তবুও তুমি পর্ব-১+২+৩

0
1

#তবুও_তুমি💙 [সূচনা পর্ব]
~আফিয়া আফরিন

(অচেনা সন্ধিক্ষণে)
আদিয়াত ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় দিয়ে বসেছিল। জুন মাসের দুপুর, জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে ঘরের মেঝেতে সোনালি ছায়া ফেলে রেখেছে। তার হাতে ধরা বইয়ের পাতাগুলো ছুঁয়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মনটা বইয়ের পাতায় ছিল না। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন সৈয়দ জহিরুল ইসলাম, চুপচাপ দৃঢ় পদক্ষেপে। তিনি এসে সোজা দাঁড়ালেন আদিয়াতের সামনে। চোখেমুখে একরকম চাপা অস্থিরতা।
— “তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, আদিয়াত।”
— “কী রকম কাজ, বাবা?” আদিয়াত মাথা তুলে তাকাল।

জহিরুল ইসলাম কণ্ঠটা নরম রাখলেন, কিন্তু তাতে আদেশের তীব্রতা চাপা পড়ল না।
— “তোমার বিয়ে ঠিক করেছি, আজই। প্রস্তুত হও।”

আদিয়াতের মুখে কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠল না, শুধু চোখের পাতাটা একটু নড়ল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— “বিয়ে? আজ? হঠাৎ কেন?”

তিনি একমুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেন, নিজের মধ্যে কিছু লুকোতে চাইছেন। তারপর বললেন,
— “আমার একটামাত্র কথা রক্ষা করার জন্য। আমার সম্মানের প্রশ্ন। বিশ্বাস করো, আমি তোমার ক্ষতি চাই না। কিন্তু এই বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে।”

ঘরটা কেমন থমথমে হয়ে উঠল। পাশের ঘর থেকে বড়বোন আলিয়া বেরিয়ে এসে বলল,
— “বাবা, এটা কি ধরনের সিদ্ধান্ত? তুমি আমাদের কিছু জানালে না?”

জহিরুল ইসলাম শান্ত স্বরে বললেন,
— “জানানোর মতো সময় ছিল না। যদি আমার কথার কোনো মূল্য থাকে, তবে আমি চাই তুমি ভাইকে বোঝাও।”
উনি দৃঢ় পায়ে হেঁটে ঘরে চললেন। তার হাবভাব বোঝা গেল না। আদিয়াত এখনও হতভম্ব। এইরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, ভেবেছিল কখনও? আলিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবছে বাবার বলে যাওয়া কথাগুলো। চোখে অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বিধা। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
— “ভাই আমি জানি, এটা তোর জন্য সহজ নয়। কিন্তু বাবার চোখের দিকে তাকা। কিছু একটা লুকানো আছে এখানে… কিছু গুরুতর।”

আদিয়াত কিছুক্ষণ নিরব বসে থাকে। বাবার বলা কথাগুলো যেন চারপাশে গুমরে গুমরে প্রতিধ্বনি তুলছে। সে চোখ বুজে একবার গভীর নিঃশ্বাস নেয়। তার মুখে আতঙ্ক নেই, উত্তেজনাও না। একটা ধীর, ভারী ভাবনা খেলা করছে চোখে-মুখে।
সে জানে—এই পরিবার, এই পদবি, এই সিদ্ধান্ত; সবই বহন করে ইতিহাস, গর্ব আর কিছু অজানা দায়। সৈয়দ জহিরুল ইসলাম হঠাৎ করে কোনো কথা বলেন না। তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত পেছনে থাকে কারণ, প্রেক্ষাপট আর অনেক না বলা গল্প। কিন্তু আদিয়াতও আর ছোট নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের পড়াশোনা শেষে যুক্তি আর মানবিকতা নিয়ে যার নিজস্ব চেতনা গড়ে উঠেছে। পড়াশোনা শেষেই সে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে সাবলীলভাবে, বাপ চাচার সাথে। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছে ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে। তবে আজকের এই সিদ্ধান্ত অন্যরকম।
সে নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— “বিয়ে মানে শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়। আমি কোনো মানুষকে জীবনে টেনে নিচ্ছি—তার সম্মান, তার ভবিষ্যৎ, তার অনুভব সব কিছুর দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি কি অন্ধভাবে সেই দায় নিতে পারি? বাবা কখনও এমন করে বলেন না, এমন অনুরোধ কখনোই করেন না; যা আমরা রাখতে পারব না। তার চোখের ওই নীরবতা… সেখানে একটা ব্যথা ছিল। আর আমি জানি, আমি তার সেই ছেলে, যার ওপর সে ভরসা করে।”
বাবার চোখের সেই অনুরোধ কোনো সাধারণ অনুরোধ নয়। এর পেছনে কিছু একটা আছে। হয়তো কোনো কথা, কোনো প্রতিশ্রুতি, অথবা… কোনো অপরাধবোধ, যা তার বাবা তাকে না বলেও বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। বাবার বড় ছেলে হয়ে সে পালাতে পারে না। সে প্রশ্ন করে নিজেকে তারপর ভাবে এবং বিচার করে।

চুপচাপ সে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ভেতরকার তীব্র এক উপলব্ধি টের পায়। একটা ঝড়ো অধ্যায়ের শুরু যেন সে আগেই টের পেয়ে গেছে। আদিয়াত ধীরে ধীরে বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে তখন সূর্যের আলো ফিকে হয়ে এসেছে কিন্তু জহিরুল ইসলামের মুখে অন্যরকম দ্যুতি খেলা করছিল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে আদিয়াত একটু থমকালো, তারপর বলল,
— “আমি রাজি, বাবা।”

জহিরুল ইসলাম একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর তার চোখে একটা প্রশান্তির ছায়া নেমে এল। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কোনো দায় যেন হালকা হয়ে গেল।
— “তোমাকে ধন্যবাদ, আদিয়াত। তুমি আমার মুখ রক্ষা করেছ।”
তার কণ্ঠের কম্পনে লুকানো একটা অপরাধবোধও ধরা পড়ে কিন্তু মুখে ছিল শুধু প্রশংসা আর স্বস্তি। তিনি সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালেন। দরজার বাইরে গিয়ে স্ত্রী নাজনীন বেগমকে ডাক দিলেন।
— “নাজনীন, আদিয়াত রাজি হয়েছে। তুমি আর আলিয়া একটু হালকা করে আয়োজন করো। আমরা কিছুক্ষণ পর বউ নিয়ে ফিরছি।”

নাজনীন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— “এত তাড়াতাড়ি?”

— “হ্যাঁ।” জহিরুল ইসলাম বললেন, “দাম্পত্যের শুরুটা হোক একেবারে আমাদের মত করে; নিরবে, শ্রদ্ধায়, বিশ্বাসে।”

আলিয়া তখন ভেতর থেকে এগিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। এক চোখে বিস্ময়, এক চোখে আনন্দ।
— “ভাই আসলেই আলাদা, তাইতো রাজি হলো বাবার ওমন সিদ্ধান্তে।”
বাড়ির ভেতর একটা হালকা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘরোয়া বিয়ের প্রস্তুতির মাঝেও একটা রাজকীয় মর্যাদা জেগে ওঠে। কারণ তারা জানে, আজ যে বউ আসছে, যে হঠাৎ এ বাড়ির সদস্য হচ্ছে, সে এই বাড়ির এই পরিবারের বড় বউ; তার জন্য এ পরিবারের হৃদয় আগে থেকেই প্রস্তুত!
.
বিয়েটা হয়ে গেল খুবই সংক্ষিপ্ত, নিরবে। মসজিদের ছোট্ট একটি কামরায় বসে দুই পরিবারের প্রতিনিধিরা চুপচাপ সাক্ষী রইলেন এক অদ্ভুত সময়ের। একপাশে আদিয়াত; পরিপাটি পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, মুখে অস্পষ্ট এক দ্বিধা; অন্যপাশে মেয়েটি ঘোমটায় ঢাকা, শান্ত এবং স্থির। তার পাশে শুধুমাত্র একজন পুরুষ, চাচা বিল্লাল হক। এই লোকটিকে আদিয়াত আগে কখনো দেখেনি কিন্তু তার চোখের চাহনিতে ছিল দায়িত্ব আর একরকম চাপা বিরক্তি। একবারের জন্যও কেউ মেয়েটির বাবার কথা তোলে না। কেউ জানতে চায় না কেন তিনি আসেননি। আদিয়াতও চায় না। শুধু ভাবতে থাকে, “কী এমন সম্পর্ক? কী এমন ঘটনা, যা এত লুকিয়ে রাখতে হয়? আমাকে এমন একটা বিয়েতে বসতে হলো, যেখানে বর-কনে দুজনেই অপরিচিত এক ভবিষ্যতের দিকে হাঁটছে; নিঃশব্দে, নির্বাকভাবে।”
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই ইমাম সাহেব কাগজে স্বাক্ষর চাইলেন। দেনমোহরের অঙ্কটা আগে থেকেই ঠিক ছিল, হাতে হাতে পরিশোধও করে দেওয়া হলো। কোনো বিলম্ব নেই, কোনো আনুষ্ঠানিক শব্দ নেই। আদিয়াত একমুহূর্ত চেয়ে দেখল মেয়েটির দিকে। ঘোমটার আড়ালে সে নিজেই নিজের পৃথিবীতে বন্দী। পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিল। আদিয়াতের চোখেমুখে কোনো কৌতূহল নেই, কিংবা কোনো দুঃখ বা আনন্দও নেই। জহিরুল ইসলাম আস্তে বললেন,
— “চলো, বাড়ি ফিরি।”

