তবুও তুমি পর্ব-৪০

0
4

#তবুও_তুমি🩵 [পর্ব-৪০]
~আফিয়া আফরিন

(শত জন্ম পেরিয়ে)
আদিয়াতের একটা বাক্য, — “খুব শক্ত করে… একটু জড়িয়ে ধরো না।” এমন আবেদন কি কখনো ফেরানো যায়? আরশীন দুই হাতে তাকে বুকে টেনে নিল। এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখল, যাতে সে তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো সহজেই বলতে পারে। আদিয়াতের চোখ ভিজে উঠল। একটুও দেরি না করে, সেও দুহাতে আরশীনকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকের ভেতরে জমে থাকা সব না-বলা কষ্ট ওই একটুখানি আলিঙ্গনে গলে যেতে লাগল।
কে বলেছে ছেলেমানুষ কাঁদে না? কে বলেছে তাদের দুঃখ নেই? দুঃখ তো মানুষ হবার প্রথম শর্ত। রং, রূপ, আর প্রকাশ হয়তো আলাদা, কিন্তু দুঃখ সবারই থাকে। কেউ প্রকাশ করে, কেউ গিলে ফেলে।
আদিয়াত নিজেকে দ্বিতীয় দলেই রেখেছিল। এই কয়েকটা দিন চুপচাপ কষ্ট সয়ে, বুকের ভেতর পাহাড় বানিয়ে রেখে দিয়েছিল সমস্ত হাহাকার। বাইরে থেকে যতোই নির্লিপ্ত দেখাক না কেন, ভেতরে সে একা ছিল; ভীষণ রকম একা। আর আজ… আরশীনের সামনে এসে সেই মুখোশটা আর রাখতে পারল না। এই মানুষটা তো তার একান্ত নিজের। যাকে দুঃখ দেখালে লজ্জা নেই, দুর্বলতা প্রকাশ করলে ভয় নেই।
আদিয়াত আর কিছু বলেনি, কিছু বোঝাতেও চায়নি। শুধু দু’হাতে আরশীনকে জড়িয়ে ধরেছিল। আরশীনও কিচ্ছু বলেনি। না সান্ত্বনা দিয়েছে, না প্রশ্ন করেছে।
সে শুধু আদিয়াতের মাথায় নিজের চিবুকটা ঠেকিয়ে রাখল। দু’চোখ বন্ধ করে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল খুব ধীরে ধীরে যেন বুকে জমে থাকা কান্নাগুলো স্বস্তি হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর, দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আদিয়াত বলল,
— “আমি ঠিক আছি।” কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা ছিল, কিন্তু ভিতর থেকে স্যাঁতসেঁতে ভাবটা ঠিকরে পড়ছিল।

আরশীন নরম গলায় বলল,
— “না, আপনি ঠিক নেই।” সে আদিয়াতের মুখটা উঠিয়ে চোখে চোখ রাখল। স্পষ্ট স্বরে বলল,
— “মন খুলুন। যদি আরোও কাঁদতে ইচ্ছে হয়, কাঁদুন। কেউ মানা করবে না। মানা করার কেউ নেই, বিশ্বাস করুন। আমি আছি এখানে। আমি আপনাকে এইভাবে দেখতে পারব না।”
— “আমার কোন দুঃখ নেই, আরশীন।”

আরশীন তার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “দুঃখ ছাড়া কোনো মানুষ নেই। যাদের দুঃখ নেই, তারা মানুষ নয়, তারা পাথর। আমি আপনাকে পড়তে পারছি, বুঝতে পারছি আপনার ভেতরে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে।”

— “বাবা এমনটা কেন করল?” আদিয়াতের কণ্ঠটা বেশ নিস্তেজ শোনাল।

আরশীন কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে ভেতরটা কুঁচকে যাওয়া উদাস গলায় বলল,
— “জানি না। হয়তো কিছু একটা ভেবে করেছিল। নিজের মতো করে কিছু বোঝার চেষ্টা করেছিল।”
— “কিন্তু তার ফল তো এখন আমাদেরই ভোগ করতে হচ্ছে, তাই না?
মানুষ এতটা স্বার্থপর হতে পারে? নিজের সিদ্ধান্তে এতজনের জীবন তছনছ করে দিতে পারে?”

আরশীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “হ্যাঁ, পারে। মাঝেমাঝে মানুষকে হতে হয়। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে।”

আদিয়াত খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি এই কথা বলছো?”
— “বলছি। আপনি কি আপনার নিজের চাচাকে দেখেননি? আমি কি আমার চাচাকে দেখিনি? যারা আমাদের আস্থা ছিল, তারাই তো সুযোগে পিঠে ছুরি মেরেছে। এরা কি স্বার্থপর ছিল না? কিন্তু তারাও পরিস্থিতিরই শিকার, আদিয়াত। কিছু মানুষ বাঁচার জন্য বেছে নেয় সহজ পথ। কিছু মানুষ বেছে নেয় ভুল পথ।”

— “উনি আমাদের বিশ্বাসটা তছনছ করে দিয়ে গেলেন। সে যে আমাদের কাছে কী ছিল তা নিজেও জানতেন না। অথচ ওই মানুষটাই…”
একটু থেমে আবার বলল,
— “উনি হয়তো শেষদিকে নিজের ভুল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই অনুশোচনাতেই ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছিলেন। ভীষণ কষ্টে পেয়েই মারা গেলেন।” আদিয়াতের চোখের কোণ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। মনে পড়ছে, মৃত্যুর আগমুহূর্তে বাবার বলা কথাগুলো। শুধুমাত্র “বাবা” ডাকটা শোনার জন্য ডাঙ্গায় সাঁতরানো মাছের মত ছটফট করছিলেন।

আরশীন সযত্নে চোখের পানিটুকু মুছে দিল। তারপর উঠে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি খুলে একটা পুরোনো অ্যালবাম বের করল। হাতের ছোঁয়ায় বোঝা যাচ্ছিল, জিনিসটা কত যত্নে রাখা। এসে আবার বিছানায় বসল। আদিয়াতের হাতে অ্যালবামটা দিয়ে বলল,
— “এটা হচ্ছে আমার সমস্ত স্মৃতির কান্ডারী। এখানে আমার বাবা, মা, বোন… আমাদের হাসি, আমাদের ছেলেবেলা, সব আছে। এখন তো বাবা আমাদের কাছে নেই, কিন্তু এই অ্যালবামটা খুললে, ছবিগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয় তিনি এখানেই আছেন। এই স্মৃতির মাঝে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই। তাই আর কষ্ট হয় না।”

আদিয়াত অ্যালবামটা হাতে নিল। পাতাগুলো উল্টালো। আরশীনও অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। প্রতিটি ছবির ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছিল। একটা একটা করে সময়, দিন, অনুভূতি সব ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।
— “জানেন, স্মৃতি বড় অদ্ভুত জিনিস। ওগুলো না আছে আজ, না কাল। আবার পুরোটাই এখন। যেমন এই ছবিগুলো, তখন আমি হয়তো ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাবা আমায় বইমেলায় নিয়ে গেল। একটা বই কিনে দিল, নাম ছিল ‘নীলপরি’। এখনো মনে আছে, আমি সেদিন সারারাত ঘুমোইনি, শুধু বইটা পড়ছিলাম।”

সে হাসল, আবার চোখে ভেসে উঠল একটু ভিজে আলো।
— “আর এই যে দেখুন, এখানে মা আছে। একদম রাগ করে বসে আছে। কারণ আমরা সবাই একসাথে ছবি তুলেছি, সে রান্নাঘরে ছিল। তখন তো আর সচরাচর ফোনের ক্যামেরা ছিল না। ছবি তোলাও ছিল স্পেশাল ঘটনা। আপনার সাথেও তো আঙ্কেলের এইরকম স্মৃতি রয়েছে তাইনা?”

— “হুমম।” আদিয়াত ছোট্ট করে উত্তর দিল।

আরশীন দু’হাত কোমড়ে গুঁজে কটমট দৃষ্টিতে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তবে এত দুঃখ কিসের? স্মৃতি আসলে ধরে রাখতে হয় না। ওরা নিজে থেকেই থেকে যায়। কেবল আমরা ভুলে যাই। কিন্তু ঠিক যখন দরকার হয়, তখন একটুকরো ছবি, একটুকরো গন্ধ বা একটুকরো বাক্য সেই স্মৃতিকে চোখের সামনে এনে দাঁড় করায়। তাই মাঝে মাঝে আমি স্মৃতির পাতায় ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাই অন্য এক পৃথিবীতে।”

আরশীনের কথা বলার ভঙ্গিতে আদিয়াত হেসে ফেলল, সত্যিকারের হাসি। তারপল বলল,
— “এত সুন্দর করে বলো কীভাবে?”

