#তরঙ্গিনী পর্ব-২৭
#আরশিয়া_জান্নাত
তৌকিরের বাসায় হঠাৎ করেই রেইড করে দু*দ*ক। ওর নামে ঘু*ষ নেওয়ার এবং অ*বৈধ ডিলার পাস করার অভিযোগ উঠেছে। একটা সাধারণ সরকারী চাকুরিজীবি হয়েও কিভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে সে, তার ইনকাম সোর্চ এর সাপেক্ষে পারিবারিক আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী এসব যে সৎভাবে উপার্জিত নয় যে কেউ অনায়েসে আঁচ করতে পারবে। বেশি না রাইসার আলমারিভর্তি শাড়িগহনার হিসেব করতে বসলেই যে কারো চক্ষুচড়কগাছ হবে। তৌকিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে, আশেপাশের সব ফ্ল্যাটের মানুষ তার দরজায় ভীড় জমিয়েছে। তৌকির দ্রুত ভাবতে থাকে কি করা যায় কাকে কল করা যায়?
দু*দ*ক অফিসার ওর সব ফাইলপত্র নিয়ে পুলিশের সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। এতো অল্পদিনেই এতো টাকার মালিক হওয়ার মতো বাপ-দাদার সম্পত্তিও তার নেই,না শ্বশুড়বাড়ির আছে। তবে এসবের উৎস কি?
তৌকির মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, আপনাদের ভুল হচ্ছে, আমি আপনাদের এক্সপ্লেইন করতে পারবো। প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।
আপনার বিরুদ্ধে আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে তৌকির সাহেব!
তৌকির মনে মনে বলল, এমনভাবে কস হা*লারপুত যেন এদেশে আমি একাই ঘু*ষ খাই তোরা ধোঁয়া তুলসি পাতা? সব আসছোস ধান্দা করতে বুঝি না আমি?
তৌকির মেইন পরিদর্শককে আড়ালে নিয়ে কিছু টাকা অফার করার ট্রায় করলো। বাট উনারা ঐসব কানে তুললেন না। বললেন, আপনার কে*ইসটা উপরের থেকে নজরদারি করা হচ্ছে। এখন মানে মানে ঢাকা ছাড়ার ফুরসত পান কি না ভাবুন! মনে তো হচ্ছেনা মানসম্মান আর থাকবে আপনার।
কিন্তু আমার উপরেই কেন? কে আছে এর পেছনে?
এসব তো আমরা জানবো না। আমরা জাস্ট অর্ডার পালন করছি। একটা কথা বলি আমরা সরকারী লোক সেই হিসাবে আপনি আমাদের ভাই ব্রাদার। আপনি বড় কাঁচা খেলোয়াড়। টাকার কামড় সহ্য করা খুব কঠিন। চারপাশে ভালোমতো চোখ কান খোলা রেখে আগানো উচিত ছিল আপনার। যাই হোক গ্রামে বাপ দাদার ভিটা আছে তো?
তৌকির তরতর করে ঘামতে লাগলো, তবে কি তার সব শেষ হয়ে যাবে? চাকরী যে থাকবেনা এটা নিশ্চিত। যা জুড়িয়েছে তাও কি থাকবেনা? একদম খালি হাতেই কি তবে এ শহর ছাড়তে হবে!
