে না। এর অর্থ সে আমাকে কয়েকদিন পর ডিভোর্স দিবে। তার মা যেহেতু হৃদরোগে আক্রান্ত, আমি যদি ভুল না হই তাহলে তার মায়ের মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে সে। তারপর আমাকে ডিভোর্স দিবে। এর অর্থ, সে বিয়ের আসর বসার আগেই আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাকে প্রতারণাই বলে। আমার স্থানে যদি একটা এমন মেয়ে থাকতো যার কাছে বিয়ে, স্বামী সবকিছু। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মানে স্বামী মন-প্রান উজাড় করে ভালোবেসে ফেলেছে তেমন মেয়ে হলে নিশ্চয়ই ভেঙে পড়তো। আর ঐ লোকটা তার ভেঙে পড়া দেখে বলতো, স্যরি আমার পক্ষে কিছু করার ছিলো না। এটা প্রতারণা নয়? যখন সে বিয়ের আসরে বসেছে তখন তার এটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো, সে বিয়ে করছে। বিয়ে করছে কোন ছেলে-খেলা নয়। এই বিয়ের সাথে একটি মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে। তাই তাকে নিজের অতীত ভুলে এই বিয়েকে সম্মান জানিয়ে মেনে নিতে হবে।”
রুম একটু থেমে শান্ত গলায় বলে,“সে যদি আমাকে বলতো তার অতীত আছে, সে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে, সে আমাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তার মেনে নিতে সময় লাগবে তাহলে আমি সব মেনে নিতাম। নিজে যেচে তার মাকে বুঝিয়ে তার সাথে তার ভালোবাসার মানুষকে এক করে দিতাম। কিন্তু সে তেমন কিছুই করেনি। সে কয়েক মাসের অপেক্ষা করছে, ছেড়ে দেওয়া জন্য। এটা প্রতারণাই। এটা অন্যায়। আমার দৃষ্টিতে যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই।”

”এজন্যই আমি তোকে এত ভালোবাসি। আফসোস তোর মতো করে সবকিছু যদি উপলব্ধি করতে পারতাম তাহলে জীবনটা ধন্য হতো।”
মুনতাহা রুমঝুমের ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরে কতগুলো বলে। ঠিকই তো। রুমঝুম নেহাৎ খুবই সাহসী, সহজে ভেঙে পড়ে না তাই নাহয় সব মেনে নিলো। কিন্তু এখানে যদি একজন নরম মনের মেয়ে থাকতো। তাকে যদি সুফিয়ান ডিভোর্স দিয়ে দিতো, তাহলে দোষ না থাকলেও বিনাদোষে তার গায়ে লাগতো ডিভোর্সির অভিশাপ। হ্যাঁ অভিশাপই। এই সমাজের মানুষ তাকে নরম পেয়ে তাকে প্রতি পদে পদে উপলব্ধি করাতো ডিভোর্স তার জন্য কতবড় কলঙ্ক। সেই সাথে তার দোষই ডিভোর্স হয়েছে। সত্যি তো। সুফিয়ান যদি বিয়ের আগেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে সে বিয়েতে বসে একটা মেয়ের জীবন তার সাথে জড়ালো কেন? এসব বুঝতে পেরে মুনতাহা রুমঝুমকে সঙ্গ দেয়।তারপরও সে বলে,“বোন তোর সব কথা ঠিক। তাও বলবো এটা শ্বশুরবাড়ি একটু মুখটা বন্ধ রাখ। সবসময় স্পষ্ট জবাব দেওয়া উচিত নয়।”
রুমঝুম মাথা নাড়ায়। মুনতাহা মুচকি হাসি দেয়। যাবার সময় শেষবারের মতো কৌতূহলী হয়ে মুনতাহা জিজ্ঞেস করে,“সত্যি এই বিয়ে ভেঙে দিবি?”

“হ্যাঁ। তবে অন্যায় করলে না। তাকে আমি তখনই ছাড়বো যখন সে এই বিয়ের মূল্য বুঝে কাজ করবে। এই বিয়েকে অসম্মান করে যদি অন্যায়ে জড়িয়ে যায় তবে নয়। আমার কাছে অন্যায়ের কোন ক্ষমা নেই। আর তার জন্য শাস্তি এটাই যে আমাকে সারাজীবন সহ্য করা।”
রুমের এই কথার অর্থ বুঝতে মুনতাহার বেশি বেগ পেতে হয় না। তবে সে বুঝতে পারে না সুফিয়ান আদো এমন একটা অপরাধ করবে? তার তো করা উচিত নয়। তবুও যদি করে। তাহলে সত্যি সে ভুল করবে। এই ভুলটা রুমঝুম মেনে নিবে না।


চলবে,