তবুও তুমি পর্ব-২২+২৩+২৪

0
17

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২২]
~আফিয়া আফরিন

(শঙ্কায় আশঙ্কা)
ষড়যন্ত্রের জাল ওরা এঁকেছিল নিখুঁত কৌশলে, অন্ধকারের গভীরতা তাদের আরও জোড়ালোভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছিল। আমিনুল ইসলাম আর রেজা দু’জনেই জানে, “সরাসরি আঘাত মানেই বিপদ।” একটাই উপায়, এমন কিছু ঘটাতে হবে যেন সেটা দেখে সবাই দুর্ঘটনা বলে ভাবতে বাধ্য হয়।
একটা এক্সিডেন্ট… নিখুঁত পরিকল্পিত এক্সিডেন্ট। না থাকবে সাক্ষী, না থাকবে অভিযোগ। না থাকবে আঙুল তোলার সুযোগ; থাকবে শুধু দুঃখ, হাহাকার আর শোকের পর্দা। আমিনুল কাগজে স্কেচ করে দেখাল রেজাকে, একটা নির্দিষ্ট রুট, একদম নিরিবিলি অংশ; এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন আদিয়াত যাওয়া-আসা করে। আমিনুল বললেন,
— “সাবধানে। আদিয়াত যেন কিছুতেই টের না পায়। ওর মগজের পরতে পরতে বুদ্ধি।”
রেজা ঠোঁট চেপে হাসল,
— “এইবার সে বুঝে উঠতে উঠতেই… সব শেষ।”

তাদের গলায় কোনো কাপুরুষতা ছিল না, ছিল শুধু অন্ধ ঈর্ষা আর নিজেদের বাঁচানোর নির্মম ইচ্ছা। ওই অন্ধকারে ওদের চোখে ভর করেছিল হিংস্রতা। কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত এই ষড়যন্ত্রের পেছনে দাগ থাকবে না। শুধু থাকবে এক শীতল, মিথ্যে অপঘাত… যেটাকে সবাই বলবে—“দুর্ভাগ্য।” আর সত্য? সেটা চাপা পড়ে থাকবে সেই বাঁকের নিচে, চাকার ঘর্ষণে মিশে যাবে রাস্তায়, আর একটা জীবন; হয়তো নিঃশব্দে মুছে যাবে…
.
আদিয়াত ঘুণাক্ষরেও টের পেল না তার পেছনে কী চলছে। আদিয়াত কেন? অবশ্য কেউ টের পেল না। সেদিন সকালটা ছিল অদ্ভুত শান্ত আর স্নিগ্ধ। আদিয়াত চেয়ারে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে আরশীনের সাথে টুকটাক কথাবার্তায় ব্যস্ত, আরশীন একমনে তার চুল ঠিক করছিল আয়নার সামনে। আদিয়াত হঠাৎ বলল,
— “আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না একদম।”
— “মাঝেমাঝে কি হচ্ছে আপনার বলুন তো?”
— “সকালটা এত সুন্দর। আপনার সাথে আরামে গল্প হচ্ছে, এই শান্তিটা কেড়ে নিতে মন চাইছে না।”

আরশীন হেসে বলল,
— “এমন গল্প তো সকাল সন্ধ্যা, সবসময় হবে।”
— “আমার বাকি জীবনটা যদি শুধু এই সবসময়ের ভেতর ডুবে থাকে, তাও কম পড়বে বোধহয়।”
— “নয়া নয়া প্রেমে পড়ে দেখি আপনার বেশ ভালো রকম অধঃপতন হয়েছে।”

আদিয়াত হেসে জবাব দিল,
— “নয়া নয়া প্রেম? কথাটা আপনি একদম ভুল বলেন নাই।”

আরশীন হালকা ধমকের মতো স্বরে বলল,
— “হয়েছে, এখনকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। বেশি মিষ্টি কথা বলে অফিস ফাঁকি দেয়া যাবে না। কটা বাজে?”

আদিয়াত অলসভাবে ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল,
— “নয়টা পেরিয়ে গেছে। আচ্ছা, একটু দেরিতে বের হই, দশটা বাজুক তারপর বের হব।”
আরশীনের জানা ছিল না তার এই তাড়াহুড়ো একটা সর্বনাশের বীজ বপন করছে। এই তাড়াহুড়োই হয়তো ভাগ্য লিখে রেখেছিল নতুন কিছু ঘটনার সূচনা হিসেবে। ঘুণাক্ষরেও আদিয়াত টের পায়নি, বাইরে কারা তার জন্য জাল বুনে রেখেছে। এই শান্ত সকালটা, এই মুহূর্তটা—তাকে কিছুতেই বোঝায়নি, আজকের দিনটা সাধারণ দিনের মতো নয়। একটা ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল ওদের নির্ভার, নিঃশব্দ সকালে… আর আদিয়াত তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানুষটির পাশে বসে, নিশ্চিন্তে দিনটাকে একটু বিলম্বিত করতে চাইছিল মাত্র।
আদিয়াতকে বিদায় দিতে আরশীন নিচ পর্যন্ত এলো। আগে কখনো আসে নাই। নিজেকে সেই অধিকারবোধ থেকে দূরে রেখেছিল। সে দৃষ্টি সীমার আড়াল হওয়া পর্যন্ত আরশীন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে এসে আলিয়ার ঘরে ঢুকল। সকালটা বেশ নিরুত্তাপ।
আলিয়া বিছানায় আধশোয়া ভঙ্গিতে মোবাইল দেখছিল। আরশীন পাশে গিয়ে বসতেই দু’জনের মধ্যে টুকটাক গল্প জমে উঠল। না। হঠাৎ আলিয়া গম্ভীর হয়ে, যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল,
— “অ্যাই অ্যাই ভালো কথা! তুমি আর ভাই এখনো দুজন দুজনকে আপনি, আজ্ঞে করে বলো? কেনো ভাই? আমি তো শুনে পুরো তাজ্জব বনে গেছি।” তার কণ্ঠে কৌতুক মেশানো বিস্ময়, চোখে নিঃসৃত কিশোরীসুলভ কৌতূহল। কথাটা যেন ঘরের বাতাসে হালকা ধাক্কা দিয়ে গেল।
আরশীন হেসে ফেলল, তবে চোখে-মুখে একটু লজ্জা খেলে গেল। এমন প্রশ্নের উত্তর সবসময় সহজ হয় না, বিশেষ করে সম্পর্কের শুরুটা যখন নতুন হয়। আরশীন জবাব দিল,
— “আসলে প্রথম থেকেই বলে আসছি তো। এখনো সে রকমই চলছে। উনিও কখনো আমাকে বলে নাই কিংবা আমিও বলার প্রয়োজন মনে করি নাই। একটু ভদ্রতার সাথে একটু ঘনিষ্ঠতা থাকলেই না সম্পর্কে সৌন্দর্য থাকে।”

আলিয়া চোখ কুঁচকে তাকাল,
— “সৌন্দর্য তো তখনই, যখন দূরত্ব কমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তোমাদের মধ্যে এখনো আপনি চললে কবে আসবে সেই তুমিময় মিষ্টি সম্পর্ক?”

আরশীন হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল,
— “আমি বোধহয় এটাতেই কমফোর্টেবল ফিল করি। অনেকদিন থেকে শুনে আসছি, নিজেও বলছি। তুমি ডাকটা কেমন গম্ভীর হয়ে যায় জানো? ও যদি কখনো আমাকে তুমি সম্বোধন করে, তবে বুকের ভেতর ধাক্কা লাগবে। আমি সিওর।”

আলিয়া হেসে উঠে বলল,
— “উফফ… কী রোমান্সরে ভাই। তবে শোনো, ভাই ফিরলে এই ডাকটা পরিবর্তন করবে। ভাই একটু দেখুক তার বউয়ের বুকে ধাক্কা লাগাটা। তুমি না বললে আমি নিজেই বলব।”
আরশীন হেসে মাথা নিচু করল। আলিয়ার চোখে-মুখে এখন মজা খোঁজার রেশ, আর আরশীনের মুখে সেই নতুন প্রেমে ভিজে ওঠা অপ্রস্তুত হাসি, ঘরের ভেতর তখন একধরনের কোমল উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
নির্বিঘ্নে, আলস্যঘন এই সকালে আলিয়ার ঘরে বসেই আরশীনের মনে পড়ে গেল সিলেটের সেই অনাবিল দিনগুলো—সবুজে মোড়া পাহাড়, ঝর্ণার গর্জন, আর আদিয়াতের চোখে ভর করে থাকা টাল-মাতাল ভালোবাসা। সেই মুহূর্তগুলো বাতাসে মিশে আজও তার গায়ে লেগে আছে। আদিয়াত নামটাই এখন তার কাছে কেবল একজন মানুষ নয়, এক রোমাঞ্চকর অনুভব; যার সঙ্গে প্রত্যেকটা মুহূর্ত নতুন, প্রত্যেকটা স্পর্শে নিঃশব্দ কাঁপন।
.
আদিয়াত অফিসে পৌঁছাল। প্রতিদিনের মতোই ছিমছাম পরিবেশ, করিডোর পেরিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকতেই এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে গেল তার, কেবিনে আগে থেকেই বসে আছে নীরা। আদিয়াত জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি এখানে কী করছো?”