নিউজপেপার থেকে শুরু করে প্রতিটি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল। তৌকিরের ছবি সব জায়গায়। মানুষও নতুন ইস্যু পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আত্মীয়স্বজন সবাই কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে কল দিচ্ছে। রাইসা নিজের গয়নাগাটি হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে, অকথ্য ভাষায় তৌকিরকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে, তার ধারণা তৌকির একটা ইউজলেস পুরুষ। নয়তো তার ঘরেই কেন দু*দ*ক আসে? ও যে এখন বাপের বাড়ি যাবে সেই মুখটাও নেই। এদিকে আশেপাশের সবাই যা নয় তা বলে যাচ্ছে। এসব আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। যারা আগে চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে সাহস করতো না তারাও কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। তৌকির আছে মহা ঝামেলায়। না বাইরে গিয়ে শান্তি না ঘরে শান্তি। কোথায় রাইসা তার এই বিপদের সময় সাপোর্ট দিবে, মেন্টালি সাহস জোগাবে তা না ও উল্টো বোম্বে মরিচ হয়ে পোড়াচ্ছে। এই কঠিন সময়ে এসে তৌকির রেবাকে মিস করতে থাকে। কত ইন্টারভিউ, এক্সাম সে দিয়েছে জীবনে। প্রতিবার একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই পায়নি। চাকরি পাওয়াই যেখানে কঠিন ব্যাপার সরকারী চাকরি তো সোনার হরিণ। অথচ রেবা সবসময় ওর পাশে থাকতো, মনোবল দিতো। ওর চাকরি হয়নি জানার পর কখনো ভ্রু কুচকে বলেনি “এখনো হলো না?” বরং সবসময় বলেছে, দেখবে একদিন খুব ভালো পদে টিকে যাবে, সেদিন এই ব্যর্থটাগুলোকেই আশীর্বাদ মনে হবে।
তৌকির নিজের ভাগ্যের উপর বিদ্রুপ করে বলতো, এইসব স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। বাস্তবে হবে বলে মনে হচ্ছেনা। মামা-চাচা ছাড়া এখন চাকরি মেলেনা।
রেবা ওর কাধে হাত রেখে বলতো, এতো হতাশ হচ্ছো কেন? মনোবল রাখো। জীবনে কোনোটাই স্থায়ী হয় না। না সুখ না দুঃখ। পার্থক্য এই দুঃখের সময়টা অনেক দীর্ঘ মনে হয় আর সুখেরটা স্বল্প,,,
তৌকির ভাবতে থাকে এই মুহূর্তে রাইসার জায়গায় যদি রেবা থাকতো সেও কি এমন বিহেভ করতো? নাকি আগের মতোই শান্তস্বরে স্বান্ত্বনা দিতো। মিথিলার কথাই কি তবে ফলে গেল? রেবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা অগ্রাহ্য করার ফলই বুঝি সে পেলো? এই চাকরি নিয়ে কত গর্বই না করেছিল সে, রেবাকে অযোগ্য বলেছে। ওর দীর্ঘ অপেক্ষাকে তুচ্ছ করে ওকে অপমান করতে কি যে আনন্দ লাগতো ওর। সবচেয়ে বেশি মজা লাগতো ওর কান্নার কল রেকর্ডিং রুমমেটদের শোনাতে। একটা মেয়ে ওর জন্য কান্নাকাটি করছে, ও গালি দেওয়ার পরো স্যরি বলছে, এসব দেখে ওর রুমমেটরা যখন বিস্মিত হতো- গর্বে ওর বুকটা ভরে যেত। অবশ্য এদের মধ্যে একজন সবসময় বলতো, দোস্ত যাই বলোস না কেন এই মেয়ের মতো মেয়ে হয় না। ওরে কষ্ট দিয়ে পাপ করিস না। ভালোবাসার মূল্যায়ন করতে শিখ। তৌকির সেসব কানেই তুলতো না। চারদিকে তার রঙিন প্রজাপতি, জীবনটা উপভোগ করার মতো অঢেল উপাদানের হাতছানি। সেই মোহে পড়ে ভুলেই গেল সব। সুখে থাকার জন্য কত কিই না করলো। দামি ফ্ল্যাট, এয়ার কন্ডিশনড বেডরুম, অসম্ভব সুন্দরী স্ত্রী। আর কি চাই এক জীবনে? অথচ ভাগ্য তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো। আগে সে বেকার হলেও সম্মানীয় ছিল, কিন্তু এখন কোথাও মুখ দেখানোর মতো মুখও রইলো না। তৌকির গাঢ় ব্যথায় নীল হয়ে গেল। এই পৃথিবীর কোথাও কি তার লুকোনোর জায়গা নেই? সে কোথায় আত্মগোপন করে বাঁচবে?
।
মিথিলা– হ্যালো বান্ধবী কেমন আছোস? নিউজ পাইছোস?
রেবা– কিসের নিউজ তুই আবার কনসিভ করছোস?
মিথিলা– কি যে কস, সিজারের পর জান লইয়া বাঁচি না আবার কনসিভ, আমি বলতেছি ঐ হ্যাংলা তৌকিরের কথা। হালায় তো একদম ঠুসস
রেবা– মানে?
মিথিলা বিস্তারিত সব বলল রেবাকে।সব শুনে রেবা বলল, ওর সৎ থাকা উচিত ছিল। এতো চাহিদার দরকার ছিল না।
মিথিলা– তোর চাহিদা কম তাই তুই এমন বলছিস। খবর নিয়ে দেখ সিক্স ডিজিটের আশেপাশে জামাইয়ের ইনকাম না হইলে অনেক মেয়েরা ঘরে ঢুকতেও দেয় না। যাদের যত টাকা তাদের ততো বেশি ক্ষুধা। এজন্য তোর ভাইয়া বলে, বৌয়ের জিহ্বা যত ছোট স্বামীর ইনকাম ততো হালাল।
তুই ওই বেচারির দোষ দিচ্ছিস কেন? তৌকির যদি ভালো হতো তাহলে এতোকিছু হতো না। এখানে বৌয়ের কি দোষ?
