তবুও তুমি পর্ব-৪+৫+৬

0
2

#তবুও_তুমি💙 [পর্ব-০৪]
~আফিয়া আফরিন

(আলো-ছায়ার খেলা)
আরশীন জানে, আজ আদিয়াতের মুড খারাপ কেন? সে মুখে না বললেও, চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। সন্দেহ দানা বেঁধেছে তার মনে। অজানা সত্য তাকে বিচলিত করেছে। আদিয়াত সত্যটা জানতে চায়, তার চোখে ধোঁকা চলবে না। আরশীন বসে বসে ভাবছিল, ঠিক সেই সময়েই আযহানের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ফিসফিস আওয়াজ,
— “ভাবি, আপনার সাথে কি ভাইয়ার ঝগড়া হয়েছে নাকি? এইভাবে কোনো কথা না বলে চলে গেল? মুখে একটুও হাসি নাই।”

আরশীন একটু চমকে তাকায় ওর দিকে। মুখে হালকা হাসি আনতে চেষ্টা করে, কিন্তু চোখে ধরা পড়ে অস্বস্তি।
— “না রে, ঝগড়া না… উনি হয়ত একটু সিরিয়াস মুডে আছে।”

আযহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল আরশীনের দিকে,
— “ভাইয়ার ওই চেহারাটা দেখে তো মনে হলো, কাউকে খেয়ে ফেলবে। কী ভয়ঙ্কর!”

আরশীন এবার আর হাসি চাপতে পারল না। হালকা হেসে বলল,
— “তোমার ভাই একটু বেশি ভাবুক, তাই অনেক কিছু মুখে না বললেও ভেতরে রাখে। চিন্তা করো না, কোনো ঝগড়া হয়নি।”

আযহান কাঁধ ঝাঁকাল।
— “তবে আমি বললাম কিন্তু, আপনি সাবধানে থাকবেন। আমার ভাই মুখে কিছু না বললেও ভেতরে কিন্তু আগুন জ্বলে।”

আরশীন এবার গভীরভাবে একটু চুপ করে গেল। মৃদু স্বরে নিজেকে বলল,
— “তা তো জানি… আর সেই আগুনেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি আমি।”
আযহান কিছু না বুঝে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে আবার চ্যানেল ঘোরাতে লাগল। আর আরশীন জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল… ভেতরে কিছু সিদ্ধান্ত যেন আরো দৃঢ় হয়ে উঠছে তার। সে জানে—এই সম্পর্ক এখন অনেক সূক্ষ্ম দড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই ছিঁড়ে যেতে পারে সব কিছু।
.
দু’দিন কেটে গেছে। আদিয়াত যেন ওর নিজের একটা দেয়াল গড়ে তুলেছে।
সব কথাবার্তা সীমিত, চোখাচোখি হলে শুধু তীক্ষ্ণ তাকানো; যেন ভেতরের সবকিছু চেপে রেখেছে। আরশীন ভেবেছিল, ওর কিছু আসবে যাবে না। এই সম্পর্কটা তো এমনিতেই পরিকল্পিত ছিল। কিন্তু এখন সেই “আসবে যাবে না”
কথাটাই নিজের মনকে বোঝানো যাচ্ছে না। অস্থির লাগছে। অকারণ খারাপ লাগছে। আদিয়াত যদি অভিযোগ করত তাহলেই বরং সহজ হতো। তবে এই নির্লিপ্ততা, এই নির্বিকার ভাব… যেন কাঁটার মতো বিঁধছে আরশীনের ভেতরে।
কেন এমন হচ্ছে? এই স্বস্তি চাওয়াটাই কীভাবে অস্বস্তি হয়ে উঠছে, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। জানতে চাওয়া আর সহ্য করতে না পারার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে, আজ আরশীন চুপ থাকতে পারল না। অবশেষে, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে পৌঁছে গেল জহিরুল ইসলামের অফিসে। রিসেপশনে নাম বলার আগেই এক ব্যক্তির মুখোমুখি পড়ে গেল। উচ্চতা মাঝারি, কড়া গলার ভর, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
— “আপনি?”
ভদ্রলোকের প্রশ্নের মুখে আরশীন সামান্য হেসে বলে,
— “জহির আংকেলের কেবিনটা কোন দিকে?”
ভদ্রলোক কিছুটা গম্ভীর গলায় দিক দেখিয়ে দিলেও ওকে চিনতে পারল না। কিন্তু আরশীন ঠিকই চিনেছে তাকে—সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, আদিয়াতের চাচা। সে চুপচাপ ভেতরে চলে যায়। পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন সে এখনো বোধ করল না। কারণ, আজ তার আসা অন্য এক উদ্দেশ্যে। কেবিনে ঢুকে জহিরুল ইসলামকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল কিছুক্ষণ। তিনি কাগজপত্রে ব্যস্ত ছিলেন। আরশীনকে দেখে অবাক হলেন না। মনে হয়, এই আসাটা তিনি অনেক আগেই আন্দাজ করেছিলেন। আরশীন কোনোরূপ ভণিতা না করে সরাসরি কথাটা বলে উঠল,
— “আমার আদিয়াতের সঙ্গে কথা বলা দরকার, ব্যক্তিগতভাবে। উনার সাথে তো আমি কথা বলব তার আগে ভাবলাম আপনাকে একটু জানিয়ে দিই।”

জহিরুল ইসলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। সহজ গলায় বললেন,
— “তোমরা এখন স্বামী-স্ত্রী, আরশীন। সম্পর্কটা কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব জীবনের। যদি আদিয়াতের সঙ্গে কিছু বলা বা বোঝানো দরকার মনে হয়, তাহলে আমাকে না জানিয়ে সরাসরি বলবে, নিঃসংকোচে। তবে পরামর্শ নিতে যখন তুমি যদি এতদূর এসেছ, তাহলে আমি আর বাঁধা হবো না। সাবধানে কথা বলো, আরশীন। ওকে বুঝতে চেষ্টা করো, ও কিন্তু খুব সহজ মানুষ নয়।” আরশীন মাথা নিচু করে শুধু “হ্যাঁ” বলল।

আরশীন কেবিন থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছিল। ঠিক তিনতলায় ওঠার মুখেই হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যায় আদিয়াতের সঙ্গে। মুহূর্তটা যেন একটু থমকে যায়; দুজনেই অপ্রস্তুত, একজন অবাক, আরেকজন নির্ভার দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আরশীন থমকে দাঁড়াল। চোখ তুলে তাকাল আদিয়াতের দিকে, চোখে একধরনের নির্লিপ্ততা সেখানে। আদিয়াত এক পা এগিয়ে এল, কণ্ঠে বিস্ময় মেশানো ভাব,
— “আপনি এখানে?”

আরশীন নিচু গলায় উত্তর দিল,
— “আপনার সাথে কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করলাম। কথাগুলো প্রয়োজনীয় তাই অপেক্ষা করতে না পেরে সরাসরি চলে এসেছি। আমরা কি ভেতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?”

আদিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
— “আসুন।”
দু’জন একসাথে উপরের করিডোরে পা রাখল। কেবিনে ঢোকার পর আরশীন তার কথা সরাসরি বলতে চায় আবার দ্বিধা কাজ করে। সে একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। গলায় জোর এনে বলল,
— “আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমি তবে খানিকটা সময় পেতে পারি?”

আদিয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকাল তবে মাথা নাড়ল,
— “নাটকীয়তা বাদ দিয়ে বলুন, আমি শুনছি।”
— “আপনার যত দ্বিধা আমাদের বিয়ে নিয়ে তাইতো? সেটাই ক্লিয়ার করব এখন…”
আদিয়াত হালকা হেসে ফেলল। হাসিটা যেন কোথাও একটা অবিশ্বাস, কোথাও যেন কৌতুক। মনে হলো, যেন কারো শিশুসুলভ যুক্তির ভাষণ শুনছে। তবে কিছু না বলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল—আরশীনের পরের কথাগুলো শোনার জন্য।

আরশীন কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— “হাসছেন কেনো আপনি?”
— “আপনি বলুন, কথা বলার সময় মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানো শোভা পায় না।”
— “ঠিক আছে বলছি। এত অস্থির হচ্ছেন কেন আশ্চর্য! কথা কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি আমি?”
আরশীন ইচ্ছাকৃতভাবে কথার গতি শ্লথ করছিল, যেন সে বললে প্রতিটি শব্দ আদিয়াত বুঝতে পারে। তাকেও সবটা বোঝানোর মত করে বোঝাতে হবে যাতে আদিয়াতের সন্দেহ বা প্রশ্ন থামিয়ে দিতে পারে। আরশীন নিচু গলায় একটানা বলতে শুরু করে,
— “এই বিয়েটা প্রথমে আমি স্বেচ্ছায় করিনি কিন্তু বাধ্য হয়েছি। আমার বাবার মৃত্যুর পর থেকে অনেক কিছুই ভেঙে পড়ে গেছে। আমি নিজেই জানি না আমার চারপাশে কে আপন, কে শত্রু। তখন জহির আংকেল সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাকে নিরাপদ রাখতে হলে এমন একটা সম্পর্ক দরকার যেটা বাইরে থেকে শক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য দেখায়। আমি রাজি হয়েছিলাম… কারণ, তখন আমার সামনে অন্য কোনো রাস্তা ছিল না।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আরশীন থেমে গেল। আদিয়াতের চোখে চোখ রাখল; যেন বুঝতে চাইল, ঠিক কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছে তার কথার ভার। সে মুখ ফিরিয়ে নিল না বরং স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। আদিয়াত ঠাণ্ডা গলায় বলল,
— “বেশ ভালোই, তাহলে নিরাপদেই আছেন।”
তার কণ্ঠে কোনো উচ্চস্বরে ক্ষোভ ছিল না তবে চোখেমুখে স্পষ্ট চাপা অভিমান। যেন কথার আড়ালে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর একটাও মুখে আনল না; শুধু জানিয়ে দিল, সে সব বুঝেছে। আরশীন কড়া চোখে আদিয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “শুনুন।”

