#টক_ঝাল_মিষ্টি (৫)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
রাতের খাবার শেষে বিছানায় বসে রুমঝুম ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে। সুফিয়ানের ভাষ্যমতে, স্নেহা অনাথ। তার কেউ নেই। অন্যদিকে শাশুড়ী মায়ের ভাষ্যমতে, স্নেহার সঙ্গে তার অনেক আগেই পরিচয় হয়েছে। সে তার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছে। সেখানে স্নেহার বাবা, মা তাকে চরম অপমান করে বের করে দিয়েছে। যেই কথা বলতে গিয়ে সুফিয়ানের মা কান্না অব্দি করে দিয়েছিলেন। রুমঝুম মনেমনে বলে,“তাহলে মিথ্যে কে বলছে? আর কেন?”
এই প্রশ্নের মাঝে তার ফোনে মুনতাহার ফোন আসে। রুমঝুম ফোন কানে ধরে বলে,“হ্যাঁ বল।”
“কাল আমাদের সাথে ঘুরতে বের হচ্ছিস তো?”
মুনতাহার প্রশ্ন শুনে রুমঝুমের মনে পড়ে, কাল তাদের বান্ধবীদের একসাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা। এসব মনে পড়তে রুমঝুম বলে,“মায়ের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।”
“বাহ। তোর মাঝে তো বউ বউ ভাবটা এসেছে। শাশুড়ীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাচ্ছিস না। বেশ বেশ। খুব ভালো।”
মুনতাহা আরও বেশ কিছুক্ষণ মজা নেয়। রুমঝুম নিশ্চুপ হয়ে তার মজার ছলে বলা কথাগুলো শোনে। মুনতাহার সাথে কথা বলা শেষে মেঝেতে শুয়ে থাকা সুফিয়ানকে ডাক দেয় রুমঝুম। সুফিয়ান মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছিলো। রুমঝুমের ডাকে তার মনোযোগ নষ্ট হয়। সে রুমঝুমের দিকে তাকালে রুমঝুম এসে মেঝেতে তার পাশে বসে। এটা দেখে সুফিয়ান শোয়া থেকে উঠে বসে। সে বলে,“আপনি আমার বিছানা তো দখল করে নিয়েছেন। এখন কি এই মেঝেটাও নিজের আয়ত্বে নিতে চান?”
“জ্বী না।”
রুমঝুম শান্ত গলায় বলে। তার শান্ত কন্ঠ শুনে সুফিয়ান মনেমনে বলে,“এর নিশ্চয় কোন ধান্দা আছে। নয়তো এত শান্তভাবে বললো কেন?”
সুফিয়ানের ভাবনার মাঝে রুমঝুম বলে,“আমি আপনার প্রেমের গল্প শুনতে এখানে এসেছি।”
“মানে?”
সুফিয়ান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলে রুমঝুম ম্লান হেসে তার সেই চিরচেনা কাটখাপ্পা গলায় বলে,“আপনি যেহেতু আমাদের দুজনকেই ঠকিয়েছেন সেহেতু আমাদের দুজনার দুজনকে চেনা উচিত। সেজন্য আমি তার সম্পর্কে জানতে চাই।”
“কি!”
সুফিয়ান বিরক্ত হয়ে রুমঝুমের দিকে তাকায়। তারপর বলে,“আপনি এরকমই টক, ঝাল আপনাকে শান্ত গলায় একদম মানায় না। আর শুনুন আমি স্নেহাকে ঠকাইনি। আর হ্যাঁ আপনার সাথে হয়তো আমি ভুল করেছি। তার জন্য স্যরি। আমি বাধ্য ছিলাম। আমি স্নেহাকে ঠকাতে চাই না সেজন্যই আপনাকে কখনো মেনে নিতে পারবো।”
“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম। এবার বেশি ভাব না নিয়ে আমাকে আপনার লাভ স্টেরি শোনান।”
“আমি আপনাকে কেন শোনাবো? আপনি আমার না বন্ধু, না কাছের কেউ। তাহলে আমি আপনাকে কেন শোনাবো?”
সুফিয়ানের এই কথার জবাবে রুমঝুম তার দিকে অদ্ভুত এক লুক নিয়ে তাকায়। তারপর কঠিন গলায় বলে,“লাভ আপনারই। আপনার লাভ স্টেরি শুনে যদি আমার মন গলে যায় তাহলে আমি আপনার মাকে বোঝাতে পারি, আপনাদের বিয়েটা নিয়ে।
আমি জানি আপনি চান সে মা রা যাওয়ার পর স্নেহাকে বিয়ে করতে। কিন্তু সেটা আদো কোন সময়ে আসবে তার কোন গ্যারান্ট্রি আছে? তাছাড়া এই ভাবনায় থাকা আপনার একটি খারাপ চিন্তার লক্ষণ। আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি, এসব ভাবনা ভুল এবং অন্যায়। তাই এসব ভুল ভাবনা মাথা থেকে ঝেরে সহজভাবে আমাদের জীবন নিয়ে ভাবা উচিত। তাছাড়া আপনার মা আপনাকে সুখী দেখলে বোধহয় বেশি খুশি হবে। তো আপনি চান না, সে থাকাকালীন আপনার এবং স্নেহার সুখী দাম্পত্য দেখুক?”
