তরঙ্গিনী পর্ব-১৩+১৪

0
427

#তরঙ্গিনী (পর্ব-১৩)

#আরশিয়া_জান্নাত

নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে। রৌদ্রজ্জোল একটা দিন, আমরা সবাই একটু আগেই কিশোরগঞ্জ এসেছি। পূর্বপরিকল্পনামতো আমরা নিকলী হাওড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। গাড়িতে সবাই নানান গল্পজুড়ে বসেছে। আমি এই প্রথম এতোজনকে নিয়ে পিকনিকে যাচ্ছি, তাই আমার কাছে ব্যাপারটা ভীষণ এক্সাইটিং। যে পথটা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। রাস্তাটা যেন জলের উপরে যাচ্ছে।
চারদিকে পানির ঢেউ, এত সুন্দর আকাশ, লম্বা এক রাস্তা যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। যেন এ পথের অন্ত নেই। এতো সুন্দর লাগছিল কি বলবো! আমি বিভোর হয়ে সবটা দেখছি, তখন রুহি বলল, জানো ভাবী কিশোরগঞ্জে আসলেও আমরা সবসময় হাওড়ে যাই না। সুনন্দার ঘাটে পিকনিক করে চলে আসি। কিন্তু ভাইয়া বলল তোমার নাকি নৌকায় চড়ার ইচ্ছে। তাই এবার নৌকায় সব হবে। অনেক মজা হবে কি বলো?

মনে তো হচ্ছেই, জানো সবসময় জার্নি বাই বোট কম্পিজিশন পড়লেই ইচ্ছে হতো নৌকা ভ্রমণ করি। ভাইয়া একমাত্র ছেলে বলে মা তাকে নদী বা পানিতে এলাউ করতেন‌ না। আর আমিও অন্যদের সাথে যেতে পারিনি।

ওহ! তাহলে তো তোমার একটা ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে!

হুম

নিকলী বেড়ীবাধে এসে আমরা সবাই জড় হলাম। জিহাদ অনেক বড় নৌকায় দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় সবাইকে ডাকলো। আমি একটু মিইয়ে বললাম, এ নৌকায় সবার জায়গা হবে?

আরাফ বলল, জ্বি এটা সবচেয়ে বড় নৌকা, এখানে ৩০জন চড়তে পারবে আমরা তো ২০জন।

আচ্ছা

আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

নাহ আসলে নৌকায় চড়িনি তো কখনো,,এতো ঢেউ দেখে একটু ভয় লাগছে।

আমি আছি তো ভয় পাচ্ছেন কেন। আসুন
আরাফ আমার হাত ধরে নৌকায় তুলল। সবাই মাদুর বেছানো পাটাতনে বসে পড়লো। বড়রা কেউ কেউ চেয়ারে বসলেন। আমি আরাফের পাশে বসতে চাইলেও বসতে পারিনি। খানিকটা মন খারাপ নিয়েই রুহিদের মাঝখানে বসলাম। ছোট চাচার ছেলে মুহতাসিম গিটার নিয়ে এসেছিল। ও আবার ভীষণ ভালো গান করে। নৌকা হেলেদুলে চলতে শুরু করলো। আমার প্রথমে অনেক ভয় লাগছিল। পানির উপর সব কেমন নড়বড়ে! এই বুঝি হেলেদুলে পড়ে যাচ্ছি!

কিন্তু ধীরে ধীরে নৌকা যখন ঘাট পেরিয়ে গেল অতোটা ভয় লাগেনি। আরাফ দাঁড়প্রান্তে বসে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাস্কেট থেকে সবার জন্য কেক বের করলাম, সবাইকে দিয়ে আরাফকে দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলাম তখন রাজিব ভাইয়া বলল, ভাবী আমাকে দিন আমি দিয়ে আসছি।

জিহাদ ওকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, ভাবি আপনিই যান।

রাজিব কুকড়ে বললো, ও ভাই এতো জোরে মারতে হয় তোর।

তুই বলদ বুঝোস না যখন আর কি করতাম? ভাই ভাবী কখন থেকে আলাদা বসে আছে দেখোস না। তোরা আসলেই বলদ।

আমি অনেক ভয়ে সাবধানে ধীরে ধীরে আরাফের দিকে গেলাম। আরাফ আমার দিকে তখনো চেয়ে আছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে।

নিন কেক খান।

আমার বৌয়ের সত্যিই বুদ্ধি হয়েছে। কি সুন্দর বাহানা দিয়ে উঠে এসেছে! বাহ বাহ!

