তরঙ্গিনী পর্ব-১০

0
411

#তরঙ্গিনী (পর্ব-১০)

#আরশিয়া_জান্নাত

আরাফ অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তায় জ্যাম লেগে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এক ঘন্টা আগে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, তাই এমন হাল। আরাফ খানিকটা বিরক্ত হয়েই গাড়িতে বসলো, তারপর যখন জ্যাম ছুটলো বাড়ির খানিকটা আগে আসতেই গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। এমন ঝড়বৃষ্টির দিনেই সব অঘটন ঘটে। একটু দূরেই তাদের বাড়ি তাই হেটেই বাড়ি ফিরছিল তখনই ঝুম বৃষ্টি শুরু। অনেকটা দৌড়ে আসলেও বেশ ভিজে গেছে সে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই শুনে রেবা চিৎকার করছে। ও পকেট হাতড়ে ফোন নিতে যাবে তার আগেই রেবা দৌড়ে এসে ধাক্কা খায় আর সেন্সলেস হয়ে পড়ে।
আরাফ ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রেবার এমন কান্ড দেখে, মনের মধ্যে নানান শঙ্কা জেগে উঠে। রেবাকে কোলে তুলে সোফায় শুইয়ে দেয়। ততক্ষণে জেনারেটর চালু করে রহিম চাচা আর তাহেরা এসে বলে, আয়হায় এইসব কি হইলো। বৌমার কি হইছে? বেহুশ হইয়া গেছে?

আরাফ রেগে বলল,আপনারা কোথায় ছিলেন? রেবা এমন ভয় পেয়েছে কেন? কি হয়েছে এখানে?

রহিম চাচা খানিকটা মিইয়ে গলায় বলল, আরাফ বাবা আপনিতো জানেন জেনারেটরটা চালু করতে টাইম লাগে, আমি ঐটাই চালু করতে গেছিলাম। আর তাহেরার ছেলে ছোট তো, ঝড়বৃষ্টিতে ভয় পাইবো ভাইবা ও একটু গেছিল। এরমধ্যে কি ঘটছে জানি না।

আরাফ আর কিছু বললো না, রেবাকে ঠান্ডা গলায় ডাকতে লাগলো, চোখেমুখে পানি ছিটালো। ধীরে ধীরে রেবার জ্ঞান ফেরে।

চোখ মেলে আরাফকে দেখেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করি। আরাফ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কিছু হয় নি আমি আছি তো। প্লিজ শান্ত হন, কান্না থামান।

আমি তার বুকে থেকেই ফুপিয়ে উঠে বললাম, কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন কত ভয় পেয়েছি আমি?

আর ভুল হবে না প্রমিজ, আমি কালকেই আইপিএস লাগাবো এখানে।

হঠাৎ খেয়াল করলাম তার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে, এ কি আপনি এতো ভিজেছেন কি ভাবে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো, চলুন চেইঞ্জ করে নিবেন। আল্লাহ! পুরা গোসল করে এসেছেন দেখছি।

আরাফ চেইঞ্জ করে এসেই আমায় জড়িয়ে ধরলো, আপনাকে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম জানেন? আপনি আমায় আগে বলেননি কেন আপনি অন্ধকার ভয় পান, তাহলে তো আমি আগেই ব্যবস্থা করতাম।

আপনিও না একদম বেশি, এভাবে কেউ কান্না করে? আমি ঠিক আছি তো।

একদম নড়বেন না, আমার কলিজাটা আগে ঠান্ডা হোক। আর আমি কান্না করছি কে বলেছে, টেনশনে গলা চেইঞ্জ হয়ে গেছে।

একদম মিথ্যে বলবেন না। আপনার চোখের পানি আমার গালে পড়েছে। আর শুনুন সবসময় এমনটাই কেন দেখাতে হবে ছেলেদের ইমোশন‌ নেই, তারা কান্না করে না? ওদের এই রীতিতে আটকে ফেলার কোনো মানে নেই। কান্না কোনো দূর্বলতা না বরং এটা শক্তির যোগান দেয়। সিমেন্ট বালুর মিশ্রণে পানি দেয় বলেই তো শক্ত দালান হয় তাই না?

আপনি এমন পরিস্থিতিতেও এমন শক্ত লেকচার দিচ্ছেন?

আমি তার বুকের বা’পাশে হাত রেখে বললাম, আপনি অনেক বিশেষ মানুষ। আল্লাহ আপনাকে আমার জীবনে পাঠিয়ে আমার সব অপূর্ণতা পূরণ করে দিয়েছে। আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী।
তারপর কাতর কন্ঠে বললাম, আমায় এভাবেই সবসময় ভালোবাসবেন প্লিজ, কখনো ভালোবাসা বন্ধ করবেন না। এখন যেমন আছেন তেমনি সবসময় থাকবেন। বদলে যাবেন না।

রেবা আপনি ঠিক আছেন? কি হয়েছে আপনার?

