#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৬]
~আফিয়া আফরিন
(রাজা-রানীর গল্প)
রাতের বেলা পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছিল শায়লার গায়ে। তিনি সোফায় বসে ধীরপায়ে কাপের চা ছুঁয়ে মুখে তুলছিলেন। এমন সময় আশার পায়ের শব্দে তিনি মুখ তুললেন।
— “মা… আপু তো আর ফোন দিল না। ওই ব্যপারটা নিয়ে একটা কথাও বলল না।” মুখ গোমড়া করে বলল সে।
শায়লা চা রেখে ধীরে বললেন, “আহ! চুপ কর তো। ও যদি সংসার নিয়ে একটু থিতু হতে চায়, তাহলে তোর সমস্যা কী?”
— “না মানে, আমি ভাবছিলাম…”
— “এসব নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করিস না মা।” শায়লার কণ্ঠে একটু চাপা ধমক জড়িয়ে গেল, “তুই জানিস না কতো কী ঝামেলা! তোদের নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই। তোদের বাবা বিশাল দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাকে। এসবে তোদের যদি কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচব কি নিয়ে বল তো?”
আশা মাথা নিচু করে কিছুটা গলার স্বর নামিয়ে বলল,
— “কিন্তু মা, ওরা আমাদের ওই বাড়িতে এসেছিল কিছু একটা খুঁজতে। এমন না যে এমনি এমনি এসেছে।”
— “নিয়ে যাক। খুঁজে পেলে নিয়ে যাক। আমাদের কিছু চুরি করে নেয়নি ওরা। অতীত থাক অতীতেই। এখন আর এসব নিয়ে কারো মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তুই আর কোনো কথা বলবি না। আমি বলছি, এসব থেকে দূরে থাক। শান্তিতে বাঁচতে দে তো।”
আশার ঠোঁটে কথা জমলেও আর কিছু বলল না। সে জানে, এই মুহূর্তে মা আর কথা শুনবে না। ঠিক এমন সময় ওর ফোনে টুং করে একটা মেসেজের শব্দ হলো। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। প্রেরক, আরশীন। মেসেজ খুলতেই চোখ ছুঁয়ে গেল আরশীনের বার্তা।
— “তোর কথাটা আমি বুঝেছি, কিন্তু গেল কিছুদিন ব্যস্ততার জন্য গুরুত্ব দিতে পারিনি। মাথায় আছে এখনও। তবে আমি ঢাকা নেই, আদিয়াতের সাথে একটা কাজে এসেছি। ফিরে দেখব। আর, আপাতত কিছুদিন যোগাযোগ করতে পারছি না।”
আশা চুপচাপ তাকিয়ে রইল। ওর চোখে খানিক চিন্তার রেখা।
.
একটা আকস্মিক সিদ্ধান্তে শহরের যান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে, তারা গিয়ে পৌঁছাল শরীয়তপুরের সেই চার চর অঞ্চলে। যেখানে নদী মুখে মুখ রাখে আর হাওয়া ফিসফিস করে গল্প বলে। রাত তখন অনেক হয়েছে। নৌকাটা ধীরে ধীরে নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলছিল। একপাশে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ, অন্যপাশে ধূসর রঙা চর; যত সামনে যাচ্ছে, ততই যেন নীরব, বিস্তৃত কোনো অচেনা জগতে প্রবেশ করছে তারা।
আরশীন মাথা গুঁজে বসেছিল নৌকার এক কোণায়। তার চোখে নদীর আলো-ছায়ার খেলা। আদিয়াত মাঝেমাঝে ওর দিকে তাকাচ্ছিল। নির্ভেজাল, নিঃশব্দ ভালোবাসার চোরাস্রোত যেন দু’জনের মাঝেই গড়ে উঠছিল।
— “এই জায়গাটা আমার অনেক দিনের চেনা।” আদিয়াত হঠাৎ বলে উঠল, “শান্তি লাগে।”
আরশীন কিছু বলল না, শুধু হালকা একটা হাসি ঠোঁটে ফুটে উঠল।
চরের ধারে যখন নৌকা ভিড়ল, তখন চাঁদ মামা ঠিক মাথার উপরে। তার আভা ছড়িয়ে পড়েছে নদীর জল আর চরের সবুজ ঘাসে। পায়ে হাঁটার পথ নেই, শুধু নদীর কাদা, শুকনো ঘাস আর অজস্র নাম না জানা পোকামাকড়ের ডাক।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে একটু উঁচু জায়গায় পৌঁছাল। নদীর ধারে দাঁড়ানো একটা পুরনো তালগাছ, পাশে ছায়া-ধরা ঘাসের চাঁদর পাতা চর।
আরশীন বলল,
— “এমন জায়গা আগে কখনো দেখিনি। একদম নির্জন, অথচ মনের ভেতরে যেন একরাশ শব্দ হচ্ছে। এত আপন আপন লাগছে এই জায়গাটা।”
— “এখানে কিছুক্ষণ বসি। আপনি চোখ বন্ধ করে শুনুন, অনুভব করুন, নদীও গল্প বলে।” আরশীন ধীরে ধীরে বসে পড়ল ঘাসের ওপর। চোখ বন্ধ করল আদিয়াতের কথা মতো। এক মুহূর্তে যেন সব ব্যস্ততা, শহরের শব্দ, মানুষের ভিড়… সব পেছনে ফেলে তারা এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই প্রান্তে, যেখানে ‘তুমি’ আর ‘আমি’ শব্দগুলো মিলেমিশে শুধু ‘আমরা’ হয়ে যায়।
মধ্যরাত গড়িয়ে এসেছে। চরের নরম বাতাসে নদীর ধারে একটা নৌকার ছাউনিতে শুয়ে আছে ওরা। ছাউনির ওপর ত্রিপলটা হালকা দুলছে, মাঝে মাঝে কাঁপে বাতাসে। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকাদের কোরাস। নদীর গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের আওয়াজ যেন কারো শান্ত শ্বাস।
আরশীন বাঁ পাশে শুয়ে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল,
— “ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
আদিয়াত চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
— “না। কিন্তু ঘুমাতে চেষ্টা করছি।”
— “আপনি এত চুপ কেন?”
আদিয়াত চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
— “এই মুহূর্তটাতে চুপ থাকতেই ভালো লাগছে। কিন্তু আপনি চাইলে কথা বলতে পারি। তবে এক শর্তে, ঘুম আসলে দায় নেবেন না।”
আরশীন কাঁধ উঁচু করে বলল,
— “ঠিক আছে।”
— “তাহলে এখন কিছু বলুন।” আদিয়াত নরম স্বরে বলল, চোখ মেলে তাকিয়ে রইল আরশীনের দিকে।
— “কি বলব?”
— “ইচ্ছে আপনার। চুপ থাকা তো মেনে নিতে পারছিলেন না।”
— “এখন আর ইচ্ছে করছে না কিছু জিজ্ঞেস করতে। বাতাসটা ভালো লাগছে। একদম নির্ভার। মনে হচ্ছে… অনেক দিন পর এমন নীরবতাকে আপন করে নিচ্ছি।”
— “তাহলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন। কাল আবার আরেক জায়গায় যাব। বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।”
আরশীন চোখ বুজল। চারদিকে নদীর গর্জন নয় বরং মৃদু গান ঘুম পাড়ানিয়া সুরের মতো। বাতাসে আদিয়াতের গলার উষ্ণতা, পাশে থাকার নিশ্চয়তা, আর চরের রাতের চাঁদ; সব মিলিয়ে মুহূর্তটা অদ্ভুত শান্তিতে এবং নিঃশব্দতায় ভরপুর। সেই নিঃশব্দতায় ভেসে যেতে যেতে, রাতটা যেন এক অলিখিত কবিতা হয়ে উঠল।
সকালটা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছিল স্বর্ণালি আলোয়। চরের চারদিক জেগে উঠেছে, বাতাসে নদীর সোঁদা গন্ধ আর দূরে কোথাও মেঠো পাখির ডাক। আরশীন আর আদিয়াত দু’জনে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠল। নৌকার ছাউনিতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা প্রথম হলেও অদ্ভুতভাবে আরামদায়ক ছিল।
তারা একসাথে হাত-মুখ ধুয়ে সামান্য নাস্তার আয়োজন করল। চরের মানুষজনের আতিথেয়তায় ফুটন্ত চা, গরম রুটি। চরটাকে ধীরে ধীরে বিদায় জানাল তারা। আরশীন পেছনে তাকিয়ে নদীর ওপারটা এক ঝলক দেখে নিল, যেন মনে গেঁথে রাখবে এই নির্জন অথচ সৌন্দর্যে ভরা অভিজ্ঞতাকে। গাড়ির দরজা খুলে আদিয়াত বলল,
— “চলুন, এবার ফেরার পালা।”
আরশীন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
— “চরটা যেন একটা স্বপ্ন ছিল, ক্ষণিকের।”
তারা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল ধীরে ধীরে, আর চরের মাটির গন্ধটা তারা নিজেদের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিল।
আদিয়াতের ভেতরে যেন এক ধরনের ক্লান্তি জমে উঠছিল দীর্ঘদিন ধরে। নিয়ম, দায়িত্ব, হিসেব-নিকাশ, সবার প্রত্যাশা আর নিজের নিরুত্তর সন্ধান। শহরের যান্ত্রিক চাপে দম আটকে আসছিল যেন।
তাই আরশীনকে পাশে পেয়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, এইবার একটু মুক্তি দরকার। ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই, পরিকল্পনার ধার না ধেরে বেরিয়ে পড়েছিল দু’জনে। রাস্তায় থাকতে থাকতে আদিয়াত হঠাৎই বলেছিল,
— “ফোনটা অফ করে ফেলুন। কিছুদিন বাইরের দুনিয়ার আওয়াজ থেকে দূরে থাকি।”
আরশীন প্রথমে একটু অবাক হলেও চুপচাপ তাই করেছিল। আদিয়াত নিজেও ফোন অফ করে দিয়েছিল। কাউকে কিছু স্পষ্ট বলেনি। শুধু মায়ের কাছে একটু আভাস দিয়ে বলেছিল,
— “একটা কাজে আরশীনকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি, ফিরে কথা বলব।”
বেশি বলা উচিত মনে করেনি। কারণ জানত, বললেই প্রশ্ন আসবে, চিন্তা হবে। আর আদিয়াত তখন নিজেকে এইসব ব্যাখ্যার বাইরে রাখতে চাইছিল। এই বেরিয়ে পড়াটা যেন এক রকম মুক্তির আর্তি ছিল, এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ। এবার, প্রথমবারের মতো, সে নিজের জন্য কিছু করছিল!