আমি তার পায়ের কাছে বসে বললাম, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একটা মজার ব্যাপার আছে জানেন? এখানে সবার সামনে লুকোচুরি খেলতে হয়। ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং।

ইন্টারেস্টিং তবে পেইনফুলও। এখানে চাইলেও যখন তখন রোম্যান্স করা যায় না, এই যে আমরা নৌকার দাঁড়প্রান্তে বসে আছি,কি সুন্দর একটা মোমেন্ট অথচ আমাদের দিকে সবার দৃষ্টি! এরচেয়ে দূরে বসেছিলেন ভালো ছিল, অন্তত দেখতে পারছিলাম মনমতো।

আমি পানিতে হাত ডুবিয়ে খেলতে খেলতে বললাম, আপনার চেয়ে থাকা রোধ করতেই সামনে এসে বসেছি। এখন শান্তি লাগছে আমার! উফফ কেমন করে একনজরে চেয়েই থাকেন, একটুও ক্লান্তি নেই আপনার!

ওহ তাই? ঐ দেখুন ঐ নৌকায় কি সুন্দর একটা মেয়ে বসে আছে, এতোক্ষণ তো দেখিনি, এখন চোখে পড়লো।

তো ভালোই তো দেখতে থাকুন না তাকে! আমায় বলছেন কেন?

এইটুকুতেই নাক লাল হলো আপনার? কথাটা বুঝুন, বৌয়ের দিক থেকে নজর সরালেই চারদিকে নজর আটকাবার মতো ফেৎনার অভাব নাই। তাই তো আমি আমার বৌয়ের দিকেই তাকিয়ে থাকি। তাকে দেখেই আমি পরিতৃপ্ত।

আমি অন্যদিকে ফিরে হাসলাম।

দূর থেকে এসব দেখে রুহি বলল, দেখ আপি ভাবী কেমন লজ্জায় লাল হয়ে আছে, ভাইয়া ভাবী একসঙ্গে থাকলে কত গ্লো করে, না!

পিহু বলল, একদম ঠিক বলেছিস।

হাবীব বলল, তোরা ঐদিকে হা করে তাকিয়ে না থেকে ওনাদেরকে স্পেস দে। বেচারারা ঠিকমতো একটু তাকাতেও পারছেনা। দুজন দুদিকে চেয়ে আছে! আহারে! আমি আরাফ ভাইয়ের মতো ভুল করবোনা, বৌ নিয়ে ঘুরতে গেলে তোদেরকে ভুলেও নিবোনা। অথবা নিলেও আলাদা গাড়িতে উঠবো।

তোর বিয়ে হতে এখনো অনেক দেরী, এখুনি এতো প্ল্যানিং। দাড়া মেঝ আম্মুকে বলছি কেমন হবি তুই!

উফ আপু তোরাও না। সব কথায় বড়দের টানিস কেন বলতো?

পিহু বলল, ঐ মুহতাসিম গিটার আনসোস কি সাজাই রাখার জন্য? গান ধরোস না ক্যান?

মুহতাসিম গিটারে সুর তুলল,

কখনো ভোর, কখনো মাঝরাতে
Highway থেকে এক চিলছাতে
প্রতি পাতা থেকে চেনা মলাটে
আমি শুধু শুধু খুঁজেছি আমায়

রাত জাগা কত কত যে সকাল
ভেবে চলি সে কি স্বর্গ, কি পাতাল
অভাবে, নাকি স্বভাবে মাতাল?
আমি যে বড়ো খুঁজেছি আমায়

লাগছে বড়ো তোমাকে ভালো
সব রঙিন, নাকি মনটা রাঙালো?
সূর্যের সাথে রোজ জ্বালো আলো
ঘুচে যাক যত আঁধার কালো

এই গানটা কি তোমায় ভাবাবে?
শুধু হাসি, নাকি চোখ রাঙাবে?
আমি বলি, যদি পারো
তুমিও খোঁজো তোমায়,,,,,,,,


