টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-০৬

0
3

#টক_ঝাল_মিষ্টি (৬)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

শাশুড়ীর জবাবের সাথে তার কর্মকান্ড মিলছে না। রুমঝুম এক প্রকার বিরক্ত হয়ে গেল। তবে শাশুড়ী মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে মুনতাহার সাথে দেখা করতে বের হয়। শাশুড়ী মা অবশ্য এই অনুমতি দিতে দেরি করেন না। তার কথা রুমঝুম এখানে স্বাধীন। সে নিজের ইচ্ছামতো চলতে পারে। রুমঝুম শাশুড়ী এরকম ভাবনায় খুশি হয়। তবে সেটা বুঝতে দেয় না।

মুনতাহার সাথে রুমঝুম সব ঘটনা শেয়ার করে৷ সে বিরক্তি নিয়ে বলে,“এই মা ছেলে কে যে মিথ্যা বলছে। কে যে সত্যি বলছে। কেন যে মিথ্যা বলছে। সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।”

“এজন্যই তোকে বলছিলাম, বিয়ের আগে অন্তত ছেলেটার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নে। কিন্তু না। তুই তো তুই। বাবা বললো বিয়েটা এখন করা জরুরি, করে নিলি।”
মুনতাহার এই কথায় রুমঝুম মাথা নাড়ায়। সে মুখে কোন জবাব দেয় না। শান্ত গলায় বলে,“এসব বাদ দে। যা করার করুক তারা। আমরা বরং যেজন্য এসেছি সেই কাজটি করি।”

মুনতাহা মাথা নাড়ায়। সে ফোন বের করে তার প্রেমিককে ফোন দেয়। মূলত রুমঝুমের সাথে তার দেখা করানোর জন্যই আজ মুনতাহা তাকে এখানে ডেকেছে। অতঃপর ঘন্টা খানেক সময় তাদের সাথে কাটালো রুমঝুম। তারপর বাড়ি চলে এলো।

বাড়ি এসে সুফিয়ানকে মলিন মুখে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। সকালে তো মুখে হাসি নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছিলো। তবে রুমঝুম এসব নিয়ে বেশি ভাবলো না। সুফিয়ান রুমঝুমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে কিছুটা রাগ নিয়েই বলে,“সব আপনার জন্য হয়েছে। সব আপনার জন্য হয়েছে।”

“মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে? কি অদ্ভুত কথা বলছেন? কী হয়েছে আমার জন্য?”
রুমঝুম কঠিন চোখে তার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে। সুফিয়ান উঠে দাঁড়ায়। সেও কঠিন গলায় বলে,“আপনার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়েছে। আজ স্নেহা আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে না। এসব আপনার জন্য হয়েছে।”

”একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে দেখা করা বুঝি সৎ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।”

“একদম ফালতু কথা বলবেন না ঝুম।”
সুফিয়ান কিছুটা চিৎকার করে কথাটি বলে। এটা দেখে রুমঝুম বেশ কঠিন গলায় বলে,“চেঁচাবেন না। আমি আপনার চেঁচামেচি শোনার জন্য এখানে আসিনি। তাও অকারণে।”

“আপনার এটা অকারণে মনে হয়?”

“জ্বী। আপনার তো খুশি হওয়া উচিত, আপনি বিবাহিত এই বিষয়টি উপলব্ধি করে আপনার স্নেহা আপনার সাথে একটি ভুল এবং অন্যায় সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আপনারও উচিত তার সাথে দূরত্ব তৈরি করা।”

“হোয়াট?”
সুফিয়ান বিরক্ত হয়ে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম স্পষ্ট গলায় বলে,“বিয়ে করার আগে আপনাকে এই কথাটি মাথায় রাখা উচিত ছিলো। আপনি বিবাহিত হয়ে গেলে যদি ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে ভালোবাসা নামক শব্দে আটকে যান তাহলে সেই সম্পর্ক কখনো সঠিক হবে না। সেটা অন্যায়। স্নেহা এই অন্যায়টা বুঝতে পেরেছে, আপনিও বুঝুন। যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই ভালো।”
এই কথায় রেগে যায় সুফিয়ান। সে রুমঝুমের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। রুমঝুম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে হতবাক হয়ে সুফিয়ানের চোখে চোখ রাখে। সুফিয়ান রাগান্বিত গলায় বলে,“আমি আপনাকে কতবার বলবো আপনাকে আমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি। বাধ্য হয়ে। এই বিয়ের আমার কাছে কোন মূল্য নেই। তাই স্নেহার সাথে আমার সম্পর্ক কোন ভুল নয়। বরং আপনার সাথে সম্পর্কটা ভুল।”
একটু থেমে পুনরায় বলে,“ভালোবাসা মানে জানেন? ভালোবাসার অর্থ জানেন? এসব বুঝেন? যদি বুঝতেন তাহলে আমার কষ্টটা অনুভব করতে পারতেন। আমি স্নেহাকে কতটা ভালোবাসি সেটা আপনি কখনো কল্পনাও করতে পারবেন না। সেই মানুষটি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাচ্ছে, এটা আমার জন্য কতবড় যন্ত্রণার সেটা আপনি কখনো উপলব্ধি করতে পারবেন না।”