নীরা ঘুরে তাকাল। নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বলল,
— “গতকাল যে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলে, সেটা তৈরি করেছি। দিতে এসেছি।”
— “আমার অনুপস্থিতিতে?”
— “অপেক্ষা করছিলাম।” নীরা জবাব দেয়।

আদিয়াতের গলা একটু কড়া হয়ে উঠল,
— “কে বলেছিল? আমার অনুপস্থিতিতে আমার কেবিনে ঢোকার সাহস তো কোন এমপ্লয়ি পায় না। নেক্সট টাইম বিষয়টা মনে রাখবে।”

নীরা ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
— “ঠিক আছে।” সে চুপচাপ সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। আদিয়াত ওদিকে একপলক তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল,
— “তোমার কিছু ম্যানার্স জানা প্রয়োজন। সিনিয়রের সামনে এখানে হুট করে বসে পড়া এক ধরনের বেয়াদবি। অফিসে কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক মানি না। সম্পর্ক থাকবে সম্পর্কের জায়গায়, আর কাজ কাজের জায়গায়। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

নীরা মাথা নাড়ল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ফাইলটা এগিয়ে দিল।
— “নাও।” আদিয়াত ফাইলটা হাতে নিল। চোখ বুলিয়ে চেক করল কিছুক্ষণের জন্য, তারপর শান্ত গলায় বলল,
— “ঠিক আছে। এইটুকু কাজ ঠিকঠাক হয়েছে। তবে সামনে যেসব প্রজেক্ট আসছে, সেখানে অনেক জটিলতা থাকবে। মনোযোগটা এখন সেখানেই স্থাপন করবে।”
নীরা শুধুমাত্র মাথা নেড়ে ইতিবাচক জবাব দিল। আদিয়াত নিজের কথার সাথে চোখ না তুলেই যোগ করল,
— “আর হ্যাঁ… এখানে আমি তোমার স্যার। সম্বোধনের দিকেও খেয়াল রাখবে। ওকে? এখন আসতে পারো। কোনো প্রয়োজনে মারুফের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”

নীরার মুখটা এক মুহূর্তে থমথমে হয়ে উঠল। চোখে কষ্টের ছায়া ফুটে উঠল। ওর গলার নিচে যেন কিছু একটা আটকে গেল। এত কঠিন ব্যবহার? এতটা দূরত্ব? সবটা যেন এক মুহূর্তে অস্পষ্ট হয়ে উঠল নীরার কাছে। সব হয়েছে ওই মেয়েটার জন্য। কিছু না বলে নীরা ধীরে পেছন ঘুরল। তার পায়ের শব্দগুলো যেন ফাঁকা করিডোর জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছিল, নীরব এক অভিমানের মতো।

সকাল থেকেই আমিনুল ইসলাম তার কেবিনে নিজের মতো গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে, এক পা আরেক পায়ের ওপর রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন কিন্তু মন অনেক গভীরে পরিকল্পনার লাইন টানছে। রাতে ঘুম হয় নাই যার দরুন চোখের নিচে হালকা কালি, কিন্তু মুখে এক ধরনের অদ্ভুত শান্ত হাসি; এক ভয়ঙ্কর স্নিগ্ধতা। তার ভেতরে চলছে অস্থির এক আগুন, প্রতিশোধের আগুন। রাখে গা রিরি করছে বারবার, হাতের আঙুলগুলো মৃদু কাঁপছে, নিদ্রাহীন চোখে এক ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতার রেখা।
তার কানে যখন খবর পৌঁছাল “আদিয়াত এসেছে” তখনই তার ঠোঁটের কোণে কুটিল এক হাসি খেলে গেল। নিঃশব্দে, নিজেকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এসেছ তো ভালোভাবে… এখন ফিরে যেতে পারো কিনা, তা তো সময়ই বলবে।” কেবিনের দরজা বন্ধ থাকলেও তার ভেতরে খুলে যাচ্ছে একের পর এক ষড়যন্ত্রের দরজা।
আদিয়াত একবারও আমিনুল ইসলামের খোঁজ নিল না, একটুও না। যেন কোনো অস্তিত্বই নেই। তার চোখে এই মুহূর্তে সম্পর্কের দাম তুলনামূলক কম। দু’দিনের সময়সীমা সে বেঁধে দিয়েছে নিজেই। আর সে সময়ের প্রতি তার নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। মনোভাবটা ছিল একেবারে স্পষ্ট,
“ঠিক সময় মতো যা বলেছি, সেটাই চাই। সম্পর্ককে রক্ষা করার শেষ সুযোগ আমি দিয়েছি। এবার যদি ছাড় দিতে হয়, সেটা সত্যের জন্য নয়, দায়িত্ববোধের জন্য হবে না।”

সকালের ব্যস্ততা আদিয়াতকে পুরো গিলে ফেলেছিল। একের পর এক মিটিং, জরুরি ফাইল, লোকজনের আসা-যাওয়া—সব মিলিয়ে নিজের দিকে তাকানোর সুযোগটুকু পর্যন্ত মেলেনি। ফোনটা বহুবার হাতে নিয়ে রেখে দিয়েছে, কিন্তু একটা বার্তা দেওয়ার সুযোগ হয়নি। আরশীনও বোঝে আদিয়াত এখন অফিসে। তাকে বিরক্ত করা ঠিক না। তবুও দুপুর গড়িয়ে যখন ক্লান্তির ছাপ নামতে শুরু করল, তখন আরশীন হালকা করে একটা টেক্সট করেই ফেলল। আদিয়াত টেবিলের ফাইল এক পাশে রেখে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল, আরশীনের ছোট্ট বার্তা।
মৃদু হাসল। ব্যস্ততা কিছুটা হালকা লাগলো। আর এই ফাঁকে দু’জনের মধ্যে চলল কিছু হালকা-পাতলা কথাবার্তা…
আরশীন লিখল,
“কি খবর? কি করছেন এখন?”

আদিয়াত জবাব দিল,
“কি করতে পারি বলে আপনার মনে হয়?”
“মনে তো হয় খুব মন দিয়ে কাজ করছেন… আবার মাঝেমাঝে আমার কথা ভাবছেন।”
“আপনি ঠিকই ধরেছেন। কাজ করছি, আর সঙ্গে একটা নাম মাথার ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে… বিরতি নিলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”

আরশীন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“ওমা! কার নাম বলো তো শুনি?”
“একটা ঝামেলার নাম… খুব দায়িত্ব জেনেও মনে বসেছে। এখন কাঁধ ছাড়ে না।”

আরশীন হেসে লিখল,
“আহা, বেশ করেই বুঝলাম আমি সেই ঝামেলা। কিন্তু একবার দেখেন, এই ঝামেলা কিন্তু আপনার জীবনটাকে সুন্দর করে দিয়েছে।”
“নিজের প্রশংসা করছেন?”
“এহে, একদম না।” আরশীন নিজের কপাল চাপড়াল।

আদিয়াত একটু ভেবে লিখল,
“তবে দিনরাত ২৪ ঘন্টা যদি আমার হাতে থাকত, আমি প্রতিদিন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তাম।”
“তাই?”
“হুমমমম… কি করছেন এখন?” আদিয়াত প্রশ্ন করল।
“কাজ করছিলাম তবে আপনার এত মিষ্টি কথা শুনে কাজের মনোযোগ হারিয়ে ফেলব এখন, নিশ্চিত।”

আদিয়াত লিখল,
“হারিয়ে ফেলুন… আমার দিকেও তো মনোযোগ চাই।” লিখেই সাথে সাথে মুছে ফেলল। এটা পাঠাতে কেমন অস্বস্তি… না ঠিক তা নয়, বোধহয় একটু লজ্জা লাগল। তার বদলে লিখে পাঠাল,
“আচ্ছা আচ্ছা, বিরক্ত করছি না নিজের কাজ করুন।”

আরশীন ভেংচি কেটে উত্তর দিল,
“হুহ, করছিই তো। আপনাকে বলতে হবে না।” আদিয়াত আর ওই মেসেজের রিপ্লাই দিল না। কাজ নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আরশীন বারবার ফোনের স্ক্রিন দেখে, হোমস্ক্রিনে কোনো নতুন নোটিফিকেশন নেই। বিকালের রোদ ফাঁকা জানালার পর্দা ছুঁয়ে তার গালে এসে পড়ছে, তবুও তার চোখ কেবল মোবাইলের দিকে।
শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
— “বাজে লোক একটা… ভণ্ড কোথাকার! আর দিবোই না মেসেজ, অপেক্ষাও করব না।”
তারপর ঠোঁটটা বাঁকিয়ে একটু হাসল নিজেই নিজের রাগের ওপর।
— “হুমম… দেখি কতক্ষণ না থাকেন আমার সাথে কথা না বলে…”
আরশীন ফোন নামিয়ে রাখলেও মনটা সেখানেই আটকে রইল, একটা শব্দের অপেক্ষায়… একটা মেসেজের আশায়। এই ছোট্ট অভিমানটুকু ও ওদের ভালোবাসার খরচ হিসেবেই জমা করে রাখল।
.
অফিস শেষে আদিয়াত বেরিয়ে এসে গাড়ির দিকে এগোতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
— “আদিয়াত, কেমন আছো?”

