তবুও তুমি পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
26

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩১]
~আফিয়া আফরিন

(একটি নিগূঢ়তা)
রেজা ঠান্ডা মাথায় কাঁটার মতো ঠেস মেরে মেরে কথাগুলো বলছিল। ওর মুখে একধরনের বিদ্রুপ। হারিয়ে যাওয়া বংশধর, হারানো অধিকার এবং অনাহুত সম্পর্কের অভিযোগ বিষ ছড়াচ্ছিল চারপাশে। কথাগুলো এভাবে বলে নিজেকে বৈধ প্রমাণ করে অন্যদের ছোট করতে চাওয়াই তার মূল লক্ষ্য।
জহিরুল ইসলাম চুপচাপ শুনছিলেন। কিন্তু একসময় আর সহ্য হলো না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। হঠাৎই রেজার গলার কলার চেপে ধরলেন তিনি, চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছিল। তিনি হয়তো মানুষ হিসেবে ১০ জনের কাছে খারাপ। অনেক ভুল করেছেন জীবনে, কিন্তু পিতা হিসেবে কখনো ব্যর্থ নন। আরশীনকে আদিয়াতের সাথে বিয়ে দেওয়ার পেছনে অনেক কারণ ছিল। কিন্তু তারমধ্যে অন্যতম কারণ হলো, রেজার চোখ থেকে ওকে সরিয়ে নিরাপদ রাখা। বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার আগে তিনি প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। সবশেষে, আজ হঠাৎ নিজের সন্তানের সন্তান হারানোর খবর শুনে জহিরুল ইসলামের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণার ঝড় বয়ে গেল। নিজের কৃতকর্মের ভুল, রেজার মতো একজনের উপস্থিতি আর অতীতে বহুবার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন তিনি। অপরাধবোধ হচ্ছে নিজের মধ্যে… অপরাধী মনে হচ্ছে তার নিজেকে। রেজা কি করবে? সে তো বাহিরের মানুষ। আর সে নিজে তো… হাহ দীর্ঘশ্বাস! রেজাকে ছেড়ে দিলেন। তার ভেতরের সমস্ত কঠিনতা গলে পড়ল একবিন্দু নীরব অশ্রুতে।

আরশীন একটু সরে গিয়ে সোফায় বসল। চোখেমুখে লাজুক একটা অভিব্যক্তি। কেবিনে ঢোকার সময় যারা ছিলেন, তাদের এখন আর দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই পরিস্থিতি দেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেছেন।
আরশীন এবার নিজের আচরণে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করল। এমন অপ্রত্যাশিত আগ্রাসী আবেগ তো ওর স্বভাবে নেই। কী করে যে এমন হয়ে গেল! আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আমি কি ভুল সময়ে এসে আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম?”

আদিয়াত ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল,
— “সময়ের আবার ঠিক-ভুল আছে নাকি?”

আরশীন ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বলল,
— “এই যে আছে… বিরক্ত করেই ফেললাম।”

আদিয়াত একটু এগিয়ে এসে টেবিলের এককোণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
— “সেটা তো আপনি ভাবছেন। আমি তো মনে করি, সময় যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে ঠিক করে নেওয়ার মধ্যেই বরং সবচেয়ে কম ভুল থাকে। আপনি এসেছেন, এটাই আসল। বাকিটা গৌণ।”

আরশীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দৃষ্টি তখন মেঝেতে আটকে,
– “হয়তো। আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। মনে আছে?”
— “হুমম। বলেছিলেন… কিন্তু বিষয়বস্তু বলেননি।”

আরশীনের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। চুপচাপ চোখ নামিয়ে বলল,
— “সেই সারপ্রাইজটা আপনাকে আর কখনোই দেওয়া হবে না।”

আদিয়াত ভুরু কুঁচকে তাকাল,
— “কেনো?”

আরশীন গভীর নিশ্বাস নিল। গলার স্বর কেঁপে উঠল,
— “হারিয়ে ফেলেছি… হারিয়ে গেছে আমার কাছ থেকে। যা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই, তা আমি হারিয়ে ফেলি বারবার… প্রতিবার। এতটাই দুর্ভাগ্য। আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেন?” কথাগুলো বুকের গহীন থেকে উঠে এলো, দীর্ঘদিন জমে থাকা দুঃখের মতো। আদিয়াত একটু থেমে বলল,
— “ভাগ্যের দোষ দিচ্ছেন? লাভ আছে কোনো? আপনার ভাগ্য খারাপ না, পরিস্থিতি খারাপ ছিল।”

আরশীন হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল। ঠোঁটের কোণে একরকম কষ্ট লুকিয়ে বলল,
— “হুহ… পরিস্থিতি শুধু আমার বেলাতেই খারাপ হয়, তাই না?” গলার কাঁপুনি, চোখের জল, আর হাসির আড়ালে ভাঙা আত্মবিশ্বাস; কোনটাই লুকিয়ে রাখতে পারল না আরশীন। আদিয়াত এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল,
— “আবার কাঁদছেন? যখন আমাদের বিয়ে হলো কিংবা তার পরের সময়গুলোতে আমি আপনাকে বেশ শক্ত একজন মানুষ মনে করতাম।”

আরশীন চোখ মুছে বলল,
— “আমার কি তখন একটা আদিয়াত ছিল? ভালোবাসার মানুষ ছিল? আপনাকে ভালোবেসেই তো গন্ডগোল করে ফেললাম। আর আপনি সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আরও বড় গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিলেন। এখন বলুন, নিজের মানুষের কাছে কাঁদতে লজ্জা আছে?”
— “তবে ঠিক আছে। মনটা হালকা করুন। এইটুকু একটা মনে যদি পাহাড় সমান দুঃখ জমিয়ে রাখেন, তাহলে আমার জায়গা কোথায় সেখানে?” আদিয়াতের কণ্ঠে কোমল আত্মসমর্পণ। সে না বলেও বুঝিয়ে দিল, তুমিই তো আমার আপন। তাহলে তোমার ভার আমি না নিলে কে নেবে?
.
ইতোমধ্যে ফরিদপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে আদিয়াত নিজের মত করে ভাবতে শুরু করেছে। ঘটনাগুলো পরপর আরশীনের বাবার সাথে সম্পর্কিত। আগে তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। আরশীনের কাছে বিশেষ কিছু জানতে পারল না কারণ তিনি কাজের বিষয়গুলোর সাথে পরিবারকে খুব কম জড়াতেন। আদিয়াতও সে কথা মাথায় রেখে এগিয়ে চলল। তারপর থেকেই শুরু… এক এক করে সে খোঁজ নিতে শুরু করে। আরশীন পাশে থেকেও কিছুই জানে না, আদিয়াত কিচ্ছু জানতে দেয় না।
এক সকালে কোনো নোটিশ ছাড়াই আদিয়াত রওনা দেয় ফরিদপুর। সাথে নেয় শুধু কয়েকটি পুরনো দলিলের ফটোকপি আর পরিচিত একজন পুলিশ অফিসারকে। কারো যেনো সন্দেহ না হয়, তাই পুলিশকে নিয়ে সিভিলে খুব সাধারণভাবেই গেছে। ওরা যেখানেই হাত দিচ্ছে, যেখানেই খোঁজখবর নিচ্ছে, ঘুরেফিরে রেজার নামটা উঠে আসছে বারবার। এটা তো কাকতালীয় হতে পারে না। ফরিদপুরে গিয়ে সে কথা বলে এক পুরনো রেজিস্ট্রি অফিস সহকারীর সঙ্গে। এক চা-দোকানী বলে,
— “এই রেজা মিয়া? ওরে তো আমরা কবে থেকে দেখিই নাই। কাগজে কলমে সব সোজা, কিন্তু মানুষটা সোজা না… মেলা ছলচাতুরি জানে।”

কেউ বলে,
— “ওর নামে কিছু নাই। প্রমাণ নাই। অভিযোগ করা যায় না কিন্তু অনেকের সর্বনাশের মূল ওই লোক। কী জানি কেমনে বারবার হাতের ফাঁক গলে পালিয়ে যায়। আমরা বাপু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এত দেখে কি করব?”
আদিয়াত ফিরে যায়, রাত জেগে পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে। আরশীন বলে,
— “আপনি এইসব নেন কেন? এত কাজকর্ম আপনার বাড়িতেও করা লাগে?”
— “একটু তো করা লাগেই। আপনি জেগে আছেন কেন এখনো?”