এ মুহূর্তে আদিয়াত একটু এগিয়ে এসে বলল,
— “বলুন। আর কোনো নিরাপত্তার দরকার আছে? সব কিছু তো এখন পরিষ্কার।”
— “সেই তো, আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন। আপনি আমার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। আমার কথার সারমর্ম বুঝুন। ভুল বোঝার হলে তারপর না হয়…”
— “ভুল বুঝি নাই তো।”
— “যতটুকু বুঝলেন, সবটাই ভুল।”
আদিয়াত গলা নিচু করে, একটু ঠান্ডা স্বরে বলে,
— “সব ঠিক বুঝেছি। তবে আগে যদি একটাবার আমাকে জানানো হতো…”
আরশীন চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে,
— “কীভাবে জানাব? আপনাকে তো আর বিয়ের কার্ড পাঠানো যাচ্ছিল না, তাই না?”
আদিয়াত বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু একটা বলবে ভাবছে, কিন্তু তার আগেই আরশীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
— “শুনুন, যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে এখন থেকে প্ল্যানের বাইরে চলা শিখতে হবে আপনাকে।”
— “এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
আরশীন চটপট বলে,
— “আপনার দিক থেকে দেখলে সমস্যা, আমার দিক থেকে অ্যাডভেঞ্চার!”
এমন সময় কেবিনের দরজা ধীরে খুলে গেল। আমিনুল ইসলাম প্রবেশ করতেই দু’জনের দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে গেল। আরশীন ও আদিয়াত দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল, যেন কিছু একটা হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে। চোখে স্পষ্ট বিস্ময় নিয়ে থমকে দাঁড়ালেন আমিনুল ইসলাম। মুহূর্তের জন্য কেবিনটা নিঃশব্দ হয়ে পড়ল।
তারপর আচমকা পরিস্থিতি সামলে, আরশীন হালকা হেসে বলল,
— “চাচা, আসসালামু আলাইকুম।”
আমিনুল ইসলাম কোনো জবাব না দিয়ে কিছুটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করলেন। চোখে মিশ্র কৌতূহল আর অনাস্থার ছাপ। তার কণ্ঠে ধীরে ভেসে এলো,
— “তোমরা এখানে দু’জন? একসাথে?”
আদিয়াত মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন কোনো দায় নেই তার এই পরিস্থিতির ওপর। আরশীন ঠোঁট কামড়ে একরকম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
— “চাচা, আমরা স্বামী-স্ত্রী… একসাথে থাকা তো অশোভন কিছু নয়, তাই না?”

তার কথায় যেন ঘরে এক মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দ ঠান্ডা নেমে এলো। চাচা আমিনুল ইসলাম মুখে কিছু না বললেও চোখে অস্বস্তি আর প্রশ্নচিহ্ন গাঢ় হয়ে উঠল। হয়তো তিনি এমন সরল উত্তর হয়ত আশা করেননি। কিন্তু যার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ ছিল, সেটা আদিয়াতের। সে ধীরে আরশীনের দিকে এমন এক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল; যাতে মিশে ছিল বিরক্তি, ইঙ্গিত, আর চাপা জিজ্ঞাসা।
আরশীন আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। তার ঠোঁটে ধরা সেই অপ্রস্তুত হাসি আর চোখের তাড়াহুড়া নিয়ে সে দ্রুত কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পেছনে রয়ে গেল কিছু ভারী হয়ে ওঠা বাতাস আর চাচার কপালের ভাঁজ। চাচার চোখের চাহনি কিছুটা কাঁটার মতো হয়ে উঠল। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন,
— “আমি যা বলতে এসেছিলাম, সেটা তো এখন ছোট হয়ে গেল এই দৃশ্যের তুলনায়।”
আদিয়াত দৃশ্যটা লঘু করতে গিয়ে হালকা হাসল, কিন্তু চাচা তার সেই হাসি গ্রহণ করলেন না। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন,
— “তোমার এই বিয়েটা… কীসের জন্য করলে? এটা তোমার বউ? কথাবার্তা তো সুবিধার মনে হলো না। ওকে বিয়ে করার ফলে নিজের জীবনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেললে।”
— “কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সময় মতোই পরিষ্কার হবে। এখন শুধু বলুন, আপনি কিসের জন্য এসেছিলেন?”

চাচা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— “তোমার বাবার নির্দেশে এসেছি। সামনের সপ্তাহে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা হবে, তার জন্য জহির ভাই ডেকেছেন।”
— “আচ্ছা চলুন।”
— “হুমমম… তবে শোনো ভাতিজা একটা কথা বলি। এখনও সময় আছে, তুমি চাইলেই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারো। পরে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। এখানে আমি তোমার ভবিষ্যৎ স্পষ্ট অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। তুমি যদি ভাইকে কিছু বলতে না পারো, আমাকে বলো। আমি ব্যবস্থা করে দিব।”
আদিয়াত একটু গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইল। দৃশ্যত শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে একধরনের চাপা ক্ষোভ যেন জমে আছে। পেছনে চাচার চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস আর অনুচ্চারিত অসন্তোষ রেখে আদিয়াত ধীরে ধীরে করিডোর পেরিয়ে গেল, বাবার কেবিনের দিকে।
.
আরশীন চুপচাপ বসে ছিল, চোখ তার ফাঁকা দেয়ালে। মনে হচ্ছিল, ওর ভেতরের কোনোটাই ঠিকঠাক জায়গায় নেই। আদিয়াতের দৃষ্টি, ঠান্ডা স্বর আর শেষ কথাগুলো বারবার ফিরে আসছিল মনে। সে জানে, আদিয়াত রাগ করার অধিকার রাখে। অধিকার রাখে দূরত্ব তৈরি করারও। আরশীন হয়তো চাইছিল একটা ব্যাখ্যা দিতে, একটা সোজা রাস্তা ধরতে। কিন্তু কোনটা বলবে আর কোনটা চিরতরে গোপন রাখবে—সেই দ্বিধা থেকেই বের হতে পারছিল না।
আরশীন সন্ধ্যাবেলা চুপচাপ এসে বসে আদিয়াতের সামনে। আলো ছিল ম্লান, ঘরের আবহাওয়া থমথমে।
— “আপনি রাগ করেছেন, তাই না?”
— “রাগ করার মতো কিছু হয়েছে নাকি?”
আরশীন একটু থেমে বলল,
— “বিয়ের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে… আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি কষ্ট পেয়েছেন।”
— “বুঝতে পেরেছো তাহলে প্রশ্ন করছো কেন?” আদিয়াত চোখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলল।
আরশীন জবাব না দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ কালো করে বলল,
— “তাকিয়ে আছেন এমনভাবে যেন আমি কোনো অপরাধী। তাই নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম, আপনি আমাকে আসলে কতটা ভুল বুঝেছেন।”
— “ভুল বুঝি নাই।”
— “আপনি তো কিছু বলেন না। আমি ভাবছিলাম বুঝি আপনি চুপচাপ থেকে শাস্তি দিচ্ছেন।”
— “এতটা নাটকীয় ভাবার কিছু নেই।”
— “আপনার মুখের ভাব তো ঠিক বলছে না।”
— “আচ্ছা, আপনি এখন কী চান?”
— “আমি চাই আপনি অন্তত বলুন, আপনি রাগ করেছেন কিনা। কারণ আমি সিরিয়াসলি… মনে করি, আমাকে একটু হলেও শুনে দেখা উচিত ছিল।”
— “এইবার তো মনে হচ্ছে আপনি নিজেই রেগে আছেন।”

আরশীন হালকা হেসে উঠে বলে,
— “রাগ না… এটা একটা জটলা হয়েছে মাথার মধ্যে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আপনি আসলে কী ভাবছেন।”
— “তাই ভাবনাটা পরিষ্কার করতেই তো বলেছিলাম, বুঝেছেন যখন তখন আর প্রশ্ন কেন?”
— “কারণ আপনি মুখে কিছু না বললে, মনে শান্তি আসবে না আমার।”
আদিয়াত ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তাহলে আপনার শান্তির দরকার নেই। অশান্তিতে থাকুন, আমাকে জ্বালাতে আসবেন না।”

