টক ঝাল মিষ্টি পর্ব-০৮

0
10

#টক_ঝাল_মিষ্টি (৮)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

রুমঝুমের বাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। এই মূহুর্তে সুফিয়ানকে সত্যিটা বলা ঠিক হবে না৷ তার মানসিক অবস্থা ভালো নয়। যেকোন কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু রুমঝুমের কথা সে সত্যির মুখোমুখি না দাঁড়ালে সারাজীবন কি মিথ্যে নিয়ে বেঁচে থাকবে? এখানে রুমঝুমের বাবা নানাভাবে তাকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু রুমঝুম সেসব গায়ে মাখে না। রুমঝুমের বাবা ব্যর্থ হয়ে তার শাশুড়ীকে গিয়ে সব বলে৷ তারা দু’জনেই এবার রুমঝুমকে বোঝানোর চেষ্টা করে। রুমঝুম বিরক্ত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন জবাব দেয় না।

__
সুফিয়ান এবং নিয়াজ একসাথে সেই ডিভোর্সি মহিলার বাড়ির কাছাকাছি আসে। কয়েকজনের কাছে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারা খুবই বাজে কথা বলে। আশেপাশের মানুষ ভাবছিলো সেই মেয়েটার আবার বিয়ের সম্মোন্ধ এসেছে। তাদের ভাষ্যমতে,“এই মেয়ে কি ভালো নাকি? একটা স্বামী ছাড়ছে। স্বামী ছাড়া মেয়ে কখনো ভালো হয়।”
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে খুব সুন্দরভাবে মেয়েটার চরিত্র খারাপ এই নিয়ে তারা বলেছে। তারা একটু দূরে আসতে কয়েকজন মহিলাকে মিলে এই বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখা যায়। এসব দেখে সুফিয়ান নিয়াজকে বলে,“এই পরিবেশে এই মহিলা থাকে কিভাবে?”

“সেটা আমিও ভাবছি।”
সুফিয়ান মহিলার জন্য ভীষণ আফসোস করে। এটা দেখে নিয়াজ সুন্দরভাবে তাকে বলে,“তোর দ্বারাও এমন একটি ভুল হতে পারে। এই ভুলটা করিস না। দেখ মেয়েটা তোকে এখানে এজন্যই আসতে বলেছে, তার ভবিষ্যৎ দেখাতে। তোর মনে হয় না, বিনা দোষে তুই তাকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করবি।”

সুফিয়ান জবাব দেয় না। সে নিয়াজের দিকে তাকায়। নিয়াজ শান্ত গলায় বলে,“স্নেহাও তো মুভ অন করে নিচ্ছে। সে তো তোর সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চায় না। তাহলে তোর মনে হয় না, তোর এখন তোর নিজের বর্তমান, তোর স্ত্রীকে নিয়ে ভাবা উচিত।”

“না। আমি স্নেহাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি জানি আমি একটি ভুল করেছি, তাই স্নেহা আমার উপর রেগে আছে। তবে তার রাগ কমে গেলে সে আমাকে নিশ্চয় বুঝবে। আমার মা আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা স্নেহা জানে। ও ঠিক বুঝবে। আর রইলো ঝুমের কথা। ঝুম অনেক স্ট্রং মেয়ে, তাছাড়া আমি ডিভোর্সের পর সবাইকে জানিয়ে দিবো দোষটা আমারই।”
সুফিয়ানের এসব কথায় নিয়াজ প্রথমে কিছুটা হতবাক হয়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে তাকে বোঝায়। ঠিক সেভাবে যেভাবে তার বিয়ের পর বুঝিয়েছে, স্নেহা তার সাথে কথা বলতে চায় না। সে তাকে এখন ঘৃণা করে। সেভাবেই এখনো বোঝাচ্ছে। নিয়াজ একজন প্রকৃত বন্ধুর মতো, সুফিয়ানের স্মৃতি থেকে স্নেহাকে দূরে করার চেষ্টা করে। তার মনে হয়, স্নেহা তার থেকে দূরে আছে এই কথাটি সুফিয়ান মেনে নিলেই একটা সময় নিজের স্ত্রীকে মেনে নিবে। তার সাথে জীবন এগিয়ে নিয়ে যাবে। সুফিয়ান নিয়াজের কথায় কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দে পরে যায়। তার মাথায় ঝুমের একটি কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলো,“বিয়ের আসরে বসে কয়েকদিন পর ডিভোর্স দিয়ে দিবো এই চিন্তাটা ভুল। আপনি অন্যায় করেছেন।”

