তবুও তুমি পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
1

#তবুও_তুমি🩵 [অন্তিম পর্ব]
~আফিয়া আফরিন

(তোমায় আমায় মিলে)

পরিশিষ্ট:
দেড় বছর পর….
সময় চলে গেছে নিজস্ব নিয়মে; চুপিচুপি, ধীরপায়ে। এই দেড় বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। কিন্তু মানুষ বদলায় না, আবার ঠিক বদলেও যায়। নিয়মানুসারে আমিনুল ইসলাম, রেজা, বিলাল হকের সবারই শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে।
শাহানা আর আশা এখন ঢাকার কলাবাগানেই আছে, তাদের পুরোনো সেই বাসায়। ফরিদপুর ছেড়ে এখানে এসে প্রথম প্রথম একটু সমস্যার সম্মুখীন হলেও এখন ঠিকঠাক। শাহানা রাজি হন নাই এখানে আসার ব্যাপারে… এই পুরো বাড়িটাই স্মৃতিরা হাতছানি দিয়ে বেড়ায়। তবে আদিয়াত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তখন তিনি আর না বলতে পারেন নাই। আদিয়াত খুব চেষ্টা করছে নিজের বাবার ভুলগুলো শোধরাতে। একেবারে যে সম্ভব নয় তা জানা আছে, তারপরেও চেষ্টার কমতি রাখেনি।
আরশীন খুশি। শুধু খুশি বললে কম বলা হয়, ওর চোখেমুখের দ্বিপ্তী ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখন মায়ের কাছে যেতে হলে দূরদূরান্ত পেরোতে হয় না। যখন মন খারাপ থাকে, অথবা একলা হয়ে যায়, তখনই চলে আসে। এরইমধ্যে আশাকে স্কলারশিপ অফার করা হয়েছিল দেশের বাইরে। চাইলেই চলে যেতে পারত নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সে চায়নি। নিজের দেশ, মা, পরিবার-পরিজন ছেড়ে ওইমুহূর্তে কোথাও যেতে ইচ্ছে হলো না। উল্টো বলেছিল,
— “দু’দিনের জীবন, কী হবে এত ডিগ্রি দিয়ে? আমি চলে গেলে আবার মা একলা হয়ে পড়বে না? মায়ের আঁচলের নিচে যতদিন থাকা যায়, থাকি।”

আরশীন একবার না, বহুবার বুঝিয়েছিল আশাকে,
— “শোন, যা তুই। নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। মায়ের জন্য আমি আছি, আমরা সবাই আছি। তুই নিজের জীবনটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নে। এটা তোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না।”

আশা প্রতিবারই মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলত,
— “না আপু, যাব না। মন চাচ্ছে না। আপাতত আবহাওয়া চেঞ্জ করতেও ইচ্ছে করছে না।”

আরশীন হতভম্ব হয়ে বলে,
— “এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? পাগল কোথাকার।”
— “আমি এখন দেশে তোমাদের কাছেই থাকতে চাচ্ছি। সব তো আছেই। পরে না হয় দেখব।”
তবুও আরশীন হাল ছেড়ে দেয় নাই। সেদিন শোনে নাই পরদিন গিয়ে বুঝিয়েছে,
— “তোর স্কলারশিপ তো হাওয়ায় আসেনি। এখনও সময় আছে, ভেবে দেখ। একটা সময় আসবে, তুই নিজেও আফসোস করবি।”
— “উফফফ, আমি ওখানে গিয়ে একা থাকতে পারবো না আপু। এখানে তোমরা সবাই আছো আর আমি ভিনদেশে একলা, বাবারে ভাবতেই পারছি না। আমার সাথে তোমরাও চলো, যাচ্ছি তাহলে।” হিহি করে হাসল আশা।

আরশীন আস্তে করে ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
— “সবসময় ফাজলাম তাইনা? তোর ভাইয়াকে বলছি, দাঁড়া।” আদিয়াতকে বলেও অবশ্য কাজ হলো না। আদিয়াত বোঝাতে গেলেই আশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে অভিযোগ জানাল, ওকে নাকি দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য সকলে একজোট হয়ে আয়তারা-পায়তারা করছে। তারপর ওকে আর কেউ কিছু বলল না এ সম্পর্কে। যা ভালো বুঝবে করবে।
নাজনীন মাঝেমাঝে এখানে আসেন। দুই মা মিলে নিজেদের জীবনের গল্প করেন। ইদানিং তো দু’জন থেকে তিনজন হয়েছে। নীরার মা বাসায় একাই থাকতেন। সন্তান তো ধরাছোঁয়ার বাহিরে আর স্বামী চার দেওয়ালের ঘরে আবদ্ধ; তাই আদিয়াতই চাচীকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তাদের তিনজনের জীবনেই ভীষণ রকম দুঃখ রয়েছে… যথাসম্ভব চেষ্টা করছে সেই দুঃখগুলোকে কাটাতে। কখনো পারছেন কখনো হেরে যাচ্ছেন। তবুও তাদের দিনগুলো কেটে যায়, নতুন একটা ভোর আসে আবার রাত নামে।

আযহান প্রেম করছে। এই ব্যাপারটা প্রথম ধরতে পেরেছিল আরশীন।
একদিন বিকেলে ছাদে গিয়ে দেখে, ও এককোণে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। স্বর নিচু, আরশীন খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে থাকল। আযহানের মুখভঙ্গির হাসি বলে দিচ্ছে, মিষ্টি কিছু চলছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “কার সাথে এত ফিসফাস চলছে?”