আরশীন কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চুপ করে থাকে। তারপর হালকা স্বরে বলে,
— “আপনার কাছ থেকে এমন কথা আশা করিনি।”
— “আপনি যেটা আশা করেন না, সেটাই আমি।”

এই কথায় একটু নিস্তব্ধতা, তারপর আরশীন চাপা হেসে বলে,
— “তা ঠিক। আপনি ঠিক আপনিই। সমস্যা হলো, আপনাকে বুঝতে গেলে সবসময় একটা অভিধান লাগবে।”
আদিয়াত হেসে ফেলে,
— “ওকে, তাহলে সেটা নিন আর ভালো করে পড়ে ফেলুন। আমি বারবার ব্যাখ্যা দিই না।”
আরশীন একপ্রকার ধপ করে উঠে দাঁড়াল। এসেছিল রাগ ভাঙাতে, উল্টে নিজেরই মাথা ধরে গেছে। কী ভয়ংকর জটিল লোক এই আদিয়াত! আল্লাহ, কী সহজ-সরল ভেবেছিল তাকে! দৃষ্টিতে দৃঢ়তা, মুখে কম কথা, গম্ভীর হাবভাব; মনে হয়েছিল শান্তশিষ্ট একজন ভদ্রলোক। কিন্তু ভেতরে? উফফ! একেকটা কথা এমন করে প্যাঁচিয়ে দেয়, যেন তাকে বুঝতে হলে আইন পাঠ করে আসতে হবে।
আরশীন দাঁত চেপে বলল,
— “আমি আর কখনও কারো রাগ ভাঙাতে আসব না। ঠেকা পড়ে নাই আমার এত। আপনি ঠিক বা ভুল যাই বোঝেন না কেনো আমার এত মাথাব্যথা নেই তা নিয়ে। আপনাকে বোঝাতে গিয়ে নিজের মাথাটাই হারিয়ে ফেলেছি মনে হয়।”
তারপর চলল, পেছনে একবারও না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তবে পেছন থেকে আদিয়াত তাকিয়েছিল কিনা… সেটা আরশীনের দেখাই হয়নি।
.
ফরিদপুর শহর। শান্ত, পরিচ্ছন্ন আর নিজের ছন্দে চলা এক জায়গা। গাছপালায় ঘেরা রাস্তা, পুরোনো লাল ইটের দোতলা বাড়ি, সব মিলিয়ে এক অনাড়ম্বর জীবনযাপন। এই শহরেই আরশীনের ছোটবেলা কেটেছে। সেই পুরনো বাড়িটা এখনও আছে, যদিও এখন অনেকটাই ফাঁকা। বাবা নেই, মা আর ছোটো বোন আছে শুধু। আরেকটু দূরে এগিয়ে গেলেই চাচার বাড়ি। প্রায় পঁচিশ বছরের মতো তিনি এই শহরেই। এলাকার মানুষজন এখনও সম্মান করে ডাকেন, “বিলাল স্যার।”
সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে ছিলেন বিলাল হক। হাতে ফরিদপুর বার্তার পত্রিকা। ঠিক তখন পাশের বাসার ছেলে এসে বলল,
— “চাচা, কাল ঢাকা যাচ্ছেন শুনলাম?”
— “হ্যাঁ রে। আরশীনের সাথে দেখা করার প্রয়োজন আছে।”

ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,
— “আরশীন আপা কবে ফিরবে?”
— “দেখি, আমি যাই আগে।”
পরেরদিন সকালে… ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিলাল হক। হাতব্যাগটা শক্ত করে ধরে আছেন। মুখে নিরাবেগ অভিব্যক্তি, কিন্তু চোখে স্পষ্ট চিন্তার রেখা। চিন্তার কারণ হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন। চোখটা হঠাৎই একদিকে আটকে গেল সেদিকে। স্যুট-প্যান্ট পড়া একজন লোক, বাদামী রঙের চকচকে জুতো, পরিপাটি দাঁড়ি-গোফ, চোখে সানগ্লাস। মুখটা খুব পরিচিত… একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজের ঠোঁটে নিজেরাই শব্দ খুঁজে পায়,
— “তাহমীদ… তাহমীদ খান?” নামটা যেন মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। কপালে চিন্তার ভাঁজ ঘনীভূত হলো। তাহমীদ খানকে এইখানে দেখাটা নিছক কাকতালীয়? নাকি ইঙ্গিতপূর্ণ? পকেট থেকে ফোন বের করলেন। ডায়াল করলেন আরশীনের নাম্বারে। ওকে জানাতে হবে এই ব্যাপারটা।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি💙 [পর্ব-০৫]
~আফিয়া আফরিন

(নীরব অথচ গভীর)
আদিয়াত আর আরশীনের বিয়েটা খুব হঠাৎ হয়েছে। কারও দেখা, কারও উপস্থিতি, কিছুই ছিল না। ওদের পরিবারের সাথে এখনো পর্যন্ত দেখা হয় নাই। সবাই এখনও এই বাড়ির কর্তার উপর ভরসা করে বসে আছে। জহিরুল ইসলামের সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করেই নেওয়া ছিল। বসার ঘরে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “আমি চাই, এবার আমরা সবাই একসাথে ফরিদপুরে যাই। আরশীনের পরিবারের কারো সাথে তোমাদের আলাপ হয় নাই, ওরাও সে সুযোগ পায় নাই; অথচ অধিকার দুপক্ষেরই আছে।”
তার এহেন প্রস্তাবে সকলেই রাজি হলো। আলিয়া তো সবার আগে, তারপর আযহান এবং সর্বশেষে নাজনীন। তার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল, জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না। সেই প্রশ্নের উত্তর যদি এখন নিজে থেকেই এসে ধরা দেয়, তবে ক্ষতি কী?
সবাই রাজি হলেও আদিয়াত তখনো চুপ। গম্ভীর মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সে নীরব—হ্যাঁ/না কিছুই বলল না। নাজনীন আরশীনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “যাও আরশীন, একবার ওকে গিয়ে বলো তুমি। ওর মতিগতি দেখে তো মোটেই মনে হচ্ছে না যাওয়ার ধান্দায় আছে। মুখটা কেমন কুঁচকে রেখেছে ছেলেটা।”

আরশীন নরম গলায় বলল,
— “আমি বলব? উনি যে যাবেন না তা তো বুঝেছি। জিজ্ঞেস করলে তো স্পষ্ট না বলেই দিবে।”
নাজনীন হালকা হাসলেন,
— “তুমি ওর স্ত্রী, এখন তোমার কথার আলাদা ওজন আছে। যত যাইহোক, ওটা ওর শ্বশুরবাড়ি। একবার বলো, হয়তো মত বদলাবে।”
আরশীন একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল। সত্যি বলতে, কেমন যেন একটু লাগল! কারণ এই প্রথম, সত্যিকারের ‘বউ’ হয়ে কিছু বলার দায়িত্ব তার ওপর পড়ল।
ধীরে ধীরে পা ফেলল আরশীন। চুপচাপ, নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে দাঁড়াল দরজার পাশে। আদিয়াত এখনও রেগে আছে, স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তবে সেই রাগটা ভাষায় প্রকাশ করে না, দৃষ্টিতেও প্রকাশ করে না। কীভাবে কীভাবে যেনো চেপে রেখে দেয় নিজের মত নিজের সমস্ত সত্ত্বাকে।
— “চলুন না প্লিজ।” আরশীন ওর কণ্ঠে একরাশ অনুরোধ মিশিয়ে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি, গেলে আপনার খারাপ লাগবে না বরং ভালো লাগবে।”

আদিয়াত ধীরে মুখ ঘোরাল। চোখে একরাশ সন্দেহ নিয়ে বলে,
— “আপনি কীভাবে জানেন, কী ভালো লাগবে আমার?”
— “আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি এবং আপনিও যাচ্ছেন, সেটা তো অনেক কিছু বোঝায়।”
এক মুহূর্ত থেমে সে যোগ করল, “আর আপনার এত প্রশ্ন, এত দ্বিধা, সেগুলোর উত্তর তো একদিন খুঁজতেই হবে। চলুন, সেই খোঁজ শুরু হোক ফরিদপুরে আমাদের বাসা থেকেই।”

— “আমার কাজ ছিল শুধু বিয়ে করে নিরাপত্তা দেওয়া। ব্যাস, সেটা করেছি। আপাতত আর কিছু পারছি না।” আদিয়াতের কণ্ঠ ছিল অনড়। যেন ধৈর্য আর যুক্তির দেয়ালে দাঁড়িয়ে নিজের সীমা টেনে দিল সে।

— “আপনারই তো প্রশ্ন বেশি, দ্বিধা অনেক। আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে না?” আরশীন চোখে সরল নিয়ে বলল।
— “অসম্ভব।” একটা ছোট্ট শব্দ, কিন্তু স্পষ্ট; দরজা বন্ধ করার মত।

আরশীন চুপ করে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর আবার বলল,
— “আপনার কাছে অনুরোধ করছি… এই প্রথম, এই শেষ। চলুন প্লিজ।” ভাঙা গলায় একরাশ ক্লান্তি, একরাশ প্রত্যাশা।
আরশীনের মুখে অনুরোধের সুর শুনে আদিয়াতের মন বোধহয় একটু নরম হয়ে এলো। ভেতরের কঠিন আবরণটা মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠল যেন। তবু সোজাসুজি কিছু না বলে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
— “ভেবে দেখব।”

আরশীন চোখ বড় করে তাকাল ওর দিকে, যেন ধৈর্য ধরে রেখেই প্রশ্নটা করল,
— “কখন ভাববেন? আঙ্কেল তো বলেছেন আগামীকাল সকালে রওনা দেবেন।”

আদিয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
— “আগামীকাল যাওয়ার আগে জানিয়ে দিলেই তো হচ্ছে, তাই না?”