সিরিয়াসলি ভাই তোর এটা মনে হয়? শোন তোরে একটা গল্প বলি। একটা লোক ছিল যার স্ত্রী তাকে সবসময় একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে বলতো আজ এসব লাগবে, যেভাবে পারো নিয়ে আসবে। তো স্বামী বেচারা যেখানে যেভাবে পারে টাকা আয় করে স্ত্রীর ঐ লিস্ট সম্পূর্ণ আনে। তো স্ত্রী ভাবে আরেহ বাহ আমার স্বামীর তো অনেক টাকা। অথচ সে জিজ্ঞাসা করেনা এটা কিভাবে এলো- ন্যায়পথে নাকি ভুল পথে। সে কেবল নিজের চাহিদার লিস্ট বানাতেই ব্যস্ত। একদিন ঐ লোকটা এক শায়েখের কাছে গিয়ে বিষয়টা বলে, তখন শায়েখ বলে দেখুন আপনার কৃতকর্মের জবাব আপনাকে দিতে হবে, আপনি যাদের জন্য অবৈধ ইনকাম করছেন তাদের আমলনামায় কিছুই আসবে যাবে না। না তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন।
পরে লোকটি ঐ নারীকে তালাক দিয়ে অন্য এক নারী বিয়ে করে। এবারের পরহেজগার স্ত্রী তাকে রোজ সকালে বলে শুনুন, যেখানেই রিজিকের সন্ধানে যাচ্ছেন মাথায় রাখবেন হারামের টাকায় বরকত নেই। আল্লাহ রিজিকে যা রেখেছেন অল্প হলেও হালালটাই চাই। আমি চাই না আপনি আমার জন্য জাহান্নামীদের খাতায় নাম তুলেন। তাই সৎ পথে থাকবেন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহই বরকত দিবেন। লোকটা নিশ্চিন্ত মনে সৎ পথেই ইনকাম করে, কোনোদিম কম কোনোদিন বেশি।অল্প হলেও তার স্ত্রী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেনা বরং শোকর আদায় করে। গল্পটা শুনে কি বুঝলি?
গল্পটা আমিও শুনেছি। তবে তুই জগাখিচুড়ি বানাইছোস মনে হচ্ছে।
মোরাল অফ দ্য স্টোরি ঐটাই ছিল। আমিতো মুখস্ত করে বসে থাকি নাই।
তবুও বোইন কারো সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখা ঠিক না।
তুই আসলেই সাফ দিলের মেয়ে। তুই খুশি না হইলেও আমি অনেক খুশি হইছি। বহুত উড়ছিল হারামজাদা। এখন এক্কেবারে জমিনে পইড়া চিৎপটাং হইয়া গেছে। সরকারী চাকরি পা** শিক ডু*কাই দিছে। এখন জেলে বইসা ভাব মারা সরকারী খানা খাচ্ছস যে তার। হেহেহে।
তুই এতো খারাপ ভাষায় কথা বলতে পারোস! উফফ
শোন নূর আমার কথা শুনে তোর মেজাজ গরম হতেই পারে। আমি কথায় রাগ ঝেড়ে ফেলি বলেই আমার বিপি নরম্যাল থাকে। নয়তো কত আগেই রাগের জন্য মরে যাইতাম।
তাও যা বলছোস।
যাক তোর খবর বল, কি হালে আছিস?
আছি ভালো তোর কি খবর?
ভালোই। এখন তো আরো বেশি ভালো।
তুই সিলেট আসবি কবে?
আমার এতো সময় আছে? বড়টারে স্কুলে দিছি তো। আরেক বন্দিজীবন শুরু। এখন বললেই আর ঘুরতে যাওয়া যাবেনা। বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার আগেই ঘুরে নে। এরপর আর পারবি না।
তোর অনেক কষ্ট হয়, না রে?
