তবুও তুমি পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
4

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৩]
~আফিয়া আফরিন

(অন্তর নিবেদিত)
ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল। আরশীন চুপচাপ বসে রইল। ও জানে, এই কথাটা নিছক হুমকি নয়, এটা কারও ঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আদিয়াতের প্রতিক্রিয়া এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে আলোছায়ার মধ্যে তার কপালের উপর পরপর কয়েকটা ভাঁজ অস্পষ্ট দেখা গেল। আদিয়াত কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলে রাখল। বলল,
— “কোথায় কোথায় এত আগুন দিয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি? খুব হুমকিধামকি আসছে দেখছি। এটা কি আগে থেকেই চলছিল নাকি বিয়ের পরই শুরু?”

আরশীন হেসে বলল,
— “আগে তো কেউ পাত্তা দিত না, তাই আগুন জ্বলে নিভেই যেত। এখন হয়তো একটু আলো ছড়াচ্ছি তাই এত নজর।”

আদিয়াত ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলল,
— “আলো ছড়াচ্ছেন না, আগুন ধরাচ্ছেন। আপনি কোথায় গেছেন, কার সাথে কথা বলেছেন, কী জানেন; সব খোঁজ নিচ্ছে কেউ। কে হতে পারে?”

— “বিষয়টা বিয়ে বা সম্পর্ক সংক্রান্ত না। যারাই এসব করছে, তাদের উদ্দেশ্য অনেক গভীর। আমি এখনো নিশ্চিত নই, কিন্তু যতদূর বুঝছি… এদের সাথে আমার বাবার যোগসূত্র রয়েছে।”

আদিয়াত তখন একটু থেমে বলল,
— “উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সাবধানে চলুন। এখন আপনি বাড়ির বাহিরে একদম নিরাপদ না। আমি চাইলাম, পুলিশে ইনফর্ম করে রাখতে সেখানেও আপনার বাঁধা।”

আরশীন হঠাৎ অনুনয় বিনয় করে বলল,
— “শুনুন না, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন প্লিজ। আপনিও তো বিষয়টার সাথে জড়িয়ে গেছেন। যারা আমার ক্ষতি করতে চাইছে, আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করছে; তাদের সমস্যা তো আপনিও। আপনি না হয়, এসব থেকে বেরিয়ে যান প্লিজ। আমি চাই না, শুধুমাত্র আমার কারণে আপনি কোনো বিপদে পড়ুন। আপনি না থাকলে অন্তত আমি নিশ্চিত থাকতে পারব, আপনার কিছু হবে না।”
— “বিয়ের কাবিননামায় স্বাক্ষর করেছি? আমি চাইলেই হেঁটে চলে যেতে পারি না।”

আরশীন চোখ নামিয়ে বলল,
— “আমি চাই আপনি নিরাপদ থাকুন। আমার জন্য আপনি বিপদে পড়–”

আদিয়াত কাটা দিয়ে বলল,
— “আপনি বিপদে পড়লে আমি কি নিরাপদে ঘরে বসে থাকব? আপনার পাশে থাকাটা শুধু কর্তব্য না, সম্পর্কের প্রতি সম্মান। এখন থেকে আপনার সাথে সেই আগুনে আমিও হাত রাখলাম। জ্বললে একসাথে জ্বলব, নিভলে একসাথে নিভব।”
আরশীন ওর দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এতদিন ধরে মানুষটাকে সে যতটা বুঝেছে, এই মুহূর্তে মনে হলো সে কিছুই বোঝেনি।এতটা আশ্রয় কেউ দেয়? এতটা নিশ্চিত করে কেউ পাশে দাঁড়ায়?
একটা কষ্ট আর একটা প্রশান্তি একসাথে বুকে চাপল। কষ্ট, কারণ তার কারণে আদিয়াত এখন বিপদের মুখে। প্রশান্তি, কারণ সে আর একা নয়। চোখের কোণে কেমন জানি এক রকম নরমতা এসে জমল। আরশীন নিজেই টের পেল, আদিয়াতের জন্য ওর ভেতরটা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। চোখ নামিয়ে ও নিজেকে বোঝাল, না এসব ভাবা ঠিক না। এসব ভাবা শুরু করলেই হারিয়ে ফেলব। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। সে কি কোনোভাবেই আদিয়াতকে ভালোবেসে ফেলেছে? ও জানে না উত্তরটা কী কিন্তু তারপরেও নিজের উদ্দেশ্য বলল,
— “এটা শুধু কৃতজ্ঞতা।” মুখে এতটুকু বললেও মনে মানে না।
আরশীন জানে, যেটাকে সে যুক্তি দিয়ে সরাতে চাইছে সেইটাতেই সে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে।
.
তাহমীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি এখন জেলা দায়রা আদালতে বিচারাধীন। তদন্তকারী সংস্থা ইতোমধ্যে চার্জশিট দাখিল করেছে। সেখানেই বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে:
তাহমীদ অবৈধ লেনদেন, অর্থ পাচার এবং একাধিক ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের সাথে সরাসরি জড়িত। গোপন ভিডিও ফুটেজ, কথোপকথনের অডিও রেকর্ড, এবং আর্থিক লেনদেনের ট্রেইল আদালতে দাখিল হয়েছে। ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর খু’নের প্রত্যক্ষদর্শী সে। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে সজীব নিজের বয়ানে সব খুলে বলেছে; তাহমীদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, কীভাবে বিশ্বাস অর্জন করে সে এইসব প্রমাণ জোগাড় করেছে। ফরেনসিক বিভাগ অডিও-ভিডিওর সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত করেছে, এই রেকর্ডিংগুলোতে কোনো রকম এডিট বা বিকৃতি নেই। আদালত এখন পর্যন্ত তাহমীদের জামিন আবেদন দু’বার নাকচ করেছে, কারণ পলায়নের সম্ভাবনা।
আলিয়া এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রতিবার কোর্ট ডেটের আগে তার চোখে কান্না জমে থাকে। সবাই সব বুঝেও নিঃশব্দে সব সামলে নিচ্ছে। তাদের মাথায়ও ঘুরছে,
— “তাহমীদ শুধু একজন অপরাধী নয়, আমাদের পরিবারের একটা অংশ। সত্যকে মেনে নিয়েছি কিন্তু সেটা সহজ নয়।” আদিয়াত’ও পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবনায় মত্ত। তাহমীদের কথা মনে পড়ছিল বারবার।
কলেজে থাকতে ওদের টুকটাক পরিচয় ছিল। তখনো বুঝতে পারেনি, সময়ের সাথে কিভাবে মুখোশ বদলে যায়। প্রথমে তো ওকে ভালোই মনে হতো। কিন্তু এরপর? রাজনীতির গন্ধ গায়ে মাখতে মাখতেই বদলাতে শুরু করেছিল। নানান নেতা, প্রভাবশালী মুখ; রাতারাতি ওকে বদলে দিয়েছিল। জহিরুল ইসলাম যখন আলিয়ার জন্য তাহমীদের সমন্ধের কথা বলেন, তখন আদিয়াত বারবার খোঁজ নিতে বলেছে এবং সে নিজেও অনুসন্ধান চালিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে সবকিছু তখন এত পরিষ্কার, এত পরিপাটি; কাগজপত্রও মুখোশ পরে আছে। ব্যাকগ্রাউন্ড ক্লিয়ার। কোনো অভিযোগ নেই, মামলার ছায়া নেই। একটা অদৃশ্য চক্র সব ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। আর এখন, এই অবস্থা! আলিয়া ভেঙে পড়েছে। আদিয়াতের মনে আত্মদায়ের ছাপ পড়ে।
নিজের দৃঢ়তা, সতর্কতা, সব ব্যর্থ মনে হয়। বোনের জীবনটা যেন তার চোখের সামনেই ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে আবার আরেক যন্ত্রণা। সকালে তার সহকর্মী মারুফ ফোন করে বলল,
— “স্যার, হিসাব বিভাগে একটা বড় সমস্যা দেখা গেছে। বার্ষিক অডিট রিপোর্টে গরমিল ধরেছে।”
— “গরমিল মানে?”
— “প্রায় কয়েক লক্ষ টাকার খাতা মেলেনি স্যার। গত ছয় মাসের বেশ কয়েকটা ইনভয়েস পাওয়া যাচ্ছে না।”
কথাটা আদিয়াতের পর জহিরুল ইসলামের কানে গিয়েছে। তিনি চমকে গেছেন। এই ভুল আদিয়াতের থেকে কীভাবে হলো? অসম্ভব! শুধুমাত্র নিজের ছেলে হিসেবে নয় তিনি আদিয়াতকে ওর একরোখা দায়িত্বের মাধ্যমে চেনেন। তবুও কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বলেন,
— “আদিয়াত, এই দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। এখানে ত্রুটি কিভাবে রয়ে গেল? চেক করো, হিসেবে গরমিল নাকি কাগজপত্রে?”
অফিসের কনফারেন্স রুমে বসে আদিয়াত। টেবিলজুড়ে ছড়ানো হিসাবের খাতা, ইলেকট্রনিক ফাইল, প্রিন্ট আউট, ক্যাশবুক; সব কিছুতেই এক অদ্ভুত অস্থিরতা।
দুপুর থেকে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে, তবু চোখ নামায়নি স্ক্রিন থেকে।
গোছানো ছিল সবকিছু, অথচ এখন অঙ্কগুলো হোঁচট খাচ্ছে। একটা নয়, দুটো নয়, পুরো তিনটা সেকশনের রিপোর্টে গরমিল। বড় গরমিল, যা চাইলেই চোখ এড়ায় না। অথচ গত মাসেই এসব ক্লিয়ার করে ফাইল করা হয়েছিল। তাহমীদের কেস নিয়ে সে সত্যিই ব্যস্ত ছিল, তবু এত বড় গ্যাপ? তড়িঘড়ি করে মারুফকে ডাকল সে। মারুফ অফিস অ্যাকাউন্ট টিমের জুনিয়র, খুবই বিশ্বস্ত একজন।
— “মারুফ, শেষবার এই রিপোর্টগুলো কে চেক করেছিল?”
— “স্যার, আপনারই চেক করার কথা ছিল। কিন্তু আপনি তো তখন কোর্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আমিনুল স্যার চেক করেছেন।”

