তরঙ্গিনী পর্ব-২৩+২৪

0
365

#তরঙ্গিনী (পর্ব-২৩)

#আরশিয়া_জান্নাত

ভাবী একটু মায়ের রুমে যাবে?

কি হয়েছে রুহি? সিরিয়াস কিছু?

রুহি মুখ মলিন করে বলল, মা পিহু বড় আপা গলা ধরে কান্নাকাটি করছে, আমার ভালো লাগছে না,,

রেবা ওর মাথায় পরম মমতায় হাত রেখে বলল, মন খারাপ করোনা, এই সময়টা বড্ড নাজুক। চলো গিয়ে দেখি।

ভাবী তুমি যাও, আমি যাবোনা।

রেবা কিছু বলল না। দোতলায় তার শাশুড়ির রুমে গেল। সেখানে এলাহী কান্ড ঘটে গেছে, সব চাচীরা ফুফুরা উপস্থিত হয়ে গেছেন।

এসো বৌমা তুমিই বোঝাও তোমার শাশুড়িকে, মেয়েকে বুকে নিয়ে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন। থামার নামই নিচ্ছেনা। এদিকে সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে, ওকে গোসল করিয়ে সাজাতে হবে।

রেবা তার শাশুড়ির পাশে বসে বলল, মা! আপনার কষ্ট হয় এমন কিছু করার ইচ্ছে আমাদের কারো নেই। আপনি যা চাইবেন তাই হবে। মেঝ চাচী বাবাকে ডাকুন। ফাহিম ভাইয়াদের ফোন করে বলে দিতে হবে ওনারা যেন বরযাত্রী না আনে।

বড় ফুপি বললেন, কি বলছো বৌমা এসব?

আপনিই বলুন ফুফু আপনাদের কাছে কোনটা বড়, পিহুর বিয়ে নাকি আপনাদের ভাবীর সুখ? আচ্ছা আপনাদের কিছু করতে হবে না। আমিই কল দিচ্ছি। এই বিয়ে ক্যানসেল।

রেবার সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে সবাই ভড়কে গেল, রেহানা কান্না থামিয়ে বলল, দেখো মেয়ের কান্ড। এই রেবা তুই কি পাগল? একটু কান্নাও করতে পারবোনা আমি? মেয়ের বিয়ে দিবো একটু মনভরে কাঁদতেও পারবোনা? এ তো দুঃখের কান্না না, সুখের কান্না। এই পিহু উঠ, যা গোসল সেরে নে, বেলা পড়ে যাচ্ছে। সবাই এখানে বসে আছ কেন? বিয়ে বাড়িতে বসে থাকা যায়? যাও না কত কাজ পড়ে আছে। উফ আমিও পারিনা ভাই, এই সংসারে আমি না থাকলে কি হবে আল্লাহ ভালো জানেন। বৌমা যা মা ওকে নিয়ে যা। কাউকে ফোন করতে হবেনা, আমার মেয়েকে ওরা নিয়ে যাক। অনেক জ্বালিয়েছে আমায় এবার পরের ছেলেকে জ্বালাক,,,

সবাই চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলল। বড় ফুফু রেবার মুখ ছুঁয়ে আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে বলল, তোর বুদ্ধি আছে মাশাআল্লাহ! তুইই পারবি তোর শ্বশুড় শাশুড়ীকে আগলে রাখতে। বেঁচে থাক মা!

রেবা পিহুকে নিয়ে ওর রুমের দিকে যাচ্ছিল তখন পিহু বলল, ভাবী তুমি কি সত্যিই বিয়ে ভেঙে দিতে? তোমায় আমাদের এখানের সবাই একটু ভয় পায় জানো? মনে হয় তুমি যা বলবে তাই করে ছাড়বে,, আমি তো ভয়েই শেষ। দেখো এখনো বুক ধুকপুক করছে,

বিয়ের আগেই এই হুম? ফাহিম ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসো তাই না?

