টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-০৪

0
10

#টক_ঝাল_মিষ্টি (৪)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে, আত্মীয়স্বজন সব যার যার বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে এই মূহুর্তে রুমঝুম এবং তার শাশুড়ী রয়েছে। সুফিয়ান একটি কাজে বাহিরে গিয়েছে। রুমঝুমকে পাশে বসিয়ে শাশুড়ী মা গল্প করতে শুরু করে। শান্ত গলায় বলে,“বৌমা আমি তোমার মতো স্পষ্টবাদী মানুষ খুব পছন্দ করি। সেজন্য আত্মীয়দের মাঝে তোমাকে নিয়ে এত কথা হলো তাও আমি চুপ ছিলাম। আসলে এই দুনিয়ায় নরমের জন্য নয়। আমি আমার জীবন থেকে বুঝেছি।”

শাশুড়ী মায়ের এই কথায় রুমঝুম শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়। শাশুড়ী মা আবারও মিষ্টি করে বলে,“তুমি বিরক্ত নাহলে আমি আমার মনের কিছু কথা তোমাকে বলবো?”

রুমঝুম জবাবে মিষ্টি করে হেসে শাশুড়ী মাকে সম্মতি জানায়। তার শাশুড়ী মা তাকে তার জীবনের সুখ দুঃখের গল্প বলতে শুরু করে। কত কষ্ট করে সে ছেলেকে মানুষ করেছে। আজ কত সুখে আছে। সবকিছু। এসব বলতে বলতে হঠাৎ শাশুড়ী মা বলে,“এখন আমার ছেলে সফল। আমাদের দুঃখের দিন কেটে গেছে। অথচ দেখো আমি এই সুখের জীবন বেশিদিন উপভোগ করতে পারবো না। যেকোন মূহুর্তে আমি মা রা যেতে পারি। হার্ট অ্যাটাক হয়ে কখন যে চলে যাবো এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে, বলা যায় না। সেই সময়টা যেকোন মূহুর্তে হতে পারে। লোকে ঠিকই বলে সুখের জীবন বেশিক্ষণ থাকে না।”

“জীবনে সব সময়ই ক্ষণস্থায়ী। তাই সময়টা একটি সময় ফুরিয়ে যাবে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আমাদের সেই সময়টাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করা উচিত।”
রুমঝুম শান্ত গলায় কথাটি বলে। শাশুড়ী মায়ের কথাটি বোধহয় ভালো লাগে। রুমঝুম বিষয়টি বুঝতে পেরে বলে,“আম্মু আপনার মনে হয় আপনি চাইলে আপনি আরও সুখী মানুষ হতে পারতেন?”

“কিভাবে?”
শাশুড়ী মা রুমের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। রুমঝুম শান্ত গলায় বলে,“আপনার ছেলে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। সন্তান হিসাবে আপনার চিন্তা করে। আপনার খুশির জন্য যদি সে আপনার জন্য এতবড় ত্যাগ করতে পারে তাহলে আপনার উচিত নয় তার খুশি নিয়ে ভাবা?”

শাশুড়ী মা বুঝতে পারে রুমঝুম সুফিয়ানের বাধ্য হয়ে বিয়ে করা নিয়ে কথা বলছে। শাশুড়ী মা অবাক হয়ে যায়। তাহলে সুফিয়ান রুমঝুমকে মেনে নেয়নি। সে তাকে তার অন্যত্র ভালোবাসার কথা জানিয়েছে। এসব ভাবনায় শাশুড়ী মা কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ে। যেটা দেখে রুমঝুম তাকে দু’হাতে আগলে নিয়ে বলে,“আপনি এত অস্থির কেন হচ্ছেন আম্মু? সবকিছু ঠিক আছে। আপনার ভাবনার মতোই সব ঠিক আছে।”

রুমঝুম এভাবে নানা কথায় শাশুড়ী মাকে নিশ্চিন্ত করে। তবুও শাশুড়ী মা চিন্তামুক্ত হতে পারে না। সে শান্ত গলায় বলে,“সুফি তোমাকে মেনে নেইনি?”