আদিয়াত মেয়েটির পাশে এগিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু একবারের জন্যও সে মুখ দেখতে চাইল না, সম্ভবত ইচ্ছে করল না। গাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হলো। মেয়েটি ঘোমটা ঠিক করে চুপচাপ উঠল পেছনের সিটে। আদিয়াত পাশে বসে গাড়ির দরজা টেনে বন্ধ করল। গাড়ি মসজিদের গলি থেকে মোড় নিল বাড়ির দিকে।
বাড়িতে পা রাখতেই নতুন বউকে ঘিরে এক নরম, নিরব উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
নাজনীন বেগম নিজ হাতে বধূবরণের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কারো মধ্যে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না কিন্তু চোখেমুখে একটা চুপচাপ আনন্দ ছিল সবার।
আলিয়া নিজেই হাত ধরে বউকে ভেতরে নিয়ে এলো। আদিয়াত তখনও কিছুটা দূরে, আড়াল রেখে চলার সহজাত অভ্যাস তার। নিজের মনটাকে বোঝানোর জন্য সকলের আড়াল হলো কিছু সময়ের জন্য।

নতুন বউকে ঘরে বসিয়ে আলিয়া পাশে বসল। আলতো হেসে বলল,
— “এই ঘরটা এখন থেকে তোমার। ভাবছো তো, কত দ্রুত সব পালটে গেল?”
বউ কিছু বলে না কিন্তু মাথা নাড়ে ধীরে।

আলিয়া আবার বলল,
— “আমি হচ্ছি তোমার ননাস, বুচ্ছো?” তারপর একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “চিন্তা করো না, তোমার সংসারে আমি কিন্তু নাক গলাচ্ছি না। আমারই সংসার আছে। তোমার ভাইয়া তো দেশে নেই, তাই এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আর এখন তো বুঝতেই পারছো, একেবারে নাটকীয় একটা বিয়ে দেখে ফেললাম।”

তার কথা শুনে বউয়ের ঠোঁটে সামান্য এক হাসি খেলে যায়। আলিয়া সেটা ঠিকই লক্ষ্য করে বলে ওঠে,
— “এই তো, হাসিটা বেশ সুন্দর। হাসিখুশি থাকবে সর্বদা তাহলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়?”
বউ এবারও চুপ থাকে। আলিয়া তার হাতটা ছুঁয়ে বলল,
— “এই ঘরটা যেমন তোমার, আমরাও এখন তোমার। কোনো ভয় নেই, এখানে ঠিক আছো তুমি।”
ঘরের জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পর্দা উড়তে থাকে। ঘোমটার আড়াল থেকে মুখটুকু স্পষ্ট দেখা যায় না এখনো। আলিয়া ঠিক তখনই জিজ্ঞেস করল,
— “এই যে শুনি, তোমার নামটা বলো তো? চেহারাও ভালো করে দেখতে পারলাম না। বাবা হুট করে ভাইকে এসে বলল বিয়ের কথা। মহা যন্ত্রণা!” নতুন বউ একটু মুখ তুলে তাকাতেই নিচতলা থেকে চিৎকার ভেসে এলো।

— “জহির ভাই, আপনি এমন করলেন কী করে? ছেলের বিয়ে আর চাচার সাথে একবার পরামর্শেরও দরকার হলো না?”
চেনা কণ্ঠ। একমাত্র চাচা, সৈয়দ আমিনুল ইসলাম।

আলিয়া দাঁড়িয়ে গেল। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
— “তোমার নামটা একটু পরে জানি, এখন একটু নিচে যাই দেখি কী হলো।”

সে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিচতলায় পৌঁছেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে আছেন সৈয়দ আমিনুল ইসলাম—রেগে ফেটে পড়ছেন একরকম। পাশে দাঁড়িয়ে জহিরুল ইসলাম, মুখটা শক্ত করে রেখেছেন তবে শান্ত। নাজনীন বেগম একটু দূরে, চাপা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে।

— “আপনার ছেলের হঠাৎ বিয়ে দিলেন, আর আমরা জানতেই পারলাম না! এইটা কী? আমাদের ভাইপো, আপনার ছেলে, তার জীবনের এমন বড় সিদ্ধান্ত আমাদের না জানিয়ে কীভাবে নিলেন?” চাচার কণ্ঠে তীব্র অভিমান, কিন্তু সেই সাথে প্রশ্নচিহ্নও।

জহিরুল ইসলাম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “আমিন, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগতও হয়। এটা আমার একান্ত দায়িত্ব ছিল, আমি তা পালন করেছি। সময় হলে সব বলব।”

— “সময় হলে? আরে ভাই, আপনি কী ভাবছেন? পরিবারে এভাবে গোপনে কাজ করা যায়?”
আমিনুল ইসলাম এবার চোখ সরালেন আলিয়ার দিকে,
— “তুই বল মা, তোর ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল, তোদের কাউকেই আগেভাগে কিছু জানানো হলো না। এর মাঝে নিশ্চয়ই কোনো গোপন রহস্য আছে।”

আলিয়া একটুও না ঘাবরে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— “চাচা, আপনি তো জানেন, বাবা যা ঠিক করেন তা নিয়ে তর্ক করার মানুষ আমরা কেউ না। আপনি একটু বসুন। দয়া করে এভাবে হাঙ্গামা করবেন না। নতুন বউ ঘরেই আছে। এসব শুনলে তার মন খারাপ হবে। বাবা আমাদের জন্য কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নাই। সেটা আমি এবং আমার দুই ভাই খুব ভালো করেই জানে। আর তাইতো, আদিয়াত কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে।”
আমিনুল ইসলাম ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। চোখেমুখে রাগ, অপমান আর একরাশ হতাশা। তিনি বসার বদলে ঘরের মাঝখানে পায়চারি শুরু করলেন। গলায় কাঁপন, চোখে টান টান উত্তেজনা।
— “তোমার এই সিদ্ধান্তে শুধু আমাকে অপমান করা হয়নি। আমার মেয়েটার দিকেও অন্যায় করা হয়েছে, জহির ভাই।”

জহিরুল ইসলাম এবারও চুপ। ভাইয়ের কথা থামার অপেক্ষা করছেন যেন।
— “তোমরা সবাই জানো, নীরা… আমার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তোমাদের মাঝে বড় হয়েছে। আমি কতবার সরাসরি না হোক, ইনিয়েবিনিয়ে বলেছি আদিয়াত আর নীরার জুটি হলে মন্দ হয় না। তোকে তো সরাসরি বলেছিলাম আলিয়া। তুই বল, তোর ভাইয়ের সাথে আমার মেয়ের বোঝাপড়া খারাপ ছিল কখন?” চোখ সরলো আলিয়ার দিকে।

আলিয়া এবার মুখ নামিয়ে ফেলল। কিছু বলার মতো নয় এই মুহূর্তে। চাচার কণ্ঠ এবার আরো ব্যথাভরা,
— “আজ সেই ছেলেটার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল, আমাদের কাউকে না জানিয়ে। এই অসম্মান শুধু ব্যক্তিগত না, পারিবারিকও।”

নাজনীন বেগম একটু এগিয়ে আসলেন, শান্ত গলায় বললেন,
— “আমিন ভাই, আমি বুঝি আপনার কষ্ট। কিন্তু আপনি জানেন না কিছু কারণ আছে। সব কিছু মুখে বলা যায় না। সময় দিলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।”

চাচা এবার আর্তনাদের মতো করে বললেন,
— “সময় দিলে কী হবে, বলেন ভাবি? মেয়ের চোখে স্বপ্ন ছিল! আমি কী বলব তাকে? যে ভাইপোকে সে নিজের মানুষ ভেবেছিল, সে তো আজ চুপিসারে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিল।”