আরশীন গোমড়া মুখে উত্তর দিল,
— “আপনার জন্য।”
— “আমি কি ধরে-বেঁধে রেখেছি নাকি?”
— “আপনার বুকে মাথা রেখে না ঘুমালে আমার ঘুম আসবে না যে।” নরম কণ্ঠের একটা আবদার।
আদিয়াত থমকে গেল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেই সে চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে স্ক্রিন বন্ধ করে দিল। ফাইল, রিপোর্ট, মেইল সবকিছু তুচ্ছ হয়ে গেল। নিঃশব্দে ওর মুখে একটুকরো হাসি খেলে গেল। সে এসে বিছানার পাশে বসল। আরশীন ততক্ষণে বালিশে মাথা রাখলেও ঘুম আসে না বলে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। আদিয়াত ধীরে হাত বাড়িয়ে ওর কপালে একটা আদর ছুঁইয়ে দিল। আরশীন নিঃশব্দে ওর বুকের দিকে এগিয়ে এল। আদিয়াত নিজের কাজের পৃথিবী একপাশে রেখে আরশীনকে নিজের বুক জুড়ে জড়িয়ে ধরল। একহাতে ওর চুলে আলতো করে আদর করতে করতে বলল,
— “আর কোন কথা নয় এখন শুধু ঘুম, ঠিক আছে?” আরশীন ধীরে শান্ত হয়। ওর নিঃশ্বাস ভারী থেকে হালকা হয়, বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল একটানা নদীর মতো। আদিয়াত নিজের সব চিন্তা, কাগজ, টেনশন একপাশে ফেলে শুধু ওর নিঃশ্বাস গুনতে ব্যস্ত। আদিয়াত ওকে বুকের ভেতর আগলে রেখেছে ঠিকই তবুও আরশীনের চোখের কোণের ক্ষীণ অস্থিরতা ফুঁটে বেরোয়, অদৃশ্য কাঁটা চোখে না পড়লেও প্রতিক্ষণে বিঁধে যায়। ও ইদানিং প্রায় সময় আদিয়াতকে নিয়ে প্রচুর ইনসিকিউরিটি ফিল করে। মেয়েটার জীবনের একটাই অভিযোগ, তার ভালোবাসার জিনিস/মানুষ কোনটাই নাকি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় না। মাঝপথে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে চলে যায়। ও জানে, আদিয়াত আছে। কিন্তু কখনও যদি পাশে না থাকে, সেই ভাবনাটাই ওর নিঃশ্বাস আটকে দেয়। অথচ আরশীন নিজেও বোঝে আদিয়াত ওর জন্য কতটা করে। কতটা ভালোবাসে। তবুও ভেতরে একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করে।
থাক না, এমনটাই যদি নিয়তি হয়? আদিয়াত যদি কখনো ওকে ছেড়ে দেয়? চলে যায়? তখন ও কী করবে? কী নিয়ে বাঁচবে? তাই আরশীন চায় এখনকার ভালোবাসাটুকু পূর্ণ করে নিতে। প্রতিটা মুহূর্ত মনে জমিয়ে রাখতে। যাতে যদি কখনো হারিয়েও ফেলে, তবে তারমধ্যে যেনো কোনো অপূর্ণতা না থাকে। আরশীন আদিয়াতকে নিয়ে জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা রাখতে চায় না।
আদিয়াত বোঝায় না কিছু। বোঝালেও ও বুঝবে না। কারণ সে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছে, না বোঝার। একটা অব্যক্ত জেদ নিয়ে নিজেকেই হারাতে চায়।

আদিয়াত অনেকটাই রেজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল। হঠাৎ মাঝখানে বাঁধ সাধলেন আমিনুল ইসলাম। তিনি আবারও রেজাকে নিয়ে এক হিসেব কষতে বসলেন। দিনকে দিন তার লোভ চড়চড়িয়ে বাড়ছিল। আজকে অফিসে না আদিয়াত ছিল না জহিরুল ইসলাম, তাই রেজাকে সরাসরি নিজের কক্ষে ডাকলেন। রেজা ঢুকল বেশ ভারিক্কি ভঙ্গিতে। চোখের চাহনি, ঠোঁটের বিদ্রূপ, কেমন যেনো! চেয়ারে বসেই বলল,
— “বুঝছেন, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে আপনাদের পুরো পরিবারটাই উড়িয়ে দিই। একেকজনের সাথে আমার এমন কিছু না কিছু হিসেব জমে আছে… যেটা আর হিসাবের খাতায় রাখাও যায় না। রক্তে লিখে ফেলেছি প্রায়।”

আমিনুল ইসলাম চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে রেজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “তুমি শুধু আদিয়াতের বিষয়টা দেখো।”

রেজা তখন কথায় ছুরি চালানোর মতো ঠাণ্ডা স্বরে বলে চলল,
— “তাকে তো একদম আলাদা করে সামলাতে হবে।”
— “কেন? ওর সাথে তো তোমার কিছু না।”

রেজা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে হেসে বলল,
— “না? না বলছেন? আরশীনকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার ছিল। প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। তখন পুলিশকে বলেছিলাম। উত্তর কী পেয়েছিলাম জানেন?”

আমিনুল ইসলাম এবার হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কী?”
— “একটা থাপ্পড়।” ডান গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল।
— “তুমি এসব কথা আগে কেন বলোনি রেজা?”

রেজা একটু হেসে বলল,
— “কারণ রেজা অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না। আমি যখন যেটা দরকার মনে করি, তখনই বলি। আপনি তো জানেন, আমি হিসেব করে কথা বলি।”
এইমুহুর্তে রেজাকে তার ভীষণ বিপদজ্জনক মনে হলো। যতটা ভেবেছিল তার থেকেও বেশি। রেজা এবার একটু ঝুঁকে এসে বলল,
— “পুলিশের বড় জামাই, মানে আপনাদের আদিয়াত মোটামুটি আমার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ জোগাড় করে ফেলেছে। খুব শিগগিরই হয়তো কিছু করবে ও। তাই ভাবলাম, যা করার আমি নিজেই করি। দ্রুত করব, নিখুঁতভাবে করব। এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। আপনারও লাভ, আমারও।”

আমিনুল ইসলাম তাকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিলেন। তার মুখে কিছু বলার ছিল কিন্তু শব্দ আটকে যাচ্ছিল গলায়। রেজা তখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, শার্টের উপরের বোতাম লাগাতে লাগাতে যোগ করল,
— “চিন্তা করবেন না, এই লাভের জন্য আপনাকে কোনো প্রতিদান দিতে হবে না। আমি ঠিক জানি, কে কী চায়। আপনি শুধু নিজের চোখটা বন্ধ রাখবেন। আজ আসি। কাল আবার এই সময়েই আসব। কিছু পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে হবে। দেখা হবে, আমিনুল সাহেব।” দরজার খোলামেলা শব্দটা ঘরের নিস্তব্ধতায় একটা ছেদ টেনে গেল। আমিনুল দ্বিধায় জর্জরিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এত অভিজ্ঞ, এত হিসেবি দুইজন মানুষ; পরিকল্পনার গভীরে এতটাই নিমগ্ন ছিল যে, একটি প্রাথমিক সতর্কতাও তাদের মন থেকে মুছে গিয়েছিল। “দেয়ালের’ও কান আছে” এই পুরোনো প্রবাদটি ভুলে গিয়েই ভুল করেছে তারা।
এই রুম সাউন্ডপ্রুফ নয়, জানলাটাও পুরোপুরি বন্ধ ছিল না। দেয়ালের পেছনে, করিডরের কোণায় একজোড়া কান অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, নিঃশব্দে… নিঃশ্বাস আটকে। চোখ বড় হয়ে গেছে বিস্ময়ে আর মনের ভেতর জমে উঠেছে প্রশ্ন আর সন্দেহের ঘনঘটা। রেজা তখন নিজের কণ্ঠস্বরে আত্নবিশ্বাসী। নিজেকে ভেবেছিল সকলের নাগালের বাহিরে। ঘুণাক্ষরেও টের পেল না, ওর উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ কারো হৃদয়ে ছুড়ির ফলা হয়ে আঘাত করছে। যাই হয়ে যাক না কেন; একথা নিশ্চিত, আজকের এই দেয়াল নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবে না।
.
নীরার মনে আদিয়াতের জন্য যে ভাবনার বীজ বুনেছে, তা একদিনে গজায়নি। বছর কয়েক আগের এক সন্ধ্যায়, বাবা বলেছিলেন,
— “নীরার বিয়ে আমি আদিয়াতের সাথেই দিব। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা ঘরেই থাকবে।” সেই কথাটাই নীরার বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত স্পন্দনের জন্ম দিয়েছিল।
সেই থেকেই শুরু। আদিয়াতের প্রতি ওর মনে তৈরি হতে থাকল এক ধরনের মমতা, একচেটিয়া অধিকারবোধ। ও বুঝত, এটা ভালোবাসা।
কিন্তু আদিয়াত, সে কখনও পাত্তা দেয়নি। অনভিপ্রেত দূরত্বটা সে নিজেই রেখে দিয়েছিল সবসময়।
নীরা অবশ্য ভালোবেসে গেছে। আদিয়াতের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও… সেই ভালোবাসা থামেনি। কতবার ভেবেছে, “আচ্ছা, যদি একদিন আরশীন না থাকে। যদি তার জায়গা কখনো ফাঁকা হয়…”
ভয়ঙ্কর চিন্তা মাথায় খেলেছে কিন্তু এরপরেই বিবেক বাঁধা দিয়েছে। নীরা কখনো কিছু বলেনি, আদিয়াতকেও না, কাউকেই না। চোখের পাতায় সেই অপূর্ণ স্বপ্নগুলো রয়ে গেছে। প্রথম প্রথম আরশীনের উপর বিদ্বেষ থাকলেও এখন নেই। তারপরেও যখন হঠাৎ দেখে আদিয়াত আরশীন হাসিমুখে তাকায়, কথা বলে, ঠাট্টা করে, নীরার চোখদুটো তখন অজান্তেই ঝাপসা হয়ে যায়।
বিগত কয়েক মাস ধরে সরাসরি আদিয়াতের তত্ত্বাবধানে কাজ করার ফলে ওর ভেতরের নেতৃত্বগুণ দেখেছে। আদিয়াতের পক্ষ থেকে নীরার জন্য আলাদা কিছুই নেই এমনকি চাচাতো বোন হওয়ার পরেও না। আরশীন যে ওর কোথায়, কোন অংশ জুড়ে রয়েছে, সেটাও বুঝতে বাকি নেই। আরশীনের সঙ্গেও ওর কখনোই খোলামেলা কথা হয় না।
দেখা হলে, একটুকরো হাসি। শুধু সামাজিক সৌজন্য মাত্র।