আদিয়াত ঘুরে তাকাল। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমিনুল ইসলাম। চোখেমুখে আগের চেনা ভদ্রতার মুখোশ, ঠোঁটে সৌজন্যমূলক এক টানটান হাসি। আদিয়াত সংক্ষেপে জবাব দিল,
— “ভালো। আপনি সময়ের কাজটা সময়মতো করলে আরও ভালো থাকতাম।”

আমিনুল একটু হেসে মাথা নাড়লেন, যেন কথাটা হজম করেও কিছু না বুঝেছেন এমন ভঙ্গি।
— “ঠিক আছে, দেখা হবে।”
আদিয়াত আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করে নিজের গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করল।
গাড়ি? হ্যাঁ, গাড়ি ঠিকই। কিন্তু আদিয়াতের অজান্তেই, আজ সেটাই এক ধূর্ত ফাঁদ। একটা বিপজ্জনক নকশার প্রথম পদক্ষেপ। যার চালক নেই, কেবল নায়ক আছে; শিকার হওয়ার অপেক্ষায়।
গাড়িটা সাঁই করে ছুটে চলেছে শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে একটু ফাঁকা দিক ধরে। আকাশে মেঘ করে এসেছে তখন। রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম। হঠাৎ করেই সামনের বাঁক থেকে একটা বেপরোয়া ট্রাক উলটো দিক থেকে ছুটে এলো। আদিয়াত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভার ব্রেক কষে চিৎকার করল,
— “স্যার! সামলে।”
ব্যস, তারপর ধাক্কা! ভয়ংকর এক ধাক্কায় গাড়িটা রাস্তার পাশে গিয়ে উল্টে পড়ল। সেকেন্ডখানেকের মধ্যে চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার। একটা মুহূর্ত, থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসের মতো নিস্তব্ধতা।

বাইরের আকাশ যেন এক নিরব হাহাকার নিয়ে ঝরছে। ধু-ধু বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম, একটানা। চারদিক ঝাপসা হয়ে গেছে জলের ধারা আর বাতাসের নাচনে। বারান্দার গ্রিল ধরে আরশীন দাঁড়িয়ে, গা ছুঁয়ে যাচ্ছে হালকা ছাট। তবুও সরছে না। একরকম অবচেতন ভাবেই যেন দাঁড়িয়ে আছে। মাথা হেলে রেখেছে গ্রিলের ওপর, চোখে স্থির দৃষ্টি। না, সে আকাশ দেখছে না, না দেখছে বৃষ্টিকে। সে দেখছে… আদিয়াতের অনুপস্থিতিকে।
ফোন করেছে কয়েকবার। প্রতিবারই একজন মহিলার সুমধুর কন্ঠে একই উত্তর: “The number you are trying to reach is currently out of network coverage.” বিরক্ত হয়ে একটা সময় ফোনটাও কোলের উপর রেখে দিয়েছে। ভেতরের টানটা বড্ড বেশি বাজছে। ওকে ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে এমন আকুলতা টের পায়নি কখনো। এখন কাছে পাওয়ার পর আদিয়াতকে কোনোভাবেই আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। একটা জীবন কি একটু নিশ্চিন্তে পার করা যায় না? খুব কঠিন হয়ে যাবে? ভালোবাসি বলাটা যতটা সহজ, অপেক্ষাটা ততটা কঠিন। দূরে আকাশে একটা বিদ্যুৎ চমকালো। আরশীন চোখ বন্ধ করল। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর কোলের ফোন ভাইব্রেট করে উঠল। হোমস্ক্রিনে আননোন নাম্বার থেকে আসা একটি এসএমএস। আরশীন সেটা ওপেন করল। “ম্যাডাম আমি মারুফ হাসান বলছি। স্যারের এক্সিডেন্ট হয়েছে। দুর্ঘটনার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। এখনই আসতে পারেন?”
চারপাশের শব্দ থেমে গেল যেন। বৃষ্টির ঝিরঝিরে ধারা, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ; সবকিছু মুহূর্তেই স্তব্ধ। আরশীনের চোখের সামনে ফোনটা ধরা, কিন্তু চোখে অন্ধকার। ওর হাত কাঁপছে থরথর করে। সম্মুখে ঝাঁপসা হয়ে আসা মেসেজ, বুকের ভেতর ঝড়। মুখে শুধু একটা ফিসফিসে শব্দ,
— “আদিয়াত…”
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৩]
~আফিয়া আফরিন

(অগ্নি ও অর্ঘ্য)
আরশীন আর কোনো কিছু বোঝায় অবকাশ পেল না। ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি ভেঙে নামল। পিছনে না তাকিয়েই ছুটে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি নামা আকাশও বোধহয় তখন তার সাথে কাঁদতে শুরু করল। বৃষ্টিভেজা পায়ের ছাপ রেখে আরশীন দৌড়ে চলে গেল গেটের দিকে। আলিয়ার জিজ্ঞাসু চাহনি, দরজার ফাঁক দিয়ে মা’র ডাকা, সবকিছুর বাইরে সে এখন। শুধু একটাই গন্তব্য, হাসপাতাল। আরশীন কোনো যানবাহন খুঁজে পেল না, ভিজেই ছুটল রাস্তায়। মাঝপথে এক রিকশা দাঁড় করিয়ে দম নিতে নিতে বলল,
— “সিটি হাসপাতাল… তাড়াতাড়ি।”
রিকশা ছুটছে। ওর মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গেছে। কিছু ভাবতে পারছে না। ফোনটাও ফেলে চলে এসেছে। আল্লাহ! বাড়িতে কিছু বলা হলো না। ওরা তো আরশীনকে পাগলের মত ছুটতে দেখেছে। চিন্তাও করছে নিশ্চয়ই। রাস্তাও যেনো শেষ হচ্ছে না। রিকশার সামনে কোনো গাড়ি এলে, ইচ্ছে করছে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। এই শহরের সব কোলাহল, সব নিয়ম, সব ‘যদি’ ‘কিন্তু’, এক মুহূর্তে সবকিছু হয়ে উঠেছে অপ্রাসঙ্গিক। রিকশাওয়ালাকে বারবার বলছে,
— “আরও জোরে চালান মামা, আর একটু তাড়াতাড়ি…”

অবশেষে রিকশা গন্তব্য থামতেই সে নামল। তাড়াহুড়োর তাড়নায় আরশীন বেরিয়ে পড়েছিল বাতাসের গতিতে। কোনো কিছুই খেয়াল করে নাই; না ব্যাগ, না টাকাপয়সা। রিকশা দাঁড়াতেই বাস্তবের ঝাঁকুনি তাকে ফেরালো। ভাড়া মেটাতে হবে অথচ সাথে তো কিছুই নেই। এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেল সে, তারপর চোখ পড়ল হাতে থাকা ছোট্ট সোনালি ব্রেসলেটটার দিকে, স্মৃতির একটা টুকরো। আরশীন একটুও দ্বিধা না করে সেটি খুলে ফেলল, তাড়াহুড়োয় চুলের গোছা উলটে পড়ল কপালের ওপরে। সে ব্রেসলেটটা রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,
— “মামা, এটা নিন। আমি প্রচণ্ড তাড়াহুড়োর মধ্যে বের হয়েছি। ব্যাগপত্র আনতেও মনে ছিল না।”
রিকশাওয়ালা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে তখনই ভেতরে দৌড় দিল। ভেজা ওড়নাটা একপাশে সরিয়ে দরজার দিকে ছুটল।
“আদিয়াত? সৈয়দ ইলহাম আদিয়াত, এক্সিডেন্ট…” রিসেপশনে দাঁড়িয়ে শ্বাসকষ্টের মতো আওয়াজ বের হলো।

রিসেপশনিস্ট বললেন,
— “হ্যাঁ, ওয়ার্ড ৫-এ আছেন। জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে।” ৫ নাম্বার ওয়ার্ডের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল আরশীন। হাসপাতালের করিডোরজুড়ে অস্থির এক শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে, চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া। চেনা-অচেনা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ওয়ার্ডের দরজার কাছে।
চোখ পড়ে গেল এক কোণায় বসে থাকা মানুষটার দিকে, জহিরুল ইসলাম। সাদা চুলে হাত বোলাচ্ছেন অন্যমনস্কভাবে। আরশীন আর দেরি করল না। ছুটে গেল তাঁর কাছে। জিজ্ঞেস করল,
— “আদিয়াতের এখন কী অবস্থা, আংকেল?”