“এটা তো স্বাভাবিক। বিয়ের মোটে কয়টা দিন। এখন মেনে নেওয়া আদো সম্ভব? আপনিই বলুন না।”
শাশুড়ী মা অবাক হয়ে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুমঝুমের হাসি মুখ দেখে শাশুড়ী মা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। তারপর বলে,”আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানতাম সুফি হয়তো এত সহজে তোমাকে মেনে নিতে পারবে না। তারপরও তোমাদের বিয়ে দিয়েছি। এর দুইটি কারণ রয়েছে।”

”কি কি?”
রুমঝুম খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে। শাশুড়ী মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“প্রথম আমি তোমার মাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমাদের বিয়ে দিবো। দ্বিতীয় স্নেহার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে।”

শাশুড়ী মায়ের এই কথা শুনে রুমঝুম ভীষণ অবাক হয়। তারপর সুফিয়ানের মা যা বলে তার ভাষ্যমতে৷ সেদিন সুফিয়ান তাকে স্নেহার কথা বলার আগে থেকেই সে সব জানে। সে সুফিয়ানের সাথে স্নেহার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার বাড়িও গিয়েছিলো। তবে সেদিন তাকে অনেক অপমানিত হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। শাশুড়ীর মুখে এমন কথা শুনে রুমঝুম কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সত্যি এমন কিছু হয়েছিলো! রুমঝুমের চিন্তা বুঝতে পেরে শাশুড়ী মা বলে,“এটাই সত্যি। আমি আমার ছেলেকে খুব ভালোবাসি। আর আমি বুঝবো না সে কেমন? কাকে ভালোবাসে? কাকে চায়? আমি সব জানতাম। আমি আমার ছেলের খুশির জন্য তোমার মাকে দেওয়া কথা ভুলে গিয়ে স্নেহার বাড়ি গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আমার ছেলের খুশির জন্য।”

রুমঝুম কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। শাশুড়ী মা তার সাথে তাল মেলায়। কথা প্রসঙ্গে শাশুড়ী মা বলে,“আমার ছেলের হৃদয়ে দ্বিতীয়বার তুমি তোমার ভালোবাসার বীজ রোপণ করতে পারো না রুম?”

রুমঝুম এই কথা শুনে চুপ হয়ে যায়। সেই মূহুর্তে বাসার কলিংবেল বেজে উঠে। রুমঝুম এসে দরজা খুলে দেয়। সুফিয়ান এসেছে। রুমঝুম দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে তাকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার জায়গা দিয়ে দেয়। সুফিয়ান সোজা নিজের ঘরে চলে যায়।


রুমঝুম ঘরে এসে দেখে সুফিয়ান ফোনে কথা বলছে। সুফিয়ান ফোনে স্নেহাকে বলছে,“আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি স্নেহা। প্লীজ আমার পরিস্থিতি বোঝ। কেউ আমাকে বুঝতে চাচ্ছে না।”

কথা প্রসঙ্গে সুফিয়ান যখন বলে,“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি এবং সারাজীবন বাসবো।” তখন রুমঝুম এসে সুফিয়ানের হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয়। এটা দেখে সুফিয়ান প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সুফিয়ান বিরক্তি নিয়ে বলে,“সমস্যা কি আপনার? আমার পরিস্থিতি তো বুঝছেন না। অথচ আমাকে বিরক্ত করতে ছাড়ছেন না।”

“আপনি ভুল করছেন তাই আপনাকে বাঁধা দিচ্ছি।”
রুমঝুমের এই কথা শুনে সুফিয়ান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। রুমঝুম সেটা উপেক্ষা করে বলে,“বিয়ের পর পরনারীকে ভালোবাসি বলা অন্যায়। আমার জীবনের সাথে জড়িত কেউ এই ভুলটা করবে সেটা আমি মানতে পারবো না।”

“আপনার মনে হয় না আপনি একটু বেশি আশা রাখছেন? আপনি আমার থেকে স্ত্রীর অধিকার চাচ্ছেন?”
সুফিয়ানও আজ প্রচন্ড রেগে গেছে। তাই রুমঝুমকে কঠিন করে জবাব দিচ্ছে। সেই মূহুর্তে রুমঝুম লক্ষ্য করে সুফিয়ানের ফোনে কারো নাম্বার কললিস্টে তো নেই। এইমাত্র যে সে স্নেহার সাথে কথা বললো সেই নাম্বার কোথায়। রুম অবাক হয়ে বলে,“আপনি ফোন কানে নিয়ে নাটক করছিলেন? কেন?”

