#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-১৯]
~আফিয়া আফরিন
(নিদ্রাহীন কল্পলোক)
চাঁদের আলোয় তখনো জোৎস্না ছড়িয়ে আছে। নীরব সমুদ্রের ঢেউ শুধু ধীরে ধীরে উঠে এসে ফিরে যাচ্ছে, ঠিক কারও অশ্রুসজল বুক থেকে ফেরা দীর্ঘশ্বাস। আরশীন একা বসে, দুই হাত জড়িয়ে নিজের হাঁটু জাপটে ধরে। চোখে টলমল অশ্রু, ঠোঁট কাঁপছে। ঠিক সেসময় আদিয়াতের স্পর্শ পড়ল কাঁধে। হালকা, স্থির, আশ্বাসের মতো।
চমকে তাকিয়ে দেখল আরশীন। কিন্তু চমক ভয়ের নয়, একধরনের মমতার ও বেদনার মিশেল। আরশীনের চোখ ভিজে গেল আরও। যেন দুঃখটা প্রশ্রয় পেয়ে এবার বুকচাপা কান্নায় রূপ নিল। আরশীন হঠাৎই উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো জ্বালা করছে কাঁদতে কাঁদতে, কিন্তু তবুও সে চোখ সরাল না আদিয়াতের দিক থেকে। ঠোঁট কাঁপছিল, কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো। তবুও স্পষ্ট বলল,
— “আপনি এত বাজে একটা মানুষ কেন? এত নিষ্ঠুর? আপনাকে যদি আগে জানতাম এমন, কখনোই… কখনোই বিয়ে করতাম না।” তার চোখে অভিমান, কষ্ট আর কেমন একটা ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্ত জমে আছে। শব্দগুলো ঠিক অভিযোগ নয়, যেন কষ্ট থেকে ছিটকে বেরোনো দীর্ঘদাহ।
আদিয়াত দাঁড়িয়ে রইল স্থির। তার চোখে কি অপরাধবোধ? নাকি শুধু বিস্ময়, এই চিরপরিচিত মেয়েটা এত অপরিচিত লাগছে কেন আজ?
আরশীন তখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, যেন পালাতে চায়। আদিয়াত এক পা এগিয়ে এলেও শব্দ করেনি, কেবল নিঃশ্বাসটা গা ঘেঁষে গিয়েছিল, কিছু বলার চেয়ে অনেক বেশি ভারি কিছু ছিল সেখানে।
— “ভালোবাসেন?” আদিয়াত স্পষ্ট কণ্ঠে আরেকবার জিজ্ঞেস করল।
আরশীন বুকের ভেতর জমে থাকা আবেগ আর কান্না চেপে রাখতে পারল না। নিঃশ্বাস চেপে ধরে বলল,
— “হুমম।”
— “কবে থেকে?”
— “জানিনা। সঠিক মনে নেই। এত দিন-রাত হিসেব করে ভালোবাসি নাই।” আরশীন নিজের আবেগ নিয়ে লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করল।
আদিয়াত একটু ঝুঁকে বলল,
— “বাজে মানুষ বললেন, আবার ভালোবেসেও ফেললেন?”
আরশীন চোখের জল মুছল। ধীরে বলল,
— “ভালো না বাসলে বোঝার চেষ্টা করতাম না। বাজে মানুষদের নিয়েই তো মনটা বেশি ব্যস্ত থাকে।”
তারপরের মুহূর্তে সময়টা যেনো স্তব্ধ হয়ে যায়। সমুদ্রের গর্জনও যেন কানে নরম হয়ে আসে। আরশীনের চোখে জল, মুখে একরাশ লজ্জা, দ্বিধা একসাথে খেলা করছে। আর আদিয়াত তার দিকে তাকিয়ে আছে একেবারে নিঃশব্দে, এক গা গা-করা প্রশ্রয়ে। একটা নরম বাতাস আসে, আরশীনের চুল ওড়াতে থাকে। আদিয়াত হাত বাড়িয়ে ওর গাল ছুঁয়ে বলে,
— “এই কান্না আমার ভালো লাগে না। আমি চাই আপনি হেসে বলেন, ভালোবাসেন।”
আরশীন চোখ নামিয়ে ফেলে, মৃদু গলায় বলে,
— “আর কিছু চাওয়া আছে আপনার?”
আদিয়াত হেসে মাথা নেড়ে বলে,
— “থাকুক, আজ শুধু এটুকুই থাক। বাকিটা সময়ে আস্তে আস্তে বলে দিবেন।”
তারা দুজন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নিঃশব্দে, কিন্তু মন-মনে খুব জোরে কথা হয়। চোখের ভাষায়, ছুঁয়ে থাকার নীরব প্রতিশ্রুতি দিয়ে। নীরবতা ভেঙে আরশীন জোর গলায় বলে,
— “এই নিরব সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে, আমি আজ নিজেকে আর লুকাব না। আমি আপনাকে ভালোবেসেছি, আদিয়াত। সব যুক্তি, সব ভয় পেরিয়ে। এটাই আমার সত্যি, এটাই আমার স্বীকারোক্তি।” আরশীনের ঠোঁট থেকে কথাগুলো ঝরে পড়তেই আদিয়াত এক হাতে ওকে জড়িয়ে নেয়। স্পর্শটা ছিল আরশীনের জন্য আচমকা, একদম বিশেষ। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে আরশীন। আদিয়াতের উষ্ণ ছোঁয়া যেন সমস্ত অস্থিরতা নিভিয়ে দেয়, সমুদ্রের বাতাসে গলে যায় দুজনের নিঃশ্বাস।
কোনো কথা ছিল না, ছিল শুধু একরম মুগ্ধতা এবং নীরব আলিঙ্গন। আদিয়াত শান্ত গলায় বলে,
— “এতদিন ভাবি নাই। তবে আজকের এই মুহূর্ত থেকে আমিও আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। হিসেবের দিক থেকে আপনি একধাপ এগিয়ে, আমি না হয় পেছনে পেছনে ছায়া হয়ে রইলাম।”
উফফ, কথাগুলো প্রতীক্ষিত ছিল। মনে হয় সহস্র জনম এমন কথা শোনার জন্য সে অপেক্ষা করে গেছে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, দেখানোর কিছু নেই। তার অবস্থান এখন আদিয়াতের প্রশস্ত বুকে। যেনো কোনো ঝড়ের পর আশ্রয় খুঁজে পাওয়া ক্লান্ত পাখি। আদিয়াতের বুকের ধীরে ওঠানামা ওর ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়; নিরাপদ, নীরব, অগাধ।
আরশীন চুপচাপ শুনে যায়। সমুদ্রের গর্জনের মাঝে এই কথা, এই নিঃশ্বাসের ওঠানামা তার হৃদয়ের গভীরে ঢুকে যায়। আর আদিয়াতের চোখে তখন শুধুই এক নিশ্চিন্ততা, ভালোবাসার ছায়ায় ঢাকা এক আশ্রয়।
.
রিসোর্টে ফেরার পথটা যেন এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়ানো। কথা নেই, শুধু মাঝে মাঝে আদিয়াত আরশীনের দিকে তাকায়, আবার আড়চোখে সরিয়েও নেয়। আরশীনও নিজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলেছে একটা ঝড়। কিন্তু সেই ঝড় আর উত্তাল নয়; শান্ত, গভীর, কোমল।
তখন কেবল ভোরের আলো ফুটছে। চারপাশ ধীরে ধীরে রঙ নিচ্ছে নরম সোনালি আলোয়। জানালার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ছে রুমের ভেতর, যেখানে ঘুমচোখে জেগে বসে আছে আরশীন। ওর চোখে এখন একরাশ লজ্জা। বুকের ভেতর দপদপ করছে। রাতে যা বলেছে, যা করেছে, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। পাগলামি করে মনের কথা বলে ফেলেছে, সামনে তাকালেই সেই মানুষটা আছে! এখন কী হবে?
আরশীন একবার দরজার দিকে তাকাল, একবার জানালার দিকে, কোনোদিকেই পালানোর রাস্তা নেই। অথচ ইচ্ছে করছে কাঁথা মুড়িয়ে আলমারির ভেতর লুকিয়ে পড়তে। আদিয়াত তখনও ঘুমিয়ে আছে। আরশীন তার দিকে তাকাতেই পারছে না। ওর দিকে তাকাতে গেলেই চোখেমুখে, সারা শরীরে একরকম শিরশির ভাব আসে। আরশীন ফিসফিস করে নিজের মনেই বলে ফেলল,
— “এখন কী করব আমি? এত সহজে নিজেকে ধরা দিলাম। এখন উপায় কী?”
তারপর হঠাৎ আদিয়াত একটু নড়ে ওঠে। আরশীনের শ্বাস প্রায় বন্ধ, ধরা না পড়ে যায় কোথায়! কিন্তু নিজেরই মনে পড়ে যায়, ধরা তো সে নিজের ইচ্ছেতেই দিয়েছে। নিজেই তো রাতের নরম অন্ধকারে স্বীকার করেছিল, “আমি আপনাকে ভালোবেসেছি।”
এখন আর ফেরার উপায় নেই। শুধুই অপেক্ষা, আদিয়াত জেগে উঠবে, তারপর… তারপর কী? সেটাই আরশীনের জানা নেই। তবে এতটুকু বোঝে; ও পালাতে পারবে না, না এই ভোর থেকে, না এই অনুভূতির অনুভব থেকে আর না আদিয়াতের থেকে।
আরশীন অনেক কষ্টে, অনেক সাধনায় নিজেকে সামলে রাখল। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হলেও, মুখে একরাশ প্রশান্তির ছায়া। এই মেয়ে তো কখনো এমন ছিল না। তার জীবনের ইতিহাসে এরকম ঘটনা নাই-ই।
নিজেকে এতটা খুঁজে পাওয়ার, এতটা হারানোর, এতটা ভালোবাসায় ভিজে যাওয়ার মানুষ সে ছিল না। আর আজ? এই সকালে, সে নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না। কিন্তু তবু স্বাভাবিক থাকার ভানটা করতেই হবে। ভান না করলে যে জোয়ার এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে… তার ভেতরের সব লুকোনো আবেগ, লজ্জা, আনন্দ; সব।
সকালের আলো পুরো ঘরটাকে নরম রোদের চাদরে মুড়ে রেখেছে। ভোরে উঠেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরশীন দূর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ বাদে আদিয়াত ঘুম থেকে উঠে দরজার দিকে এগোয়। যেহেতু রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় নাই, চোখে ঘুমের ছাপ এখনো রয়ে গেছে।
— “ঘুম ভাঙলো নাকি?” আরশীন ঠোঁটে চাপা হাসি আনে, এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি গতরাতে।
আদিয়াতও যেন কিছু মনে রাখেনি, একেবারে স্বাভাবিক। একবার তাকিয়ে বলল,
— “আপনি জেগে পড়েছেন? এত সকালে?”