নিকলী থেকে ফিরে আমরা সেই রাতটা কিশোরগঞ্জ সদরে কাটিয়ে আসি। সত্যি বলতে এতো সুন্দর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার পূর্বে হয়নি। কিশোরগঞ্জের সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ। এটা আমার স্মৃতিতে আজীবন অম্লান থাকবে।
ঢাকায় ফেরার পরদিন আমরা ফের রাজশাহী ব্যাক করি।
মা ফেরার পথে অনেককিছু রেঁধে পাঠিয়েছেন বলে দুদিন আর রান্নার ঝামেলা ছিল না। চারদিন সবার কোলাহলে থেকে এখানের নিরবতা বড়ই বিধছিল। আমি বেলকনীতে বসে ভাবছিলাম নিজের পরিবর্তনের কথা। আগে ভাবতাম এতো মানুষের মাঝে আমি কিভাবে থাকবো, আর এখন মনে হচ্ছে এতো নিরবতার মাঝে কিভাবে থাকবো। মেয়েদের কে বোধহয় আল্লাহ এভাবেই গড়েছেন। আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিতে পারি। নয়তো হুট করে এসে নতুন পরিবারের সদস্য হয়ে এখানেই মৃত্যু পর্যন্ত অবস্থান করা চাট্টিখানি কথা নয়। শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে কত ভালোমন্দ ভয় থাকে মনে, ওরা কেমন হবে, ভালো হবে কি না মানিয়ে নিতে পারবো কি না! কেননা এর উপরি ডিপেন্ড করে বাকীজীবনটা কেমন কাটবে। যাদের ভালো পরিবার জুটে তারা ভাগ্যবতী হলেও যাদের ভালো হয় না তাদের আজীবন কষ্টই করতে হয়। আমি এদিক দিয়ে ভাগ্যবতীই বলা চলে। আলহামদুলিল্লাহ! আরাফের পরিবারের সবাই আমায় এতো সহজে আপন করেছে বলেই আমার মনেই হয় না আমি এক বছর আগেও তাদের চিনতাম না। আরাফ অফিস থেকে ফিরে বলল, কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি?

নাহ এমনি সবাইকে মিস করছিলাম,,

ফোনে কথা বলুন,

বলেছি,, বলার পর আরো বেশি খারাপ লাগছে। আপনার কাজ শেষ হবে কবে?

আরাফ টেবিলের উপর আইসক্রিমের বক্স রেখে বলল, জানেন তো আরো মাস খানেক থাকতে হবে। চিন্তা করবেন না খুব শীঘ্রই আমরা ফিরে যাবো।

আমি আইসক্রিমের বক্স খুলে খেতে বসে গেলাম। আরাফ ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, আপনাকে দেখতে না ভীষণ কিউট লাগছে। মনে হচ্ছে গাল ফুলিয়ে রাখা বাচ্চা মেয়ের মান ভাঙাতে কেউ আইসক্রিম দিলো।

আমি জানি তো আমি বুড়ি, আমাকে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না।

ওমা আমি কখন বললাম আপনি বুড়ি?

বোঝাচ্ছেন আর কি আমি বুড়ি হয়েও বাচ্চা মেয়ের মতো বিহেভ করছি!

আরাফ ক্যালেন্ডারে চোখ বুলিয়ে বলল ওহ এই ব্যাপার!

আমি বললাম, কি ব্যাপার?

আপনার মুড সুইং এর ব্যাপার।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ উঠে উনার জন্য চা করতে গেলাম।

রেবা শুনুন,

জ্বি?

আপনাকে কি কখনো বলেছি এটা?

কোনটা?

আমি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি!

আমি লজ্জায় তার দিকে তাকাতে পারলাম না, সে কর্মকান্ডে সেটা প্রকাশ করলেও মুখে হয়তো এই প্রথম বললেন। তাই তার এই তিন শব্দের বাক্যটা আমার ভেতরে অনুভূতির তীব্র ঝড় বইয়ে দেয়। আরাফ মুচকি হেসে বলল, আমরা অনেকগুলো বছর একসঙ্গে কাটাবো, দুজনের বয়স বাড়বে সাংসারিক দায়িত্ব বাড়বে। আপনার লাবণ্যতা ম্লান হবে। চুলে পাক ধরবে। আমিও যুবক থাকবো না। জীর্ণশীর্ণ দেহ হবে। বার্ধক্য আমাদের হানা দেবে। সেই দিনও আপনিই হবেন আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দর রমণী।