পিহু রক্তিম হয়ে মাথা নাড়িয়ে হুম বলল।

রেবা হাসলো।

বিয়ের ফাংশন কমিউনিটি সেন্টারে হওয়ায় সবাই রেডি হয়ে সেখানে যাচ্ছে। আরাফ সবাইকে পাঠিয়ে লাস্ট গাড়িতে উঠলো। যাওয়ার পথে পার্লার থেকে পিহু, রুহি, রেবাকে পিক করে ভেন্যুতে নিয়ে যাবে এমনটাই পরিকল্পনা। তখনি কোত্থেকে সানজেনা এসে হাজির

একি সাঞ্জু তুমি যাওনি?

না ভাইয়া আমার লেট হয়ে গেল আসতে, সবাই কি চলে গেছে?

হুম। আচ্ছা গাড়িতে উঠো।

সানজেনা ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতে দরজা খুলতেই আরাফ বলল, কাইন্ডলি পেছনে বসো, আমি পথেই রেবাকে পিক করবো।

তখন পেছনে চলে যাবো এখন বসি?

সরি,আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড!

সানজেনা আর কিছু না বলে পেছনে গিয়ে বসলো।

টিপ্পনী কেটে বলল, তোমার ওয়াইফের কি ন্যারো মাইন্ড নাকি? আই মিন সন্দেহ করে বেশি? ভরসা নেই?

আরাফ ড্রাইভ করতে করতে বলল, ভরসা করলে বুঝি নিজের কেয়ারফুল থাকতে নেই? আমার তো মনে হয় তার সামনে যেমন থাকি পেছনেও তেমনি থাকা শ্রেয়।

যেমন?

যেমন,, আমি ড্রাইভ করার সময় এই জায়গাটা তার জন্য বরাদ্দ এটা সে জানে। এখন তার অনুপস্থিতিতে আমি অন্যজনকে বসতে দিলে বরাদ্দকৃত জায়গার অপব্যবহার হবেনা? যেটা তার সেটা তারই। এখন সে উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক।

একটা সামান্য সিট নিয়েও এতো সিরিয়াস?

আমি তার প্রতি অনেক সিরিয়াস। এখন সেটা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন

ওহ ভালো!

পার্লারের সামনে এসে আরাফ বলল তুমি গাড়িতে বসো আমি ওদেরকে নিয়ে আসছি।

ওকে

আরাফ পার্লারের ভেতর গেল ওদের আনতে, তখন সানজেনা গাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসলো, সিটবেল্ট লাগিয়ে এমনভাবে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে আরম্ভ করলো লাইক ও এখানেই বসে ছিল।

রুহি আর মারজান(সেজ চাচীর বড় মেয়ে) পিহুকে নিয়ে গাড়িতে বসলো। ওরা সানজেনাকে দেখে অবাক হলো বটে। রুহি বলল, আপু আপনি পেছনে আসুন, ভাবী ওখানে বসবে,,

সানজেনা বলল, ওহ হ্যাঁ আমাকে এখানে বসতে দেখলে আবার ভাবী কি না কি মনে করে!

বলল অথচ তবুও উঠলো না। রুহি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। মেয়েটা চাইছে কি? এখনো উঠেনা কেন?

আরাফ রেবার দিকে তাকিয়ে বলল, মাশাআল্লাহ! আমার বৌটা এমনিতেই অপ্সরা, সাজলে তাকে সম্রাজ্ঞীর মতো লাগে,,

রেবা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলল, আপনিও না সবসময় বাড়িয়ে বলেন।

নাহ সত্যি। একটু দাঁড়ান একটা ছবি তুলি,,
দারুণ!

আচ্ছা চলুন সবাই ওয়েট করছে তো।

আরাফ বলল, কুচি সামলে নামুন, দেখি আমি আগে নামছি, আপনি দেখে পা ফেলবেন।

রেবা চারদিকে তাকিয়ে বলল, আরাফ আমি নামতে পারবো, আপনার কথা শুনে দেখুন সবাই তাকিয়ে আছে।

সো হোয়াট? দেখি আমার হাত ধরুন, কুচিটা হালকা করে উপরে তুলে নামবেন কেমন?

আচ্ছা।

রেবা ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো, আরাফের ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে এর আগে কখনো শাড়ির সাথে হিল পড়েনি!