আযহান কেমন থতমত খেয়ে গেল। ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে ফেলল।
— “না মানে… এমনি, বন্ধু…”

আরশীন কোমরে হাত রেখে একটু কটমট করে তাকিয়ে বলল,
— “বন্ধু? তুমি আমাকে বন্ধু বোঝাও? বলো এখন, কে সেই মহানুভবী?”

আযহান একটু হেসে, সংকোচে মাথা চুলকাল। আরশীন জিজ্ঞেস করল,
— “প্রেম করছো?”
— “ইয়ে মানে হ্যাঁ… ধরা পরে গেলাম। তবে বেশি দিন না ভাবি।”

আরশীন চোখ সরু করে তাকাল,
— “তাহলে তোমার ভাইয়াকে বলে খুব শীঘ্রই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, তাই না?”

আযহান তৎক্ষণাৎ আতঙ্কিত ভঙ্গিতে বলল,
— “না না। এখন একদম না। ভাইয়া ঘাড়ে ধরে আমাকে অফিসের কাজে বসিয়ে দেবে। এমনিতে এখনই যা করে, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।”

আরশীন হেসে গড়িয়ে পড়ল প্রায়,
— “আচ্ছা আচ্ছা, মেয়েটা কে শুনি? কোন ড্রামা থেকে ধরে আনলে?”

আযহান গলা নামিয়ে বলল,
— “এই ড্রামা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত। এখানে কোন প্রডিউসার-ডিরেক্টর নেই। প্লটও একেবারে আসল, নিখাদ। বুকের মধ্যে থেকে বের হয়েছে।”

আরশীন হাসি চেপে বলল,
— “আরেব্বাস! প্রেম তো তাহলে জমে উঠেছে। ঠিকঠাক মতো ডায়লগ মুখস্থ করে রাখো, আদিয়াতের সামনে গিয়ে গুবলেট খেলেই তোমার প্রেম-পিরিতি শেষ। ও কী বলবে জানো?”
— “কী?”
— “যেই ছেলে এখনো ভালোভাবে কথা বলতে পারে না, যে ছেলে বাড়ির ছোট বলে সবার মাথার উপর উঠে বসে থাকে, যে ছেলে একটা ফাইল হাতে নিলে তার হাত ব্যাথা হয়ে যায়; সে আবার কীসের প্রেম করছে? যাহ সর, সামনে থেকে।”
আযহান লাজুক হাসল। আসলেই ভাইয়া এটাই বলবে। সে অবশ্য ভাবিকে ম্যানেজ করে ফেলল। ভাবির কথা তো আর ভাইয়া ফেলতে পারবে না। আজ থেকে ও বরং অফিসে যাবে। কোনোকিছু না পারলেও আদিয়াতকে সাহায্য করবে শুধু। আযহানের এই কর্মকান্ড দেখে আলিয়া হতবাক। দু’দিন আগে হাজার অনুরোধ করেও ওর পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। আর এখন নিজেই অফিস যাচ্ছে, তাও প্রতিদিন। ভাবা যায়? আরশীনকে সে কথা বলতেই আরশীন বলল,
— “বিয়ের বয়স হয়েছে, বোঝো না?”

আলিয়া হা হয়ে যায়। বলে,
— “ওমা! বলো কী? আযহান না দুইদিন আগে হলো মাত্র। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদত। আদিয়াত শুধু বলত, এই বাচ্চাগুলো এত কান্নাকাটি করে কেন? কত শান্তিতে মায়ের কোলে শুয়ে থাকে, তাও কাঁদে। আমি তো আমার মাকেও দিয়ে দিয়েছি… ওর কথা শুনে আমি হাসি, মা হাসে, বাবা…”
ব্যস, আলিয়ার হাসিমুখ থমকে গেল। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলো একটু। এই একটা জায়গায় ওরা তিন ভাইবোন এসে আটকে যায়। আলিয়ার মন খারাপ আরশীনের নজর এড়ালো না। এই মুহূর্তটা বদলানো দরকার। দ্রুত কথার মোড় ঘুরিয়ে আরশীন আলিয়ার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল,
— “আপু, আজ একটু শপিংয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। চলো না যাই। আমার কিছু দরকারি জিনিসপত্র কেনা লাগবে।”

আলিয়া বলল,
— “আদিয়াতকে ফোন দিয়ে আসতে বলো।”