আরশীন ঠোঁট কামড়ে বলল,
— “মানে সকাল সকাল আপনার দরজায় আবার অনুরোধের ভান্ডার নিয়ে হাজির হতে হবে?”

আদিয়াতের ঠোঁটের কোণে হালকা একটুকরো হাসি খেলে গেল। আরশীনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলল,
— “সকাল সকাল যদি দরজায় না পেয়ে ফিরে যান তাহলে কিন্তু পরের ট্রিপে একা যাবেন।”

আরশীন ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “মানে?”

আদিয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “মানে এই যে আপনার ‘ভালো লাগবে’ কথাটার উপর ভরসা করছি, তাই না ভালো লাগলে স্বভাবতই মন খারাপ হবে…”

আরশীন চোখ ঘুরিয়ে বলল,
— “উফফফ, বাঁচা গেল। আপনি যে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন এটা এত ঘুরিয়ে না বলে সোজাভাবে বললেও হতো। তাহলে সকাল সকাল আপনার দরজায় আমাকে হাজির হতে হচ্ছে না, তাইতো?” আদিয়াত হেসে ফেলল। এই হাসির ভেতরেই যে খানিকটা বরফ গলল, বোঝা গেল।
.
সকালবেলা ঘরজুড়ে একটা ছোটখাটো ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। কিন্তু সবার মাঝেই যে একরকম বিস্ময় তা হলো—আদিয়াত সত্যিই প্রস্তুত! পরিপাটি পোশাকে, নির্ধারিত সময়েই।
নাজনীন দূর থেকে ছেলেকে দেখে মৃদু হেসে ফেলেন। এই ছেলের মনস্তত্ত্ব তিনি বুঝতে শিখেছেন বহু আগেই। একঘেয়ে, গম্ভীর আর নিজের মতো থাকা স্বভাবের আদিয়াতের কাছে কোনো আবেগ বা অনুরোধ সহজে পৌঁছায় না। একমাত্র বাবা ছাড়া তেমন কারো কথা সে পাত্তা দেয় না, জানেন তিনি। তাই হুট করে হওয়া এই বিয়ে তাকে যেন মানসিকভাবে খানিক অস্বস্তিতে ফেলেছে—মা হিসেবে নাজনীন সেটা চোখে চোখেই বুঝে গিয়েছিলেন। তবে তারও একটা বিশ্বাস ছিল। সম্পর্ক যেভাবেই শুরু হোক না কেন, ঘরের বউয়ের প্রতি পুরুষের দুর্বলতা একটা সময় তৈরি হয়, যদি সেই নারী নিজেকে ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আরশীন সে চেষ্টা করেছে—সাহস আর সম্মান নিয়ে। আর তার ফলশ্রুতি আজকের সকাল। এই মেয়েটাকে তার খারাপ লাগেনি বরং এই কয়দিনে সে বুঝতে পেরেছে, আরশীন অন্যদের মতো নয়। ব্যবহারে কোনো অভদ্রতা নেই, চোখে মুখে অহংকারের ছায়া নেই, কথায় ঝাঁজ নেই আবার বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতাও নেই। আচরণে একটা অন্যরকম সরলতা আছে অথচ মনের ভিতর কী যেন চাপা কিছু লুকানো… খুব সাধারণ অথচ ঠিক সাধারণ নয়।
নাজনীন মনে মনে বললেন,
— “বউ যদি নিজের জায়গায় ঠিক থাকে, ছেলেকে বোঝাতে বেশি সময় লাগে না। এই জন্যই বলে, ঘরের বউয়ের একটা আলাদা ক্ষমতা থাকে।”

ওরা ফরিদপুর পৌঁছায় ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ। দিনের রোদ তখন তেজী, তবু হাওয়ায় ছিল একরকম আরাম। শহরে পা রাখতেই চারপাশের পরিচিত গন্ধ যেন আরশীনকে এক নিমেষে শিকড়ের কাছে টেনে নিল। ছোটবেলার হাজারো স্মৃতি যেন বাতাসে দুলছিল।
বিলাল হকের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন। কারণটা স্পষ্ট—আরশীনের আসার খবর। সেই খবর পেয়ে সকাল থেকে ছটফট করছিলেন, বারবার ঘড়ি দেখছিলেন, এমনকি একটু আগে তো নিজেই মেইন রোড পর্যন্ত গিয়েছিলেন জামাই আর নতুন আত্মীয়দের রিসিভ করতে। বাড়িতে ফিরতেই শুরু হলো গৃহস্থালি ব্যস্ততা আর নতুন অতিথিদের অভ্যর্থনা। একে একে সবাই নিজেদের পরিচয় দিল, হাসিমুখে কথা বলল। চাচা-চাচি, ফুফু-খালা, এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীও যেন মুখিয়ে ছিল জামাইবাবুর দেখা পেতে।
আদিয়াতকে দেখে সবার চোখে ছিল একধরনের মুগ্ধতা। এমন ঘটনার সাথে আদিয়াত নতুন তাই সে একটু অপ্রস্তুতবোধ করল। আসার পথে গ্রামের এক-দুই জায়গায় তো জানালা দিয়ে মুখ বের করে উঁকি মেরেছে কৌতূহলী কিশোরীরা। কেউ কেউ আবার চাপা গলায় বলছিল,
— “এই যে, ওই যে আরশী আপুর জামাই আসছে।”
আরশীন মুখ নামিয়ে রাখলেও হাসিটা যেন ঠোঁটের কোণায় খেলে যাচ্ছিল। জামাই অবশ্য বেশ ভালো নাকানিচুবানি খেল। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে ও যেন একপ্রকার অঘোষিত জেরায় পড়ে গেল। প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল এক গ্লাস পানি খেতে খেতে; এক খালাম্মা রীতিমতো ঝুঁকে বললেন,
— “এই যে বাবা, জামাই নাকি? মুখখান তো নায়ক মার্কা!” দ্বিতীয় ঢেউটা এলো আরো কিছুক্ষণ পরে। পাশের বাড়ির এক চাচা মুখে পান গুঁজে জিজ্ঞেস করলেন,
— “আরশীনের সাথে প্রেম ছিল না তো? নাকি হুট করেই ধরা খাইলা?” আদিয়াত কোনোরকম ঠোঁট টিপে হাসা থেকে নিজেকে সামলালো। এর মাঝেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরল,
— “দুলাভাই, আপুরে কত ভালোবাসেন?”
— “আপুর কিন্তু অনেক রাগ, একদম মিসাইলের মত। আপু যখন রাগ করে তখন কী করো?”
আদিয়াত মাথা নিচু করে একটা রুমাল বের করল, যেন ঘাম মুছে। বাস্তবে অবশ্য সেটা ছিল তার নিঃশব্দ আত্মরক্ষা ঢাল। সকলের কথাবার্তায় আদিয়াতের মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছিল, যাকে বলা যায় সৌজন্য রক্ষার হাসি—না পারা যায় রাগ করতে, না পারা যায় উত্তর দিতে। আরশীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। সে হাসি সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। জানালার এককোণে দাঁড়িয়ে থেকেও আদিয়াতের চোখে ধরা পড়ে গেল। আদিয়াত ওকে কথায় নয় বরং ইশারায় ডাকল। আরশীন আসতেই তৎক্ষণাৎ আশপাশ থেকে সবাই সরে গেল। আদিয়াত বলল,
— “জামাই হওয়া তো মুসিবতের ব্যাপার। কিছু বলতেও পারিনা আবার সইতেও পারিনা। মনে হচ্ছে একটা সেলে বন্দী আছি।”
— “আপনি তো এখনও শুধু মেইন গেইট পার হইছেন, ভিতরের ইন্টারোগেশন রুম তো বাকি। আপনার জন্য এক ফুপু এসে বসে আছেন—বিয়ের প্ল্যান থেকে শুরু করে… থাক আর না বলি।”

তারপর একটু নিচু গলায় কানে কানে যোগ করল,
— “আর হ্যাঁ, পাশের বাড়ির আন্টিরা বলতেছে আপনি নাকি নায়কের মতো দেখতে। এখন থেকে সাবধানে চলাফেরা করবেন, জামাইবাবু!”

আদিয়াত চোখ গরম করে বলল,
— “আপনিও শুরু করেছেন, আশ্চর্য।”
আরশীন হেসে আবার বলে,
— “আমি তো একদম ফ্রন্টলাইন রিপোর্টার। লাইভ কভারেজ করছি আপনার দুর্দশার। এই যে সবাই ভালো ছেলে টেস্ট নিচ্ছে, আমি কিন্তু পাশ করানোর জন্য সাইলেন্ট সাপোর্ট দিচ্ছি… বুঝলেন?”
— “আপনি তো পুরো শত্রু পক্ষে চলে গেলে। আমার লাইনে থেকে আমারই খবর ছড়াচ্ছেন আবার সাপোর্ট দেওয়ার কথাও বলছেন?”

