#টিউলিপ (পর্ব-৫)
#আরশিয়া_জান্নাত
তাজরিন আপু যাওয়ার পর বাসাটা একদম খালি হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটোর হৈচৈ হাসিখেলায় মুখোরিত ঘরটা সুনসান নিরবতায় ছেয়ে গেছে। এমন না আমি খুব শোরগোলে বড় হয়েছি। তবে এখানে মানুষের সংখ্যা খুব কম হওয়ায় হয়তো এই নিরবতা আমার বুকে বিঁধছিল। আমি বেলকনিতে বসে বাইরের মানুষদের দেখছিলাম রায়ান ভার্চুয়াল মিটিং এ ঘন্টা খানেক ধরে বসে আছে। আম্মু কল করেছিল নাইওর যাওয়ার রীতিটা পালন করতে। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের ব্যস্ততা উপেক্ষা করে আর যাওয়া হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে তাজরিন আপুকে জোর করে হলেও আরো কটা দিন রেখে দিলে ভালো হতো।
তার উপস্থিতি অনুভব করে পেছনে গা এলিয়ে বললাম, “অবশেষে কাজ শেষ হলো আপনার?”
“অনেক বোর ফিল করছিলেন তাই না?”
“হু..”
“খুব স্যরি।”
“স্যরি দিয়ে পোষাবেনা। অন্যকিছু চাই।”
“কি লাগবে বলে দেখুন, সেটা হাজির করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
আমি উনার গলা জড়িয়ে বললাম, “যা চাচ্ছি তা চাইলেও যে এখনি হাজির করতে পারবেন না জনাব, কিছু টা টাফ বটে!
“কী শুনি তো আগে?”
আমি উনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, “ঘরভর্তি সোনামনিদের শোরগোল…”
উনি আমার কথার মানে কী বুঝলো কে জানে, উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো, “এটা কোনো ব্যাপার হলো? আপনি একটু সময়দিন আমি এখনি ব্যবস্থা করছি। বলেই কাকে কল করতে চলে গেল।”
আমি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি। এই লোকটা কি সত্যিই বোঝেনি আমি কী বলেছি? আশ্চর্য!
বিকেলের মধ্যেই ছোট ছোট বাচ্চা দিয়ে ঘর ভরে গেল। তাদের উপস্থিতিতে পুরো বাড়ি ফের কোলাহলে টইটম্বুর। আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতেপারছিলাম না। উনি উনার সব কলিগদের ইনভাইট করেছেন, সকলকে বলেছেন তাদের পরিবারের ছোট সদস্যদের মাস্ট আনতে। অতঃপর আর কী করার হাসিমুখে সবার আপ্যায়ন করছি আর ভাবছি আমার ভবিষ্যৎ এতোটা সহজ হতে যাচ্ছেনা যতটা সহজ হবে ভেবেছিলাম।🤦🏻♀️
রান্নাঘরের কেবিনে বসে আম্মুর বানানো পাকোড়া খেতে খেতে বললাম, “তুমি কী ঠিক করেছ রহস্যের জট পাকিয়ে জীবন পার করে দিবে? সত্যি টা কী কেউই বলবেনা?”
“কিসের রহস্যের জট? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“ডক্টর রায়ানকে পাইছো কিভাবে? নেহাতই কাকতালীয় বলে পার পাবা না বলে দিচ্ছি। গত ২বছরে অনেক পাত্রপক্ষ আসছে গেছে, কোনোটাতেই তুমি সায় দিয়েও দাও নাই। কেমন গরিমসি করেছ। কিন্তু এটার বেলা তুমি একদম শুরু থেকে খুব খুশি ছিলা। এবার একটু ঝেড়ে কাশো দেখি।”
আম্মু হেসে কুটিকুটি হয়ে বললেন, “তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে জামাইয়ের কাছ থেকে কথা বের করতে পারিস নি। তাই এসেছিস আমার কাছে। বেচারি…”
“আম্মুউউউউ তুমি আমার আম্মু হয়ে এভাবে অপমান করতে পারোনা…”
“যার নাই মান তার আবার অপমান!”