আজ অফিসে আদিয়াত ছিল না, কাজের চাপ ছিল না। ফাইলপত্র গুছিয়ে নীরা বাবার কেবিনে যাচ্ছিল। কিন্তু… কেবিনের দরজার খুব কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎই সে আটকে গেল। ভিতর থেকে বাবার সাথে আরেকজনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। নীরা দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিচ্ছাকৃতভাবে কানের কাছে শব্দগুলো ধাক্কা মারতে লাগল। কথাগুলো প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না কিন্তু একটু পর যখন বাক্যের অর্থ মাথায় ঢুকল, তখন মনে হলো মাটি ওর পা টেনে নিচ্ছে। শিরা-উপশিরায় কাঁপন, চোখে অন্ধকার। কথার ভেতর ছলচাতুরি, হিংসা, ষড়যন্ত্র; আর এসবটাই আদিয়াতকে ঘিরে। আতঙ্ক আর অবিশ্বাসে শরীরটা ঝিম ধরে গিয়েছিল। বাবা? তার মতো একজন মানুষ এমন পরিকল্পনার অংশীদার? নীরার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। বুকের ভেতর কিছু একটা ছটফট করল। চিৎকার করে উঠতে চাইল, অথচ গলা থেকে শব্দই বেরোল না। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। পেছন ফিরে দৌড়ে চলে আসে। পা বেঁধে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল করিডোরের এককোণে। চোখের সামনে সব ঝাপসা। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজেকে সামলে বাইরে বেরিয়ে আসে। মুহূর্তেই এই অফিস, এই দালান, এই মানুষগুলো অচেনা মনে হচ্ছিল। দুনিয়ার আলো ছেড়ে ও বোধহয় এক অজানা অন্ধকারে ঢুকে পড়েছিল। ঠিক তখনই ভবনের সামনের চত্বরে একটা গাড়ি এসে থামল। দরজা খুলে নামল আদিয়াত। অসহ্য যন্ত্রণার মাঝেও ওকে দেখে এক চিলতে আশ্বাস নামল বুকের ভিতর। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঠিক সামনে দাঁড়াল সে। আদিয়াত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কী হয়েছে? এভাবে দৌড়ে এলে কেন?”
নীরা কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শব্দহীন কাঁপুনির মতো চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। আদিয়াত খানিক চিন্তিত হয়ে বলল,
—“নীরা, আর ইউ ওকে? কাঁদছ কেনো?”

নীরা মাথা নাড়ল। কাঁপা গলায় বলল,
—“কিছু না। কিছু না…” নিজের মুখে নিজের কান্নার ব্যাখ্যা দিতে পারল না সে।
আদিয়াত ওর কাঁধে হাত রাখল
—“শরীর খারাপ?”
—“নাহ।” নীরা মাথা নিচু করে বলল। ওর কণ্ঠে এমন এক অসহায়তা আর ভয় ছিল, যা কোনো শব্দ দিয়েই বোঝানো যায় না। অসহায়তা নিজের বাবাকে নিয়ে আর ভয় আদিয়াতকে নিয়ে।
আদিয়াত নরম কণ্ঠে বলল,
—“বাড়ি যাবে?”

নীরা ধীরে মাথা নাড়ল।
—“হুমম।”
—“এসো, পৌঁছে দিচ্ছি।” কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই নীরা ওর পিছু নিল। গাড়িতে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল। সিটবেল্ট বাঁধারও শক্তি অবশিষ্ট নেই। গাড়ির কাচে আলো-ছায়ার লুকোচুরি চলছে কিন্তু ওর মনে চলছিল এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি।
আগামীকাল। শব্দটা যেন কানে বাজছিল বারবার। কাল ওই লোকটা এসে আবার হাসিমুখে বিষ ঢালবে। আর তার বাবাও… আহ, সেই মানুষটাও সব জানে। জড়িয়ে পড়েছে অন্ধকার জালে। নীরার কেমন অসহায় লাগছে নিজেকে। কাকে জানাবে? আরশীনকে? ফোন হাতে নিয়েও নামিয়ে রাখল। এখন বলা ঠিক হবে? কালকের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কেমন হয়?
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩২]
~আফিয়া আফরিন

(মরণান্তক)
রাত তখন অনেকটা পেরিয়ে গেছে। শহরের কোলাহল থেমে গেছে, রাস্তাঘাট মোটামুটি নিস্তব্ধ। গাড়ির দরজাটা বন্ধ করতেই ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে মনে করিয়ে দিল, আজকের দিনটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। আদিয়াত ক্লান্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল। ড্রইংরুমে আযহান আর আলিয়া ছিল, আরশীনকে কোথাও দেখতে পেল না। ঘরে গেল, সেখানেও নেই। নিচে এসে একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে না দেখতে পেয়ে ছাদে পা বাড়াল। আরশীন সেখানেই ছিল। মাঝখানটায় বসে আছে হাঁটু কোলে তুলে, চুপচাপ। মুখটা ওইদিকে ফেরানো। আদিয়াত একটু অবাক হলো। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু সেটা ঠিক কী? আদিয়াত এগিয়ে এলো। আদিয়াতের উপস্থিতি টের পেয়ে আরশীন একবার তাকাল মাত্র, কিছু বলল না। আদিয়াত কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
— “এই এত রাতে একা বসে আছেন কেন?”

আরশীন মুখ ফেরাল। একটুকরো হালকা হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। স্পষ্ট কণ্ঠে সুন্দর করে বলল,
— “আমার যে মন খারাপ।”
— “কেন?”
— “জানি না…”
— “জানেন না?”
— “হ্যাঁ। ইদানিং এমনই হয়। কোনো কারণ ছাড়া মন ভার হয়ে থাকে। কোনো কিছু না ঘটলেও মনে হয় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অথচ কিছুই হয় না। শুধু আমার ভেতরেই কিছু হয়ে যায়… নিজেকেই ঠিক চিনতে পারি না।”
ওর এমন রূপ নতুন নয়, ইদানিং ঘন ঘন হচ্ছে। হাসছে, হঠাৎ চুপ হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবার কাঁদে। আরশীন কী ভাবছে, কেন ভাবছে, তা সে নিজেও ঠিক ঠাহর করতে পারে না।
আদিয়াত আরশীনের হাত ধরল, ওকে টেনে উঠাল। কোনো কথাবার্তা বলল না। আরশীন নীরবে উঠে এলো, কোনো প্রতিরোধ নেই। ঘরে ঢুকতেই আলিয়া আর আযহান তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে। আলিয়া জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? আরশীনকে এইভাবে টেনে কোথা থেকে নিয়ে এলি?”

আদিয়াত গলা খানিকটা উঁচু করে,
— “তা তো আমিও জানতে চাই। তোরা এতগুলো মানুষ, কেউ একটাবার ওর খোঁজ নিবিনা? এইভাবে চলতে থাকলে এই মেয়ে পাগল হয়ে যাবে একদিন।”
আরশীন সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
— “আপনি কি বলছেন এসব? সবাইকে বলার কি দরকার ছিল? আমি ঠিক আছি তো। এমনি বাড়ির কথা মনে পড়ছিল।”

আদিয়াত ধমকের সুরে বলল,
— “প্লিজ, আপনাকে এখন আর কিছুরই কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমাকে যা বলছেন, সেসব নিজেকে বলুন।”

আলিয়া আরশীনের কাছে এসে দাঁড়াল। উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
— “আমি নিজেও খেয়াল করেছি তোমাকে কিছুদিন ধরে। ভেবেছিলাম হয়তো ব্যক্তিগত কিছু, তাই জোর করিনি। সত্যি করে বলো তো আরশীন, কি হয়েছে? মা-ও তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছে। কেমন করে ভাবনার গভীরে ডুবে থাকো সারাক্ষণ? কী নিয়ে এত ভাবো?”

আরশীন কাঁধ নামিয়ে ধীরে বলল,
— “না আপু, কিছু না।” কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে টেনে গিয়ে বসল সোফায়।
আলিয়াও পাশে এসে বসল।
— “কিছু না বলে সব এড়িয়ে যাওয়া যায় না আরশীন। যদি কোনো সমস্যা থাকে, আমাদের সাথে ভাগ করে নাও। আমরা কি তোমার পর? এতদিন একসাথে আছি, এতটা দূরত্ব রাখো কেমন করে?”

আরশীন মাথা নত করে বলল,
— “এমন কিছু না। মাঝে মাঝে শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে।”
— “শুধু কি তাই?”
আরশীন এবারও কেবল মাথা ঝাঁকাল, — “হ্যাঁ।”

হঠাৎ করেই আলিয়ার চোখে যেন একটু ঝলক খেলে গেল। হাসি চেপে বলল,
— “ভালো কথা তোমার মুড সুইং হচ্ছে, তাই না? বিষয়টা জটিল, ভেবে দেখার মত। অ্যাই, কোনো সুখবর আছে নাকি?”
প্রশ্ন শুনে মুহূর্তেই পরিবেশ পাল্টে গেল। আযহান ঘুরে তাকাল। আরশীন মাথা তুলল, চোখে বিস্ময় আর কিছুটা ঘোর। ধীরে বলল,
— “না তো।”