আদিয়াতের চোখ কুঁচকে গেল। সে দেরি না করে সোজা গেল আমিনুল ইসলামের কেবিনে। চাচা তখন ফোনে ব্যস্ত, আদিয়াতকে দেখে হাসিমুখে ইশারায় বসতে বললেন। কথা শেষে আদিয়াত সরাসরি প্রশ্ন করল,
— “চাচা, রিপোর্টগুলো আপনি চেক করেছিলেন?”

আমিনুল একটু থেমে বললেন,
— “কিছু কিছু দেখেছিলাম। তোমার অনুপস্থিতিতে তো কিছুই থেমে থাকেনা, তাই বলেছিলাম আমাকে দিয়ে যেতে। কিন্তু শেষদিকে অনেক কাজ চাপে পড়ে, সবগুলো আর দেখা হয়নি। আমি ভেবেছিলাম, তুমি ফিরে এসে নিজেই শেষ চেক করে নেবে।”
— “হুম… ঠিক আছে।”

সেদিন তার বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। বাড়ির গেট খুলে ধীর পায়ে ঢুকল। গায়ে এখনো অফিসের ফর্মাল পোশাক, শুধু গলার টাই আলগা, চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ, চোখদুটো লালচে, কপালের মাঝে ভাঁজ; সবমিলিয়ে একপ্রকার বিধ্বস্ত অবস্থা। আরশীন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সিঁড়ির ধারে। আদিয়াত ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
— “এতরাতে এখনও জেগে?”
— “আপনি তো ফিরেননি…”
— “ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন।” আদিয়াত ঠাণ্ডা স্বরে বলল।
আরশীন বলল না কিছু। শুধু ভেতরের গলাটা ভার হয়ে এল। সে জানে অফিসে সমস্যার বিষয়টা, সেটা আদিয়াতকে চেপে রেখেছে।
আরশীন নিচু গলায় বলল,
— “খাওয়া-দাওয়া করবেন না? কত রাত হয়ে গেছে…”
— “না। ইচ্ছে নেই।”
আদিয়াতের মুখ দেখে মনে হলো, ওকে এই মুহূর্তে জোর করা যাবে না। তাই মাথা নাড়িয়ে সে সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ আদিয়াত পেছন থেকে বলল,
— “আপনার যদি খুব অসুবিধা না হয় তাহলে আমাকে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারেন, মাথাটা ভীষণ ধরেছে।”
আরশীন দ্রুত চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। চা বসিয়ে দিল। বুকের ভেতর হঠাৎ কী যেন টনটন করে উঠল। ওর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। কী আশ্চর্য! নিজের বউয়ের কাছে এক কাপ চা চাইতেও এত অনুনয় করতে হবে কেন?

ঘরের দরজা খুলতেই হালকা আলোয় চোখে পড়ল, আদিয়াত বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। অফিসের কাপড় তখনও গায়ে। পায়ে মোজাও খোলা হয়নি। একটা হাত কপালে, আর চোখ দুটো ছাদের দিকে স্থির। চুপচাপ কিছু একটা গভীরভাবে ভাবছে অথবা কোনো অদৃশ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে নিজের ভেতরে।
আরশীন থেমে গেল দু’পা দূরে। এমন ক্লান্ত চেহারা সে কখনও দেখে নাই। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। আহ… ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসল। আদিয়াত চোখ ফেরাল না। কেবল ধীরে বলল,
— “আপনি শুয়ে পড়ুন, আর জেগে থাকতে হবে না।”

আরশীন একটা কাজ করল। চুপচাপ তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিল। নরম হাতে ছুঁয়ে দেখল।
— “কাপড়টা তো বদলাননি এখনো।”

আদিয়াত নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল, গলার স্বর নিস্তেজ,
— “ভেতরে ভেতরে সব এলোমেলো লাগছে। কোথাও কিছু ঠিক নেই।”
আরশীন উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার এনে দিয়ে বলল,
— “সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আপনি এখন চেঞ্জ করে আসুন।” কণ্ঠে কোনো আদেশ ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত কোমল আশ্রয়। আদিয়াত সেই কথা শুনল তারপর একটু চুপ করে আরশীনের দিকে তাকাল। সে ফিরে এলে আর বিশেষ কোনো কথাবার্তা হলো না। রাতের নিস্তব্ধতার মত তারাও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আরশীনেরও ইচ্ছে হলো না ওকে আর বিরক্ত করার। আজ সকালেই জহির আংকেলের সাথে কথা হয়েছে। তিনি এসব নিয়ে একটু চিন্তিত এবং ব্যস্ত। আদিয়াতের থেকে যে এত বড় ভুল হতে পারে, তা বিশ্বাস’ই করতে পারছেন না।

ভোর ছয়টা… আমিনুল ইসলাম ফজরের আগে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন। তার ঠোঁটের কোণে কুটিল হাসি। নিজের মানুষ বলেই হয়ত আদিয়াতের সাইন করা ফাইলগুলো’তে উনিশ-বিশ করতে খুব একটা অসুবিধে হয় নাই। অবশ্য তিনি জানতেন না এই গরমিলের পুরো দায়ভার আদিয়াতের উপর পড়বে। ভেবেছেন অফিস সহকারী মারুফ কিংবা ক্যাশিয়ারে যারা আছে তাদের মধ্যে কারো উপর দায়টা পড়বে। কিন্তু আদিয়াত… সে ফেঁসে গেল। তাও খারাপ হয় নাই। এইবার দেখবে, বড়ভাই ছেলের পক্ষে কথা বলে নাকি বিপক্ষে।
আমিনুল ইসলাম একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। সেখানে বেশ কিছু টাকা প্রয়োজন, তারজন্যই এত কিছু। যেই টাকা তিনি আলাদা করে রেখেছেন সেগুলোই দিতে এসেছেন। আরোও আগেই দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু অপরপক্ষের মানুষ আসতে দেরি করে ফেলেছে। উনি বারবার ঘড়ি দেখছেন, ভোরের আলো ফুটে গেছে। অপরাধমূলক কাজকর্ম যত গভীর রাতে করা যায় তবেই মঙ্গল। প্রকৃতির আলোতে সব ফুটে উঠে, কোনো কাজ করে শান্তি নাই। ভীষণ বিরক্ত তিনি। মনে মনে বিভিন্ন গালিগালাজ আওড়াচ্ছেন। অবশেষে যার জন্য অপেক্ষা করছিল সে যখন এলো তখন গালিগালাজ ভেতরে চেপে মুখে তেলতেলে হাসি ফুটিয়ে তুললেন।
.
ভোরের আলো চোখে মুখে পড়তেই আরশীনের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে প্রথমেই জানালার দিকে তাকাল, আলোর রোদের সরল রেখাটা ঠিক বিছানার মাঝখান দিয়ে এসে পড়েছে। তড়াক করে উঠে জানালার পর্দা টেনে দিল সে, যাতে আলোটা আর না আসে। আদিয়াতের ঘুমটা যেন ভেঙে না যায়। পর্দার আড়াল থেকে ফিরে আসতেই চোখ পড়ল বিছানার পাশে ঘুমিয়ে থাকা আদিয়াতের দিকে। ঘুমন্ত মুখশ্রীর মধ্যে একরকম কোমলতা, এক ধরনের প্রশান্তি লেপ্টে আছে। এতটা কাছ থেকে ওকে এভাবে দেখেনি কখনো, দেখার প্রয়োজনও পড়ে নাই। এখনও কি পড়ে? কিন্তু অবাধ্য মন! না চাইতেও দেখতে চায়। নিঃশ্বাসের ওঠানামা একরকম ছন্দ তৈরি করেছে ঘরে।
আরশীন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, এক অজানা মায়া নিয়ে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে।
সময় কীভাবে চলে যায়। ওদের বিয়েটা হয়েছে মোটে ছয় মাস। ছয়টা মাস, যা কোনো কোনো দম্পতির কাছে একসাথে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস হয়, কারও কাছে এখনও অচেনা বাঁকের মতো। আরশীনের জন্য এই ছয় মাস ছিল নতুন মানুষকে বুঝে ওঠার, তার খোলসের নিচে লুকিয়ে থাকা আসল রঙগুলো খুঁজে বের করার সময়। এই কয়েকদিনে সে আদিয়াতকে দেখেছে, জেনেছে এবং বুঝেছে। যদিও তাকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয় নাই, কিন্তু যতটুকু বুঝেছে; ততটুকু এই কয়েক মাসের সম্পর্কের জন্য ঠিক আছে।
আদিয়াতকে এমনভাবে আগে কখনো দেখেনি সে। ক্লান্তির ছাপ তো দেখেছে কিন্তু আজকেরটা অন্যরকম। এ শুধু শরীরের ক্লান্তি নয়, মানসিক অবসাদ, ভেতরের জমে থাকা ভার, অজস্র না বলা প্রশ্ন আর দায়িত্বের ঘূর্ণিপাকে একা পড়ে যাওয়ার ছাপ। যেন একজন সৈনিক, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছে কিন্তু যুদ্ধটা এখনো বুকের ভেতর চলছে।
আরশীন একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল তাকে। একসময় মনে মনে বলতে বাধ্য হলো,
— “কাবিননামায় স্বাক্ষর করার পর সে আমার স্বামী, তাকে এতদিন ধরে দেখছি অথচ আজকে আমি তাকে নতুন করে দেখছি মনে হয়। স্তব্ধ দৃঢ়তা নিয়ে দেখছি। আচ্ছা ওর পাশে দাঁড়িয়ে কখনো ভালোবাসার দাবি করলে সেটা কি অন্যায় হবে?”