জহিরুল ইসলাম মুখ তুলে তাকালেন। ও এমনভাবে খবর পেয়ে ছুটে এসেছে দেখে খানিকটা বিস্ময় বোধ করলেন। নরম হাতে আরশীনের মাথায় হাত রাখলেন,
— “ডাক্তার বের হলেই জানা যাবে মা। চিন্তা করো না।”

কিন্তু আরশীনের চোখে তখন অশ্রুর বন্যা,
— “কী করে হলো এসব? কখন হলো?” কণ্ঠটা কেঁপে গেল। ঠোঁট কাঁপছে, প্রশ্ন থেমে নেই।

জহিরুল ইসলাম এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
— “সবকিছু জানি না এখনো। পুলিশ বলেছে, সামনে থেকে বেপরোয়া গতিতে একটি গাড়ি ছুটে আসছিল। তবে… আমি বিস্তারিত শুনিনি।”
একটু থেমে আবার বললেন, “বাড়িতে এখনো জানাইনি। নাজনীন আগে থেকেই হাই প্রেশারের রোগী। এই খবর শুনলে ওর-ই ভালোমন্দ কিছু হয়ে যাবে। তুমি তাদের বলে এসেছ?”
আরশীন চুপ। ও দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে, মনে হচ্ছে পুরো শরীরটা শূন্য হয়ে গেছে। একটা নিঃশ্বাস, একফোঁটা আশার অপেক্ষায় কেবল দাঁড়িয়ে থাকা।
হাসপাতালের কড়া আলো আর ক্লান্ত বাতাসের মাঝে হঠাৎ করেই ওয়ার্ডের দরজা খুলে গেল। একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। সাদা অ্যাপ্রনে, চোখে-মুখে উদ্বেগ। জহিরুল ইসলাম সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। আরশীনও এক পা এগিয়ে গেল, বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠল ওর। ডাক্তার সবার দিকে তাকালেন। সবাই উনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চারপাশটা নিস্তব্ধ। ওরা সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। তিনি ধীরে ধীরে বললেন,
— “রোগীকে খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আনা হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, মাথায় চোটও আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।”

আরশীনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, হাতটা ঠান্ডা হয়ে নেমে এল পাশে। ডাক্তার আবার বললেন,
— “এই মুহূর্তে আমরা কিছুই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। ওর অবস্থা এখনো জটিল। কেবিনে নেওয়া হয়েছে, সব পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। কিছুটা সময় যাক… তারপর বোঝা যাবে কী করা যাবে।”

কথাগুলো বলার সময় তাঁর গলা নিজেও ভারি হয়ে এসেছিল। জহিরুল ইসলাম এক পাশে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আরশীন নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। সে নিজের বুকের ভেতর হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। আরশীন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বুকের ভেতরটা ধসে পড়ল হঠাৎ করে, ও ধপ করে পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়ল। দুটো হাত মুখে চাপা দিয়ে কান্না শুরু করল। চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা করে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিঃশব্দে। জহিরুল ওর এই অবস্থা দেখে মারুফকে গলা নিচু করে বলল,
— “মারুফ, বাড়িতে খবর দাও। সাবধানে। বাড়াবাড়ি কিছু বলার দরকার নেই। নাজনীন শুনলে যেন ঘাবড়ে না যায়।” মারুফ মাথা নেড়ে চলে গেল।
হাসপাতালের করিডোরে বসে থাকতে থাকতে আরশীনের বুকের ভেতর পুরোনো ক্ষতগুলো যেন আবার নতুন হয়ে জেগে উঠল।
চারপাশে ভেসে আসছে ফিনাইলের গন্ধ, স্যালাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডারের শব্দ; এসবের মধ্যেই এক ভয়াবহ অতীত আবার ফিরে আসছে। সেই দুই রাত, বাবাকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করার পর থেকে পুরো পৃথিবীটাই কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরলেও বাবা কথা বলতে পারেননি, শুধু তাকিয়ে থাকতেন ফ্যালফ্যাল করে। আরশীন কিছু বললেই একটা ব্যথা-মাখানো চাহনি ছুঁয়ে যেত বুকের গভীরে। তৃতীয় দিন সকালে সাইলেন্টলি ভোরটা নিয়ে এলো এক চিরন্তন বিদায়। সেই দিনের পর থেকেই হাসপাতাল মানেই তার কাছে এক দুঃস্বপ্ন। আর আজ? আজ যেন সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে। আরশীন মনে মনে ফিসফিস করে বলল,
“আমার সাথেই কেনো এমন হয় বারবার? এই ভয়ের, এই শূন্যতার, এই দুঃখের অনুচ্চারিত অভিশাপ শুধু আমাকেই কেনো বইতে হয়?”
তার চোখের কোণে জমে থাকা জল থামছে না। সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, “কোন পাপ করেছি আমি? কার কাছে? কেনো কাছের মানুষগুলো এভাবে পালিয়ে যেতে চায়? বারবার? এভাবে?” প্রতিবারই একটা ঝড় এসে তার বুকচিরে চলে যায়।
.
সবাই ভেবেছিল, খবরটা পেলে নাজনীন ভেঙে পড়বেন। দিশেহারা হয়ে যাবেন, কান্নাকাটি করবেন, ঘাবড়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি বেশ শক্ত ছিলেন। চোখের কোণে জল থমকে ছিল ঠিকই, কিন্তু শব্দ বেরোল না একটাও। একবারও ভেঙে পড়েননি, হাহাকার করেননি। নিজেকে ধরে রেখেছিলেন অদ্ভুত এক দৃঢ়তায়। ভেতরটা তার চৌচির হচ্ছিল, বুকের ভেতর কান্না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল, তবুও তিনি নিজেকে আটকে রেখেছিলেন শুধু একটা কারণেই। তা হচ্ছে, আরশীনকে সামলাতে হবে।
আরশীন তো নিঃস্ব প্রায়, কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে। কেমন নিঃসাড় হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে আতঙ্ক আর অজানা ভয় মাখা। ওর পুরোটা জগৎ যেন পায়ের নিচ থেকে সরে গেছে। নাজনীন সেই মুহূর্তে একজন শাশুড়ি নন, মায়ের মত নিজের সন্তানের আশ্রয় হয়ে কথা বলছিলেন। আরশীনের কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দিচ্ছিলেন।
— “কিছু হবে না, মা। ও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমরা তোমাকে সামলাব নাকি আদিয়াতকে? পরে তো ছেলে আমাদের দোষারোপ করবে, আমরা ঠিকমতো তোমার যত্ন করতে পারি নাই।” আরশীন চোখ মুছে তাকে জড়িয়ে ধরলে তিনি পরম মমতায় আরশীনকে বুকে টেনে নিলেন।

এক্সিডেন্টের খবর পাওয়া মাত্রই সবাই ছুটে এসেছে। হাসপাতালের করিডোর তখন ধীরে ধীরে ভরে উঠেছে পরিচিত মুখে। রাত গভীর হলেও কারও চোখে ঘুম নেই, সবাই যেন একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর আটকে আছে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে খুব দ্রুত, আদিয়াতের এক্সিডেন্ট… অবস্থা আশঙ্কাজনক। চাচা-চাচি, মামা-মামী, ভাই-বোন, কাজিন, সবাই ছুটে এসেছে। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না এই মুহূর্তটাকে।
আজহান তো রাজশাহী থেকে এসে পৌঁছেছে ঝড়ের গতিতে। রাত্রি তিনটা বাজে, হাসপাতালের সাদা আলো, ওষুধের গন্ধ, আর নীরবতা, সব মিলিয়ে এক ধৈর্যের পরীক্ষাগার মনে হচ্ছে। তখনই নিঃশব্দ পায়ে আরশীন এসে দাঁড়ায় কেবিনের সামনে। সবার ভেতরেও ও একা।
চোখে-চোখে সবাই তাকে দেখে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। কারণ আরশীনের চোখেই যেন সবার মনের ভাষা লেখা; ভয়, কষ্ট, আশংকা আর অপেক্ষা। এই মুহূর্তে সবার হৃদয় আটকে আছে কেবিন ৩০২-এর সেই দরজার ওপাশে। একজন মানুষ, যার জেগে ওঠার অপেক্ষায় এতগুলো হৃদয় একসাথে নিঃশব্দে প্রার্থনায়।
রাত তিনটা। সারা হাসপাতাল জুড়ে এক নিস্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে করিডোরে কারও হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ ভেসে আসে। আলো-আঁধারির মাঝে আরশীন দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের সামনে। কাঁচের ওপাশে শুয়ে আছে আদিয়াত। মাথায় প্যাঁচানো ব্যান্ডেজ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কপালে ক্ষতচিহ্ন, চেনা মুখটা অচেনা হয়ে গেছে হঠাৎ। সেই চওড়া কাঁধ, যে কাঁধে সে নিশ্চিন্তে মাথা রেখেছিল, আজ নিস্তেজ হয়ে আছে। মুখে কোনও হাসি নেই, নেই সমন্বিত চোখের দৃঢ় দৃষ্টি।
আরশীনের চোখের সামনে এক ঝাপসা পর্দা নেমে আসে। শরীরটা একবার কেঁপে ওঠে। ওর দুই চোখে জমে থাকা কষ্টগুলো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল না বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে লাগল এক দৃষ্টিতে। কেবিনের ভেতর মেশিনের একটানা শব্দ বাজছে বিপ… বিপ… বিপ… ওই শব্দ আরশীনের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। আরশীন কাঁচে হাত রাখল আলতো করে…
চোখ বন্ধ করে একটা কথা বলল মনে মনে,
— “আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, ছেড়ে যাবেন না কখনও। কথা রাখুন আদিয়াত… প্লিজ।”