বাচ্চা হলে তো অনেকে মোটা হয়ে যায়, যত্নহীনতায় সৌন্দর্য কমে যায়। তখন আর বৌকে ভালোবাসে না,,,

একটা কথা কি জানেন যুগ যত আপগ্রেড হচ্ছে আমাদের কাছে অপশনও বেড়েছে। আমরা যখন অনেকগুলো অপশন পাই তখন এচিভ করা অপশনটাকে আর ভালো লাগে না। বিয়ের আগে মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে যতোটা যত্নে আর আহ্লাদে থাকে, বিয়ের পর তার ছিটেফোটাও যদি করা হয় তবে মনে হয় না কোনো মেয়েই তার স্বামীর কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটাই এমন এখানে সবাই নিজেদের মেইনটেইন করতে পারেনা। এর বহুবিধ কারণও রয়েছে। একটা কথা মাথায় রাখবেন এতোকিছুর মাঝেও কিছু পুরুষ আছে যারা তাদের স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসে, তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে যে মেয়েটা তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে তার মাঝেই স্নিগ্ধতা খুঁজে পায়। যে পুরুষ ভাবতে পারে তার অংশকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর জন্যই শরীরে গঠন বদলাচ্ছে, আফটার প্রেগন্যান্সি ডেইলী রুটিন বদলাচ্ছে। তার পক্ষে আর যাই হোক অপছন্দ করার চিন্তা আসেনা। সে ঐ অনাদরে অযত্নে মুখে ক্লান্তির ছাপ আর ডার্কসার্কেলের চোখের মায়ায় হারাতে পারে। কৃতজ্ঞতায় স্ত্রীকে আগের চেয়ে আরো বেশি ভালোবাসতে পারে।

আপনার কথা শুনলে মনেই হয়না পৃথিবীতে খারাপ পুরুষ আছে। অথচ নিউজপেপারে কত নির্মম ঘটনা দেখছি রোজ। ওরা কি ভালোবাসেনা? ওদের মধ্যে কি আপনার সেই কল্পিত একটাও পুরুষ নেই?

কমে গেছে তবে বিলুপ্ত নয়। খোঁজ নিলে জানবেন এখনো অনেক পুরুষ আছে যারা নিজের স্ত্রী ব্যতীত কারো দিকে তাকায় না, স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসে, কেউ প্রকাশ করে তো কেউ করে না।

আপনি ভীষণ পজিটিভ মানুষ।

নেগেটিভিটি ছড়ানোর এলিমেন্টস তো কম নেই, আমি পজিটিভ হয়েই বরং আলোর দিশারী হই। কি বলেন?

বেশ বললেন।

আমি মনে মনে ভাবতে থাকি আপনাকে দেখে আপনার মতো করেই যেন সবাই ভাবতে শিখে। পৃথিবীটা হয়ে উঠুক ভালোবাসাময়।

চলবে,,,,

#তরঙ্গিনী পর্ব-১৪

#আরশিয়া_জান্নাত

হ্যালো নূর? ও ভাই তুই এতো নিষ্ঠুর এতোদিনে মনে পড়ছে আমার কথা?

না রে তোর কথা প্রায়ই মনে পড়ে, কিন্তু কল করা হয় না। কেমন আছিস?

ভালো আর থাকমু কেমনে বল, দুইটা ফাজিল পোলামাইয়া যার আছে সে ভালো থাকতে পারে? দুইটাই জন্মের ব্রিটিশ। একটু চোখের আড়াল হইলেই সব নষ্ট করে ফেলে। আমার কথা ছাড় তোর খবর বল, সুখবর পামু কবে?

জানি না।

ওমা জানিস না মানে কি? বাচ্চা নিবি না? বছর তো হয়ে আসছে। তোর এক্স তো পোলার বাপ হয়ে নাচতেছে, তুই ক্যান পিছাই আছোস? তোর তো উচিত দুইটা জন্ম দিয়ে আগাই থাকা। দেখ ব্যাটা আমিও দুই বাচ্চার মা হইছি!

বাচ্চা দেখিয়ে লাভ?

