#টক_ঝাল_মিষ্টি (৭)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
সেদিন আকাশটা মেঘলা ছিলো। শাড়ী পড়ে স্নেহা সুফিয়ানের সাথে দেখা করতে আসে। দু’জনে সময়টাকে উপভোগ করে তাদের পছন্দে একটি স্থানে ঘুরতে গিয়ে। সবকিছু ঠিক ছিলো। হঠাৎ স্নেহা প্রশ্ন করে,“আমাকে বিয়ে করবে তো সুফিয়ান?”
”আমি তুমি ছাড়া কাকেই বা বিয়ে করবো?”
সুফিয়ানের এই প্রশ্নে স্নেহা চুপ হয়ে যায়। একটু সময় নিয়ে বলে,“আমার না বড্ড ভয় হয়। মনে হয় তোমার বউ হিসাবে আমি না অন্যকেউ জায়গা দখল করে নিবে। আর তুমি তাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে।”
“কি!”
সুফিয়ান অবাক হয়। পরক্ষণে হেসে দেয়। বলে,“মেয়ে মানুষের এই এক সমস্যা। অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়। তোমার এত ভয় পাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকেই ভালোবাসি এবং তোমাকেই বিয়ে করবো। আর হ্যাঁ বিয়ের পর অবশ্যই তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসবো।”
স্নেহা সুফিয়ানের এই কথায় খুশি হয়। সুফিয়ান তাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলে,“চলো তোমার মনের ভয় আজ দূর করে দেই। তোমাকে নিয়ে আজই মায়ের কাছে যাবো। চলো?”
“আজই?”
“হ্যাঁ এখনই।”
স্নেহা অবশ্য রাজি হচ্ছিলো না তবে সুফিয়ান জোর করায় মেনে নেয়। তারা দু’জন বাইক নিয়ে বের হয়। মাঝরাস্তায় বাইকের চাকার সাথে খড় বেজে যায়, যার ফলে সুফিয়ান ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। তাদের বাইক এক্সিডেন্ট করে। স্নেহা ‘সুফিয়ান’ বলে নিচে পড়ে যায়। স্নেহা রাস্তার মাঝে পরে গিয়েছিলো, আর দূর্ভাগ্যবসত সেই সময়ে একটি ট্রাক দ্রুত গতিতে চলে আসে। যেটা স্নেহার গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যে কেউ কিছু বুঝে উঠতেই পারে না। সুফিয়ানের চোখের সামনে এত ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটে, সেই সাথে মাথায় আঘাতের ফলে সেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাদের দু’জনকে ধরে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে লাভ হয়নি তেমন। স্নেহা সেই স্থানেই মা রা গিয়েছিলো।
সুফিয়ানের মা খবর পেয়ে চলে আসে। সেখানে আগেই সুফিয়ানের বন্ধু নিয়াজ উপস্থিত ছিলো। সে পুরো ঘটনা সুফিয়ানের মাকে বলে। সে শুনে স্নেহার জন্য কিছুটা ভেঙে পড়ে। যদিও সুফিয়ান তাকে আগে স্নেহার কথা বলেনি।
সেই মূহুর্তে সুফিয়ানের জ্ঞান ফিরলে সে পাগলের মতো ব্যবহার করা শুরু করে। চিৎকার করে শুধু স্নেহাকে ডাকতে ডাকে। সুফিয়ানের মা এবং নিয়াজ তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। ডাক্তার জানায়, সুফিয়ান মানসিকভাবে খুব বড় একটি আঘাত পেয়েছে। তাই এমন করছে। এরপর বেশ কয়েক মাস ধরে সুফিয়ানের চিকিৎসা চলে। সে সুস্থ হয়। সুফিয়ানের মা খুব খুশি ছিলেন তার ছেলে সুস্থ হয়ে গিয়েছে। তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে একদিন তিনি ফোনে সুফিয়ানকে স্নেহার সাথে কথা বলতে শোনেন। প্রেমের গল্প, ভালোবাসার গল্প। তারা কোথায় দেখা করবে সেই কথা। এসবে তিনি অবাক হয়ে যান। গিয়ে সুফিয়ানকে ধরেন। ফোন কেড়ে নিয়ে বলে কি করছে? কিন্তু সুফিয়ান জবাব দেয় না। সে লাজুক মুখে তাকায়। অর্থাৎ সে ভাবছে সে প্রেমিকার সাথে কথা বলছে এটা মাকে