#টক_ঝাল_মিষ্টি (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
“আমি সারাজীবন স্নেহার স্মৃতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু সেই জায়গায় অন্য কাউকে বসানো সম্ভব নয়।”
সুফিয়ানের এই কথায় ম্লান হেসে রুমঝুম বলে,“এই দুনিয়ায় কেউ একা থাকতে পারে না। চলার পথে কাউকে প্রয়োজন। কারো স্মৃতি মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা যায় কিন্তু সেটা নিয়ে সারাজীবন কাটানো যায় না।
যাই হোক, এসব কথা বাদ।সঠিক সময় আসলে আপনি আপনার জীবনের সেই মানুষকে ঠিকই খুঁজে পাবেন। পার্থক্য এটা সেই মানুষটি হয়তো আমি হবো না। কারণ জোর করে কাউকে মনের মধ্যে প্রবেশ করানো যায় না।”
এই কথা বলে রুমঝুম ঘর থেকে বাহিরে চলে যায়। সে তার শাশুড়ীকে গিয়ে সুন্দরভাবে বোঝায়, তার চলে যাওয়া উচিত। এই মূহুর্তে সুফিয়ানের কাছে সে এক মস্তবড় বোঝার মতো। যার জন্য সুফিয়ান অন্য এক বাধনে জোর করে বাধা পড়ে আছে। রুমঝুমের শাশুড়ী এসবে কষ্ট পায়। শান্ত গলায় বলে,“তুমি চলে যাবে? সুফিয়ান সুস্থ হলে এটা হবে তা তো কথা ছিলো না।”
”এটাই হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আপনি বুঝতে পারেননি। আপনি আপনার অসুস্থতাকে পুঁজি করে হয়তো তাকে জোর করতে পারবেন কিন্তু তার মনকে নয়।”
“আমার ছেলেটা সারাজীবন একা থাকবে? এভাবে কষ্টে কাটাবে?”
এই কথার জবাবে রুমঝুম সুন্দরভাবে বলে,“না। সঠিক সময় আসলে সে চলার সঙ্গী পেয়ে যাবে। কিন্তু সেই মানুষটি আমি হবো এটা ভাবা আপনাদের ভুল। জোর করে কাউকে মনের মধ্যে প্রবেশ করানো যায় না।”
রুমঝুম সুন্দরভাবে তার সাথে কথা বলে। তার শাশুড়ীও উপলব্ধি করে তারা জোর করে এই বিয়ে দিয়ে ভুল করেছে। তবে রুমঝুমের শান্ত গলা অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই কয়েক মাসে রুমঝুম সুফিয়ানকে অনেক সময় দিয়েছে, তাকে সুস্থ করতে যা প্রয়োজন তাই করেছে। এসবের মাঝে তাদের কাছাকাছি আসা হয়েছে। রুমঝুমের শাশুড়ী বুঝতে পারে তার এই শান্ত ভাষা সুফিয়ানের প্রতি ভালো লাগার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
*
রুমঝুম সবাইকে বিদায় জানিয়ে শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে দেয়। যাবার সময় সুফিয়ানকে বলে,“ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন। আমি সই করে দিবো। আর হ্যাঁ আবার কেউ জোর করলেই অন্যায় করার জন্য উঠেপড়ে লাগবেন না। বিষয়টি ন্যায়, অন্যায় সেটা আগে বিবেচনা করে নিবেন।”
“সবকিছুর জন্য স্যরি ঝুম।”
সুফিয়ানের এই কথায় রুমঝুম মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। তবে রুমঝুম যাবার পূর্বে একজন কেয়ার গিভার রেখে যায় শাশুড়ীর জন্য। তার সবসময় খেয়াল রাখার জন্য। রুমঝুমের এসব দায়িত্ববোধ সুফিয়ানের ভালোই লাগে।
__
রুমঝুমকে বাড়ি দেখে তার বাবা করুণ চোখে তার দিকে তাকায়। সে সব ঘটনাই জানে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কষ্ট লাগছে। সে নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে এতবড় ভুল করলো। বাবা শান্ত গলায় বলে,“তুমি চলে আসলে কেন? সময়ের সাথে কি তোমাদের দুজনার চলার পথ এক হতো না?”