তোর জামাই তোরে আদরে সোহাগে রাখছে এটাই তো প্রমাণ! যত বেশি বাচ্চা তত বেশি প্রমাণ।

ধুরর তুইও না যা তা।

নয়তো কি? দেখ তোর বর তোরে কত ভালোবাসে এটা দেখানোর আর কোনো উপায় আছে বেবি ছাড়া?

বাচ্চা হওয়া মানেই অনেক ভালো আছি বা ভালোবাসে বুঝায় তোরে কে বলল? বিয়ের পরপরই তো বেবি নিয়ে ফেলে কিন্তু ভালোবাসা নাই। সাথীর কথা মনে নাই তোর? ও তো ঠিকঠাক চিনবারো সুযোগ পায়নাই। বিয়ে হইছে কনসিভের খবর পাওয়ার আগেই বর বিদেশ চলে গেল,,,,

শোন নূর, আগুনের আশেপাশে থাকলে মোম গলে যাবেই। ছেলেরা বৌরে পছন্দ করুক আর নাই করুক ধৈর্য ধরে সর্বোচ্চ তিনদিন থাকবে। এরপর ঠিকই ম্যাচ শুরু। এখানে ভালোবাসার অপেক্ষা করা মানে বহুত লম্বা টাইম ওয়েট করা। আর আমরা মেয়েরা তো এমন ধাচে গড়া কেউ একটু আদর করে কথা বললেই গদগদ হয়ে যাই, সেখানে সবচেয়ে বড় সুখটা পেয়ে কি হাল হয় চিন্তা কর? ভালোবাসা হবে তারপর সব হবে এমন ভাবনায় থাকলে এই জীবন শেষ,,,তাই বিয়ের পর শরীর দিয়েই মন ছোঁয়া হয়। এটাতে দোষের কিছু নাই। যাকে ধর্মমতে বিয়ে করেছি তারই তো সব। তুই নিজেই বল আমার ভালোবাসার জন্য যদি তোর ভাই অপেক্ষা করতো এই দুইটা দুনিয়াতে আসতো? প্রথম বাচ্চা হবার পরে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মাইছে আমার। সে এতো যত্ন করবে আমিতো ভাবিই নাই।

আচ্ছা মিথি শারীরিক সম্পর্ক কি খুব জরুরী? মানে ধর তুই তাকে অনেক ভালোবাসিস কিন্তু তুই অপেক্ষা করছিস সে তোকে ভালোবেসে কাছে না টানা অবধি যাবিনা। তবে এটা কি পুরুষের জন্য কঠিন হবে?

কঠিন মানে? অনেক কঠিন হবে। সে আর মানুষ পর্যায়ে নেই আপার লেভেলে চলে গেছে।‌ এই নূর বলিস না তোদের মধ্যে এখনো কিছু হয় নাই! ওহ মাই গড।।।

আমি চুপ করে রইলাম, এই কথার পিঠে কি বলবো আমি? মিথি কিছুক্ষণ হা‌হুতাশ করে বলল, নূর তুই মাথা নষ্ট করা সৌন্দর্যের অধিকারী। তোকে যে মানুষটা এতোদিন সময় দিয়েছে তাকে আর অগ্নিপরীক্ষায় রাখিস না বোন। এটা ওদের জন্য অনেক টাফ। তোকে সৃষ্টিকর্তা তার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, বায়োলজিক্যাল নিডস পূরণ করা তোর কর্তব্য। তোর উচিত ছিল আরো আগেই,,,

আমি বলেছিলাম উনাকে কিন্তু উনি বললেন আপনার মন জয় না করে শরীর চাই না,,

তুই অনেক লাকি রে নূর! এমন মানুষ সবাই পায় না। উনার খুব যত্ন করিস। পাপী হইস না।
স্বামীর চাহিদা পূরণ করা আমাদের উপর ফরজ। কি বলেছি বুজতে পারছিস? আমার সেদিনই বোঝানো উচিত ছিল তোকে। উফ তুইও না এতো চাপা কিছুই বলিস না কাউকে।

আমি এখন কি করবো? সত্যিই অনেক পাপ হয়ে গেছে?