আরশীন তো ঘুমালোই না। তবে সেটা স্পষ্টভাবে না বলে গলায় মেকি স্বর ফুটিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ, আর ঘুম এলো না। ভোরে ঘুম ভেঙে গেল তারপর সকাল দেখছিলাম।”
আদিয়াত আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেস হতে যায়। এই নির্লিপ্ততা, এই স্বাভাবিক ভাব, আরশীনের সহ্য হলো না। গত রাতের স্বীকারোক্তি, কান্না, জড়িয়ে ধরা, বুকের ভেতর হাহাকার; সবকিছু কি কেবল ওই রাতের মধ্যেই বন্দী থাকবে? কিছুই কি মনে নেই আদিয়াতের?
আরশীনের মনে এক অদ্ভুত টানাপড়েন। মনে প্রাণে চাচ্ছে আদিয়াত ওকে আবার জড়িয়ে ধরুক, কিছু বলুক, বলুক সে কতটা স্পেশাল…
কিন্তু আবার মুখ ফুটে নিজেই বলতে পারছে না। যদি ওর এতটুকু আগ্রহও না থাকে? যদি ও কিছুই ভাবে না? তাহলে? না এটা হতে পারে না, সে নিজেই স্বীকার করেছিল।
আরশীন বুঝতে পারছে না, বাস্তব আর নিজের অনুভবের মাঝখানে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে গুমোট এক কান্না চেপে রেখেছে আর বাইরে ঠিক আগের মতই স্বাভাবিক।
.
আজ সকালে কুয়াকাটার আকাশ ছিল মেঘলা। বাতাসে ছিল একরকমের স্বস্তি, রোদের তাপ নেই। আদিয়াত আর আরশীন বেরিয়ে পড়ল রিসোর্ট থেকে। রিসোর্টের গেইট পেরিয়ে ওদের গাড়ি ধীরে ধীরে শহরের দিক পাড়ি দিল। দুপুর নাগাদ আদিয়াত আরশীনকে নিয়ে গেল রাফিদের সঙ্গে একপলক দেখা করাতে। রাফিদের বাসার উঠোনটা ছিল ছায়াঘেরা, আরশীনের পায়ের ছায়া পড়ে রোদে কাঁপছিল হালকা। রাফিদ এক ঝলক দেখে হেসে বলল,
— “এই তাহলে ভাবি?” আরশীন একটু কুণ্ঠিত, তবু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ছিল। অল্প কথাবার্তা, হালকা চা আর মৃদু হাসির বিনিময়ে দেখা শেষ হলো। সেখান থেকে আদিয়াত ওকে নিয়ে রওনা দিল গঙ্গামতীর চরের দিকে।
ওখানে গিয়ে আরশীনের মনটা না চাইতেই খানিকটা হালকা হলো। মাঝেমধ্যেই হাওয়ায় পাতা উড়ে আসছিল, নারিকেল গাছগুলোর মাথা দুলছিল ছন্দে ছন্দে। আরশীন চুপচাপ হাঁটছিল, কখনো বালুতে পা ডুবিয়ে, কখনো ম্যানগ্রোভের পাতায় চোখ রাখছিল। আদিয়াত পাশেই ছিল; সবসময়ের মত চুপচাপ, শান্ত, গম্ভীর, তবু চোখে ছিল সজাগ আশ্বাস। চর পেরিয়ে বিকেলের রঙ ছড়িয়ে পড়তেই ওরা পৌঁছাল লেবুর চরে। সূর্যটা তখন একটু নীচে নেমেছে, চারপাশে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে জলে। । সূর্যটা ধীরে ধীরে পানির মধ্যে গলে যাচ্ছে—ধীরে, নিঃশব্দে, এক অনির্বচনীয় কোমলতায়। পশ্চিমাকাশ রঙ বদলাতে বদলাতে কখনো লালচে, কখনো গোলাপি, আবার কখনো হালকা বেগুনিতে রূপ নিচ্ছে।
চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ঢেউয়ের মৃদু গর্জন, বাতাসে হালকা লবণের গন্ধ। বাতাসটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে উঠছে, যেন প্রকৃতি নিজেই একটা পাতলা চাদর মেলে দিচ্ছে চারপাশে। চর জুড়ে ছিল নিঃশব্দ এক আবহ, পেছনে শুধু পায়ের আওয়াজ আর দূরে কিছু ঢেউয়ের মৃদু শব্দ।
আরশীন দাঁড়িয়ে ছিল নিরব, একবার জলরেখার দিকে তাকিয়ে, একবার আদিয়াতের দিকে।
— “এখন কোথায় যাবো আমরা?” আরশীনের কণ্ঠে ছিল কৌতূহল মেশানো কোমলতা।
— “চলুন, কোথাও একটা যাই।”
— “সেটা কোথায়?” আরশীন সন্দেহের চোখে তাকাল।
— “আগে তো যাই।” আদিয়াত মুখে রহস্যজটিল হাসি রেখে সামনে এগিয়ে চলল।
— “ইদানিং এত রহস্য রেখে কথা বলছেন যে?” আরশীন ভ্রু কুঁচকে কিছুটা অভিমানে বলল।
— “একটু… ইচ্ছে করছে।”
আরশীন মুখ ফিরিয়ে নিল। আদিয়াত ধীরে ওর হাতের ওপর হাত রাখল। আরশীন সামান্য কেঁপে উঠল।
— “আসুন। আর সময় নষ্ট না করি।” আদিয়াত বলল কোমল কণ্ঠে।
— “হুম। আমাদের তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে।” আরশীন নিচু কণ্ঠে বলল।
— “বাড়ি ফেরার কথা এত তাড়াতাড়ি চিন্তা করছি না। এখন ফিরব না, আরোও কিছুদিন পর।”
— “কিছুদিন?” আরশীন অবাক হয়ে তাকাল। “এতদিন কোথায় থাকব আমরা?”
— “কিছুদিনের জন্য না হয় যাযাবর হয়ে গেলাম। আপনি এবং আমি…”
তার কণ্ঠে যেনো কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানার চেয়ে ভালোবাসার নিরাপত্তা ছিল বেশি। আরশীন চোখ নামিয়ে ফেলল। মুখে কিছু না বললেও হাতের শক্ত করে ধরা আঙুলগুলোই সম্মতির ইঙ্গিত দিল।
আদিয়াত গাড়ি স্টার্ট দিল সিলেটের উদ্দেশে। চারদিকে ধীরে ধীরে গাঢ় অন্ধকার নামছিল, আর শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে তারা চলে যাচ্ছিল দূরে… আরও দূরে। আরশীন জানালার পাশে বসে চুপচাপ বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে ছিল। রাস্তার দু’পাশে ছুটে চলা আলো-আঁধারি মিশে যাচ্ছিল তাদের দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে। রাত গভীর হতে হতে রাস্তা ফাঁকা হতে থাকল। ড্রাইভের একটানা ধকল, রাতের নিস্তব্ধতা, আর মাথার মধ্যে ছায়া ফেলতে থাকা ভাবনা, সব মিলিয়ে আদিয়াতের চোখে জমে উঠেছিল নিদ্রার ক্লান্তি। তবুও থামল না। ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই পাহাড়ের ছায়া পড়তে শুরু করল। শহর ঘুমিয়ে থাকলেও প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। সকালে ঠিক নয়টা নাগাদ, তাদের গাড়ি জাফলং-এর এক পাহাড়ঘেরা রাস্তায় ঢুকল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘভেজা পাহাড়, পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির নদী—সেই প্রথম আরশীন জানালার কাঁচ খুলে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল।
আদিয়াতের শরীর তখন ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়ার মতো। আগেভাগেই রিসোর্ট বুক করে রেখেছিল। পাহাড়ঘেরা সেই নিরিবিলি রিসোর্টে তারা পৌঁছেই চেক ইন করল। একসাথে রুমে ঢুকল। বাইরের প্রকৃতি তখনও নিঃশব্দে স্বাগত জানাচ্ছিল তাদের নতুন দিনের শুরুতে।
রিসোর্টের ঘরটা একদম শান্ত। জানালার পর্দা সরু করে রাখা, যেন সূর্যের আলো একেবারে হঠাৎ করেই চোখে না লাগে। ঘরের ভেতর হালকা শীতলতা, এসির ধীর ধারে ভেসে আসা বাতাস আর কাঠের আসবাবের গন্ধে যেন ঘুম ঘনিয়ে আসে আরও।
আরশীন ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একটানা রাতভর জার্নি, ক্লান্ত শরীরটা যেন বিছানায় পড়তেই নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানায়। আদিয়াত তো এসেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে, এক হাত চোখের উপর রেখে। তার নিশ্বাস গভীর কিন্তু তাতে কোনো শব্দ নেই। একটু পর আরশীন ঘুম ঘুম চোখে ফিসফিস করে বলে,
— “এত ধকল কেন সহ্য করলেন?”