মারজান বলল, দেখ তোরা আরাফ ভাইয়া কি করছে,

সবাই তাকিয়ে দেখে আরাফ ছোট ছোট কদম ফেলে রেবাকে নিয়ে আসছে, যেন একটু নড়চড় হলেই রেবা পড়ে যাবে।

পিহু বলল, আমার ভাইয়া ভাবীকে একটু বেশিই কেয়ার করে। একদম রাণীর মতো রাখতে চায়।

রুহি— রব নে বানা দি জোড়ি!

রেবাকে দেখে সানজেনা গাড়ি থেকে নামলো। আরাফ অনেক অবাক হলেও রেবা এটাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না। যেন সানজেনা এখান থেকে বের হওয়া অস্বাভাবিক না। আরাফ রেবাকে যত্ন করে গাড়িতে তুলে সিট বেল্ট বেধে দিলো, তারপর দরজা বন্ধ করে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো।

সানজেনা অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে বলল, ভাবী সিটবেল্ট বাঁধতে পারেননা এখনো?

রেবা হেসে বলল, পারি তবে উনি নিজে বেধেই নিশ্চিন্ত হন।

আরাফ ভাইয়া যে এতো ন্যাকামো করতে পারবে আমি ভাবতেও পারিনি। একদম নিব্বা টাইপ বর,,,হিহিহি

ওর হাসিতে কেউ যোগ না দিলেও আরাফ দ্বিগুণ জোরে হেসে বলল, তুমি একদম ঠিক বলেছ, তোমার ভাবীর আগমনে আমার বয়স ১০বছর কমে গেছে। ভালো নামকরণ করেছ। এই রেবা আমি নিব্বা হলে আপনি তবে নিব্বি তাই না? দেখেছেন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও আমরা নিব্বা নিব্বি হয়ে গেছি! হাহাহা

সানজেনা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখ করে কানে ব্লুটুথ গুজলো।

রুহি আর পিহু মিটমিট করে হাসতে লাগলো।


রেবা আর আরাফ যখন কমিউনিটি সেন্টারে একসঙ্গে ঢুকলো, তখন কয়েকজন মহিলা বলল, দেখেন আরাফ চৌধুরী আর তার ওয়াইফকে। কি দারুণ মানিয়েছে তাদের না?

হুম আসলেই। তবে শুনেছি মেয়ের ফ্যামিলি অতোটা হাই না।

ছেলের বৌ আনতে হয় নিজের চেয়ে লো ক্লাসের। তবেই ভালো হয়। কথার নীচে থাকে।

তা যা বলেছেন।

আরেকজন যোগ দিয়ে বলল, কার কথা বলছেন আরাফের? ও ওর ওয়াইফের জন্য যা পাগল! এসেছেন যখন দেখবেন, এক মুহূর্ত হাতছাড়া করবেনা। সবাই তো বলে ওর মতো বৌ পাগল লাখে একটা।

হাহাহা, সবে তো বিয়ে হয়েছে। প্রথম প্রথম সবাইই একটু কনসার্ন দেখায়।

তৌকির মহিলাদের গসিপ শুনে একটু আগ্রহবোধ করলো কাকে নিয়ে এতো আলোচনা হচ্ছে দেখতে। আরাফকে দেখলেও তার ওয়াইফকে দেখলো না। তৌকির ফোন কানে তুলে বললো, হ্যাঁ রাইসা বলো?

একটু কষ্ট করে ওয়াশরুমে আসো তো, বাবু পটি করেছে। আমি একা সামলাতে পারছি না।

আচ্ছা ওয়েট করো আমি আসছি।
তৌকির অনেকটা বিরক্ত হলো, এজন্যই সচরাচর বিয়ের দাওয়াতে বৌ বাচ্চাকে আনেনা। বাচ্চাসহ বিয়ে এটেন্ড করা বাইক্কা অশান্তি! কিন্তু ফাহিম এতো করে বলল, না এসে পারলো না। ফাহিম ওর ছোটভাইয়ের বন্ধু। ঢাকায় থাকাকালীন তার সাথে অনেক সখ্যতাই গড়ে উঠে। ছেলেটার বিয়েতে না আসাটা সমিচীন নয় ভেবেই তৌকির এসেছে। এখন মনে হচ্ছে একা আসলেই ভালো হতো।