সকাল হয়েছে। হাসপাতালের জানালার ফাঁক গলে সূর্যের আলো কেবিনের দেয়ালে পড়ছে। চারদিকের কোলাহল একটু একটু করে বাড়ছে, কিন্তু আদিয়াত তখনও নিস্তব্ধ। যন্ত্রপাতির শব্দ, হালকা শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দ, আর গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা স্যালাইনের নলগুলোই তার অস্তিত্বের প্রমাণ। রাত পেরিয়ে গেলেও তার জ্ঞান ফেরেনি। আরশীন, জহিরুল, নাজনীন, আলিয়া, আযহান সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ডাক্তাররা বলছে, সময় লাগবে। শারীরিক ট্রমা ছাড়াও মাথায় যে আঘাতটা লেগেছে, সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।
এই সময়ে খবর এলো, ড্রাইভাের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তার কাছ থেকেই ঘটনার বিস্তারিত জানা গেল। তিনি বললেন,
— “হঠাৎ বাঁক থেকে একটা ট্রাক খুব জোরে আসে। সাইড নিতে গিয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারায়। আমি কিছু বোঝার আগেই ধাক্কাটা লেগে যায়। এরপর শুধু অন্ধকার।”
সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। কথাগুলো যেন বুকের ভেতর আরও ভার করে তুলছিল। আরশীনের বাড়ি থেকেও সকলে সকালেই চলে এসেছে হাসপাতালে। এমন পরিস্থিতিতে সবার চোখেই উদ্বেগ, মুখে প্রার্থনার ছায়া। ডাক্তার বেরিয়ে এসে জানালেন,
— “আদিয়াতের অবস্থা এখন স্টেবল। ভয় ছিল, ব্রেইনে কোনো রকম জটিলতা না হয়। তবে আপাতত সেসব কাটিয়ে উঠেছে। আশা করছি, সাত থেকে আট ঘণ্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।” একফোঁটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল সকলে। আরশীন চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারের কথায় সে চোখ বন্ধ করল। কাল রাত থেকে আরশীনের অবস্থা একেবারেই বদলে গেছে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। বৃষ্টি ভেজা গাঁয়ের কাপড় গাঁয়েই শুকিয়েছে, তবুও এক চুল নড়ে নাই। হাসপাতালের করিডোরের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে। ডাক্তার জানিয়েছেন, এখন চিন্তার কোন কারণ নেই। তাই নাজনীন বারবার ওকে বলছেন,
— “ তুমি এখন একটু বাড়ি যাও। খাওনি কিছু, রাতভর জেগে আছো… অসুস্থ হয়ে পড়বে।” কিন্তু সে শোনেনি। কেবল ধীরে মাথা নেড়েছে,
—“আমি এখানেই থাকবো।” ওর চোখের ভাষা বোঝা যায় না, বোঝে না কেউ। ভিতরের ঝড় সে নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখছে, প্রকাশ করতে পারছে না।
জীবনটা এতটা অগোছালো হয়ে যাবে, ভাবেনি সে কখনও।
একটা সোজাসাপ্টা, শান্ত জীবন চেয়েছিল। খুব বেশি কিছু না, শুধু ভালোবাসার মানুষগুলোকে পাশে চেয়েছিল। অথচ সে যাদের ভালোবাসে তাদের জীবনের সাথে টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায়। বাবা ছিল ওর ভালোবাসা, শক্তি, সাহস, অনুপ্রেরণা; উনিও চলে গেলেন। দুটোদিন নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে নির্মম ভাবে হেরে গেলেন। আদিয়াতের কথা আরশীন ভাবতেই চায় না। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। আর সে প্রতিবার সে এই পরিস্থিতির সামনে বুক চিতিয়ে অসহায়তা নিয়ে দাঁড়ায়।
হাসপাতালের করিডোরে রাতভর জেগে থাকা ক্লান্ত মুখগুলো একে একে আরশীনের পাশে এসে অনুরোধ করছিল। আরশীন নরম স্থির কণ্ঠে সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আপনারা সবাই বাড়ি যান। আমি এখানে থাকবো। ওকে রেখে কোথাও যাবো না।”

তার গলায় কোনপ্রকার জেদ ছিল না, ছিল শুধু ভালোবাসার দৃঢ়তা। চোখে ঘুম নেই, শরীরে অবসাদ, তবুও সে এতটুকু দুললো না। সবাই ধীরে ধীরে বিদায় নিল। করিডোরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। আরশীন নিঃশব্দ পায়ে কেবিনের দরজা ঠেলেই ঢুকল। আদিয়াতের নিস্তেজ শরীর, মেশিনের টিকটিক শব্দ, সবকিছু মিলিয়ে হৃদয়টা ফেঁটে যেতে চাইল। ও এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ বিছানার পাশে বসল। হাত বাড়িয়ে খুব আলতো করে আদিয়াতের হাতের আঙুলে ছুঁয়ে দিল; একটুকরো নিশ্চয়তা, একটুকরো আশ্বাস হিসেবে। ওর চোখে জল নেই, মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু এক অবর্ণনীয় অনুভূতির ছায়া। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবী তার কাছে গুটিয়ে এসেছে এই ছোট্ট কেবিনটাতে, আদিয়াতের পাশে। আরশীন ওর হাত নিজের কাছে টেনে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে। ঠাণ্ডা আঙুলের ছোঁয়ায় সে আদিয়াতের ভেতরের সমস্ত যন্ত্রণা নিজের হৃদয়ে টেনে নিচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই, হঠাৎ করে আদিয়াতের চোখে এক হালকা নড়াচড়া। চোখ খুলে যায় ধীরে ধীরে। ঝাপসা চাহনির মাঝে একটা চেনা মুখ ধরা পড়ে, কাছে বসে থাকা আরশীন। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুখে এক অব্যক্ত প্রশান্তির ছায়া নিয়ে আদিয়াত হালকা করে ডাকল,
— “আরশীন!”
আওয়াজটা আকাশভাঙা গর্জনের মতো নয় বরং নিঃশ্বাসের মতো কোমল, তবে আরশীনের কাছে তা বজ্রাঘাতের মতোই বিস্ময়কর। সে চমকে তাকাল আদিয়াতের মুখের দিকে। দেখল, ওর ঠোঁটে এক অনুরাগভরা হাসি, চোখের দৃষ্টিতে মিশে আছে অগাধ ভালোবাসা।
আরশীনের চোখ এক নিমেষেই ছলছল করে উঠল। ও আদিয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। আদিয়াত চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেন পৃথিবীর সমস্ত আলো আরশীনের চোখে এসে থেমেছে। হঠাৎ আরশীন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, চোখের জল আর আটকে রাখা গেল না। এই কান্নার শব্দেই আদিয়াত নড়ে উঠল। উঠে বসতে চাইল। কিন্তু শরীরে লাগানো যন্ত্রপাতি, স্যালাইন, অক্সিজেন, সব মিলে তাকে আটকে রাখল। ব্যথায় মুখটা সামান্য বিকৃত হল।
আরশীন তৎক্ষণাৎ বলল,
— “উঠতে হবে না আপনাকে।”

আদিয়াত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “কাঁদছেন কেন আপনি?”

আরশীন চোখ মুছে উত্তর দিল,
— “আমার কি এই মুহূর্তে হাসা উচিত?”
— “হ্যাঁ। তবে কাঁদবেন না। কান্নাকাটি আমার ভীষণ অপছন্দের।”

আরশীন থমকে গেল। একটু চুপ করে বলল,
— “দুঃখেও কাঁদব না?”

আদিয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “কীসের দুঃখ?”

আরশীন চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “আপনার জন্য।”
— “আমি আপনার দুঃখ? বাহ! ভালোই তো। আগে জানতাম না।”

আরশীন মুখ তুলল।
— “আপনি দুঃখ না। আপনার এই পরিস্থিতি… এটা দুঃখের।”

আদিয়াত থামিয়ে দিল ওকে। ঠোঁটের কোণে এক শান্ত হাসি নিয়ে বলল,
— “কেনো দুঃখ প্রকাশ করছেন? আমি কি মরে গেছি?”