আদিয়াত চোখ খুলে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
— “কারো পাশে থাকার ইচ্ছেটা যদি সত্যি হয়, ধকল ধকল মনে হয় না। চলে যাওয়া ওই সময়টুকু আমার কষ্ট মনে হলো না, মনে হলো নতুন কিছু পাওয়া। সারারাত না ঘুমিয়ে আসা, অযথা বকবক করা; আপনার পাশে থাকায় সব তুচ্ছ-ই মনে হলো।”
আরশীন হেসে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে ওর চোখ জুড়ে আসে ঘুম। তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলে,
— “এখন একটু ঘুমান।”
ঘরের ভেতর তখন শুধু দু’জন মানুষের নিঃশ্বাস আর বাইরের পাখির ডাকে এক অপূর্ব শান্তির সুর বাজতে থাকে।
আদিয়াত ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়। চোখ বন্ধ, মুখে যেন একটা শান্ত ছায়া। আরশীন ধীরে ধীরে উঠে বসল। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকা আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের সামনে এমন কাউকে দেখে যার প্রতি না বলা হাজারটা আবেগ জমে আছে। তারপর এক নিঃশব্দ আবেগে হাত বাড়িয়ে দিল। আলতো করে গাল ছুঁয়ে দেখল। কেমন উষ্ণ, কেমন পরিচিত মনে হলো সেই ছোঁয়া। আদিয়াত নড়ল না, চোখও খুলল না—তবু ওর নিঃশ্বাসে যেন একটা কোমল অনুভব খেলা করল।
আরশীন ভয়ে ভয়ে চুলে হাত চালাল, ধীরে ধীরে। এই মানুষটাকে চোখ দিয়ে ছুঁয়ে, মন দিয়ে বোঝার চেষ্টায় লিপ্ত। এই প্রথম, এত কাছ থেকে, এত আপন করে কারো দিকে তাকানোর সৌভাগ্য হলো ওর। যে মানুষটা কিছুদিন আগেও পুরোপুরি চেনা ছিল না, আজ তাকে নিজের শ্বাসের মতো আপন লাগছে। এমন মুহূর্ত তো কেবল গল্পে, কল্পনায় ভাবা যায়। আরশীন নিজেকেই প্রশ্ন করল,
— “এতখানি আপন হওয়া কি সত্যি সম্ভব? নাকি আমি এখনো স্বপ্নের ভিতরেই আছি?”
তার ভেতরে তখন এক ধরনের অভিমিশ্র জন্মায়। আবেগ, ভয়, আহ্লাদ, কৃতজ্ঞতা আর অজানা এক মায়ার তরঙ্গ। এমন আপন অনুভব যদি স্বপ্ন হয়, তবে সে ঘুম ভাঙাতে চায় না। এই স্বপ্নে হারিয়ে থাকাই তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জয়।
আদিয়াত আসলে ঘুমিয়ে ছিল না। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে শুয়ে থাকলেও সে টের পাচ্ছিল, আরশীনের নরম আঙুলগুলো কীভাবে ওর চুলে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুখে ছায়া পড়ে থাকা চুল সরাতে গিয়ে ওর আঙুলের শীতলতা কীভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে স্পর্শে-স্পর্শে। ঘুমের ভান করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে সে জানে, এই নির্ভরতার মুহূর্তটা আরশীনের কাছে কতটা মায়াবী। সে চাইছিল না, এই নিঃশব্দ ভালোবাসার ভাষাটাকে কোনো শব্দ দিয়ে ভেঙে ফেলতে।
আরশীনের ছোঁয়ায় বুকের গভীরে এক অচেনা আর কোমল উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে আদিয়াতের। সে শুধু মনে মনে বলল,
— “এই যে আপনি ছুঁয়ে যাচ্ছেন, আমি অনুভব করছি। কারণ আপনি এখন আমার নিজের মানুষ, পুরোপুরি।”
বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। ঘরে ভেসে ছিল শুধু হালকা বাতাসের শব্দ আর নিঃশ্বাসের নরম ছন্দ। হঠাৎই আদিয়াত আরশীনের হাতটা ধরে চোখ মেলে তাকাল। তার চোখে ছিল একরাশ প্রশ্রয়।
আরশীন চমকে উঠল, যেন ধরা পড়ে গেছে কোনো নিষিদ্ধ কল্পনায়। হঠাৎই একটু দূরে সরে গেল,
— “আমি… মানে… আমি তো শুধু…” কথা আটকে গেল গলায়। মুখে একধরনের নার্ভাস হাসি।
আদিয়াত হালকা হেসে বলল,
— “লুকিয়ে চুরিয়ে দেখার কী দরকার? আমি তো সামনেই আছি।”
আরশীন কাঁপা দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মাথা নিচু করে ফেলল। আদিয়াত একটু ধৈর্য ধরেই আবার বলল,
— “তাকান… দেখি।”
আরশীনের চোখ কাঁপছে। দৃষ্টি যেন হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে। কিছু একটা আটকে আছে ভেতরে। আদিয়াত এবার কণ্ঠটা একটু রসিক করল,
— “এইভাবে কাউকে লুকিয়ে দেখা, ছোঁয়া… এটা কিন্তু মস্ত বড় অপরাধ। আপনার শাস্তি নিশ্চিত।”
— “কী?” আরশীন ফিসফিস করে বলল।
আদিয়াত আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। তার কণ্ঠ যেন হালকা বৃষ্টির মত কোমল,
— “আমার চোখের দিকে তাকান… তবেই জানতে পারবেন।”
আরশীন ধীরে ধীরে চোখ তুলল। আর আদিয়াতের চোখে তখন এক পৃথিবী নিরাপত্তা, ভালোবাসা আর এক চিমটি দুষ্টুমি, যা কাউকে আজীবন আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট।
আচমকা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, আদিয়াত এক ধাপ এগিয়ে এলো। একরাশ নীরব আবেগ নিয়ে আলতো ভঙ্গিতে আরশীনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তটায় সময় থমকে দাঁড়াল। বাতাস হালকা থমথমে, চারপাশে কেবল হৃদস্পন্দনের শব্দ। আদিয়াতের সেই স্পর্শটা এতটাই নরম, গভীর আর বিমূর্ত ছিল যে, আরশীন নিজেই বুঝতে পারল না; সে দাঁড়িয়ে আছে, না ভেসে যাচ্ছে। তার মনে হলো, শরীরটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেছে, মাথা যেনো ঘুরে পড়ে যাবে… কিন্তু ঠিক তখনই নিজের মধ্যেই কোথা থেকে যেন একটা শক্তি খুঁজে নিয়ে সামলে নিল নিজেকে। এটা কি বাস্তব? নাকি স্বপ্ন? আদিয়াতের মুখে তখন শান্ত এক হাসি, যেন কিছু না হয়েও সব কিছু ঘটে গেছে!
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২০]
~আফিয়া আফরিন
(প্রেমাসক্তি)
আরশীন তখন শান্ত হয়ে তাকিয়ে ছিল। তার মন তার শরীরের এক এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ধাক্কা খাচ্ছিল। আদিয়াতের কাছ থেকে পাওয়া সেই হালকা স্পর্শ, যেনো গা ছমছমে আলোর মতো। নরম কিন্তু এত গভীর যে আরশীনের ভিতর পর্যন্ত তা পৌঁছে গিয়েছিল। আদিয়াত তখন অনুমতি নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
— “আমি যদি আরেকটু কাছে আসি, আপনি কি পালিয়ে যাবেন?”
আরশীনের মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু তার চোখের ভেতর সেই তলানোর ভয়ও ছিল। আদিয়াতের এই সহজসিদ্ধ শান্তির মধ্যে কোথাও যেনো একটা তীব্র আকর্ষণ, একটা আধ্যাত্মিক স্পর্শ ছিল, যা মনের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
— “পালাতে তো চাই না।” আরশীন মৃদু স্বরে বলল, “কিন্তু কেমন যেন অনুভূতি। কিছুই বুঝতে পারছি না।”
আদিয়াত তাকে আরো কাছে টেনে নিল। তার শীতল হাতগুলো আরশীনের হাতের ওপর রাখল আরেক হাতে ওর ঠোঁট আলতো ভাবে ছুঁয়ে বলল,
— “এটাই তো, এই অনুভূতিগুলোই জীবনের সুন্দরতা। কখনো কখনো কিছু অনুভূতি এত সহজ অথচ এত গভীর হয়, যে আপনি তখন শুধু অনুভব করতে পারবেন কিছু বলতে পারবেন না।”
আরশীন তাকাল, আসলেই কিছু বলতে পারল না। তাদের মাঝের পৃথিবী থমকে ছিল, যেনো কেবল তাদের দুইজনেরই উপস্থিতি এখানে ছিল।
— “আমার চোখে, আপনার অবস্থান যতটা অদ্ভুত ততটাই বাস্তব।” আদিয়াত বলল আর তার নিঃশ্বাসের গাঢ়তায় কিছু যেন অন্যরকম হয়ে উঠল।
এটা শুধুমাত্র কথা ছিল না। শব্দের মধ্যে যে উষ্ণতা ছিল, তা আরও বেশি অনুভূত হচ্ছিল। আরশীন শুধু একটুও নড়ল না, যেন সে একটি গল্পের চরিত্র; যাকে আদিয়াত তার পৃথিবী থেকে একেবারে নিজের ভুবনে নিয়ে চলে গেছে।
আদিয়াত সামান্য ঝুঁকে এসে গভীরভাবে তাকাল আরশীনের চোখে। চারপাশে জাফলংয়ের ভোরের শান্ত বাতাস, দূরে মেঘের কোলে হালকা রোদ, আর পাথরের ফাঁকে গড়িয়ে চলা নদীর ধারা, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রকম নীরবতা তৈরি হয়েছে।
— “বলুন, কি চান আপনি আমার কাছ থেকে?” আদিয়াতের কণ্ঠটা ছিল নরম, কিন্তু সে আসলেই জানতে চায়।
আরশীন থেমে গেল এক মুহূর্ত। তারপর চোখ নামিয়ে বলল,
— “শুধু চাই এই মুহূর্তটা থেমে যাক। এতটা অবিশ্বাস্য লাগছে কেন আমার?”
— “মনে হচ্ছে, আমরা কোনো গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েছি। যেখানে সব কিছু সত্যি, অথচ স্বপ্নের মত।”
আরশীন সরাসরি তাকাল।
— “এমন কেন হচ্ছে বলুন তো? আমি তো নিজেকে এমনটা চিনতাম না… এভাবে কাউকে নিয়ে ভাবি, এটা তো আমার মতো নয়।”
আদিয়াত হেসে বলল,
— “ভালোবাসা কি কখনও আমাদের মতো হয়? ওটা তো ঠিক তখনই আসে, যখন আমরা তৈরি থাকি না। শুধু আসে, তারপর থেকে সবকিছু বদলে যায়।”
আরশীন মুখ ফিরিয়ে একটু দূরে তাকাল। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের ঝিলিক পড়ছে ওর মুখে। সে চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল।
— “এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায় বলুন তো?”