আরশীন মুখ কুঁচকে বলল,
— “ধুর! ওর সাথে কে যায়? পাঁচ মিনিট যেতেই তাড়াহুড়ো শুরু করবে আর চোখে-মুখে বিরক্তি তো আছেই। আমি আসলে তোমার সঙ্গেই যেতে চাচ্ছি। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না। একটু ঘুরে আসি, হালকা হওয়া যাবে। শপিং শেষ করে মায়ের কাছ থেকেও ঘুরে যাব, তারপর অফিস হয়ে একসাথে বাড়ি ফিরব। কী বলো?” আলিয়া রাজি হলো। আইডিয়া মন্দ না। ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ বসে থাকতে থাকতে দমবন্ধ লাগে। আদিয়াত বলেছিল, অফিসে জয়েন করতে। আলিয়া সেই থেকে এখনও বিষয়টা নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে।
আরশীনের সাথে শপিংয়ে এসে মনটা ভালো লাগল। দু’জনই ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনল। কখনো ড্রেসের রং নিয়ে একদফা হাসাহাসি করল। শপিং শেষ করে ওরা গেল কলাবাগানের বাড়িতে। শাহানা ভীষণ খুশি হলেন ওদের দেখে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া ওখানেই হয়ে গেল। সাথে জমজমাট আড্ডা তো রয়েছেই। কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে পড়ল। অফিসের পথেই সারি সারি ফুচকার দোকান। আরশীন বলল,
— “আপু চলো, ফুচকা খেয়ে আসি।” দু’জনে আবার গাড়ি থেকে নামল। অফিসে যখন পৌঁছাল তখন বিকাল। ওটা ছুটির সময়, তাই মানুষজন কম ছিল। ওরা সরাসরি আদিয়াতের কেবিনে এলো। এসে আযহানকে দেখতে পেল। আলিয়া জিজ্ঞেস করল,
— “কিরে? এখানে কি করছিস তুই?”

আযহান ওদের দেখে অবাক হলেও গম্ভীর মুখে জবাব দিল,
— “কাজ করছি ভাই, বিরক্ত করো না প্লিজ।”
— “ওরে আমার কাজের ছেলে আসছে রে। ভাই কোথায়? তোকে এসব দেখতে দিয়েছে কেন? তুই তো সব গন্ডগোল করে ফেলবি।”

আযহান তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
— “বেশি বোঝো তুমি।”
— “বেশি না, ঠিকটাই বুঝি। এত কাগজপত্র নিয়ে যে বসে আছিস; ক খ পারিস তো নাকি ওইটাও ভুলে গেছিস?”
— “আপুউউউউউ…” আযহান ক্ষেপলো।

কথার মাঝেই আরশীন এগিয়ে এলো। চেয়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে আযহানের কাঁধে আলতো চাপ দিল। মুখে দুষ্টু হাসি,
— “আপু, বলেছিলাম না পাত্রীর খোঁজে আর দেরি করা চলবে না। ছোটো ভাই এখন মস্ত বড় অফিসার হয়ে গেছে।”

আযহান কপাল কুঁচকে বলল,
— “ভাবি আর আপু, প্লিজ না… এখন এসব নিয়ে কথা বলো না। আমি সিরিয়াসলি রিপোর্ট তৈরি করছি।”

আরশীন হেসে বলল,
— “হুম… করো করো, সিরিয়াসলি করো। আমরা যাচ্ছি কিন্তু ভুলবশত রিপোর্ট ফাইল করতে গিয়ে লাভ লেটার লিখে ফেলো না।” আযহান হতাশ দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকাল। মজা নিচ্ছে? আচ্ছা, ঠিক আছে। তারও সময় আসবে একদিন।
এরপর’ই আদিয়াত এলো। আদিয়াতের কাছ থেকে জানা গেল, আজ আযহানের শাস্তি। কাগজপত্র সব এলোমেলো করে ফেলছে। আরশীন হেসে কুটিকুটি হলো। শাস্তি শেষ হলে সবাই মিলে প্রিয় রেস্টুরেন্টে গেল। ডিনারটা ওখানেই সমাপ্ত করল। রাতের ওই সময়টুকু দারুণ কাটল। বাড়ি ফিরে এসেও আরশীন আলিয়ার ঘরে গিয়ে শপিংয়ে কেনা জিনিসপত্রগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিল, গল্পগুজব করছিল। কিছুক্ষণ বাদে আযহান এসেও যোগদান করল। আদিয়াতকে ডাকলেও সে এলো না, ঘরে এসে আরশীনের অপেক্ষা করতে লাগল। সেকেন্ড গেল… মিনিট গেল… ঘন্টা পেরোল, আরশীনের খবর নেই। আদিয়াত বিছানায় শুয়ে বসে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগল। অবশেষে ঘড়ির কাঁটায় যখন দেড়টা বাজল তখন তার আগমন ঘটল। ঘরে আসতেই আরশীন ঘরের বাতাসে একধরনের থমথমে ভাব টের পেল। দরজা বন্ধ করতে না করতেই আদিয়াত বলল,
— “ঘরে না এলেও হতো।”

আরশীন আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— “ওমা, তাহলে আমি ঘুমাতাম কোথায়?”