এই কথাটা শুনেই আরশীন ভয়ে কেঁপে উঠল। দ্রুত ওর হাত বাড়িয়ে আদিয়াতের মুখে চেপে ধরল,
— “ওই কথা বলবেন না প্লিজ।” তার গলায় কষ্ট জমে আছে, গলার স্বর কেঁপে যাচ্ছে। এক অনুচ্চারিত ভয়, এক বোধগম্য ভালোবাসা গুমরে গুমরে বেরিয়ে এলো এই ছোট ছোট বাক্যগুলোর ফাঁকে।
আরশীন দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আপনি জানেন না… জানেন না আমার জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো। এই আমি, যাকে সবাই সবসময় হাসিখুশি ভাবে… আমার ভেতরটা অনেক আগেই মরে গেছিল। কোনো অনুভব ছিল না। কেবল একটা খালি খোলস হয়ে গেছিলাম আমি। কিন্তু আপনি, আপনি সেই মৃত অনুভূতিকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছেন।”
সে একটু থামল। কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো। কণ্ঠে কান্না জমে আছে, শব্দগুলো কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসছে। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। সে চোখ মুছল না।
— “সত্যি বলছি, যাদের আমি ভালোবাসি, তারা সবাই বড্ড অসময়ে ছেড়ে যায়। এক এক করে হারিয়ে যায়, কেউ কিছু না বলেই। আমি তো একটা মানুষ… না? এত দুঃখ, এত শূন্যতা একা বয়ে বেড়ানো কি সম্ভব? কেমনে সইবো বলেন? আমার তো এত সহ্যশক্তি নাই… নাই তো…”
আরশীনের চোখে জল। তখন আদিয়াত হালকা গলায় বলল,
— “আমি আছি তো। যতক্ষণ আমার নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ আমি আছি।”

আরশীন চোখ তুলে তাকাল আদিয়াতের দিকে। সেই চাহনিতে ছিল প্রশ্ন, সংশয়।
— “কিন্তু তার নিশ্চয়তা কি আদিয়াত?”
আদিয়াত তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। শুধু একটুকু হাসল, হাত বাড়িয়ে ইশারায় ওকে কাছে আসতে বলল। আরশীন এগিয়ে এলো, চোখে জলের ছায়া নিয়েই। আদিয়াত ওর কপালে আলতো করে একটি দৃঢ় চুম্বন এঁকে বলল,
— “কোন নিশ্চয়তা নেই। শুধু আপনার বিশ্বাসের উপর আছি আমি।”
আরশীন চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল। এই ছোট্ট বাক্যই যেন এক পৃথিবী নির্ভরতার বার্তা।
— “বিশ্বাস? তাহলেই চলবে?”

আদিয়াত চোখ টিপে বলল,
— “চলবে মানে? দৌড়াবে!”
আরশীন হেসে উঠল; একটা নিঃসঙ্কোচ হাসি, অনেকক্ষণ পর তার মুখে ফুটল। সেই হাসিতে ছিল বাঁচার আনন্দ, ভালোবাসার পরশ।
পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। কেবিনের ভেতরের ভারী আবহাওয়াটা যেন হঠাৎ করে খসে পড়ল, ফ্রেশ হয়ে উঠল সবকিছু। ও রিসিপশন থেকে বাড়িতে ফোন করে জানাল, “ভয়ের কিছু নেই। আদিয়াত এখন অনেকটা ভালো। কথা বলেছে। আপনারা চিন্তা করবেন না।” এদিকে ডাক্তার কেবিনে এসে চেকআপ করে গেলেন। বললেন, “পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। আর কয়েকদিন বিশ্রাম দরকার, তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আরশীন বলল না কিছুই, পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হয়তো তখন তাদের চোখে, তাদের নীরব ভালোবাসার মুহূর্তেই ফুটে উঠেছিল।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-২৪]
~আফিয়া আফরিন

(নিবিড় হৃদ্যতা)
হাসপাতালের সেই কেবিনটা সন্ধ্যার আলো-আঁধারে একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল। বাইরে থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি, করিডোরে নার্সদের ধীরে পায়চারি, সব মিলিয়ে একটা ভারী আবহ ছেয়ে গেছে। হঠাৎ এক এক করে পরিচিত মুখগুলো কেবিনে ঢুকতে শুরু করল। প্রথমে এলো নাজনীন। চোখে গভীর দুশ্চিন্তা। ছেলেকে এক নজর দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন, কষ্টে নিজেকে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করছেন। এরপর আরশীনের মা, আযহান, আলিয়া সকলেই ছুটে এসেছে যার যার দিক থেকে। কেউ ওর পায়ের কাছে বসছে, কেউ কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর তো মায়ের কান্নাকাটি আছেই। আদিয়াত একটু আগে আরশীনকে সামাল দিল এখন মাকে সামাল দিতে দিতে ভাবছে,
— “এই অসুস্থতায় তো নিজে একটু যত্ন পাওয়ার কথা ছিল। অথচ আমার সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করতে হচ্ছে। কী আজব দুনিয়া! যেন আমার কষ্টে সবাই আমার চেয়েও বেশি ব্যথিত।”
আরশীন এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আদিয়াতের চোখ পড়তেই হালকা করে বলল,
— “সবাই খুব চিন্তা করছে আপনার জন্য। এখন সামলান সকলকে।”

আদিয়াত ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল,
— “এতো কষ্টে নাই আমি, যতটা সবাইকে শান্ত করতে গিয়ে হচ্ছি। কে অসুস্থ? আমি, না ওরা?”
এই কথায় হালকা একটা হাসির ঝিলিক পড়ে গেল আরশীনের মাঝে। নাজনীন চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
— “তুই চুপ কর। কথা কম বল, বিশ্রাম নে।”
— “তোমরা অযথা চিন্তা করছ। এই দেখো, তাকাও আমার দিকে আমি একদম ফিট আছি। এই সামান্যতে ব্যাকা হয়ে গেলে হবে? শুধু আশেপাশে এসব আবর্জনার জন্য উঠে বসতে পারছি না। খুলে ফেলব?”

আরশীন ধমক দিয়ে এগিয়ে আসে,
— “অ্যাই না। দাদাগিরি দেখাচ্ছেন? খুব তাইনা? চুপচাপ শুয়ে থাকুন। মা-বাবাকে বলি আপনাকে আরেকটু বেশি বকা দিতে। তাও যদি একটু শিক্ষা হয় আপনার। আমার কথা তো কানেই তোলেন না।”
— “এখানে আমার কী দোষ? আমি তো কিছুই করি নাই।” আদিয়াত চোখ বড় বড় করে বলল।
— “এইতো কথা বলছেন, এটাই আপনার সবচেয়ে বড় দোষ। এত কথা বলছেন কেনো?”
— “সবাই আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছে কেনো?”

আরশীন চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,
— “করবে না? পরিবার আসলে এমনই, নিজের জখম নিয়ে ভাবার আগে সবার কষ্ট লাঘব করার দায় পড়ে যায় নিজের উপর।” মোটামুটি সবাই টুকটাক কথাবার্তা বলছিল। আদিয়াতও ক্লান্ত কণ্ঠে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিল। চারপাশে সকলের মধ্যে একধরনের স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।
এই উষ্ণ পরিবেশের মধ্যেও আমিনুল ইসলাম ছিলেন ভিন্ন এক জগতে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেবিনের কোণায়, মুখে নিষ্প্রভ অভিব্যক্তি, নির্বিকার। কারো সাথে কোন কথা নয়, কারো সাথে চোখাচোখি নয়। অথচ ভিতরে ভিতরে তার ভ্রু কুঁচকে আছে, চোখে অদ্ভুত এক চাপা রাগ আর অস্থিরতা।
“এটা কী করে হলো?” মনে মনে গুঞ্জন তুললেন তিনি।
“বেঁচে গেল? কীভাবে? এই দুর্ঘটনার পরও! রেজা… ওই রাবিশটা একটা কাজও ঠিকমত করতে পারে না। ব্যর্থ! অথচ টাকা নিয়েছিলো লাখ লাখ।” চোখ নামিয়ে হাসপাতালের টাইলসের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমিনুল।
“এখন কোথা থেকে আসবে আমার সেই টাকাগুলো? ভেবেছিলাম আজ নিশ্চিন্তে একটা নিঃশ্বাস ফেলব… ভুল। ভাগ্যও বোধহয় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এখন।”
তাকালেন আদিয়াতের দিকে। হাসপাতালে শুয়ে থাকা ছেলেটা এতটা অচেতন নয়, তবুও অদৃশ্য এক ঘূর্ণিতে তার চারপাশে মানুষ জড়ো হচ্ছে; ভালোবাসা, সহানুভূতি, মনযোগ সবকিছু ওর দিকে।
“এখনই তো নতুন করে কিছু ভাবতে পারছি না। আগে এই পরিস্থিতি সামলাতে হবে। আপাতত একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর… তারপর নতুন করে সব শুরু করব। এবার আর ভুল হবে না।” এই ভেবে তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুখে ধোঁয়াটে এক অভিব্যক্তি, পরাজয়ের লজ্জা আর ভবিষ্যতের শঠতার ছায়া একসাথে লেগে ছিল সেই চাহনিতে।
.
বাড়ি থেকে যখন সবাই এসেছে, তখন তারা আরশীনের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে এসেছিল। গতকাল রাত থেকে একটানা হাসপাতালে থেকে চেহারায় ক্লান্তির ছাপ পড়ে গিয়েছে, তবুও ওর একগুঁয়েমি, আদিয়াতকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, আদিয়াতকে আরও অন্তত এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে। আরশীনও থেকে যাবে, এই হাসপাতালের কেবিনে, আদিয়াতের পাশে, ওর জেগে থাকা আর ঘুমিয়ে পড়ার মাঝে এক অদৃশ্য পাহারাদার হয়ে।
দুপুরের আলোটা কেবিনে নরম হয়ে এসে পড়ছে। আদিয়াত ঘুমোচ্ছে নিঃশব্দে। আরশীন বেরিয়ে রিসেপশনের ওখানে গিয়ে ম্যাগাজিন নিয়ে বসল। আশা এসে বসলো পাশে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,
— “ভাইয়াকে তুমি ভালোবাসো, তাই না আপু?”