আরশীন কাঁধ উঁচু করে নাটুকে ভঙ্গিতে বলে,
— “বলা উচিত না তাই না? স্বজনপোষণ নিষিদ্ধ! এখনকার জামাইরা নিজের দায়িত্ব নিজেই বহন করে।”
আদিয়াত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
— “এখানে আর কতক্ষণ থাকতে হবে আমাকে?”

আরশীন ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— “শ্বশুর বাড়ি যে মধুর হাড়ি এই অনুভূতি না পেয়েই পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন? কী মনে করেছেন? এত সহজে ছাড়া পাবেন। উঁহু। এসেছেন নিজের ইচ্ছায় আর যাবেন, আমার ইচ্ছায়।” আরশীন হাসতে হাসতে সবার ভিড়ের দিকেই এগিয়ে গেল। মুখে এখনো চাপা হাসি খেলা করছে। আদিয়াতের চোখে সেই মুহূর্তে স্পষ্ট ধরা পড়ল—এই মেয়েটা যেন অন্য কেউ। ঢাকায় ওর যে গাম্ভীর্য, আত্মরক্ষার প্রাচীর; সেই ছবির চেয়ে এখনকার আরশীন অনেক বেশি খোলামেলা, প্রাণবন্ত। যেন নিজের মতো করে বাঁচছে। ঢাকার ভদ্রস্থ, মুখ গোমরা আরশীন আর এই আরশীনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
.
সন্ধ্যার মৃদু আলোতে গোটা পাড়ায় একটা নরম আলো ছড়িয়ে আছে। আত্মীয়-স্বজনের ভিড় কিছুটা কমতেই আরশীন বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর মুখে স্পষ্ট উত্তেজনা। চাচা বিলাল হক দাড়িপাল্লার মতো চেহারা করে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কোথায় যাস রে এই সন্ধ্যাবেলা?”

আরশীন হালকা হাসল।
— “মোড়ের মাথায় একটু কাজ আছে, চাচা।”

চাচা চোখ সরু করলেন,
— “কোনো বিশেষ কাজ?”

আরশীন ঘাড় নাড়ল।
— “আপনি সাথে চলেন। আপনি নিজেই বুঝবেন এই কাজ কতটা বিশেষ।”
চাচা একটু দ্বিধায় থাকলেও ওর পেছনে হাঁটা ধরলেন। কিছদূর যেতেই আরশীন থেমে গেল। মোড়ের মাথায় একটা চা-স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “দেখছেন কারবার? আলিয়া আপু স্বামীর জন্য বসে অপেক্ষা করছে আর সে? ভণ্ড ব্যাটাচ্ছেলে কোথাকার!”
চাচা অবাক হয়ে তাকালেন, তারপর ধীর গলায় বললেন,
— “এ তাহলে আলিয়ার জামাই?”
আরশীন ঠোঁট কামড়ে রাগ চেপে বলল,
— “হ্যাঁ চাচা। তাহমীদ খান। মাস দুয়েক আগে কিছু কাজের কথা বলে গিয়েছিল। পরিবার জানে সে বিদেশে। কেউ জানে না সে বাংলাদেশেই ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু এখানে কি কাজ?”

চাচার গলা ভারি হলো,
— “এই ছেলে তো সুবিধার নয়। বছর দশেক আগে থেকে ওকে চিনি আমি। তবে যতটুকু চিনি তা সবটাই অপরাধের সাথে জড়িত। আলিয়ার মতো মেয়েটার সাথে এমন করছে? তুই কী করবি এখন?”

আরশীন চোখ সরু করে তাকিয়ে রইল তাহমীদের দিকে।
— “মুখোমুখি বসে কথা বলতে চাই। তারপর যা হবার হবে। চাচা, আপনি জানেন? আট বছর আগে একটা ছেলে খুন হয়েছিল। বিকেল বেলা, কলেজ থেকে ফেরার পথে। রাজনীতির শিকার হয়েছিল সে। কোনো দল-ধর্ম জানত না, শুধু প্রতিবাদ করেছিল কিছু অন্যায়ের।”

চাচা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন,
— “জানি। সেই খুন এখনো বিচার পায়নি।”

আরশীন মাথা নিচু করল। গলার স্বর ভারি হলো,
— “হ্যাঁ, কারণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দলীয় প্রভাব ছিল। সাক্ষী হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তখনো জানতাম না, আজ যার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সে সেই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন ছিল। তাহমীদ খান। এদের তো বড় বড় ব্যাপার। বিশাল অন্যায় করেও টাকা আর ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যায়। বাবা এই বিষয়টাই দেখছিল কারণ ওই ছেলেটার বাবা-মা আজও ন্যায় চেয়েছিল। কিছু ক্লু, কিছু তথ্য জোগাড় করেছিল কিন্তু তার আগেই….।” আরশীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

চাচা বললেন,
— “তোর বাবা বোধহয় জানত তার সকল অপূর্ণ কাজ তুই করবি। ছোটবেলায় যা দুষ্টামি করে করেছিস বড় হয়ে সেটাই দায়িত্ব হয়ে গেছে। ভাইজানের শত্রুও কম ছিল না। তোকে সাবধান থাকতে হবে।”

— “খুব তাড়াতাড়ি আমি দেখব বিষয়টা। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই লোকটাকে ফেলে রাখা যাবে না। আমি আপুর সাথে ওর বিয়েটাকেও এখন অন্য চোখে দেখছি চাচা। সবকিছু আড়াল করে অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য বিয়েটা হয়তো একটা মাধ্যম ছিল।”

চাচা তখন ধীর গলায় বললেন,
— “তোর কাজটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, সাবধান থাকিস মা। তুই কিন্তু এখন একজনের বউও।”
আরশীন একটু হেসে বলল,
— “আমি আগে কারো মেয়ে, তারপর বউ।”
চাচা চুপ করে রইলেন। চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছায়া কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষ, তাই মুখ ফুটে কিছু বললেন না। আরশীন তখনি মোবাইল বের করল। একটা নম্বরে ডায়াল করল। খুব নিচু গলায়, যেন হাওয়ায় মিশে যায় এমন স্বরে বলল,
— “ওর নাম তাহমীদ খান। যতদিন ফরিদপুরে আছে, ততদিন ওকে চোখের আড়াল হতে দিও না। প্রতিটি রিপোর্ট চাই আমি। আমি দেখতে চাই এই একটা লোক কতদিন নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারে।” ফোনের ওদিক থেকে সম্মতির শব্দ ভেসে এল।

সন্ধ্যার আলোয় বাড়ির উঠোনটা যেন ঘরে ফিরে পাওয়ার উষ্ণতা নিয়ে জ্বলে উঠল। বাড়ির বয়স্ক নারীরা চায়ের কাপ হাতে টিপটিপ গল্পে মগ্ন, চোখেমুখে প্রশান্তির রেখা। বারান্দার কোণে বসে আযহান, আদিয়াতকে নিয়ে জহিরুল ইসলাম পুরোনো দিনের গল্প করছেন হয়ত। এই পরিবারের সাথে যে তারও একটা সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে, তাই বোধহয় বলছেন! এই মানুষটা ওদের পরিবারের এক অভিভাবক; যার চোখে-মুখে মমতা, গলায় উষ্ণতা। আরশীন যেন দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিল।
আরশীনের মা শায়লা; আলিয়া আর নাজনীন এত তাড়াতাড়ি মিশে গেছে যেন তাদের একসাথে থাকতে পারা একটা উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ছোটোবোনটা শুধু অনুপস্থিত, মামাবাড়ি রয়েছে। কথা হয়েছে, কাল সকাল সকাল চলে আসবে। ওইদিকে আদিয়াতের সাথে দুষ্টুমি করার মানুষের অভাব নেই। কথায় কথায় হুল্লোড় চলছে। আদিয়াত কেবল মাথা নিচু করে চুপ করে থাকল তবে চোখে-মুখে লাজুক হাসির রেখা দেখা দিল।
আরশীন তখন পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। মুখে ওর সেই চেনা খুনসুটে হাসি, চোখে কিছু একটা গোপন রাখার চেষ্টা। আদিয়াত চোখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই আরশীন হাসল। কিছু না বললেও স্পষ্ট বোঝা যায়, এই দু’জনের মাঝে সময়ের অনভ্যস্ততাটা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আদিয়াত একটু আনমনা চোখে চারপাশে তাকিয়ে শেষমেশ আরশীনের দিকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,
— “কোথায় ছিলেন?”

আরশীন দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে হাসল, ঠোঁটের কোণে চিরচেনা দুষ্টুমি।
— “কেনো? মিস করছিলেন নাকি?”