কিভাবে বলবে? তার পরবর্তী দিন নিয়াজকে সঙ্গে নিয়ে সুফিয়ান স্নেহার সাথে দেখাও করে। যেখানে অবশ্য স্নেহা ছিলো না। সুফিয়ান হাওয়ায় কথা বলছিলো। এসব দেখে নিয়াজ এবং সুফিয়ানের মা আবার সেই নিউরোলজিস্টের কাছে গেলে, সে সুফিয়ানকে আবার কিছু টেস্ট করিয়ে জানান সুফিয়ানের মাথা থেকে ঐ এক্সিডেন্টের ঘটনা বেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ সাময়িক ভাবে তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে। মূলত সুফিয়ান স্নেহার মৃ ত্যু মেনে নিতে না পেরে নিজের কল্পনায় স্নেহাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই তার মৃ ত্যু ঘটনা ভুলে গিয়ে এখন কল্পনার স্নেহার সাথে সে অতীতে যেমন ছিলো তেমনভাবে চলছে। এসব শুনে সুফিয়ানের মা নিজের ছেলেকে নিয়ে ভীষণ ভেঙে পড়ে।
এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। সুফিয়ানকে ডাক্তারের পরামর্শ মতো রেখেও কোন লাভ হয় না। তার মাঝে সুফিয়ানের মায়ের হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। সুফিয়ানের মা এসবে আরও ভেঙে পড়ে। এখন তার ছেলের কি হবে? সারাজীবন কে তাকে দেখবে? তখন তারা সুফিয়ানের বিয়ের পরিকল্পনা করে। যদি সুফিয়ান অন্যকাউকে বিয়ে করে তখন তাকে তারা এটা বোঝানোর চেষ্টা করবে, তার এই বিয়েতে কষ্ট পেয়ে স্নেহা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এভাবে হয়তো তার কল্পনার স্নেহা তার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
___
এতক্ষণ এসব কথা সুফিয়ানের মা অর্থাৎ রুমঝুমের শাশুড়ী তাকে বলছিলো। সে এরপর রুমঝুমের হাত ধরে বলে,“এসব ঘটনা তোমার বাবা জানে। সে আমার খুব ভালো বন্ধু। তোমার মায়ের সুবাদে আমাদের পরিচয় হলেও আমরা দুজন ভাই, বোনের মতোই মিশে গিয়েছিলাম। তাই আমার দুর্দিনে সে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ও বলেছিলো তুমি পারবে আমার সুফিয়ানের স্মৃতি থেকে স্নেহা নামক অতীতটাকে অতীতে বন্দি করতে।
প্লীজ আমার ছেলেকে ছেড়ে দিও না। আমার ছেলে অসুস্থ জেনে যদি তুমি তাকে ছেড়ে দাও এই ভয়েই আমি একটি মিথ্যে কথা তোমাকে সাজিয়ে বলছিলাম। তুমি দয়া করে আমার ছেলেকে ছেড়ে দিও না।”
রুমঝুম জবাব দেয় না। তার শাশুড়ী তাকে নানাভাবে বোঝায়। তার ছেলে তার জন্য সবকিছু। সে হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না। তবে তার আগে নিজের সন্তানকে তার সাথে সুখী দেখে যেতে পারলে মায়ের মন শান্তি পেতো। রুমঝুম তার সব কথা শুধু শুনে যায়। কিন্তু কোন কথা বলে না। সুফিয়ান যে অসুস্থ বা তার মানসিক কোন সমস্যা আছে এটা রুমঝুমের সন্দেহ হয়েছিলো তখন যখন সে তাকে স্নেহার সাথে কথা বলতে দেখেছে অথচ কললিস্টে তার কোন নাম্বার ছিলো না। তারপর তাকে মেডিসিন নিতে দেখে সেটার নাম মোবাইলে সার্চ দিলে রুমঝুম কিছুটা ক্লিয়ার হয়। সেই সাথে আজ যখন রুমঝুম মুনতাহার সাথে ছিলো তখন সে সুফিয়ান এবং নিয়াজকেও একই রেস্টুরেন্টে দেখেছিলো। যেখানে সুফিয়ান স্নেহার জন্য অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু নিয়াজ বারবার তাকে বোঝাচ্ছিলো স্নেহা আসবে না। সে মুভ অন করে নিচ্ছে। সুফিয়ান নিয়াজের কথায় ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিলো। সে বলে,“এখানে আমরা আসলাম মাত্র পাঁচ মিনিট হলো। এরমাঝে তুই কিভাবে বলছিস ও আসবে না?”