আমি অসহায়ের মতো মুখ করে বললাম, “তোমার কাছে আমি আমার কোনো ছেলেমেয়েকে দিবোনা। তুমি ওদের সামনে আমাকে বেইজ্জত করে দিবা, পরে ওরা আমাকে আর সম্মান করবেনা।”
“কিরে এতো তাড়াতাড়ি সুখবর এসে গেছে নাকি? যাক এইদিকে অন্তত ফাস্ট হয়েছিস।”
“আআআআআআম্মুউউউউউউ”
“উফফ কানের পর্দা ফেটে গেল রে।”
“তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করতেছ যাতে আমি তোমাকে প্যাঁচাই না ধরি তাই না?”
আম্মু আমার গালে হাত দিয়ে বলল, “এখানে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। আমি শুধু ওকে দেখে চিনেছি বলেই শুরু থেকে খুশি হয়েছিলাম। ছেলেটাকে আমার ১ম দিনই ভালো লেগেছিল এটা তো তোর অজানা না। তাই ওর ছবি দেখে আমি শুধু দোয়া করেছিলাম তোরা কেউ যাতে অমত না করিস।”
নিশান ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে বলল, “ভুল দরজায় বসে ঠকঠক করে তো লাভ হবেনা। আগে সঠিক দরজাটা খুঁজে বের কর।”
আমি চোখ বড় করে বললাম, “ডোন্ট সে তুই এখানে ইনভলব!”
নিশান বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “সুন্দরীদের মাথায় বুদ্ধি না থাকলে মানা যায়, তাই বলে পেত্নিদের মাথায় ও বুদ্ধি নাই! হোয়াট এ শেইম!”
“দেখছো আম্মু তোমার পুঁচকে ছেলে আমাকে কি বলতেছে..”
“এই আপু আমি মোটেও পুঁচকে না, খুব শীঘ্রই আমি ২০ বছরে পা রাখবো।”
“ওলে লে, ২০বছরেই নাকি সে বড় হয়ে যাবে! দেখি এদিকে আয়, নাক চিপে দেখি কত বড় হয়েছিস।”
“তোর বোধহয় কাহিনী টা শোনার ইচ্ছা নাই। যাক না শুনতে চাইলে নাই।”
আমি ওর কান টেনে বললাম না বলে যাচ্ছিস কোথায়, ভালোয় ভালোয় বলে দে নয়তো তোর সব কটা রাজ ফাঁস করে দিবো।”
“এসব ব্ল্যাকমেইলে নিশান ডরায় না। তুই বরং একটা ভালো ডিল তৈরি কর। পছন্দ হলে আমি বলবো।”
অগত্যা বুকে পাথর রেখে আমার সবচেয়ে প্রিয় ল্যাপটপটা ওকে ঘুষ দিয়ে রহস্য উদঘাটন করলাম।
।
“নওরিন? ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
“নাহ, কিছু বলবেন?”
“আমাদের কী কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিত? আই মিন বিয়ের পর সবাই যেমন বেড়ায়।”
“সবাই কেমন বেড়ায়? এই যে বাবার বাসায় এসেছি এটাও তো বেড়াতে আসা এরকম কিছু বলছেন?”(ভং ধরে বলা)
“নাহ”
“তাহলে?”
“হানিমুন বলে যে,, ঐ টাইপ কিছু আর কি!”
“আকাশে তো মুন আছেই, আপনি ছাদে গিয়ে বসেন আমি দেখি বাসায় হানি আছে কি না..”
“আপনি ইচ্ছে করে ফাজলামি করছেন তাই না!”
“ফাজলামির কী আছে আপনাকে কিছু বললে আপনি যেরকম মিনিং বের করেন আমিও আপনার কথার সেরকম মিনিং বের করছি!”
“আমি রিসেন্ট আবার কী করেছি?”
“কিছু করেননি না??”
“সেরকম কিছু তো মনে পড়ছেনা।”
আমি উঠে বসে দুহাতে নিজের মাথা চেপে বললাম, “রিল্যাক্স মিসেস রায়ান। রিল্যাক্স….”
উনি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনি সবচেয়ে বড় জিনিস টাই মিস করে যাচ্ছেন?”
“দেনমোহরের চেক উইথড্র হয়নি? আমাকে আগে বলবেন না?”