— “যতক্ষণ আপনি চাইবেন। আমি আছি, এই নীরব সময়টার পাশে। আপনি, আমি আর কিছু না চাওয়া এই মুহূর্ত।”
আরশীন তার হাত শক্ত করে ধরল, চোখ ভেজা ভেজা। একটা অনুভূতির ঢেউ ধীরে ধীরে বুকে আছড়ে পড়ছে, আর তাতে ডুবে যেতে তার একটুও আপত্তি নেই।
চারপাশে তখন নিঃশব্দ সঙ্গীত, ভোরের আলোয় ছায়া খেলা করছে তাদের চোখে। তারা একে অপরকে দেখছে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো তাড়া নেই, শুধু দুজন মানুষ, এক অনুভবের নিঃশব্দ গভীরতায় আবদ্ধ।
অনেকটা সময় গড়িয়ে গিয়েছিল, সময় থেমে গেছে ওদের চোখের মাঝে। তারা কেউ কিছু বলছে না, তবুও ভাষাহীন এক কথোপকথন চলছিল। চুপচাপ, নিঃশব্দ, গভীর। আদিয়াত আরশীনের চোখে তাকিয়ে থেকে বুঝে নিচ্ছিল প্রতিটি না-বলা বাক্য, আরশীন যেন ধীরে ধীরে মুখস্থ করে নিচ্ছিল আদিয়াতের চাহনি, দৃষ্টির ভাষা, এমনকি নিঃশ্বাসের ছন্দটাও। ওরা হয়তো নিজেরাও টের পায়নি, তারা এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় নেমেছে; কে কাকে আগে হৃদয়ে গেঁথে নিতে পারে, ঠোঁটস্থ করতে পারে, কণ্ঠস্থ করতে পারে।
তখনই হঠাৎ এক শত্রুর মতো কেঁপে উঠল আদিয়াতের ফোন। সেই মৃদু কণ্ঠনাদ মুহূর্তভাঙা বজ্রপাতের মতো এসে আঘাত করল নির্ভার নিরবতায়। আরশীন হঠাৎ চমকে উঠল। মুহূর্তটা যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল হাতের মুঠো থেকে। তড়িৎবেগে উঠে বসল আরশীন। চোখে তখনো আগের ঘোর, ঠোঁটে খানিকটা বিমূঢ়তা, আর মনে একটা অদ্ভুত খালি খালি অনুভব। যেন কিছু হারিয়ে গেল, অথচ কী হারালো তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
আদিয়াত তখন চোখ নামিয়ে ফোনটা হাতে নিচ্ছে, আরশীনের চোখ জানালার দিকে যেখানে দূরে, চা-বাগানের ফাঁকে ভোরের রোদ গাঢ় হয়ে উঠছে, কিন্তু আর তা আগের মতো লাগছে না।
আদিয়াত ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই মুখভঙ্গি একটু বদলে গেল। পরিচিত নম্বর, অফিসের। রিসিভ করেই গলার স্বর পালটে নিল; কঠিন, গম্ভীর, পুরোপুরি প্রফেশনাল। মিনিট দুয়েক কথা বলল, শুধুমাত্র,
— “হ্যাঁ ঠিক আছে, আমি দেখে নিচ্ছি, মেইল পাঠাও।” এই ধরনের কথাবার্তা। তারপর ফোনটা রেখে মুখ ঘুরিয়ে আরশীনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
— “আই এম সরি… একটু জরুরি একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে ফোনটা এসেছিল। আমাকে কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হবে।”
আরশীন নিজের চুলের খোঁপা ঠিক করার ভান করে চোখ নামিয়ে নিল। মাথা নেড়ে হালকা হেসে বলল,
— “না না, ঠিক আছে… আপনি কাজ করুন।”
ওর কণ্ঠে নির্লিপ্ত এক সৌজন্য। অথচ ভিতরে একটা হালকা খালি লাগার অনুভব জমে উঠছে। এই তো ঠিক তখনই, যখন মুহূর্তটা সবচেয়ে পূর্ণ ছিল, তখনই সেটা মাঝপথে থেমে গেল। ওর এই কাজকর্ম, অফিস সবকিছুকে জাত শত্রু মনে হচ্ছে। নিজেই বলে কয়েকদিন ব্যস্ততা থেকে দূরে থাকবে আবার বসেছে কাজ নিয়ে।
আদিয়াত ল্যাপটপ খুলছে। আরশীন পাশে বসে, এক দৃষ্টিতে তার ব্যস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, এই মানুষটার কাজের দুনিয়ায় সে কতটুকু জায়গা পায়? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। ভালোবাসা মানে শুধু হাত ধরে থাকা না, মাঝে মাঝে একপাশে চুপচাপ বসে তার ব্যস্ততাটাকেও ভালোবাসা!
.
অফিসঘরটা থমথমে। ভেতরে হালকা এসির ঝিরঝির শব্দ আর কাঁচের দেওয়ালে সূর্যের আলো ধাক্কা খেয়ে পড়ছে ঝাপসা হয়ে। চেয়ারে বসে আমিনুল ইসলাম ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করছিলেন। তার কপাল একটু ভাঁজ হয়ে গেছে। আর ঠিক তখনই সাইড টেবিল থেকে পাওয়া এক খবর যেন মনের মধ্যে একটা স্নায়ু চেপে ধরল, আদিয়াত আজকের প্রজেক্ট মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করছে। চোখ সরু করে তাকালেন সামনের দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটার দিকে। বিরক্তি আর বিস্ময়ে ঠোঁটের কোণে হালকা মোচড়। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, আদিয়াত এখন সবকিছু থেকে দূরে। একরকমের নিঃসক্রিয়। নিজের ভুলেই না হয় হিসাবের বোঝাটা ওর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিল। একটু হালকা আতঙ্কে ছিলেন। কিন্তু এরপর? বারবার যখন আদিয়াতের নাম ঘুরেফিরে আসছিল, প্রথমে একটু অখুশি হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ধীরে ধীরে সব হিসেব মিলে গেল তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথেই। দারুণ হয়েছে আসলে। যদি এই ভুলের দায় আদিয়াতের ওপর প্রমাণ করা যায়, তাহলেই তো তার গলার রজ্জু শক্ত করে বাঁধা যাবে। হয়তো বোর্ডে একবার প্রমাণ করে দিতে পারলেই যথেষ্ট—আদিয়াত দায়িত্বজ্ঞানহীন, হিসাব জানে না, সময়মত রিপোর্ট ফাইল করতে পারে না। বড় ভাই তো আর মাত্র কয়েকদিন। আদিয়াতকে সরাতে পারলেই হলো। আর আযহান? হাস্যকর… সে এসব বোঝার ধারেকাছেও নেই। তাকে কনভিন্স করা, চুপ করিয়ে রাখা কোন ব্যাপারই না। আমিনুলের চোখ ঝলকে উঠল। কাঁধের ওপর ভারী একটা চাপ যেন হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। মনে মনে বললেন,
— “আর ক’টা দিন। বড় ভাই, আর ক’টা দিন! তারপর এই কোম্পানি… এই প্রজেক্ট… সব আমার নিয়ন্ত্রণে। আদিয়াত থাকবে না সামনে। আমি চাইলে উঠবে, আমি চাইলে নামবে।”
একরকম অন্ধকার পুলক ছড়িয়ে পড়ল। তিনি আরাম করে পিঠ হেলিয়ে বসলেন চেয়ারে।
— “ভাইপো, এবার দেখা যাক তোমার ঘুঁটি কিভাবে ফেলে দিই…” পুরো খেলার মাস্টারমাইন্ড তিনি, তার মনে এখন মস্ত এক পরিকল্পনার জাল।
.
আদিয়াতের ব্যস্ততারা যেন আজ পণ করেছে, তাদের ভালো মুহূর্তগুলো সহজে আসতে দেবে না। উফফ, কী যন্ত্রণাদায়ক! এমন সময় কাজ এসে হাজির হয় যে; না ফেলা যায়, না সহ্য করা যায়। মনের মধ্যেকার উথালপাথাল ভালোবাসা আর দায়িত্বের টানাপোড়েনে একটা ক্লান্ত দুপুর কেটে গেল।
আরশীন জানালার পাশে বসে ছিল। পাহাড় আর কুয়াশার খেলা দেখছিল। আদিয়াত এসে দাঁড়াল, গা ঝাড়া দিয়ে ক্লান্তি ঝেড়ে একটু হালকা হলো। তারপর ডেস্কের দিকে ইশারা করে হেসে বলল,
— “এই নিন, সব ফেলে এলাম। বন্ধ করে দিলাম, কাজের ঝামেলা। আসলে এমনটাই তো কথা ছিল, না? কিন্তু মাঝেমাঝে কথা রাখা এমন কঠিন হয়ে যায়।”
আরশীন তাকাল ওর দিকে, চুপচাপ। আদিয়াত হালকা হাসল। তারপর গম্ভীর স্বরে আবার বলল,
— “তবে আগামী কয়েকদিন আর কোনো পিছুটান নেই।” থেমে, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে যোগ করল, “উঁহু, একটা পিছুটান অবশ্য রয়েই গেল।”
আরশীন কপাল ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
— “সেটা কী?”
আদিয়াত সরল গলায় বলল
— “আপনি!”
— “আমি?” আরশীন বিস্মিত।
আদিয়াত ধীরে মাথা ঝাঁকাল,
— “হুম।”
— “কীভাবে?”
আদিয়াত ওর মুখোমুখি বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— “এই যে, আপনি পাশে না থাকলে মন বসছে না। আর আপনি পাশে থাকলেও মন কোথাও বসতে চায় না, এর চেয়ে বড় পিছুটান আর কী হতে পারে?”