“হয়তো না। আমি সেখানে থেকে সারাজীবন সুফিয়ানের অসহয় মুখ, আমাকে মেনে নিতে না পারার কষ্ট, অন্য মেয়ের জন্য কান্না দেখতে পারবো না। এটা সম্ভব নয়। আর হ্যাঁ যা কিছু হয়েছে তার জন্য তুমি দ্বায়ী। যেখানে তোমার সুফিয়ানের মাকে তার চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিলো সেখানে তুমি এই বিয়েতে বিনাবাক্যে রাজি হলে।”
রুমঝুম আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলো। তবে বললো না। সে ঘরে চলে যায়। ঘরে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। সে মনেমনে ভাবে, একদিন পর তার এই চলে আসা যখন পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ছড়িয়ে পড়বে তখন কি হবে? তারা নানা কথা বলবে। তবে না, তাদের সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ দিবে না রুমঝুম। রুমঝুম নিজেকে সামলে এই কথাই ভাবে। অন্যের কথায় কষ্ট পেয়ে মুখ লুকিয়ে কান্না করার দিন শেষ। এরা সেই প্রতিবেশী যারা থাকেই কারো একটু খুঁত পাওয়ার আশায় যাতে সেটা নিয়ে মজা নিতে পারে। তাদের এই হাসির পাত্র হওয়ার দিন শেষ। মনমরা হয়ে এসবই ভাবছিলো রুমঝুম। সে অতীতে করা নিজের ভুল নিয়েও ভাবে।
অতীত,
রুমঝুম এত কঠিন, এত বেয়াদব কখনোই ছিলো না। সে অন্যসব সাধারণ মেয়েদের মতোই ছিলো। হাসি-খুশি, প্রানবন্ত। তার জীবনেও প্রেম এসেছিলো। সাগর নামে একজনকে ভালোবাসতো রুমঝুম। সেই সাগর যখন তাকে ঠকিয়ে পরিবারের কথায় অন্য একজনকে বিয়ে করে তখন রুমঝুমের দুনিয়া একদম থমকে গিয়েছিলো। রুমঝুম সাগরকে অনেক ভালোবাসতো। তাই তার এই ধোকা মেনে নিতে পারেনি। সাগরের বিয়ের কথা শুনে নিজেকে ঘরবন্দী করে নেয়। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সেই বিয়ের পাঁচদিন পরই সাগর তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তার কথা, সে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে সে রুমঝুমকেই ভালোবাসে। রুমঝুম এসব ইগনোর করে। সাগরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এসবের জন্য সাগর তার বাড়ির সামনে চলে আসে। সাগরকে বাড়ির সামনে এভাবে দেখে রুমঝুম নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। সে সাগরের সাথে দেখা করে। সাগর বারবার তার কাছে ক্ষমা চায়। সে তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে রুমঝুমের সাথে ঘর বাধার কথা ভাবে। সেদিন রুমঝুম চেয়েও সাগরকে থাপ্পড় মারতে পারেনি। তবে তার কথা ইগনোর করে। এসব ভুল সেটা রুমঝুম বুঝতো। কিন্তু সাগর নিজের স্ত্রীকে মেনে নিতে পারেনি, তাই বারবার রুমঝুমের কাছে আসে।