আলিয়া এবার কিছুটা বিরক্তবোধ করে বলল,
— “চাচা, আমরা কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি। আপনার কষ্টটা আমরা বুঝি। কিন্তু ভাইয়ের এই বিয়েটা হয়তো বাবার অনেক দিনের একটা প্রতিজ্ঞার ফল… কিছু কথা আছে যেগুলো শুধু বাবা বলতে পারবেন।”

চাচা ফোঁস করে ওঠেন,
— “তাহলে বলুক, এখনই বলুক। আমিও শুনি একটু, আমার চুপ করে বসে থাকার সময় নেই।”
আদিয়াত এতক্ষণ এইখানে উপস্থিত ছিল না। উপরের একঘরে গিয়ে নিজের সাথে বোঝাপড়া করছিল। কথাবার্তা স্পষ্টতা অনুসরণ করে নেমে এলো। সেই মুহূর্তে সিঁড়ির ধাপ ধাপ শব্দে সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল ওপরে। মুখে অভিমান নেই, তর্ক নেই—একটা দৃঢ়, শান্ত অভিব্যক্তি।
চাচার চোখে চোখ রেখে সে বলল,
— “চাচা, আপনার রাগটা আমি বুঝতে পারছি। আপনার মতো আমিও হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমিও অবাক হয়েছি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আমার বাবার। আর আমি তার ছেলে, তার সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করাটা আমার কাছে অসম্ভব।”
একটু থেমে, মৃদু গলায় বলল,
— “আপনি তো জানেন, বাবা সহজে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। উনার জীবনে কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল, কিছু দায়িত্ব ছিল; আমাকে তিনি বলেছিলেন শুধু এটুকু, তুমি আমার মুখের কথা রাখো। ব্যাস, আমি রেখেছি।”

চাচা এবার একটু পিছিয়ে এলেন। আদিয়াতের চোখে একধরনের স্থিরতা, যা তাকে চুপ করিয়ে দিল।
— “নীরার ব্যাপারে আপনার যে ভাবনা ছিল, সেটা আমিও বুঝেছি। আমি সম্মান করি সেটা। কিন্তু আমি কোনোদিন আপনাকে কোনো আশা দিইনি। এই বিয়ের পেছনে যদি অন্যায় কিছু থাকত, আমি নিজেই এক পা’ও এগোতাম না।”

আদিয়াত এইবার বাবার পাশে এসে দাঁড়াল।
— “এই বিয়েটা হঠাৎ হলেও অসম্মানের কিছু নয়। আমাদের পরিবারের সম্মান থাকুক—এইটুকুই আমি চাই। আপনার চোখে যদি আমি ছোট হয়ে থাকি, দুঃখিত। তবে বিশ্বাস রাখেন, আমি বাবার সিদ্ধান্তকে শুধু মানিনি, হৃদয় থেকেও মেনে নিয়েছি।”
ঘরে এক মুহূর্তের নীরবতা। চাচার মুখে কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা আহত অহংকার।
আলিয়ার চোখে গর্ব, তার ভাই ঠিক সময়েই ঠিক কথাটা বলেছে।
.
চাচা হম্বিতম্বি করে ফিরে গেছেন। বাড়ির বাতাস যেন একটু হালকা। কিন্তু সেই হালকাভাবের নিচে লুকিয়ে আছে অজানা চাপা টেনশন। নাজনীন বেগম নতুন বউকে দেখার উদ্দেশ্যে একবার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
আলিয়া বলল,
— “মা, সকালে দেখো বউমার মুখ। এখন ও খুবই ক্লান্ত। সারাদিন যা হলো…”

নাজনীন মাথা নেড়ে ধীরে পেছনে সরে গেলেন। আলিয়া এবার ভাইকে নিয়ে ঘরের দরজার কাছে এলো।
হালকা হেসে বলল,
— “ভাই, একটু অচেনা লাগলেও সময় নিয়েই চেনা হবে। আর… বউয়ের সাথে সাবধানে কথা বলিস, সেও চাপের মধ্যে আছে ক্লিয়ারলি বোঝা যাচ্ছে।”

আদিয়াত হালকা মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকল। ঘরের কোণে বসে আছে এক শান্ত ছায়ামূর্তি, ঘোমটায় আপাদমস্তক ঢাকা। মাথা নিচু, হাত ভাঁজ করে কোলে রাখা। ঘরের নরম আলোয় তার বসে থাকা অবয়ব ছায়ার মতো নিস্তব্ধ। আদিয়াত থমকে গেল। কত কিছুর ভেতর দিয়ে আজকের দিনটা গেল। কিন্তু এই মুহূর্তটাই যেন সবচেয়ে অপরিচিত। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর নিজের গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল,
— “বিয়েতে আপনার মত ছিল?”

ঘোমটার আড়াল থেকে কোনো শব্দ এল না। শুধু নিঃশ্বাসের খুব হালকা গতি।
আদিয়াত জানে, এই নীরবতা মানে অনেক কথা। একটা মেয়ের জন্য এভাবে বিয়ে হওয়া, এই অবস্থায় এক নতুন ঘরে আসা, এটা সহজ নয়। তার নিজের মনেও হাজার প্রশ্ন। কিন্তু আজ সে আর কোনো প্রশ্ন করতে চায় না। ঘরে নীরবতা, বাতাসেও একটা দ্বিধা মিশে আছে।
আদিয়াত কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরেকবার নিজেকে সংহত করল। তারপর একটু নরম গলায় বলল,
— “আপনার নামটা…?”

মুহূর্তখানেক নিস্তব্ধতা। তারপর একদম হঠাৎ করেই মেয়েটি ধীরে ঘোমটা সরিয়ে নিল। এক মুখ চাঁদের মতো শান্ত, চোখে অভিমান আর অচেনা আতিথ্যের মিশেল। সে মিষ্টি অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “আমার নাম আরশীন, আলভিনা হক আরশীন।”
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি💙 [পর্ব-০২]
~আফিয়া আফরিন

(অগ্রদূত)
নামটা শোনার পর আদিয়াত খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মেয়েটা এখন ঘোমটা সরিয়ে, মাথা নিচু না রেখে, সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে কোনো জড়তা নেই, যেন সে অনেকটা জানে কী কী জিজ্ঞেস করতে পারে আদিয়াত এখন! আরশীন হালকা হেসে বলল,
— “আমি জানতাম আপনি নাম জিজ্ঞেস করবেন।”

আদিয়াত একটু কৌতূহলী মুখে তাকাল,
— “পরিচয়ের প্রথম পর্বে নাম জিজ্ঞেস করাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা আপনি কি আগে থেকেই জানেন আমি কে?”

— “জানি। পরিচিত না হলেও, নামটা নতুন না। আর আজ তো… আপনার সাথে আমার বিয়েটাই হয়ে গেল।” একটু হেসে বলল সে।

— “আসলে আমি কিছুই জানতাম না। শুধু বাবার কথার মান রাখতে এই সিদ্ধান্তটা… একরকম না বুঝেই নিতে হলো।”

আরশীন একটু গম্ভীর হলো। তারপর বলল,
— “আপনার সাহস আছে। একরকম না বুঝেই, একটা জীবনকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। আচ্ছা আপনি কি খুব অনিচ্ছায় বিয়ে করেছেন? এরকমটা হলে আমার ভীষণ অপরাধবোধ হবে।”

আদিয়াত উল্টো জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি খুব অনিচ্ছায় এসেছেন?”

আরশীন মাথা নাড়ল। বেশ গুছিয়ে জবাব দিল,
— “না। আমি জানতাম, এটা হঠাৎ কিন্তু অপ্রত্যাশিত না। আমার চাচা বলেছিলেন, বিয়েটা হবে। শুধু কবে, কীভাবে, তা জানতাম না। কিন্তু যখন শুনলাম… আপনার বাবা নিজে চাচার কাছে গেছেন, তখন আমি আর প্রশ্ন করিনি।”

আদিয়াত একটু চুপ করে রইল। তারপর ধীরে বলল,
— “আপনার একদমই কিছু বলার ছিল না? কিছু জানার ছিল না? আমার সাথেই কেনো আপনার বিয়েটা হতে হচ্ছে তাও আবার ধরাবাঁধা সময়ের মধ্যে।”

আরশীন এবার কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
— “সত্যিটা জানতে চাওয়ার অধিকার অবশ্যই আপনার আছে। এই বিয়ের পেছনে সত্যি কিছু আছে, যা আপনি জানেন না। আর আমি চাই না, এই বিয়েটা শুধু মানসিক বোঝা হয়ে থাকুক। সেটা তো আমাদের দুজনেরই প্রতি অন্যায় হবে, না?”