গাড়ি একে একে মেঘনা পেরিয়ে সড়কে উঠে এলো। শুরু হলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার সফর, গন্তব্য চট্টগ্রাম। প্রথম কিছু মাইল দুজনেই চুপচাপ ছিল। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা, পেছনে ফেলে আসা চরের নরম বাতাসের কথা মনে করা; এসব নিয়েই ভাবনায় ডুবে ছিল ওরা। পথে একবার কুমিল্লার কাছে এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় বিরতি নিল তারা। হালকা একটু খাওয়া-দাওয়া করে আবার গাড়ি ছুটল। রাস্তায় মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে পড়ছিল আরশীন। আদিয়াত মৃদু গলায় বলল,
— “ঘুমিয়ে পড়ুন।”
— “হুমমম।” আরশীন মাথা গুঁজে দিল সিটে। অচিরেই হারিয়ে গেল ঘুমে। ওরা ছুটছিল দক্ষিণের দিকে। পাহাড় আর সমুদ্রের শহর চট্টগ্রামের দিকে; একটা নতুন প্রান্তের খোঁজে, একটুখানি নিঃশ্বাসের আশায়।
.
চট্টগ্রামে পা রাখতেই বাতাসের গায়ে লবণাক্ততার গন্ধ। গাড়ি যখন শহরের দিকে ঢুকল, তখন বিকেলের আলো পড়ছিল পাহাড়ের কোলে। আদিয়াত জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। শহরের ব্যস্ত কেন্দ্র এড়িয়ে, সমুদ্রের কাছাকাছি এক হোটেল বুক করল। হোটেলটি পাথরঘাটা থেকে কিছুটা দূরে, কর্ণফুলীর মিঠা পানির ঢেউ আর গভীর সমুদ্রের মিশ্র হাওয়া লাগে যেখানে।
হোটেলটা খুব জাঁকজমক নয় তবে পরিষ্কার, নিঃশব্দ আর সমুদ্রের গর্জন মৃদু মৃদু শোনা যায়। একতলা ওপরে, সামনের দিকের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায় এমন ঘরটাই পছন্দ করল আদিয়াত। আরশীন রুমে ঢুকে প্রথমেই জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। সূর্য তখনো পুরোপুরি ডুবে যায়নি, লালচে আভা ছড়িয়ে রেখেছে পানির গায়ে। ঢেউগুলো যেন নরম করে ডাকছিল, “এসো, কিছু না ভেবে কেবল তাকিয়ে থাকো…”
আদিয়াত পাশে এসে দাঁড়াল। বলল,
— “এখানে একরাত থাকব। ব্যস্ততার বাইরে, খানিকটা দূরে।”
আরশীন বলল,
— “এখানকার বাতাসেও যেন শান্তি মিশে আছে। মনে হচ্ছে, এই শহরটা কেবল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।”
— “নেটওয়ার্ক থেকে দূরে থাকুন কিছুদিন। কারো সাথে যোগাযোগ করার দরকার নেই।”
— “কিছুদিন কেনো? আপনি না বললেন, আমরা একরাত এখানে আছি। তারমানে আগামীকাল তো ফিরে যাচ্ছি।”
আদিয়াত হাসল,
— “বাড়ি ফিরছি না এত তাড়াতাড়ি। কুয়াকাটা যাবো।” ওর কথা শুনে আরশীন এত অবাক হলো যা বলার মত নয়। ওর বিস্ময় যেন সমুদ্রের হঠাৎ উথাল ঢেউ, নিরবতার ভেতর আচমকা এক তীব্র জাগরণ। তার চোখে জোয়ারের মত বিস্তার, বিস্ময়ে টইটুম্বুর।
হোটেল থেকে বেরিয়ে দুজনে হাঁটতে শুরু করল পতেঙ্গা সমুদ্রতটে। পায়ে হালকা বালু, কানে ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দ, আরশীনের চুলে উড়ন্ত হাওয়ার ছোঁয়া। তারপর ওরা গেল নেভাল রোডের দিকে, সেখানে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে কাচ্চি আর চট্টগ্রামের বিখ্যাত কালাভুনা খেলো। সাথে ছিল নরম রুটি আর ঠাণ্ডা লেবুজল। আরশীন বলল,
— “এটা আমার ভীষণ পছন্দ!”
আদিয়াত হাসল, অনেক দিনের পুরোনো কোনো গল্প মনে পড়েছে।
— “শুধু এটা খাব বলেই কলেজে থাকতে একবার হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রাম চলে এসেছিলাম। কেউ জানতও না।”
— “সিরিয়াসলি?”
— “হ্যাঁ, কোনো আয়োজন ছাড়া একাই রওনা দিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল এই কালাভুনটা না খেলে জীবনটাই বৃথা।”
— “আরেব্বাস!”
আদিয়াত হেসে বলল,
— “চট্টগ্রামের শুধু পাহাড়-সমুদ্র না, রান্নাতেও শ্রেষ্ঠত্বের একটা আলাদা ভাষা আছে।”
.
বাড়ির ভেতরে একটা চাপা উদ্বেগের বাতাস বইছে। জহিরুল ইসলাম বসার ঘরে চুপচাপ পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে ছিলেন, কিন্তু চোখ পড়ছিল না কিছুতেই। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল ফোনের দিকে। আদিয়াত হঠাৎ করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে আরশীন সাথে। ফোন বন্ধ। কোথায় গেছে? কতদিন থাকবে? কোনো কিছু না বলে যাওয়া আদিয়াতের স্বভাবে নয়, কিন্তু আবার এমন সিদ্ধান্তও সে হুট করে নিয়ে ফেলে। সে আরশীনকে নিয়ে গেছে, তাই নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু গেল কোথায়?
নাজনীন জানেন না। আদিয়াত খোলাসা করে কিছু বলে নাই। তিনিও জানেন, ছেলের পরিকল্পনা সহজে কেউ বোঝে না। ওর সিদ্ধান্তগুলো সবসময় একধরনের নীরব অভিপ্রায়ে বাঁধা; কোনোটা রাগ, কোনোটা ক্লান্তি, কোনোটা হয়তো নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।
জহিরুল ইসলাম স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “ইদানিং অফিসে যা পরিস্থিতি, তাতে মাথার ভেতর নিশ্চয়ই কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কী ভাবছে, তা সে কাউকেই বোঝতে দিচ্ছে না। ওর কিছু কিছু বিষয় মাঝেমধ্যে চিন্তার চেয়েও বড় চিন্তার জন্ম দেয়।”
বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে অনুপস্থিতি, আর তার অস্পষ্টতা পুরো বাড়িকে মোড়া রাখে এক অজানা প্রশ্নচিহ্নে।
—
রাত নেমেছে চুপিচুপি। সমুদ্রের গর্জন যেন দূর থেকে কেবলই ছুঁয়ে যায় জানালার কাঁচ। রুমের নরম আলো, নিস্তব্ধতা… সেই নিস্তব্ধতার মাঝে আরশীন চুপচাপ বসে আদিয়াতকে দেখছিল। সে টেবিলের ওপাশে বসে ল্যাপটপে কী যেন দেখছিল, হয়তো কাজে কিছু নোট নিচ্ছিল। এই মানুষটার ভেতর-বাহির মিলিয়ে একরকম প্রশান্তি আছে, যা কিছুটা আগুনের মতো আবার কিছুটা জলও। আরশীন খেয়ালই করেনি, সে কতক্ষণ ধরে আদিয়াতকে দেখছে। চোখের চাহনিটা হয়ে উঠেছিল গভীর, তন্ময়। ঠিক তখনই আদিয়াত হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল।
— “কি ব্যাপার, এত মন দিয়ে দেখছেন?” তার চোখে ছিল কৌতূহল।
আরশীন যেন চমকে উঠল ধরা পড়ে, চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
— “ক… কিছু না। এমনি…। আপনি কাজ করছিলেন তাই দেখছিলাম।”
আদিয়াত মৃদু হেসে বলল,
— “কাজ তো আমার ল্যাপটপে, কিন্তু দৃষ্টিটা তো আপনার দিকেই ছিল। মুখেই কি সব উত্তর লেখা?”
— “আপনার কি রূপ বেয়ে বেয়ে পড়ছে নাকি? যে আমি তাকিয়ে থাকব?”
আদিয়াত হেসে বলল,
— “তা না হলে এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিলেন? রূপ বেড়েছে বলেই হয়তো দেখছিলেন, আর এখন অস্বীকার করছেন। সমস্যা নাই, আমি কিছু মনে করি না। সুন্দর মানুষদের দিকে তো সকলে একটু তাকিয়েই দেখে, স্বাভাবিক! আমি এক কাজ করি, এইদিকে ফিরে বসি। আপনি দেখতে থাকুন ভালো করে। আলোও জ্বালাব? যাতে স্পষ্ট দেখা যায়। অন্ধকারে কি-ই বা দেখছেন বলুন তো? রূপ তো আলোয় বেশি ঝলমল করে।”
আরশীন লজ্জা পেয়ে বলল,
— “ইশশশ, চুপ করুন তো।”
— “বলুন, আলো জ্বালাবো?”