“আপনার মনে হয় না আপনি একটু বেশি ভাবছেন? আমি ছেলে হয়ে আমার মাকে বোঝাতে পারলাম না। সেখানে আপনি বোঝাবেন?”
সুফিয়ানের এই কথার জবাবে রুমঝুম পুরো কনফিডেন্সের সাথে বলে,“আমি বোঝাতে পারবো। আমি আপনার মতো নই। আমার নিজের উপর বিশ্বাস এবং ভরসা আছে। আমি অবশ্যই পারবো।”
রুমঝুমের এত আত্মবিশ্বাস দেখে সুফিয়ান অবাক হয় না। এই ক’দিনে সে এতটুকু বুঝে গেছে এই মেয়ে মহা ঘাড়ত্যাড়া। নিজেকে নিজের অনেককিছু মনে করে৷ এসব বুঝতে পেরে সুফিয়ান বলে,“নিজেকে যে পন্ডিত ভাবে দিনশেষে সেই কিন্তু ঠকে।”
“চিন্তা নেই। আমি ঠকতে অভ্যস্ত। তাই ভয় করি না।”
খুব সামান্য একটি কথা। কিন্তু এই কথার মাঝে কিছু একটা ছিলো। সুফিয়ান রুমঝুমের চোখের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকায়। তারপর বলে,“আপনার কাছে আমি একজন ভুল মানুষ। তাই আমার লাভ স্টেরি আপনার ভালো লাগবে না। আপনি বুঝতে পারবেন না।”
“বলেই দেখুন।”
রুমঝুমের এমন জবাব পেয়ে সুফিয়ান বলতে শুরু করে। প্রথমে দ্বিধা নিয়ে বললেও কিছু মূহুর্তে মাঝে তার চোখে,মুখে অন্যরকম আনন্দ দেখা যায়। সে স্নেহার সাথে কাটানো তার সুন্দর মূহুর্তের বর্ননা দিয়ে খুশি হয়। তার স্নেহার প্রতি এত গভীর ভালোবাসা দেখে, তার চোখেমুখের উল্লাস দেখে রুমঝুম বুঝতে পারে সুফিয়ানই সঠিক। তবে সুফিয়ানের কিছু কথায় রুমঝুমের অন্য এক সন্দেহ হয়। তাই খুব কৌশলে জিজ্ঞেস করে,“ঐদিন আপনারা ঘুরতে যাওয়ার পর কি হলো?”
“আমরা ঘুরেফিরে বাড়ি চলে এসেছি।”
এখানে রুমঝুম আরও কিছু প্রশ্ন করে সুফিয়ানকে। সুফিয়ান জবাব দেয় তবুও রুমঝুম তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তার তাকানো দেখে সুফিয়ান বলে,“আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কি খারাপ লাগছে?”
”খারাপ কেন লাগবে?”
রুমঝুম বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। সুফিয়ান বলে,“না ঠিক আছে। আপনার এই গুনটা ভালোই আছে। আপনার জায়গা অন্যকেউ থাকলে হয়তো স্বামীকে অনেক স্বপ্ন দেখতো, সেই স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বের হয়ে তার প্রেমিকার গল্প শোনার সৎ সাহস দেখাতো না।কিন্তু আপনি তো আপনি। আপনি অন্যরকম। এটাই ভালো। নয়তো আমাকে সারাজীবন এই গিল্ট নিয়ে কাটাতো হতো যে আমি তাকে খুব বাজেভাবে ঠকিয়েছি। সে আমাকে ভালোবাসারা বিনিময়ে কষ্ট পেয়েছে। আপনার ভাষ্যমতে আপনাকে ঠকিয়েছি ঠিকই তবে আপনি তত কষ্ট পাননি। এটা আমার জন্য খুব ভালো হলো।”
“বুঝলাম।”
এই কথা বলে রুমঝুম মাথা নাড়ায়। তারপর সুফিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলে,“আমার জীবনের একটা নীতি বলি, আমি বিশ্বাস করি সুখের সময় ভাগ করে নেওয়া যায় কিন্তু কষ্ট নয়। কষ্টগুলো একান্ত নিজের হওয়া উচিত। তবে হ্যাঁ একেবারেই যে ভাগ করে নিবো না তা নয়। কিন্তু কষ্ট খুব সাবধানে ভাগ করতে হয়। সাবধানে মানুষকে দেখানো উচিত। শুধুমাত্র তাকেই যে এই কষ্টের সঠিক মূল্যয়ন করতে পারবে।”
সুফিয়ান রুমঝুমের এত কঠিন কথা পুরোটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝেছে৷ সে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“আপনি তো আমার ভালোবাসার গল্প শুনলেন। তা আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?”