বর এসেছে এমন একটা হৈ হৈ কলরবে চারদিক মুখোরিত হয়ে গেল। রুহি আর পিহুর বান্ধবীরা সবাই গেইটে দাঁড়ালো। রেবা পেছনে এক কোণায় দাঁড়িয়ে ওদের বাদানুবাদ দেখছে। তর্কাতর্কি শেষে একটা ভালো এমাউন্ট হাসিল করে সবাই ফাহিমকে বরণ করে ভেতরে ঢুকলো। আরাফ কোত্থেকে দৌড়ে এসে রেবার সামনে দাঁড়িয়ে গেল,যেন সেই ভীড়ে তার কিছু না হয়। রেবা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। আরাফ পেছনে ফিরে বলল, কি ব্যাপার হাসছেন কেন?

আপনি যেভাবে দৌড়ে এলেন, একদম নায়কের মতো লেগেছে।।

আপনিও না খুব বোকা। এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছেন কেন?

আমি ভাবলাম একপাশে দাঁড়িয়ে থাকাই সেইফ! ওদের এসব দেখতে ভালোই লাগছিল।

আচ্ছা। এখানে অনেক গেস্ট হবে, আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি শেষ হতে পারবোনা। আমার পাশে পাশেই থাকুন।

তৌকির ওর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে বলল, বাপরে এই লোক দেখি আসলেই সাংঘাতিক বৌ পাগল! এ কি বাচ্চা মেয়ে যে মেলায় হারিয়ে যাবে। হঠাৎ পরিচিত হাসির শব্দ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখে, রেবা!

রেবা হেসেই বলল, যথা আজ্ঞা!

তৌকির চমকে যায় ভীষণ। রেবাই তাহলে আরাফ চৌধুরীর ওয়াইফ? তৌকির রেবাকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দেখলো। এটা সত্যিই রেবা? রেবার বেশভুষায় ওর সৌন্দর্য যেন অনেকগুণ বেড়ে গেছে, ওর হাসিমুখ দেখে ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিনচিন করে উঠল।
রেবাকে এভাবে দেখবে এ সে স্বপ্নেও ভাবেনি। রেবা আরাফের হাত ধরে হাসতে হাসতেই চলে গেল। তৌকির ওদের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো পলকহীনভাবে,,

তৌকির স্টেইজের সামনে অতিথিদের বসার জায়গায় বসে রইলো। সেখানে বসেই পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো রেবাকে। রেবাও ভাবী হবার কর্তব্য পালন করতে বেশ কয়েকবার স্টেজে উঠে,নামে। একেবার একেক কাজে আসা যাওয়া চলছেই। এতে তৌকিরের তাকে দেখতে আরো সুবিধা হয়। তৌকির যতদূর জানে মেয়ের বাড়ির লোকেরা বিশাল পরিবার, টাকাপয়সার অভাব নেই। এই ভরা সংসারে রেবা যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যে কেউ দেখলেই আঁচ করতে পারবে। তৌকির হিসাব মেলাতে পারছেনা, রেবার মতো মেয়ে এখানে কিভাবে সম্ভব!!

রাইসা বলল,, এই বিয়ে পড়ানো তো হয়ে গেছে। এখনো খাবেনা? চলো না আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।

তৌকির বলল, হু চলো।

ঐদিকে বর কনে যে টেবিলে খেতে বসেছে তার পাশের টেবিলেই তৌকির আর তার স্ত্রী বসেছে। তৌকিরের বরাবর সামনে রেবা আর আরাফ বসে। ওরা ওকে না দেখলেও ও খুব সহজেই ওদের দেখছে।

আরাফ নিজ হাতে ওর প্লেটে এটা ওটা তুলে দিচ্ছে, মাঝেমধ্যে খাবার মুখেও তুলে দিচ্ছে। আর কিসব বলে দুজনেই হাসছে। ওয়েটার রেবার পাতে সরষে ইলিশ তুলে দিতে চাইলে আরাফ তাকে থামিয়ে বলল, মাছ দিবেন না ওনার ইলিশ মাছে এলার্জি আছে।