সুফিয়ানের প্রথমবারের মতো মনে হয় সত্যি এটা অন্যায় ছিলো। মায়ের খুশির জন্য সে কোন মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে না। এই বিয়েটা করা তার ভুল ছিলো, এই বিয়েটা করে সেটা ডিভোর্স অব্দি নিয়ে যাওয়ার ভাবনা ভুল ছিলো। কিন্তু সে তো নিরুপায় ছিলো। তার মায়ের ছোটবেলা থেকে তার জন্য করা ত্যাগের কথা মনে পড়লেই তো তার জন্য জীবনটাও দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সুফিয়ানের। এসব কথা নিয়াজকে জানালে নিয়াজ বলে,“তুই একটা ভুল করেছিস সেটা শুধরেও নিতে পারিস। তুই যে ডিভোর্সের চিন্তাটা করছিলি সেই চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দিয়ে দে। জীবনে এখন যেই পরিস্থিতিতে আছিস সেখান থেকেই জীবনকে সাজা তাহলে হয়তো তোর এসব গিল্টি কমে যাবে।”

নিয়াজের এই কথায় যুক্তি আছে। কথাটিও যথার্থ। কিন্তু সুফিয়ান তো ভালোবাসে স্নেহাকে। সেই স্নেহা যে তাকেই তার দুনিয়া মনে করে। স্নেহার এই পৃথিবীতে সে ছাড়া কেউ নেই।

সুফিয়ান বাড়ি এসে চিন্তিত হয়ে বসে পড়ে। তার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তার করনীয় সম্পর্কে তার মস্তিষ্ক তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। অতঃপর সে সিদ্ধান্ত নিলো সে স্নেহাকে ফোন দিবে। সে তাই করলো। ফোন হাতে নিয়ে অদৃশ্যভাবে কল দিয়ে ফোনটি কানে ধরে। তারপর স্নেহার সাথে একা একা কথা বলতে শুরু করে। সুফিয়ান বলে,“আমি জানি স্নেহা তুমি ভালো নেই। কারণ তুমি আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো। আমার তোমাকে ঠকানো উচিত হয়নি। আমার জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো, ঝুমেরও জীবনটা নষ্ট হচ্ছে। তবে বিশ্বাস রাখো, আমি সব ঠিক করে দিবো স্নেহা। তুমিই আমার বউ হবে। প্লীজ আমার সাথে একবার দেখা করো। আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।”

সুফিয়ান এই কথা বলে বারবার ক্ষমা চায়। রুমঝুম বিছানার উপর বসে সুফিয়ানের এসব পাগলামি দেখে। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখে। সুফিয়ান পাগলের মতো স্নেহার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মনে হচ্ছে তার মস্তিষ্কে স্নেহা যে রাগ করে হারিয়ে গেছে সেই স্নেহাকে সে আজ ফিরিয়েই নিয়ে আসবে। অতঃপর আবার তারা দেখা করবে, ঘুরবে। রুমঝুম আর নিতে পারলো না। সে সুফিয়ানের হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয়। সুফিয়ান বিরক্তি নিয়ে বলে,“বারবার ফোন কেড়ে নেন এটা কেমন স্বভাব? এতটুকু কমনসেন্স নেই যে অন্যের জিনিস ধরতে বা কেড়ে নিতে নেই?”

“না নেই। আপনার যেমন মনে নেই আপনার ঘরে আপনার স্ত্রী বসে আছে। তেমন আমারও ফোনটা কেড়ে নিতে নেই তা মনে নেই।”
রুমঝুম তার স্বভাবমতো কঠিন গলায় কথাটি বলে। তার কথা কানে যেতে সুফিয়ান চুপ হয়ে যায়। সে রুমঝুমের চোখের দিকে তাকায়। বেশ গভীর মনোযোগ দিয়ে তার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। রুমঝুম এটা দেখে বলে,“চোখে আপনার জন্য ভালোবাসা নাকি ঘৃণা খুঁজছেন?”

“কোনটাই নয়। দুঃখ খুঁজছিলাম। আমি আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কতটা কষ্ট পাবেন তাই ভাবছিলাম। যাই হোক আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, সেটা শুনুন।”

“হ্যাঁ বলুন।”
রুমঝুম সুন্দরভাবে কথাটি বলে। এটা দেখে সুফিয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবে নিজেকে সামলে বলে,“আপনি সঠিক। আপনি ঠিকই বলেছেন আমার অন্যায় হয়েছে। বিয়ের আসরে আমাকে আপনার স্বামী হিসাবে নিজেকে তৈরি করে বসা উচিত ছিলো। সেটা আমি পারিনি। তার জন্য স্যরি। আমি হাজারবার এজন্য ক্ষমা চাইতে রাজি আছে। যেহেতু আমি একটি ভুল করে ফেলেছি সেহেতু আমিই সবটা ঠিক করার দায়িত্ব নিতে চাই।”