আলিয়া হেসে বলল,
— “উমম, ঠিক আছে। এখন না থাক, ভবিষ্যতে থাকবে তো। আর এই মনখারাপ করে থাকার দরকার নেই। চলো, আজকে আযহানের সাথে আমরা নতুন একটা ড্রামা দেখব। আযহান, শুরু কর না! প্রথম থেকেই দে, আজ সারারাত এই ড্রামা দেখে কাটিয়ে দিই।” এরপর আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই দেখবি নাকি? দেখলে আয়।”
আরশীন স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিল, চুপচাপ। একটানা তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে, ও কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
আদিয়াত? সে পাশেই ছিল। আরশীনের প্রতিটি ভঙ্গি, চোখের ভাষা, কথার অন্তর্নিহিত দোলাচল, সব লক্ষ্য করছিল এক অপলক দৃষ্টিতে।
আলিয়ার বলা “সুখবর” শব্দটা ওর ভেতরে কোথাও ধাক্কা দিয়েছিল। আরশীনের মুখের পরিবর্তন, হঠাৎ-ভয়-লুকানো গাম্ভীর্য সবকিছু মিলিয়ে ওর মনে হলো, সে কিছু মিস করছে। কিছু একটা বুঝে উঠতে পারছে না, যা বোঝা তার দরকার ছিল। আরশীনের এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কারণ কি? মুখে প্রকাশ করছে না অথচ চোখের ভাষায় প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা বোঝা যাচ্ছে না। আদিয়াত ওকে নিয়ে সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ল। আরশীন চাচ্ছে কি? কি ভাবনা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? সরাসরি কথা বলতে হবে, অন্ততপক্ষে কৌশলে ওর পেট থেকে কথা বের করতে হবে।
.
নীরা আজ সকাল থেকেই অস্থির। সারারাত চিন্তায় চোখে একফোঁটা ঘুম আসেনি। মাথায় ঘুরছে গতকালের সেই কথোপকথন। নিজের কানকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা দুঃস্বপ্ন হলে ভালো হতো। ওই লোকটা আজ আবার আসবে, চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক তা শুনতে হবে। ওর মনে হচ্ছে, আগুনের উপর দিয়ে হাঁটছে। সকাল থেকেই একবার বাবার কেবিনের দিকে যাচ্ছে, একবার আদিয়াতের খোঁজ করছে। কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। সময় তার পেছনে ছুটছে, আর সে নিজে ছুটছে ভয় আর দোটানার মধ্যে।
আদিয়াতকে ঘটনা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টার সাথে যেহেতু তার বাবার নাম জড়িয়ে আছে তাই বলার সাহস পাচ্ছে না। আদিয়াত জানলে কী করবে? একমুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাবে। নিজের চাচা বলে হয়ত মাফ করে দিবে কিন্তু সম্মান? সেটা তো ওখানেই চিরতরে মাটির সাথে মিশে যাবে। হাতের তালু ঘামে ভিজে যাচ্ছে, বুক ধুকপুক করছে। কখনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আবার মুহূর্তেই পিছিয়ে আসছে।
— “না, না, ওকে বলা ঠিক হবে না। আমি বরং আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। দেখি ওই লোক কখন আসে। তারপর না হয় সুযোগ বুঝে আরশীনকে ঘটনা বলা যাবে। সে নিশ্চয়ই আদিয়াতের ক্ষতি হতে দিবে না…”
ঘড়ির কাঁটা আজ খুব দ্রুত চলছে অথচ নীরার জন্য প্রতিটা মিনিট যেন একেকটা পাহাড় ডিঙানোর মতো। আরশীনকে দায়ভার দিয়ে সে নিজে দ্রুত সরে পড়বে। তারপর যা হবে দেখা যাবে। এত চাপ মাথার মধ্যে নেওয়া যাচ্ছে না।

দুপুরের দিকে লোকটা এলো। নীরা তক্কে তক্কে ছিল। তাই একমুহূর্তও দেরি করল না। তখনই ওর টেবিলে একটা ফাইল এসে পড়ল, চেক করে সাবমিট করতে হবে।
— “না! এখন না।” দ্রুত ফাইল হাতে নিয়ে ছুটে গেল আদিয়াতের কেবিনে। দরজায় ধাক্কা না দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ল। আদিয়াত তাকাতেই বলল,
— “আদিয়াত, প্লিজ! এই ফাইলটা আমি একটু পরে চেক করে দিয়ে দিচ্ছি। খুবই জরুরি একটা কাজ আছে আমার। প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও। তোমার বোন হিসেবে এই সময়টা নিলাম… প্লিজ, প্লিজ!”
বলেই, আদিয়াতের উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।
আদিয়াত চুপ। তাকিয়ে রইল হতভম্বের মতো। নীরা এমনভাবে ছুটে গেল যেন এক্ষুনি না গেলে ওর ট্রেন মিস হয়ে যাবে। এতদিন তো অফিসিয়ালি ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করত। আজ হঠাৎ করে নাম ধরে ডাকল? তাও আবার বলল, বোন হিসেবে কথা বলল! বাহ… সূর্য কোন দিক থেকে উঠল? না চাইতেই আদিয়াতের ঠোঁটের কোণে একটা সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল।

নীরা কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল। হৃদপিণ্ড কানে কানে শব্দ করছে, ধুকধুক। গতদিন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ আবার ঠিক সেই জায়গায় এসে দাঁড়াল। চারপাশের নিঃস্তব্ধতা ভার সৃষ্টি করেছে। ভেতরে কথাবার্তা চলছে কিন্তু আজকের সুর একেবারেই আলাদা। খুব সাধারণ আলোচনা। সবটাই দৈনন্দিনের চেনা ছাঁচে। সে একটানা শোনে, গতকালের মতো একটা কথাও নেই। না কোনো হুমকি, না কোনো হিসেব চুকানোর ইঙ্গিত।
— “এটা কি হলো?” সন্দেহের ছায়া পড়ে নীরার মনে। ওহো… গতকাল তো শুধু একটুখানি দেখেছিল। পুরোপুরি ওর মুখই তো দেখেনি সে। উত্তেজনায় সব গুলিয়ে ফেলেছে। আবারও অপেক্ষা করতে হবে, ওই লোকটার জন্য। কখন আসবে? ভুল লোককে অনুসরণ করলে, আসল বিপদ তো আরও গভীরে চলে যাবে। এক হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে নিজের ভারসাম্য রাখে সে।

নীরা চোরা দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। চোখদুটো নিবদ্ধ দরজার দিকে, একটুও সরছে না। প্রতিটি পদশব্দে চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি সেই… কিন্তু না, যারা আসছে তারা সবাই পরিচিত মুখ। হাতে ফাইল, সবাই নিজের কাজেই ব্যস্ত। সে একে একে অনুসরণ করেছে কয়েকজনকে। তাদের কথাবার্তা, হাঁটার ভঙ্গি, চোখের ভাষা সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। যাকে খুঁজছে, সে নেই। একবারও সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠ, সেই বেপরোয়া অঙ্গভঙ্গি চোখে পড়েনি আজ। আজ ওই লোকটার ছায়াও মেলে নাই আশেপাশে।
নীরা অপেক্ষা করছিল আবার সত্যটাও কাউকে বলতে পারছিল না। যথেষ্ট চেষ্টা করছে সাবধান থাকার, নজর রাখার। আজ অবশ্য সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। আদিয়াত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পর নীরা অফিস থেকে বের হলো। ভাবছিল, ওরা তো অন্য কোথাও পরিকল্পনা করতে পারে। কিন্তু কোথায় করবে? বাবাকে চোখে চোখে রাখলে অবশ্য বোঝা যাবে সেটা। অফিস থেকে একা ফিরল না, একপ্রকার বায়না ধরে বাবাকে নিয়ে তারপর বাড়ি গেল। সে রাতে তিনিও আর বাহিরে বের হলেন না, তাই অন্য কোথাও পরিকল্পনার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল।
.
আদিয়াত রাতে আরশীনকে নিয়ে বাহিরে বের হয়েছিল। উদ্দেশ্য, ওর মন-মেজাজ ভালো করা। যদিও এখন তার মনের মধ্যে বিষন্নতার ভাবটুকু নেই। বেশ হাসিখুশি’ই রয়েছে। আকাশের শেষ আলোটা মিশে গেছে যমুনার জলে। পানির ওপর হালকা ঢেউ, পাড়ে নরম বাতাস। দূরে মাঝেমধ্যে নৌকার ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছে। আদিয়াত গাড়ি গাছের নিচে পার্ক করল, — “নেমে আসুন”
আরশীন নেমে এলো চুপচাপ। এই ধরনের জায়গায় আগেও এসেছিল, কিন্তু আলাদা রকম শান্তি লাগছে আজ। দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নদীর পাড়ে। আরশীন বলল,
— “অনেকদিন পরে এমন হাওয়ায় দাঁড়ালাম। জানেন, এমন জায়গা আমার খুব পছন্দ।” আদিয়াত একবার শুধু মাথা ঝাঁকাল। নদীর দিকে মুখ করে বসল দুজন। আরশীন বলল,
— “আমার মাঝে মাঝে এই শহরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসে।”

আদিয়াত শান্ত গলায় বলল,
— “তাই তো নিয়ে এলাম। হাওয়া খান, মনটা হালকা হবে।”
— “আমার মন হালকাই আছে। মনের ওজন কম।”
— “ইদানিং মনের ওজন একটু বেড়ে গেছে না? কী হয়েছে বলবেন আমাকে? উঁহু, জোর করব না। ইচ্ছে হলে বলতে পারেন।”
— “এখন বলব?” আরশীনের চোখে প্রশ্ন।
— “বললাম তো, আপনার ইচ্ছে। আমি জোর করব না।”
— “তাহলে না বলি। এই সুন্দর সময়ে দুঃখের কথা মনে করতে হয় না। শুনেন না, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। আমরা যদি এখন…” কথা শেষ হতে না হতেই একদম বাজখাঁই শব্দে আরশীনের ফোনটা বেজে উঠল। আশেপাশের নিরবতা চটকে দিল অপ্রত্যাশিত এক ঝাঁকুনির মতো। ব্যাগ থেকে বের করে স্ক্রিনে তাকাল— “Nira Calling…” ভুরু কুঁচকে গেল ওর। নীরা সাধারণত তাকে ফোন করে না। আজ হঠাৎ? আরশীন আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করল। আদিয়াত একবার তাকাল, কিছু জিজ্ঞেস করল না শুধু চোখে অল্প কৌতূহল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো নীরার শান্ত গলা,
— “হ্যালো আরশীন। আদিয়াত কোথায়? তোমার সাথে আছে?”
প্রশ্নটা শুনে আরশীনের চোখ গেল আদিয়াতের দিকে।
— “আদিয়াতের খোঁজ করছো? ওকে সরাসরি ফোন দিলেই হতো।”

ওপাশ থেকে নীরা কিছুটা অস্বস্তিতে বলল,
— “রাত হয়ে গেছে, তাই তোমাকে ফোন দিলাম। আদিয়াত কোথায়?”