আদিয়াত গভীরভাবে মাথা নাড়ল,
— “আপনি ঠিক বলেছেন। আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, বাবার কথার পেছনে কী ছিল। আর তার আগে…আমি, বা আমার বাড়ির কেউ চাইব না আপনি একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে এসে পরের মত থাকেন। এই ঘর, এই বাড়ি, সবটাই নিজের মনে করার চেষ্টা করুন। আমি তাড়াহুড়োতে বিয়ে করলেও, সম্মান দেওয়ার বিষয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করব না। এই বিয়েটা হঠাৎ ছিল। একটা সিদ্ধান্ত, যার ভিত মজবুত না কোমল জানা নেই।”

আরশীন এক গাল হেসে বলল,
— “এই কথাটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য।”
আদিয়াত চাইলে আরও অনেক কিছু জানতে পারত। তার মনে প্রশ্নের জট লেগে আছে; এই বিয়ে, এই মেয়ে, এই রহস্য। কিন্তু তারপরেই তার চোখে পড়ে আরশীনের শান্ত মুখ, ক্লান্ত দৃষ্টি। হয়তো সেও একটা লম্বা দিন পার করে এসেছে।
আদিয়াত ভাবছিল, হয়তো সে শুধু ভদ্রতার খাতিরেই উত্তর দিচ্ছে। তাই আর কিছু না বলে বলল,
— “আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।”

আদিয়াত উঠে যেতেই, দীর্ঘ এক চাপা নিশ্বাস ফেলে আরশীন হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল।
— “উফফ…” সে মুখে একরকম চাপা কষ্টের শব্দ করল।
ঘোমটার নিচে বসে থাকার একঘেয়েমি আর ক্লান্তি যেন শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কোমড়, পিঠ, হাত, পা—সব ব্যথা করছে। সে একটু পা ছড়িয়ে দিল, হাত মেলে দিল দু’দিকে। তারপর ধীরে ধীরে চারপাশটা দেখতে লাগল।
ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিঃশব্দ। আলোটা হালকা ধূসর, নরম। দেয়ালে ছিমছাম সাজানো কিছু বইয়ের তাক, একপাশে ছোট একটা টেবিল ঘড়ি আর দেয়ালের গা ঘেঁষে একজোড়া চেয়ার। আশপাশটা দেখে আরশীনের ভালোই লাগল।
সে আস্তে বিছানায় হাত রাখল। হঠাৎ তার ঠোঁটের কোণে একরকম নির্লিপ্ত হাসি ফুটে উঠল। জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল আরশীন। রাতের হাওয়ায় পর্দা উড়ছে ধীরে ধীরে। একটা গা ছমছমে শীতলতা যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে এসে তাকে ছুঁয়ে গেল। সে নিজের দুই হাত জড়িয়ে ধরল বুকের কাছে। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। জীবনের নতুন ধাপে পা দিয়েছে। অজানা এক ঘরে, অপরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে শুরু করেছে নতুন পথচলা। তবুও ভিতরে কোথাও এক চিলতে আশ্বাস, এক ধরনের নিশ্চিন্ততা। নিচু গলায়, যেন নিজের কাছেই বলল সে,
— “জহির আংকেল তাহলে ভুল বলেন নাই। আমিও তাকে ভরসা করে ভুল করিনি। আদিয়াতকে বিশ্বাস করা যায়। তিনি আংকেলের মতই দৃঢ়, শান্ত স্বভাবের। অন্তত আজকের এইটুকু সময়ে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল।”
তার চোখে একধরনের আত্মপ্রত্যয় জ্বলে উঠল। সে জানালার কাঁচে হাত রাখল।
নতুন জীবনটা কঠিন হোক বা সহজ—সেখান থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে আসা যাবে না।

আদিয়াত ফিরে এসে অভ্যাসবশত দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিল। পরক্ষণেই সে এক মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখ চলে গেল জানালার দিকে, যেখানে আরশীন দাঁড়িয়েছিল। একধরনের দোলাচলে পড়ে গেল সে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত? একসাথে একই ঘরে, একই বিছানায় শোয়াটা কি ঠিক হবে? বিয়ে হয়েছে সত্যি, কিন্তু এত দ্রুত, এত হঠাৎ করে…
তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে একগুচ্ছ ভাবনা। অপরিচিত একটা মেয়ে, কিছুক্ষণের পরিচয়ে সে কীভাবে চট করে অধিকার ফলাতে পারে? বিয়ে বিষয়টাকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। এখন বিয়ে হয়েছে, মানেই তো সব কিছু নিজের মতো করে নেওয়া নয়। আদিয়াত একটু এগিয়ে আসে। কিন্তু তার অস্থির চোখ, দ্বিধাপূর্ণ ভঙ্গি দেখে বোধহয় আরশীন সব বুঝে গেল। সে ধীরে বিছানার একপাশটা হাত দিয়ে ঠিক করে বলল,
— “আপনি শুয়ে পড়ুন না। আজকের দিনটা আপনার জন্যও সহজ ছিল না মনে হয়।” মেয়েটার কণ্ঠে কোনও কৃত্রিমতা নেই। একটা সহজ, শান্ত ভঙ্গি। যেন বোঝে এই সম্পর্কটা সময় নিয়ে গড়ে তুলতে হবে।

— “আপনার সমস্যা হবে না তো? যদি অস্বস্তি বোধ করেন, তাহলে আমি অন্য ঘরে ব্যবস্থা করে নিই।”

আরশীন তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তাকাল। তার চোখে ছিল অবাক হওয়া আর একরকম দৃঢ়তা।
— “না না, কোনো দরকার নেই। সমস্যার প্রশ্নই আসে না। আমার জন্য আপনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন, এটা তো হয় না। প্লিজ!” তার কণ্ঠে যেন একরকম তৎপরতা। আদিয়াত কিছু বলল না। আরশীনের কণ্ঠে কোনও দ্বিধা ছিল না বরং একরকম আত্মমর্যাদা আর স্বচ্ছতার ছাপ।
একটু পর বিছানার দু’পাশে তারা দু’জন শুয়ে পড়ল। মাঝখানে কিছুটা দুরত্ব রাখল ইচ্ছাকৃতভাবে। ঘর নিস্তব্ধ, কেবল টেবিল ল্যাম্পের নরম আলো আছড়ে পড়ছে। দুজনই নিঃশব্দ কিন্তু একটুকরো অদৃশ্য সম্মতির সেতু যেন তৈরি হয়ে গেল তাদের মাঝখানে।
.
বাড়ির ভেতরে তখনও নিঃশব্দতা। দূরে মসজিদের মাইকে ফজরের আজান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। পাখিদের কিচিরমিচির, জানালার পর্দায় ফালাফালা আলো পড়ছে, হালকা রোদ্দুরে ঘরের দেয়াল রূপালি হয়ে উঠেছে।
আরশীন প্রথমে চোখ খুলে জানালার দিকে তাকাল। অচেনা এক ঘর, অচেনা মানুষ! বিছানার একপাশে আদিয়াত ঘুমিয়ে আছে। মুখটা শান্ত, স্থির। সে আস্তে করে উঠে বসল। তার পা মেঝেতে ছোঁয়ামাত্র একটু শীতলতা ছুঁয়ে গেল। সে পর্দা সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। ভেজা ভেজা ঘাস, আর দুটো কাক পাখা মেলে ওড়াউড়ি করছে। অদ্ভুত এক বাস্তবতা চারপাশ ঘিরে ধরেছে কিন্তু মনে হচ্ছে সে প্রস্তুত; নতুন এই পরিচয়ের, এই সম্পর্কের, এই সকালের জন্য। পেছনে বিছানায় আদিয়াতের নড়াচড়ার শব্দ পেল সে।
আরশীন জানালার গ্লাসে কপাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভোরের আলোটা ধীরে ধীরে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন তার চুপ থাকা ভেঙে দিচ্ছে আলো-হাওয়ার স্পর্শ। এই বাড়িতে তার আগমন শুধুই আকস্মিক এক বিয়ের পরিণতি নয়। সে এসেছে একটা ভীষণ উদ্দেশ্য নিয়ে। জহির আংকেল বলেছিলেন,
— “সব কিছু আমি সামলাবো। তুমি শুধু সাহস রেখো আর নিজেকে গুটিয়ে রেখো যতটা পারো।”
আরশীন সেই কথায় ভরসা রেখেছে। সে জানে না, তার এই ছোট্ট যাত্রা কোথায় গিয়ে শেষ হবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত তার কাজ অনেক কঠিন। একই ঘরে, একই ছাদের নিচে থেকে আদিয়াতকে জানতে দেওয়া যাবে না অথচ তাকে বোঝাতে হবে। সে নিজেকে আড়াল রাখবে, কিন্তু তার লক্ষ্য—কাউকে বুঝতে না দিয়েই ছুঁয়ে যাবে সবাইকে।