আদিয়াত কণ্ঠে ঠান্ডা ব্যঙ্গ নিয়ে বলল,
— “কেনো? যেখানে ছিলে সেখানেই। আসার তো দরকার ছিল না।”
আরশীন বুঝল, তার মান হয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালো কী না! ধীরে পায়ে আদিয়াতের পেছনে এসে জড়িয়ে ধরল। আদিয়াত আরশীনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
— “অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাব।”

আরশীন একটু ঠাট্টার ছলে বলল,
— “তো? এতক্ষণ কি করছিলে? আমি এলাম আর ঘুম ধরে গেল?”
— “এতক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করেছি। এখন ঘুম পুরোপুরি এসে গেছে।”
আদিয়াত কথাটা বলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। আরশীন ওর পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নরম গলায় বলল,
— “আপুর সাথে কথা বলছিলাম। অনেকদিন পরে এমন করে একটু বাইরে গেলাম তো… কীভাবে সময় কেটে গেল বুঝতে পারিনি।”

আদিয়াত আরশীনের কাঁধে হাত রাখল, আরেক হাত দিয়ে ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল। মৃদু স্বরে বলল,
— “ভালো করেছো।”
— “রাগ কি পড়েছে?” আরশীন আদিয়াতের দিকে তাকাল। আদিয়াত হেসে বলল,
— “রাগ করলাম কখন? রাগ করে একমুহূর্ত থাকতে দিয়েছেন আজ পর্যন্ত?”

আরশীন ঠোঁট টিপে হাসল।
— “কেন থাকতে দিব? তোমার অভ্যাস খারাপ। অকারণে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকো।”

আদিয়াত একহাতে আরশীনের মুখটা তুলে নিল। কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
— “রাগ তো আপনার সাথেই দেখাই ম্যাডাম। অন্যকারো সাথে দেখালে তখন মানতে পারবেন?”

আরশীন চোখ ছোট করে হেসে বলল,
— “তুমি যে অন্যকারো সাথে রাগ দেখাতে পারবে, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?”
— “আমাকে জেনে গেছো পুরোটাই?”
— “অনুভব করেছি।”

আদিয়াত নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “কী কী অনুভব করলে?”

আরশীন ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
— “তোমার রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, ভালোলাগা, দুঃখ, কষ্ট… পরিশেষে আপাদমস্তক তোমাকেই।”

— “কখন অনুভব করলে?” আদিয়াতের ঠোঁটের কোণে একটা ক্ষীণ হাসি। আরশীনের হাতটা নিজের হাতে নিল। তারপর হাত ধরে খেলাচ্ছলে আঙ্গুল বেয়ে নামল, উঠল, কখনো কবজির কাছে থেমে আবার কাঁধে গিয়ে থামল। আরশীন কেমন ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,
— “প্রতিটা নিঃশ্বাসে।”
আদিয়াত কিছু বলল না। শুধু তাকিয়েই থাকল কিছুক্ষণ। এরপর ওর দুহাত নিজের হাতে মুঠোবন্দী করে বিছানায় নিয়ে এলো। মাঝখানে নরম বালিশ পড়ে রইল কিন্তু চোখে চোখ আটকে ছিল। আদিয়াতের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে আরশীনের গালের পাশে বুলিয়ে গেল, তারপর গলায়, তারপর ধীরে হাত ধরে আঙুলের ফাঁক গলে যায়। আরশীন ওর অবাধ্য হাত চেপে ধরে বলল,
— “কি করছো?”

আদিয়াত ওর ঠোঁটে নিজের আঙুলটা চেপে ধরল,
— “ভালোবাসছি… প্রেম করছি।”
— “এটা প্রেম?”

আদিয়াত সামান্য হেসে বলল,
— “এটা শুধু প্রেম না, এটা অভ্যেস।”
— “আমি তোমার অভ্যেস হয়ে গেছি?”
— “তুমি আমার সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত, ভালোবাসা, মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ। অভ্যেসও বটে, প্রয়োজনও আর প্রিয়জনও।”
.
এই তো সুখ-দুঃখ, অভিমান-ভালোবাসার টানাপোড়েনে কেটে গেছে দেড়টা বছর। কখনো হাসি, কখনো অশ্রু, জীবনের নিয়মেই একেকটা অধ্যায়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সৈয়দ বাড়ির প্রত্যেকজন। আজ এই বাড়িতে লেখা হতে চলেছে এক নতুন অধ্যায়। একটি নতুন সূর্যের আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে সকলে।
একটা বিশাল বড় সুখবর, যে সুখে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। হাসপাতালের করিডোরে সবাই একত্রিত হয়েছে। কেউ করিডোর জুড়ে পায়চারি করছে, কেউ চুপচাপ বসে আছে। আদিয়াত ভেতরে ভেতরে অস্থির। কতটা কী হচ্ছে তার, তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলে আর ছেলের বউ নতুন একটা চিরন্তন পরিচয়ে পরিচিত পেতে চলেছে।
ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগোচ্ছে। চুপ করে বসে থাকা শাহানা মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। আশা বারবার ওয়ার্ডের দিকে তাকাচ্ছে।
আদিয়াত করিডোরজুড়ে পায়চারি করছিল। চোখে-মুখে ছিল চাপা উত্তেজনা, অস্থিরতা, আর তারচেয়েও বেশি অজানা ভার। আরশীনের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে বারবার। ভেতরে ও একা… নাহ একা নয়, ওর ভেতরে একটা প্রাণ আছে। সে আজ পৃথিবীতে আসতে চলেছে। আদিয়াত নিজের বুকে হাত রাখল। আশ্চর্য, বুকের ধুকধুকানিটাও কি একটু বেশি লাগছে না আজ? অভ্যস্ত ধৈর্যটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মাথার মধ্যে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আরশীনের কি অবস্থা? ডাক্তার কতক্ষণ আগে ভেতরে গেছে, এখনও বের হচ্ছে না কেন? একটা মৃদু কান্না, একটা ছোট্ট স্পর্শ আর আরশীনের জন্য অপেক্ষা করছে তার সমস্ত সত্তা পাশপাশি চিন্তায় পরাণ পুড়ছে। আযহানও একরকম অস্থির হয়েছিল। আদিয়াত রামধমক দিয়ে বলল,
— “এটা হাসপাতাল, তোর বাড়ি না। এত দৌড়ঝাঁপ না করে চুপচাপ গিয়ে বসা যাচ্ছে না। যা, বেয়াদব।”