আরশীন মুখ নামিয়ে নিচু হয়ে বসে রইল। হাতের আঙুল দিয়ে অস্পষ্ট দাগ কাটছিল। গাল রাঙা টকটকে লাল, চোখের কোণে মৃদু হাসির রেখা। আদিয়াত একটু ঝুঁকে এসে মুচকি হেসে বলল,
— “আপনাকে তো কিছু বলাই যাচ্ছে না। সাথে সাথেই লাল হয়ে যাচ্ছেন।”
আরশীন মুখ তুলেই আবার নামিয়ে নিল। আদিয়াত হালকা হাসল, একটু খুনসুটির ঢঙে যোগ করল,
— “দিনের আলোয় সেটা আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাতে হলে না হয় ভুলেও যেতাম…”
আরশীন “উফফ” বলে মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকাল। মনে হচ্ছিল, তার মুখের তাপ এবার কান ছাড়িয়ে গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আদিয়াত ঠিক বুঝতে পারছিল, আরশীনের শরীরে লজ্জা কেমন এক কোমল আঁচড় কেটে যাচ্ছে। মুখের রঙ টকটকে লাল, চোখে অবোধ সংকোচ। সে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল,
— “চলুন, এবার এই ঘরটাকে একটু ছুটি দিই। একটু হাওয়া লাগুক আমাদেরও।”
আরশীন তার হাতটা ধরল। মুখে এখনো লজ্জার রেশ, কিন্তু চোখে জ্বলজ্বলে কৌতূহল। রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে শুরু করল জাফলংয়ের সবুজে ঢাকা পথে। চারদিক ঘিরে আছে টিলা, দূরে সাদা মেঘে ঢাকা খাসিয়া পল্লীর মাথাগুলো যেন হাতছানি দিচ্ছে। পথের ধারে অদ্ভুত রকমের শান্ত পাথুরে ঝর্ণাধারা, যেখানে জলের শব্দ একটার পর একটা কবিতার পংক্তির মতো বয়ে যাচ্ছে। আদিয়াত আর আরশীন হাঁটছে পাশাপাশি। মাঝে মাঝে আরশীনের ওড়নাটা বাতাসে উড়ে গিয়ে আদিয়াতের গায়ে লাগছে। সে কিছু না বলে হেসে তাকায়, আরশীন লাজে চোখ ফিরিয়ে আবার পথ দেখে।
পায়ের নিচে কাঁচা পথ, সামনে বিশাল চা-বাগান। সূর্যটা তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে, সোনালি আলোতে চা-বাগানের পাতা ঝলমল করছে। ওরা টুকটাক কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলছে। কণ্ঠে নিঃশব্দ আবেগের ছোঁয়া। ওদের হাঁটতে ক্লান্তি নেই, হৃদয়ের মধ্যে জমা অনেক না-বলা কথা প্রকৃতির ছায়ায় হেঁটে হেঁটে নিজেদের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। এই দিনটা থাকবে হয়ত থাকবে বহুদিন… ঘাসে লাগা তাদের পায়ের চিহ্নের মতোই, মনেও গেঁথে থাকবে অমলিনভাবে!
সন্ধ্যার আবছা আলোয় আকাশে জমেছে হালকা মেঘের আস্তরণ। দূরে দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। প্রতিবার ঝলকে চারপাশটা অদ্ভুতভাবে রূপকথার মতো লাগে। আদিয়াত তখন আরশীনের কাছ থেকে আধা ঘণ্টার জন্য ছুটি চাইলো।
— “আমি একটু বের হচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরব। বেশি দেরি হবে না।”
— “আকাশটা ভালো দেখাচ্ছে না আদিয়াত…” ওর চোখেমুখে মৃদু দুশ্চিন্তার রেখা।
— “আমি সাবধানে যাবো, ভয় পাবেন না। আচ্ছা, এক কাপ চা নিয়ে বসুন এই সময়টুকু। আমি এসে পড়ব।”
আরশীন আর কিছু না বলে মৃদু মাথা নাড়ল।
অন্যদিকে, আদিয়াত হেঁটে চলেছে সিলেট শহরের গলিঘুঁজির ভেতর। সন্ধ্যার আলো আর দোকানের ঝিকিমিকি আলো মিলে একরকম মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। তার ভাবনায় তখন একটাই কথা,
“বিয়ের পর আমি ওকে কিছুই দিইনি। একটা মানুষ, যে নিজের সমস্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে আমার জীবনে এসেছে, তাকে কিছু না দেওয়া… এটা ঠিক হচ্ছে না।”
নিজের এই উপলব্ধি তাকে একটু ব্যথিত করল। হাতের মধ্যে সময় কম, আশেপাশে ঘুরে ঘুরে পছন্দমতো কিছু পাচ্ছে না। দোকানে দোকানে খুঁজছে, তবুও কোথাও কিছু ওর মন টানছে না। হঠাৎ এক কোণার ছোট্ট বুটিকের জানালায় চোখ আটকে গেল। একটা শাড়ি; গাঢ় মেরুন জমিন, তার ওপর সোনালি জরির সূক্ষ্ম কাজ, যেনো মেঘলা সন্ধ্যায় কোনো রাজকীয় নারীর পরনের উপযোগী।
শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আদিয়াতের মনে পড়ল, বিয়ের দিন আরশীনকে প্রথম শাড়িতে দেখেছিল কিন্তু ভালো করে দেখা হয় নাই।
সেই মুহূর্তটায় চাপে, দায়িত্বে, বাস্তবতার ভেতর প্রেম খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখনো বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। সে শাড়িটা কিনল। হাতে নিয়ে অনুভব করল,
— “এইটুকু দিতে পারি আমি। মানুষটা পরিচিত কিন্তু সম্পর্কটা তো নতুন… নতুন কিছুর শুরু হোক উপহারের উষ্ণতায়।” সে ফিরে চলল নিজের… উঁহু নিজেদের চেনা ঘরে, আরশীনের কাছে।
আদিয়াত যখন ফিরে এলো, তখন বাইরে বৃষ্টি একটুখানি থেমেছে মাত্র। তবে তার শরীর জুড়ে ছিল সেই বৃষ্টির ছোঁয়া, একদম গভীরভাবে। ভেজা শার্টটা গা-লাগা, ধূসর রঙ যেন গাঢ় হয়ে গিয়েছে ভিজে। কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়ছে ছোট ছোট ফোঁটা। চুলগুলো এলোমেলো, বৃষ্টির ধাক্কায় ঘাড়ে গিয়ে লেগে আছে। গালের কাছে জমে থাকা ফোঁটা ওর গম্ভীর মুখটাকে কিছুটা কোমল লাগাচ্ছিল। আরশীন দরজা খুলেই এক মুহূর্ত থমকে গেল। এভাবে ভেজা আদিয়াতকে এর আগে কখনো দেখে নাই। মনে হচ্ছিল; আলতো আলোয়, ধোঁয়াটে বাতাসে, ভালোবাসার মানুষ তার দিকেই ফিরে এসেছে কাঁপা কাঁপা বৃষ্টির গন্ধ নিয়ে।
— “ইশশশ, আপনাকে বলেছিলাম না, বের হবেন না।” আরশীন অস্থির গলায় বলল। ভেজা আদিয়াতকে দেখে ওর মুখে বিরক্তি, উদ্বেগ আর মমতার এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি হলো।
— “দাঁড়ান, আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি!” একটুও দেরি না করে দৌড়ে গেল রুমের ভেতর। কাপবোর্ড খুলে নরম একটা তোয়ালে টেনে বের করল, আর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলো।
আদিয়াত তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে, হাতে প্যাকেট রেখেছে সাইড টেবিলে। আরশীন ওদিকে তাকায়নি। তার চোখের দৃষ্টি তখন শুধু আদিয়াতের কাঁধে, ভেজা চুলে আর ঠান্ডায় হালকা করে নীল হয়ে আসা আঙুলগুলোতে আটকে আছে।
— “এই নিন।” আরশীন তোয়ালেটা বাড়িয়ে দিল আদিয়াতের দিকে। “ভিজে গেলে ঠান্ডা লেগে যাবে…”
আদিয়াত হালকা হেসে বলল,
— “আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু আরশীন শুনছে না। সে তখন ওর ভেজা চুলের ভেতর তোয়ালে গুঁজে দিচ্ছে…
— “কী এমন জরুরী কাজ পড়ল আপনার? কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? কাজ কি পরে করা যায় না?”
আদিয়াত ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে এলো। ভেজা চুলগুলো পেছনে রাখা, মুখে হালকা জলের ঔজ্জ্বল্য, কাঁধে নেমে আসা শার্টের খোলা কলারে যেনো আলগা একটা ভরসা, তার চোখে ঠান্ডা স্থিরতা। সে ধীরে পা ফেলে আরশীনের কাছে এসে দাঁড়াল। হাতে রাখা ছোট প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
— “এটা আপনার জন্য। এটা আনতেই তো বের হয়েছিলাম।”
আরশীন কিছুটা বিস্মিত হয়ে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল।
— “কি এটা?”
— “খুলে দেখুন।”
আরশীন প্যাকেটটা খুলে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে একখানা দারুণ শাড়ি বের করল। রঙটা এমনই, যেনো ঠিক ওর জন্যই বাছাই করা। চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
— “এটা কেনো?” ওর কণ্ঠে ছিল অবিশ্বাসের মিশ্রণ, একরাশ লজ্জা।
আদিয়াত হালকা হাসল।
— “বিয়ের পর আপনাকে কিছু দিয়েছিলাম?”
আরশীন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “কিছু দিতে হবে কেনো? আর দেন নাই আপনি? আপনি তো আপনাকে দিয়েই…” ওর কণ্ঠ হঠাৎই ক্ষীণ হয়ে এলো। কথাটা শেষ না করেই আরশীন চুপ হয়ে গেল। আদিয়াত একটু ঝুঁকে এল তার দিকে। গলা একটু গভীর হলো, গম্ভীরতায় মিশল প্রশ্ন,
— “আমাকে? আমাকে কি?”
আরশীন ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে জিভ চালাল একবার। চোখ তুলে তাকাল আদিয়াতের চোখে, কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “আপনাকেই তো… দিয়ে দিয়েছেন নিজেই। চাইলেও আর ফেরত নেওয়া যাবে না।”
আদিয়াত এবার এক পা এগিয়ে এসে বলল,
— “তাহলে আমি এখন… আপনার সম্পত্তি?”
— “তারচেয়েও বেশি।”
আদিয়াত ধীরে, কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
— “আমাকে চাই আপনার?”
আরশীন থমকে গেল। এক মুহূর্ত তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, চোখ তুলে তাকাতে গিয়েও পারল না। বুকটা যেন কোনো অজানা শঙ্কায় ধুকপুক করছিল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল, বড় বড় করে শ্বাস ফেলল। সে কিছু বলতে চাইল না বরং যেন পালাতে চাইছে, পিছিয়ে যেতে উদ্যত।
কিন্তু আদিয়াত তাকে ছেড়ে দিল না। ধীরে দুপাশে হাত বাড়িয়ে, ওকে ঘিরে ধরল। গড়ে তুলল এক ধরনের নিঃশব্দ বেষ্টনী যেখানে পালানোর কোনো রাস্তা নেই, কেবল সত্যিটাকে মেনে নেওয়ার একমাত্র পথ রয়ে গেল। আবারও, এবার একটু গা ছমছমে স্থিরতায় জিজ্ঞেস করল,
— “আমাকে চাই আপনার?”