এসবের মাঝে একদিন সাগরের স্ত্রী আসে। সে এসে রুমঝুমকে সবার সামনে থাপ্পড় মারে। এখানে তার ভাষ্যমতে, রুমঝুমের সাথে ব্রেকাপ হওয়ার পরও রুমঝুম বারবার পুরনো জিনিস নিয়ে ব্লাকমেইল করে সাগরকে তার কাছে ডাকে। সাগরের সাথে নোংরামি করার চেষ্টা করছে। রুমঝুম এসব শুনে হতবাক হয়ে যায়। এখানে অনেক লোকজন ভিড় হয়। রুমঝুম সাগরকে এই বিষয়ে সত্যি বলতে বললে সেও নিজের স্ত্রীর সামনে স্ত্রীর কথাগুলোই সঠিক বলে। সেদিন সাগরের স্ত্রী রুমঝুমকে অনেক গালাগালি করে, সেই সাথে রুমঝুমকে আর কখনো যদি সাগরের সাথে দেখে তাহলে তার খবর আছে জানিয়ে চলে যায়। এই ঘটনায় সবাই রুমঝুমকে নিয়ে গসিপ করতে শুরু করে। সে বাড়ির বাহিরে বের হলে মানুষজন তাকে নানা মন্তব্য করতে শুরু করে। রুমঝুম এসবে এতই ভেঙে পড়ে যে সে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টাও করে। তখন তার বাবা তাকে খুব সুন্দরভাবে বোঝায়। মানুষ সারাজীবন কথা বলবে তাই বলে সে ভুল পদক্ষেপ নিবে। এই ঘটনার প্রায় এক বছর পর রুমঝুম নিজেকে সামলে উঠে। সে মানসিকভাবে নিজেকে স্ট্রং তৈরি করতে সক্ষম হয়। তার পর থেকেই কেউ তাকে কথা শোনানোর সুযোগ পায় না। সে প্রতিটি শব্দের পাল্টা জবাব দেয়। এতদিন ছিলো খারাপ মেয়ে, এখন হয়েছে বেয়াদব। সবার চোখে এটা হলেও তারা আর কখনো এই বেয়াদবকে সামনাসামনি কিছু বলতে পারেনি। এখানেই হয়তো রুমঝুমের স্বার্থকতা।
বর্তমান,
রুমঝুম এসবই ভাবছিলো। সুফিয়ানকেও রুমঝুম সাগরের মতো ভাবছিলো। যে নিজের স্ত্রীকে এবং প্রেমিকা দু’জনকেই ঠিক রেখে চলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু না। সুফিয়ান তেমন কিছুই করেনি। এসবেই হয়তো সুফিয়ানের প্রতি মায়া জন্ম নিয়েছে। তাছাড়া সুফিয়ান তো অসুস্থ ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রুমঝুম।
__
সময় কেটে যায়। সুফিয়ান তার মায়ের অনেক খেয়াল রাখে। তার মা এসবের মাঝে তাকে রুমঝুমের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে। রুমঝুমের প্রসঙ্গ উঠলে সুফিয়ান চুপ হয়ে যায়। সে কোন কথা বলতে পারে না। সুফিয়ানের মা তাকে শান্তভাবে বলে,“একবার বৌমাকে নিয়ে ভেবে দেখ না সুফি। আমি মানছি ও সবসময় মুখের উপর জবাব দেয়, এটা হয়তো অনেকের ভালো লাগবে না। কিন্তু তার মাঝে কি কোনই ভালো গুন নাই। যেটা একজন মানুষের হৃদয়ে তার জন্য মায়ার জন্ম দিতে পারে।”
সুফিয়ান জবাব দেয় না। সে শুধু শুনে। সুফিয়ানের মা তার অসুস্থতায় রুমঝুম নিঃস্বার্থভাবে তার এবং তার মায়ের কত যত্ন নিয়েছে সেসব কথা বলে। সুফিয়ানের মায়ের কাছে সুফিয়ান রুমঝুমের অতীত সম্পর্কেও জানে। সুফিয়ান বুঝতে পারে কেন বাসর ঘরে তার গালে থাপ্পড় মারতে একবারও ভাবেনি রুমঝুম। কেন প্রতিবেশীদের কথা শোনায়। সবটা বুঝতে পারে সুফিয়ান।
সুফিয়ান একা ঘরে রুমঝুমের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো নিয়ে ভাবে। তার স্মৃতিতে স্নেহার সাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্তগুলোও ভেসে উঠে। এসবের মাঝে মনমরা হলে হঠাৎ রুমঝুমের কিছু কথা মনে পড়লে সে হেসে দেয়। যে সময় সুফিয়ানের হয়তো রুমঝুমের কথা অনেক ঝাঁজালো লেগেছিলো তবে আজ খুব হাসি পাচ্ছে তার সেসব কথা ভেবে।