আরশীন হেসে কাঁধ ঝাঁকাল। বলল,
— “জানিনা। মনে হয়, অনেক কিছু হারানোর পর যারা বেঁচে থাকে, তারা কিছু কিছু জিনিস নিজে থেকেই শিখে ফেলে।”

আদিয়াতের বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে গেল। এতদিন ধরে জমে থাকা ভার, চাপা কান্না, না বলা কথা, সবমিলিয়ে যে ভারী পাথর চেপে ছিল, তাও নেমে গেল। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলার সাথে সাথে বহুদিন পর নিজেকে হালকা মনে হলো।
আরশীনের হঠাৎ যেন কিছু একট মনে পড়ায় সে বলল,
— “এই, আপনি আমাকে তুমি তুমি করে ডাকছেন?”

আদিয়াত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল,
— “হুমমম। ইচ্ছে হলে তুমিও ডাকতে পারো।”

আরশীন ভুরু কুঁচকে, চোখ কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— “কেনো?”
— “আমার জিনিস তো… একদম ব্যক্তিগত। ডাকলেই হলো একটা। সম্বোধনে কি আসে যায়?”

আরশীন ঠোঁটের কোণে একটা খুনসুটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “কিছু যায় আসে না? তবে তুই করে বলব?”

আদিয়াত একগাল হেসে বলল,
— “পারলে বলো।”
হাসিতে হাসিতে ওদের মধ্যে টুকটাক আরো কিছু কথাবার্তা হলো। সবটাই ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কথাগুলো বেশিক্ষণ চলমান ছিল না। ওরা চুপ করে গেল, ভুলে যেতে চাইল ওইমুহূর্ত। আদিয়াত মায়ের কথাও বলল। আরশীন যখন শুনেছে, তিনি নিজে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন তখন আর আনন্দ দেখে কে! মায়ের কথা ভেবে অবশ্য মনে মনে শঙ্কিত হলো। তিনি কি যেতে দিবেন? আদিয়াতকে বলতেই, ও আশ্বাস দিল। শাশুড়ির কাছে গিয়ে নিজের বাবার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইল। তারপর একরকম আর্জি জানাল যেন আরশীনকে তার সাথে যেতে দেয়।
শাহানা প্রথমে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল। একদিকে নিজ মেয়ের ভাবনা, অন্যদিকে আদিয়াতের চোখের ভাষায় ঝরে পড়া ভালোবাসা।
তিনি ভেবেছিলেন, আরশীনকে আর কখনো ওই বাড়িতে পাঠাবেন না। সম্প্রতি ঘটনার কারণে হয়তো অনেক অপমান সহ্য করতে হবে মেয়েটাকে। কিন্তু আদিয়াতের অনুরোধে এমন কিছু ছিল যেটা শাহানা এড়াতে পারলেন না। তিনি মাথা নাড়লেন সম্মতির চিহ্নে। আদিয়াত বলল,
— “আপনি যদি আমার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেন… তাহলে আমি একটাই কথা বলব, আরশীনকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। ওর ভালো-মন্দ, কষ্ট, হাসি-কান্না, সব দেখার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”
— “আচ্ছা।”
শাহানা বুঝতে পেরেছিলেন আদিয়াতকে। জহিরুল ইসলামের মত পাষণ্ড মানুষের ছেলে এমনও হতে পারে?

আদিয়াত আর দেরি করতে চাইল না। শাহানা জোড়াজুড়ি করলেও সেদিনই আরশীনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। গাড়ির জানালার বাইরে ছুটে চলা পথের ধুলো মাড়িয়ে বাড়িতে পা দিতেই একটা পরিবর্তন টের পাওয়া গেল। কয়েকদিন ধরে জমে থাকা বিষণ্ণতা কর্পূরের মত উবে গেল। বাড়িতে আত্নীয়-স্বজন ছিল, আরশীন সবার সাথে কথাবার্তা বলে জিজ্ঞেস করল,
— “মা কোথায়?”