আযহান সুরসুর করে গিয়ে বসে পড়ল। বুঝতে পারল না, ভাইয়ের অযথা রাগ করার কারণ কি? আদিয়াত বাহিরে থেকে যতই সংযত থাকুক, ভিতরে ভিতরে কী যে হয়ে যাচ্ছে…
তক্ষুনি ভেতর থেকে নরম সুরে বাচ্চার কান্না ভেসে এলো। আদিয়াত থমকে গেল। মুহূর্তটুকু থেমে থাকল, ঘুরতে থাকল তাকে কেন্দ্র করে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ, সেই কান্নার সাথেই তাল মিলিয়ে চলছিল।
এক নিঃশ্বাসে দরজার দিকে এগিয়ে এলো। চোখে ছিল ভীতিমিশ্রিত উচ্ছ্বাস।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলো নার্স। হাসিমুখে বলল,
— “কংগ্র্যাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে।”
জীবনে বহু কথা শুনেছে সে, কিন্তু এমন তিনটা শব্দ আগে কখনও শোনে নাই, এতটা গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়নি। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই বলল,
— “আলহামদুলিল্লাহ!”
— “মাশাআল্লাহ!”

আদিয়াত জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন কেমন আছে?”
— “মা আর ছেলে, দু’জনই ভালো আছে।”
আদিয়াতের বুকের ভারটা নেমে গেল। ওরা ভালো না থেকে যাবে কোথায়? আদিয়াত যেভাবে আদা জল খেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বাপ্রে বাপ!

নার্স তার কোলে ছোট্ট একটা তুলতুলে কাপড়ে মোড়ানো শিশু তুলে দিল। এক ঝলকে দেখেই বুকটা ভরে উঠল। একফোঁটা প্রাণ, অথচ আস্ত পৃথিবী। আদিয়াত ফাঁকা ঢোঁক গিলল। সন্তর্পণে ওর কানে আযান দিল। বেশিক্ষণ নিয়ে থাকতে পারছিল না, হাত কাঁপছিল। সবাই যখন নতুন সদস্যকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আদিয়াত ধীরপায়ে এগিয়ে এলো আরশীনের দিকে। আরশীনের শুকনো মুখে হাসি ফুটে উঠল। ও মুখের ক্লান্তি লুকিয়ে বলল,
— “কি, এইবার খুশি তো?”

আদিয়াত কথা বলল না। আস্তে করে ওর রুক্ষ, নরম হাতখানা নিজের দু’হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
— “খুব কষ্ট হয়েছে, তাই না?”

আরশীন চোখ নামিয়ে বলল,
— “তা একটু হয়েছিল বটে… তবে এখন আনন্দ হচ্ছে প্রচুর। ইশশ, আমাদের সন্তান। ভাবতে পারছো তুমি?” ওর কণ্ঠে তখন বাচ্চার মতোই বিস্ময় আর আনন্দের মিশেল। আরশীন ঘাড় ঘুরিয়ে আশাকে ডাক দিল,
— “আশা, বাবুকে একটু দে না। কোলে নিই।”
আশা হাসিমুখে এগিয়ে এলো। বাবুকে বুকের কাছ থেকে একটু নামিয়ে এনে যখন আরশীনের কোলে দিতে যাবে, তখনই আরশীন বলে উঠল,
— “আগে ওর বাবার কাছে দে। আরেকটু কোলে নিয়ে থাকুক। ও তো তখন একঝলক দেখেছিল মাত্র।”

আশা ধীরে বাবুকে আদিয়াতের কোলে দিয়ে অন্যপাশে সরে গেল। বাবার কোলে এসে নড়াচড়া করছে ও। নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
আরশীন বিছানায় একটু উঠে বসার চেষ্টা করতেই আদিয়াত এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেলল। আরশীন তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
— “এই না না… আমি ঠিক আছি। তুমি ওকে ভালোভাবে নাও তো। আমার কাছে আনো, দেখি একটু…”