“ভালোবাসা মানে আমি ঠিকই জানি। কিন্তু আপনি জানেন না। আপনাদের মতো পুরুষরা জানে না।”
রুমঝুমের কথার মাঝে সুফিয়ান বাধা দিয়ে উঠলে রুমঝুম বলে উঠে,“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আপনাদের মতো পুরুষরা ভালোবাসার অর্থ জানে না বলেই একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করে। আরে ভাই, সামান্য একটু চাপ প্রয়োগ করায় যে ভালোবাসাকে তুমি ছাড়তে পারো সেই ভালোবাসা কতটা সঠিক। আর হ্যাঁ শুনুন মিস্টার সুফিয়ান, আপনাদের মতো পুরুষরা ভালোবাসতে জানে না। সত্যি জানে না। আজ আপনি স্নেহার জন্য পাগল, কাল আমি দুইবার সিগনাল দিলে আমার জন্য পাগল হয়ে যাবেন। তখন ঘরে বাহিরে দুই জায়গায় সময় দিবেন। আপনাদের খুব ভালোভাবেই চিনি আমি।”

”বাজে বকবেন না।”
সুফিয়ানের এই কথায় রুমঝুম জবাব না দিয়ে তার বাহু থেকে সুফিয়ানের হাত সরায়। তারপর বলে,”আমি বাজে বকি না।”

“আমি….।”
সুফিয়ান রেগে কিছু বলতে নিবে সে কিছুটা অসুস্থ বোধ করে। তাই দ্রুত নিজের ঔষধ বক্স থেকে ঔষধ বের করে খেয়ে নেয়। রুমঝুম এটা গভীরভাবে লক্ষ্য করে। তবে কিছু বলে না। সুফিয়ানের কিছুটা সুস্থ বোধ হতে সে রুমঝুমের দিকে তাকায়। শান্ত গলায় বলে,“আমার জীবন থেকে চলে যান প্লীজ।”

এই কথার জবাবে রুমঝুম মুচকি হাসি উপহার দেয়। তার হাসি দেখে সুফিয়ান অবাক হয়। রুমঝুম শান্ত গলায় বলে,“আপনার মায়ের অসুস্থতা?”

এই কথায় সুফিয়ান হতভম্ব হয়ে যায়। সে দ্রুত রুমঝুমকে বলে,“না প্লীজ যাবেন না। আমার মা যতদিন আছে ততদিন একটু মানিয়ে নিন প্লীজ।”

”স্বার্থপর মানুষ আমি খুব অপছন্দ করি সুফিয়ান।”
সুফিয়ান এবার অসহয় চোখে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম আবারও বলে,“আমি জানি আমার পছন্দ অপছন্দে আপনার কিছু যায় আসবে না। কিন্তু আপনার ভাবনাটা ভুল। আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন এই আশায় যে একদিন আপনার মা চলে যাবে, আপনি সেদিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্নেহাকে বিয়ে করবেন। আপনার এই চাওয়া ভুল। এটা অন্যায়। এটা আপনাকে বুঝতে হবে সুফিয়ান। বিয়ের আসরে আপনি বাধ্য হয়ে বসেছেন। হ্যাঁ ঠিক আছে। আপনি আপনার মাকে ভালোবাসেন তাই তার সুস্থতার জন্য বসেছেন। কিন্তু তাই বলে যাকে বিয়ে করবেন তাকে একটা সময় ছেড়ে দিবেন, তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা অবস্থায় প্রেমিকার সাথে পরকীয়া চালাবেন। এটা অন্যায়। আর আমি অন্যায়কে সাপোর্ট করি না।”

“পরকীয়া? ছিহ৷ আপনি এসব ফালতু কথা বলছেন কেন?”