একজন উত্তর দিল,
— “শোবার ঘরে আছে। চোখটা বোধহয় একটু লেগে গেছে। দুপুর থেকে তোমার কথা বলছিল। এখন তুমি এসেছ, গিয়ে দু’দন্ড বসো। কথাবার্তা বলো, ভালো লাগবে।”
আরশীন তাই করলো। শাশুড়ির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা মারল। ভেতর থেকে শোনা গেল ক্লান্ত গলা, “দরজা খোলা।”

আরশীন নিঃশব্দে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের বাতাসে স্তব্ধতা জমে ছিল, জানালা দিয়ে আলো পড়েছে বিছানার ধারে। নাজনীন শুয়ে আছেন চুপচাপ। আরশীন তার দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ, কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। মুখে বিষণ্ণ ক্লান্তি, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, ক্লান্তির ছোঁয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরটাও বোধহয় ভেঙ্গে গেছে। আরশীনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পাশে বসল, তৎক্ষণাৎ বলল না কিছুই। নাজনীন নিজেই আরশীনকে দেখে উঠে বসলেন। তিনি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আরশীন কিছু বলার আগেই নাজনীন ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
— “এসো মা…” নাজনীন ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন। এমন এক আলিঙ্গন যা হাজারটা না বলা কথা এবং সব খারাপকে একমুহূর্তে মুছে দেয়। আরশীন জিজ্ঞেস করল,
— “আমি কি খুব কষ্ট দিলাম আপনাকে?”

নাজনীন চোখ মেললেন না,
— “তোমার কী মনে হয়?”
— “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার প্রতি আপনার রাগ এখনও আছে?”
— “তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই মা… কোনো অভিযোগও না। আমি খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম। ভালো-মন্দ বুঝতে পারছিলাম না।”

— “আমি জানতাম আপনি কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু রাগ করেননি।” আরশীন স্বাগতিক্ত করল।

নাজনীন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— “তুমি তো আমার মেয়ের চেয়ে কম কিছু না… তুমি চলে গিয়েছিলে বলেই হয়ত আমার আরও বেশি কষ্ট লেগেছিল। সেসময় তুমি যদি আমার পাশে থাকতে, তাহলে ওরকম হতো না।”
ঘরের বাতাসটাই হালকা হয়ে এলো। মাঝেমাঝে জীবনকে যতটা কঠিন মনে হয়, জীবন আসলে ততটা কঠিন নয়। জীবনকে একটু ভালবাসলেই, একটু হাত বুলিয়ে আদর করলেই তা বশ হয়ে যায়।
.
সময় কেটে যায় নিয়মে… ধরে বেঁধে রাখা যায় না। জীবন থেমে থাকে না, যাই কিছুই ঘটে যাক। ওরাও সময়ের সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। জীবনের নিয়মে দিনগুলো এখন অনেক বেশি ব্যস্ত।
আদিয়াতের কাজের চাপ প্রচণ্ড। সবকিছু একসাথে এসে চেপে বসেছে ওর কাঁধে। মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে পড়ে, মনে হয়; সব ছেড়েছুড়ে চলে যায় কোথাও একটা। কিন্তু যেতে আর পারে না… বাবা নেই, তার অভাব মানসিকভাবে টের পায়।
একটা বিষয়ে জহিরুল ইসলাম বেশ দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। চলে যাওয়ার আগে নিজের সবকিছু সুষ্ঠুভাবে ভাগ করে গিয়েছিলেন। কার কতটা প্রাপ্য, কে কী দেখাশোনা করবে, কে কোথায় থাকবে, সব লিখিতভাবে নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। যদিও প্রয়োজন ছিল না। তার ছেলে-মেয়েরা এমন না যে, এসব ঠুনকো বিষয়ে ঝামেলা করবে। তবুও নিজের স্বস্তির জন্য করেছেন।
তবে বেশিরভাগটাই আদিয়াতকে সামলাতে হয়। আযহান ওসব পারে না উল্টো বিরক্ত হয়ে যায়। এইতো সেদিনের ঘটনা। আদিয়াত অফিসে এসেই দেখল আযহান চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। টেবিলের উপর একগাদা ফাইল, পাশে কফির কাপ। আদিয়াত সত্যি ওকে দেখে অবাক হয়েছিল। কারণ আযহান আগেই বলে দিয়েছিল, এসব কাজকর্মের মধ্যে আমাকে কখনোই তোমরা বাঁধতে পারবে না।
— “এইটা কি দেখছি আমি? আযহান সাহেব যে ড্রামা থেকে উঠে এসে কাজে নেমে পড়েছে।”