নাজনীন বেগম ডান হাতে ওড়নার খুঁট ধরে হালকা ঠেস দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বউমাকে প্রথমবার চোখের সামনে পেয়ে অনেক কিছুই একসাথে দেখলেন। আরশীনের পিঠে ছড়ানো চুল, যেটা এখনও আঁচড়ানো হয়নি। দেখলেন তার চোখের ভেতরের ভয় মেশানো লজ্জা, যেটা ঠিক নতুন বউয়ের মতোই। আরশীন তার চোখে চোখ পড়তেই ঘাবড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে ঘোমটা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করল কিন্তু খোলা চুলে ও সেটাও ঠিকমতো করতে না। নাজনীনের মন খারাপ হলো না বরং মায়া লাগল।
মেয়েটা যতটা অগোছালো, ততটাই মায়াবী। শুধু চোখ নয়, সেই শ্যামলা মুখে একটা ধীর শান্ত আকর্ষণ আছে। চোখ দুটো টানা টানা, যেন কিছু না বলেও অনেক কথা বলছে। চোখের নিচে সামান্য গর্ত আছে কিন্তু সেই গর্তে ক্লান্তির ছায়ার চেয়ে জীবন দেখার চিহ্ন বেশি।
নাজনীন দেখলেন, বউমা তার দিকে তাকিয়ে একটু জোর করেই হাসল।
আর সেই হাসিটা… একটা ভাঙা-ভাঙা আস্থার ইঙ্গিত রাখল। এই মেয়েটা অভ্যস্ত নয় এত দৃষ্টি সামলাতে তবে দৃষ্টি তার ওপর পড়লে সে পালিয়ে যেতে চায় না। এই জিনিসটা ভালো লাগল নাজনীনের। নাজনীন সোফার পাশের চেয়ারটায় বসে আলতো গলায় বললেন,
— “এসো।”

আরশীন একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। পায়ে যেন শব্দ না হয়, এমন ভঙ্গিতে ধীর পা ফেলে সামনে দাঁড়াল। নাজনীন তাকে ভালো করে লক্ষ করলেন একবার। তারপর হালকা হাসলেন।
— “বসো।”

আরশীন নিচু গলায় বলল,
— “জ্বি।” চোখে-মুখে জড়তা, কণ্ঠে একরকম আদবকায়দা। তবু একটা স্বচ্ছতা আছে যেন।

— “তোমার বাবার নাম কী?” নাজনীন আচমকাই জিজ্ঞেস করে বসলেন।

আরশীন এক মুহূর্ত থমকে গেল। তারপর নিচু গলায় বলল,
— “উনি আর বেঁচে নেই।”

এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। নাজনীন গলার স্বর আরও কোমল করে বললেন,
— “আহা। আর মা?”
আরশীন উত্তর দিতে যাবে, এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখা গেল সৈয়দ জহিরুল ইসলামকে। বরাবরের মত তার চেহারা শান্ত কিন্তু চোখের দৃষ্টি দৃঢ় এবং তীক্ষ্ণ। তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
— “সব আছে। মা, বোন—ওরা গ্রামে থাকে। সময় হলে দেখা হবে সবার সাথে।”

নাজনীন এক চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন, একটু অবাক—উনি নিজে কথা বলে বউমার উত্তর সামলে দিলেন। জহিরুল ইসলাম আর দেরি করলেন না।
একটা ধীর অথচ কঠিন স্বরে বললেন,
— “এইসব প্রশ্ন-উত্তর পরে হবে। আপাতত খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করো। নতুন বউ এসেছে, ওকে আপন করে নাও।” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “আমি কিছুক্ষণ পর অফিসে যাব।”
আরশীন অবাক হলো না বরং খানিকটা নিশ্চিন্তই লাগল তার। এই মানুষটার উপস্থিতি যেন অদৃশ্য একটা ব্যারিকেড তুলে দেয় তার চারপাশে; একটা ছায়া, যা তাকে রক্ষা করে।
তিনি নিচু স্বরে বললেন,
— “একটু সামলে চলো মা। এখনই কাউকে কিছু বুঝতে দিও না।” আরশীন একবার চোখ তুলে চাইল তার দিকে, তারপর নিঃশব্দে মাথা নাড়াল।
.
নতুন বউয়ের ছাড়ে আজ আদিয়াতকে অফিসে যেতে মানা করে দিলেন জহিরুল ইসলাম।
— “এই একদিন অফিস না গেলেও চলবে। আমি আর আমিন আছি তো।” তিনি হাসিমুখে বললেন। আদিয়াতও কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তাই ঘরের ভেতরেই কাটল ওর সকালটা। আরশীনও সারাদিন ও ঘরে ঢোকার সুযোগই পেল না। আদিয়াত থাকার কারণে ও ঘরটা একরকম ওর জন্য সংরক্ষিতই ছিল যেন। তাই সে একেক সময় একেক ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিল নতুন বাড়িটা। জানালা দিয়ে পেছনের বাগান, ছাদে শুকাতে দেওয়া শাড়িগুলো, পর্যবেক্ষণ করছিল। কিছুক্ষণ আলিয়ার সাথে বসে গল্প করল। আলিয়া আগ্রহ নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছিল, তবে অদ্ভুতভাবে ওর প্রশ্নগুলো সব সাবধানে পরিপাটি। কোনো কৌতূহল যেন সীমা লঙ্ঘন না করে।
একসময় আরশীন শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল,
— “কিছু সাহায্য করতে পারি কি না বলবেন। আমি আসলে কোনো কাজকর্মে দক্ষ নই।”

নাজনীন বেগম রান্নাঘরের দিক থেকে ঘুরে তাকিয়ে একবার তাকে দেখলেন। মেয়েটির চোখে-মুখে সত্যি একটা আন্তরিকতা আছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন,
— “না মা, তুমি এসেই কাজ করবে কেন? তোমার এখন আদিয়াতকে সময় দেওয়া উচিত। এই সংসারের কথা তো সারাজীবন শুনবে।”

আদিয়াতকে সময় দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, আরশীন এমনিই পা বাড়াল নামমাত্র তার ঘরের দিকে। ঘরটা তার জন্য নিজের হয়ে ওঠেনি এখনও। একটা অদৃশ্য দূরত্ব, একধরনের সংকোচ ঘিরে রেখেছে তাকে। সে জানে, এই ঘর সে নিজের ইচ্ছেতে নয় বরং পরিস্থিতির টানে পেয়েছে। দরজার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। হালকা বাতাসে পর্দা একটু দুলছিল, জানালার পাশে রাখা চেয়ারে পড়ে ছিল আদিয়াতের একটা শার্ট। বিছানার চাদরের একপাশে সামান্য ভাঁজ পড়া। অল্প অগোছালো কিন্তু তাতে অদ্ভুত একটা শৃঙ্খলা লুকিয়ে। আরশীন ধীরে পা টিপে ভেতরে ঢুকল। আদিয়াত ঘরেই ছিল তবে মনোযোগ ল্যাপটপে নিবদ্ধ। আরশীন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। ঘরের ভেতরের নীরবতা খানিকটা ভারী হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ আদিয়াত বলে উঠল,
— “বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছেন মনে হচ্ছে?”

আরশীন চমকে তাকায়। ওর উপস্থিতি তাহলে আদিয়াত খেয়াল করেছে? ম্লান হেসে বলে,
— “একটু হাঁটাহাঁটি করছি, জানালার ধারে দাঁড়ালাম… ঘরটার সাথে পরিচিত হচ্ছি বলতে পারেন।”

— “আপনি চাইলেই সমস্তটার সাথে পরিচিত হতে পারেন। কেউ আপনাকে আটকাবে না। কোন সমস্যা হলে মাকে বলতে পারেন।”

— “সমস্যার কথা কি আপনাকে বলা যাবে না?”

আদিয়াত হেসে বলে,
— “বলতে চাইলে অবশ্যই বলতে পারেন। তবে আমি সবসময় বাসায় থাকি না।”

— “আপনার অনুপস্থিতিতে তাহলে সমস্যার কথা শাশুড়িমাকে বলব, তাইতো?”