আরশীনের ঠোঁট কাঁপে। দৃষ্টি দুলে ওঠে। সে ধরা গলায় বলল,
— “আমি… মানে…”
আদিয়াত ওর ঠোঁটে আঙ্গুল রাখল। চোখ গেঁথে রাখে ওর চোখে। প্রশ্নের চাপে, অনুভবের ওজনে ভারী হয়ে ওঠে মুহূর্তটা।
— “শশশশশ, ইয়েস? ওর নো?” কণ্ঠটা এবার আর কোমল ছিল না, ছিল প্রবল আবেগে গাঁথা সাহস, যেন সে আর প্রতীক্ষা করতে চায় না। আরশীন উত্তর দিল না। কিন্তু ওর চোখে যা ছিল, সেটা উত্তর না দিয়েই সব বলে দিল। সে হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরল আদিয়াতকে। শক্ত করে, যেনো ওর সমস্ত আবেগ, সমস্ত দ্বিধা এক নিমিষেই আলিঙ্গনে ঢেলে দিল। ও এমনভাবে মুখ লুকালো আদিয়াতের বুকের গভীরে, যেনো খুঁজছে কোনো গোপন কুঠুরি। পরের মুহূর্তে আদিয়াত তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নিল শক্ত করে, গভীর আশ্বাসে। আরশীন একরাশ বিস্ময়ে আদিয়াতের বুকের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেল, মাথা গুঁজে দিল বুকে। ওই বুকের শব্দই ওর নিজের হৃদয়ের তালের মত বাজছে। তারপর আদিয়াত আলতো হাতে আরশীনের থুতনিতে স্পর্শ রাখল, নির্বাক আহ্বানের মতো। ধীরে মুখটা উঠিয়ে নিল নিজের দিকে, আরশীনের কাঁপা দৃষ্টির গভীরে ডুবে গেল কিছুক্ষণ। একটা নিঃশব্দ টান, একটা অব্যক্ত চাওয়া… সারা মুখে চুমু ছড়িয়ে দিল আদিয়াত; কখনো আবেগে, কখনো সম্মোহনে। চোখ, গাল, কপাল, সবখানে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেনো বলছিল, “আপনি আমার…”
অতপর সেই অবাধ্য স্পর্শ থমকে দাঁড়াল ওর ঠোঁটে এসে; একটা অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞা, এক অনিবার্য আকর্ষণ। ওষ্ঠ্যে এসে থেমে গেল সমস্ত শব্দ, সমস্ত ব্যাখ্যা। সেই চুমু ছিল যেনো দুজন মনের সব শব্দের শেষ পংক্তি।
আদিয়াতের দুই হাত আরশীনের মুখের পাশে, যেন এক পৃথিবী আগলে রেখেছে সে। তার দৃষ্টিতে ছিল আশ্রয়, ছিল দখল, ছিল কিছুটা প্রশ্ন… কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল নিবিড় ভালোবাসা। আরশীন সেই দৃষ্টির নিচে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিল। ঠোঁটে এসে থেমে যাওয়া চুমুটা যেন ছিল অপেক্ষার, সম্মতির, অথবা কিছু পবিত্র চুপচাপ অনুভবের ছোঁয়া। আরশীন চোখ বুঁজে ফেলল। ঠোঁট কাঁপল, নিঃশ্বাসে অনুরণন তৈরি হল। আদিয়াত তখন একফোঁটা শব্দ না করে ওর ঠোঁটে কষ্টহীন এক চুমু আঁকল… গভীরভাবে! চুমুর গভীরতায় মুহূর্তটা থমকে রইল। সময় নিঃশব্দে থেমে গেল ওদের চারপাশে। আদিয়াত ধীরে ধীরে ওকে নিজের বাহুর পরিসরে নিয়ে এলো। আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিল। একটা মায়াবী প্রশ্রয় আরশীনের ভেতরকার ঝড় শান্ত হতে হতে ফের বিগড়ে যাচ্ছিল।
তাল মাতাল একটা মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল। হৃদয়ের তালে তালে ঝাঁকুনি লেগে উঠল, স্পর্শগুলো যেন সুরের মতো মিশে গেল। দুটি হৃদয় একসাথে নেচে উঠল, কানে গুঞ্জরিত হলো মনের অদৃশ্য সুর। আদিয়াতের দৃষ্টিতে ছিল টান, ছিল টলমল উত্তাপ। একফোঁটা দ্বিধাও নেই। সে জানে, এই মেয়েটিই তার সবচেয়ে আপন। সে বিন্দু পরিমাণ দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়, একহাত দিয়ে আলতো করে আরশীনের এলোমেলো চুল সরিয়ে দেয় কপাল থেকে। আরেক হাতে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনে।
— “আপনি জানেন না, আমি কেমন করে ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে!” ফিসফিসিয়ে বলে সে। তারপর নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায় আরশীনের গাল। হৃদয় ছুঁয়ে যায় ওর চোখ। বুকের গহীনে জমে থাকা আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি ছোঁয়ায়। আরশীন শুধু একটুখানি বলার সুযোগ পেল,
— “আপনি কি পাগল করে ফেলবেন আমাকে? আপনি কি…” একটা মুহূর্ত নির্বাক, নিবিড়; যেখানে শব্দ নয়, স্পর্শই ভাষা হয়ে ওঠে। আরশীন সেই প্রেমাসক্তি ছায়ার মতো মেখে নেয়। নিজেকে আর লুকায় না, আর ঠেকায় না। সে ওকে নিজের সবটুকু অনুভবে জড়িয়ে ধরে। ঘরের বাতাস তখন ওদের শ্বাস- প্রশ্বাসের মতই একটু ভারী হয়ে এলো।
এই ছিল স্বীকারোক্তির চূড়ান্ত রূপ—শব্দহীন, অথচ সবচেয়ে স্পষ্ট।
ভালোবাসা, যা কোনো “হ্যাঁ” বা “না” চায় না, কেবল বোঝে হৃদয়ের কম্পনে।
.
.
.
চলবে….
#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২১]
~আফিয়া আফরিন
(চাতুর্যের অন্তস্তলে)
রাতটা বাস্তবের থেকেও বেশি স্বপ্নের মতো ছিল। এতটা গভীর, এতটা পূর্ণ, এতটা আপন, যা ভাবনাতেও ছিল না। একটা শরীরী ছোঁয়া ছাড়িয়ে, মন থেকে মন ছুঁয়ে যাওয়ার মুহূর্ত… এমন একটি রাত, যেখানে শব্দ ফুরিয়ে গিয়েছিল, চোখ বলেছিল সব, নিঃশ্বাসে গলেছিল কথা। আরশীন আর আদিয়াত যেন একে অপরের সমস্ত একাকিত্ব ঢেকে দিয়েছিল।
সকালটা এল নিঃশব্দে… পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের হালকা আলো ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছিল। আরশীনের ঘুম হঠাৎই ভেঙে গেল। কুন্তলা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে। তার চোখের পাতা কেঁপে উঠল। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারল না, তারপর হঠাৎ খেয়াল করল তার মাথা আদিয়াতের বাহুতে রাখা। আর আদিয়াত গভীর ঘুমে। ওর নিঃশ্বাসের গতি স্থির। একপলক তাকিয়ে রইল আরশীন। চোখ সরাতে পারছিল না, অথচ চোখ মেলতেও সাহস করতে পারছিল না। লজ্জা… খুব চুপিসারে ওর গাল বেয়ে নেমে এলো। নিজেকে একটু সরে নেবার চেষ্টা করল; ধীরে, নিঃশব্দে। কিন্তু বাহু থেকে মাথা তুলতেই আদিয়াত একটু নড়ে উঠল। আরশীন সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। সেই ঝড়-তুফানের রাতের মতোই ভেতর কাঁপছিল কিন্তু বাইরে নির্বিকার থাকার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত।
“সারারাত এমনভাবে ছিলাম ওর সাথে? আদিয়াত জানে? বুঝেছে কিছু? সারারাত এইভাবে থাকতে কষ্ট হয় নাই ওর?” মনের ভেতর কুয়াশার মতো প্রশ্ন ঘুরে বেড়াতে লাগল।
চারপাশে নিস্তব্ধতা… আদিয়াত ধীরে ধীরে চোখ মেলল। চোখ খুলেই প্রথম যে মুখটা চোখে পড়ল, সে আরশীনের; চোখে একরাশ লজ্জা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আদিয়াত মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
— “এভাবে চুপচাপ তাকিয়ে আছেন কেন?”
— “ঘুম ভেঙে গেছে।”
— “ঘড়ি দেখছেন?” আদিয়াত জিজ্ঞেস করল।
— “হ্যাঁ, দশটা বাজতে চললো।”
— “তাই নাকি? আপনি তো দেখি আমার সময়জ্ঞানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।”
— “তাই? আর কী কী বারোটা বাজিয়েছি শুনি?” আরশীন ভুরু কুঁচকাল।
— “আমার। আমার সকাল, বিকেল, রাত… সবকিছুরই।”
আরশীন হেসে ফেলল,
— “তাহলে কি বলব নিজেকে? আপনার দৈনিক বিপর্যয়?”
— “না, আপনি আমার প্রতিদিনের প্রয়োজন। সম্ভব হলে আমি ঘড়ির কাঁটা বন্ধ করে রাখতাম।”
— “এতটা পাগল হলেন কী করে?
— “কেন? তাতে অস্বস্তি লাগছে?”
— “উঁহু। স্বপ্নের মত লাগছে।” আরশীন চোখ বন্ধ করে বলল।
আদিয়াত আলতো হেসে আরশীনের হাতটা নিজের আঙুলে পেঁচিয়ে নিল।
— “স্বপ্ন হলে আমি চাই না কখনো ঘুম ভাঙুক।”
— “আপনি পুরোপুরি আমার কাছে এসেছেন নাকি এখনও কোথাও কোনো দ্বিধা আছে।” আরশীন কিঞ্চিত কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
— “গতকালটা এমনভাবে গেল যে সেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসে আপনার নাম। তারপর আর দ্বিধা থাকে?”
— “তবুও আমি জানতে চাই। আমি একা ভালোবাসছি নাকি দু’জনেই সমানভাবে আছি এখানে?”