আরশীন ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
— “আলোর দরকার নেই। কারো রূপের অহংকারের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।”
আদিয়াত হালকা হাসিতে বলে উঠল,
— “আচ্ছা, স্বীকার করলেন তবে?”
আরশীন একটু চোখ কুঁচকে তাকায়, তারপর একদম রাগী সুরে ফোঁস করে উঠে দাঁড়ায়,
— “আপনার এত কথার জবাব নেই আমার কাছে।” সে ঘুরে যাওয়ার উপক্রম করতেই আদিয়াত ওর হাত টেনে ধরল।
— “বসুন।”
শব্দটা ছোট হলেও এতখানি মায়া আর দৃঢ়তায় ভরা ছিল যে, আরশীন আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। হাতটা ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে বসে পড়ল ও আদিয়াতের পাশে।
আরশীন বুঝতে পারছে, ধীরে ধীরে আদিয়াতের প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতা কোন অসহায় আবেগ নয় বরং এক ধরণের আত্মসমর্পণ। আদিয়াতের কথার ভেতর যে মমতা থাকে, তার দৃষ্টির গভীরে যে আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায়, আরশীন যেন তাতেই একটু একটু করে গলে যায়। সে মাঝে মাঝে ভাবতে চায়, এতটা নরম হয়ে পড়া কি ঠিক? এত অনুভবে জড়িয়ে পড়া কি নিরাপদ? কিন্তু তবুও… আদিয়াতের আদরমাখা কণ্ঠ যখন তার কানে বাজে, তখন সমস্ত যুক্তি হারিয়ে যায়। সে আর রাগ রাখতে পারে না, অভিমান জমে না।
এ যেন এক ভালোবাসার জাদু, যেখানে চাইলেই আরশীন ছাড়তে পারে না।
— “কিছু বলুন তো। ভালো লাগছে না। গল্প জানেন না? শোনান।”
— “রাজা-রাণীর গল্প শুনবেন?”
— “আচ্ছা শোনান তবে….”
আরশীন বলতে শুরু করে,
— “এক ছিল রাজা। রাজার জীবনটা ছিল খুব গোছানো, নিয়মে বাঁধা। সকাল থেকে রাত, সবকিছুই ছিল নির্দিষ্ট ছকে। একদিন হঠাৎ করে সেই রাজার জীবনে এক রানীর আগমন ঘটে। না, কোনো রাজকীয় মিছিল বা ধুমধাম নয়। একদম সাধারণভাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত কিন্তু অদ্ভুতভাবে হৃদয়ছোঁয়া। প্রথমে দুজনেই নিজের নিজের জগতে ব্যস্ত থাকে। রাজা রাজ্য শাসনে, দায়িত্বে। রানী তার নিরব উপস্থিতিতে ধীরে ধীরে এক আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু রানীর মনে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জন্ম নেয়। সে বুঝতে পারে, সে রাজার চোখে চোখ রাখলে আর চোখ সরাতে পারে না… হয়তো ভালোবাসা। হয়তো নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছে সে সেই রাজার কঠিন অথচ কোমল জগতে।”
— “তাহলে কি রাজা জানে না, যে রানী তাকে ভালোবেসে ফেলেছে?”
আদিয়াত হঠাৎ বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
— “রাজা বুঝতে পারে হয়ত তবুও চুপ থাকে। ওর ভাবনারা বড় গভীর, জলের নিচে চলা ঢেউয়ের মতো।” আরশীন হেসে জবাব দিল।
— “রানী কি অপেক্ষা করে যায়?”
— “হ্যাঁ… শত সহস্র জনম, শুধু তাকিয়ে থাকে। তবে না দাবি করে, না অভিযোগ তোলে। ভালোবাসা কি আদায় করার কিছু?”
সেই মুহূর্তে বাতাস থেমে যায় যেন। আরশীন চুপ করে যায়। আদিয়াত তাকিয়ে থাকে তার দিকে, অনেকক্ষণ ধরে। কথা হয় না আর কিন্তু তবুও যেন অনেক কিছু বলা হয়ে যায়।
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৭]
~আফিয়া আফরিন
(মুখোমুখি)
পরদিন সকাল… আলোটা জানালার ফাঁক গলে হালকা নরমভাবে রুমে এসে পড়ছে। আরশীন ধীরে ধীরে চোখ মেলে, পাশে তাকিয়ে দেখে আদিয়াত জেগেছে। আরশীন আস্তে উঠে জানালার পর্দা টেনে দেয়, যেন এই শান্তি একটুখানি দীর্ঘ হয়। আদিয়াত চোখ তুলে তাকায়। বলে,
— “আজ বারোটায় এখান থেকে চেকইন করব। এরপর যাব পাহাড়ে। সেখান থেকে ডিরেক্ট কুয়াকাটা।”
— “পাহাড়?”
— “নিয়ামতী পাহাড়, বা ফয়’স লেকের দিকে যেতে পারি। কিংবা বাটালি হিল। শহরের ভেতরেই পাহাড় ছুঁয়ে দেখা যায়।”
আরশীন বেশ উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল,
— “আমার তো এখন মনে হচ্ছে, আমি স্রেফ একটা ট্রাভেল সিরিজে কাস্ট হয়ে গেছি।”
আদিয়াত মুচকি হাসল। আরশীনকে দ্রুত রেডি হতে বলল। সকালের নাস্তা কোনোরকমে মুখে দিয়ে রওনা হলো পাহাড়ের দিকে।
পাহাড়ে পৌঁছেই সময়টা অন্যরকম হয়ে গেল। ওপরে উঠতেই হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে আদর করে ছুঁয়ে দিল আরশীনের মুখ। মাথার উপর রোদ, মেঘের দল খেলছে লুকোচুরি। সামনে পুরো চট্টগ্রাম শহর যেন হাতের তালুর মাঝে। জাহাজ, সমুদ্র, গলি, পথঘাট সবই দূর থেকে একরকম অদ্ভুত সুন্দর লাগে। আরশীন ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গেল পাহাড়ের কিনারে। চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছনে দাঁড়ানো আদিয়াত একটা মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
— “চুপ করে আছেন যে, মন খারাপ?”
— “না।” আরশীন ধীরে বলল, “মন ভালো… খুব ভালো। এত উঁচু থেকে তাকালে সব চিন্তা ছোট লাগে।”
পাহাড় থেকে নামার সময় বিকেলটা যেন ধীরে ধীরে গা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সূর্যটা একপাশে ঢলে পড়েছে, আলোটা নরম, সোনালি। ওরা হাত ধরে হেঁটে চলেছে সরু পাহাড়ি পথ ধরে। কেউ কিছু বলছে না, তবু হাজারটা কথা যেন আদান-প্রদান হচ্ছে চোখে চোখে, নিঃশ্বাসে। আরশীনের মনে হচ্ছিল, ও যেন কোনো সিনেমার দৃশ্যের ভেতর হাঁটছে। আশেপাশে সব শান্ত, শুধু দূর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক, আর পাতার মৃদু শব্দ। আদিয়াত মাঝে মাঝে তাকায় ওর দিকে, আড়ালে আবডালে খেয়াল রাখে।
চারপাশে হালকা কুয়াশা, বাতাসে হিম। পাহাড় নিচে নেমে গেছে ঢালু হয়ে, আর উপরে নীলচে আকাশের পটভূমিতে মেঘেরা ধীরে ভাসছে।
আরশীন হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে পাশ ফিরে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এত সুন্দর জায়গা। আচ্ছা, আপনার ভ্রমণের সঙ্গী হঠাৎ করে আমাকে করতে ইচ্ছে করল কেন? জীবনসঙ্গী না হয় ভুল করে হয়েছি। তবে আপনি ভ্রমণসঙ্গী ইচ্ছেকৃত করলেন কেন?”
আদিয়াত একটু থেমে, দূরে পাহাড়ের রেখার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলল,
— “ভ্রমণসঙ্গী হুট করে কেউ হয় না। এই রাস্তা ধরে হাঁটার সময়, পাশে যেন এমন একজন থাকুক, যার সাথে চুপ করেও কথা বলা যায়, আর হাসলেও মন ভরে যায়। আপনি ঠিক সেরকমই।”
— “প্রথম প্রথম তো সহ্যই করতে পারতেন না।”
— “তখন ব্যাপারটাই এমন ছিল। তবে সহ্য করতে পারতাম না এটা বলা ভুল। আপনার কিছু বিষয় আড়ালে ছিল।”
— “এখন সব জানেন বলেই আমাকে সঙ্গি করলেন?” আরশীন ভুরু কুঁচকাল।
আদিয়াত হেসে বলল,
— “না। আপনার দিক থেকে পাশে থাকার মত অনুভবের সারা পেয়েছি বলেই সঙ্গি করেছি।”
— “তবে তো আমি ভাগ্যবতী।”
— “কেনো?”
— “এইযে আপনি আমাকে… আমার অনুভবকে বুঝলেন।”
— “আমি বুঝেছি বলেই আপনি ভাগ্যবতী? কারো বোঝা না বোঝা কি ভাগ্যের উপর নির্ভর করে?”
— “অনেক ক্ষেত্রে করে।”
— “সেটা কোন ক্ষেত্রে?”
আরশীন ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— “আপনাকে এতকিছু এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি না।”
— “আশ্চর্য! রেগে গেলেন কেন?”