আরশীন ভ্রু সামান্য উঁচু করল,
— “আমার সামনেই আছে। কথা বলবে? নাও…”

নীরা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
— “না না, আমি কথা বলব না। শুধু খোঁজ নিতে ফোন করছিলাম।”

আরশীনের কণ্ঠে কৌতূহল আর এক চিলতে সন্দেহ জেগে উঠল,
— “খোঁজ? এই রাতের বেলা? আমি বুঝলাম না আসলে। হঠাৎ ওর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন তোমার?”
— “এমনিতেই, রাখছি আমি। ওর দিকে একটু খেয়াল রেখো।” এইটুকু বলেই নীরা ফোন কেটে দিল।
আরশীন এমনভাবে আদিয়াতের দিকে তাকাল, বোধহয় চোখের আগুনে মুহূর্তেই ছাই করে দিবে। আদিয়াত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? এমন ফায়ার হয়ে গেছেন কেনো?”

আরশীন বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল,
— “হবো না? রাত সাড়ে এগারোটায় একজন ফোন করে আপনার খোঁজ করবে? তাও আমার কাছে। বাহ, কত দরদ দেখছি।”

আদিয়াত হতভম্ব হয়ে বলল,
— “ফোনটা কে করেছিল?”
— “নীরা। আজ তো আপনার খবর আছে ভালোই। আমি কিছুতেই মানব না। বলুন তো, কী করছেন আপনি?”
— “আমি কি করলাম?” আদিয়াত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
— “গা জ্বালানো কথা বলবেন না। ও আমাকে ফোন করল কেনো?”

আদিয়াত মুখ গম্ভীর করে বলল,
— “আমি কি করে বলব?”
আরশীন হঠাৎই উঠে দাঁড়াল। মুখটা গোমড়া করে উল্টোদিক ফিরে চলে যাচ্ছিল। আদিয়াত এলো পিছু পিছু। আরশীন যেখানে যাচ্ছে, সেও পিছু নিচ্ছে। কথা বলছে না… আরশীন থেমে পেছন ফিরে তাকাল।
— “কী সমস্যা আপনার? কেনো পিছু নিচ্ছেন? না না, থাকেন। আমি নীরাকে ফোন করে এখানে আসতে বলছি। আমাকে নিয়ে এসে এসব নাটক কেন? আপনাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে ফোন দিল। বুঝে গেছি বাইরে বাইরে এসবই তো করেন, তাই না? যাচ্ছি আমি, ভালো থেকেন আপনি।” আরশীন শক্ত হয়ে কতগুলো বললেও শেষে হাসি এসে গেল। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে ফের মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। আদিয়াত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর মুখ থেকে আবার বেরিয়ে এলো সেই গা জ্বালানো কথা,
— “আমি কী করলাম?”
— “আপনি তো নাটের গুরু। আমাকে বাড়ি নিয়ে যান।”
— “নিয়ে যাবো না। মাথা ঠান্ডা করুন।”
— “শাটআপ। নিজে দশ খানে টাঙ্কি মারবে দোষ নাই। আমি মাথা গরম করলে সেটা দোষ? অসভ্য কোথাকার। আপনাকে আমার আর দু’চোখে দেখতেই ইচ্ছে করছে না।”

আদিয়াত মজার ছলে বলল,
— “চশমা এনে দিব? চারচোখে দেখবেন?”
— “ফাজলামি করেন আমার সাথে?”

আদিয়াত বেশ ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বলল,
— “হুমমম।”
আরশীন আরোও রেগে গেল। আদিয়াত সহজে বাড়ি ফিরল না। আরশীনকে নিয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত সেখানেই ছিল। যদিও আরশীনের রাগটা ইচ্ছাকৃত ছিল, তবুও মজা লাগল।
.
পরদিন…
নীরার ভেতরটা অস্থিরতায় কাটছে। আজ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই সেই ভয়ঙ্কর লোকটা এসে হাজির হয়েছে। ওর চেহারায় ফুরফুরে ভাব দেখে মনে হচ্ছে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে। গলার স্বরটা ঠান্ডা।
— “সব জায়গায় পাখা ছড়িয়ে দিয়েছি। আদিয়াতের সাথে আমার কথা হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সে আসবে… মতিঝিলের ওই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং-এ। সময় মতো সব হবে।” শব্দগুলো এতটাই নির্লিপ্তভাবে ভয়ানক যে, কানে আসা মাত্রই নীরার শরীর শীতল হয়ে গেল। লোকটা একটা ঠিকানা বলল, নীরা মাথায় টুকে নিল। আদিয়াতের সাথে কথা হয়েছে? আদিয়াত ওখানে যেতে রাজি হয়েছে? ও কি জানে না এই লোকটা কে? ফোনটা কাঁপা হাতে বের করল। আরশীনকে ফোন দিল। একবার… দু’বার… তিনবার… ফোন বাজে, কিন্তু কেউ ধরে না।
— “প্লিজ রিসিভ করো আরশীন… প্লিজ।” আবার আদিয়াতকে ফোন দিল। ও অফিসে নেই, আজ বাইরে মিটিং। ফোন অফ। নীরা ততক্ষণে হাঁপিয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পড়ছে থাপথাপ করে। তাহলে এখন? এখন কার কাছে যাবে? না, আর সময় নেই। সেই মুহূর্তে আর কিছু ভাবার অবস্থায় ছিল না নীরা। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামল। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে একটা রিকশা, তারপর ট্যাক্সি, সবকিছু এলোমেলো। মাথা কাজ করছে না। একটাই দৃশ্য মাথায় ঘুরছে; একটা আধা তৈরি বিল্ডিং, ছায়া ঢাকা করিডোরে দাঁড়িয়ে আদিয়াত, আর অন্ধকারের কেউ… ওর মস্তিষ্ক এমন এক জায়গায় থেমেছিল যে এই অবস্থায় পুলিশে খবর দেওয়ার মত ভাবনাটুকুও মাথায় আসে নাই। যেন পুলিশ নামক কোনো পেশার অস্তিত্ব দুনিয়ার বুকে নেই।
মাঝরাস্তায় গিয়ে আরশীনকে ফোনে পেল। ঠিকানা দিয়ে দ্রুত বলল,
— “আরশীন, শুনো, বেশি কথা বলার সময় নেই। একটা ঠিকানা দিলাম। মতিঝিল, পুরনো বিল্ডিং, টাওয়ার ৭-এর পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে, ওখানে। দেরি করো না, আদিয়াতের বড় বিপদ রয়েছে। আমি পরে সব বলব। এখন শুধু এসো, সন্ধ্যার আগে পৌঁছানোর চেষ্টা করো।”
ফোন কেটে গেল। আরশীন স্তব্ধ। স্থির হয়ে রইল।
— “আদিয়াতের বিপদ?”
তার মাথায় আর কিছুই ঢুকছিল না। ফোনটা হাত থেকে নামিয়েই ছুটে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। আরশীন জানে না ঠিক কী ঘটেছে। জানে না কোথায় আছে বিপদের ফাঁদ। তবে এইটুকু জানে; যেখানে আদিয়াত আছে, সেখানে ওর দেরি করা চলে না।
রাস্তায় বেরিয়েই দ্রুত একটা ট্যাক্সি থামাল। ঠিকানাটা বলল। বাহিরে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল। শহরের কোলাহল, হেডলাইটের আলোয় একবার উজ্জ্বল, একবার নিস্তব্ধ। তাড়াতাড়ি পৌছাতে হবে, কোনোভাবেই দেরি করতে পারবে না। আদিয়াতকে ফোন করেছে কয়েকবার, ফোন অফ।

আদিয়াত দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিংটার নিচে, নির্দিষ্ট এক স্তম্ভের পাশে। বিকেলের আলো ফিকে হয়ে গিয়েছে, চারপাশে একটা কাঁচা অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। আদিয়াত হাতঘড়ি দেখল। ৫টা ৩৮ বাজে। চারপাশটা একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল, কারো দেখা নেই। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ফোনটা এখনো অফ। মিটিংয়ে থাকায় অফ করে রেখেছিল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল। স্ক্রিন অন করতেই একগাদা মিসড কল চোখে পড়ল। নীরা– ১৮টা। আরশীন– ১৬টা। আদিয়াতের চোখ কুঁচকে গেল। ওরা দুজন একসাথে ফোন দিচ্ছে কেন? গতকাল দুজন নাটক করল। এখন আবার কী? নতুন কোন ফ্যাসাদ? হুহ। অবজ্ঞাভরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
কিন্তু আদিয়াত জানে না তার অবহেলার ঠিক এই মুহূর্তে, শহরের অন্য প্রান্ত থেকে দুটি হৃদয় পাগলের মতো ছুটে আসছে কেবল তাকে রক্ষা করার জন্য। নীরা আর আরশীন, ভিন্ন কারণে কিন্তু একই মানুষকে ভালোবেসে সবকিছু পেছনে ফেলে আসছে।

প্রথমে নির্দিষ্ট জায়গায় আরশীন তারপর নীরা এসে পৌঁছাল। কেউ’ই আদিয়াতকে দেখতে না পেয়ে উপরের দিকে পা বাড়াল। অন্ধকার তখন ঘনীভূত হচ্ছিল। আদিয়াত উপরের দিকে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে সেদিকেই এগিয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না, শুধু একটা ছায়াময় চলাচল টের পাওয়া গেল। ঠিক তখনই… দূর থেকে ছুটে আসছিল নীরা।
— “আদিয়াত, আদিয়াত সরো।” চিৎকার করে উঠল সে। আদিয়াত চমকে পেছনে ঘুরল। তার চোখে-মুখে বিভ্রান্তি, কিছু বলার আগেই “ফাট!” আগ্নেয়াস্ত্রের ঝাঁঝালো আওয়াজ ছুটে এলো বাতাস ভেদ করে। আদিয়াত থমকে গেল। সময় থেমে গেল। ঠিক তখনই ছুটে এলো নীরা। আর গুলিটা, সোজা নীরার কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। রক্ত ছিটকে উঠল বাতাসে। নীরা ছিটকে পড়ল আদিয়াতের সামনে। আদিয়াত দৌড়ে এলো। নীরার কাঁধে হাত রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল সে।
— “কি করছ তুমি? এভাবে এসেছ কেন?”