— “আপনি শুধু ভালোবাসেননি, আপনি আমাকে গড়ে তুলেছেন। আমি কখন যে পুরোটা আপনার হয়ে গেছি, সেটা বুঝতেই পারিনি।”
আরশীন চুপ করে যায় কিছুক্ষণ। আদিয়াত ওর হাত নিজের বুকে রেখে বলে,
— “এই বুকের স্পন্দনটা এখন আপনার নামে চলছে। দ্বিধার কোনো জায়গা রাখিনি আমি।”
— “তাই?” আরশীনের মুখটা হাসি হাসি দেখাল।
— “হুম… কারণ আমি জানি, আপনি আমায় চেয়েছেন যেমন করে ঠিক তেমনি আমিও আপনাকে চেয়েছি।”
— “আপনার এই নিশ্চিন্ত ভরসাটুকু আমি কোথাও পাইনি আগে।”
— “পাবেনও না। কারণ এটা কেবল আমার কাছেই তোলা ছিল, শুধু আপনার জন্য।” আদিয়াত হেসে বলল।
আরশীন একটু হেসে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। আদিয়াত তখন থুতনিতে আলতো ছোঁয়া দিয়ে ওর মুখটা নিজের দিকে ফেরায়,
— “আবার লজ্জা পাচ্ছেন?”
— “না… তবে আপনি যখন এভাবে তাকান, মনে হয় নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারব না।”
— “লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। এখন থেকে আপনার সবটুকুই আমার জানা দরকার। আপনার হাসি, অভিমান, খুঁতখুঁতে মেজাজ, ভালোবাসা…”
— “আর আপনি?”
— “আমি? আবার জিজ্ঞেস করছেন? আমি তো অনেক আগেই আপনাকে দিয়ে দিয়েছি নিজেকে।”
দু’জনের চোখে চোখ পড়ে যায় আবার। নিরবতা ভরে ওঠে হৃদয়ের শব্দে। পরবর্তী মুহূর্ত সময়ের গহীনে বাঁধা পড়ে গেল। আদিয়াত আর আরশীন পাশাপাশি বসে ছিল এক টিলার কিনারে, সামনে বিস্তীর্ণ সবুজ চা-বাগান, দূরে সুর করে বাজছিল বৃষ্টিভেজা পাখির ডাক। বাতাসে ভেসে আসছিল লেবু ফুলের হালকা গন্ধ। চুপ করে থাকা আকাশটাও যেনো ওদের পাশে থাকার আশীর্বাদ করল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর সবুজ পাতাগুলোতে জমে থাকা পানির ফোঁটা টুপটাপ করে ঝরে পড়ছিল; তেমনই নরম, তেমনই গভীর ছিল সেই মুহূর্ত। এইবার সমস্ত পিছুটান পেছনে ফেলে, ওরা ছুটল মাধবকুণ্ডের দিকে।
চোখের সামনে খুলে গেল সবুজ পাহাড়ের পটে আঁকা জলের এক অবিরাম সংগীত। সড়ক থেকে পাহাড়ি পথ, তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছে গেল ঝর্ণার গর্জনের কাছে। জলের ছিটে, হাওয়ার ছোঁয়া আর প্রকৃতির নিঃশব্দ হাসি। সকালে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ ওরা পৌঁছে যায় মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের পাদদেশে। ঝর্ণার গর্জন এক ধরনের সুরেলা শব্দের মতো বাজছিল কানে। পানি নিচে পড়ে সাদা ধোঁয়া তুলছে, সেই স্রোতের শব্দে মিশে আছে এক মায়াবী ছন্দ।
আরশীন একটু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জলপ্রপাতের সামনে। আদিয়াত ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরে আরশীন ফিসফিসিয়ে বলে,
— “এতো উচ্চতা থেকে পড়ে আসা জলের শব্দটাও কেমন শান্তি দেয়, না?”
আদিয়াত তাকিয়ে বলে,
— “অথচ আপনার ভেতরেও একটা এমন ঝর্ণা আছে। বাইরে শান্ত, ভিতরে উচ্ছ্বসিত।”
আরশীন হেসে ফেলে। হাওয়ায় ওর চুল উড়ছে, চোখে জলকণা, ঠোঁটে কোমল প্রশান্তি। ওরা ধীরে ধীরে হাত ধরে হাঁটতে থাকে পাশের পাথুরে পথ ধরে। পা ভেজে যায় জলের ছিটায়, কিন্তু তাতে যেনো প্রেম আরও গভীর হয়ে ওঠে। আরশীন হঠাৎ থেমে যায়। বলে,
— “এই দৃশ্যটা আপনাকে নিয়ে দেখা হলো বলেই মনে থাকবে।”
আদিয়াত ওর হাতটা শক্ত করে ধরে। পাহাড়ি পথ, ঝর্ণার গান, সবুজে মোড়া সেই নির্জনতা; সব মিলিয়ে মাধবকুণ্ড হয়ে উঠল এক প্রেমিক জুটির ভালোবাসার অনবদ্য সাক্ষ্য।
সিলেটে আরও তিনদিন কাটল ওদের দুচোখ ভরে দেখা, দু’হাত ভরে ছোঁয়া আর মন ভরে অনুভব করার মাঝে। প্রতিটি সকাল শুরু হতো কুয়াশা মেশানো সবুজের গন্ধে, চা-বাগানের নিঃশব্দ সৌন্দর্যে।
দুপুরগুলো কেটেছে পাথরঘাটার কোলঘেঁষা জলের ধারে হাঁটতে হাঁটতে কিংবা লালাখালের নৌকায় চুপচাপ বসে। বিকেল হলে ওরা চলে যেত কোন না কোন পাহাড়ি কোণে। মালনীছড়া, বিছানাকান্দি, জাফলং… রাতগুলো কেটেছে আলো-আঁধারির মধ্যে হাসি, গল্প, আর নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি বুনে। সিলেট বোধহয় তাদের প্রেমের অনুচ্চারিত কবিতা হয়ে উঠেছিল, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে একেকটা অনুরণন রেখে। সিলেটের দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে তাদের ভালোবাসা আরেকটা রূপ পেল, সুনির্বাচিত প্রতিজ্ঞার!
অবশেষে সময় হলো বাড়ি ফেরার। কোনো মধুর স্বপ্ন থেকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠার মুহূর্ত। গাড়ির চাকা যখন ধীরে ধীরে সিলেট ছেড়ে শহরের কোলাহলের পথে এগোতে শুরু করল, তখন একরাশ স্মৃতি বুকে চেপে দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। চলে আসবে মাঝেমাঝে, এই শহর তাদের ভালোবাসার বুনন গেঁথে দিয়েছে জোরালোভাবে। ভালোবাসার টানেই ফিরে আসবে… আসতেই যে হবে।
ফিরে যাওয়ার পর যেন চারপাশে বাস্তবের কড়া আলো। সিলেটের রঙিন স্বপ্ন ফেলে ওরা ঢুকে পড়ল চেনা পরিবেশে। যেখানে প্রতিটি দৃষ্টির আলাদা ভাষা, প্রতিটি কথার আড়ালে কিছু না কিছু থাকেই। আলিয়া এসেছে। ওদের দেখে বেশ খুশি হয়ে এগিয়ে এলো। ওর ভেতরের দুঃখি ভাবটা লক্ষ্য করা গেল না। জহিরুল ইসলাম বাসায় ছিলেন না। নাজনীন এগিয়ে এলেন গম্ভীর মুখে, কপালে ভাঁজ স্পষ্ট। ওদের দেখে প্রথমে কিছু না বলে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎই আদিয়াতকে বললেন,
— “তুই কি একটা কথা শোনার মানুষ নস? এভাবে না বলে চলে যেতে হয়?”
আদিয়াত একটু থতমত খেয়ে গেল।
— “তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত মা। কয়েকদিন আগেই আমাকে বলছিলে, বিয়ে করে বউকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
— “খুশি? না বলে উধাও হয়ে গেলে কোনো মা খুশি হয়?”
এইবার পাশ থেকে আরশীন মিটিমিটি হেসে বলল,
— “আমি কিন্তু আপনাকে বলতে বলেছিলাম। উনি আমাকেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।”
নাজনীন চোখ ছোট করে আদিয়াতের দিকে তাকালেন,
— “তুই তোর বউকেও কথা বলতে দিস না এখন? খুব লাট সাহেব বনে গেছিস না?”
আদিয়াত গলা খানিকটা খাঁকারি দিয়ে মৃদু হেসে বলল,
— “আরে মা তুমি তো জানোই, আমার প্ল্যান হুট করে হয়… আর এইবার তো চুপিচুপি একটু সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছেই ছিল।”
— “সারপ্রাইজ! আমি কী ভয়ে ভয়ে ছিলাম। একবার ফোন দিয়েই লাপাত্তা। তারপর একটা ফোন নাই, একটা খোঁজ নাই।”
আলিয়া এগিয়ে এসে তর্কাতর্কির ইতি টানল। ওরা জার্নি করে এসেছে, ফ্রেস হোক, খাওয়া-দাওয়া করুক, তারপর না হয় আবার শুরু করা যাবে। বেশ কয়েকদিন পর আরশীনকে দেখে তার নিজেরও ভালো লাগল। কেমন আপন আপন মনে হয় ওকে…
দু’জন যখন ঘরে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখন নাজনীন ডেকে পেছন থেকে বললেন,
— “দেখিস, আর একবার এমন করলে আমিও তোর বাবাকে নিয়ে পালাব।” সবাই একজোটে হেসে উঠে মুহূর্তটা হালকা করে দিল।
.
এই ক’দিনের অভিজ্ঞতা যেন আরশীনের হৃদয়ে গেঁথে থাকা এক ঝলমলে উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়। ফিরেই আলিয়ার সঙ্গে বসে সবটা ভাগ করে নিল; একটা উৎসাহে টগবগ করা, হাসিতে টলমল করা মুহূর্তে। আলিয়ার সামনে আরশীন খুলে ফেলল নিজের সমস্ত অনুভূতির দুয়ার। কুয়াকাটার সমুদ্র, গঙ্গামতীর চর আর লেবুর চরের নির্জন সৌন্দর্য, সেখানকার সূর্যাস্তের রঙিন আভা, জাফলং-এর জলের স্বচ্ছতা, পাহাড়ের নীরবতা; সবই যেন ছিল একেকটি ছবি।
আরশীন শুধু বলল না, কীভাবে আদিয়াত একেকটা মুহূর্তে তাকে আপন করে তুলেছে। কীভাবে অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ভালোবাসার ছায়া নেমে এসেছিল চোখের পাতায়।
ঘরে ফিরে এসে দেখল ভীষণ নীরব সন্ধ্যায়, যখন আলো নরম হয়ে এসেছে, বাইরের আকাশে রঙ ছড়াচ্ছে গোধূলির আলো; আদিয়াত একা বসে ছিল বারান্দায়। তার চোখে ছিল দৃষ্টির গভীরতা, মুখে এক ধরনের দ্বন্দ্বের ছায়া। আরশীন ঠিক তখন পাশে এসে বসে।
— “চুপচাপ বসে আছেন কেন?”