”মানে?”
সুফিয়ান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। রুমঝুম ফোন দেখালে সুফিয়ান মনেমনে খুশি হয়। হয়তো রুমঝুমের হাতের চাপ লেগে ডিলেট হয়ে গেছে। তাই সুফিয়ান বলে,“হ্যাঁ আমি অভিনয় করছিলাম। আপনার রিয়াকশন দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো সোজা আমাকে অন্যায়কারী বানিয়ে দিলেন।”

“মজা করছিলেন ঠিক আছে। তবে বাস্তবে এটা করলে এটা অন্যায়ই। শুনে রাখুন, আমি এই ধরনের অন্যায় মানবো না। যতদিন আমরা একসাথে থাকবো ততদিন আপনাকে আমাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়ে থাকতে হবে। আর স্ত্রী থাকতে অন্য নারীর সাথে কথা বলা অন্যায়। এই অন্যায় করা যাবে না। এটা যদি করেন তাহলে আমি আপনাকে কখনো মুক্তি দিবো না।”
রুমঝুমের এই কথা শুনে সুফিয়ান বিরক্ত হয়ে তার দিকে আড়চোখে তাকায়। রুমঝুম সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে,“এমনিতে দুজনে কষ্ট পেয়েছেন। সেসব সুখ দুঃখের গল্প করে তাকে আপনি সান্ত্বনা দিতে পারে, সে আপনাকে দিতে পারে। কিন্তু ভালোবাসার কথা বলা যাবে না। আপনি নিশ্চয় জানেন বিয়ের পর অন্যকাউকে ভালোবাসাকে সমাজে কী বলে থাকে?”

“আপনি একটু থামবেন। যখনই সুযোগ পান তখনই জ্ঞান দিতে থাকেন নিজের টক ঝাল ভাষা। কেন মিষ্টি করে বলতে পারেন না এসব?”
সুফিয়ানের এই কথায় রুমঝুম ভাবলেস ভাবে তার দিকে তাকায়। সুফিয়ান বিরক্তি নিয়ে আবারও বলে,“আমি জানি আমার করনীয়। আপনার বলার প্রয়োজন নেই। আর আমি আপনার সাথে কোন কথাই বলতে চাই না। আপনি আমার পরিস্থিতি কখনো বুঝবেন না। না স্নেহার পরিস্থিতি বুঝবেন। আমার তো তাও মা ছিলো। কিন্তু স্নেহার তো এই দুনিয়ায় কেউ নেই যার জন্য ও বাঁচবে। আমি ছিলাম ওর ভালোবাসা সেই আমিও ওকে ধোঁকা দিয়ে দিয়েছি।”

এই কথাটি শুনে রুমঝুম অবাক হয়ে যায়। সে বিষ্ময়ের গলায় বলে,“স্নেহার কেউ নেই মানে?”

“স্নেহা অনাথ।
আপনি জানেন স্নেহা ভাবছে অনাথদের কেউ ভালোবাসে না। মানুষ স্বপ্ন দেখাতে পারে। কিন্তু কেউ ভালোবাসতে পারে না। আমি স্নেহাকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। স্নেহার এই কথাগুলো আমার জন্য কত বিষাক্ত তা যদি আপনি বুঝতেন।”
সুফিয়ানের পুরো কথা শুনে রুমঝুম হতভম্ব হয়ে যায়। না, সুফিয়ান এবং স্নেহার কষ্টের কথা শুনে হতভম্ব হয় না। সে হতভম্ব হয়ে যায় এটা জেনে যে স্নেহা অনাথ। কারণ আজই তার শাশুড়ী মা তাকে বলেছিলো, স্নেহার বাবা-মা তাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। তার মানে শাশুড়ী মায়ের বলা কথাগুলো মিথ্যা? কিন্তু সে মিথ্যা কেন বললো? রুমঝুম এসব ভেবে ভীষণ হতবাক হয়। সুফিয়ান তার হতভম্ব ভাবের মাঝে তার দিকে তাকিয়ে বলে,“আপনি জীবনেও বুঝবে না। কারণ আপনি মানুষটা টক ঝালময়। আপনার মাঝে কোন মিষ্টান্ন ভাব নাই। যার মাধ্যমে আপনি আমাদের দুঃখ বুঝতে পারেন।”


চলবে,