আমার ভালো লাগছে না, একদম ভালো‌ লাগছে না। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি আপনাকে ডিজার্ভ করি না আরাফ। আপনি অনেক ভালো, আপনার মনে কোনো কলঙ্ক নেই। আপনার মতো একজনকে জীবনসঙ্গী পাওয়া আমার সাত কপালের ভাগ্য।

রেবা!

জ্বি

আমার দিকে তাকান।

আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকালাম।
উনি আমার গালে হাত রেখে বলল, এই শব্দগুলো বলা কি খুব প্রয়োজন? কেন এতো কষ্ট পাচ্ছেন বলুন তো?

আমি নিজেকে সামলে বললাম, আমি খুবই দুঃখিত। আমি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

বলেই আমি চলে যাচ্ছিলাম সে আমার হাত ধরে পেছন থেকে দুহাতে আকড়ে বলল, আমি আছি রেবা, আমি ইনশাআল্লাহ সবসময় থাকবো। আপনাকে আমি এখন যেমন ভালোবাসি মৃত্যুর পরও তেমনি ভালোবাসবো। আপনি কেন এসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন? ভবিষ্যতের চিন্তা করে বর্তমানে কষ্ট পাওয়া কি ঠিক?

আমি তাকে কিভাবে বলি, অতীতে একজনের অনেক ভালোবাসা পেয়ে দূর্বল হওয়া আমিটা শেষে তার ভালোবাসার রং বদলাতে দেখেছি। আমার বড্ড ভয় হয় আমি ভালোবাসতে শুরু করলে আবারো মন ভাঙবে, এখন যেমন যত্ন আর আহ্লাদে আমি ভাসছি, তখন এইসব স্মৃতি আমার বুকে কাটার মতো বিধবে। আরাফের ভালোবাসা হারালে আমি এবার আর বাঁচতে পারবো না। একদমই পারবো না। আমি জানি না আমার কি হয়েছে, আমার এমন বুক ভেঙে কান্নাই বা কেন আসছে, আরাফের আলিঙ্গনে আমার ভেতরটা যেন আরো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। সবটুকু দুঃখ যেন অশ্রু হয়ে তার সামনে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তাকে দেখাতে চাইছে, দেখুন কি নিদারুণ যন্ত্রণার বোঝা চেপে বেঁচে আছে মেয়েটা!

আরাফ আমায় একটুও থামালো না, সে বুক পেতে দিলো ইচ্ছেমতো কেঁদে নিতে। হয়তো সে চাইছিল আমি আমার সব দুঃখ তার বুকেই ঝরিয়ে ফেলি, আর সে সবটা শুষে নিবে। আমিও গুটিশুটি হয়ে তার বুকেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

রেবা! আমি হয়তো বুঝতে পারছি আপনি কেন এতো কষ্ট পাচ্ছেন। আমার এই ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে আমি আপনার জীবনের প্রথম প্রেম হতে পারি নি। সমস্যা নেই প্রথম প্রেম না হতে পারলেও আমি আপনার শেষ প্রেম হবোই। আজকে আপনি যার যন্ত্রণায় পুড়ে এতো কাঁদলেন, আমি সেই মানুষটার শেষ অবশ্যই দেখবো। কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি এতো ভালোবাসবো যে আপনি তার কথা ভেবে কষ্ট পাওয়া তো দূর বরং আনন্দিত হবেন এই ভেবে সে চলে গিয়েছিল বলেই আপনি এতো সুখী হয়েছেন। আজকেই আপনার কান্নার শেষ দিন।আমি আপনাকে আর ঐ রাস্কেলের জন্য কান্না করতে দিবো না। আই প্রমিজ।

আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন রাত প্রায় একটা। আমি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি চোখমুখ ফুলে বিচ্ছরি অবস্থা। তার উপর মাথাটাও ভীষণ ধরেছে। আরাফ কি ডিনার করেছে? আল্লাহই জানে উনি কি ভেবেছেন আমাকে, এমন ভ্যা ভ্যা করে কান্না করেছি। উফ আমি তাকে মুখ দেখাবো কি করে!

আরাফের খোঁজে বের হয়ে দেখি সে দোতলার বেলকনীতে বসে আছে, বাইরে তখনো অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আমি অনেকটা জড়তা নিয়েই তার সামনে গিয়ে বললাম, আপনি ডিনার করেছেন?