আদিয়াত গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “না, খুঁজছিলাম।”

আরশীন ভ্রু কুঁচকে মুচকি হেসে বলল,
— “ওই একই হলো। খোঁজা মানেই মিস করা।”
— “আপনি নিজের মতো করে সব ব্যাখ্যা করে নিচ্ছেন?”
— “হ্যাঁ, কারণ তাতে জবাব দেওয়াটা সহজ হয়ে যায়।”

আদিয়াত তখন ধীরে বলে,
— “ঠিক আছে। তবে এতক্ষণ বাইরে ছিলেন কেন?”
— “একটু বাতাস নিতে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে ছুঁয়ে দেখার দরকার পড়ে।”
— “ওহ আচ্ছা, নিজেকে হারিয়ে ফেলার আগেই ফিরে এসেছেন; সেটাই ভালো হয়েছে।”

আরশীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ, কারণ মনে হলো কেউ হয়ত এই অচেনা জায়গায় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।”

আরশীনের কথা শুনে আদিয়াত ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আচ্ছা, প্রেমিক আছে নাকি?”

আরশীন আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— “আছে তো! একটু খুঁজে দেখুন, পেয়ে যাবেন।”

আদিয়াত বুকে আড়াআড়িভাবে হাত বেঁধে বলল,
— “গোয়েন্দাগিরি করার জন্য তো আর আসিনি।”
— “তাহলে দায়িত্ববোধ থেকেই করুন।”
— “দায়িত্ববোধ? সেটা কীভাবে?”

আরশীন অবাক ভঙ্গিতে বলল,
— “ওমা! নিজের বউয়ের প্রেমিক খুঁজে বের করা কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?”

আদিয়াত ঠোঁট চাপা হাসিতে বলল,
— “বেশ, তাহলে ধরেই নিচ্ছি আপনি আমাকে জেলাস করাতে চাইছেন।”
— “একেবারেই না। আপনি যদি হন, সেটা তো বোনাস!”

আদিয়াত হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলল,
— “এইভাবে কথা বলে কনফিউশন ছড়ানোটা আপনি বেশ ভালো পারেন।”
— “ধন্যবাদ। বউ হিসেবে কিছু গুণ থাকা তো দরকার, তাই না?”
— “বউয়ের গুণ যদি এমন হয় তবে আর বিপরীতে যে থাকবে তার বুদ্ধি রাখতে হবে তিনগুণ!”

আরশীন হেসে বলল,
— “তাহলে তো আপনি ঠিক লোকই পেয়েছেন।” আরশীনের কথায় আদিয়াত জোরেই হেসে উঠল। মুহূর্তটা যেন একটু বেশিই প্রাণবন্ত হয়ে গেল। আরশীন প্রথমবারের মতো থমকে তাকাল ওর দিকে। তার হাসিটা—সত্যিই সুন্দর। চাপা দাঁড়ির আড়ালে ঠোঁটের কোণে হালকা টোল। নিঃসন্দেহে, সে হাসি ভীষণ সুন্দর।
.
.
.
চলবে….

#তবুও_তুমি💙 [পর্ব-০৬]
~আফিয়া আফরিন

(আড়ালে অঝোরে)
সে রাতে একটু বৃষ্টির আভাষ দেখা গেল। মেঘে ঢাকা আকাশ। ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে পড়ছিল ঘরের কোনাকাঞ্চি দিয়ে। হঠাৎ একটা পর্দা হেলে পড়ল, আরশীন জানালার দিকে তাকাল। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল। সবাইকে জানালা দরজা লাগিয়ে দিতে বলল। আলিয়া আপু শুতে যাওয়ার আগে যেন জানালাটা বন্ধ করে দেয়, এই ভেবেই ওই ঘরের দরজার দিকে এগোলো। দরজার সামনে দাঁড়াতেই সে থমকে গেল। শুনশান রাতে ঘর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসছে যদিও আলগোছে আর রয়েছে আলিয়ার চাপা হাসি। অনিচ্ছাকৃতভাবে আস্তে করে দরজার ফাঁক দিয়ে কান পাতল,
— “কতদিন হলো? আসলেই কাজে গেছো না আরেকটা বিয়ে করে বসে আছে সেটা আমি কিভাবে বুঝব? যাইহোক, ওখানেই থেকে যাও এখানে আসতে হবে না। কেউ তোমার অপেক্ষায় নেই।”
আরশীন ঠিক বুঝে ফেলল। তাহমীদ… ভন্ড কোথাকার। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার ঠোঁটের কোণে। তারপর কাঁধ সোজা করে দরজায় হালকা করে টোকা দিল। ভেতর থেকে হঠাৎ নীরবতা। আলিয়ার গলা শোনা গেল, কিছুটা বিব্রত আর কৃত্রিম শান্ত।
— “কে?”
— “আমি, আরশীন।”
— “আসো।”
দরজাটা খুলে গেল। আলিয়ার মুখে অস্বস্তির ছাপ, কিন্তু তবু চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকার। আরশীন হালকা হেসে বলল,
— “জানালাটা খোলা আপু। রাতে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে পানির ছিটেফোঁটা আসতে পারে। ভাবলাম জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে যাই।”
আলিয়া হেসে বলল,
— “আচ্ছা।” আরশীন মাথা নেড়ে জানালাটা বন্ধ করে বেরিয়ে এলো। ঘরে এসে একটু গুছিয়ে নিয়ে বসতেই চোখে পড়ল, আদিয়াত কোথাও নেই। এখানেই তো ছিল, গেল কোথায়? ভুরু কুঁচকাল সে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে, ঘরের দরজাটা আধখোলা রেখে বারান্দা, বসার ঘর—সবদিকে একবার উঁকি মেরে ঘরে এলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে দরজায় টুক করে শব্দ। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে আদিয়াত। আরশীন জিজ্ঞেস করল,
— “কোথায় গিয়েছিলেন?”
— “আপনার প্রেমিককে খুঁজতে।”

আরশীনের ভুরু উঁচু হলো। চোখে একধরনের নাটুকে বিস্ময়।
— “তাই নাকি? কেউ মিললো?”
— “হুঁ…..”
তখনই ঝাপিয়ে বৃষ্টি নামল। আরশীন চমকে উঠল। দৌড়ে গিয়ে জানালার পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে, দেরি হয়ে গেছে। পানির ছাঁট এসে মুখ, গাল, চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। জানালাটা বন্ধ করল ঠিকই, কিন্তু বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির গন্ধ, ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া—সব মিলিয়ে যেন একরকম ভালো লাগা জমে রইল ওর চোখে মুখে। আদিয়াত একটা তোয়ালে হাতে এগিয়ে এলো, গলায় এক ধরনের মৃদু উদ্বেগ।
— “এই সময়ের বৃষ্টির পানি ভালো না। একটুতেই ঠান্ডা লেগে যাবে। মুখ মুছে নিন।”
আরশীন তোয়ালেটা হাতে নিল ধীরে। চোখে মুখে ছাঁট লাগা জল মুছতে মুছতে হালকা হেসে বলল,
— “এই সামান্যতেই? জানেন, আমি কী ভাবছি? ভাবছিলাম, একটু যদি ভিজতে পারতাম… বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতে পারতাম।”

আদিয়াত ভ্রু কুঁচকাল,
— “ঠান্ডা লাগলে তখন কী করবেন?”
আরশীন উত্তর দিল না। চোখে-মুখে একটু বেঁকে যাওয়া হাসি নিয়ে সে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। পর্দা সরিয়ে সামান্য জানালার পাল্লা খুলে বাইরে উঁকি দিল।
বৃষ্টির শব্দ যেন আরও কাছাকাছি এসে আঙিনার ছাদ ছুঁয়ে গলগল করে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতর। একটু পর সে ঘুরে দাঁড়াল, আদিয়াতের চোখে চোখ রেখে বলল,
— “একটা জায়গায় যাবেন?”
— “কোথায়?”

আরশীন হালকা গলায় বলল,
— “আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা, চিলেকোঠার ঘরে। অনেক দিনের সঙ্গী ওটা আমার। বৃষ্টির শব্দ সেখানে যেন আরও কাছ থেকে শোনা যায়। যাবেন?”
— “আপনি আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কেন হঠাৎ?”
এই প্রশ্নে আরশীন থমকে গেল। কথাটার ওজন বুঝতে পারল না। হঠাৎ করেই বলেছে। সেভাবে ভাবনা-চিন্তা থেকে কিছু বলে নাই। সে একটুখানি হাসল। কণ্ঠে হালকা কৌতুকের ছোঁয়া রেখে বলল,
— “গেলে যাবেন না গেলে থাকুন। আমি তো যাবই।” বলেই পেছন ঘুরল। আরশীন ধীর পায়ে এগোচ্ছিল। পেছন থেকে পায়ের শব্দ পেয়ে বুঝল, আদিয়াতও পিছু নিয়েছে। সে ঘুরে না তাকিয়েই হালকা গলায় বলল,
— “এখন আসছেন কেন আমার সাথে?”