যা হবার হয়ে গেছে, এটাকে আর বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি যা যা বলছি মন দিয়ে শোন,,,,

মিথির ফোন রেখে আমি কপালের ঘাম মুছতে লাগলাম। নাহ আমি আসলেই অনেক বড় বোকা। আজকে বুঝলাম কেন তিনি সবসময় বলতেন আমি একটু একটু বুদ্ধিমতি হচ্ছি!! আমিও তো বলি আমাকে তার বোকা মনে হতো কেন,,,,

লতাকে বললাম মালীনিকে বলে গোলাপ আনতে। আর অনলাইনে বেশকিছু জিনিস অর্ডার করলাম। আজকে আমি আরাফকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দিবো।।


দোতলার দখিন দিকের ঘরটা আমি অনেক সুন্দর করে সাজালাম। লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বিছানায় হার্টশেইপ করলাম। সুগন্ধি মোমবাতি দিয়ে পুরো ঘর সাজালাম। বলতে গেলে একদম আমাদের বিয়ের রাতের মতোই সাজালাম ঘরটা, উনার পছন্দসই করে। সব সাজানো শেষে দরজাটা লক করে আমাদের ঘরে এসে ভাবছি কোন শাড়িটা পড়া যায়। সবকয়টাই উনার পছন্দ করা। তাই বিশেষ কোনোটাই সিলেক্ট করতে পারছিনা। বহু ভেবে ঠিক করলাম লাল শাড়িটা পড়বো।
আরাফ আসার আগেই আমি রহিম চাচা আর তাহেরা ছুটি দিয়ে ফেললাম। আরাফের জন্য রান্না শেষ করে শাওয়ার নিলাম। তারপর অনেক যত্নে সাজতে শুরু করলাম।
আরাফের গাড়ির শব্দ শুনতেই বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। উনি আমায় এমন সেজেগুজে থাকতে দেখলে কি ভাববেন?! লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি কি সব সরিয়ে ফেলব? হঠাৎ মনে পড়লো মিথির বলা কথাগুলো। না না উনি আমার স্বামী, উনিই আমার হকদার। উনাকে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
মুখে এসব বললেও আমার হাত পা অসম্ভবভাবে কাঁপতে লাগলো। ওহ আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও। আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি, আমায় মার্জনা করো।

কি ব্যাপার বলুন তো রেবা?রহিম চাচা তাহেরা কেউই দেখি নেই। দারোয়ান বলল সবাই নাকি চলে গেছে, আপনি একা ভয় পাচ্ছেন‌না তো?

আমি তার দিকে না ফিরেই বললাম, আমিই উনাদের চলে যেতে বলেছি।

ওহ! তা এমন মুখ লুকিয়ে রেখেছেন কেন কি হয়েছে?

কিছু হয় নি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার পরিবেশন করছি।

এতো তাড়াতাড়ি?

কয়টা বাজে? ওহ মাত্র নয়টা!

আপনি ঠিক আছেন রেবা? কিছু কি হয়েছে? এমন অদ্ভুত বিহেভ করছেন কেন?

আরাফ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললাম।
আরাফ আমার হাত সরিয়ে বলল, মাশাআল্লাহ!

আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখি আরাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।

এই ব্যাপার তাহলে?

কোন ব্যাপার?

আমার জন্য সেজেগুজে বসে আছেন তাই না?

না মানে ঐ আর কি।

আরাফ আমার চিবুক তুলে বলল,রেবা আপনি আমার চক্ষুশীতলকারিণী। আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল আপনাকে দেখে।

আপনার সঙ্গে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

বলুন?

এখানে না। আমার সঙ্গে আসুন।

আরাফ জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার সঙ্গে এলো। দরজা খুলতেই সে অবাকে চরম শিখরে পৌঁছে বলল, এসব আপনি করেছেন? সিরিয়াসলি!

আমি তার সামনে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়লাম,
আরাফ বললো আয়হায় কি করছেন আপনি উঠুন।