নীরা কেঁপে কেঁপে বলল,
— “তোমাকে বাঁচাতে আদিয়াত। তুমি… তুমি টার্গেট ছিলে।”
আওয়াজ অনুসরণ করে আরশীন ছুটে এলো দূর থেকে, হাওয়া কাঁপিয়ে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে, চোখেমুখে আতঙ্ক।
— “আদিয়াত, নীরা…।” একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল। আদিয়াত আরশীনকে দেখে থ হয়ে গেল। এরা দুইজন একসাথে? কী হচ্ছে? আরশীন কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই আদিয়াত নীরাকে তুলল এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য।
“ঠাশ!” আরেকটি গুলির শব্দ। টার্গেটে আদিয়াত থাকলেও সোজা গিয়ে লাগল নীরার বুকের বাঁ পাশে। ওর শরীরটা ধীরে ধীরে আদিয়াতের বুকে ঝুঁকে পড়ল। মুখের সামনে অন্ধকার নেমে এল।
— “উঁ… আহ্‌!” আদিয়াত স্তব্ধ হয়ে গেল। আরশীনের চোখ বিস্ফারিত। পায়ের নিচে মাটি নেই। নীরা নিস্তেজ ঠোঁট নাড়ল,
— “তুমি, তুমি ওদের চিনো না আদিয়াত। সাবধানে থেকো, তোমার অনেক বিপদ। আর তোমার সাথে আরশীনও জুড়িয়ে গেছে।”

আদিয়াত ওর হাত চেপে ধরে বলল,
— “কিচ্ছু হবে না তোমার।”
গুলির আরোও কয়েকটা ফাঁকা আওয়াজ শোনা গেল। আদিয়াত উঠে দাঁড়াল। আরশীন এগিয়ে নীরার মাথাটা কোলে তুলে নিল। নীরা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমি এখনও আদিয়াতকে ভালোবাসি। এখনও… সারাজীবন ভালোবাসব। আমি যদি ওকে ভালোবেসে যাই, তোমার কি সাধ্য আছে আটকানোর?”
আরশীন ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল। ওর বুকের মধ্যে উথালপাথাল হয়ে যাচ্ছে। নীরা ফের বলল,
— “এসবের মূলে কারা আছে জানো? ওরা পরশু থেকে প্ল্যান করছিল। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। ওই লোকটার নাম জানিনা, কিন্তু কিন্তু আমার বা…” ব্যাস ওইটুকুই ছিল নীরার শেষ কথা। ওর চোখের তারা নিভে গেল। নীরার নিথর শরীর কোলে নিয়ে আরশীন নির্বাক বসে থাকল। আচমকা আকাশপাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল,
— “আদিয়াত!”
চারিপাশ স্তব্ধ। শুধু বাতাসে গুলির গন্ধ, আরশীনের হাহাকার আর থেমে যাওয়া হৃদস্পন্দনের শব্দ।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৩৩]
~আফিয়া আফরিন

(বিদারণ)
পুরো ঘটনায় আদিয়াত হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও যে জায়গাটায় ঠান্ডা মাথায় সত্য খুঁজতে এসেছিল, সেখানে এখন রক্ত, কান্না আর বিভ্রান্তির এক দুঃস্বপ্ন বয়ে যাচ্ছে। আদিয়াত এখানে এসেছিল, একেবারে ভিন্ন এক কারণে। সকালবেলা একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল,
— “স্যার, আজ একটু মতিঝিলে আসবেন? আপনার শ্বশুরের মৃত্যুর পেছনে কিছু তথ্য আছে, যা আপনার জানা জরুরী। সন্ধ্যার দিকে আসুন প্লিজ।”
আদিয়াত তো সত্যের পেছনেই ছুটছিল। তাই এই কথা শুনে চিন্তাভাবনা ছাড়াই ছুটে এসেছিল। কিন্তু এখানে এসে সবকিছু পলকেই পালটে গেল। ছোঁড়া গুলির আওয়াজ, নীরার ছুটে আসা, আরশীন, তারপর সেই নিস্তব্ধতা, যেখানে শুধু রয়ে গেল নীরার নিথর দেহ।
চারপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। আতঙ্ক, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ ফোন করেছে পুলিশে, কেউ আবার দূর থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আর আদিয়াত? হাঁটু গেড়ে বসে আছে। রক্তমাখা শার্ট, গা থেকে বেয়ে পড়ছে ঘামের সঙ্গে মিশে যাওয়া লাল রক্ত। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, কপালের ঠিক বা’পাশে একফোঁটা রক্তের দাগ জমে আছে। হাতের তালু দুটো শক্ত করে মুঠো করা; বোধহয় ওর ভিতরে জমিয়ে রেখেছে ক্রোধ, অসহায়তা আর অপরাধবোধ।
একটা জীবন তার সামনে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে নাকি শেষ হয়ে গেল? এই যে মাথার উপর একটা ঋণের বোঝা, এর ভার কীভাবে বইবে? নীরার রক্তমাখা ছোপ সারাজীবন তার জীবনের অপরাধচিহ্ন হয়ে থাকবে।
পাশেই আরশীনের আহাজারি আকাশ ফাটাচ্ছে। তবুও আদিয়াতের চোখ সেদিকে যাচ্ছে না। ও পারছে না সামনে থাকা দেহটা ছেড়ে উঠতে। পারছে না এই মৃত্যু মেনে নিতে। এ মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা কোনো ‘চক্রান্তের’ চূড়ান্ত দৃশ্যপট।
ইতোমধ্যে পুলিশ চলে এসেছে। চারপাশে জটলা বাঁধে লোকজনের, সবার মুখে আতঙ্ক, কৌতূহল আর অস্থিরতা। নীরার নিথর দেহটাকে স্ট্রেচারে তোলা হয়। সাদা চাদরের নিচে মুখ ঢেকে দেওয়ার আগে আরশীন আর একবার চেঁচিয়ে উঠে,
— “না। নীরা একটু আগে আমার সাথে কথা বলেছে, এটা হতে পারে না।”

নীরার দেহ হাসপাতালের মর্গে নেওয়ার পর ওর বাসায় খবর দেওয়া হয়। থানায় তখন আরশীন চুপচাপ বসে আছে। চোখ ফুলে গেছে, বারবার ওড়না চোখেমুখে চেপে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। তার গলার আওয়াজ নেই কিন্তু ভিতরটা আর্তনাদ করছে প্রতিমুহূর্তে। পুলিশ অফিসার ফরমাল প্রশ্ন করল দু’জনকে। সবশেষে আদিয়াত এইটুকু বুঝল না, কার সাথে তার এমন শত্রুতা থাকতে পারে যে খুন করার পরিকল্পনা করতে পারে? স্ব-ইচ্ছায় তো কারো কোন ক্ষতি করে নাই। তবে কি ভুলবশত? তবে সেটা কেমন?