— “হুঁ। তবে খুব শীঘ্রই যদি সবকিছু নিজের মনে করেন তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর যদি হয়েও থাকে তবে সেটা নিজেই সমাধান করতে পারবেন। আর আমার দায়িত্বে আমি বলছি, যদি কোনো দ্বিধা থাকে তাও স্পষ্ট করবেন।” আদিয়াত শান্ত স্বরে আরশীনের চোখে চোখ রেখে জবাব দেয়।

আরশীন হালকা গলায় বলে,
— “আপনার ব্যবহারে সেটা বোঝা যাচ্ছে।”

আদিয়াত হালকা একটু হেসে জানায়,
— “আমার চেষ্টার ঘাটতি হলে জানাবেন।”

আরশীন তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর চোখ সরিয়ে বলল,
— “চেষ্টা নয়, পাশে থাকা—এই মুহূর্তে সেটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।”

ওর কথার প্রসঙ্গে আদিয়াত হালকা মাথা নেড়ে বলল,
— “সবকিছুর ব্যাখা হয় না কিন্তু পাশে থাকা যায়। আপনার পাশে থাকার এই সিদ্ধান্ত আমি ভেবেই নিয়েছি।”
আরশীন আরেক দফা নিশ্চিত হলো—এই মানুষটিকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। তার কথার মধ্যে কোনো জোর আছে, কোনো কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা নেই। একরকম আশ্বাস মিশে আছে, যা অনায়াসে বিশ্বাস জাগায়। হয়তো এটাই হয়, যখন একজন মানুষের ভেতরের দৃঢ়তা নীরবে ছুঁয়ে যায় অন্যকে।

সন্ধ্যার পরের আলো-আঁধারিতে করিডোরটা ছিল প্রায় নিঃশব্দ। জহিরুল ইসলাম অফিস থেকে ফিরেই হালকা কাশি দিয়ে সোজা পেছনের দিকের করিডোরে এগোলেন। যেন জানতেন, ওখানে কেউ অপেক্ষা করছে। আরশীন কিছুটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখে স্বাভাবিক ভাব, কিন্তু চোখে টানটান সতর্কতা।

— “সব ঠিক তো?
— “হ্যাঁ আংকেল। যতটুকু সম্ভব…”
বাকিটুকু বলা হলো না। চোখের ইশারায় কথার শর্টহ্যান্ড চলতে লাগল। তাদের বাক্যালাপের শব্দগুলো যেন বাতাসে মিশে গিয়ে হারিয়ে গেল দেওয়ালের পথ না খুঁজেই।
ঠিক তখনই আলিয়া, সে যেন হাওয়ায় ভেসে এলো। হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়াতেই, দু’জনের চোখ ছেয়ে গেল বিস্ময়ে। মুহূর্তে চুপচাপ হয়ে গেলেন জহিরুল ইসলাম আর আরশীন; একসাথে। আরশীন নিঃশ্বাস চেপে ধরল। জহিরুল ইসলাম কপালটা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি💙 [পর্ব-০৩]
~আফিয়া আফরিন

(সংশয়ে অনুবৃত্তি)
রাত পেরিয়ে সকাল। করিডোরের সেই মুহূর্তটা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে আরশীনের মনে। আলিয়া কি কিছু বুঝতে পেরেছে? ওর দৃষ্টিতে বা কথাবার্তায় সেরকম কিছু মনে হলো না। আরশীন জানে, এই বাড়িতে তার পথ মসৃণ হবে না।
তবে জহির আংকেল একবার পাশে দাঁড়িয়েছেন—তার মানে কিছু একটা তো আছে, যা তাকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যাবে। এখন দরকার, নিজেকে ধরে রাখা।
.
আদিয়াত আজ সকাল থেকেই অফিসে। তিনতলার কর্পোরেট কনফারেন্স রুমে বসে নতুন একটা ব্র্যান্ড প্রেজেন্টেশন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কোম্পানির মেইন ব্রাঞ্চে আজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ক্লায়েন্ট আসার কথা, তাদেরকে নিয়ে ব্যবসার একটি নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। আদিয়াতের চোখে-মুখে চাপা বিরক্তি। সে ফাইলের পর ফাইল খুঁটিয়ে দেখছে, নোট নিচ্ছে, নির্দেশ দিচ্ছে। তাঁর কণ্ঠে সংযত অথচ দৃঢ় একটানা টোন। সহকর্মীরা তার গম্ভীরতা, মনোযোগ আর নেতৃত্ব সবকিছুর সাথেই মোটামুটি পরিচিত তবে আজ তাকে আলাদা মনে হচ্ছে।
— “স্যার, এই প্রজেক্টের নামটা আপনি ঠিক করে দিলেই আমরা এগোতে পারি।”

আদিয়াত চোখ তুলে তাকাল। একরোখা কণ্ঠে বলল,
— “উঁহু শুধু নাম নয়, এই কাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে।”
কথা হচ্ছিল গভীর, পেশাদার আলোচনায় ডুবে ছিল পুরো রুমটা। হালকা ফ্লুরোসেন্ট আলো আর কাঁচের জানালা দিয়ে দুপুরের রোদ ঢুকে পড়েছে কনফারেন্স রুমে। আদিয়াত টেবিলের ওপর রাখা গ্রাফ চার্টে চোখ রেখেছিল।
সহকর্মীরা তার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছিল। ঠিক তখনই—ঠকঠক, একটা কাঁচের শব্দ রুমের ভারসাম্য ভেঙে দিলো। চোখ তুলে তাকাল আদিয়াত, সঙ্গে বাকিরাও।
নীরা! গ্লাসের দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। হালকা নীল সিল্কের শাড়ি, গলায় ঝুলছে সরু একটা চেইন, ঠোঁটে ম্লান একটা হাসি কিন্তু চোখে ছিল অদ্ভুত এক তীব্রতা। দরজাটা সাবধানে খুলল। সে ভেতরে পা বাড়াল ধীরে ধীরে কিন্তু আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণভাবে। নীরার চোখ চারদিক দেখে নেয় দ্রুত। পেছনের স্লাইড বোর্ডে এখনও মিটিংয়ের প্রজেক্ট রিপোর্ট ঝুলে আছে। টেবিল ঘিরে থাকা সহকর্মীরা হালকা সরে দাঁড়িয়েছে। আদিয়াতের চোখে ছিল মাপা বিস্ময়, তবে মুখে ঠান্ডা স্বর। নীরা ভেতরে পা বাড়িয়ে বলল,
— “আমি কি ভুল সময়ে চলে এসেছি?” তার ঠোঁটে হালকা হাসির আভা। যেনো কোনো মজার বিষয় চলছে এখানে।
কেউ কোন কথা বলল না, একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এক মুহূর্ত নীরবতার পর আদিয়াত ঠান্ডা ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
— “এটা অফিস, নীরা। এখানে সময় নির্ধারিত হয় আলোচনার প্রয়োজন অনুযায়ী। তোমার কী দরকার?”

নীরা এক পা এগিয়ে এসে চেয়ার ছুঁয়ে বলল,
— “দরকার তো আছেই, তবে ব্যক্তিগত। অবশ্য তোমার সহকর্মীরা থাকলে সমস্যা হলে আমি অপেক্ষা করতে পারি।”
আদিয়াত চোখ সরিয়ে সহকর্মীদের দিকে তাকাল। তারা তার ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে ধীরে ধীরে রুম ছাড়তে শুরু করল। নীরা এসে আদিয়াতের সামনে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে… ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা অদ্ভুত ছিল; রাগ, অভিমান, অনুযোগ, ঘৃণা মিশেলে।
— “তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, এটা অন্যদের মুখে শুনতে হলো। সত্যি?”

আদিয়াত ওর চোখের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়,
— “হ্যাঁ, সত্যি।”

নীরা হালকা হাসে। একটু তির্যকভাবে বলে,
— “তা বলে এতটা হঠাৎ? কাউকে কিছু না জানিয়ে?”

কাজের মাঝে বিরক্ত করায় আদিয়াত একটু রাগান্বিত হয়ে। তবে নিজেকে শান্ত রেখে উত্তর দেয়,
— “কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিঃশব্দে নিতে হয়, সময়ের দাবিতে।”

নীরা গলা চড়িয়ে বলে,
— “তাহলে কি এই বিয়েটা তোমার সময়ের দাবি ছিল নাকি কাউকে দেখানোর জন্য একটা জেদ?”