আরশীনের মনে ভালোবাসা নিয়ে বিশেষ কোনো রঙিন স্বপ্ন ছিল না। “ভালোবাসা” শব্দটা তার কাছে ছিল একটু ধোঁয়াটে, একটু কল্পনাবিলাসী। বাস্তবের কঠিন হিসেব নিকাশে ওসবের জায়গা ছিল কম। সে ভেবেছে, সম্পর্ক মানে দায়িত্ব, সম্মান আর সহানুভূতির ভারসাম্য; তাতেই জীবন চলে যায়। কিন্তু এখন… এখন কী হচ্ছে তার ভেতরে?
আদিয়াতের দিকে তাকালে, তার কথাগুলো শুনলে কিংবা এমনকি তার নীরব উপস্থিতিতেও কেন যেন মনের কোণে হালকা কিছু নাড়া দেয়। হঠাৎই মনে হয়, এই নির্লিপ্ত মানুষটার চোখে কোনো একটা নির্ভরতা আছে। এই মানুষটা পাশে থাকলে জীবনটা হয়তো একটু সহজ হতে পারে।
সময় কি তবে বদলে যাচ্ছে? অনুভূতিরা কি ধীরে ধীরে মেলে আসতে চাইছে? না কি ভালোবাসা, যেটাকে এতকাল অবহেলা করেছে, সে নিজেই দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে? এক অজানা স্বীকারোক্তির মতো অনুভব হয় তার ভেতরে, কিছু একটা বদলাচ্ছে। নিঃশব্দে। নিঃশর্তে। এই স্বীকারোক্তি ভালো হবে, না খারাপ; আরশীন জানে না। জানবার উপায়ও নেই। ভবিষ্যতের জটিল পথে কী অপেক্ষা করে রেখেছে, তা বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু মন তো আর যুক্তি মানে না। মন তো হিসেব-নিকেশের পাতা খুলে বসে না। সে তো শুধু টের পায়; কার উপস্থিতিতে নিঃশ্বাসটা হালকা হয়, কার চোখে চোখ পড়লে এক মুহূর্তের জন্য সব চিন্তা থেমে যায়।
আরশীন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বহুবার। বলেছিল, এটা সাময়িক কৃতজ্ঞতা, ভালো ব্যবহারের প্রতিফল, একসাথে থাকার স্বাভাবিক অনুভব। কিন্তু আজ, এই ভোরবেলার আলো ছুঁয়ে সে বুঝে গেল মনকে আর থামানো যাবে না। তাকে জোর করে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। সে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরেই একটা নতুন অধ্যায়ের দিকে হাঁটছে বোধহয় যেটা… অন্যরকম, অনিশ্চিত, কিন্তু আশ্চর্য রকম আত্মিক।
আরশীন অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা-মন্দবাসা সবকিছু সম্পর্ক একদিকে সরিয়ে রেখে সে একটু ফ্রেশ হতে গেল। হালকা ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক ঝলক দেখে নিল। দিনদিন চেহারাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কি দেখে যে আদিয়াত তাকে বিয়ে করল? ওহো, সে তো বিয়ের আগে দেখার অবকাশ পায় নাই। আরশীন একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠল। ফোনটা হাতে নিতেই দেখল, আশার নাম্বার থেকে স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠেছে।
— “আপু, আমাদের কলাবাগানের বাড়িতে তুমি আজ একটু গিয়ে খোঁজ নিও তো। ওরা নাকি আজকে আবার গিয়েছিল। বাবার কাছে হয়ত একটা মেমোরি চিপ ছিল, যেটার খোঁজে ওরা বারবার যাচ্ছে। ওখানে অনেক প্রমাণ রাখা আছে। প্লিজ, ওটা ওদের হাতে পড়তে দিও না।”
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৪]
~আফিয়া আফরিন

(অর্ধাঙ্গ, অর্ধাঙ্গিনী)
অফিসের বাতাস যেন হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠেছে। আগের সেই গুছানো শৃঙ্খলার ছায়াও নেই কোথাও। সবাই একে অপরের মুখ চেয়ে আছে, কাঁধে চাপা উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। হিসেবপত্রে যে গরমিল ধরা পড়েছে তা সরাসরি প্রভাব পড়েছে কোম্পানির মূল আর্থিক স্থিতিতে। এটা আর ছোটখাটো ভুল নয়, এটা লস… অনেক বড় লস। অবশেষে সকলের প্রশ্নের চাহনি, সমস্ত আঙুল এসে ঠেকল আদিয়াতের দিকেই। বিশেষ করে আমিনুল ইসলাম, যিনি এই কোম্পানির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ সদস্য তার প্রতিক্রিয়া ছিল সবচেয়ে তীব্র। সভা কক্ষে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চোখেমুখে তীব্র হতাশা, কণ্ঠে অভিযোগের ঝাঁজ।
— “একটা মানুষ যদি হিসাব ধরে রাখতে না পারে, তার হাতে দায়িত্ব রাখার মানেটা কী? আমি আগেও বলেছিলাম, কাজ ভাগ করে নিতে হবে। আজকে দেখছেন ফলাফল।” তিনি পরিবার ও অফিস দুই ক্ষেত্রেই আদিয়াতের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছেন বারবার। জহিরুল ইসলামের কেবিনে যখন আমিনুল ইসলাম ঢুকলেন, তখন চারপাশ এক অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। কাঠের টেবিলে রাখা কিছু রিপোর্টে চোখ রেখে তিনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আমিনুল গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “ভাই, আপনার ছেলের ভুল বলে কি সব এড়িয়ে যাবেন?”