আরশীনের মুখ গম্ভীর, ঠোঁট চেপে ধরা। হাতের ওয়ান টাইম চায়ের কাপটা ও তর্জনী-অঙ্গুলির মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে ছিল। পরমূহূর্তেই রাগে ফুসে উঠে সেই কাপটা আদিয়াতের দিকে ছুঁড়ে মারল। সোজা গিয়ে লাগল ওর সাদা শার্টে। এক কোণে ছড়িয়ে পড়ল গাঢ় বাদামি দাগ। আদিয়াত থমকে দাঁড়াল, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
আরশীন আর একটাও কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়ল। দরজাটা “ঠাস” করে বন্ধ করে দিল, যেন সেই শব্দের মধ্যেই ওর সমস্ত অভিমান আটকে আছে। গাড়ির ভেতরে বসে আরশীন জানালার দিকে মুখ ফেরালো।
আদিয়াত ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলে পাশে এসে দাঁড়াল। গায়ে লাগা চায়ের দাগটা শুকিয়ে গাঢ় হয়ে উঠেছে। শার্টটা নিজের হাতেই একটু টেনে নিচে তাকিয়ে বলল,
— “এটা কি করলেন আপনি?”
আরশীন চোখ সরিয়ে নিল জানালা থেকে, মুখে স্পষ্ট রাগ আর অভিমান। ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দিল,
— “বেশ করেছি। আবার এমন কিছু বললে, চা এনে আপনাকে গোসল করাব।”
আদিয়াত একটু হেসে ফেলল। দুষ্টামির স্বরে বলল,
— “বাহ, রাগের ভাষাও এত কাব্যময় হতে পারে জানতাম না। তবে আপনাকে এত রাগ করতে দেখে ভালোই লাগছে।”
আরশীন মুখ গম্ভীর রেখেই গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। আদিয়াত আর একটুও রাগ করল না। শুধু দরজাটা খুলে ওর পাশে বসে বলল,
— “আপনার রাগটা সত্যিই খুব সুন্দর!”
কথাটা শেষ হতে না হতেই আরশীন চট করে ওর দিকে কটমট করে তাকাল। চোখদুটো ক্ষীপ্ত, যেন সেই চোখ দিয়েই আগুন ছুঁড়ে মারবে আদিয়াতের দিকে। ঠোঁট আঁটসাঁট করে বলল,
— “সুন্দর? রাগ কখনো সুন্দর হয় নাকি?”
— “হ্যাঁ, খুব সাবলীল।”
আরশীন মুখটা ওইরকম গম্ভীর করেই রাখল। পথিমধ্যে একটুও হাসল না। আদিয়াত আগে বলবে না, ওর রাগটা বেশি সুন্দর? তাহলে তো সারা সময়টা রেগে রেগেই কাটিয়ে দিত। আয়নায় একবার দেখতে হবে, রাগলে তাকে ঠিক কেমন দেখায়! আগে সবাই বলত, হাসলে তোকে সুন্দর দেখায়। আর এখন? আদিয়াতের আবার তার চৈত্রের খড়ার মত রাগটা পছন্দ হলো কেনো?
চট্টগ্রামের পাহাড় ঘেরা সকাল পেছনে ফেলে ওরা রওনা দিল কুয়াকাটার পথে। আদিয়াতের পরিকল্পনায় ছিল একটানা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছানো। ভ্রমণের রোমাঞ্চটুকু ছাপিয়ে এবার সে অন্য একটা জিনিস আবিষ্কার করতে চাচ্ছে।
প্রথমদিকে আরশীন মুখটা বাংলার পাঁচের মত বানিয়ে রাখলেও পরে বেশ হাসিমুখে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। আলিয়ার ঘুরোপথে রওনা হয়েছিল। আশেপাশের আরোও সুন্দর সুন্দর জায়গা পরিদর্শন করল। ওর মাথায় কী ঘোরার নেশা চেপেছে। সারারাত ড্রাইভ করল, কোনো ক্লান্তি নাই। অথচ আরশীন বসে থেকে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছিল। তাই কোনো একটা সুন্দর জায়গা দেখলেই নেমে যাচ্ছে। পাহাড়, নদী, খাল, সেতু, প্রকৃতি যেন রাস্তার দুই পাশে গল্প সাজিয়ে রেখেছিল ওদের জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল ডুবে গেল সন্ধ্যায়। তখনই তারা কুয়াকাটার কাছাকাছি। সাগরের হালকা হাওয়া এসে মুখ ছুঁয়ে যেতে লাগল। রাস্তার পাশে ঝাউবন, মাঝে মাঝে নারকেল গাছের সারি আর দূরে বালুরাশির আভাস।
সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ আজকে হলো না। এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। আরশীনের জন্য একেরপর এক চমক অপেক্ষা করছিল। প্রথমত, আদিয়াতকে আবিষ্কার করল এক ভিন্ন মূর্তিতে। দ্বিতীয়ত, এই স্বপ্নের পৃথিবীতে স্বপ্নের মত কাটানো দিনগুলো। যাবতীয় জীবনের দুঃখগুলো এক নিমিষেই দূর হয়ে গেল। মনেই নাই জীবনে কীসের না পাওয়া আছে, কীসের দুঃখ আছে, কীসের পরাজয়, কীসের ভুল-ত্রুটি, কীসের হিসেব-নিকেশ; সমস্ত একপাশে রেখে আচ্ছন্নতা তাকে আবির্ভুত করে রেখেছে। তৃতীয়ত, আদিয়াত আগে থেকেই সবকিছু ঠিক করে রেখেছিল। এক সাগর-সংলগ্ন রিসোর্ট বুক করে রেখেছিল। একদম নিরিবিলি, জানালা খুললেই সমুদ্র দেখা যায়। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যাবে এমনভাবে বেছে নিয়েছিল রুমটা। আরশীন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এটা কীভাবে করলেন আপনি?”
— “অনলাইনে।”
— “আপনার তো ফোন অফ ছিল।” আরশীন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল।
— “ল্যাপটপে করেছি।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল সে।
সেদিনের সন্ধ্যা রিসোর্টের ঘরটা যেন একটু বেশি নিঃস্তব্ধ লাগছিল। চারদিকে বাতাসের শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আদিয়াত বেরিয়ে গেছে। বলেছিল, একটু দূরেই এক বন্ধুর বাসা।অনেকদিন নাকি দেখা হয় না তাই দেখা করে আসবে।
আরশীন একা ঘরে বসে রইল। জানালার পাশে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখছিল ঠিকই, কিন্তু মনটা কিছুতেই ভরছিল না। একা থাকা যে এমন বিষণ্ন লাগতে পারে, সেটা এই প্রথম টের পেল। আদিয়াত ওকে নিয়ে গেলেই পারত। তবে আরশীন জোর করে নাই। কারণ এত জায়গায় যখন নিয়ে এসেছে, তবে সেখানে নিয়ে যাওয়ার মত নয় বলেই হয়তো নিল না। সে কোনো অভিযোগ করল না। ভরসা করে এসেছে, ভরসার সীমা টানার মতো মনের জায়গাটাও নেই আর। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে, আরশীন অপেক্ষা করল। নীরবে, স্থিরে, নিঃশব্দে…
.
আদিয়াত আরশীনকে সত্যি কথা পুরোটা বলেনি। এখানে তার এক বন্ধু থাকে সেটা ঠিক। কিন্তু সে যে কেবল বন্ধুই না, একজন পুলিশ অফিসার, সেটা বলা হয়নি। তার সাহায্যে অফিসের আর্থিক লেনদেন, অনলাইন ট্র্যাকিং এবং ই-মেইল ও মেসেজের নজরদারি শুরু করেছে গতকাল। হঠাৎ করেই আদিয়াতের একজনের উপর সন্দেহ হলো, একদম হঠাৎ। সে সাবধানে পুরনো বিল, অডিট রিপোর্ট, পেমেন্ট রেজিস্টার খতিয়ে দেখে। লক্ষ্য করে কিছু ইনভয়েস এমন কিছু কোম্পানির নামে করা যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব ইনভয়েসে সই করা হয়েছে এমন কিছু নাম ব্যবহার করে যেগুলো অফিসের বাস্তব কর্মীর সঙ্গে মেলে না।
ঠিক তখনই বন্ধু রাফিদ সাহায্যে এগিয়ে আসে। রাফিদ বলে,
— “দেখ, এগুলো স্রেফ সন্দেহ নয়। এগুলোর ডকুমেন্টাল প্রুফ দরকার। তুই শুধু একটু সময় দে। আমি নোটিস ছাড়াই জিনিসগুলো স্ক্যান করে নেব।”
ওরা দু’জন মিলে পুরনো ই-মেইল চেক করে। লগ ফাইল থেকে বের করে কে কখন কোন সার্ভারে ঢুকেছে। সকালবেলাই রাফিদ আর আদিয়াত মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার একটা লোভনীয় ফাঁদ পাতা হবে।
একটি ভুয়া চুক্তি প্রস্তুত করে, যেখানে একটা অদ্ভুত বড় অ্যামাউন্ট একটা ক্লায়েন্টের মাধ্যমে রিলিজ দেওয়া হবে। চুক্তিটি রাখা হয় এমন জায়গায়, যেখানে শুধুমাত্র আদিয়াতের সন্দেহাতীতের কেউ যেতে পারে। ফাইলের মধ্যে থাকে নকল অ্যাকাউন্ট নম্বর, যার ট্র্যাক রাখা হয়। রাফিদ আগে থেকেই সেই অ্যাকাউন্টে নজর রাখে। দেখা যায়, চুক্তি ফাঁস হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি ছোট অংশ ট্রান্সফার হয় একটা ভুয়া কোম্পানির অ্যাকাউন্টে। এবং সেখানেই ধরা পড়ে, ট্রান্সফার অ্যাপ্রুভ করেছেন আমিনুল। অফিস কম্পিউটার থেকেই করা হয়েছে। পাসওয়ার্ড ছিল একমাত্র আমিনুলের কাছে। রাফিদ অবাক হয়ে বলল,
— “ভাই, এটা তো তোর চাচা!”
আদিয়াত চুপ করে গেল। একটা মুহূর্তে যেন সময় থেমে দাঁড়াল। রাফিদের কণ্ঠে বিস্ময়ের পাশাপাশি দুশ্চিন্তার ছায়া। কারণ সে জানত, আত্মীয়তা থাকলে এই লেভেলের দুর্নীতি ফাঁস করাটা শুধু অফিসিয়াল না, ব্যক্তিগত সম্পর্কের খোলস ছিঁড়ে দেওয়ার মত ব্যাপার।
— “অবাক হলাম না খুব একটা, ধারণা করেছিলাম।” আদিয়াত বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল।
— “ধারণা করেছিলি কীভাবে?”