“আপনি ঘুমান প্লিজ। আপনার সাথে আর একটা কথা বললে এখন ৩য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।”
আমি রাগে গজগজ করতে করতে তার দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়লাম। উনি কিছুক্ষণ বসে কী ভাবলো কে জানে। হঠাৎ আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বললো, “এমন নয় আমি ইচ্ছে করে এটা এভয়েড করেছি। আমার মনে হয়েছিল এরকম হুট করে কিছু করা ঠিক না। এটলিস্ট অপরপক্ষকে একটু সময় দেয়া উচিৎ মানিয়ে নিতে। কিন্তু আপনি যে এভাবে রাগ করবেন জানলে অপেক্ষা করতাম না”
আমি উনার দিকে ফিরে বললাম, “আমরা দুজন দুজনকে কতটা অনুভব করি এটা তো আর সিক্রেট নেই! তবে অপেক্ষার নামে কাঁটাতার দিয়ে রাখলেন কেন? আমার পুরো শরীর ঐ কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে জানেন?”
উনি আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো, “আজ আমি আপনার সব ক্ষত সারিয়ে দিবো প্রমিজ। Let me love u with all my soul…..”
🌸🌸🌸🌸🌸🌸
আমাদের পরবর্তী জীবন খুব সুন্দর কেটেছে। আমরি একে অপরের আশ্রয় হয়ে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেছি। এমন নয় পথটা খুব সহজ ছিল, তবে এটাও মিথ্যে নয় মানুষটা আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ধৈর্যশীল। ইনফ্যাক্ট তার তুলনায় আমার ধৈর্য অনেক কম। আজকাল অনেকেই বলে সেইম মেন্টালিটির লাইফ পার্টনার পাওয়া ব্লেসিং। বাট ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমার কাছে এটা ভুল মনে হয়। লাইফ পার্টনার বিপরীতমুখী হলেই বরং এডজাস্ট করা অনেকটা সহজ হয় কারণ আমি যেমন রাগ করবো সেই সেইম রাগ অন্য একজন দেখালে সহ্য করতে আদৌ পারবো কি না জানিনা। বরং রণযুদ্ধে দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুরো জীবন পার করবো। ডক্টর সাহেব যে খুব স্বস্তি দেয় তাও নয়। তাকে আজও সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতে হয় আমি কী চাইছি। এছাড়া বাকি যেকোনো বাহ্যিক প্রয়োজন সে বলার আগেই হাজির করে। আমি বুঝে নিয়েছি মানুষ সবদিকে বেস্ট হয়না। আমি ও নই। আর এভাবেই আমরা একে অপরের Soulmate হয়ে জীবন নামক ছোট্ট জার্নিটা পার করছি। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের ছোট্ট সংসারটা যেন এভাবে ই সুখেশান্তিতে থাকে সেই দোয়া করবেন।
এই জীবনে শখের এই একটা জিনিসই আমাকে যন্ত্রণা দেয়নি। আমার শখের পুরুষ আমার জীবনে গ্রিন ফরেস্ট হয়ে ছায়া দিচ্ছে, আরাম দিচ্ছে। আমি সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী!
Back then: রেটিনা কোচিং সেন্টারে পড়াকালীন জুনিয়র ডক্টর রাফি স্যার আড্ডায় বসে তার এক সিনিয়র ভাইয়ের গল্প করছিলেন। তিনি প্রায়ই ক্লাস শেষে নানারকম গল্প বলে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। নিশান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনে। কিন্তু এবারের গল্পটা শুরুতে চেনা চেনা ঠেকলেও নিশান সিওর ছিল না এটা তার বোনের ই গল্প কি না। সবাই চলে যাওয়ার পর সে একটু আন্দাজেই ঢিল মারার মতো বলল, “ভাইয়া ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মে আই আস্ক আপনি কী ডক্টর রায়ানের গল্প বলছেন?
রাফি কিছু টা অবাক হয়ে বললো, “তুমি কিভাবে জানলে, উনাকে চেনো নাকি?”
“আপনি কী মেয়েটার নাম জানেন?”
“না জেনে উপায় কী ইনফ্যাক্ট আমাদের লজিং এর সবাই মোটামুটি জানে ডক্টর রায়ানের মিস নওরীনের খবর!
নিশান ভীষণ চমকে বলল, “আমি কী কোনোভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি প্লিজ না বলবেন না, খুব আর্জেন্ট!!”
রাফি স্যার হেসে বললেন, “আমার গেসিং বলছে তুমি সেই মেয়েটাকে চিনো তাই না!”
নিশান মনে মনে বলল, “আপুনি তুই খুব নিষ্ঠুর। কীভাবে পারলি একটা মানুষ কে এরকম কষ্ট দিতে!”
#সমাপ্ত