জহিরুল ইসলাম ধীরে মাথা তুললেন। কিছু বলার আগেই আমিনুল আরও এগিয়ে এসে বললেন
— “আপনার ছেলে, ঠিক আছে। কিন্তু এই ভুল একটা কোম্পানির ভিত কাঁপিয়ে দিল। এটা যদি শুধুই ভুল হতো, বুঝতাম। কিন্তু এই হিসাব গরমিলটা কি সত্যিই ভুল? না ইচ্ছাকৃত কিছু? আপনি কী করবেন আমি জানি না, কিন্তু আমিও দেখব। এইবার সবাইকে জবাব দিতে হবে।”

জহিরুল ইসলাম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। নরম স্বরে বললেন,
— “তুই যা বলছিস সেটার গুরুত্ব বুঝি। আমি নিজেও এই ঘটনায় গভীরভাবে দুঃখিত। আদিয়াত আমার ছেলে, ঠিক। কিন্তু কোম্পানির ক্ষতি আমার নিজের ক্ষতির চেয়েও বড়।”

— “তবে যাইহোক না কেন, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না জবাবদিহি করতেই হবে, অনেক প্রশ্ন আছে।”
এই কথার পরেও আমিনুল ইসলাম থেমে রইলেন না। আরও বললেন,
— “দেখেন ভাই, আত্মীয়তা থাক আর না থাক, অফিসের প্রশ্নে আমি রেয়াত করতে জানি না। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি, আজও করব। এবার সত্যিটা বের করেই ছাড়ব। আদিয়াত কোথায়? আমার উত্তর চাই।”

জহিরুল শান্ত গলায় বললেন,
— “তুই নিজের কাজে যা। আদিয়াতের সাথে আমি কথা বলছি… জবাব চাওয়ার হলেও আমি চাইব আর দেওয়ার হলেও আমিই দিব। তোদের উপর কোন প্রভাব না পড়লেই তো হলো?”
— “নিজের ছেলে বলে ছেড়ে দিবেন?”
— “এখানে ছেড়ে দেওয়া অথবা ধরে রাখার প্রসঙ্গ কেন আসছে? ব্যাপারটা আমার ছেলেকে কেন্দ্র করে, আমি বুঝে নিবো বলেছি। আদিয়াতের সাথে আলাদাভাবে কথা আমি বলব। ফাইলগুলো ওর চেক করার পর তোর চেক করার কথা ছিল, কিন্তু তুই ব্যস্ত বলে এড়িয়ে গেছিস। তাহলে দায় একা আদিয়াতের উপর পড়বে কেন? অর্ধেক তো তোর উপরেও পড়া উচিত। সেটাই কি চাচ্ছিস?”
জহিরুল ইসলামের কণ্ঠ ছিল শান্ত, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন ভারী পাথরের মতো। কথাগুলো শুনে আমিনুল ইসলাম কিছু মুহূর্ত চুপ করে রইলেন তারপর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, গলায় ক্ষীণ কাঁপন,
— “আমি ভাবতেই পারি নাই আপনি এভাবে কথা বলবেন, ভাই। আমি তো সবসময় এই কোম্পানিকে নিজের ঘর ভেবেই দেখে এসেছি। আর আজ আপনি বলছেন আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি? এখানে হিসাবের হিসাবটাই বড়। আমি শুধু এতটুকুই বলব, আমাকে বিশ্বাস না করলে আমি এখান থেকে সরে দাঁড়াব।”
— “এইজন্যই বোধহয় লোকে বলে আত্মীয়তা আর অফিস আলাদা রাখতে হয়। কে কার উপর দোষারোপ করছে আর কে নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকছে, কীভাবে বলি?”
আমিনুল আর কিছু বললেন না। তিনি ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, দরজা অল্প জোরে ঠেলেই। জহিরুল ইসলাম বেরিয়ে গেলেন। আধাঘণ্টায় বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে এলেন। সারাদিন অফিসে গুছিয়ে রাখা ধৈর্য আজ ক্লান্ত মনে ভার হয়ে নামছে। ঘরে ঢুকেই প্রথমে খোঁজ নিলেন,
— “আদিয়াত বাসায় আছে?”

গৃহকর্মী মাথা নাড়ল,
— “না স্যার, উনি বাসায় নেই। সকালবেলা বেরিয়ে গেছে।”
জহিরুল ইসলাম নীরব হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। ভেতরের ঘরে পা দিতেই চোখ পড়ল সোফার কোণায় বসা আরশীন আর আযহানের দিকে, গল্প করছিল তারা। আরশীন বলছিল,
— “ওই সিরিজের নায়কটা একদমই ঠিক কাজ করেনি, বউকে ফেলে এমন করে কেউ যায়?”

আযহান মাথা নেড়ে বলল,
— “তাই তো। এজন্য প্রথম এপিসোড দেখেই ওই সিরিজ বিদায় দিয়ে দিয়েছি।”
— “আমাকে তাহলে নতুন একটা সিরিজ সাজেস্ট করো, আমি দেখব।”
ওদের মধ্যে সাধারণ কথাবার্তা হচ্ছিল। জহিরুল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন সোজা নিজের ঘরের দিকে।
আদিয়াত বাড়ি ফিরল দশটা নাগাদ। নাজনীন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। আজ একটু আরশীনকে বকাবকিও করলেন। উনার ধারণা, আরশীন হয়ত ঠিকঠাক আদিয়াতের খেয়াল রাখতে পারছে না। আরেকটু খেয়াল রাখলেই হয়! এরমধ্যে তার ফোনটাও অফ। বউ যদি ছেলেকে বাঁধতে না পারে তাহলে কি করে হবে?
ছেলে ঘরে পা রাখতেই মায়ের মন শান্ত হলো। ভেতরে ঢুকতেই কাজের মেয়ের মাধ্যমে জানতে পারল, বাবা ডাক পাঠিয়েছেন। এ কথা শোনার পর আদিয়াত আর দেরি করল না। কোনোদিকে না তাকিয়ে, না কারও সাথে কথা বলে সোজা উঠে এলো বাবার ঘরের সামনে। দরজায় হালকা নক করল। ভেতর থেকে বাবার গলা ভেসে এল,
— “আসো।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ঘরের গম্ভীর পরিবেশটা টের পেল ও। জহিরুল ইসলাম একা বসে আছেন, সামনে ছড়ানো কিছু ফাইল। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,
— “কাগজপত্রের বা হিসাব-নিকাশের আর কোন সুরাহা করা গেল? গতমাসে আমরা সবাই এতটাই ডিস্টার্ব ছিলাম যে, এই বিষয়ে নজর দিতে পারি নাই।”

— “তাই বলে পুরো রিপোর্টে ভুল? এটা তো আমি নিজের থেকে এক্সপেক্ট করতে পারছি না। আমি নিজেও জানি, এই ভুলটা আমার হওয়ার কথা নয় কিন্তু কিভাবে হলো; সেটাই বুঝতে পারছি না।”
— “যা গেছে তা বরং বাদ দিই…”

আদিয়াত বাবাকে থামিয়ে বলল,
— “বাদ দিব কেনো, বাবা? দোষ যদি হয় আমার, তবে আমি দায়ভার নিতে রাজি আছি। নিজের দায়িত্ব থেকে কোনদিন সরে যাইনি, যাবও না। কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে একবার বলো, তোমার সত্যিই কি মনে হয় এই ভুলটা আমার? এই হিসাবের গোলমালটা আসলেই আমার করা?”

তিনি ছেলের চোখে চোখ রেখে বললেন,
— “তুমি ছোটবেলা থেকেই যা করেছ, নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েই করেছ। কখনো তোমাকে ফাঁকি দিতে দেখিনি। তাই তো আজও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি, এই ভুলটা তোমার না। কিন্তু আদিয়াত, আমি তো শুধু তোমার বাবা না, এই কোম্পানিরও একজন অভিভাবক। সত্যিটা খুঁজে বের করতেই হবে। দোষ যারই হোক না কেনো! কারণ এবার শুধু ক্ষতি না, বদনামের আশঙ্কাও আছে।”

আদিয়াত বলল,
— “আমি জানি, বাবা। আমি সেটা করতেই এসেছি। দোষ যেই করুক, এবার সে বাঁচবে না। যেহেতু আমি নিজের দিক থেকে সত্য, তাই এটা আমিই দেখব। চাচা কিছু বলছে?”
আমিনুল ইসলামের কথাটা তিনি এখনই ছেলেকে বলতে চাইলেন না। আজ যা করেছেন তা তো সামান্য ছিল এরপরেও যে ঝামেলা করবে, তা বড়ভাই হিসেবে তিনি বেশ ভালো করেই জানেন। আদিয়াতকে আপাতত সত্যটা বলল না,
— “না, কী আর বলবে? তোমার উপর সকলের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।”
— “ঠিক আছে, আগামীকালও আমি অফিস যাচ্ছি না। আমার তত্ত্বাবধায়নে যতগুলো ফাইল আছে, সবগুলো ঘরে বসেই চেক করব।”
ওই ঘর থেকে বেরোনোর পর আদিয়াত একটু থমকে দাঁড়াল। মা তো চিন্তা করছিল… তাই মায়ের খোঁজে পাশের ঘরে আসতেই তাকে পাওয়া গেল। সদ্য নামাজ পরে উঠছিলেন। স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
— “আয় বাবা, ঘরে আয়।”
আদিয়াত ভেতরে ঢুকল। ঘরটা শান্ত, পরিচ্ছন্ন। সে ধীর পায়ে এসে তাঁর পাশে বসল। মাথাটা আলতো করে ঠেকিয়ে দিল মায়ের কাঁধে। মা ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
— “মন খারাপ তাই না বাবা? তাই বলে ফোন বন্ধ করে রাখবি? একটা খবরও দিবি না আমাদের? জানিস না চিন্তা হয়।”