আদিয়াত সন্তর্পণে এগিয়ে এলো। ওকে আরশীনের দিকে এগিয়ে নিয়ে এলো। আরশীন পলকহীন চেয়ে রইল। ছোট ছোট হাত-পা, নরম, কুঁচকে থাকা আঙুলগুলো বোধহয় ওর হাত ধরতে চায়। চোখ দুটো আধা খোলা, ছোট গোল মুখে নিঃশ্বাস পড়ছে টুকটুকে নরম ঠোঁটে।
গায়ের রঙটা একদম আদিয়াতের মতো ফর্সা। চিবুকেও হালকা একটা খাঁজ। আরশীনের চোখে পানি চলে এলো। সে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
— “দেখেছ? তোমার ফটোকপি নিয়ে এসেছি পৃথিবীতে।”

আদিয়াতও হাসল। ও বরাবরের মত সকলের সামনে চুপ রয়েছে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। একটা সংকোচ, অস্বস্তি ঘিরে রয়েছে। সকলের সামনে চেহারায় একটা গভীরতার মুখোশ পরে থাকবে। দরজার ওপাশে আরশীনের কাছে আবার এক নিমিষেই সহজ হয়ে যায়। আরশীন জিজ্ঞেস করল,
— “বাবার অভাব মিটল?”

আদিয়াত একটু তাকাল ওর দিকে। প্রশ্নটা বুঝতে পারল না পুরোপুরি।
— “হুঁ?”

আরশীন ধীরকণ্ঠে বলল,
— “বাবা না থাকার অভাবে… বাবা ডাকতে না পারার যন্ত্রণায় যে তুমি প্রতিক্ষণে গুমড়ে থাকো, আমি জানিনা ভেবেছ? আমি জানি, আদিয়াত। তোমার সেই অজানা শূন্যতা আমিও তো কতদিন ধরে অনুভব করছি, তাইনা?”

আদিয়াত বাবুর দিকে তাকাল। ওর বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। আরশীন আবার বলল,
— “আমারও তো বাবা নেই। কতদিন হয়ে গেল বাবাকে ডাকিনি। খুব করে আল্লাহর কাছে চেয়েছি আমাদের একটা ছেলে হোক… যাকে আমরা ‘বাবা’ বলে ডাকব। যে আমাদের শূন্যতা থেকে মুক্তি দিবে। আমরা দুজনেই বাবাকে হারিয়েছি। আজ একটু হলেও সেই শূণ্যতা মিটলো তো, তাইনা বলো?”

আদিয়াত বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর আরশীনের দিকে চেয়ে বলল,
— “একটু মিটেছে? না বরং বলি, পরিপূর্ণ হয়েছে। এতদিন ধরে ভেতরে জমে থাকা এক শূন্যতা আজ সত্যিই মুছে গেছে। শুধু আমরাই ওকে ‘বাবা’ বলে ডাকব না, এখন থেকে ও আমায় ‘বাবা’ ডাকবে। এক জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়েও বড় কিছুই নেই। ওর দিকে আমি যখন প্রথম তাকিয়েছিলাম… অবাক হয়ে দেখলাম, বাবাকেই বোধহয় দেখছি।”
আরশীন মৃদু হাসলো। আদিয়াত পুনরায় বলল,
— “সে মানুষটা যতই ভুল করুক, আমি তাকে অস্বীকার করতে পারি না। বরং আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তিনিই তোমাকে আমার কাছে এনেছিলেন। আর সেই কারণেই আজ আমি এই ছোট পুঁচকুটার বাবা।” বলেই আদিয়াত ওকে একটু উপরে তুলে নাকটা পেটে ঘষলো।
মুহূর্তেই ও কেঁদে উঠল। নরম, টুটফাটা সেই কান্না ঘরভর্তি নিঃশব্দতায় সুরের মতো ছড়িয়ে পড়ল। আদিয়াত একটু হকচকিয়ে বলল,
— “এই যে, নির্ঘাত মাকে মিস করছে।”

আরশীন ওকে কোলে তুলে নিল। অবাক কাণ্ড, সেকেন্ডের মধ্যেই কান্না থেমে গেল। ছোট্ট মুখটা মায়ের বুকের সঙ্গে আলতোভাবে ঠেকিয়ে চোখ বুজে এলো। আরশীন নিচু স্বরে বলল,
— “তোমার কথাবার্তায় ছেলে বোরিং হচ্ছিল বোধহয়। এখন আর দুঃখের কথা বলো না তো, দুঃখের দিন শেষ হয়েছে।”
.
আজ আরশীন ফিরছে নিজের সংসারে এই ফেরা আর আগের মতো নয়। এবার ওর সঙ্গে আছে ওদের নতুন স্বপ্ন, নতুন সূচনা। বাড়ি আজ সাজানো হয়েছে উৎসবের মতো করে। অতিথিদের কোলাহল, রান্নাঘর থেকে আসা সুগন্ধ সবমিলিয়ে একেবারে অন্যরকম একটা পরিবেশ।
আরশীন আর আদিয়াতের বিয়েটা হয়েছিল যেনোতেনোভাবেই। তারপর আর অনুষ্ঠান করাই হলো না। এতো কাহিনী হলো মাঝখানে। কারো মনমেজাজ ঠিক ছিল না। ইচ্ছেও ছিল না কিছু করার। আজ সেই সুযোগ এলো… একেবারে বাচ্চাসহ গৃহপ্রবেশ।
বাড়ির মূল দরজার সামনে সবাই অপেক্ষা করছিল। আদিয়াত আরশীন পাশাপাশি, কোলে ছেলে; মায়ের বুকে মাথা গুঁজে নিশ্চিন্ত ঘুমে। তাদের দু’পাশে দাঁড়ানো আযহান আর আলিয়া। মিষ্টি ভালোবাসায় ঘরোয়া প্যারেডের মত ওরা ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে এসে আযহান বলল,
— “কী জাদু হলো ভাইয়ার জীবনে। কয়েকদিন আগে বের হলো দুইজন আর আজ ফিরে এলো তিনজন হয়ে। কবে যে আমার জীবনে এই জাদু ঘটবে?”