আরেহ না। দিনশেষে ওদের দেখলে মন ভরে যায়। পরের জন্য তো খাটতেছি না, নিজের স্বামী আর সন্তানের জন্যই করতেছি। জীবন এতেই সুন্দর। আমরা মেয়েরা সবসময় এটাতেই শান্তি পাই,,, কষ্ট হলেও প্যারা নাই।
ঠিক বলছোস।
আচ্ছা দোস্ত রাখি, তোরে খবরটা দেওয়ার জন্যই পেট গুড়গুড় করতেছিল। এখন অল ক্লিয়ার। কি যে শান্তি লাগছে তৌকিরের নিউজ দেইখা। সব তোর অভিশাপ বুঝছোস।
নারেহ আমি অভিশাপ দেই না। ওর পরিবারের কথা ভেবে খারাপ লাগছে।
তুই পারোসও। ঢঙ্গী। ভালো থাকিস বায়
তুইও ভালো থাকিস, টাটা।
রেবা বেলকনী দিয়ে সুদূর নীল আকাশে চেয়ে রইল। এটা সত্যিই নিয়তির খেলা? আল্লাহ সত্যিই এভাবে পরাস্ত করলো তৌকিরকে নাকি এ নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার? আচ্ছা তৌকিরের ছেলেটার কি হবে??
চলবে,,,,
#তরঙ্গিনী পর্ব-২৮
#আরশিয়া_জান্নাত
মানুষ মুখে যতোই বলুক তার সাথে অন্যায় করা মানুষটার শাস্তি হোক। কিন্তু মনের কোথাও না কোথাও একটু হলেও কষ্ট লাগে। এই মমত্ববোধ বা মনুষ্যত্ব এখনো আছে বলেই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। সবাই নির্মম হলে তা সম্ভব হতোনা। রেবা সবসময় চাইতো তৌকিরকে কষ্ট পেতে দেখতে। ও যেমন কষ্ট পেয়েছে তেমনটা পেতে দেখতে। রেবার মতো যাদের মন ভেঙেছে, তারা সবাইই হয়তো চায় বেঈমানদের শাস্তি হোক, অহঙ্কারের পতন ঘটুক। মজার ব্যপার হলো পৃথিবীতে আল্লাহ সবকিছুর শাস্তি না দিলেও ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটাই দেন। সেই শাস্তি যে ভোগ করে সে অনেকসময় বুঝে আবার অনেক সময় বোঝেনা কোন পাপের শাস্তি সে পাচ্ছে। এর একটা সহজ কারণ হলো স্বভাবতই মানুষ নিজের কৃতকর্ম ভুলে যায়। তাই শাস্তি হয়না, পায়না এই কথা বলার পথ নেই।
রেবা তৌকিরকে ভালোবাসতো এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতের বেশ বড় অংশজুড়ে যে মানুষটা ছিল তাকে এড়িয়ে গেলেও উপেক্ষা করা কি যায়? মানুষের মনটা বড়ই অদ্ভুদ। পশুপাখিকে দুটোদিন আদরযত্ন করে পোষ মানানো গেলেও মানুষকে পোষ মানানো যায়না। এই মন বড়ই নিষ্ঠুর! যুক্তি বোঝেনা, ভালোমন্দ বোঝেনা।
রেবার নিজেকে জঘন্য মনে হয়, মনে হয় ও আসলেই দুশ্চরিত্রা! নয়তো এখনো এই মন কেন তৌকিরের জন্য পুড়বে? তৌকিরের বিপদ শুনে কেন অস্থির লাগবে? ওর ভালোমন্দে ওর কি-ই বা এসে যায়? কেন সে পারছেনা আনন্দিত হতে? কোথায় বিঁধছে ওর?
রেবা ঘর অন্ধকার করে পড়ে থাকে। ওর এই মনখারাপের বিষাক্ততা ছড়িয়ে যায় পুরো শরীর জুড়ে,,
আরাফ দরজায় নক করে ভেতরে ঢোকে, লাইট জ্বালিয়ে বলে, কি ব্যাপার এমন অন্ধকারে বসে আছেন যে?
রেবা কপালের উপর থেকে হাত না সরিয়েই বলে, আলো চোখে লাগছিল,তাই।
আপনার কি শরীর খারাপ? মাথা ব্যথা করছে?
নাহ
তাহলে?
সবকিছুর কারণ থাকতে হবে? এমনি একটু শুয়ে থাকতে পারিনা? অন্ধকারে একা সময় কাটাতে পারিনা? আমায় কি একটু স্পেস দেওয়া যায়না? এতো কৈফিয়ত কেন দিতে হয়?