আদিয়াত মাথা নাড়ল ধীরে,
— “মন খারাপ না তো।”

মা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন একটুক্ষণ। তারপর নিঃশব্দে বললেন,
— “আমাকে মিথ্যা কথা বলছিস? তোর মাকে? তোর কণ্ঠ শুনে আমি বুঝে যাওয়ার ক্ষমতা রাখি মন ভালো না খারাপ! এসব বাদ দে। জীবনে চলতে গেলে জীবন কি কখনো এক নিয়মে চলে? ভালো-খারাপ কতকিছু লেগে থাকে। তোর বাবা সামলে নিবে। তুই এত চাপ নিচ্ছিস কেনো?”
মা যেভাবে বুঝেছে, সেভাবেই থাকুক; তার ধারণার উপর আর কোন কথা না উঠুক। কিন্তু সে তো জানে, মায়ের চিন্তা-ভাবনার মত সবকিছু এত সরল নয়। এই গোটা বিষয়টা তার জন্য যে কী অপমান, অসহ্য এবং যন্ত্রণাদায়ক; এটা শুধুমাত্র সে নিজে বুঝতে পারছে। পাশে থেকে সবাই সান্ত্বনা দিতে পারবে। বাবা বলছে, আমি সব দেখে নিব। মা বলছে, এত চাপ নিস না। আর আরশীন? সে তো এক কাঠি উপরে। হেসে হেসে বলছে, আরে আপনিও না! এরকম ভাবতে ভাবতে একদিন ভাবুক হয়ে পাগল হয়ে যাবেন। শেষে ঠিকানা হবে পাগলা গারদ।
এই বলেই ধপাস করে বসে পড়ে টেবিলের পাশে। আদিয়াতের সামনে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা ফাইলগুলো গুছিয়ে সাইডে সরিয়ে রাখে। অন্য সময় হলে আদিয়াত কড়া গলায় কিছু বলত হয়ত। কিন্তু তখন… কিছু বলল না। বরং চুপ করে তাকিয়ে থাকল আরশীনের দিকে। মনে হচ্ছিল, মেয়েটার এই কাণ্ডটাই দরকার ছিল ওর। বাড়ি থেকে বের হয়েছিল আরশীনকে বলেই, তবে গন্তব্য কোথায় তা বলে যায় নাই। ইচ্ছাকৃতভাবে ফোন বন্ধ রেখেছিল। মাঝেমধ্যে সকলকে একটু চিন্তায় রাখলে ক্ষতি কি?
সে চোখ বন্ধ করল। মাথাটা মায়ের কোলে নামিয়ে রাখল। সেই পুরোনো চেনা ঘ্রাণটা, যা একমাত্র মায়ের কাছেই মেলে। ঘরের বাতাসের মত মনটাও তখন যেন আরও শান্ত হয়ে এলো।
.
রাতের খাবার টেবিলে আজ একটু হালকা মেজাজেই কাটল। সারাদিনের টানাপোড়েন কিছুটা ঢেকে গেল নরম আলো আর চেনা মুখগুলোর সাথে টুকটাক কথাবার্তায়। এইদিকে আযহান আর আরশীন সেই চলমান ড্রামা সিরিজ নিয়ে নিজেরাই একখানা আলাদা পর্ব চালিয়ে যাচ্ছে।
— “তুমি দেখছোই না, পরের এপিসোডে ও আসলে পালিয়ে যাবে।”
— “তাই? আমি ভাবছিলাম, ও ফাঁসিয়ে দেবে। দেখা যাক, কোনটা সত্যি হয়।”
ফিসফিস ফিসফিস, গল্প চলতেই থাকে। মাঝে মাঝে হাসি, আর কখনো চোখ গরম করে ওঠে উত্তেজনায়। খাবে কি না, নাকি গল্পেই রাত পার করে দেবে; এই নিয়েই সকলে চোখাচোখি করে হেসেও ফেলে।
আলিয়া নেই। সকালেই চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি। কারও বারণ শুনল না। নাজনীন তো কোনোভাবেই ওই বাড়ি যেতে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
আলিয়া সেদিকে কান না দিয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত ছিল।
আরশীনও আটকাতে চেষ্টা করেছিল, জহিরুল ইসলাম বাঁধা দিয়েছিলেন তবুও কিছুতেই আটকানো গেল না ওকে। ওর ভেতরে হঠাৎ একটা আকুলতা জেগে উঠেছে, যা কেউ বুঝতে পারল না। শেষমেশ কেউ কিছু বলল না আর। শুধু চুপচাপ দেখে গেল ওর চলে যাওয়া।
খাওয়ার পর বসার ঘরে হালকা আলো, গরম চায়ের কাপ আর মা-বাবার শান্ত গলায় চলতে থাকা গল্পের সুরে একটা ঘরোয়া উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল। জহিরুল ইসলাম সেদিন অনেকদিন পর খোলাখুলিভাবে আদিয়াতের সঙ্গে গল্প করলেন। ছোটবেলার কোন ঘটনা মনে করিয়ে, মাঝেমধ্যে হাসলেনও। মা মাঝে মাঝে চোখ তুলে আদিয়াতকে দেখে ভাবছিলেন, ছেলেটা আমার কত বড় হয়ে গেল!
আরশীন তখন সেই মুহূর্তে বসার ঘরে ছিল না। মা আর ছোটবোনের সঙ্গে কথা বলার জন্য ভেতরের ঘরে চলে গিয়েছিল। মা-বাবার সাথে গল্পগুজব শেষে একটা সময় পরে আদিয়াত উঠে নিজের ঘরে এল। দরজা খুলতেই তার চোখ পড়ল, ঘরের মাঝখানে নরম আলোয় আরশীন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চুপচাপ, নীরব, একদম কোমল মনে হলো।
এই মেয়েটা… যাকে সে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি এখনও, আজ সারাটা দিন পাশে থেকেছে। কখনো কোন অভিযোগ না করে, কখনো বিরক্তির কারণ হয় না। এমনিতে অকারণে রাত জেগে থাকে, গল্প করে, চা বানায় আর আজ… একটুও অপেক্ষা করল না। আদিয়াত আসলে ভেবেছিল, আজ রাতে দু’দন্ড কথা বলবে ওর সাথে। হয়তো কিছু হালকা হাসির কথা কিংবা বলা যায়, একটা ছোট্ট ধন্যবাদ।
‘ধন্যবাদ’—কেন দিতে চায়, ঠিক জানে না আদিয়াত। কোনো বাধ্যতা নেই, কোনও নিয়মেও পড়ে না, তবু মন বলছে। আজকের দিনের জন্য, ওর পাশে থাকার জন্য, ওর সেই আগল-দেওয়া চুপচাপ সাহচর্যের জন্য, একটা ধন্যবাদ ওর প্রাপ্য!
আদিয়াত ধীরে ধীরে খাটের পাশে এসে দাঁড়ায়, খানিকক্ষণ আরশীনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আনমনে বলে,
— “আপনি জানেন না, আমি ঠিক কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনি এটাও জানেন না, আপনি আমার সবচেয়ে কঠিন সময়টায় নীরব সঙ্গী হয়ে থেকেছেন। আর সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কী উপকার যে করলেন! এই উপকারের ঋণ তো একটা ধন্যবাদ দিয়ে শোধ করা যাবে না।”
তারপর চুপচাপ আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সে। ধন্যবাদটা রয়ে যায় চোখের কোণে। শব্দ হয়ে ওঠেনি এখনও…
.
পরদিন সকালে আদিয়াত অফিসে গেল না। ব্যপারটা পালিয়ে বেড়ানোর মতো নয়, মন-মানসিকতা নেই আসলে। যতদিন না কুলকিনারা পাচ্ছে ততদিন অপরাধবোধ মাথা থেকে যাবে না। যে করেই হোক, যা হোক, কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু এই কাজটা যে কে করতে পারে, সেই বিষয়ে একদমই আইডিয়া নেই। ফোন হাতে নিয়ে মারুফকে ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ওইদিক থেকে তার ফোন এলো। স্ক্রিনে মারুফের নাম দেখে ও চোখ বুজে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
— “হ্যাঁ মারুফ।”
— “স্যার, একটু জরুরি ব্যাপার আছে। অফিসে আসতে পারবেন?”
— “ঠিক আছে।”
আদিয়াত ফোন রেখে উঠে দাঁড়াতেই দরজায় টোকা পড়ল। আরশীন চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল। চোখেমুখে একটা কৌতূহল। আদিয়াতকে রেডি হতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
— “কোথায় যাচ্ছেন?”
— “অফিসে। মারুফের ফোন এসেছিল।”

আরশীন কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “আমি যাই আপনার সাথে? ভালো লাগছে না একা ঘরে বসে থাকতে। আপনি তো আবার আমাকে একা বের হতেও মানা করে দিয়েছেন।”

আদিয়াতও ওর মত করে ভেবে বলল,
— “চলুন তাহলে। দেখি গিয়ে কী পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি চলছে অফিসে!”