তার চোখেমুখে পরিচিত দুষ্টু হাসি। সবাই হেসে উঠলেও আদিয়াত একচোখে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল না কিছুই। আযহান তৎক্ষণাৎ মুখ গম্ভীর করে নিজের মাথা চুলকে বলল
— “ওরে বাবা, আমি তো মজা করছিলাম ভাইয়া… মাফ চাই। চলে গেলাম, অনেক কাজ আছে।”
আশেপাশে হো হো করে হাসির রোল পড়ে যায়। আলিয়া ওকে কনুই দিয়ে ঠেলে পাশ কাটিয়ে নিয়ে যায়।

ঘরে গৃহপ্রবেশের আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই নামকরণ নিয়ে ধুম পড়ল। কে কী নাম রাখবে, কার নামটা আধুনিক, কারটা অর্থপূর্ণ, এই নিয়ে শুরু হলো তর্ক আর হাসাহাসি। আযহান ফাজলামি করে বলল,
— “আমি আমার একমাত্র ভাতিজার নাম আদর করে রাখলাম মফিজ মিয়া।” পাশ থেকে আলিয়া ওর পিঠে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
— “এই ছেলের শুধু বাদঁরামি? শোনো আরশীন আমি ভাবছিলাম, ‘আরহাম’ নামটা কেমন হয়? অর্থও ভালো আর শুনতেও ভালো লাগছে। বাদবাকিটা তোমাদের ইচ্ছা।”
— “আমাদের ইচ্ছা আবার কি আপু? তোমাদের ছেলে, সবাই মিলে রেখে দাও কিছু একটা।”

আলিয়া সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল,
— “তাহলে ভালো নাম তোমরা কিছু একটা রেখে দিও। ডাকনাম হিসেবে এটাই থাকুক। তোমাদের নামের সাথে মিলিয়েই রেখেছি।”
ছোট আরহামকে নিয়ে ওদের আনন্দের শেষ নেই। ওর দিকে তাকালেই আদিয়াতের মনে পড়ে যায় সেই দিনটা, যখন আরশীন প্রথম তাকে বাবা হওয়ার খবরটা জানিয়েছিল। কী ঐন্দ্রজালিক একটা মুহূর্ত!
সেদিন নিশুতি রাত। এমন সময়, আরশীন ধীরে ধীরে এসে আদিয়াতের পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, নিঃশব্দে ওর উপস্থিতি অনুভব করছিল। আদিয়াত তাকাল, চোখে ভেসে উঠল প্রশ্ন। আরশীন বোধহয় কিছু বলতে চায়…
আরশীন কোনো কথা না বলে ওর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের পেটের ওপর রাখল, একটু নিচুতে। আলতো গলায় বলল,
— “তুমি কি অনুভব করতে পারছো, তোমার অস্তিত্বের একটা অংশ আমার মধ্যে বেড়ে উঠছে।”

আদিয়াত স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। পরম মমতায় আরশীনকে জড়িয়ে ধরেছিল। মুখে বলল না কিছুই তবে অনুভবে জানিয়ে দিল, এই পৃথিবীতে এরচেয়ে বিস্ময়কর কিছু আর হতে পারে না। মুহূর্তের মধ্যেই আদিয়াত আরশীনের কপালে, গালে হাজারখানিক চুমুতে ভরিয়ে দিল।
আগেরবারের কথা কেউ ভুলে যায়নি। যে দুঃস্বপ্ন জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল, তা কাটা দাগের মতো এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু সেই দুঃখের স্মৃতি আর নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার মতো মূর্খ ওরা নয়। সেই ভুল, সেই দহন একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে।
সেই থেকেই, এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ আরশীনকে একটু বেশিই খেয়ালে রেখেছে। ওর চারপাশে একটা অদৃশ্য বৃত্ত টেনে রেখেছে।

আর আদিয়াত? সে নিজের জীবনটাই গুটিয়ে এনেছে আরশীনের চারপাশে। শেষ ক’মাসে সব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তার সময়, মন, স্পর্শ, সবকিছু উৎসর্গ করেছে স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের জন্য। আরশীনের একেকটা ছোট্ট আবদার, একেকটা অকারণ খামখেয়ালিপনাকেও আদিয়াত আগলে রেখেছে গভীর যত্নে। চাইছিলো না কোনো ত্রুটি। চাইছিলো না হাসিমাখা মুখের নিচে কোনো চাপা কান্না লুকিয়ে থাকুক। এরপর সবমিলিয়ে আজকের এইমুহূর্ত…

আদিয়াত যখন সারাদিন পর ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে, তখন আরহামের সেই ছোট্ট মুখটা দেখে পরাণ জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে যায়।
আরহাম ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে ওর মুখের অভিব্যক্তি, ওর হাসি, ওর ভাষা, ওর কৌতূহল। মায়ের কাছে যতটা থাকে, তার চেয়েও বেশি থাকে ফুপির কাছে। আরশীন মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলে,
— “খাওয়ার সময় খালি মায়ের কথা মনে পড়ে, তাইনা?”