— “অনুভব করেছিলাম, ধরা পড়ার আগেই। চাচার ব্যবহার একেক সময়ে একেকরকম হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখনই অফিসের বড় কোনো প্রজেক্টে আমার হাত পড়েছে, তখনই যেন অদৃশ্য একটা চাপ চলে আসত। ব্যাকডেটেড ইনভয়েস, ফাঁকা অথরাইজেশন লেটার আর সব সময় আমাকে ব্যস্ত রাখতে চাওয়ার প্রবণতা। শুরুতে ভাবতাম, হয়তো আমার উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস করেন। পরে বুঝলাম, এটা আসলে আমাকে সরিয়ে রাখার কৌশল।” আদিয়াত এক মুহূর্ত থামল।
— “কিন্তু রক্তের সম্পর্ক দিয়ে যদি সত্যি চাপা পড়ে, তাহলে তো আমাদের মধ্যে সত্যের মূল্যই থাকবে না।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। আদিয়াত কপালে হাত চাপিয়ে বলল,
— “এহে! ভাই, অনেক দেরি করে ফেললাম রে। এখনই বের হতে হবে।” তারপর রাফিদের দিকে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
— “তুই আপাতত এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলিস না। কেমন? আমি সব বুঝেশুনে, ঠিক সময়ে বলব।”
রাফিদ মুচকি হেসে বলল,
— “ওকে ভাই, যা তাহলে। তবে একটা কথা মনে রাখ, আগামীকাল ভাবির সাথে ঠিকঠাক পরিচয় করিয়ে দিবি কিন্তু। এইভাবে পালিয়ে বউ নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে আর চলবে না শালা। বিয়ের দাওয়াত পর্যন্ত পেলাম না।”
— “দাওয়াত আমি নিজেই পাই নাই ভাই। কাগজে কলমে যা হইছে, সেটাকেই বিয়ে বললে এখনো একটু খটকা লাগে। তবে দেখা করাব।”
রাফিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
— “আবার প্রেমিক বরের মত বলছিস… যা, যা এখন। ভাবিকে একা ফেলে রাখলে কিন্তু কাল দেখা হলে আমার কথাই আগে শুনবি।” আদিয়াত বেরিয়ে পড়ল। চারপাশে তখন নিস্তব্ধতা নেমেছে, শুধু সাগরের গর্জন যেন তার ভেতরের অস্থিরতা গিলে ফেলছে নিঃশব্দে। গভীর রাত, ভিজে হাওয়া, আর নোনা গন্ধ মিশে ছিল তার চিন্তার ভাঁজে। নিজেকে মুক্ত করতেই যেন বেরিয়ে পড়া। যতটা না আরশীনের কাছে গোপন কিছু ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল নিজের ভেতরের ভার ঝেড়ে ফেলার আকাঙ্ক্ষা। অন্তত নিজের কাছে তার অবস্থান আজ পরিষ্কার। এতদিন চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আজ সে ছেড়ে দিয়েছে এই খোলা সাগরের পাড়ে, অনেকটা নিঃশব্দে অথচ গভীর শ্বাসে। রাতে যখন রিসোর্টে ফিরল, তখন রুম জুড়ে একটা প্রশান্ত নিস্তব্ধতা। আলোর তীব্রতা কমানো, যেন কেউ ইচ্ছে করেই নিভিয়ে রেখেছে।
দৃষ্টি পড়ল সোফার কোণে, আরশীন ঘুমিয়ে আছে কাত হয়ে। ক্লান্ত মুখটা একদিকে হেলে পড়েছে, হাতে এখনো ফোন ধরা। হয়ত শেষবারের মত অপেক্ষায় ছিল একটা কল বা দরজার শব্দে জেগে উঠবে বলে। আদিয়াত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নিজের মনে বলল,
— “গল্পের রাণীর মত ভালোই অপেক্ষা করতে শিখেছেন আপনি।” আরশীন যেভাবে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, দেখে মনেই হচ্ছিল না যে ঘুমটা খুব আরামদায়ক। মাথাটা সামান্য হেলে গেছে, গলার কাছে এলোমেলো চুল এসে পড়েছে, আর এক হাত পড়ে আছে বালিশের খোঁজে যেন। এতক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকলে নিশ্চয়ই ঘাড়ে ব্যথা উঠবে, মাথাও ধরবে। আদিয়াত আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। একটু ঝুঁকে তার মুখটা দেখল। শান্ত, কোমল, অদ্ভুত এক নির্ভরতার ছায়া যেন ছড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ সেই মুখে। ওর ভেতর হঠাৎ একটা চাওয়া জাগে, সে তো চাইলেই মেয়েটাকে একটু আরামে রাখতে পারে, একটু যত্ন করতে পারে। দুই হাত বাড়িয়ে ওকে কোলে তুলতে গিয়েই ওর হাতের হালকা টান টের পেল। আরশীন ঘুমের ঘোরেই যেন বুঝে গিয়েছিল কার স্পর্শ, কার উপস্থিতি। সে নিজের অবচেতন মনে দিয়ে আদিয়াতের হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
— “চলে এসেছেন? এতক্ষণ অপেক্ষা করায় কেউ? আপনি না খুব নিষ্ঠুর!”
আদিয়াত উত্তর দিল না, শুধু একটু ম্লান হেসে ওর কপালে চুল সরিয়ে রাখল। আরশীন ওইভাবে ফের বলল,
— “একলা একলা যখন ঘুরবেন তো আমাকে নিয়ে এলেন কেনো? আপনি একটুও বুঝলেন না।”
আদিয়াত থমকে গেল। চোখ রাখল ওর মুখে। নিঃশ্বাসের মাঝে কেমন একটা অভিমান মিশে আছে। তার বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠল। মনে মনে বলল,
— “কখনো তো বোঝানোর চেষ্টা করেন নাই…”
চাইলেই কি সব বোঝা যায়? কেউ যদি নিজের বুকের ভিতরটুকু আগলে রাখে, কোনো জানালাও না খোলে। তাহলে কি বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে তার ভিতরের দুঃখ, ভালোবাসা, দ্বিধা?
আদিয়াত এক হাত রাখল আরশীনের মাথায়। চুলে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “ভুল বললাম আমি। বোঝানোর চেষ্টা তো করেছিলেন… রাজা-রানীর গল্প বলে।”
আরশীন একটু কাত হয়ে আদিয়াতের বুকের দিকে মুখ রাখল, যেন এতক্ষণ অপেক্ষার ক্লান্তি মুছে দিল এক নিমেষে। আদিয়াত কিছু না বলে ওর কাঁধে একপাশে হাত রাখল। চুপচাপ, নিঃশব্দে বসল। ঘরজোড়া হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে, সমুদ্রের গর্জন দূরে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে।
—
সকালবেলার রোদ জানালার ফাঁক গলে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। নরম আলো আস্তে আস্তে ছুঁয়ে দিচ্ছে চারপাশ, আর সেই আলোতে হালকা গরম এক কোমল ঘুমভাঙা ভাব। আরশীন ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল, সে বিছানায় শুয়ে আছে। এক মুহূর্ত থমকে গেল সে। তারপর মনে পড়ে গেল। স্পষ্ট মনে আছে, সে তো রাতের বেলা সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। আদিয়াত বিছানায় ঠিক তার পাশেই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখে এক প্রশান্ত নিঃশ্বাস, শত ব্যস্ততা আর ভাবনার ভার হালকা করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।
আরশীন জানে, আদিয়াত-ই তাকে তুলে নিয়ে এসেছে বিছানায়। এই ছোট্ট যত্নটা… এই নিঃশব্দ আদরটা বুকের মধ্যে এক উষ্ণ ঢেউ তুলল।
ও আড়মোড়া ভেঙে একটু উঠে বসল তারপর আবার ধপ করে বিছানায় পড়ে গেল। এক চিলতে হাওয়া এসে পর্দা দুলিয়ে গেল। ঘরের ভিতরটায় কেমন যেন একটা ভালোবাসার গন্ধ মিশে আছে।
আরশীনের বারবার উঠাবসায় বিছানা একটু দুলে উঠল। ঘুমে ডুবে থাকা আদিয়াতের চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেল। আরশীন ওর দিকে ঘুরে তাকাল। চোখে হালকা হাসি।
ঠিক তখনই আদিয়াতের দিক থেকে একটা কথা ভেসে এলো। কথাটা যেন হঠাৎ শান্ত আকাশে এক চিলতে বজ্রপাত। আশা-ভরা, ভয়-ভরা, রোমাঞ্চে মোড়ানো। সে গভীরভাবে তার চোখে চোখ রেখে বলল,
— “ভালোবাসেন?”
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন
(স্বচ্ছ আত্মদান)
আরশীনের হৃদয় কেঁপে উঠল। ভেতরে যেন ঢেউ খেলে গেল এক তীব্র আবেগের। এতদিন যা জমে ছিল, যা কখনো নাম দেওয়া হয়নি, সেই অনুভবটা হঠাৎ করেই বোধহয় একটা শব্দে নাম পেয়ে গেল। ঘরের নিস্তব্ধতা, বাইরের সাগরের মৃদু গর্জন, সকালবেলার রোদ সব মিলিয়ে মুহূর্তটা থমকে গেল। আরশীন তাকিয়ে রইল, চোখে বিস্ময়… আদিয়াতের প্রশ্নটা যেন শান্ত আকাশে হঠাৎ বজ্রপাত। সে খানিক চুপ থেকে বিস্ময় কাটিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল,
— “কাকে?”