আরশীন চোখ গোল করে বলল,
— “তাহলে তো এইবার আপনাকে হিরো বানাবে।”
— “হিরো? ভিলেন হওয়া এখন কাঁধে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দেখি আজ স্ক্রিপ্ট কী বলে।”
আরশীন হেসে নিচে নামল। সিঁড়ির ঘুরন্ত কোণায় দাঁড়িয়ে আদিয়াত তখনও ফোনে কথা বলছিল। আরশীন পা ফেলে নিচে নামতেই নাজনীন সামনে এগিয়ে এলেন। চোখে-মুখে মমতার ছাপ, যেন সারা রাতের চিন্তা এক মুহূর্তে গলে পড়েছে। মায়া করে আরশীনের মাথায় হাত রেখে বললেন,
— “কাল বোধহয় একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম, তাই না মা? কিছু মনে করো না।” তার চোখে একফোঁটা অনুশোচনা।
— “আদিয়াত রাতে ফিরছিল না, চিন্তায় মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল। বুঝতেই পারছো, এখনকার সময়টা একটু ভিন্ন রকম…”

আরশীন মাথা নিচু করে, মৃদু হেসে বলল,
— “না না, আপনি এমন করে বলবেন না। আপনি আমাকে শাসন করলে মনেই হবে আমি নিজের বাড়িতেই আছি। যেকোনো বিষয়ে বলার, বোঝানোর, রাগ করার অধিকার আপনারই আছে।”
নাজনীন চোখে একরাশ মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন আরশীনের দিকে। মুখে শান্তির ছায়া।
সেই মুহূর্তে ফোনটা পকেটে রেখে আদিয়াত নামল সিঁড়ি বেয়ে। আরশীন আর মা-কে কথা বলতে দেখে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। তাদের কথার সারাংশ ওর কানেও গেছে কিছুটা। তাই আরশীন পাশে আসতেই জিজ্ঞেস করল,
— “মা বকাবকি করেছে? কী হয়েছে আবার? কী যেনো… কী যেনো বলছিলেন?”

আরশীন একটুখানি ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে,
— “আপনি আবার জিজ্ঞেস করছেন? সব তো আপনার জন্যই হলো।”

আদিয়াত অবাক ভঙ্গিতে বলল,
— “আমার জন্য?”

— “হুঁম।” আরশীন চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি যেনো বলেছিলেন? নির্বাসনে যাচ্ছি, ফোন অফ থাকবে, বাড়িতে কাউকে কিছু জানাতে হবে না। সেইটুকুতেই তো বিপদ। আমি নাকি স্বামীর কোনো খোঁজখবর রাখি না। আপনি যে নির্বাসনে যান, ফোন বন্ধ রাখেন, খবর না দিয়ে বাড়ির বাইরে থাকেন; সব দোষ নাকি আমার।”
— “মা একটু বেশি চিন্তা করছিল, ওখানে তোমার দোষ নেই।”

আরশীন একটু ঠোঁট কামড়ে নিচু গলায় বলল,
— “হুমম আপনার দোষের ভাগিদার হলাম আমি।”

আদিয়াত বোধ হয় বোধহয় কণ্ঠে একরাশ মৃদু স্নেহ জড়িয়ে বলল,
— “ঠিক আছে, এরপর গুণের ভাগিদার করে নিব আপনাকে।”
আরশীন থমকে গেল এক মুহূর্ত। মুখ না ঘুরিয়েও অলক্ষ্যে তাকাল আদিয়াতের দিকে। চোখে ছায়াপথের মতো প্রসারিত এক ভাবনা। কত সহজভাবে বলল ও, অথচ কথাটা কত গভীর!
অর্ধাঙ্গ আর অর্ধাঙ্গিনী—একের দোষে যেমন অন্যজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি একের গুণে অন্যজনের জীবনও আলোকিত হয়। সম্পর্ক তো এভাবেই তৈরি হয়, ভাগ করে নেওয়া সমস্ত দোষ আর গুণ; সমান ভালোবাসায়।
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ২২৮২

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৫]
~আফিয়া আফরিন

(স্বপ্নের পথে)
অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আরশীনের নজরে পড়ল, এক কোণে নীরা দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠল না ঠিক, তবে অস্বস্তি একটা খচখচে অনুভূতির মতো জমে রইল বুকের ভেতর। জানতে পারল, সে নাকি এখানকার এক গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দিতে যাচ্ছে। তাই প্রায়ই আসে, কাজ বুঝে নিতে।
আদিয়াত সোজা চলে গেল তার কেবিনে। দরজা হালকা ভেজানো, ভিতরে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার উপস্থিতি চোখে পড়ল। আরশীন নিজে একটু দূরে, এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টির আড়ালে, ইচ্ছাকৃতভাবে সে নিজের অবস্থান জানান দিতে চায় না। কয়েক মুহূর্ত বাদে নীরাও সেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। মুখে একটানা হালকা হাসি, যেন মনে হচ্ছে এখানে জিলাপি বিলি হচ্ছে আর সে না এলে বুঝি ভাগ কম পড়ে যেত!
আদিয়াতের অফিসে জরুরি ডাক পড়েছিল কারণ আমিনুল ইসলাম, সকাল থেকে অফিসে এসে রীতিমতো উত্তাল পরিবেশ তৈরি করেছেন। চোখ মুখে রাগের ছাপ, কণ্ঠে চাপা গর্জন। বারবার হিসাবের গরমিলের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলে যাচ্ছেন,
— “জবাব চাই! এত বড় লস, অথচ কোনো হিসেব নেই? আমাকে দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে কেউ পার পাবে না। এই অন্যায় মেনে নেওয়ার মতো মানুষ আমি না। যার দায়, সে দায় স্বীকার করুক। আমি দায়ী হলে আমি ছাড়ব, কিন্তু কাউকে রক্ষা করার জন্য আমার ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা কেউ করবেন না।” তার মূল বক্তব্য এরকম,
— “দেখুন জহির ভাই, আমি শুধু এই কোম্পানির একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নই আমি এর একজন অংশীদার। শেয়ার আছে আমার। সুতরাং কোম্পানির ক্ষতিতে আমার ক্ষতিও হচ্ছে। এখন এই লসের দায় কার, সেটা পরিষ্কার করে না বললে আমি বসে থাকতে পারি না। আদিয়াতের কাছ থেকে আমি সকলের সামনে সরাসরি জবাব চাই। এই গরমিল কীভাবে হলো, সেটা ওকেই বুঝিয়ে বলতে হবে। আর যদি বলেন, সে ব্যস্ত ছিল কিংবা ভুল হয়েছে, তাহলে দয়া করে আমি নিজে আমার দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিয়ে নেব। কারণ যেখানে স্বচ্ছতা নেই, সেখানে আমি থাকতে পারি না। এটাই আমার শেষ কথা।”

আদিয়াত খুবই সাধারণভাবে এবং শান্ত কণ্ঠে বলে,
— “আমি আমার দায়িত্ব অস্বীকার করছি না। এই কোম্পানির প্রতিটি কাগজে, প্রতিটি অঙ্কে আমার নজর থাকে। কোথাও যদি গাফিলতি হয়ে থাকে, আমি সেটা স্বীকার করতে পিছপা হব না। কিন্তু এর মানে এই নয়, আমি চুপচাপ দোষ নিয়ে বসে থাকব যখন জানি পুরো চিত্রটা এখনো স্পষ্ট না। আমি তদন্তে সহায়তা করব। সত্য বের করে আনব। কিন্তু হ্যাঁ, অন্যের ভুলের দায় আমি নিজের কাঁধে নেব না। আমার ভুল হলে, আমি তার দায় নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এবং আপনারাও নিজের মত অনুসন্ধান করতে পারেন, এখানে সত্যি আমার কোন ত্রুটি আছে কিনা! ইচ্ছাকৃত হোক অথবা অনিচ্ছাকৃত ভুল, আমি মাথা পেতে মেনে নিব। কোম্পানির ক্ষতি হলে সেটা আমার নিজের ক্ষতির মতোই।”

আমিনুল ইসলাম ঠোঁট কামড়ে সামান্য বিরতিতে চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ ছোট করে বললেন,
— “কিন্তু তুমি তো জানো, শুধু কথায় বিশ্বাস চলে না। কাগজে কলমে প্রমাণ চাই এখন। তুমি বলছো সত্য বের করবে, ভালো কথা। তবে মনে রেখো, সত্য যদি তোমার দিকেই আঙুল তোলে তখনও যেন তোমার কণ্ঠে এই একই আত্মবিশ্বাস থাকে।”