ওখানে সবাই নানারকম হাসি ঠাট্টা করছিল। সাধারণত বর কনে খেতে বসলে যা হয় আর কি। হঠাৎ মুহতাসিম উঠে বলল, ফাহিম ভাইয়া পারফেক্ট বর হতে চাইলে আরাফ ভাইয়াকে ফলো করবেন। তাহলে সিওর আপনাদের ম্যারিড লাইফ জোশ হবে।

রুহি বলল, এক্স্যাক্টলী। ভাইয়া থেকে শিখুন কিভাবে সবার মাঝে থেকেও নিজের ওয়াইফের যত্ন নিতে হয়।

রেবা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল, আরাফ বলল, তোদের সিসিক্যামেরা সবসময় এদিকেই তাক হয়ে থাকে কেন? বরকনের দিকে ফোকাসড থাক না,

কি করবো বলো আমাদের আইকন তো তোমরা, বড়টা যে হালে যায় আমরা ছোটরাও সেই পথ অনুসরণ করি হেহেহে।

তৌকিরের বুক ভার হয়ে এলো। সে বুঝে পায় না এই বিষাদতা কিসের, রেবা আর ওর নেই বলে, নাকি রেবা ওকে ছাড়াও অনেক সুখে আছে বলে? বুকের ভেতর কিসের হাহাকার বিরাজমান?

রাইসা বলল, এই কি হয়েছে তোমার কিছুই দেখি খাচ্ছ না!

তৌকির বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠো, শরীরটা ভালো লাগছে না।

না খেতে চাইলে বাবুকে রাখো, আমি একটু শান্তিতে খেয়ে উঠি!

তৌকির হাত মুছে তার ছেলেকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। এই কমিউনিটি সেন্টারের বিশাল হলটা তার কাছে দমবন্ধকর মনে হচ্ছে, এখানে একটুও অক্সিজেন নেই। একটুও না,,,

চলবে,,,,,,

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৪

#আরশিয়া_জান্নাত

মানুষের মাঝে একটা অদ্ভুদ পশুত্ব বিদ্যমান। সে সবসময় অন্যের সুখে সুখী হতে পারেনা। হয়তো উদারমনা মানুষ মুখে বলে ও সুখে থাকলেই আমিও সুখি। কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা হলো, আপনি যাকে একসময় ভালোবাসতেন বা যে আপনাকে একসময় খুব ভালোবাসতো, তার দুঃখী চেহারা কিংবা আপনার অনুপস্থিতির ছাপ তার মাঝে স্পষ্টত দেখাই মনের অজান্তে কল্পনা করেন। যখন সেটা হয়না না চাইতেই মন খারাপ হয়। আমরা যাকে ভালোবাসি, যে আমাদের প্রাক্তন, তাকে সুখে থেকো বলাটা সহজ হলেও- সে আমাদের ছাড়া ভালো আছে কিছু ক্ষেত্রে দিব্যি সুখেও আছে এটা আমাদের মেনে নেওয়া সহজ হয়না। বুকের মাঝে একটা তীব্র হাহাকার ঠিকই জানান দেয় ও কেন ভালো আছে? আমায় ছাড়াও কেন এতো ভালো আছে?