আমিনুল ইসলাম থানায় এসে উপস্থিত হলেন। চোখেমুখে অপ্রস্তুত ভঙ্গি, চোখজোড়া লাল, ভেতরে তোলপাড়ের মতন। আর কেউ জানুক বা না জানুক, তিনি জানতেন এই পরিকল্পনার নিশানা ছিল আদিয়াত।
তাকে সরিয়ে দেওয়ার ফন্দি কষেছিল রেজা, আর ঠিক সেই ফাঁদেই পা দিল নীরা। তারই একমাত্র মেয়ে। বড্ড আদর যত্নে বড় করে তোলা।
আর এখন? সে নেই। বদলে পড়ে আছে শুধু একটা মৃতদেহ, ঠান্ডা, রক্তমাখা। উনার চোখেমুখে স্তব্ধতা নয়, বিস্ফোরণ জমে ছিল। তিনি কাঁদলেন না, চিৎকার চেঁচামেচিও করলেন না। শুধু ঠান্ডা মাথায় তার মেয়ের মৃত্যুর পুরো দায়ভার আদিয়াত আরশীনের উপর চাপিয়ে দিলেন। কণ্ঠে ব্যথা মেশানো তীব্র ক্ষোভ,
— “তোমাদের জন্যই হয়েছে সব। তোমাদের যা ইচ্ছে তা হতো, আমার মেয়ে চলে গেল কেন? ও তোমাদেরকে কেন আগলাতে গেল? তোমরা কি করেছ আমার মেয়ের জন্য? কিচ্ছু করো নাই দিনশেষে ওকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছ। মেয়েটা আদিয়াতের জীবন বাঁচানোর জন্য এত বড় ঝুঁকি নিল? চিন্তা করল না আমাদের কথা। তুমি আদিয়াত, তুমি দায়ী সাথে তোমার বউও।”
আদিয়াত কথা বলার চেষ্টাও করল না। তবে আরশীন এগিয়ে এলো। এতক্ষণে নিজেকে সামান্য হলেও সামলে নিতে সক্ষম হয়েছে। ও বলল,
— “চাচা শোনেন, নীরা…” আরশীন পুরো কথাটা শেষ করার আগেই তিনি গগনবিধারী চিৎকারে ফেটে পড়লেন,
— “চুপ, একদম চুপ‌। তোমার মুখে আমার মেয়ের নাম শুনতেও গা ঘিনঘিন করছে। ওর জীবন এত সস্তা ছিল না। তুমি তো উড়ে এসে একদম জুড়ে বসে গেছো। তোমার কী? যা গেছে তা আমার গেছে। তোমার তো আরও আনন্দ পাওয়ার কথা। তোমার জন্য ওর জীবনটা একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তুমি কি বুঝতে পারো, একটা বাবা কেমন করে নিজের মেয়ের মুখ আর শেষবার ছুঁতেও সাহস পাচ্ছে না? বড় বড় কথা না বলে, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারবে?” তার কান্না এখন রাগে পরিণত হয়েছে।
কথাগুলো ছুরি হয়ে বিঁধে যাচ্ছিল আরশীনের বুকের গভীরে। সে চুপ করে গেল, তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। সবাই জানে সত্যটা ঠিক কতটা নিষ্ঠুর।
.
নীরার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই চারদিক থেকে মানুষ আসতে শুরু করে। নীরার বাসা তখন শুধুই কান্না, শোক আর স্তব্ধতায় ভর্তি।
নীরার মা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, নীরা নেই। একটানা কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে, তবুও বুকের ভেতর থেকে হাহাকার থেমে থাকছে না।
— “আমার মেয়ে কই গো? একবার মুখটা দেখাও। আমি তো ওকে খাইয়ে দিতাম, শোয়াতাম, বুকে আগলে রাখতাম। কী করে এমন হয়ে গেল, কে নিল আমার নীরাকে…?”
আশপাশের সবাই নিঃশব্দ। এই কান্নার কাছে কারো কিছু বলার থাকে না, এই কান্নার কাছে কোন সান্ত্বনা বাক্য খাটে না। নাজনীন তাকে সামলাতে গিয়ে নিজেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। ঘরের পরিবেশ ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল, তখন আলিয়া আরশীনকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো। আরশীন একেবারে পাথর হয়ে গেছে। কোনো কথা নেই, কোনো চাহনি নেই। শুধু থেমে থেমে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। চোখ বন্ধ করলে আশ্চর্যজনকভাবে নীরার নিথর মুখটা ভেসে উঠে।

আদিয়াত সেদিন রাতে আর বাড়ি ফেরেনি। ফেরার মতো অবস্থা ছিল না, ইচ্ছাও ছিল না। নীরার মৃতদেহটা চোখের সামনে থেকে সরালেও মনের ভেতর থেকে সরাতে পারছিল না সে। তার অন্তর অনন্ত ঘূর্ণির মধ্যে আটকে গেছে; ঘুরছে, জ্বলছে, পুড়ছে… অথচ থামছে না কিছুতেই। হাসপাতাল, থানা, প্রশাসনিক কাজ সবকিছু তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। দায়িত্বের চেয়ে বেশি দায়ভার এখানে।
নীরার জন্য কিছু করতে পারেনি, সেই অপরাধবোধে নিজের ভেতরেই নিজেকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছিল আদিয়াত। রাতভর কখনো থানার ডেস্কে বসে, কখনো মর্গের করিডোরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। পুলিশ একের পর এক জিজ্ঞাসা করেছে, রিপোর্ট তৈরি করেছে, স্টেটমেন্ট লিখেছে। আদিয়াত বোধহয় মেকানিক্যাল টাইপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, সে একটা যন্ত্র যা কেবল উত্তর দিচ্ছে। মাঝে মাঝে শুধু নিজের শার্টের দিকে তাকাচ্ছিল… রক্তমাখা সেই কাপড়, যেটা এখন শুকিয়ে গিয়ে লালচে বাদামি দাগ হয়ে আছে। প্রতিটি ছাপ নীরার শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে বুকের মধ্যে জ্বালা দিচ্ছে। আরশীনের মুখটা মনে পড়ে গেল; বিস্মিত, দগ্ধ, দিশেহারা মুখ। কোথায় আছে কে জানে? একটা খোঁজ নেওয়া হলো না। ফোন করতেও ইচ্ছে হলো না। ক্লান্ত লাগছে, দুর্বল লাগছে, মাথার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা, শরীরে অসাড়তা, ভেতরে অসহায়ত্ব; এই অবস্থায় আর ফোন করে কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
আদিয়াত পরদিনও একটুখানি ফুসরত পেল না। সকাল থেকেই মরদেহ বুঝে নেওয়া, দাফনের ব্যবস্থাপনা সবকিছুতেই তার উপস্থিতি জরুরি ছিল। পুরো দায়িত্বটা ওর কাঁধেই পড়ে গেছে। চোখে লালচে কালি, মুখে দিনভর জেগে থাকা ক্লান্তির রেখা, তবুও নিজেকে বিশ্রাম নিতে দিচ্ছিল না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ সবকিছু চূড়ান্ত হলো। নীরা; যার হাবভাব, চলাফেরা, হাসিঠাট্টা সবসময় গমগম করত আজ নিস্তব্ধ কবরে চিরঘুমে শুয়ে আছে।
আদিয়াত এরমধ্যে আর বাড়ি আসেনি। ওখানেই ফাঁকে নিজের রক্তমাখা শার্টটা পালটে নিয়েছিল সে। তাও গায়ে সেই রক্তের গন্ধ লেগে আছে। সন্ধ্যার পর নিজের বাড়িতে এসেও শান্তি পেল না। এখানেও কেমন শোকের মাতম, সব খাঁ খাঁ করছে। মায়ের ঘর ফাঁকা। মা আজ নীরাদের বাড়িতে, শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে। “নীরাদের বাড়ি”—এই কথাটা কেমন ঠোঁটে বিষ লাগিয়ে বলার মতো লাগল আদিয়াতের কাছে। নীরা তো নেই। নীরার নামটাই কেমন অর্থহীন হয়ে গেছে। “নীরাদের বাড়ি” বলতে গিয়েও বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে। ও আর নেই… সত্যি নেই।

নিচ থেকে ভেসে আসা দরজার খোলার শব্দে আরশীন নেমে এলো। বাড়িতে এখন আরশীন ছাড়া কেউ নেই। আলিয়া কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে। আরশীন নিচে এসে দেখল, আদিয়াত দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো লালচে, আপাদমস্তক ভেঙ্গে পড়ার চিহ্ন। ওকে দেখে আরশীনের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আদিয়াতকে কোনদিন এই অবস্থায় দেখেছিল সে? নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “কখন এসেছেন?”

আদিয়াত নিচু গলায় উত্তর দিল,
— “এক্ষুনি।”
— “ওখানকার এখন কি অবস্থা? আমি আর গেলাম না… আপুর সাথে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপু আমাকে থাকতে বলল।”
— “ভালোই হয়েছে। থাকুন আপনি। এসব জায়গা আপনার জন্য না।” তারপর একমুহূর্ত চুপ থেকে ক্লান্ত গলায় যোগ করল,
— “ঘরে যান। বিশ্রাম নিন। এখন আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ভার হয়ে আছে। ফ্রেশ হবো, গোসল করব… শরীরে অশান্তি লাগছে খুব।” এই বলে সে ধীর পায়ে আরশীনকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আরশীন তাকিয়ে রইল। আদিয়াতের কথাগুলো তাকে কিছু একটা ভাবতে বাধ্য করল। সে ভেবেছিল আদিয়াত হয়তো কিছু বলবে, শোক ভাগ করে নেবে কিংবা অন্তত কিছু অনুভব করবে। কোনো একটা মানবিক আবেগ দেখাবে। কিন্তু আদিয়াতের কণ্ঠে ক্লান্তির চেয়েও বিরক্তবোধ বেশি ছিল, একদম স্পষ্ট।
“এসব জায়গা আপনার জন্য না। ঘরে যান, এখন আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।” এটা কি একরকম সহানুভূতির ছদ্মবেশে তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া নাকি খোঁচা মেরে কথা বলা? সে বুঝতে পারল না। করণ আদিয়াতের মুখে বোঝার মত কোনো অভিব্যক্তি ছিল না।
.
আমিনুল ইসলাম অস্থির পায়চারি করছেন। তাঁর চোখে ঘুম নেই, মুখে রক্ত নেই। একমাত্র মেয়ের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। সবকিছু জেনেও কিছু করতে না পারার অক্ষমতা তার ভিতরটা ছিঁড়ে ফেলছে। রেজাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে ফেলেছেন কিন্তু রেজা হাওয়া হয়ে গেছে। গা-ঢাকা দিয়েছে নিশ্চিত। মেয়ের খুনের ধরা পড়ার চেয়ে তার কাছে বেশি জরুরী নিজেকে বাঁচানো। আদিয়াতকে খুনের পরিকল্পনায় তিনিও সমানভাবে জড়িয়ে আছে।
এইদিকে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গতিতে। হামলার ঘটনাটি পরিষ্কার একটি পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা তা বোঝা গেছে। টার্গেট ছিল আদিয়াত কিন্তু ঘটনাচক্রে মারা গেছে নীরা। আদিয়াতকে থানায় ডেকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনার সন্দেহ হয় কাদের ওপর? কাকে সন্দেহ করবে সে? চুপ থেকেছে, একবারও কারো নাম বলেনি। কীভাবে বলবে? যাকে সন্দেহ হচ্ছে, সে কেউ বাইরের লোক নয়। নিজের মানুষের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া কীভাবে দাঁড়াবে সে?
নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব চেপে রেখে অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছিল পুলিশকে।
আমিনুল ইসলামের পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেলেও মস্তিষ্কের কোণে একটুখানি ঠান্ডা জায়গা এখনো কাজ করছে। তিনি আদিয়াতকে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছেন। কখন কী বলছে? কার নাম নিচ্ছে? কার সাথে কথা বলছে? চোখ সরাচ্ছেন না একমুহূর্তের জন্যও। কারণ তিনি জানেন, সত্যটা তার ভেতরেই আছে। আর সেটা বেরিয়ে এলেই সব জারিজুরি শেষ। কৌশলে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্য রকমের এই স্বার্থপর লোকটা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কুমিরের কান্না কেঁদে যাচ্ছেন।