— “ভাবছিলাম কিছু…” সে আর বলতে চাইল না। কারণ সে জানে, কিছু সত্য অল্প সময়ে বলা ঠিক নয়।
আমিনুল ইসলাম তার আপন চাচা, বাবার অগাধ বিশ্বাস যার প্রতি তিনিই এখন আদিয়াতের চোখে এক বড় শঙ্কার উৎস। সে চায় না আরশীন জানুক, এই বিশ্রী পটভূমিতে তার পরিবারের কেউ জড়িত আছে। জানাজানি হলে পরিবারের আস্থার ভিত নড়ে উঠবে। সে চায় না বাবা জানুক, যার ঘাড়ে মাথা রেখে এতদিন নিশ্চিন্ত ছিলেন; তার ছায়াতলেই গাছটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই আদিয়াত চুপ করে থাকল। নিজের ভেতরে একটা দৃঢ় সংকল্প বুনে ফেলল, একবার। শুধু একবার চাচাকে সে সুযোগ দেবে। নিজের মতো করে, একান্তে কথা বলবে তার সঙ্গে। সমস্ত হিসাব-নিকাশ বুঝে নেবে।
আরশীন ওর মুখের ভঙ্গিমা দেখে কিছুটা বুঝলেও কিছু বলল না। পাশে বসে হাতটা ধরল আলতো করে। আদিয়াত তখন ডাকল ওকে,
— “আরশীন!”
— “হুমমম।”
— “কিছু সম্পর্ক রক্ষা করতে হলে, কিছু বোঝা একা বয়ে নিতে হয় তাইনা?”
— “হয়ত।” আরশীন ছোট্ট করে উত্তর দিল।
— “ঠিক আছে।” এই মুহূর্তে সে শুধু নিজের নীতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সত্য প্রকাশ করবে, তবে সময় হলে। আর সিদ্ধান্ত, তার একার। শুধু দায়িত্ববোধে নয়, সর্ম্পকের দায়ে…
আরশীন অনুভব করেছিল, আদিয়াতের ভিতরে কিছু একটা নীরবে ঘূর্ণায়মান। চোখে-মুখে, আচরণে, এমনকি নীরবতাতেও একটা ভার খেলে যাচ্ছে। ও বুঝেছিল, আদিয়াত হয়তো কিছু লুকোচ্ছে। তবুও সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ভালোবাসার গভীরতা কখনো কখনো প্রশ্নে নয়, অপেক্ষায় মাপে। আরশীনও ঠিক সেই কাজটাই করল। আদিয়াত যদি মনে করে বলা দরকার, তবে সে বলবেই।
—
ব্যস্ততা আবার পুরো ছন্দে ফিরে এলো। আগের নিখুঁত গতি আর দায়িত্ববোধ নিয়ে পরদিন সকালে আদিয়াত ঢুকল অফিসে। দীর্ঘ কয়েকদিনের অনুপস্থিতির পর তাকে দেখে সহকর্মীরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মারুফ হেসে বলল,
— “স্যার আপনার অবর্তমানে পুরো অফিস গতি হারাতে বসেছিল।”
— “আরে ভাই, তো তোমরা আছো না। ঠিক সামলে নিতে।”
আদিয়াত কেবিনে ঢুকে জানালার পর্দাটা হালকা সরিয়ে বাইরের আলোটুকু ভেতরে আসতে দিল। তার দৃষ্টিতে কিছুটা অন্যমনস্কতা।
এই কয়েকদিনে সশরীরে অফিসে না থাকলেও, সে প্রতিটি কাজের খুঁটিনাটি তদারকি করেছে। কোনো ফাইল তার চোখ এড়ায়নি, কোনো সিদ্ধান্ত অনুমতি ছাড়া যায়নি। অনুপস্থিত হলেও সে ছিল সর্বত্র।
চেয়ারে বসতেই মারুফ এসে ফাইলের একটা স্ট্যাক রেখে বলল,
— “স্যার, আপনার সাইন লাগবে।”
আদিয়াত কিছুটা খাপছাড়া ভঙ্গিতে বলল,
— “তোমাদের আমিনুল স্যার অফিসে উপস্থিত রয়েছেন?”
এই প্রথম, চাচাকে “চাচা” না বলে “আমিনুল স্যার” বলল। হয়তো সম্পর্কের একটা দেয়াল নিজের ভিতরে সে আজ তুলেই নিয়েছে। মারুফ খানিকটা বিস্ময় বোধ করলেও প্রশ্ন করল না।
সে একটু দ্বিধা নিয়ে বলল,
— “জি স্যার, কিছুক্ষণ আগেই বড় স্যারের কেবিনে ঢুকেছেন।”
আদিয়াত হালকা মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
— “ঠিক আছে। নীরা বোধহয় জয়েন করেছে, তাই না?”
— “জি স্যার। নীরা ম্যাডামের আজ প্রথম দিন। উনি আপনার আন্ডারেই আছেন।”
— “ঠিক আছে, পরবর্তী এসাইনমেন্টটা ওকে দিয়ে দাও। পরে আমি নিজে কথা বলব।”
ব্রেক টাইমে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আদিয়াত পৌঁছাল আমিনুল ইসলামের কেবিনে। তার মুখে কোনো সৌজন্যের ছায়া নেই, চোখে দৃঢ়তা আর ঠোঁটে চাপা সংযম। কেবিনে ঢুকেই বিন্দুমাত্র ভনিতা না করে হাতে ধরা কয়েকটা ফাইল ঠাস করে আমিনুলের টেবিলে রাখল।
তারপর চেয়ার টেনে একেবারে চোখের সামনেই বসে পড়ে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর স্বরে বলল,
— “দেখুন।”
আমিনুল ইসলাম থমকে গেলেন। আদিয়াতের এমন বেয়ারা ধরনের রূপ তার চেনা নয়। এমন কঠোর, এমন সংযত অথচ জ্বলন্ত দৃষ্টির মুখোমুখি তিনি খুব কমই হয়েছেন। একটু দ্বিধা নিয়ে ফাইলগুলো হাতে তুললেন।
প্রথম পাতায় চোখ রাখতেই ঠোঁট শুকিয়ে এলো। পরের পাতা… আরেকটা হিসাবের ছিদ্র, তৃতীয় পাতায় ঘাপলা… চতুর্থ পাতায় স্পষ্ট দুর্নীতির ছায়া। সব যেন নথিভুক্ত, সাজানো, নির্ভুলভাবে উপস্থাপিত।
তার চোখ কপালে উঠল। কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। এটা তো তার সমস্ত ‘জারিজুরি’র দলিল! এত নিখুঁতভাবে কেউ যে এসব জোগাড় করতে পারে, তিনি কল্পনাও করেননি। আদিয়াত একই ভঙ্গিতে বসে রইল, চোখে চোখ রেখে। যেন বলছে,
“আজ আপনার মুখ, আপনার বিবেক, আপনার লজ্জা; সব নিজেই কথা বলুক।”
আদিয়াত আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না ওনার প্রতিক্রিয়ার জন্য। বরং নিজেই একরোখা অথচ কঠিন কণ্ঠে বলল,
— “দেখলেন তো? আশা করি বুঝতে পেরেছেন সবটা। এইবার আপনার সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে, যা গণ্ডগোল করেছেন তার মাশুল দেওয়া। আমি আপনাকে আজ থেকে, এখন থেকে, এই মুহূর্ত থেকে দুই দিন সময় দিচ্ছি; হিসাবটা ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দেবেন। আমার পক্ষ থেকে এটা আপনার জন্য ফাস্ট এবং লাস্ট আল্টিমেটাম।”
আদিয়াতের কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা ছিল না, কিন্তু একধরনের শীতল দৃঢ়তা ছিল যেটা চিৎকারের থেকেও বেশি ভয়াবহ। আমিনুল ইসলাম নিশ্চুপ। কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই, শুধু মুখ শুকিয়ে গেছে। আদিয়াত দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ঘুরে তাকিয়ে আরেকবার স্পষ্টভাবে বলল,
— “দুই দিন মানে শুধুমাত্র দুই দিন।”
তারপর কোনো শব্দ না করেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কেবিনে পড়ে রইল স্তব্ধতা, টেবিলজোড়া ফাঁস হওয়া হিসাব আর আমিনুল ইসলামের চুপচাপ বিবর্ণ মুখ।
আমিনুল ইসলামের মগজের ভিতর যেন ঘূর্ণিঝড় উঠেছে। তিনি কখনও কল্পনাও করেননি, আদিয়াত এতটা নিশ্চুপে নিঃশব্দে তার সব গোপন কু-কীর্তির জাল উল্টে দেবে। বুকের ভেতর চেপে থাকা আতঙ্ক এক ধাক্কায় উঠে এলো গলায়। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে হিসেব কষলেন,
যদি আদিয়াত জানে, তবে বড় ভাই জানতেও খুব একটা সময় নেবে না। মান-সম্মান, পদ-পদবি, দাপট, সবকিছু ভেঙে পড়বে মুহূর্তেই। এটা হতে দেওয়া যাবে না। তিনি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে কেবিন ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। যেন একটা আগুন তার পেছনে ছুটছে। সরাসরি শহরের এক গলিপথে, তার অপরাধের সঙ্গী রেজার কাছে পৌঁছালেন। সিগারেট হাতে রেজা অবাক হয়ে বলল,
— “এই সময়ে এখানে? সব ঠিক আছে তো?”
আমিনুল কাঁধে হাত রেখে চুপচাপ বসে পড়ে বললেন,
— “না রেজা… সব শেষ হয়ে যাবে। আদিয়াত সব জেনে গেছে। এবার বড় ভাই জানলেও আর ফেরার পথ থাকবে না।”
রেজা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— “তাহলে এখন কী করবেন?”
— “যারা আমাকে শেষ করতে চায় আমি তাদের শেষ করে দিব।”
রেজা বোধহয় মনে মনে খুশি হলো। একটা পুরোনো হিসাব আছে আদিয়াতের সাথে… যেটা ও জানে না। এবার সময় এসেছে সেটা ওকে মনে করিয়ে দেওয়ার। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। এবার শুধু খেলা শুরু করার সময়। তাদের চারপাশে হালকা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। শহরের কোণে তখন একটা অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের ছায়া জমতে শুরু করল।
.
.
.
চলবে….