আদিয়াত ঠান্ডা গলায় বলল,
— “আমি তো গিরগিটি না, যে পরিস্থিতি বুঝে রঙ পাল্টে ফেলব। সত্য যদি আমার বিপক্ষেও যায়, তাকেও মেনে নেবো। নিজের দায় থেকে কখনো পালিয়ে যাইনি, যাবও না। কিন্তু দোষারোপের খেলায় আমি নেই। আপনি যদি সত্যিকারের উত্তর চান, আমি সেই পথেই আছি।”
ঘরের সবাই নীরব। চাপা একটা উত্তেজনা যেন দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ মুখ তুলছে না, কেউ কারো চোখে তাকাচ্ছে না।
আরশীন একটু দূরে, কোণার পাশে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিল। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আদিয়াতের উপর। যেভাবে ও পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে শান্ত, সংযত অথচ দৃঢ়; তা তার চোখে বিস্ময়ের এক নতুন আভা এনে দিল।
এতটা স্পষ্টভাষী, মাপজোখ করা শব্দচয়ন, অথচ মুগ্ধতার মতো একটা ভারী ঠান্ডা ভাব… এত আত্মবিশ্বাসী অথচ বিনয়ী অবস্থান, এসব তো শুধু বইয়ে পড়া যায়। বাস্তবে এমন মানুষ ক’জন হয়?
আরশীনের মনে হচ্ছিল, সে যেন নতুন করে আদিয়াতকে চিনছে। মানুষটা একেকটা বাক্যে শুধু নিজের দায়িত্ব নিচ্ছে না বরং চারপাশে থাকা প্রত্যেকটা মানুষকে একরকম পাঠ পড়িয়ে দিচ্ছে, কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে সম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! ও বোধহয় ছলাত ছলাত করে আদিয়াতের এই রূপটার প্রেমে পড়ে গেল। সবকিছু একসাথে মিলে এমন এক দৃশ্য তৈরি করল, যেটা আরশীনের হৃদয়ে আলতো কাঁপন তুলে দিল। বিশ্বাস, ভরসা, সম্মানে মোড়ানো একজন মানুষ। ওকে তো আরশীনের পাওয়ার কথা ছিল না। ভাগ্যের জোরে পেয়ে গেল। সেই ভাগ্যকেই ওই মুহূর্তে সহস্র সালাম করে নিল। এই দুনিয়ায় এই রকম ভরসা দেওয়ার মতো মানুষ আর ক’জন পাওয়া যায়, যার ভরসায় অজান্তেই একটু একটু করে, নীরবে… প্রেমে পড়া যায়!

কথাবার্তা শেষ হতেই ওখান থেকে একে একে সকলে বেরিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত নীরা থাকল। ঘর ফাঁকা হলে আদিয়াতের সামনে এসে দাঁড়াল,
— “তোমার জীবনের ডাউন ফলের মেইন কারণ হচ্ছে ওই মেয়েটা। আজ যদি আমার সাথে তোমার বিয়ে হত, এইদিনে দেখতেই হতো না। মেয়ে জামাই হওয়ার উপলক্ষে বাবাও হিসাব নিকাশ চাইতো না।”

আদিয়াত মাঝে মাঝে নিজের মানুষের ব্যবহারে অবাক হয়। এদের এত রূপ! এত পরিবর্তন! গিরগিটিও লজ্জা পেয়ে বলবে,
— “ভাই আমাকে আমার চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিয়ে তোমরা কতদূর এগিয়ে গেছো। আমি তো তোমাদের গুরু, আমাকেও একটু সম্মান দাও প্লিজ!”
আদিয়াত নীরার কথার জবাবটা দিল একরকম শাণিত কণ্ঠস্বরে।
— “তুমি একটা ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো, নীরা। আমার জীবনের ‘ডাউন ফল’ যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা কোনো সম্পর্কের কারণে না। আর তোমার ধারণা অনুযায়ী, বিয়েটা যদি তোমার সাথে হতো তবে আমি মনে হয় কী হয়ে যেতাম? কিন্তু না, আমি আজকের আদিয়াত সেই আদিয়াত’ই থাকতাম। খোলস পাল্টানোর স্বভাব আমার মধ্যে নেই। আর ওই মেয়েটা বলছো যাকে… সে অন্তত আমার পাশে দাঁড়াতে জানে। ঝড় উঠলেও ছায়া হয়ে থাকে, প্রশ্ন তুলে না।”

— “ছায়া হয়ে থাকে? কতদিন থাকবে? ওটা তো শুধু তীব্র রোদে পাশাপাশি হেঁটে যায়। আর বৃষ্টির অথবা রোদ দুইয়ের জন্য’ই ছাতা লাগে কিন্তু।”

আদিয়াত হেসে বলে,
— “ছায়া হচ্ছে নিজের অস্তিত্বের একটা অংশ, যেটাকে চাইলেও সরিয়ে রাখা যায় না। আর ছাতা? ধরলাম আর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। দাঁড়াও… তোমার কথার শেষ একটা জবাব দিয়ে নিই। আমি কারো জামাই হওয়ার লোভে নিজের বিবেক বিকিয়ে দিই না। হিসাব যদি চাও, চৌদ্দ ঘাটে বুঝিয়ে দিতেও রাজি আছি। কিন্তু তোমার মতো কারও কাছ থেকে সুবিধা নেব; এটা কখনো ভাবোনি, ভাববও না। গেট আউট ফ্রম হেয়ার। তোমার চেহারাও আমি আর দেখতে চাই না।”
নীরা সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে বের হলো। আরশীন তো ওখানেই ছিল, সব কথা শুনেছে। সে সটান বেড়িয়ে এলো। আদিয়াতের উদ্দেশ্য শুধু একটা কথা বলল,
— “আমি একটু ডোজ দিয়ে আসি কেমন?” সে থাই গ্লাসের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো। নীরার চোখে কিছুটা বিরক্তি আর কিছুটা অবজ্ঞা। তার সামনে গিয়ে নির্ভরচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়াল আরশীন।
— “তুমি যে আমার স্বামীকে লাইন মারার চেষ্টা করছ, সেটা বুঝতে আমার অতটা কষ্ট হয় না, নীরা। আমি অতটা সরল নই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখো; ও আমার শুধু স্বামী না, ও আমার সম্মান, আমার আস্থা। ওকে কেউ টলাতে চাইলে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকব না।
তুমি যদি ওকে কাছে পেতে চাও, তাহলে বলছি তোমার সময় শেষ। তোমার জন্য যদি ওকে জেদে পরিণত করতে হয়, তাতেও আমি রাজি। আমার জেদ থেকে ওকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। তাই সময় থাকতে নিজের মুখ বাঁচিয়ে সরে যাও, নইলে হারটা শুধু প্রেমে হবে না, আত্মমর্যাদাতেও লাগবে।”

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল আরশীন, তারপর ঠোঁটে এক চিমটি হাসি এনে বলল,
— “আর হ্যাঁ, কাউকে লোভ দেখিয়ে পাওয়া যায় কিন্তু আদিয়াত সেই তালিকায় পড়ে না।” কথা শেষে নীরার অভিব্যক্তি দেখার প্রয়োজন মনে করল না। যেভাবে ঝড়ের মতো এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।
.
আদিয়াত ধীরস্থিরভাবে তার টেবিলের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল। প্রতিটি ফাইলে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল মনোযোগ দিয়ে, যেন কোথাও ভুল করেও আর কোনো ভুল না থাকে।
আরশীন একটু দূরে বসে ছিল। সাদা সোফাটিতে নরম ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল। চোখ পড়েছিল অক্ষরে, কিন্তু মন পড়েছিল অন্য কোথাও। ওর চোখ মাঝে মাঝে ঘড়ির কাঁটার দিকে চলে যাচ্ছিল, তারপর আবার বইয়ের পাতায় ফিরে আসছিল।
আদিয়াত মাথা তুলে একবার তাকিয়ে বলল,
— “বোরিং লাগছে আপনার তাইনা? আরেকটু বসুন। সামান্য সময় লাগবে।”
আরশীন মাথা নাড়ল।
— “ঠিক আছে।” শুধু এটুকু বলেই আবার বইয়ে চোখ রাখল। আরশীন অপেক্ষা করছে। চুপচাপ, নিঃশব্দে। সময় যেন তাকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে, অপেক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে। হয়তো এটাই তার ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র ভাষা। ভালোবাসা মানে দাবি না, প্রাপ্তির আকুতি না। ভালোবাসা মানে অপেক্ষা; নিঃশব্দ, নিরলস, নিঃশর্ত। আর সে অপেক্ষা করবেই, শত সহস্র জনম যদি লাগে তবুও! কেবল আদিয়াতের চোখে চোখ রেখে, স্রেফ তার পাশে থাকার আশায়।