— “আমাকে।” আদিয়াত একদম সহজ গলায় বলল, যেন বহু আগেই নিশ্চিত ছিল উত্তরের।
— “আপনাকে মানে? কী আপনাকে?” আরশীনের গলায় অবিশ্বাস।
— “আপনি ভালোবাসেন।” আদিয়াতের কণ্ঠে কোনো উঁচু-নিচু ঢেউ নেই, একটানা সোজাসাপ্টা।
আরশীন এবার একটু চোখ বড় করে তাকাল,
— “কে বলেছে আপনাকে এসব? নিজেই ভাবছেন, না কেউ শিখিয়ে দিয়েছে?”
— “ডুবে ডুবে জল খাওয়া বন্ধ করেন তো।”
আরশীন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, এটা কীভাবে হলো? আদিয়াত ওর মনের ভেতরের গোপন কথাগুলো জেনে গেল কী করে? এত সাবধানে সবকিছু আড়াল করছিল সে, নিজেকেই বোঝাচ্ছিল; এ কিছুই না, মুগ্ধতা মাত্র। তবু আদিয়াত এত নিশ্চিত ভাবে বলল,
— “ভালোবাসেন?”
মনে হলো, কেউ যেন তার বুকের এক কোণে রাখা গোপন চিঠির খামটা খুলে পড়ে ফেলেছে। আয়হায়! সব জেনে গেছে নাকি? এখন কি হবে? আরশীনের গাল হালকা লাল হয়ে উঠল। সে রাগ দেখাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিল, কারণ মনের ভেতর অকারণ একটা হাসির ঢেউ উঠছিল বারবার। ভাবল, আদিয়াতের সামনে একবার জোরে গলা তুলে বলবে, —“ভুল করেছেন।” তাও কি পারে? ওর চোখে তাকালেই মনে হয়, সে সব জেনে গেছে। কি করে জানল? এতটা বুঝে ফেলে কেন? এতটা কেউ বোঝে? আরশীন একটু হেসে ফেলল নিজের মনেই। চুপিচুপি স্বীকার করে নিল, এই মানুষটা ঠিকই পড়ে ফেলে ওর না বলা কথাগুলো। আর সেটা যে বেশ ভালোই লাগে… এটা আর লুকিয়ে কী হবে?
আরশীনের মুখে এক চিলতে হাসি ছিল ঠিকই, কিন্তু চোখের ভেতর ঝাপসা একটা ভাব এসে পড়ল হঠাৎ করেই। আদিয়াত, কখনোই সহজে ধরা দেয় না। হয়তো বোঝে, কিন্তু কিছু বলে না। আজ হঠাৎ করে এমন এক প্রশ্ন করে বসল কেন? আরশীনের বুকের ভেতরে জমে থাকা মেঘের মতো উত্তরেরা থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ ও জানে, আদিয়াতকে ভালোবাসে। তবে সে কি জানে আদিয়াতের উত্তর? সে কী চায়, কেমন জীবন কল্পনা করে, কীসের জন্য ওকে টেনে নিচ্ছে এত দূরে? যতক্ষণ না এই মানুষটার ভেতরটা সে পুরোপুরি বুঝতে পারছে, ততক্ষণ এই স্বীকারোক্তি, এই আবেগ; সবই একটা ঝুঁকি। নিজে এগিয়ে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিল, অথচ সে যদি সে হাতে কিছু না রাখে?
তাহলে? সেই ভয়টাই যেন বুক চেপে ধরল। এই যে আনন্দে ভেসে যাচ্ছিল একটু আগে, এখন মনে হচ্ছে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অন্ধকার, নিঃশব্দে ওর হাতটা টেনে ধরছে। আরশীনের চোখের কোণ সামান্য কেঁপে উঠল। হৃদয়ে জমে থাকা উষ্ণ একটা অনুভব নিমেষেই ঠান্ডা হয়ে গেল। অপমান নয়, নিজের ভালোবাসাকে নিজেই ছোট করে দেখা হবে যদি সব না জেনে নিজেকে উজাড় করে দেয়।
— “কথার জবাব দিলেন না?” আদিয়াত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।
আরশীন উঠে দাঁড়াল। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
— “কী জবাব দিব? রাতে কখন ফিরেছেন মনে আছে? উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছিলেন নাকি, যে এমন আজব কথা বলছেন?”
— “উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছি বলতে আপনি ঠিক কী বোঝালেন?”
আরশীন হেসে বলল,
— “ওই যে… যা মানুষ বন্ধুদের সাথে থাকলে খায় আর কী!”
আদিয়াত চোখ দুটো একটুখানি সংকুচিত করে বলল,
— “আরশীন! এত কথার পর আপনার এই কথা মনে হলে? বাহ, এই কয়েকদিনে বেশ ভালোই চিনেছেন আপনি আমাকে!”
আরশীন মুখ ফিরিয়ে হালকা একটা “হুঁ” শব্দ করল। ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে কোনো কথা বলল না আর। ওর মনের মধ্যে তখন পালানোর তাড়া। এতটাই তাড়া যে আদিয়াত কী বলছে না বলছে, কিছুই শোনার অবকাশ পাচ্ছে না। ভুলবশত নিজেও কি বলে ফেলেছে সেটাও তার মাথায় নেই। সবকিছু মিলিয়ে আশ্চর্যজনক এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। বের হওয়ার উপায় কি? এখন তো আদিয়াতের সামনে থেকেও সরার উপায় নেই। এখানেই থাকতে হবে তাকে, আদিয়াতের মুখোমুখি এবং চোখাচোখি! উফফ, কী যন্ত্রনা। ও আনমনে গিয়ে জানালার পর্দা মেলে দিল। ওড়নার প্রান্তদেশ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পর্দা মেলে দিয়ে থাই গ্লাস খুলতেই সমুদ্রের বাতাস এসে মনটা হালকা করে দিল। আরও খানিকক্ষণ পড়ে আদিয়াত পাশে এসে দাঁড়াল। আরশীন ইচ্ছাকৃতভাবে সরে দাঁড়াল এবং মুখাবয়ব গম্ভীর রাখল। ওহো, মনেই নাই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রাগী চেহারাটা একবার পরিদর্শন করা লাগত। ওটা কি আসলেই সুন্দর নাকি ভুয়া? আদিয়াত হঠাৎ এসে বলল,
— “এখানে কি করছেন আপনি? খাওয়া-দাওয়া করবেন না?”
আরশীন মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল,
— “ক্ষিদে নেই। আপনি যান।”
— “না খেয়ে শরীর খারাপ করলে তখন সেই দায় তো আমি নিব না।”
— “একবেলা কিংবা একদিন না খেয়ে শরীর খারাপ করার মত জমিদার আমি কখনোই ছিলাম না।”
আদিয়াত ভুরু কুঁচকে বলল,
— “তাই? তবে ঠিক আছে, পরে আবার আমাকে দোষারোপ করবেন না যে আমার কারণে আপনার না খেয়ে থাকতে হয়েছে। আমি কিন্তু যথেষ্ট সেধেছি। আপনি যান নাই সেই দায়ভার সম্পূর্ণ আপনার।” এই বলে আদিয়াত রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। সম্ভবত নিচে কোথায় গেছে। সে যাওয়ার সাথে সাথে আরশীন রাগে অদৃশ্য একটা লাথি মারল সম্মুখে। দায়ভার তাইনা? খুব দায় দেখানো হচ্ছে? এক মিনিট দায় দেখিয়ে আবার এড়িয়ে গেল? বাহ রে… অথচ বিয়ের দিন বলেছিল, আপনার সব দায়-দায়িত্ব আমার। এই তার ছিরি? পুরুষ মানুষ অভিনয়ের জন্য সেরা রেহহ!
আরশীন আয়নার সামনে গিয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়াল। পরক্ষণেই চেহারার রূপ পরিবর্তন করে রাগ নিয়ে এলো। রাগলে তার নাক, ভুরু, ঠোঁট সব কুঁচকে একখানে আসে, কপালে পরপর কয়েকটা ভাঁজ পড়ে। এটা নাকি আবার সুন্দর? হেহে, কী বলে না বলে? ওই ছেলের মাথা পুরাই গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতেই দরজায় টোকা পড়ল কারো।
.