আযহান গম্ভীর মুখে বলল,
— “ভাইয়া, আমি আজ থেকে সিরিয়াস মানুষ। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাই। ফাইল হাতে নিয়ে এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি।”

আদিয়াত হেসে বলল,
— “তা এক ঘণ্টা ধরে কি করা হচ্ছে?”

আযহান দুঃখী মুখ করে বলল,
— “কভার পেইজ পড়লাম। এত ভালোভাবে বানাইছে, মনে হয় গল্পের বই।”
— “তারপর?”
— “তারপর খুলতেই দেখি অঙ্ক, হিসেব, শেয়ার… ভাইয়া, এগুলা সামলাও কী করে? আমি ভাই একদম সাদা-সরল মনের মানুষ, এত প্যাঁচ নিতে পারতেছি না। এগুলো পিতা-পুত্রের অংকের মতই কঠিন।”

আদিয়াত হেসে বলল,
— “না পারলে রেখে দে।”

আযহান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল,
— “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি ‘মেন্টাল সাপোর্ট’ দিবো। মানে তুমি কাজ করবে আমি পাশে বসে চা খেয়ে খেয়ে বলব, জিও ভাইয়া তুমি পারবে। তোমাকে পারতেই হবে।”
— “থাক আর সাপোর্ট লাগবে না।” আদিয়াত মুখে যতই বলুক সাপোর্ট লাগবে না কিন্তু আযহান পাশে থাকায় খারাপ লাগে না। যদিও কাজের কাজ কিছুই করে না, অকাজ’ই করে। তাও থাকুক। একা একা সময়ও কাটতে চায় না…

নাজনীন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। তবে তার এখন কষ্ট হয়, আলিয়ার কথা ভেবে। ওইটুকু একটা মেয়ে, জীবনটা চলবে কীভাবে? যতই ভাইয়েরা থাকুক না কেনো, নিজের সম্বলও দরকার পড়ে একটা সময়ে। নাজনীন বলেছিল, বিয়ের কথা। আলিয়া একবাক্যে না করে দিয়েছে। আরশীনও কয়েকবার বলেছিল, একটা বিয়ে হলে জীবনটা গোছানো হতো। আলিয়ার মতে, ওর একবার বিয়ে হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার যদি বিয়ে করে, সেই মানুষটা ভালো হবে তার নিশ্চয়তা কি? একটা জীবন তো সমস্যা নেই। সবাইকে নিয়ে একভাবে কেটেই যাবে।
.
আজ নিশুতি রাত। রাস্তা-ঘাটের আলো ঝিমিয়ে পড়েছে, রাস্তাও তুলনামূলক ফাঁকা। সবকিছু সামলে, হাজার ব্যস্ততা আর ক্লান্তির দেয়াল ভেঙে আদিয়াত এই রাতে আরশীনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল লংড্রাইভে।
আরশীন বেশ খুশি, অনেকদিন পর মন খুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে হালকা বাতাসে ওর চুল উড়ছিল। মাঝেমধ্যে মাথা ঘুরিয়ে আদিয়াতের দিকে তাকাচ্ছিল আর নিঃশব্দে হাসছিল, টুকটাক কথাবার্তা চালাচ্ছিল। ও বাচ্চাদের মতো আনন্দে ডুবে গিয়েছিল। এতকিছুর পরেও আরশীনের কোনো অভিযোগ নেই, কোনো অভিমান নেই; ও একটু ভালোবাসাতেই বহুত খুশি হয়ে যায়। আদিয়াত ড্রাইভ করতে করতে হালকা সুরে বলল,
— “অনেক খুশি মনে হচ্ছে? খুশিতে আপনার চুলগুলো নাচছে, দেখতে পাচ্ছি।”

আরশীন জানালার বাইরে দেখছিল। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
— “হুম, খুব খুশি। রাতের আবহাওয়াটা সুন্দর। আকাশটা কী সুন্দর লাগছে… যেদিকে তাকাচ্ছি, সবটাই সুন্দর।”

আদিয়াত একরকম রসিক ভঙ্গিতে বলল,
— “আর আমি?”