আদিয়াত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— “ভাবলাম দাওয়াত কবুল করে নেই।”
চিলেকোঠার ছোট্ট জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় আরশীন। পেছন থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আদিয়াতও। ঘরটা নরম আলোয় ভাসছে—ছাদের ফাঁক দিয়ে হালকা বাতাস ঢুকছে, সঙ্গে মেঘভেজা গন্ধ। বাইরে বৃষ্টি নামছে টুপটাপ শব্দে, যেন ছাদে কেউ গল্প বলে যাচ্ছে ছন্দে ছন্দে। আরশীন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দূরের আকাশের দিকে—মেঘের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কিছু না বলা কথা যেন চোখে ভাসে। আদিয়াত পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার নিঃশব্দ অনুভবকে ভাগ করে নেয়। কোনো কথা নেই, শুধু বৃষ্টির ছন্দে মিশে থাকা দুটি নিঃশ্বাস—একটা শান্ত, আরেকটা অপেক্ষায়।
চিলেকোঠার জানালার কোণে মাথা ঠেকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায় আরশীন। তার চোখে হালকা ঝাপসা ভাব, কেবল স্মৃতি নয়, কিছু অনুভবও যেন ঘোর লেগে আসে। নরম গলায় বলল,
— “জানেন, এই ঘরটার সাথে আমার ছোটোবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”

আদিয়াত পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে, জানালার গরাদ ছুঁয়ে দেখে। চোখে থাকে কৌতূহল আর একটু মৃদু হাসি।
— “বড়বেলার নেই?”

আরশীন হেসে ফেলে হালকা, যেন নিজেকেই দোষ দেয় নিজের দূরত্বের জন্য।
— “খুব কম। মাধ্যমিকের পর তো ঢাকা চলে গেছিলাম। পড়াশোনার পার্টটুকু ওখানেই শেষ করেছি। এখানে আসা হতো খুব কম। ছুটির সময় কিংবা এমন সময় যখন বৃষ্টি উপভোগ করার সুযোগ থাকত না।”

আদিয়াত একটু মাথা নাড়ে। তার কণ্ঠেও মিশে যায় বাতাসের সুর,
— “আচ্ছা, তাই?”
একটা ছোট্ট চুপ এসে পড়ে তাদের মধ্যে। কিন্তু সেটা ভারী নয়, বরং নরম—যেন বৃষ্টির ভেতরেও কিছু কথা না বলেই বলা হয়ে যায়। আরশীন জানে, এই ঘর শুধু ইট-পাথরের না বরং এটা একটা সময়, এক টুকরো ফেলে আসা দিন, যা আজ জেগে উঠেছে—বৃষ্টির দিনে, আবারও। সে হালকা স্বরে বলল,
— “একসময় বিকেলে এখানে বসে গল্পের বই পড়তাম। নিচের উঠোনে খেলার শব্দ ভেসে আসত। আর আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবতাম, বড় হয়ে কী হবো।”

আদিয়াত একটু হেসে বলল,
— “তাহলে সেই আরশীন বড় হয়ে কি হলো?”

— “কী জানি! নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না ঠিকমত। যত দিন যাচ্ছে ততই আরো এলোমেলো হয়ে উঠছি।”

আদিয়াত এবার একটু নিচু গলায় বলল,
— “বাচ্চা একটা মানুষ আপনি। এত দুঃখ কীসের আপনার? একটাই জীবন, হেসেখেলে পার করবেন; তা না করে কী করছেন?”
চিলেকোঠার ঘরটা তখন একটু ঝিম ধরা বিকেলের মতো—বাইরে বৃষ্টি ক্ষণিক থেমে গিয়েছে, কেবল ছাদের ওপরে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ছে একটানা ছন্দে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মানুষ; আরশীন আর আদিয়াত, যেন ওই ছন্দের মধ্যেই ডুবে গেছে।
আদিয়াত হঠাৎ নিঃশব্দতা ভেঙে, একটু নিচু গলায়, কিন্তু সরাসরি চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল,
— “এই ছোট্ট জীবনে আপনার এত দুঃখ কিসের?”

প্রশ্নটা হালকা ছিল না, অথচ আরশীনের মুখে কোনো চমক নেই। যেন এই প্রশ্ন সে বহুবার নিজেকে করেছে। একটু হাসল, খুবই নরম আর যেন ক্লান্ত সেই হাসি।
— “দুঃখের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। আমাকে খুব ভালোবাসে।”
— “আপনি বরণ করে নিয়েছেন বলেই তো। ছেড়ে দিন।”
আরশীন জানালার গরাদ ছুঁয়ে বলল,
— “ছাড়তে পারছি না তো।”

আদিয়াত একটু এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ায়। মুখটা শান্ত কিন্তু চোখে একরাশ কৌতূহল।
— “বলুন… শুনি, কীসের এত দুঃখ আপনার?”

আরশীন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে যেন সময়ের কোনো দৃশ্য ভেসে উঠছে।
— “বলব।”
— “বলুন।”
— “এখন না, পরে। সময় আসুক।”

আদিয়াত কিছুটা থেমে, আবারও প্রশ্ন করে,
— “সময়ের অপেক্ষা নাকি বিশ্বাসের?”

প্রশ্নটা এবার আরশীনের গায়ে যেন ধীরে ধীরে এসে পড়ে। সে একটু নড়ে, চোখে একধরনের চাপা শীতলতা। উল্টো প্রশ্ন করে,
— “আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?”
— “জি না, শুধুমাত্র প্রশ্ন করেছি; উদ্দেশ্যে জানতে চাওয়া।”
তার স্বর শান্ত। মুহূর্তটা খুব নরম হলেও, তার গভীরতা কাঁপিয়ে দেয় বাতাসকেও। চিলেকোঠার ছাদ যেন আরও নীচু হয়ে আসে—এই দুজন মানুষের নিঃশব্দ টানাপোড়েনে। বাইরে তখন আবার বৃষ্টি নামছে। ভেতরে, সময় থেমে আছে কিছু না বলা কথা আর অতল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভেতর। আরশীন হেসে ফেলে। মাথা নিচু করে বলে,
— “আমি আসলে নিজেকে বুঝতে চাচ্ছি। যদি বুঝতে সক্ষম হই তবে সব বলব। কথা দিচ্ছি… আরশীন কিন্তু কথার বরখেলাপ করে না। বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
আলিয়ার হালকা চালে মাথা নাড়ল। মুখে কিছু না বললেও বোঝা গেল, সে বিশ্বাস রাখবে।
.
ঢাকার অভিজাত এলাকায় সৈয়দ গ্রুপের বিশাল বহুতল ভবনের পঞ্চম তলায় আমিনুল ইসলামের অফিস। পুরো ঘরটায় এক ধরণের রাজকীয় স্থিরতা। দেয়ালে পুরনো দিনের কিছু সাদা-কালো ছবি—বাবার, দাদার; যাদের হাতে এই ব্যবসার বীজ রোপণ হয়েছিল। চেয়ারের পেছনে বিশাল একটা বুকশেলফ; সেখানে কর্পোরেট আইন, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ইতিহাস, রত্নভাণ্ডারের মত ভারি ভারি বই। আজ সকালে আমিনুল ইসলাম একটু বেশিই চিন্তিত। তার সেক্রেটারি নাসির টেবিলে কফির কাপ রেখে বলল,
— “স্যার, সিঙ্গাপুর থেকে কনফার্মেশন এসেছে। কিন্তু যেভাবে সরকার নতুন ট্যাক্স রুল আনছে, সেটা আমাদের বাণিজ্যের ওপর চাপ ফেলতে পারে।”

আমিনুল কৌতুকপূর্ণ হেসে উঠলেন,
— “সিস্টেম বদলাচ্ছে নাসির।”

তিনি কোন সিস্টেমের কথা বললেন নাসির বুঝল না। উল্টো বলল,
— “স্যার, আমাদের ফাইল গুলো তো সব ঠিকঠাক। আদিয়াত স্যারের দায়িত্বে ছিল ওসব।”
— “হুম। কিন্তু রাজনীতি যেখানে প্রবেশ করে, সেখানে ফাইলের সচ্ছতা দিয়ে সবকিছু মেপে দেখা যায় না।”
এই সময় ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম ফুটে উঠল, রেজা ভাই। এটা তেমন সাধারণ ফোন না। রেজা ভাই নামের এই ব্যক্তিটি বর্তমান শাসক দলের বড় এক ডন টাইপের লোক। তাদের সাথে সৈয়দ গ্রুপের সরাসরি কোনো চুক্তি নেই কিন্তু আমিনুল গোপনে তার সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে রেখেছে। ফোন তুলেই শুনলেন,
— “আমিন ভাই, একটা সাহায্যের দরকার ছিল। আপনার এলাকায় একটু জায়গা লাগবে আমাদের, ছোট একটা প্রজেক্ট উঠবে।”

আমিনুল শান্ত গলায় উত্তর দিলেন,
— “ভাই শোনেন…. আমি অনেকগুলো পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। কিন্তু জহির ভাই আদিয়াতের বিয়েটা দিয়ে আমার সাড়ে সর্বনাশ করল। না হয় আমার মেয়েকে ওখানে বিয়ে দিলে ছোট একটা প্রজেক্ট না, বিশাল কিছু হতে পারতো। আমি চেষ্টা করছি তবে নিয়মের বাইরে যাব না রেজা ভাই, সেটাও জানেন।”