এভাবেই সময় অনেকটা কেটে যায়। প্রায় এক মাস। সুফিয়ান এবং রুমঝুম দুজন দুদিকে আলাদাভাবে জীবন কাটাচ্ছে। সুফিয়ানের মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রুমঝুমের বাবা আসে দেখতে তবে সুফিয়ান রুমঝুমকে আসা করছিলো। কিন্তু রুমঝুম আসেনি। রুমঝুমের না আসা সুফিয়ানকে কিছুটা হতাশ করে। সুফিয়ান পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। তবে সে বুঝতে পারে তার ভাবনায় আজকাল রুমঝুম বিরাজ করছে। এসব শুধুমাত্র তার সাথে ভুল হয়েছে। অকারণে একটি বিয়েতে জড়িয়ে গিয়ে তার জীবনের ক্ষতি হয়েছে সেজন্য হচ্ছে নাকি অন্যকোন কারণে সুফিয়ানের জানা নেই। সুফিয়ান এসব নিয়ে অনেক ভাবে। অনেকক্ষণ ভাবে। তার মায়ের কথাও সে ভাবে। তার মা হয়তো রুমঝুমকে দেখলে খুশি হতো। কিন্তু মুখ ফুটে এই কথাটি সে বলছে না। সুফিয়ানের মা মূলত তাদের দুজনকে সুখী দেখলে অনেকবেশি খুশি হতো। তার মধ্যে মাঝে মাঝে গিল্ট ফিলিংসও দেখতে পায় সুফিয়ান। যেখানে তার মনে হয় সে রুমঝুমের সাথে সুফিয়ানকে জড়িয়ে অন্যায় করেছে। রুমঝুমের উপর মস্তবড় অন্যায় হয়েছে। সুফিয়ান সবকিছু বিবেচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেয়।
★
সুফিয়ান নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে রুমঝুমের কাছে আসে। রুমঝুম সুফিয়ানকে দেখে অবাক হয়। সে কিছুটা ভয়ও পায়। তার মনে হয় সুফিয়ান তাদের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলতে এসেছে। হয়তো সাথে করে পেপারও নিয়ে এসেছে। এই বিষয়টি ভেবে রুমঝুম কিছুটা কষ্ট পেলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। কোন এক মূহুর্তে তার যে সুফিয়ানের প্রতি দূর্বলতা জন্ম নিয়েছে সেটা সে সুফিয়ানকে বোঝাতে চায় না। শুধু সুফিয়ান নয় সে কাউকেই বোঝাতে চায় না। সেজন্য সে নিজেকে সামলে নেয়। অন্যদিকে সুফিয়ান অন্যরকম দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকায়। যে দৃষ্টি বলছে, সে ডিভোর্স নয় বরং টক ঝাল রুমঝুমের জীবনে মিষ্টি হয়ে এসেছে। তাদের এই সম্পর্কের টক-ঝাল-মিষ্টি এক পরিনতি দিতে এসেছে। রুমঝুম সুফিয়ানের চোখে চোখ রেখে তার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। সুফিয়ানও একই চেষ্টা করে যাচ্ছে। দু’জনার কারোরই চোখে পলক পড়ছে না। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সুফিয়ান রুমঝুমের চোখে চোখ রেখেই বলে,“আপনার জীবনের মিষ্টির অভাব দূর করার কারণ বানাবেন আমাকে ঝুম?”
সুফিয়ান রুমঝুমের জবাবের অপেক্ষায় তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সুফিয়ানের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে রুমঝুম কোনই জবাব দেয় না। রুমঝুম তাকে অপেক্ষায় রেখে দেয়।
(সমাপ্ত)
(স্যরি। গল্প ভালোভাবে শেষ করতে পারিনি। সুন্দর হয়নি। আমি জানি। তার জন্য স্যরি। শেষে এসে অপেক্ষায় রেখে দিলাম, যাতে আপনারা নিজেদের মতো রুমঝুমের জবাবটি কল্পনা করে নিতে পারেন। রুমঝুম যেমন চরিত্রের সেই অনুযায়ী তার জবাব কেমন হতে পারে, আপনারাই বলে যান। আর হ্যাঁ আমি আবারও স্যরি ভালোভাবে গল্পটি শেষ করতে না পারায়। নতুন গল্প এই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারি সেই দোয়া করবেন।)