আদিয়াত ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,
— “দেখানোর কিছু থাকলে, লুকিয়ে হতো না। আর জেদ? আপাতত এসব নিয়ে তোমার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি না। আমার সময়ের অনেক দাম।”

— “তুমি… তুমি।” নীরা পুরো কথা শেষ করতে পারে না। তার কণ্ঠে তখন রাগের আঁচ, চোখদুটি লালচে হয়ে উঠেছে। ঠোঁট চেপে রাখলেও ভেতরের ক্ষোভ ছিটকে পড়ছে আচরণে। কথাগুলো উচ্চারণের সময় তার কণ্ঠ কাঁপছিল কিন্তু চোখে ছিল স্পষ্ট আগুন। সেই আগুন অপমানবোধে জ্বলে ওঠা। সে একবার সরাসরি আদিয়াতের চোখে তাকাল। নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। তার কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশে বেরিয়ে এলো,
— “তুমি কীভাবে পারলে এটা করতে? আমি কিছুই জানলাম না? একটুও ভাবলে না আমার কেমন লাগবে?” অভিমানী সেই রাগ যেন নিঃশব্দে কেঁপে উঠল পুরো ঘরজুড়ে।
আদিয়াত নীরার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে কোনো রাগ নেই, কিন্তু শীতল এক দৃঢ়তা জমে আছে। তারপর খুব স্থির স্বরে বলে,
— “আমি এসব প্রশ্নের জবাবদিহি করতে বাধ্য নই, নীরা। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত, সেটা আমি নিজে বুঝে নিই।”
একটু থামল। এবার তার কণ্ঠে একটা স্নিগ্ধ অনড় সুর জড়িয়ে যায়,
— “তোমার তো রাগে ফেটে পড়ার মত কিছু হয় নাই। তুমি এত জোর দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করছো কোন সাহসে? তোমার বা তোমাদের তরফ থেকে কিছু থেকে থাকলে সেটা আমার দায় নয়। আমি কি তোমাকে বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে ভাবো কিংবা….”

আদিয়াতের কথা পুরোপুরি শেষ করতে দিল না নীরা। মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিয়ে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
— “আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম আদিয়াত। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করেছিলাম কতশত।”

আদিয়াত হালকা হেসে ওঠে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে একটা স্পষ্ট বিরক্তি জমে থাকে। কণ্ঠে ঠাণ্ডা কৌতুকের ছোঁয়া, চোখে তীব্র ধিক্কার। সে ধীরে বলে—
— “স্বপ্ন দেখার আগে জেনে নেয়া উচিত, অন্য মানুষটা ঘুমোচ্ছে নাকি জেগে আছে।” আদিয়াত নীরার অভিব্যক্তি দেখে পুনরায় বলল,
— “স্বপ্ন দেখে যদি বাস্তবের উপর দাবি আসে; সেটা তো শুধু হাস্যকর নয়, অশোভনও বটে।”

নীরার মুখ তেতো হয়ে যায়। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। আদিয়াতের কথাগুলো ছুরির মতো কেটে গেল নীরার আত্মাভিমানকে। অপমানে তার মুখের রঙ মুহূর্তেই ফ্যাকাশে থেকে গাঢ় কালচে হয়ে উঠল—চোখের দৃষ্টিও নিচে নেমে এল। ঠোঁট কাঁপলেও কিছু বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।
তবু শেষ চেষ্টায় সে কণ্ঠ শক্ত করে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
— “তুমি জানো না আদিয়াত, তুমি কী হারালে…”

আদিয়াত থামে না, ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা চালে বলে,
— “আমি হারানোর আগে ভাবি, জেতার মতো কী ছিল সেখানে।”
তারপর আর একমুহূর্ত নষ্ট না করে সে ফিরে যায় তার কাজে। নীরার চোখের সামনে দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, অপমান আর অপূর্ণতার ভারে ভারাক্রান্ত একটা নীরব দুপুর জমে ওঠে ঘরজুড়ে।
.
আদিয়াতের হঠাৎ বিয়ে নিয়ে পরিবারের একাংশ নীরব অভিমানে ডুবে আছে। মুখে না বললেও ছোটখাটো কথাবার্তা, চোখচাহনি আর ব্যবহারে অনিচ্ছার ছাপ স্পষ্ট। যেন কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তে নিজেকে উপেক্ষিত বা অবহেলিত মনে করছে। সবার মুখে যেন একরকম চাপা অস্বস্তি, বিষয়টা তারা মেনে নিতে পারেনি পুরোপুরি।
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে গন্ধরাজ ফুলের মিষ্টি গন্ধ। জহিরুল ইসলাম বসে আছেন চেয়ারে। চোখে কাঁচের চশমা, হাতে কাগজ। তিনি ছেলেকে ডাক পাঠিয়েছেন। আদিয়াত এলো…
জহির চশমা নামিয়ে বললেন,
— “তুমি জানো, আযহান আজ ফিরছে রাজশাহী থেকে। বড় ভাইয়ের হঠাৎ বিয়ে নিয়ে তার মনটাও খারাপ দেখলাম। আমি ভেবেছি, এই সপ্তাহেই একদিন ঘরোয়াভাবে একটা অনুষ্ঠান রাখি। বিয়েটা তো অনেকটা হুট করেই হয়ে গেল।”

আদিয়াত নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। তারপর সোজা গলায় বলল,
— “আগে আমি জানতে চাই, পুরো বিষয়টা কী ছিল। হুট করে আমাকে বিয়ে করালে, কারন কী? বাবা, তোমার ভরসায় আমি মাথা নত করেছিলাম। এখন আমি জানতে চাই, ঠিক কীসের জন্য এই তাড়াহুড়ো?”

জহিরুল ইসলাম এক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন। তারপর ধীরে বললেন,
— “আমি বলব, সবটাই। তবে এখন একটু ধৈর্য ধর, যা করেছি ভেবে-চিন্তেই করেছি।”

আদিয়াত শান্ত গলায় বলল,
— “ঠিক আছে তাহলে তুমিও ধৈর্য্য ধরো। আমি ঠিক করেছি, অনুষ্ঠান তখনই হবে, যখন আমি আরশীনকে পুরোপুরি জানতে পারব। শুধু নাম বা মুখ চেনা নয়, ওর পেছনের সত্যটা।”
আদিয়াত বাবার সামনে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু চোখেমুখে একরকম কাঠিন্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঠোঁট দুটো ছিল টানটান, কণ্ঠে সংযত অথচ দৃঢ় জেদ। তার চোখে ছিল প্রশ্ন, চাহনিতে একরকম প্রতিবাদ। কোনো উচ্চস্বরে কিছু না বলেও যেন বুঝিয়ে দিল—সে আপাতত কেবল শ্রোতা নয়, উত্তরও জানতে চায়। পায়ের শব্দটাও যেন ভারী হয়ে উঠল যখন সে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেল। সৈয়দ জহিরুল ইসলাম নিশ্চুপ, কিন্তু ছেলের অভিমানের ভাষা বুঝতে তার একটুও দেরি হলো না।
আদিয়াতের আচরণের পেছনে নিছক আবেগ নয়, ছিল যুক্তির ভিত্তি। আজ অফিসে ভুলবশত বাবার কিছু কথা তার কানে এসেছিল আর সেখানে শোনা এক টুকরো কথোপকথন তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। কথার ভাঁজে ভাঁজে “আরশীন” নামটা শুনে যেন হঠাৎ সবকিছুকে আর স্বাভাবিক মনে হয়নি আদিয়াতের।
দুপুর আড়াইটা নাগাদ…
আদিয়াত নিজের কেবিনে বসে কাজ করছিল। দরজা অর্ধেক খোলা। বাইরে বাবার পুরনো পরিচিত কেউ এসেছেন—একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক, ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা টাইপ। জহিরুল ইসলাম কথা বলছিলেন তার কেবিনে, গ্লাস দরজা অর্ধেক খোলা থাকায় ভেতরের আওয়াজ মাঝে মাঝে বাইরে শোনা যাচ্ছিল। আদিয়াত মনোযোগ না দিলেও হঠাৎ কানে আসে দুটো লাইন—
— “আরশীনের ব্যাপারটা তুমি জানো না বলেই তো এতদূর নিয়ে এলাম। ওর মতটাই ছিল সবচেয়ে জরুরি…” একটু থেমে আবার শুনতে পেল,
— “ও না চাইলে আমি কখনও আদিয়াতকে রাজি করাতাম না।”