আরশীন সহজভাবে বলল,
— “ভালোবেসে ফেলেছি।”
— “তাই? কীভাবে ভালোবাসলে?”

আরশীন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল
— “উঁহু… ওটা তো সিক্রেট। বলা যাবে না।”

আশা হালকা অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— “আচ্ছা না বলো। তুমি কবে বুঝলে, তুমি ভাইয়াকে ভালোবাসো?”

আরশীন হালকা হেসে তাকাল, মুখে যেন দুষ্টু এক চঞ্চলতা।
— “ভালোবাসা জিনিসটা অদ্ভুত, আশা। কখন কাকে ছুঁয়ে যায়, বলা যায় না। হুট করে হয়ে যায়। বুঝতেই পারি না কোথা থেকে শুরু, কেন শুরু… শুধু জানি, ওকে ছাড়া দিনটা অপূর্ণ লাগে।”

আশা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। আরশীন একটু চুপ করে থেকে আবার বলল,
— “প্রথমটা ছিল বিরক্তি, ওর থেকে সবকিছু গোপন রাখতে হবে এমন একটা বিষয়। এরপর মনে হলো, ওকে ছাড়া এই গল্পটা জমে না। একসময় বুঝলাম, আমি ভেতর থেকেই বদলে যাচ্ছি।”
— “ভালোবাসা কি বদলে দেয়?” আশা মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
— “হ্যাঁ। ভালোবাসা মানুষকে নরম করে দেয়, শক্ত করে তোলে আবার দুর্বলও। কেউ একজন হঠাৎ জীবনের কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায়, আর কিছুই আগের মতো থাকে না।”
আশা চুপ করে রইল। চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল কেবিনের যন্ত্রপাতির হালকা শব্দ, আরশীনের ভেতরের অনুভবের গর্জন যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
— “তোমার ভালোবাসায় খুব সত্যতা আছে আপু। জানো?” আশা বলল।
আরশীন একটু হেসে বলল,
— “ভালোবাসা যদি সত্য না হয়, তাহলে সেটা শুধু অনুভূতির অপচয়।”
দুই বোনের কথোপকথনের মাঝে জহিরুল ইসলাম হঠাৎ করেই উপস্থিত হলেন। তিনি আশার পাশে বসে টুকটাক খোঁজখবর নিলেন। একসময় কথার প্রসঙ্গ ঘুরে গেল, ওদের কলাবাগানের বাড়ির দিকে। নিচু গলায় জানালেন, শত্রুপক্ষ কলাবাগানের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। কে বা কারা, এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না তবে বিষয়টা গুরুতর। বাড়ির নিরাপত্তা নাই তাই যে কেউ প্রবেশ করতে পারে। তারা ভাঙচুরও করেছে বেশ কিছু জিনিস।
জহিরুল জানেন, সেই বাড়িটা শুধুমাত্র একটি স্থাবর সম্পত্তি নয়; এহসানুল হকের জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক ওই বাড়ির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বহু গোপন নথিপত্র, কাগজপত্র, এমনকি কিছু দুর্লভ তথ্য ও বস্তু সেই বাড়ির ভেতরে সযত্নে রেখে গিয়েছিলেন। শত্রুরা এখন তা হাতিয়ে নিতে চাইছে।
তিনি আশাকে বুঝিয়ে বললেন, এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো সতর্ক থাকা। যদিও আশাদের ঠিকানা ও সংশ্লিষ্টতা কেউ জানে না বলেই তাদের বিপদের আশঙ্কা আপাতত কম, তবুও সাবধান থাকা দরকার। বিশেষ করে মা-মেয়েকে খুব হিসেব করে চলতে হবে। কখন কোন অশুভ পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায়, বলা যায় না। আশার চোখে-মুখে উদ্বেগ। কথাগুলো শুনে তার ভিতরে একটা অনিশ্চয়তা গেঁথে বসে গেল। ভবিষ্যতের দিনগুলো আর সরল আর নির্ঝঞ্ঝাট থাকবে না। আরশীন কথাগুলো শুনে চুপচাপ বসে ছিল, কিন্তু ভেতরে ওর ভিতরটা উথালপাথাল হচ্ছিল। ও কিছু করতে পারছে না। আদিয়াত পরিষ্কারভাবে ওকে বলে দিয়েছে, এখন আর কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। কলাবাগানে যাওয়া তো দূরের কথা, বাইরে বের হওয়াটাও আপাতত নিষেধ। সে জানে, প্রতিমুহূর্ত নজরদারি হতে পারে এবং কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু আরশীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ভীষণ দ্বন্দ্ব। একদিকে আদিয়াতের অবস্থার জন্য তাকে ছায়ার মতো পাশে থাকতে হচ্ছে, অন্যদিকে নিজের পরিবারের নিরাপত্তা, বাবার স্মৃতি আর সেই গোপন সত্যগুলো টানছে অন্যপাশে। যাদের বিরুদ্ধে লড়াই, তারা থেমে নেই। বরং আরো বেশি আগ্রাসী হচ্ছে।
আদিয়াত পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু নিশ্চুপ থাকলেও বিপদ বাড়বে। অন্তত একটা কনফার্মেশন দরকার। শত্রুরা ঠিক কী খুঁজছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে কিংবা ওদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। সরাসরি না পারলেও কাউকে পাঠাতে হবে, নজরদারি রাখতে হবে। আরশীন এই প্রস্তাবটা রাখতে গেলেই এক সিস্টার এসে সামনে দাঁড়াল,
— “ম্যাডাম, স্যার আপনাকে ডাকছেন।”
আরশীন তাকাল। আদিয়াত জ্ঞান ফেরার পর থেকে যতবার ডেকেছে, ততবারই একটা তৃষ্ণা জমেছে ওর মনে; ওর কথা শুনবে, ছুঁয়ে দেখবে, পাশে থাকবে। তাই আরশীন দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
কেবিনের দরজায় এসে ও কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরের দৃশ্যটা এক মুহূর্তেই ওর ভেতরটা ভার করে তুলল। আদিয়াত খালি গায়ে শুয়ে আছে। বুকে ব্যান্ডেজ, সদ্য ড্রেসিং শেষ হয়েছে। মেদহীন ফর্সা পেটটা ব্যান্ডেজের ফাঁক গলে ছিল। নার্স ইনজেকশনের জন্য হাতটা সামান্য উঁচু করে ধরে রেখেছে। এক হাতে ইনজেকশন দিচ্ছে আরেক হাতে ওর কনুইটা ধরে আছে, সাধারণ অথচ জড়িয়ে ধরা ভঙ্গিতে।
আরশীনের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। হাত ধরার কী দরকার ছিল? এমনকি এত আদুরে ভঙ্গি? কেউ একজন আছে যে আদিয়াতের ‘বউ’ নামে পরিচিত। তাহলে তার কর্তব্য কী? আরশীন হঠাৎ-ই ঈর্ষায় নরম হয়ে উঠল। ওর চোখ পড়ল নার্সের চোখে; সেই চোখে অদ্ভুত কোমলতা, যত্ন, একরকম স্নেহ যেন। আরশীন সেটা গিলতে পারল না। নার্স এবার আদিয়াতের কপালে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,
— “ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। ব্যান্ডেজও আছে নড়াচড়া করবেন না, ওকে?”

ঠিক ওইসময় আরশীন ঠাস করে একটা শব্দ করল। নার্স হকচকিয়ে তাকাল।
— “আমি আছি এখন উনার খেয়াল রাখার জন্য। আপনি যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডেকে দিব।” নার্স কিছু বলার আগেই আরশীন ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে তার কাজ শেষে বেরিয়ে পড়ল। আরশীন ধীরে ধীরে আদিয়াতের পাশে এসে বসল। মুখে অভিমান লুকোতে পারেনি, তবে চোখে-মুখে স্পষ্ট ভালোবাসার দাবি। ঠোঁট উল্টে বলল,
— “অন্য কেউ আপনার যত্ন নেবে, এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।”

আদিয়াত বুঝে ফেলল বিষয়টা। মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল।
— “আপনি এসেছেন? এখন সত্যি আর কিছু লাগবে না। কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমার কাছে থাকবেন বলে বাড়ি যাচ্ছেন না। কিন্তু কাছাকাছি থাকছেন কোথায়?”

আরশীন উল্টো প্রশ্ন করল,
— “ওই নার্সের সাথে আপনার কি?” কণ্ঠে হালকা রাগ মেশানো।
আদিয়াত খানিকটা অবাক হলো,
— “মানে?”

আরশীন চোখ তুলে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— “হাত ধরল কেনো? এত যত্নআত্তি করার কী দরকার?”