এই কঠিন সময়টা রেবা পর করেছে। তৌকির ওকে ভুলে গেছে, একটা মিষ্টি মেয়েকে নিয়ে সংসার পেতেছে, তার জমানো দীর্ঘ বছরের প্রেমকে পায়ে পিষে কি অনায়াসেই না চলে গিয়েছিল সে? মানুষের মন এত পাষন্ড হতে পারে, এতো বছরের স্মৃতি যাকে একটুও কষ্ট দেয় না,ভাবায় না, সেই মানুষটার জন্য কত রাত রেবা চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়েছে। সময়ের সাথে আরাফের প্রচেষ্টায় রেবা ঐ কঠিন মায়া ভুলে এগিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বুকের মাঝে রয়ে যাওয়া দগদগে ক্ষতটা কি এতো সহজে নিশ্চিহ্ন হয়?
তৌকিরের ধারণা ছিল রেবার অতো সহজে বিয়ে হবেনা, বা হলেও মধ্যবয়স্ক কারো সাথেই হবে। রেবা হয়তো এখনো ওকে ভেবেই। কান্নাকাটি করে, মুভ অন করা রেবার পক্ষে অসম্ভব। এমনই এক আত্মঅহং এ ডুবেছিল সে। নিজেকে দামী মানুষ বলেই মনে হতো, বাবাহ ওর জন্য একটা মেয়ে এখনো কাঁদে এটা কি কম গর্বের? এতে যে পৈশাচিক আনন্দ মেলে তার কি সংজ্ঞা দেওয়া যায়? রাইসা যখন তাকে মাঝেমধ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে, তৌকির তখন এই ভেবে শান্তি পায় এই পৃথিবীতে একজন আছে যে ওকে মাথায় তুলে রাখে। দূরে হলেও ঠিকই তার জন্য দোআ করে।
অথচ তৌকির ভুলে যায় অনাদরে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কিছুই টিকে থাকেনা। আর এ তো রক্তেমাংসে গড়া মানুষের পরিবর্তনশীল মন! এই পৃথিবীতে কারো অনুভূতিকে অবজ্ঞা করা কত নির্মম!

আরাফের সঙ্গে রেবাকে দেখে তৌকিরের বহু বছরের দাম্ভিকতায় আঘাত হানে। রেবাকে কেউ একজন রাণীর মতো আগলে রাখতে পারে এ যেন তার কাছে আকাশ কুসুম কল্পনা।

তৌকিরের হঠাৎ করেই মনে হতে থাকে রেবার সেইসব বৈশিষ্ট্য যার আকর্ষণে সে কতদিন উন্মাদ ছিল। রেবা! হ্যাঁ রেবা, সেই সদ্য অঙ্কুরিত হওয়া পুষ্পের ন্যায় কোমল কিশোরী মেয়েটা। তারুণ্যের দোরে পা রাখার আগ মুহূর্তে মেয়েদের সৌন্দর্যের যে আভা ছড়ায় তার সামনে পৃথিবীর কোনোকিছুর তুলনা হয়না। রেবার হাসি, চোখের লাজুক চাহনী, কথার বলার সময় মাথা নীচু করে উড়নার কোণে আঙুলে প্যাঁচানো, ভয়মিশ্রিত কন্ঠে রাতের ফোনালাপ, সবকিছু যেন ক্রমান্বয়ে প্রতিফলিত হতে থাকে মানসপটে। তৌকিরের মনে তীব্রভাবে জেগে উঠে কয়েকবছর আগের অতীত হওয়া ধুলোবালিতে জমা প্রেম! নিজেকে মনে হয় অনেক বিভৎস কীট। কিভাবে পেরেছিল সে রেবার সকল ত্যাগ তিতিক্ষাকে ভুলে যেতে? মেয়েটা কত কিই না করেছিল ওর জন্য, অথচ ও বিনিময়ে কি দিয়েছিল? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। কিন্তু সেই ভাবনা স্থায়ী হবার সময় পায়না। রাইসার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে সে,

চলো বরকনের সঙ্গে ছবি তুলি।

এখন তুলতেই হবে?

ওমা বিয়েতে আসছি যে ছবি আপলোড করবো না? তাছাড়া সাফিনকে দেখাবা না ওর বন্ধুর বিয়ে কেমন হলো!

ওহ হ্যাঁ। চলো।

তৌকিরকে দেখে ফাহিম হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করে জড়িয়ে ধরলো।

ভাইয়া আপনি এসেছেন! অসংখ্য ধন্যবাদ। আস্সালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন তো? খাওয়া হয়েছে আপনাদের?

হ্যাঁ, তোমার কথা কত শুনি তোমার ভাইয়ার কাছে। এসে অনেক ভালো লেগেছে। অনেক অনেক শুভ কামনা তোমাদের জন্য

থ্যাঙ্কস।

এই সেলফি তুলো না,

তৌকির ফোন বের করে হাসিমুখে সেলফি তুলল।

রেবা তখন আশেপাশে না থাকায় তাকে দেখল‌ না।

আরাফ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে রইলো, রেবা তাঁর কাধে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। সারাদিন এতো দৌড়ঝাপের মধ্যে ছিল এক দন্ড রেস্ট করার সময় পায়নি। এখন ঘাড়মাথা ধরে এসেছে যেন।
রেবা মোলায়েম স্বরে বলল, এখন কেমন লাগছে?