“আপনি এতটাও অসুস্থ নন যে আমার কথা বুঝবেন না। বিয়ে, প্রেম, ভালোবাসা এসব বুঝলে আমার কথাগুলোও বুঝবেন। ঘরে বউ বাহিরে প্রেমিকা তো এই সম্পর্কের নাম কি?”
সুফিয়ান হতভম্ব হয়ে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম এবার কিছুটা নমনীয় গলায় বলে,“প্রথমত আপনার এই বিয়ের আসরে বসার আগে আপনার মাকে বোঝানো উচিত ছিলো আপনি স্নেহাকে ভালোবাসেন। তাকেই বিয়ে করবেন। যেহেতু সেখানে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন তো আপনার এই কথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো, আপনি যাকে বিয়ে করছেন সে আপনার স্ত্রী। আপনার দায়িত্ব, আপনার কর্তৃব্য। আপনার সাথে তার জীবন জুড়ে আছে। তো আপনি তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিবেন। কিন্তু আপনি সেটা না করে বাসর ঘরে তাকে কিভাবে ছাড়বেন সেই কথা বলেন? আপনি জানেন একজন ডিভোর্সি মেয়ের কষ্ট। জানেন না? হয়তো জানলেও বুঝতে পারেন না।”
সুফিয়ান কিছু বলতে পারে না। সে রুমঝুমের দিকে হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। রুমঝুম শান্ত গলায় বলে,“একজন ডিভোর্সি, বিনা কারণে, যেখানে দোষটা তার ছিলো না। তাও ডিভোর্সি হওয়ায় তার জীবন কতটা নরকময় হয়েছে সেটা জানতে চান? তাহলে আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি, ওখানে গিয়ে ঐ মহিলার সাথে দেখা করে আসুন। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার ভাবনাটা কতটা অন্যায়। আর হ্যাঁ সব দোষ আমার এই কথাটা বলবেন না। দোষ সব আপনার মায়ের, তারপর আপনার। এখানে আমার কোন দোষ নেই।”

এই কথা বলে রুমঝুম সেই মহিলার নাম এবং ঠিকানা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়। এতক্ষণ এদের তর্ক সুফিয়ানের মায়ের কানেও কিছুটা গিয়েছে। তবে সে তাদের মাঝে তৃতীয় পক্ষ হতে চায়নি সেজন্য নিজের ঘরে চলে যায়। রুমঝুম তার ঘরেই আসে। রুমঝুমকে এই সময়ে ঘরে দেখে শাশুড়ী মা অবাক হয়। সে বলে,“কিছু বলবা মা?”

রুমঝুম জবাব না দিয়ে শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়। রুমঝুমের শাশুড়ীর তার এই শান্ত চোখই কেমন ভয়াবহ লাগে এখন। রুমঝুমের শাশুড়ী মনেমনে বলে,“এই মেয়ে এভাবে তাকাচ্ছে কেন? ওর বাবা বললো ওকে সব বলে দিতে, ও খুব চতুর মেয়ে। যেকোন সময় সব বুঝে নিতে পারে। কিন্তু ওকে সব বলে দিলে ও কি এখানে থাকবে?”

রুমঝুম তার শাশুড়ীর ভয়মিশ্রিত মুখপানে তাকিয়ে থাকে। বাহিরে দরজা খোলার শব্দ হলে রুমঝুম বুঝতে পারে সুফিয়ান নিজের সাথে যুদ্ধ করে তার কথামতো সেই মহিলার খোঁজে গিয়েছে। এটা বুঝতে পেরে রুমঝুম তার শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করে,“অসুস্থ কে আপনি নাকি আপনার ছেলে?”
রুমঝুমের মুখে এই কথা শুনে তার শাশুড়ীর ভয় দ্বিগুন বেড়ে যায়। সে কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলে,“তুমি এসব কি বলছো?”

“এটাই বলছি, আপনার ছেলে অসুস্থ এই কথা আমাকে না জানিয়ে ঠকালেন কেন? আর এখন আড়াল করছেন কেন? এই ভয়ে যে আপনার ছেলে অসুস্থ এটা জেনে আমি চলে যাবো। তো আপনার এটা মনে হয়নি, আজ নয়তো কাল একদিন আমি সত্যটা জানবোই। তবুও এই লুকোচুরি কেন?”
রুমঝুমের একসাথে বলা এত প্রশ্নে শাশুড়ী মা হতবাক হয়ে যায়। রুমঝুম আবারও কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে,“এবার বলুন, আপনি বেশি অসুস্থ নাকি আপনার ছেলে?”


চলবে,