এরইমধ্যে দুটোদিন পেরিয়ে গেল কিন্তু কারো ভেতর কোনো বদল নেই। বাড়ির পরিবেশটা স্থির হয়ে গেছে; চুপচাপ, ভারী আর অব্যক্ত।
আদিয়াত এখনো নিজের অপরাধবোধের গহ্বরে ডুবে আছে।
নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দোষ দিতে পারছে না। সবটা কেমন একটা ভার হয়ে বুকের মধ্যে চেপে বসে আছে। কারো মুখোমুখি হতে পারছে না, এমনকি নিজেরও নয়।
আরশীন ঘোরের মধ্যে আছে। চোখের সামনে যা ঘটেছে তা বিশ্বাস করা খুব কষ্টসাধ্য তার জন্য। মনে হয় শরীরটা এখানে, কিন্তু মনটা অনেক দূরে কোথাও। নীরার চলে যাওয়াটা বাস্তব, কিন্তু মেনে নেওয়া অসম্ভব।
আর বাকিরা? তারা শোক প্রকাশ করছে নিয়মমাফিক। তবুও তাদের দিনের শেষে একটা ঘুম আসে, একটা ভোর আসে। কিন্তু আদিয়াত আর আরশীনের রাতের ঘুম আর সকাল, দুটোই থেমে গেছে দু’দিন আগের সেই রাত্রির অন্ধকারে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো, এই শোকটা একেকজনের মধ্যে একেক রকমভাবে বাসা বেঁধেছে। কেউ টের পাচ্ছে, কেউ চেপে রাখছে, কেউ সহ্য করছে আর কেউ ভেঙে পড়ছে নিরবে।
সেদিন বিকেলের আলোটা নিস্প্রাণ হয়ে এসেছিল। ঠিক এমন সময় আদিয়াত নিজের ঘরে রেডি হচ্ছিল। শান্তির ভীষণ প্রয়োজন, দমবন্ধ লাগছে, একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার খুব প্রয়োজনবোধ করছিল। তখনই আরশীন এসে জিজ্ঞেস করল,
— “এই সময় কোথায় যাচ্ছেন?”
— “বাহিরে।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

আরশীন এগিয়ে এলো,
— “কাজ আছে?”
আদিয়াত নিঃশব্দে মাথা নাড়ল,
— “না।”

আরশীন এবার কিছুটা বিরক্ত আর দুঃখমিশ্রিত সুরে বলল,
— “অপ্রয়োজনে কেন যাচ্ছেন? মা শুনলে রাগ করবে। এমনিতেই সবাই আপনাকে নিয়ে চিন্তায় আছে, বুঝতে পারছেন না?”

আদিয়াত কেমন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। গলার স্বর তুলনামূলক কড়া হয়ে উঠল,
— “তো? ঘরের মধ্যে বসে থাকব? এই দেয়ালের সাথে কথা বলব?”

আরশীন নরম স্বরে বলল,
— “আপাতত কিছুদিন থাকুন না বাড়িতে। মানুষ চিন্তা করে আপনার জন্য।”

আদিয়াত এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। আরশীনের চোখে চোখ রেখে বলল,
— “আরশীন, প্লিজ। মেজাজটা গরম হয়ে যায়, এমন কথা বলবেন না।”
— “চিন্তা হয় যে।”
— “চিন্তা হলে কি করার আছে?” এক নিঃশ্বাসে বলল।

আরশীনেরও গলার স্বরটা একটু উঁচু হলো,
— “বাহিরে যাবেন না। আমি আপনাকে এই বেলায় কোথাও যেতে দিচ্ছি না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, হাঁপিয়ে উঠেছি সবকিছুতে। প্রথমে আমার বাবা, তারপর…” আরশীন কথাটা শেষ করতে পারল না। হঠাৎই মাথা দু’হাতে চেপে বিছানায় বসে পড়ল।
আদিয়াত ওর দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
— “তারপর?” জিজ্ঞেস করল আদিয়াত।

আরশীন মুখ নিচু করে বলল,
— “কিছু না।”

আদিয়াত এবার একটু ঝুঁকে তার চোখে চোখ রাখল,
— “মিথ্যা কথা বলবেন না। তারপরের কথাটুকুই আমি শুনতে চাই, আরশীন।”
আরশীন কিছু বলল না। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরেছিল যাতে টু শব্দ বের না হয়। চোখ নামিয়ে রেখেছিল। ভিতরে ভীষণ ঝড় বয়ে চলেছে, তবু মুখে একফোঁটা বাক্য নেই। হঠাৎই আদিয়াত বলে উঠল,
— “নিজের সন্তান হারানোর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?”

শব্দগুলো ঘরে বজ্রপাতের মতো লাগল। আরশীনের নিঃশ্বাস আটকে গেল। চোখ বড় হয়ে উঠল। আদিয়াত জানে? এইভাবে বলল? এতটা সরাসরি? আরশীন মুখ তুলল না, চোখে জল থরথর করছে। আদিয়াত আরশীনের কান্নাভেজা মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের নীরবতার পর তার গলার স্বর আরও শক্ত হয়ে উঠল,
— “কেনো? এই কথা বলতে এত কষ্ট কেনো হচ্ছে? আপনি তো আমাকে কিছু বলেন নাই।। আপনার চোখের চাহনি, আচরণ সবকিছু বলে দিয়েছে আরশীন। আপনাকে আর কি বলব আমি?”
আরশীন মুখ নামিয়ে ঠোঁট কেঁপে কেঁপে থেমে গেছে। আদিয়াত আরও একধাপ এগিয়ে এলো। তার কণ্ঠে তীব্র হতাশা, ধৈর্যের সীমা ফুরানো কষ্ট,
— “আপনি সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষ দিচ্ছেন, আমি সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা কি শুধু আপনার ছিল? আমাদের নয়? আমি কি কিছু জানারও যোগ্য না? অন্তত জানতে পারতাম। এখন শুধু শূন্যতা। বলুন, এই শূন্যতার হিসেব আমি কোথায় রাখব?”

— “আপনি জানেন?” আরশীনের কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারিত প্রশ্নটা ঘরের নিরবতা ভেঙে অসহ্য একটা ভার ছড়িয়ে দিল।

আদিয়াত চোখ সরিয়ে নিল না,
— “হ্যাঁ। সবটা। আর আমি একা নয়, বাড়ির সবাই জানে।”

আরশীনের ঠোঁট ফাঁকা হলো,
— “কীভাবে?”

আদিয়াত এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
— “আমাকে কি বোকা না গাধা, ঠিক কোনটা মনে হয় আপনার বলেন তো?”
— “আদিয়াত! এভাবে বলছেন কেনো?” আরশীনের গলায় ক্ষতবিক্ষত এক ভাঙন।
— “কীভাবে বলা উচিত? আপনি বলুন… আপনি কী ভেবেছিলেন? আমি কিছুই বুঝব না? আপনি একটা পুরো জীবন নিজের ভেতরে ধারণ করে রাখবেন, আমি টেরও পাবো না? সবশেষ হয়ে যাওয়ার পর এসে আমার কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করছেন? এটা একটু বেশি নাটকীয়তা নয়?”

আরশীন অসহায় গলায় ফিসফিস করে বলল,
— “আপ… আপনার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না?”

আদিয়াত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— “সেই সুযোগ আপনি রেখেছেন আমার জন্য? আপনি শুধু নিজেকে ভেবেছেন। আমার কষ্ট কি আপনাকে একমুহূর্ত ভাবিয়েছে?”

— “যে গেছে, সে তো আপনারই একটা অংশ…” আরশীন থেমে গেল, চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।
— “শুনতে চাচ্ছি না আপনার থেকে কিছু।” আদিয়াত আর কিছু বলল না। ঠাণ্ডা মুখে ঘরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল। কোনো জোরে ধাক্কা না, কোনো শব্দ ছাড়াই একটা বোবা অভিমান নিয়ে চলে গেল সে। পেছন ফিরে। তাকালও না।
আরশীন দাঁড়িয়ে ছিল, পাথরের মতো স্থির। দরজার ফাঁক দিয়ে আদিয়াতের ছায়াটা মিলিয়ে যেতে দেখল। ভেতরে ভাঙা একটা নিঃশব্দ প্রলয়ের মতো ওর বুকের ভেতর কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। আরশীন ফিসফিস করে নিজের মনেই কীসব কীসব বলল। তারপর নিঃশব্দে মাথাটা গুঁজে ফেলল দুই হাঁটুর মাঝে। পুরো ঘরটা তখন নিঃশ্বাস থামিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
.
.
.
চলবে….