মারুফ হচ্ছে কোম্পানির বিশ্বস্ত একজন বিশেষ করে আদিয়াতের। অফিসে তাদের সম্পর্কটা ফর্মালিটিজ-এ সীমাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে আলাদা, ঠিক বন্ধুত্বের মত। ওর ছুটি চলছিল। আজ অফিস ছিল না। মিরপুর-১০ এ এসেছিল একটা ব্যক্তিগত কাজে। হঠাৎ সেখানে চোখে পড়ল আমিনুল ইসলাম এবং রেজাউল করিমকে। তাকে অধিকাংশ মানুষ রেজা ভাই নামেই চেনে। এমন একটা ডন টাইপের লোকের সাথে আমিনুল স্যার এত রসিয়ে রসিয়ে পান খেতে খেতে কি কথা বলতে পারেন? আবার লেনদেনও হচ্ছে কীসের যেন। বিষয়টা মারুফের ভালো লাগল না। বেশ কয়েকমাস আগে এই রেজা ভাইয়ের সাথে জহির স্যারের বেশ ঝামেলা হয়েছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে। একপর্যায়ে রেজা বলেছিল,
— “আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? দেখে নিব আমি আপনাকে, দেখে নিব সবাইকে। বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি কেমন হয়, হারেহারে বুঝবেন।”
তার সাথে কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল তারপর সে কীভাবে দেখে নিবে, তা কারোর জানা নেই। জহিরুল ইসলাম অবশ্য ঘাবড়ান নাই। তিনি ঠান্ডা এবং স্পষ্ট গলায় বলেছিলেন,
— “প্রবাদ বাক্য শুনেছ, পাগলে কিনা কয় আর ছাগলে কিনা খায়? তোমার উল্টাপাল্টা কথা দ্বারা তুমি তো প্রমাণ করেই দিলে যে তুমি পাগল। এখন এই পাগলামি করতে গিয়ে কোনো ধাক্কা খেলে তুমি হবে ছাগল। বুঝেছ? আমার সাথে ঝামেলা করলে তার ফল যে কেমন হতে পারে, তা কিন্তু তুমি বেশ ভালো করেই জানো রেজা। সবচেয়ে ভালো হবে, দূরে থাকো তবেই নিরাপদ থাকবে।”
কে যে কাকে হুমকি দিচ্ছে কে জানে? আদিয়াত তখন ঢাকা ছিল না। এটা তার বিয়ের কিছু মাস আগের ঘটনা। পরে অবশ্য শুনেছিল। বাবাকে বলেছিল, এসব ফালতু মানুষের সাথে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে।
এখন ওই ফালতু মানুষটার সাথে আমিনুল ইসলামের এত কী খাতির? মারুফ তো দূর থেকে তাদের কথাবার্তা শুনতে পেল না। কিন্তু হাসিমুখ, হাবভাব দেখে বিপদের আশঙ্কা পেল। এরা কি খারাপ কিছুর পরিকল্পনা করছে? দুই ধারালো বুদ্ধির মাথা একসাথে হলে নিশ্চয়ই কখনো ভালো কিছু হবে না। এক ধারালো বুদ্ধির মানুষ তো নিজের বুদ্ধি দিয়ে আদিয়াতের অনুপস্থিতিকে “পালিয়ে যাওয়া” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার ভাষ্যমতে,
— “কোনোকিছু না বলে চলে যাওয়ার মানে কি? যেসব টাকা-পয়সা খোয়া গেছে, সেসব নিয়ে ফূর্তি করতেছে। আমরা এত বোকা? কিছু বুঝিনা? চুল কি হাওয়ায় পাকছে? হাঁটুর বয়সী ছেলের এমন ঘটনার পর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া বুঝতে রকেট সাইন্সের প্রয়োজন হয় না।” তার কথাকে কেউ অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দেয় নাই। তাই নিজেই একসময় চুপ হয়ে গেছেন। কিন্তু সকলের মনেই প্রশ্ন, স্যার হঠাৎ গেল কোথাও? আগে তো কখনো এমন করে নাই।
.
টক… টক… টক… আরশীন ভেতর থেকে বলল,
— “কে?”
বাইরে থেকে একটা কিশোরসুলভ কণ্ঠ ভেসে এল,
— “রুম সার্ভিস ম্যাম। স্যার পাঠিয়েছেন।”
‘স্যার?’ শব্দটা শুনে আরশীন মুখ বাঁকাল। দরজার ছিটকিনি খুলে দিল ধীরে ধীরে। হাতে ট্রে সেখানে রাখা এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি, একটা ছোট চিরকুট। ছেলেটা বলল,
— “স্যার বললেন, আপনার জন্য এটা। বিশেষভাবে বানানো।” আরশীন অবাক হয়ে ট্রে-টা হাতে নিল। চোখ পড়ল চিরকুটে লেখা ছোট্ট বাক্যে,
— “নিন, আমি নাই ঝামেলাও নাই। আজ সকালের কফিতে আমার অনুপস্থিতি মিশিয়ে দিয়েছি। দারুণ লাগবে।”
আদিয়াত।
আরশীনের মুখে না চাইতেও ফুটে উঠল এক মুগ্ধ হাসি। মনেই হলো না কিছুক্ষণ আগে তার বিরক্তি ছিল, অভিমান ছিল। সব এই কফির উষ্ণতায় গলে গেল।
ভেতরে ভেতরে একটা কিছু নরম করে গলে যেতে থাকলেও মুখে তার এক চিলতে কঠিন ভাব। ঠোঁট আঁটসাঁট, চোখে একরকম জিদ।
— “ধুর, এসব ছেলেমানুষি নাটক করে কী হবে?” নিজেকেই বলল সে।
কিন্তু বুকের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠেছে ঠিকই। সেই কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্রের হালকা বাতাস চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল, কিন্তু ও কিছুতেই নিজের মুখ থেকে সেই অভিমানের পর্দা সরাতে দিল না। আদিয়াতের মুখোমুখি হতেই হবে, এটা সে জানে। চোখে চোখ পড়লেই এক মুহূর্তে সব দুর্বলতা উথলে আসবে, সেটা আগে থেকেই বোঝে সে। তাই চোয়াল শক্ত করল, মুখটাকে একটু ঘাম ঘাম করে রাখল, যেন সে বড্ড গম্ভীর… যেন সে ক্লান্ত… যেন কিছুই মনে নেই।
— “আমি এত সহজে ধরা পড়ার মেয়ে নই, মিস্টার আদিয়াত।”
নিজেকে বোঝানোর মতো একটা হাসি দিয়ে মাথা দুলিয়ে কফিতে চুমুক দিল। ঠোঁটে কফির উষ্ণতা, মনে চলমান এক অদৃশ্য খেলা; যেখানে ভালোবাসা, অভিমান আর আত্মসম্মান একই সঙ্গে টানাটানি করছে।
দুপুর নাগাদ আদিয়াতের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষে ওরা তখন সমুদ্রের চরে। চারপাশজুড়ে বিশাল এক শূন্যতা, বালি, ঢেউ, আর বাতাস। সূর্যের আলো একটু ঝিমিয়ে পড়েছে, ছায়া লম্বা হচ্ছে। আরশীন পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগোচ্ছে। আদিয়াত কিছুটা পেছনে, ওর পায়ে পায়ে হাঁটছে যেন কোনো দূরত্বই না থাকে। আর একটু এগোলেই শুরু হবে ঘন সবুজ এক বন। গাছপালার নিঃশব্দ আহ্বান কানে ফিসফিস করে,
— “এসো, আমাদের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাও।”
বনের মাথাগুলো দূর থেকে ছুঁয়ে ফেলছে আকাশের নীল, আর ঢেউয়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে পাখিদের ডাকের সাথে। বাতাসে লবণের ঘ্রাণের সাথে যোগ হয়েছে কচি পাতার গন্ধ। আদিয়াত ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল,
— “মানুষের মনটা আসলে এই সমুদ্রের মতো, জানেন? উপরে শান্ত, নিচে টান। কখন ভাটা আর কখন জোয়ার, সবাই বুঝতেও পারে না।
আর কেউ যদি সত্যিই মন বোঝে, সে তো মাঝির চেয়েও নিপুণ। কারণ ঢেউ নয়, গভীরতাই মানুষকে ডোবায়।”
— “আপনার এসব জ্ঞান শোনার জন্য আমি এখানে আসি নাই।” আরশীন শক্ত কণ্ঠে বলে।
আদিয়াত হেসে বলে,
— “রাফিদ অর্থাৎ আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাব। চলুন আপনিও, পরিচয় করিয়ে দিই।”
— “দরকার নেই। আপনি যান।”
— “সিওর?”
— “হুম।”
— “তাহলে চলুন আপনাকে রিসোর্টে পৌঁছে দিই। একা একা এখানে কি করবেন? আমার ফিরতে হয়তো একটু দেরি হতে পারে।”
আরশীনকে রিসোর্টে পোঁছে দিয়ে আদিয়াত নিজের মত বেরিয়ে পড়ল।
আরশীন মন খারাপ করল। সেই শুধু আদিয়াতকে ভালোবেসে গেছে। অথচ আদিয়াত একটুও ভালোবাসে না। ওর বোধহয় মায়াও কাজ করে না। এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়? ওর এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসার বিনিময়ে সেই সমুদ্র থেকে তাকে এক চিমটি ভালোবাসা দিলেও সে খুশি। অথচ সে ভালোবাসা নয়, জ্ঞান দিচ্ছে। জ্ঞান চাই না তো ওর। যথেষ্ট জ্ঞান আছে, জ্ঞান দেওয়ার জন্য অন্য মানুষও আছে। কিন্তু সে হচ্ছে স্বামী, তার কাছ থেকে পাবে আকাশ-বাতাস কাঁপানো, সাত-সমুদ্র উথাল পাতাল করা ভালোবাসা। তা না… শালার কপালই খারাপ। আজ সারাদিনে কতবার যে সে কপাল চাপড়েছে, তার হিসেব নেই। মনটা এখন ভীষণ অস্থির লাগছে, হাঁসফাঁস লাগছে, দমবন্ধ লাগছে। এমন মানুষ জীবনে কেন আসে যে ভালোবাসা বোঝেই না? সে তো বুঝলোই না উল্টো ইগনোর করে চলে গেল। আরশীনের রাগ হচ্ছে তবে কান্না পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে, আদিয়াতের সামনে গিয়ে ইচ্ছেমত শার্টের কলার চেপে ধরে; সে যে ভালোবাসে তা বোঝাতে। চলে গেল বন্ধুর সাথে দেখা করতে। ওকে মাত্র একবার সাধল। আর কয়েকবার সাধলে কি হতো? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? সব ধ্বংস হয়ে যেত? ওর ইগোতে লাগত? তো লাগুক! কী করবে এত ইগো দিয়ে? যত্তসব।
কয়েকবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করল। তারপর নিচে নামল। সমুদ্রের ঘ্রাণ, বাতাস, আশেপাশের প্রকৃতি কিছুই তার মন ঠিক করতে পারছে না। সামনে দিয়ে কোনো কাপল হেঁটে গেলে রাগ হচ্ছে। কেউ কারো হাত ধরলে ওর রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে, জোর করে হাতটা গিয়ে ছাড়িয়ে দিতে। আশ্চর্য, এত রাগ হচ্ছে কেন তার? অন্যকে দেখলে এত হিংসা হচ্ছে কেন? ও তো কখনোই এমন ছিল না। সব হয়েছে আদিয়াতের জন্য। না ওর জীবনটা এমন হতো, না আদিয়াতের সাথে বিয়ে হতো, না ওর সাথে দিনের পর দিন এক ঘরে থাকতে হতো আর না ওকে ভালোবেসে নিজেকে বিসর্জন দিতে হতো! আরশীন ফের ঘরে এসে বসল। ভাববে না সে আর আদিয়াতকে। ফিরে যেতে হবে… তার জীবনের অন্য একটা লক্ষ্য আছে। সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে নিয়ে এসেছে। নিজের উদ্দেশ্য বলল,
— “মাথা থেকে এসব সরিয়ে ফেল ভাই। তোর দুদিনের জীবনের সাথে আদিয়াতের জীবন জড়িয়ে ওকে বিপদের মুখে ফেলিস না। যদি সত্যিই ভালোবাসিস তবে দূরে থাক। যাতে তোর সর্বনাশা ভালোবাসার ছোঁয়া ওর না লাগে। সে মানুষটা ভীষণ ভালো। এমন ভালো মানুষের কপালে খারাপ কিছু হতে দিস না। এমনিতেই পাশে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেছে, পাশে দাঁড়িয়েছে, তোর সমস্ত দায়িত্ব, তোর বাবার খু’নের তদন্তের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে; এরপর তাকে আর ভালবাসা নামক প্যারা দেওয়ার দরকার নেই।”
আরশীনের অন্তঃস্থল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। আহারে জীবনটা, মাঝেমাঝে বড্ড মায়া হয় নিজের জন্য! কতকাল নিজেরে ভালোবাসা হয় না। নিজের জন্য যা বরাদ্দ ছিল তা আদিয়াতকে দিয়েই শেষ… তার জন্য আর কী অবশিষ্ট আছে?