অনেকটা ভালো লাগছে, থ্যাঙ্কস।

রেবা মাথার পেছনে আঙুল দিয়ে আলতো করে ম্যাসাজ করে বলল, একটু পরেই তো পিহুকে নিয়ে যাবে, সেই পর্যন্ত একটু কষ্ট করুন। বাসায় গিয়ে হট শাওয়ার নিবেন, আরাম লাগবে।

আরাফ রেবা পেটে হেলান দেয়ে মাথা উঁচু করে বলল, আপনি যে ম্যাসাজটা করছেন না ওতে আমি আরো ২৪ঘন্টা খাটতে পারবো। ডোন্ট ওরি!

দেখি আপনি আমার সামনে বসুন তো। আপনার উপরও কম ধকল যায় নি। জিরোন একটু,,

জিরোবো তবে এখন না। আপনার ভালো লাগলে চলুন ওখানের কি হাল দেখি।

হুম চলুন।

রেবা শাড়ির আচল ঠিকঠাক করে কুচি সামলে এগোতে লাগলো। তখনই তৌকির আর রাইসা ওদের সামনে দিয়ে আসছিল। রেবা তৌকিরকে দেখে ভীষণ চমকে গেলেও প্রকাশ করলো না, শান্তদৃষ্টিতে তার বৌবাচ্চাকে দেখে তৌকিরের চোখে চোখ রাখলো,
তৌকির ও রেবার দিকে চেয়ে রইলো, আরাফ ওর হাত ধরে কি সুন্দর কথা বলে বলে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে আরাফকে ভাগ্যবান বলেই মনে হচ্ছে তার।
রেবা আর তৌকির পাশাপাশি বিপরীত দিকে পথ অতিক্রম করলো। চারপাশের কোনোকিছু প্রভাবিত না হলেও দুটো মানুষের আত্মা একটু হলেও কেঁপে উঠেছিল
রেবা চোখের কোণ ভরে আসার আগেই হাসিমুখে আরাফের বাহু ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। একটিবারও পেছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করলোনা অতীত হয়ে যাওয়া সুখী মানুষটাকে,,, পিছু ফিরলেই দেখতো একজোড়া চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল তার দিকে যতদূর পর্যন্ত তাকে দেখা যায়।


ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পিহুকে বিদায় দিয়ে সকলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। আরাফ গাড়ি থামিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বোনকে বিদায় দেওয়ার পর প্রতিটা ভাইয়ের মন খারাপ থাকে, আরাফও তার ব্যতিক্রম নয়। রেবার ওর পাশে এসে বললো, মন খারাপ করবেন না। দোআ করুন ওরা যেন সুখী হয়।

জানেন রেবা বড় আপুর বিয়ের সময় আমি অনেক কান্না করেছিলাম। আপু চলে যাচ্ছে এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য তখন কঠিন ব্যাপার ছিল। আপু কত করে বুঝালো আবার চলে আসবে, আমরা সবাই গিয়ে তাকে নিয়ে আসবো। কিন্তু আমি তাকে ছাড়িনি। পরে আমায় সাথে নিয়েই আপু শ্বশুড়বাড়ি গেল। আজ দেখুন আমি বড় ভাই হওয়ায় তেমনটা করতে পারিনি। আমি এখন বড় হয়ে গেছি না? আমি কিভাবে সবার সামনে কান্না করে বলতাম আমার বোনকে নিও না? সময় বদলেছে কিন্তু অনুভূতি তো বদলায় নি।
আমিতো বদলাই নি!