রেজা ভাই হেসে বলল,
— “আরে ভাই, গতবার আমি আপনার বিষয়টা দেখেছিলাম এবার আপনি আমারটা দেখবেন। আর আপনি পারবেন বলেই তো আপনাকে ফোন করলাম।”
ফোন রেখে আমিনুল চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন জানালার পাশে। সামনের রাস্তার গাড়ি-মানুষের ভিড় দেখলেন কিছুক্ষণ। শরীরের প্রতিটি মাংসপেশী যেনো টানটান উত্তেজনায় কাঁপছে।
আরশীন—মনে মনে নামটা বারবার উচ্চারণ করলেন। যেন একটা কাঁটা গলায় বিঁধে আছে। এই মেয়েটা তার সমস্ত হিসাব-নিকাশ এলোমেলো করে দিয়েছে। এই জায়গায় তো তার মেয়ের থাকার কথা ছিল। বহুদিন ধরে সাজানো সেই পরিকল্পনাটাই ভেস্তে গেল। কে জানে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই মেয়ে। তার রক্তে কোনো ধন-সম্পদের শিরোনাম নেই, কোনো রাজনৈতিক সুবিধারও নয়। শুধু একটা বিছিন্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। অথচ এখন সে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ পরিবারের নামের সামনে, সৈয়দ ইলহাম আদিয়াতের স্ত্রী পরিচয়ে!
আমিনুল ইসলামের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল আগের সেইসব লোকদের মুখ—যারা কখনও তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেউ টিকতে পারেনি। নিজের ঠোঁট চেপে ধরে ভাবলেন,
— “এ আবার এমন কী? ডাল-ভাতের মতো একটা সাধারণ মেয়ে। সরিয়ে দিতে বেশি কষ্ট হবে না। পথের কাঁটা আমি কখনও সহ্য করিনি, এবারও করব না।”
ঘরটায় তখন শুধু টিকটিক করে চলতে থাকা ঘড়ির শব্দ আর আমিনুল ইসলামের হিমশীতল চিন্তার গর্জন।
.
তাহমীদ গতকাল রাতেই আলিয়ার সাথে কথা বলেছিল। আলিয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানিয়ে দেয়, তারা সবাই এখন ফরিদপুরে রয়েছে। কথাটা শুনে তাহমীদের যেন মাটির নিচ থেকে পা সরে গেল। বুকের ভেতর ধক করে উঠে গেল। মুহূর্তেই মাথার ভিতর একের পর এক চিন্তার ঢেউ উঠতে লাগল। এই মুহূর্তে তাকে এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে। যত বড় বিপদই হোক, তার তো পরিকল্পনার অভাব নেই। কিন্তু এখন বাঁচার তাগিদটাই বড়। কিন্তু যখন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যাওয়া সম্ভব হলো না।
এদিকে সকালবেলা আরশীন নিজের ফোনে সজীবের কাছ থেকে খবর পেল।
আরশীন ফোন রেখে মুচকি হেসে নিজের মনেই বলল,
— “বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার দেখো খায় কে!”

তারপর আদিয়াতের কাছে গিয়ে বলল,
— “চলুন, বের হই।”
— “কোথায়?”
— “এইতো সামনে, আপনাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।” আড়ালে আজকের উদ্দেশ্যটা বেশ ঘন জট পাকানো ছিল। প্রথম উদ্দেশ্য সাধারণ শুধুমাত্র ঘোরাঘুরি, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অবশ্যই একটু প্যাচালো—তাহমীদকে সাবধান করে দিতে চায় সে।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগিয়ে এলো। স্টেশন মানেই তো এই শহরের প্রাণকেন্দ্র। সব রকম মানুষজনের আনাগোনা। ট্রেন আসা-যাওয়ার শব্দ, হকারদের ডাকে গমগম করছে চারদিক। গরম রোদে পিচ ঢালা রাস্তাটা চকচক করছে, কিন্তু মানুষের কোলাহলে সেটা চাপা পড়ে গেছে। কারও ট্রেন ধরার তাড়া, কারও অপেক্ষা, কারও বিদায়। এই ভিড়ের মাঝেই সামনে কোথাও যে লোকটা থাকতে পারে, সেটা আরশীন জানে। আরশীন থামল। চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে চারপাশে বোলাতে লাগল।
— “এই জায়গাগুলো কিন্তু দেখার মতো, না?” মৃদু কণ্ঠে বলল সে।
— “আপনি এখানে ঠিক কাকে দেখতে আসছেন সেটা আগে বলেন তো?” আদিয়াতের চোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ খেলা করছে। আরশীন শান্ত মুখে তাকাল, যেন কিছুই জানে না। কিন্তু চোখের কোণ বরাবর একবার চারপাশ দেখছিল। ঠিক তখনই দেখল সামনের ফুটপাত ধরে, অল্প দূরত্বে একপাশে সিগারেটের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে তাহমীদ। রোদচশমা পরে মাথা নিচু করে কারও সাথে ফোনে কথা বলছিল। আরশীনও খুব হিসেব করে আজ আদিয়াতকে সাথে এনেছে। এই মুহূর্তে তাহমীদের দৃষ্টি টানার জন্য আদিয়াত একটা ভালো টার্গেট।
আদিয়াত খানিক সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। সে এখনও জানে না ঠিক কী হচ্ছে। চারদিক দেখছিল মনোযোগ দিয়ে। ওভাবে দু’একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই তাহমীদের দিকেও তার চোখ যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। আরশীন তার স্বভাবসিদ্ধ স্বরে বলল,
— “সামনে সাবধানে হাঁটবেন, উঁচু-নিচু রয়েছে।”
— “কিছু হলে তার দায় আপনার। আপনি তো গাইড হয়ে এসেছেন।”
আরশীনও হাসল। নিজের অতিরিক্ত মনোযোগের জন্যই হয়তো সামনের অগোছালো মাটির খাদটা তার চোখ এড়িয়ে গেল। হঠাৎই ধপাস! একটা অপ্রস্তুত ধ্বনি তুলে মাটিতে পড়ে গেল আরশীন। দুই হাত সামনে দিয়ে ধাক্কা সামলাতে চেষ্টা করল ঠিকই, কিন্তু ধুলো-মাটি ছিটকে মুখে এসে পড়ল। আদিয়াত চমকে পেছন ফিরে তাকাল,
— “আরশীন!”
দৌড়ে এগিয়ে এসে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। আরশীন খানিক বিব্রত হয়ে মুখ তুলল, আশেপাশে তাকাল। চোখে মুখে মাটির ছাপ। চুলও এলোমেলো হয়ে গেছে। তবে ঠোঁটের কোণে একধরণের লাজুক হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “আমি আপনাকে সাবধান করছিলাম, আর নিজেই পড়ে গেলাম। দুর্ভাগ্য বলে একটা কথা আছে জানেন তো?”
— “উঠুন দেখি। সাবধানে চলাফেরা করতে পারেন না? আমাকে আসছিলেন সাবধান করতে।”

আরশীন একটু হেসে তার হাত ধরল। উঠে দাঁড়ানোর সময় বলল,
— “এটাই তো আমার বিশেষত্ব। অন্যদের সাবধান করে নিজেই ভুল করে বসি।”

আদিয়াত মৃদু ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “এ রকম বিশেষত্বে বিপদ বাড়ে।” আরশীন দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলোবালি হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ ছোট করে হাসল।

স্টেশনের চতুর্মুখী কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমীদ খান। চারপাশের সবকিছু মিলেমিশে এক ধরনের স্থির অস্থিরতা তৈরি করেছিল। কিন্তু এই অস্থিরতার মাঝেই তাহমীদের দৃষ্টি আচমকা স্থির হয়ে গেল। দূরে, খানিকটা ভীড়ের ফাঁকে হালকা একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। মেয়েটাকে চিনতে বেগ পেতে হলো তবে তার সামনেই দাঁড়িয়ে একজন… হালকা ঢেউ-খেলানো চুল যা স্বাভাবিকভাবে সামনে পড়ে রয়েছে, চাপা দাড়ি, উজ্জ্বল কিন্তু স্থির দৃষ্টি। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ছিল শান্ত, চোখেমুখে অদ্ভুত এক ভারিক্কি মিশ্রিত ভঙ্গি। তাহমীদের গলা শুকিয়ে গেল। অদ্ভুত শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। সে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। আদিয়াত….! মাথার ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যেতে লাগল। এতটা কাছে! সে জানত না, পাশে থাকা মেয়েটাও তাকে লক্ষ্য রাখছে। মুহূর্তেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল মাথা থেকে পায়ে। তাহমীদ এবার ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকল। সে জানে, এখানে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা বোকামি হবে।

আরশীন আড়ালেও লক্ষ্য রাখল। তাহমীদ যে মুখে আতঙ্কের ছাপ লুকানোর চেষ্টা করছে আরশীন ঠিক তা ধরে ফেলল।
— “ব্যাটার মনে ভয় ঢুকেছে।” মনে মনে বলল আরশীন। কিন্তু এখনই কিছু করা যাবে না। সে যতটুকু চেয়েছিল ততটুকু করতে পেরেছে। তাহমীদের এখন অস্থিরতা বাড়ানো দরকার। যাতে সে নিজের ভুলে আরও বেশি গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে।
.
.
.
চলবে….