তখন নিয়াজ খুব কনফিডেন্সের সাথে বলে স্নেহা আসবে না। সুফিয়ান এসব কথায় পাত্তা দে না। তবে রুমঝুম দেয়। তাই তো সে তাদের দুজনকে লক্ষ্য করে যায়। অনেক সময় পর সুফিয়ান ফোন কানে নিয়ে স্নেহার সাথে কথা বলে। স্নেহার কাছে ক্ষমা চায়, একবার দেখা করতে চায়। কিন্তু স্নেহা করতে চায় না। সুফিয়ান কথা বলছে ঠিকই কিন্তু তার ফোনে কোন রিং হয়নি। মানে কেউ কলই করেনি। এসবেই রুমঝুম বুঝে যায় যা বোঝার। প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলো শাশুড়ী অনাথ বলে স্নেহাকে মেনে নেয়নি তবে যখন তার শাশুড়ী সেদিনের প্রশ্নের জবাবে বলছিলো, ভালোবেসে একে-অপরে সুখী হতে চাইলে বাধা দেওয়া উচিত নয়। তখন সে বুঝেছে বিষয়টা অন্য। সেখান থেকে এতদূর আসা।
রুমঝুম এসব ভাবছিলো তখন তার শাশুড়ী কিছুটা অসহয় গলায় বলে,“আমার ছেলে খুব ভালো বৌমা। ও তোমাকে একবার ভালোবাসলে তুমি বুঝতে পারবে ওর মতো মানুষ তুমি আর কোথাও পেতে না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, একবার ওকে ভালোবেসে কাছে টেনে দেখো। দয়া করে অসুস্থ বলে দূরে ঠেলে দিও না।”
রুমঝুম কোন কথা বলে না। তবে মাথা নাড়িয়ে তার শাশুড়ীকে আশ্বাস দেয়। রুমঝুমের আশ্বাস পেয়ে তার শাশুড়ী খুবই খুশি হয়। তার চিন্তা অর্ধেক কমে যায়। রুমঝুম তার মুখভঙ্গির এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে। মনেমনে বলে,“যদি একজন অসুস্থ মানুষকে শান্তি দিতে একদিন চুপ থাকতে হয় তবে থাকলাম।”
★
শাশুড়ীর সামনে চুপ থাকলেও রুমঝুম তার বাবার সামনে চুপ থাকে না। তার বাবা যখন জানতে পারে রুমঝুমকে তার শাশুড়ী সব বলে দিয়েছে। তখনই সে রুমঝুমের কাছে চলে আসে। তাকে দেখে রুমঝুম শান্ত গলায় বলে,“তোমার মনে হয় না এটাকে ঠকানো বলে?”
“হ্যাঁ। তার জন্য আমি স্যরি।”
বাবার এই কথা শুনে রুমঝুম কঠিন চোখে তার দিকে তাকায়। তারপর কঠিন গলায় বলে,“স্যরি বললে সবকিছুর সমাধান হয়ে যায় না। তাছাড়া বিয়ের আগে আমাকে আমার যে স্বামী হবে তার সম্পর্ক সব সত্যি জানানো উচিত ছিলো। এটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। তুমি কাজটি মোটেও ঠিক করোনি।”
“বিয়ের আগে বললে তুমি রাজি হতে?”