আরাফ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, একজন বলেছিল মেয়েদের কান্নার পর চেহারায় ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ভর করে। আপনাকে দেখে আমার ইচ্ছে করছে ঐ লোকটাকে নোবেল দিতে।

আমি খুব দুঃখিত, তখন আসলে

মাঝেমধ্যে একটু মনমতো কান্না করা খারাপ না কিন্তু। এতে ভেতরটা ধুয়ে মুছে যায়। তবে একটা ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আপনি বেশি কাঁদবেন না রেবা। মনে রাখবেন আপনার শরীরের প্রতিটা কণা আমার সম্পদ। যেটা আল্লাহ আমায় গিফট করেছেন, আপনার অশ্রুকণার জবাবদিহি আমাকেও দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমার ভীষণ কষ্ট হয়,,,

আমি অবশ্যই খেয়াল রাখবো।


সেই রাতের কান্নায় কি ছিল জানিনা তবে মনটা একদম ভারমুক্ত হয়ে গেল যেন। আমার মনে হলো আমি তৌকিরের জন্য শেষ কান্নাটুকু কেঁদে ফেলেছি। এখন থেকে ঐ দুঃখ আমায় আর কাদাতে পারবে না। মানসপটে ভেসে উঠে সেই রাতের একটা দৃশ্য। আমি যখন হিচকি তুলে ক্লান্তিহীন ভাবে কাঁদছিলাম, আরাফ ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমার কান্না থামাতে। হঠাৎ সে আমার মাথার পেছনে ধরে গাঢ় চুম্বনে অধর মিশিয়ে নেয়। আমি কান্না ভুলে চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়েছিলাম।
সে বলল, যাক বাবা কান্না থামলো আপনার!

ঐ স্মৃতি মনে পড়তেই লজ্জায় আমি মুখ ঢেকে ফেললাম। আহ এইসব লজ্জার কথা এতো মনে পড়ে ক্যান!!

ভাবীসাহেবা আপনার মুখে কি হইছে? এমন দুহাতে ঢেকে রাখছেন যে?

লতার কথায় আমি সোজা হয়ে বললাম, আরে না কিছু হয় নি। এমনি হাত দিয়ে মুখ মুছেছি আর কি।

ওহ। আরাফ ভাইয়া আপনার জন্য এসব পাঠাইছে নেন।

আমি প্যাকেটটা নিয়ে ভেতরে গেলাম। চিরকুটে লেখা, শাড়িটা পড়ে তৈরি থাকবেন। আজ বিকেলে বেড়াতে যাবো।

আমি তখনই প্যাকেট খুলে শাড়ি পড়তে শুরু করি। বহুদিন পর নিজের ইচ্ছায় সাজতে বসি। চোখে হালকা করে কাজল,আর আইলাইনার , ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক। চুলগুলো বেশ সুন্দর করে একপেশে খোঁপা করে ডিজাইনার পিন সেট করলাম। ব্যস এইটুকুই সাজ। হাতভর্তি চুড়ি আমার পছন্দ না, তাই মানানসই দুটো চুড়ি হাতে পড়েই আমি একদম রেডি।

আচ্ছা এরকম সাজে দেখে আরাফ পছন্দ করবে তো? এটা কি বেশি সিম্পল হয়ে গেছে?
পরে মনে হলো সে বিনা সাজেই যখন মুগ্ধ হয়ে থাকে, এতেও হবেই। আমি জানি আমার বরের চোখে আমিই সেরা। স্বামীর মনোযোগ বা ভালোবাসা মেয়েদের মনে যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে, তা মনে হয় না আর কেউ সহজে করতে পারবে। কেননা স্ত্রীদের একমাত্র আশ্রয়স্থল আর পরম নির্ভরতার জায়গা তার স্বামী। যার স্বামী ঠিক তার সব ঠিক। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি,
আরাফ দরজায় হেলান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে আমায় দেখছে।

কখন এসেছেন আপনি? এরকম বিনা শব্দে এসে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না,

এটা সত্যিই আপনি? আমিতো ভেবেছিলাম ভুলে অন্য কারো রুমে চলে এসেছি কি না!!

ঢং আর কি। যেন আমায় সাজে দেখেননি আগে।

তখনেরটা আর এখনেরটা যে আলাদা এ নিশ্চয়ই আপনি ভালো বুঝবেন। আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে রেবা, এখন তো আমার সাহসে কুলোচ্ছেনা আপনাকে নিয়ে বাইরে যেতে। সবাই তো আপনার দিকেই চেয়ে থাকবে!!

আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে বললাম, বেশি বাড়িয়ে বলছেন।

একদম না। ইনফ্যাক্ট এই সৌন্দর্যের প্রশংসার জন্য শব্দগুচ্ছ শর্ট পড়বে,,, এই রেবা আপনি সবসময় এমন সাজবেন না কেমন? মাঝেমধ্যে এভাবে সেজে চমকে দিবেন। আমার পক্ষে রোজ এমন সৌন্দর্য অবলোকন করা সম্ভব নয়।

আমি শাড়ির আচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললাম, আজকে কি কোথাও যাওয়া হবে নাকি এখানেই দিন কাটাবো?

আরেহ না চলুন।

তারপর আমরা বের হলাম, আরাফ ড্রাইভ করতে শুরু করলো।

চলবে,,,