“তো স্নেহার কাছে ফিরবেন না?”
রুমঝুমের এই কথায় সুফিয়ান অবাক হয়। সে বলে,“কখন ফিরবো না বললাম। আমি স্নেহাকে অনেক ভালোবাসি।”

“আচ্ছা। তাহলে অন্য প্লান করেছেন। তাহলে সেটা ক্যান্সেল করে দেন।”

“মানে?”
সুফিয়ান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। রুমঝুম কঠিন গলায় বলে,“আমি আপনাকে ছাড়ছি না। তাই স্নেহার সাথে ঘর বাধার প্লান ক্যান্সেল করে দিন।”

“মানে? কেন? আপনি তো আর আমাকে ভালোবাসেন না? তাহলে কেন?”
সুফিয়ান হতভম্ব হয়ে যায়। সে রুমঝুমের থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। রুমঝুম সরাসরি স্নেহার মৃ ত্যুর কথা বলে না। ঘুরিয়ে বলে,“বিয়েটাকে ছেলেখেলা আপনি মনে করতে পারেন কিন্তু আমি নই। আর যে নেই তার জন্য স্বপ্ন সাজিয়ে লাভ নেই। স্নেহা আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে, আপনার উচিত এটা মেনে নেওয়া।”

”ছেড়ে গেছে মানে? সাবধানে কথা বলুন। এমনভাবে বলছেন মনে হচ্ছে দুনিয়ায় নেই। সে রাগ করেছে। তার মানে এটা নয় সারাজীবনের জন্য ছেড়ে গেছে।”
সুফিয়ান একটু থেমে আবারও বলে,“আমি কালই ওর সাথে দেখা করে ওর রাগ ভাঙাবো।“

“থাপ্পড় আর একটা দরকার?”
রুমঝুম আগুন চোখে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে। সুফিয়ান অবাক হয়ে বলে,“মানে?”

“আপনি এত অবুঝ নন যে এইটুকু কথা বুঝবেন না। আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি। বিয়ের পর স্ত্রীকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম, ভালোবাসা করা অন্যায়। আর আমার জীবনে থেকে এই ধরনের অন্যায় করা যাবে না। সো মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলুন।”
রুমঝুমের এই কথা শুনে সুফিয়ান রেগে বলে,“ভেবেছিলাম আপনার জীবনটা যাতে সুন্দর হয় সেই পরিকল্পনা করবো। কিন্তু আপনি যা মানুষ। যাই হোক আমি আপনার কথামতো কাজ করবো এটা ভুলেও ভাববেন না।”

“আমার কথামতো কাজ করতে বলিনি। বলেছি অন্যায় করা যাবে না। আপনি বন্ধু হিসাবে দেখা করলে মেনে নিতাম কিন্তু প্রেমিক হিসাবে নয়। স্যরি। বিয়ের আসরে বসার সাথে সাথে অন্যকারো প্রেমিক হওয়ার অধিকার আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এই ভুল করলে বাধা অবশ্যই দিবো।”
রুমঝুম বুঝে গিয়েছে এখনই সরাসরি স্নেহার মৃ ত্যুর কথা বলা ঠিক হবে না। সেজন্য এভাবে কথা বলে সুফিয়ানকে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। সুফিয়ান এসব শুনে রাগান্বিত চোখে রুমঝুমের দিকে তাকায়। রুমঝুম কঠিন গলায় বলে,“ভুল ভুলই হয়। রাগ বা চিৎকার চেঁচামেচি করলে ভুলটা সঠিক হবে না। আর হ্যাঁ বিয়ের পর যদি আপনার প্রেমিকার প্রতি এত ভালোবাসা থাকে তাহলে আমি বাধ্য হবো সেটা করার যেটা আমার আপনাদের সাথে করা উচিত।”

”কী করবেন আপনি?”
সুফিয়ান রাগী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। রুমঝুম জবাব না দিয়ে শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,“সময় আসুক।”
এই কথা বলে রুমঝুম বিছানায় ঘুমাতে চলে যেতে নেয় তখন সুফিয়ান তার হাত ধরে ফেলে। রুমঝুম অবাক হয়ে সুফিয়ানের দিকে তাকায়। তারপর বলে,“হাত ধরার অধিকার আপনার আছে?”
এই কথার জবাবে সুফিয়ান যা বলে তা শোনার জন্য রুমঝুম মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।


চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)