“না। আমি এমন কাউকে বিয়ে করতাম না যে সারাক্ষণ মুখের সামনে এসে অন্য একজনকে ভালোবাসার গান গাইবে। তাছাড়া এই দুনিয়ায় ট্রিটমেন্টের এত অভাব পড়ছে যে এমন উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে হবে। মানে সারা দুনিয়ায় যত সমস্যা তার সমাধান বিয়ে? এটা কেমন কথা? ছেলে বাউণ্ডুলে হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে দাও ভালো হবে। ছেলের নেশায় আসক্ত বিয়ে দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন বলা যায় ছেলে পাগল তার বিয়ে দাও পাগলামি বন্ধ হয়ে যাবে।
বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে। সবকিছুর সমাধান যদি বিয়েই হয় তবে দেশে এত ডাক্তার, এত হাসপাতাল থেকে কি লাভ? সব তুলে নিলেই তো হয়।”
রুমঝুমের এসব কথার জবাবে বাবা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর বলে,“সবকিছুর সমাধান বিয়ে নয়। তবে আমার এই ঝাঁজালো মেয়েকে বউ হিসাবে পেয়ে যে কেউ ঠিক রাস্তায় এসে যাবে সেটা আমি জানতাম। তোমার কথার যা তেজ তা শুনলে ঐ কথাই তিনদিন কানে বাজবে আর ঐ তিনদিন কারো অন্যকোন মেয়ের নাম মনে পড়বে না। তাই….।”
বাবার মজার ছলে বলা কথাগুলো রুমঝুমের কাছে বিঁষের মতো লাগছে। সে বাবার দিকে রাগী লুক দেয়। সেটা দেখে তার বাবা সিরিয়াস হয়ে বলে,“তোমার মতো ভাঙা হৃদয়ের একজন মানুষ অন্য একজন ভাঙা হৃদয়ের মানুষকে বেশি ভালো বুঝবে, এটা ভেবেই আমি তোমাদের এক করেছি। আমার মনে হয় না আমি ভুল করেছি।”
বাবার এই কথায় রুমঝুম অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সে নিজের অতীতের কিছু কথা ভাবতে শুরু করে। তারপর বলে,“এই দুনিয়ার মানুষ বেয়াদবির ভাষায় যত তাড়াতাড়ি শুধরে যায় তত তাড়াতাড়ি কখনোই ভালোবাসার ভাষায় শুধরায় না। তাছাড়া আমি আমার যে আমিকে অতীতে ফেলে এসেছি সেই আমিকে এখন নিয়ে আসতে পারবো না। তাই এই রুক্ষ, বেয়াদব রুমঝুমের ভাষায় যদি সুফিয়ান ঠিক হয় তবে ঠিক আছে কিন্তু তাতেও সে ঠিক নাহলে আমার কিছু করার নেই। স্যরি বাবা তোমাদের জন্য আমি এরচেয়ে বেশি কিছু করতে পারবো না।”
একটু থেমে রুমঝুম আবারও বলে,“যদিও সুফিয়ান একজনের সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় আমাকে বিয়ে করেছে এই একটি কারণে আমি এই বিয়ে কখনো মেনে নিতাম না। যেহেতু এখানে সুফিয়ানের দোষ কম, তাছাড়া মানুষটি তার কল্পনা সেহেতু আমি তোমাদের খুশির জন্য সুযোগ দিতে পারি। তবে মিথ্যে দিয়ে নয়। আমাকে স্ত্রী হিসাবে পেয়েছে তাই স্নেহা হারিয়ে যাচ্ছে, স্নেহাকে ভুলে দ্বিতীয় অপশন হিসাবে আমাকে বেছে নেওয়া উচিত এসব আমি তাকে বোঝাবো এটা ভাবলে তোমরা ভুল ভাবছো। আমি তার সুস্থতার জন্য যেটা দরকার সেটা করবো। সত্য যতই কঠিন সেটাকে মেনে নিয়েই সবার জীবনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তাই সুফিয়ানকে জানতে হবে সে মিথ্যের দুনিয়ায় আছে এবং তার স্নেহা মা রা গেছে। এই সত্যি মেনে নিয়েই তাকে সামনে এগোতে হবে। সেই সামনের জীবনে আমি থাকবো নাকি অন্যকেউ সেটাও সেই সিদ্ধান্ত নিবে। আমি শুধু সে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তাকে সঠিকটা বোঝাতে পারি। অন্যকিছু তোমরা আমার থেকে আশা করো না। স্যরি।”
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।)