আদিয়াত থমকে গেল। আরশীন নামটা যেন গলা টিপে ধরল তাকে। সে আর কাজের দিকে মন দিতে পারল না। চেয়ার থেকে হেলে এসে একটু দরজার দিকে তাকাল। কাচের ওপারে ছায়াময় মুখ, বাবার চেনা ভঙ্গিমা; তবে কণ্ঠে ছিল চাপা উত্তেজনা। একসময় কথোপকথন শেষ হলো, ভদ্রলোক চলে গেলেন। আদিয়াত কিছু জিজ্ঞেস করল না কিন্তু তার চোখে পড়ল, বাবার মুখে চিন্তার রেখা। তিনি দরজার ফাঁক গলিয়ে পেছনে একবার তাকালেনও যেন! তারপর থেকে সে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে আছে। সে কি আরশীনকে জিজ্ঞেস করবে নাকি অপেক্ষা করবে সময়ের জন্য? নাকি আরশীনের প্রতিটি আচরণ এখন থেকে পর্যবেক্ষণ করবে?
আদিয়াতের চোখের ভাষা, থমথমে নীরবতা—সবকিছু জহিরুল ইসলামের নজর এড়ালো না। ছেলের মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে, তা তিনি নিখুঁতভাবে টের পেলেন, তবুও চুপ রইলেন। এই দ্বিধা, এই সন্দেহের বীজ এখনো ছোট কিন্তু ঠিকভাবে পানি পেলে তা বিশাল একটি দ্বন্দ্বে পরিণত হতে পারে।
.
আরশীনের গল্পটা সবার অগোচরে এক গভীর রঙে আঁকা। ওর বাবা, মারা গেছেন মাত্র তিন মাস হলো—হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায়, যেটাকে সবাই কেবলই দুর্ঘটনা বলে ধরে নিয়েছে। কিন্তু আরশীনের মন মানতে পারেনি; বাবার মুখে শোনা শঙ্কা, কিছু অসমাপ্ত কথাবার্তা, আর মৃত্যুর আগের অস্বাভাবিকতায় সে ঠিক বুঝে গিয়েছিল বিষয়টা অন্যকিছু। আরশীন একা ছিল, খুব একা। সহানুভূতি পেয়েছে, সহযোদ্ধা পায়নি। পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে তার বাবার মৃত্যুর রহস্যটা একপ্রকার দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। ঠিক তখনই সামনে আসেন জহির আঙ্কেল—তার বাবার বহু পুরনো বন্ধু। শুধু বন্ধুত্ব নয়, আস্থা ছিল, ভরসা ছিল; আর সেই ভরসাতেই আরশীন তাকে সব খুলে বলে। এই আস্থার সূত্রেই, অনেক না বলা গল্পের অংশ হয় আজকের আদিয়াত—যাকে আরশীন আগে থেকেই জানত, শুধু নামেই। তবে এই নাম, এই পরিচয় একদিন বাস্তব হয়ে উঠবে; তা কখনও ভাবেনি।

সেসময় জহিরুল ইসলামের ভাবনার মধ্যে হঠাৎ একটা সুতো জড়িয়ে উঠল—একটা এমন গিঁট যেটা খুলতে গেলে সময় নয়, প্রয়োজন হয় সাহস আর সিদ্ধান্তের। তিনি থেমে গেলেন না। নিজেকে নিজেই বললেন,
— “বিবাহযোগ্য একটা ছেলে আছে আমার, আর এ লড়াইয়ে ভরসার মানুষ খুব কম। যদি শত্রু এত কাছে হয়, তবে আরশীনকেও কাছে আনতে হবে।”
তিনি যোগাযোগ করেন আরশীনের চাচার সাথে, তারপর সরাসরি আরশীনের সঙ্গে। স্বভাবসিদ্ধ ভদ্রতা আর সংযত কণ্ঠে বলেন,
— “এই লড়াইয়ে তুমি একা নও। বিষয়টা শুধু তোমার বাবাতে আটকে নেই, আমার পরিবারেরও একটা অংশ আছে এখানে। কিন্তু পাশে দাঁড়াতে হলে, তোমাকে আমাদের পরিবারের ছায়ায় আনতেই হবে। এই সম্পর্ক শুধু সম্পর্ক নয়—এটা রক্ষা।”

আরশীন নীরব হয়, সম্মতি জানায়। তবে সম্মতির ঠিক পরেই ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। নিজের চোখেমুখে লেগে থাকে অপরাধবোধের ছাপ। সে ভাবে,
— “আমি কি আদিয়াতের জীবনে অনাহুত হয়ে যাচ্ছি? ওর তো আরও ভালো জীবন হতে পারত। হয়তো কোনো মেয়ে, যার জীবন এত অনিশ্চয়তায় ভরা নয়।”
ভবিষ্যৎ তাকে ভয় দেখায়। যে খেলায় সে জড়িয়েছে, সেখানে ‘আজ আছে তো কাল নেই’ এমনটাই বাস্তবতা। তবুও থেমে গেলে চলবে না। যেই দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলে নিয়েছে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে হেরে যাবে।

সকাল সকাল ড্রয়িংরুমে বসে ছিল আরশীন। আলিয়া আপুও ছিল, একটা ফোন আসায় কথা বলতে গেছে। সামনে টিভি চালু, তবে আওয়াজ ছিল না। ওর মধ্যে গম্ভীর ভাবটা বোঝাই যাচ্ছিল। তখনই পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর,
— “এইভাবে বসে থাকলে তো কেউ ভাববে আপনি বাড়ির অতিথি।”

আরশীন চমকে তাকাল। তাকিয়ে দেখে এক মুখ হাঁসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ছেলেটি চেনা, কাল রাতেই দেখা।
— “আযহান?”
— “ইয়েস, আপাতত এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য কিন্তু সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষক। ভাবছিলাম, নতুন সদস্যের মানসিক অবস্থা যাচাই করা দরকার।”
— “মানে আমি পরীক্ষার টেবিলে?” আরশীন নড়েচড়ে বসল।
— “আরে না, আপনি তো পাশ করে ফেলেছেন। এত শান্তভাবে বসে আছেন দেখে নিশ্চিত হয়েছি।”

আরশীন হালকা হেসে বলে,
— “বাহ, সুন্দর কথা বললে তো।”
— “কখনো কখনো বলি। বিশেষ অতিথির সামনে তো রীতিমতো পরিপক্ক হওয়া দরকার।”

আযহান চ্যানেল বদলাল। জিজ্ঞেস করল,
— “খেলাধুলা দেখেন?”
— “তেমন না। তবে কয়েকজনকে চিনি।”
— “খেলোয়ার চেনা মানে আধা পাশ।” পরক্ষণেই আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— “বাড়ির সবাই আজকে কোথায়? এত চুপচাপ আবহাওয়া কেন? একটু আগে আম্মুর সাথে কথা বলতে গেলাম, ধমক দিয়ে বিদায় করে দিল। রান্নাঘরে বোধহয় আজ চিনি কম পড়েছে। সেজন্যই সবাই কম মিষ্টি।”

আরশীন মুচকি হেসে বলে,
— “কিন্তু তোমার কথাই তো চিনি বেশি মনে হচ্ছে।”
— “ঠিক ধরেছেন। এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন আপনি, অথচ সবার মুখে যদি মিষ্টি কম পড়ে তবে এটা আমাদের ছোটদের পক্ষে সহ্য করা মুশকিল।”
আরশীন হেসে উঠল।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল আদিয়াত। ধূসর রঙের স্লিম ফিট প্যান্ট আর উপরে হালকা মেরুন শার্ট, হাতা কনুই অবধি গোঁজা। চুলটা নিখুঁতভাবে সেট করা। কোমরে একটা চামড়ার বেল্ট, হাতে ঘড়ি আর পারফিউমের হালকা ঘ্রাণে ওরা ফিরে তাকাল। সে নামতেই ঘরের পরিবেশে একধরনের ভারীতা জমে উঠল। দু’জন কথা বলা মানুষ হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। এদিকে আদিয়াতের চোখদুটি সোজা গিয়ে স্থির হলো সোফায় বসে থাকা দু’জনের উপর—আরশীন আর আযহান। আরশীনের দিকে একটু বেশি সময় থেমে থাকল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আরশীন তার দিকে একঝলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। স্নিগ্ধ মুখে একধরনের অপরাধবোধ ছায়া ফেলল।
অবস্থাটা একটু থমথমে হয়ে গেল হঠাৎই। আদিয়াত চোখ নামানো আরশীনের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে পড়ে রইল একরাশ অদ্ভুত চাপা অনুভূতি।
আযহান ফিসফিস করে বলে উঠল,
— “বাবারে! ভাইয়ার মুড তো দেখি একেবারেই ফ্রেশ না। যেই লুকটা দিয়ে গেল, আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম।”
আরশীন একটুখানি মুখ তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল… চুপচাপ।
.
.
.
চলবে….