রাতের নরম আলোয় ঘরটা ছিল বেশ স্নিগ্ধ। আদিয়াত আরহামকে কোলে নিয়ে ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটছিল। ঠিক তখনই আরশীন ঘরে ঢুকল। দু’জনকে এভাবে চিপকে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “আজকাল তো মনে হয় আমাকে ভুলেই গেছে একজন। আগে আমাকে ঘরে না দেখলে গোমড়া মুখে বসে থাকত। এখন তো ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসি থামছে না।”

আদিয়াত হেসে ফেলল। ছেলের মাথায় একটা চুমু দিয়ে আরশীনের দিকে এগিয়ে এলো। আরশীন সরে যেতে যেতে বলে,
— “সামলে চলো। ছেলের বাবা হয়েছো। যখন তখন যা ইচ্ছে করবে, তা আর চলবে না।”

আদিয়াত অবাক হয়ে বলল,
— “আমি কিছু করলামই বা কখন?”

আরশীন গম্ভীর মুখে বলল,
— “আর করতেও যেও না।”
— “মানে রেস্ট্রিকশন দিয়ে দিচ্ছো?”

আরশীন ঘাড় কাত করে বলল,
— “ইয়েস, পুরোপুরি। আজ থেকে ফর্মালি ঘোষণা করে দিলাম।”

আদিয়াত হেসে আরহামের ছোট্ট হাতের আঙুল ধরে বলল,
— “বস তো আমার সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ওকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি? তাহলেই তো রেস্ট্রিকশন থাকবে না। আমি তখন আমার বউয়ের কাছেও যেতে পারব। যখন তখন কিছু করতেও পারব আর যা ইচ্ছে। হিসাব করে চলতে হবে না।”

আরশীন ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
— “ইশশশ… কী ভয়ংকর স্বার্থপর তুমি।”
— “ভালোবাসা ভাগ হয়ে গিয়ে আমার ভাগে কম পড়ল যে।” মুখ কালো করে আদিয়াত আরশীনকে আরেকবার জড়িয়ে ধরতে গেল। আরশীন তৎক্ষণাৎ সরে যেতেই আদিয়াত কপট বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “এইতো এইতো সরে যাচ্ছো কেনো? তোমার নামে আমি সরকারিভাবে অভিযোগ জানাব। প্রেম করালে, পাগল বানালে, তারপর মা হয়ে প্রেমিকাকে লুকিয়ে ফেললে। ধরতে গেলেই দৌড়াচ্ছ।”

আরশীন বিছানার এককোণে বসে বলল,
— “আদিয়াত, তোমার অভিযোগ আমলযোগ্য হবে না। আমি এখন ডুয়েল রোলে আছি বুঝলে?”
— “তাহলে আমার ভালোবাসা কই?”
— “ভালোবাসছিই তো।”

আদিয়াত ধপ করে ওর পাশে বসে বলল,
— “ভালোবাসার নামে প্রতারণা চলছে। আমি এর বিচার চাই।”

আরশীন চুলগুলো হাত খোঁপা করে বেঁধে বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “উফফ, কি হয়েছে তোমার? যাতা কথা বলছো কেনো? যত্তসব পাগলের পাল্লায় পড়েছি। ওকে দাও দেখি। যতদিন যাচ্ছে, পাগলামি আরো বাড়ছে।”

আদিয়াত বাবুকে কোলে দিল। নাটুকে গলায় বলল,
— “নারী তুমি আসলেই ছলনাময়ী। পাগল করে দিয়ে এখন পাত্তা দিচ্ছো না।”
আরশীন আরহামের ছোট্ট খেলনা টেডি তুলে নিয়ে আদিয়াতের পিঠে একটা বাড়ি বসিয়ে দিল।
— “তোমার নাটকীয় সংলাপের অ্যাওয়ার্ড দিলাম। অসভ্য কোথাকার।”

আদিয়াত পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— “হৃদয়ে লাগল।”
আরশীন মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল। আর ওইদিকে আরহাম নিঃসংকোচে দুই হাত-পা ছুঁড়ে দুনিয়ার কোনো খবর না রেখেই নিজের ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

ভালোবাসা বড় অদ্ভুত। ভালোবাসা মানে একে অপরের পাশে থাকা নয়, বরং ভাঙা সময়েও হাসিমুখে একে অপরের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
দুইটি হৃদয়ের ভুল, ক্ষত, বিরোধ আর বোঝাপড়ার মধ্যেও একটি কথাই সত্যি হয়ে থেকে যায় “তবুও তুমি”, যা ভালোবাসার একমাত্র ঠিকানা।
.
.
.
সমাপ্ত।