আদিয়াত ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। জানালার কাঁচ দিয়ে সন্ধ্যার আলো মাখা শহর পিছিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু বাড়ির দিকে গাড়ি যাচ্ছে না, এটা বুঝেও আরশীন কিছু জিজ্ঞেস করল না। আজ সে প্রশ্নহীন। শুধু একটুখানি তাকিয়ে দেখল আদিয়াতের মুখ, আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। গাড়ির হালকা নীরবতায় হঠাৎই গুনগুনিয়ে উঠল সে,
— “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো? পৃথিবীটা যদি স্বপ্নের দেশ হতো… তবে কেমন হতো বলো তো? যেখানে কোনো হিসেব নেই, নেই কোনো ব্যথা কিংবা বোঝা…”
গানটা মুখে আসেনি, এসেছে মনের গহীন থেকে। সুরটা হয়তো নিখুঁত ছিল না, কিন্তু অনুভূতি ছিল নিখাঁদ।
রাস্তায় আলো-আঁধারি খেলছে, মাঝে মাঝে হেডলাইটে ভেসে ওঠা মানুষের মুখ, দোকানের আলো, অথবা কোনো চেনা অচেনা পথ। সবই যেন ঘোলাটে লাগছিল, কিন্তু তার মনে স্পষ্ট এক অনুভূতি; আদিয়াত।
ভিতরে ভেতরে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে আজ যেন শব্দ জমেছে অনেক। কিন্তু মুখে কিছুই বলছে না। সে ধীরে বয়ে চলা নদীর মতো শান্ত, আরশীনের চোখে তখন এক ধরনের কোমল আভা, যেখানে সব সময়মতো কোনো দাবি বা অভিযোগ ছিল না, ছিল কেবল ভালোবাসার নীরব সুর। সেই মুহূর্তে চারপাশের বাতাসও নরম হয়ে এলো। গাড়ির জানালায় ঠেকা চাঁদের আলো আরশীনের কপালে পড়ল। তখন তার সত্যিকার অর্থে মনে হলো, এই পথটা বোধহয় আসলেই শেষ হওয়ার নয়!
নীরবতা বৃষ্টিভেজা জানালার মতো জমে ছিল গাড়ির ভেতরে। সেই নীরবতা হঠাৎ ভেঙে দিয়ে আদিয়াত একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “গুনগুন করে গাইছেন কেন? জোরে গান করুন, আমিও শুনি।”

আরশীন চমকে তাকাল। মুখে লজ্জার ছায়া। আলতো হেসে বলল,
— “আমি তো গান জানি না। এমনিই হুট করে আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে গাইতে ইচ্ছে করল…”

আদিয়াত হালকা হাসল, গলার টোনে প্রশ্রয় মাখানো,
— “যতটুকু জানেন, ততটুকুই গান।”
— “আবহাওয়াটা সুন্দর, সাথে পরিবেশটাও এবং মুহূর্তটাও… এই বেসুরো গলার গান শুনে যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা শুধু আমার দোষ নয়, অতিরিক্ত লজ্জারও বটে।” আরশীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলল।
— “আচ্ছা ঠিক আছে, জোর করব না। ইচ্ছে হলে গাইবেন।” শান্ত গলায় বলা কথাটাই যেন কেমন ভোঁতা লাগল আরশীনের কানে।
মনের ভেতর কোথা থেকে যেন একটুখানি অভিমানের কাঁটা এসে বিঁধল। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। আর একটু জোর গলায় বললেই কী হতো? আশ্চর্য! গানের মুডটাই চলে গেল।
গাড়ির কাচের বাইরে সন্ধ্যার নরম আলোটা ধীরে ধীরে গাঢ় হতে লাগল। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, রাস্তার পাশ ঘেঁষে ছুটে চলছিল গাড়িটা। ভেতরে নরম আলো, নীরব গান, আর দুটো মানুষের অনুচ্চারিত অনুভব। আদিয়াত হঠাৎ নরম গলায় বলল,
— “আপনার তো বাড়ি যাওয়ার খুব একটা তাড়া নেই, তাই না?”

আরশীন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই জবাব দিল,
— “না। কেনো?”
— “তাহলে যাবেন একজায়গায়?”

আরশীন এবার চোখ সরিয়ে তাকাল তার দিকে। কপালে ভাঁজ, গলায় কৌতূহল।
— “কোথায়?”

আদিয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “কোথায়… উমম, সেটা তো এখনই বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে এমন একটা জায়গায়, যেখানে গেলে দু’দণ্ড শান্তি পাবো।”
আরশীনের চোখে একটু চমক। অভিমান কোথাও মিলিয়ে গেল, বদলে এল একরাশ নির্ভরতা। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। যেমনটা হয়, যখন কেউ অজানা কোনও যাত্রায় সঙ্গী হওয়ার কথা ভাবে। আচমকা এক দুষ্টুমিভরা উচ্ছ্বাসে আরশীন গাড়ির ভেতরেই হালকা ঝাঁকানাকা কণ্ঠে গেয়ে উঠল,
— “চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে মিশে গেছে…” গলার তালে ছিল একধরনের টান, মনে হচ্ছিল যেন গানের সাথে সাথে ভেতরের কথাগুলোও ঢেলে দিচ্ছে— “যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে নদীর জল, চোখ বুঁজলেই দেখা মেলে এক স্বপ্নের সম্বল।”
আদিয়াত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার হাসির কোণে লুকানো থাকল বিস্ময়, ভালো লাগা, আর একটা আলগা উষ্ণতা; যেটা কেবল এমন কেউ জাগিয়ে দিতে পারে, যার পাশে থাকলে পৃথিবীর সব কোলাহল নিঃশব্দ হয়ে যায়! আদিয়াত মুখ ফিরিয়ে বলল,
— “আপনি তো বলেছিলেন গান পারেন না? অথচ এখন তো একেবারে গলা খুলে গাইছেন।”

আরশীন হেসে বলল,
— “ওটা তো আপনার দোষ। এখন আবহাওয়া আর আপনার কথার সাথে তাল মিলিয়ে গাইতেই ইচ্ছে হলো। এটা আনন্দের মুহূর্ত। আপনি জানেন, আমার ঘুরতে খুব ভালো লাগে।” একটু থেমে আবার বলল,
— “আচ্ছা, লং ড্রাইভে যাবেন?”
— “উঁহু, তার চেয়েও বড় কোথাও।” আদিয়াত বলল।
— “কোথায়?”

আদিয়াত ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি টেনে বলল
— “আন্দাজ করুন তো?”

আরশীন চোখ গোল করে ভুরু কুঁচকে বলল,
— “হানিমুনে নিয়ে যাবেন নাকি?”

আদিয়াত হো হো করে হেসে উঠল,
— “দারুণ বলেছেন। আচ্ছা চলেন, হানিমুনেই নিয়ে যাই। কখনো তো যাই নাই। একবার বরং গিয়েই দেখি।”

আরশীন ফিসফিস করে হেসে বলল,
— “এই মুহূর্তটাই যদি না শেষ হয়…” তার চোখে খেলে গেল একরাশ ধরা-না-দেওয়া স্বপ্ন।
আরশীন জানালার কাচে মাথা রাখল। বাইরের বাতাস চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে, তবুও সে নড়ছে না। গাড়ির গতিতে এক অদ্ভুত সুর, যেন নিঃশব্দে একটা গান বাজছে, যেটা কেবল তার হৃদয়ই শুনতে পাচ্ছে। আদিয়াতের পাশে বসে থাকাটাও আজ আলাদা রকম এক অনুভব এনে দিয়েছে তার মনে। এমন নয় যে সে প্রথমবার আদিয়াতের সান্নিধ্যে আসছে। কিন্তু আজকের মুহূর্তটা ভিন্ন। আজ সে শুধু শরীর নিয়ে নয়, মন নিয়েও তার পাশে বসে আছে। আদিয়াতের প্রতিটা কথা, প্রতিটা হাসি, আজ যেন ওর হৃদয়ের তন্তুগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। তার বুকের ভেতরে ধুকপুক করে বাজছে এক অচেনা সুর, এই কি তবে ভালোবাসা? এতো চুপচাপ ভালোবাসা, যেখানে কিছু বলা লাগে না—শুধু একজনের পাশে বসেই পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাওয়া যায়। সে একবার আদিয়াতের দিকে তাকাল। আদিয়াতের হাত এবং মনোযোগ স্টিয়ারিংয়ে এবং দৃষ্টি সম্মুখে। আরশীন চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। এই পুরুষটা তার নিরাপদ আশ্রয়, তার নিজের মানুষ। সে ভেতরে ভেতরে বলল,
— “এই পথ যেন কখনও শেষ না হয়। এই গাড়ির গতিতে ছুটে যাক আমাদের গল্প, ভুলে যাক পৃথিবীর সব হিসেব-নিকেশ।”
.
.
.
চলবে….