রেবা আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি মন ভরে কাঁদুন আমি কিচ্ছু মনে করবোনা। কেঁদে আপনার মন শান্ত করুন।

আরাফ রেবাকে শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। রেবা মনে মনে বলল,আল্লাহ আপনি এই নরম দিলের মানুষটাকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুন।

রেবা বেলকনীতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো, তৌকিরের ছেলেটা অনেক কিউট হয়েছে দেখতে। তৌকির ভালোই আছে, কি সুন্দর পারফেক্ট ফ্যামিলি ওর। স্ত্রীকে নিয়ে অনেক ভালোই আছে হয়তো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, আমাদের গল্পের সূচনা একসঙ্গে হলেও সমাপ্তি ঘটেছে ভিন্ন দুটি চরিত্রের সাথে। তোমার গল্পের নায়িকা রাইসা, আর আমার গল্পের নায়ক আরাফ! তুমি ভালো আছ তৌকির, অন্য কারো সঙ্গে ঘর বেঁধেই ভালো আছ,,,অবশ্য আমিও অনেক ভালো আছি। হয়তো এটাই ছিল উপরওয়ালার লেখা। আমাদের আর কখনো দেখা না হোক,,,

রেবা!

জ্বি?

ঘুমাবেন না?

হ্যাঁ আসছি,
🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀

আরাফের মনমেজাজ একদম খারাপ হয়ে গেছে। নাহ সানজেনাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছেনা। মেয়েটার সমস্যা কি? এতোদিন বাসায় তাও মানা গেছে আজকাল অফিসে এসেও বিরক্ত করছে। এসবের মানে কি? আগে তো এমন ছিল না, এখন এমন হয়েছে কেন? বড় বোনের ননদ বলে চুপচাপ সহ্য করলেও এখন তার কার্যকলাপ মোটেই সহনশীল রইছেনা। রেবা এই পর্যন্ত অফিসে না আসলেও সানজেনা অনেকবার এসে গেছে। তাইতো সেদিন ও বলেছিল রেবা যেন অফিসে আসে। ওর সঙ্গে সময় কাটায়। এই সমস্যা দূর করতে কি করা যায়?

হঠাৎ রেবাকে আসতে দেখে ওর সব বিরক্তি নিমিষেই মিশে যায়। ওর ম্যানেজার রেবাকে আরাফের কেবিনে এনে বলে, ম্যাম এটা আরাফ স্যারের কেবিন, আপনি ভেতরে যান।

ধন্যবাদ ম্যানেজার সাহেব।

আরাফ উঠে এসে বলল, হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আপনি সত্যিই এসেছেন?

রেবার ওর চেয়ারে বসে চারদিকে তাকিয়ে বলল, এতো অবাক হবার কি আছে? আপনি যখন বলেছেন আমি আসবোনা?

নাহ সেটা না, তবে এমন সময় এসেছেন যখন আমার ভীষণ দরকার ছিল।

আপনার জন্য লাঞ্চ নিয়ে এসেছি। কোথায় খেতে বসেন, এখানেই?

হুম।

একজন এসে লাঞ্চবক্স দিয়ে গেল, রেবা বক্স খুলে আরাফের জন্য খাবার পরিবেশন করলো। নিন শুরু করুন।

আপনি খেয়েছেন?

হুম।

রেবা টেবিলের উপর রাখা ফটোফ্রেমে তাদের বিয়ের ছবি দেখে বলল, আপনি এই ছবিটা এখানে রেখেছেন, সুন্দর তো ছবিটা!

আপনার পাশে তোলা সব ছবিই সুন্দর। তবে এটা একটু বেশিই সুন্দর।

আমি জানতাম ছেলেরা নিজেদের ম্যারিড বোঝাতে পছন্দ করেনা, আপনি দেখি উল্টো! বিয়ের ছবি এটে বসে আছেন, দেখো সবাই আমার বৌ আছে! হাহাহা

শুনুন সবাই এক না, যাদের মনে অন্যকিছু আছে তারাই বিয়ের মতো সুন্দর ব্যাপারটা হাইড রাখে। আমিতো পারলে ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলতাম।

রেবা ওর পাতে আরেকটু তরকারি দিয়ে বলল, বলুন না বাধা দিয়েছে কে?
একটু থেমে ফের বলল, আরাফ! যা আপনাকে অনাকাঙ্খিত চিন্তায় ফেলেছে তা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিন। কিছু জিনিসকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলতে হয়। মেন্টালি প্রেশার নিয়ে না।

আরাফ চমকে তাকালো রেবার দিকে। রেবা রহস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসলো।

চলবে,,,