প্লিজ আরাফ আমি যা করছি করতে দিন। আরাফ আপনাকে আজকে আমি কিছু কথা কনফেস করবো। আমি যখন বিয়ে করে আপনার বাড়িতে পা রাখি এর আগ অবধি আপনার সম্পর্কে জানার কোনো বিশেষ আগ্রহ আমি দেখাইনি। এমনকি কাবিনে সাইন করার সময়ও দেখিনি বরের নামটা কি। বলতে পারেন একদম অচেনা একটা মানুষের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে আমি আপনার বাড়িতে এসেছিলাম। আমি ভাগ্যবতী বলেই আপনার আর আপনার পরিবারের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। আপনি আমার প্রতি অনেক যত্নশীল, আমার সবকিছু আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।
আরাফ আমি ব্রোকেন হার্টেড গার্ল। আমার অতীত আছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি অসতী নই। কোনো মেয়েই তার বরকে অতীতের কথা বলতে চাইবেনা, কিন্তু আপনি আমার বিশ্বস্তের জায়গাটা এমনভাবেই অর্জন করেছেন আমি আপনাকে বলতে ভয় পাচ্ছিনা। আরাফ আমি জানি আপনি আমায় বুঝবেন, আমার অতীত আপনাকে বদলাবে না।
আমি আপনার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চাই, তাই এসব কথা আপনাকে জানাচ্ছি।

আরাফ আপনি আমার চোখে অনেক সম্মানীয় ব্যক্তি। আপনার স্থান আমার মনের কোথায় আমি হয়তো কখনোই বলে বোঝাতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম আমার দ্বারা আর কোনোদিন ভালোবাসা হবে না। আপনি আমার ধারণা বদলে দিয়েছেন। আমি নতুন করে আবার প্রেমে পড়েছি। পরিপক্ক আমিটা চাইছি আপনাকে পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসতে। আপনি যেমন করে আমায় ভালোবাসেন ঠিক তেমন করেই আপনাকে ভালোবাসতে। আপনার সঙ্গে আমি অনেক অন্যায় করেছি, আমি রোজ ভাবতাম স্ত্রীর দায়িত্ব আমি ঠিকঠাক পালন করছি। অথচ আমার আসল দায়িত্বটাই এড়িয়ে গেছি। আপনি আমায় কতভাবে বুঝিয়েছেন, আমি ওসবের আসল অর্থ বুঝিনি। আপনি বারবার বলেছেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসবেন না, আমার যে আগ বাড়িয়ে আসার দরকার ছিল আমি বুঝিনি। আপনাকে তো ভালোবেসেছি বহু আগেই তবু কেন এতোদিন দূরে সরেছিলাম জানিনা! আমায় আপনি ক্ষমা করুন আরাফ। আমার জন্য আপনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান আমার ছিল না। এই নির্বোধকে ক্ষমা করে গ্রহণ করুন প্লিজ।

আরাফ আমার মুখোমুখি বসে বললো, রেবা আপনাকে আমি নিষেধ করেছিলাম কাঁদতে। আপনি তারপরও কাঁদছেন?

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আপনি ভীষণ ভালো আরাফ, আমি আপনাকে কোথায় তুলে রাখি বলুন তো? আমার যে বড্ড ভয় হয় আপনার যত্ন আমি করতে পারবো কি না,

হুসস। এতো কথা বলতে পারেন আপনি! সবসময় এমন করে ভাবেন কেন শুনি?

আমি তার শরীরে ভার ছেড়ে দিয়ে বললাম, আমার একদম ভালো লাগছে না, একদম না। আমায় তুলে ধরুন তো। আমার মন ভালো করে দিন।

আরাফ আমায় কোলে তুলে বলল, এখুনি মিইয়ে পড়লে তো চলবে না, আমার দশ মাসের উপোস ছুটবে, বুঝতে পারছেন তো?

আমি লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢাকলাম। আরাফ হাতের উপরেই চুমু খেয়ে বললো, রেবা আপনি চোখ জলসানো সুন্দর। আমার না যেন আজ‌ জ্বর উঠে যায়!

আমি হাত সরিয়ে চোখ বড় বড় করে বললাম, জ্বর আসবে কেন!

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার অধরজোড়া দখল করে নিলো।

রেবা আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি, সত্যিই অনেক ভালোবাসি। আপনি জানেন না আপনাকে পেয়ে আমি কতোটা সুখ অনুভব করছি। আমার তরঙ্গিনীর মাঝে ডুব দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হলো অবশেষে।

আমি তার গালে গভীর করে চুমু খেয়ে তার কান্না মুছে বললাম,আমি ও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আমায় অনেক আদর করুন না। আপনার উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত করুন না প্লিজ,,,

আরাফ তার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে গভীর স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে লাগলো তার প্রিয়তমার প্রতিটি অঙ্গে,,,

চলবে,,,,