“সেটা আপনাকে কেন বলবো?”
রুমঝুমের এই কথা শুনে অবাক হয়ে যায় সুফিয়ান। সে বিষ্ময় নিয়ে বলে,“আমি যে আপনাকে বললাম।”
“তো? আপনি বলেছেন বলে আমাকে বলতে হবে নাকি? স্যরি। এমন কোন নিয়ম থাকলেও সেটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কোন নিয়মের ধার ধারি না। আমার মর্জির মালিক আমি। শুধুমাত্র আমি।”
এই কথা বলে রুমঝুম বিছানায় চলে যায়। সুফিয়ান হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। একটুপর সুফিয়ান রুমঝুমকে ডাক দেয়। সুফিয়ান বলে,“ঝুম?”
“আপনি বিশেষ কেউ নন যে এখন ঘুম বাদ দিয়ে গল্প করবো। তাই বিরক্ত না করে ঘুমান।”
রুমঝুমের এই কথায় সুফিয়ান তার দিকে অগ্নিচোখে তাকায়। তারপর বলে,“নিজের বেলায় ষোলোআনা তাই না?”
রুমঝুম জবাব দেয় না। সুফিয়ান আবারও জিজ্ঞেস করে,“আপনি জানতেন প্রতিবেশীদের সাথে ওভাবে কথা বললে আপনাকে খারাপ বলা হবে। না মানে আপনি যতটা বুঝদার সেই হিসাবে বললাম। তো সব জেনেও কেন আপনি ওভাবে কথা বললেন?”
“কিছু না বললেও তারা এমনি খুঁত বের করতো। তাই আমি যেটা সেটা হয়েই থাকি। বেয়াদব হওয়া সহজ কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া কঠিন। খুবই কঠিন। আর আমি কঠিন নয় সহজ কাজ করায় বিশ্বাসী।”
রুমঝুম স্পষ্ট জবাব দিয়ে চোখ বন্ধ করে। সে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। সুফিয়ান এদিকে রুমঝুমের কথা ভাবে। সেদিন পাশের বাসার ভাবীদের সাথে ওভাবে কথা বলা দেখেই সুফিয়ানের মাথায় এই প্রশ্নটা এসেছিলো। তাই আজ প্রশ্নটা করলো। তবে রুমঝুমের উত্তরটা তেমন পছন্দ হলো না।
___
রুমঝুম সকাল থেকে শাশুড়ী মায়ের পাশে পাশে ঘুরছে। সে আসলে তার মিথ্যা বলার কারণ জানতে চায়। রুমঝুম চাইলে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু কোথাও গিয়ে তার হৃদরোগ বাধা দিচ্ছে। যেই মানুষটি মিথ্যে বলতে গিয়ে কান্নার অভিনয় সুন্দরভাবে করতে পারে, তার কাছে এই মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন করলে যে যেকোন কিছু হতে পারে। এসব ভেবেই রুমঝুম দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে যায়। অতঃপর সে সরাসরি প্রশ্ন না করে একটু ঘুরিয়ে বলে,“আম্মু আপনার কাছ থেকে একটি পরামর্শ চাচ্ছি। দিবেন প্লীজ?”
“হ্যাঁ বলো। তুমি আমার বৌমা কম মেয়ে বেশি। তুমি একটা কেন হাজারটা পরামর্শ চাইবে। আমি হাসিমুখে দিয়ে দিবো। সন্তানরা কোন কাজে বাধার সম্মুখীন হলে সেখানে সঠিক পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকাই তো মায়েদের কাজ।”
শাশুড়ী মায়ের এত সুন্দর কথা শুনে রুমঝুম তার চরিত্র নিয়ে ভাবনায় পড়ে যায়। এ কেমন মানুষ সেটাই ভাবছে? যাই হোক রুমঝুম বেশি না ভেবে বলে,“মূলত আমার এক বান্ধবী একটি সমস্যা রয়েছে। তারই পরামর্শ চেয়েছে আমার কাছে। বিষয়টা হলো ওর ভাই একটি মেয়েকে পছন্দ করে। কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েটা অনাথ। এখন এটা নিয়ে ওরা দ্বিধায় আছে।”
একটু থেমে রুমঝুম জিজ্ঞেস করে,“একটা অনাথ মেয়েকে কি ওদের পরিবারের অংশ করা উচিত? অনাথ মেয়েটা কি বউ হিসাবে পার্ফেক্ট হবে?”
প্রশ্নটি করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে রুমঝুম তার শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার শাশুড়ী মায়ের জবাবের আশায়। এসব ক্ষেত্রে মূলত বেশিরভাগ মানুষ নিজের সাথে তুলনা করে পরামর্শ দিয়ে থাকে। সেটা ভেবেই রুমঝুমের এভাবে প্রশ্ন করা।
’
’
চলবে,