.
আদিয়াতের সত্যি হাসি পাচ্ছে। আরশীন একেক সময় একেক রকম হয়ে যাচ্ছে। একবার লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে, একবার রেগে আগুন, আরেকবার অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, এড়িয়ে যাচ্ছে, শান্ত থাকতে পারছে না। মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার; না বোঝার মত এতটাও বোকা সে নয়। তবে যা শোনার তা আরশীনের মুখ থেকে শুনতে চায়। ভালোবাসার ওজন অনেক! বইতে না পারলে তা চাপিয়ে দিতে নেই। আরশীনের মনোভাব সে বুঝেছে। তবে স্বীকার করতে পারছে না কেন, এটাও আদিয়াত জানে। তাই তো ইচ্ছে করেই গা জ্বালানো কথা বলে চলে এসেছে। সমুদ্রের পাড়ে এসে বালুর উপর হাত-পা ছড়িয়ে দিয়েছে। এখানে এসে যে নতুন সিম তুলেছে, সেটাও বন্ধ করে রেখেছে। আরশীন নিশ্চয়ই খুঁজবে… আচ্ছা খুঁজুক। খুঁজে কী করবে? আদিয়াতের জানতে ইচ্ছে করল। আশ্চর্য, তার মনটাও গন্ডি মুক্ত হয়ে এমন লাগামছাড়া হয়ে গেল কেন? আক্কেল নাই একদম! রাত বাড়ছে, গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, সমুদ্রের গর্জন ফিসফিসানি সবটাই কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে।
আরশীনকে ভালোবাসাই যায়। বড্ড সহজ-সরল, প্যাচগোছ নেই একদম, পাশে থাকার খুব সুন্দর মন-মানসিকতা আছে, বোঝার মত মন আছে। এমন মানুষকে সহজে বশ করা যায় না তবে একবার বশে এলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। আদিয়াত চোখ বন্ধ করল। কী করছে ও এখন? ঘুম? মনে হয় না। গতদিনের মত আজও হয়ত অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে গেছে। আদিয়াত ফোন হাতে নিল। অন করে সরাসরি ওকে ফোন করল। আরশীন বোধহয় ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। সাথে সাথেই রিসিভ করল,
— “কোথায় আপনি? প্রতিদিন এরকম নাটক করছেন কেনো? আপনার নাটক দেখব বলে আমি এখানে এসেছি? একদম বাড়িতে ফোন করে মাকে বলে দিব। কার কথা শুনবেন বলেন তো? চিন্তা হয় না আপনার জন্য। যেখানেই যান অন্তত বলে তো যেতে হয়। ফোন অফ করে রেখেছেন কেনো? ইচ্ছে করে তাইনা? মানুষকে না জ্বালালে আপনার তো আবার পেটের ভাত হজম হয় না।” আরশীনের কণ্ঠে অধিকারবোধ মিশ্রিত ছিল।
— “শাসন করছেন?”
আরশীন একমূহুর্ত থমকাল। তারপর জোর গলায় বলল,
— “যদি শাসন মনে করেন তবে তাই। আপনি হুট করে হাওয়া হয়ে যাবেন। তারপর? এর জবাবদিহি আমি করব নাকি? আপনার বাবা-মা তো আমাকেই বলবে। আমি দায় নিব কেনো?”
— “আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?”
— “দিচ্ছি। ঋণী থাকতে পছন্দ করি না। ফিরে আসুন।”
— “যদি না আসি?”
— “আমাকে বলুন আপনি কোথায় আছেন, আমি ঘাড়ে পাক দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসছি আপনাকে।”
আদিয়াত বেশ জোরেই হেসে উঠল। এই শূণ্য প্রকৃতিতে ওর হাসি আর সমুদ্রের গর্জন মিলে খুব সুন্দর একটা আওয়াজ তৈরি হলো। সে একটু রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল,
— “বলব না। খুঁজে বের করুন।”
— “আপনাকে আমি কোথায় খুঁজব? আপনি এমন কেনো? রাতে কি ঘুমাতে দিবেন না? ঘুমাতে তো পারছিই না, উল্টো যন্ত্রনায় আমার জীবন শেষ। বলুন, কোথায় আছেন?” তিরিক্ষি মেজাজে বলল আরশীন।
— “মনের টান যেখানে গিয়ে শেষ হবে আমাকে ঠিক সেখানেই খুঁজে পাবেন।”
আরশীন ফের থমকাল। এটা কেমন ধাঁধা? বলল,
— “সময় কতটুকু?”
— “আজীবন!”
এইবার ও একটু রেগে গেল। ফোঁসফোঁস করে বলল,
— “আপনি আমার সাথে ফাজলামি করেন?”
— “ফোন রাখছি। আসুন আপনি। অপেক্ষায় থাকলাম…”
আরশীন ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। এক আজব মানুষের পাল্লায় পড়েছে সে। মনের টান… মনের টান, দীর্ঘক্ষণ ভাবল সে। মনের টান কোথায় গিয়ে শেষ হতে পারে? ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বিকাল নাগাদ যখন শেষপ্রান্তে অর্থাৎ ঘন জঙ্গল শুরু হওয়ার আগের জায়গায় গিয়েছিল, তখন সে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল,
— “এমন সৌন্দর্যের আচ্ছাদনে এলে মনে আর কোনো টান থাকে না কারো জন্য। মনে হয়, সব বুঝি শেষ হয়ে যায় এই সমুদ্রের বিশালতায়! সমুদ্র সব তার বুকে টেনে নিয়েছে।”
আরশীন আর দেরি করল না। বেরিয়ে গেল। এই রাত-বিরাতেও সব জাঁকজমকপূর্ণ, আলোকিত, লোকারণ্য। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। পা চালিয়ে গেলে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগতে পারে।
আদিয়াত বুঝে গিয়েছিল, আরশীন এই ধাঁধার সমাধান করে ঠিক পৌঁছে যাবে এখানে এবং তাই হলো। সে অবশ্য আগেভাগেই গা বাঁচিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে। আরশীনকে এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজছে তাকে। এই ভরা চাঁদের আলোয় সমুদ্রের বুকে তাকে এক রহস্যময়ী মানবী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কতকাল যাবত কাউকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে।
আদিয়াতের তো এখানেই থাকার কথা। ও নেই কেনো? ঠিক এই জায়গাটা, হ্যাঁ এটাই সেই জায়গা। তবে কি আদিয়াত অন্যকিছু বুঝিয়েছে। কোথায় গেলে পাবে ওকে? নিজের এমন ব্যর্থতার জন্য চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। সে বসে পড়ল বালুচরে… আনমনে বলতে শুরু করল,
— “আমি সত্যি জানিনা, আমার ভবিষ্যৎ কি? সবকিছু ভুলে আমি আপনাকে ভালোবেসেছি। আপনি বড্ড কষ্ট দিচ্ছেন আমায়। ভুল করেছি আপনাকে ভালোবেসে? সেই ভুলের শাস্তি এতটা নিষ্ঠুরভাবে দিচ্ছেন? আচ্ছা, ঠিক আছে আমি মাথা পেতে আমার ভুলের শাস্তি গ্রহণ করছি। তবুও ফিরে আসুন, আমার একা একা ভালো লাগছে না। সবকিছু বোঝা মনে হচ্ছে। বিশেষ করে আমার জীবন! এই ভার বইতে পারছি না। ভালোবেসেছি… তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্য নেই তবে চেপে রাখতে পারব। আমার ভালোবাসা বোধগম্য হওয়াতে আপনি যে এইভাবে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন তা বুঝলে আমি নিজেকেও নিজের ভালোবাসা বুঝতে দিতাম না। অনুরোধ করছি, ফিরে আসুন। এরপর বাড়ি ফিরে যাব তারপর আবার ওই একঘেয়ে জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলব। আমাকে কেনো নিয়ে এলেন আপনার সাথে? কেনো এত কাছাকাছি রাখলেন? আমি যে আবেগে বিবেক ভুলতে বসেছি। আমি যে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারি নাই। কথা দিচ্ছি, আর ভালোবাসব না… কখনোই না… কোনোদিনও না…” আরশীন সত্যি সত্যি অঝোরে কান্না শুরু করে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আদিয়াত ওর পেছনে এসে দাঁড়াল এবং কাঁধে হাত রাখল।
.
.
.
চলবে….