আরশীন ভুরু কুঁচকে বলল,
— “আপনার দিকে তো তাকাই নাই।”

আদিয়াত গাড়ির গতি একটু কমিয়ে বলল,
— “তবে তাকাও।”

আরশীন চোখ সরিয়ে জানালার দিকে ফিরতে গিয়েও ফের তাকাল আদিয়াতের দিকে। বলল,
— “এইতো এইতো… আবার আপনি–তুমি গুলিয়ে ফেললেন।”
— “তাতে কী? তাকাও দেখি…”

আরশীন মুখ ঘুরিয়ে আদিয়াতের দিকে তাকাল। গাড়ির হেডলাইটের মৃদু আলো ওর চোখের একপাশে পড়ে হালকা ঝলক তৈরি করছিল। সে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, পর্যবেক্ষণের ভঙ্গিতে। চির পরিচিত মুখ নতুন আলোয় আবিষ্কার করছে। একমুহূর্ত পর নরম কণ্ঠে বলল,
— “দেখেছি।”
— “কি দেখলে?”

আরশীন চোখ সরাল না। ধীরভাষায় বলল,
— “একটা মানুষ… যাকে বাইরে থেকে কঠিন লাগে, কিন্তু ভিতরে অনেক নরম। সবকিছুর পরেও নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবে। তারপর আরেকটা মানুষ দেখলাম… যে আমার পুরো পৃথিবী। সুখ-দুঃখের এক বিশাল সমুদ্র। যে আমায় দেখে বুঝে নিতে পারে, আমি ঠিক আছি কি না। যে নিজের কষ্টের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয় আমাকে। যে আমাকে বোঝে, ভাবে, আমার জন্য চিন্তা করে… এই মানুষটার ভালোবাসা বড্ড গভীর। মানুষটা আমার ছায়ার মতো। কখনো সামনে, কখনো পাশে, কখনো পেছনে, কখনো আমার মধ্যে। তার দিকে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, নিজের সবচেয়ে আপনজনকে।”

আদিয়াত গাড়ি চালাচ্ছিল, দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ ছিল। আরশীনের কথাগুলো শুনে ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল। বলল,
— “এমনভাবে দেখতে থাকলে আমি তো গন্তব্যই ভুলে যাব।”
— “মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আমি আছি না?”
— “আছো আছো, খুউব আছো। এমনি করেই থাকো।”

আরশীন জানালার পাশে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। বাইরে রাতের হাওয়া গাড়ির সঙ্গে দুলে যাচ্ছিল; শীতল, নরম, মন ছুঁয়ে যাওয়া। মুখ ফিরিয়ে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “একটা অনুরোধ করি?”
— “করো।”
— “একটা গান শোনাবে? শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।” আরশীন জোর গলায় অনুরোধ করল।

আদিয়াত গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মাথা নাড়ল,
— “আচ্ছা।”

প্রকৃতির সাথে সাথে গাড়ির মধ্যেও তখন নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে আদিয়াত গান ধরল,
— “তুমি গল্প ছিলে আমার উপন্যাসে,
তুমি কবিতার মতো এই দিনের শেষে…
তুমি অল্প করে কিছু স্বপ্ন দিলে, আমি প্রেমিক রবো শত জনম ধরে।
দেখি তোমায় দেখি আমি এক পলকে,
রোজ প্রেমে হারাই দেখতে দেখতে…
দেখি তোমায় দেখি দুটি নয়ন ভরে,
ভালোবাসি মেয়ে, এই আমি তোমাকে…”
আরশীন চুপ করে শুনছিল। ওর ঠোঁটের কোণে একরাশ সুখ এসে জমেছিল। চোখের পাতা ভার হয়ে আসছিল গান শুনতে শুনতে। গান শেষ হতেই আরশীন হাসতে হাসতে বলল,
— “তুমি প্রেমিক রবে শত জনম ধরে? তুমি তো গোড়া থেকেই আমার স্বামী।”
.
.
.
চলবে….