আদিয়াত বুঝে উঠতে পারছিল না, রাগটা নার্সের উপর না তার উপর। হালকা হেসে বলল,
— “ইনজেকশন দিচ্ছিল, প্রেসার দেখছিল। আর ব্যালান্স রাখার জন্য হয়তো ধরেছে। এটা সিরিয়াস ব্যাপার কিছু না।”
— “আগে বলেন, আপনার বউ কে?”
— “আপনি।” আদিয়াত উত্তর দিল।
— “তাহলে ওই নার্স এত যত্ন করে হাত ধরেছিল কেনো?”
— “ব্যথা কমাতে।”
— “হুম… এখন থেকে শুধু আমি ধরব। ব্যথা দিতে হলেও আর কমাতে হলেও।” এই বলে আরশীন ওর হাতটা আলতো করে ধরল, নিজের অধিকার নিয়েই। আরশীনের ভেতরের সমস্ত অভিযোগ যেভাবে এসেছিল ওভাবেই এক মুহূর্তেই গলে গেল। আদিয়াত অবাক হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে শুয়েও সে যেন বুঝতে পারছে আশেপাশে কী হচ্ছে। মেয়ে মানুষের মন বোঝা বড্ড কঠিন! তার থেকেও কঠিন মেয়ে মানুষ নিজেই। না হলে এই হাসপাতালের বেডে শুয়ে তাকে এসব ভাবতে কেনো হচ্ছে?
ওর বুকের ব্যান্ডেজ টান দিচ্ছে, শরীর যন্ত্রণায় জর্জরিত, কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরছে অন্য তরঙ্গ। আরশীন চুপচাপ পাশে বসে আছে। সবকিছুর সাথে আদিয়াত আরেকটা জিনিসও খুব ভালো করে বুঝল; যতই ব্যাথা হোক, সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ‘ট্রিটমেন্ট’ হলো এক চিমটি ভালোবাসা। আদিয়াত একরকম দীর্ঘশ্বাস ফেলেই ভাবল,
— “ভালোবাসা মানুষকে দুর্বল করে না বরং জটিল করে তোলে। কারণ, সে কেবল শরীরের চিকিৎসা চায় না, চায় মনেরও। আর মেয়েদের সেই চিকিৎসা… সেটা কোনো ডাক্তারও বুঝে উঠতে পারে না।”

আরশীন এরপর থেকে কেবিনের কোণায় বসেই চোরা চোখে নজর রাখতে শুরু করল, কে আসছে আর কে যাচ্ছে। প্রতিটা পায়ের শব্দেই ওর চোখ চলে যায় দরজার দিকে। ঢংয়ের সেই নার্স…। বারবার দরজায় এসে দাঁড়ায়, ছোটখাটো অজুহাতে ঢুকে পড়ে। ওর হাতের ফাইল না থাকলেও মুখে মিষ্টি হাসি লেগে থাকে।
আরশীনের ভিতরে তখন একরাশ বিরক্তি। কিছু বলা যায় না, তবুও সে চোখ সরিয়ে রাখতেও পারছে না। সেই দৃশ্য; আদিয়াতের খালি গায়ে ব্যান্ডেজ, নার্সের স্পর্শে হাত ধরা, সেটা ওর চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। তার চাহনিতে একটা নিরব পাহারার ছাপ, আদিয়াতের চারপাশে সে নিজেই এক প্রহরী।
আদিয়াত তখন বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায়। চোখে সেই রসিকতা, ঠোঁটের কোণে একটুখানি দুষ্টু হাসি। গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে বলল,
— “আপনি কি আগে থেকেই এমন হিংসুটে নাকি?”

প্রশ্নটা শুনে আরশীন এক মুহূর্ত থমকাল। মুখটা কড়া করে বলল,
— “কি করে বলব? আগে বিয়ে করেছিলাম নাকি?”

আদিয়াত হালকা ভ্রু কুঁচকে কল্পনার ঢেউ তুলল,
— “ওহ আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম আগেও বিয়ে করেছেন।”

আরশীনের চোখে তখন রাগের দমক। কণ্ঠস্বর ধারালো,
— “আপনার ভাবনাতে আমার কি?”

আদিয়াত হাসতে চাইলেও বুঝতে পারল এখন সময়টা ঠিক হাসির নয়। মেজাজ একটু গরম।
— “কিছু না?”
— “জি না। এত উল্টাপাল্টা কথা বলছেন কেন আপনি? আপনাকে না ডাক্তার বেশি কথা বলতে নিষেধ করছে? আপনার এই বকবক আমার একদম সহ্য হচ্ছে না।”
তারপর একটানা বলে গেল, রাগে-অভিমানে, “দয়া করে মুখ বন্ধ রাখেন। আর যদি খুব কথা বলার ইচ্ছে হয় তবে আমি নার্সকে ডেকে নিয়ে আসি, তার সঙ্গে গল্প করুন। উনার তো ইন্টারেস্ট বেশ মনে হলো। ডাকবো তাকে? আরে ধুর, আমি আবার জিজ্ঞেস করছি কেন?”

এক দমে কথাগুলো বলেই আরশীন উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ কঠিন, মেজাজ গরম। সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর আদিয়াত বালিশে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা এমনই। অভিমান আর ভালবাসা, রাগ আর শীতলতা, সব একসাথে মিশে এক অনন্য রূপে ফুটে ওঠে।
আরশীন চলে যাচ্ছিল। আদিয়াত ডেকে বলল,
— “দাঁড়ান দাঁড়ান… এত রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো মজা করছিলাম।”
আদিয়াত উঠে বসতে চাইলো, কিন্তু ওর বুকের কাছে ব্যান্ডেজ কিছুটা টান দিয়ে উঠে উঠল। মুখটা কুঁচকে গেল ব্যথায়। আরশীন এক ধাপে এলো ওর পাশে।
— “আপনি উঠছেন কেন? কতবার আপনাকে কথা বলতে হয়?” চোখে-মুখে বিরক্তি থাকলেও গলায় ছিল দুশ্চিন্তার রেশ।

আদিয়াত গলার স্বর নরম করে বলল,
— “আপনি হিংসুটে হোন বা ঝাঁঝালো, এই ব্যথা যদি প্রতিদিন আপনার এমন যত্ন পাওয়ার দরজাটা খোলে, তাহলে এই ব্যথা থাকুক।”
আরশীন তাকিয়ে রইল কিছুটা সময়, তারপর চোখ সরিয়ে নিল। মুখে রাগ ধরে রাখার চেষ্টা করলেও ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি খেলে গেল।
— “আপনার নাটক এখনো বন্ধ হয়নি দেখি।” গলা নরম করে এলেও মুখে কড়া ভাবটা ধরে রাখল।

আদিয়াত ফিসফিস করে বলল,
— “আপনি পাশে থাকলেই সব নাটক বাস্তব মনে হয়। প্লিজ, আপনি রাগ করে হলেও একটু বসুন?” ওর অনুরোধে আরশীন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। এই মুহূর্তে ওদের কথাগুলোর বাইরে আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
.
আদিয়াত হাসপাতাল থেকে ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু তার চেহারায় এখনও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। হাসপাতালে থাকাকালীন কাজের বিষয়ে সে একবারও মুখ খোলেনি। রিলিজের এক সপ্তাহ পর, জহিরুল ইসলাম নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন,
— “তুমি আপাতত বিশ্রামে থাকো। কাজের কথা পরে ভাবা যাবে।”
সব ঠিক আছে তবে তার মনে একটা জিনিস ক্রমাগত ধেয়ে আসছে; চাচার কাছ থেকে সে হিসাব চেয়েছিল, উত্তর চেয়েছিল। কিন্তু সেসবের কোনো সাড়া নেই। আমিনুল ইসলাম একবারও এসে কিছু ব্যাখ্যা দেননি। আদিয়াত ভাবছে, সে ঘটনায় হতচকিত হয়ে গেছেন। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে এই দুর্ঘটনার জন্য সে হাসপাতালের বিছানায় কয়েকদিন পড়েছিল, তা আসলে নিছকই দুর্ঘটনা নয় বরং তারই এক আত্মীয়ের, তারই রক্তের মানুষটির নিখুঁত এক ষড়যন্ত্র। বিশ্বাসঘাতকতা যদি জানত, তাহলে কি ভেঙে পড়ত সে? হয়তো না, কিংবা হয়তো চিরকালের মতো চুপ করে যেত।

আদিয়াত বাসায় আসার পর থেকেই আরশীন কড়া নজরদারির মতো তাকে ঘিরে রেখেছে। ওর কাজের প্রতিটা খুঁটিনাটি, প্রয়োজীয় সব, ওষুধ খাওয়ানো থেকে ঘুমানোর আগে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, যত্নআত্তি কোনোকিছুর কমতি রাখে নাই। আজকের দিনটা আলাদা। আদিয়াত সকালবেলা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল, কপালের কোণে সাদা ব্যান্ডেজ; ওসব পরোয়া করল না।
— “অনেক কাজ জমে আছে।”
— “আপনি আবার কী করতে যাচ্ছেন?” আরশীন একরকম চমকে উঠল।
— “আপনাদের বাড়ি যেতে হবে। ওই ঘটনার অংশবিশেষ আমি শুনেছি। এবার পুরোটা জানতে হবে।”
আরশীন যেতে চাইলো না। এমনিতেই আদিয়াতের শরীর ঠিক নাই। কিন্তু ওর জোরাজুরির কাছে দোনোমনো টিকলো না। ভাবল, ঠিক আছে অনেকদিন তো ঘরে বসেই। ছেলেমানুষ আর কতক্ষণ এইভাবে শুয়ে বসে থাকতে পারে? বাইরে গেলে ভালো লাগবে।
.
.
.
চলবে….