আপনি এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? আমিতো জাস্ট জিজ্ঞাসা করলাম। বললেই পারতেন একা থাকতে চাইছেন।
রেবা বুঝতে পারে ও অযথাই আরাফের উপর রাগ ঝাড়ছে, কিন্তু স্যরি বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। সে উল্টোদিকে ফিরে বলল, ভালো লাগছেনা আমার। কাইন্ডলি লাইটটা অফ করে অন্য ঘরে যান।
আরাফ লাইট অফ করে বেরিয়ে গেল। রেবা এই প্রথম তার সাথে এতো রুডলি কথা বলেছে। সে মনকে যতোই বলছে হয়তো ওর মুড অফ তাই এমন করেছে। ব্যাপার না! মন ততোই কু ডাকছে। তৌকিরকে কি এখনো ও ভালোবাসে? ওর খারাপ সংবাদ শুনেই কি তবে,,, না আর ভাবতে পারেনা। অতীতে কি ছিল না ছিল তা নিয়ে আরাফের মাথা ব্যথা নেই, তবে বর্তমানেও যদি রেবার মনে ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকে এটা আরাফ সহ্য করবেনা। আরাফ রেবাকে অনেক ভালোবাসে, ওর যত্ন করে, ওকে বোঝার চেষ্টা করে। ও কষ্ট পায় এমন কোনো কাজ ও পারতে করেনা। এতো ডেডিকেশন, এতো এফোর্ট সবকিছুই কি ঠুনকো তৌকিরের সামনে? তৌকিরের প্রতি রেবার অনুভূতি কি এতোই তীব্র যে আরাফের ভালোবাসা সেটা নিঃশেষ করতে পারেনা?
আরাফের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, মনে হয় রেবা ওকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারেনি। ও এখনো অতীতেই পড়ে আছে।
আরাফকে একা বসে থাকতে দেখে সানজেনা এসে ওর পাশে বসলো।
কি ব্যাপার ভাইয়া একা বসে আছ যে?
এমনি হাওয়া খেতে এসেছি।
তুমিতো এই টাইমে নিজের ঘর থেকে বের হওনা, আজ হাওয়া খেতে এসেছ? স্ট্রেইঞ্জ!
আরাফের নিজের রাগ সংবরণ করে হেসে বলল, স্ট্রেইঞ্জের কিছু নেই। অফিসে প্রেশার বেশি পড়লে আমি মাথা ঠান্ডা করার সময় নেই।
বাবাহ! মাথা ঠান্ডা করে ওয়াইফের কাছে যাও যাতে তার উপর প্রভাব না পড়ে! কেন সে বুঝি তোমার রাগ সহ্য করে না? তাকে ভালো দিকটাই দেখাও সবসময় মন্দ দিক দেখাও না? এ কেমন সম্পর্ক?
এখানে খারাপ কি পেলে?
অবশ্যই পেয়েছি। শোনো, আমরা যখন কাউকে পছন্দ করতে শুরু করি তার ভালোদিকগুলো দেখেই পছন্দ করি, শুরুরদিকে সেসবই আমাদের চোখে পড়ে। আরেকটু সহজ করে বলি, একটা মানুষের ভালোগুণ দেখে যে আকর্ষণটা হয় সেটা হচ্ছে পছন্দের প্রথম পর্যায়, এরপর ধীরে ধীরে মন্দ দিক নজরে পড়বে। দেখা গেল মানুষটার সব ঠিক আছে কিন্তু ভীষণ ঠোঁটকাটা, মুখের উপর অপমান করে দেয়। বা মেজাজ ভীষণ তিরিক্ষ রেগে গেলে কোনো হুঁশ থাকেনা। আবার হতে পারে তার কিছু বদঅভ্যাস আছে যা সে ছাড়তে পারেনা। কোনো মানুষই ১০০% পারফেক্ট না; দোষগুণ থাকবেই। তো যেসব পছন্দ এই দোষগুলি দেখার পরও কমেনা বরং আগের মতোই থাকে অর্থাৎ পছন্দের মানুষর দোষগুণ জেনেই মানুষটাকে মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকে তখনই সেটা ভালোবাসা বলে অভিহিত হয়। তুমি তাকে তোমার ভালো দিক দেখিয়েই মুগ্ধ করছো, খারাপ দিক দেখাচ্ছ না। কতদিন থাকবে এই মুগ্ধতা বলো?
তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে আমার খারাপ দিক ও দেখেনি?
ভেরি সিম্পল, আসার পর থেকেই শুনছি বিয়ের পর থেকে তুমি বদলে গেছ। আগের মতো রাগ নেই, ঠান্ডা হয়ে গেছ। এখন আবার তুমি নিজেই বললে মাথা ঠান্ডা করে রুমে যাবে জাস্ট বিকজ তোমার রাগ ও না দেখুক!! এসব কি আড়াল করা নয়?
তুমি কঠিন করে ভাবছো। বিষয়টা তেমন নয়।
আরাফ ভাইয়া! একটা কথা বলি শুনবে? আমরা মেয়েরা না ক্রিটিক্যাল মাইন্ডের। গোছানো পারফেক্ট ছেলে আমাদের টানেনা, আমরা মিষ্টি কথায় প্রেমে পড়লেও ভালোবাসি ঐ পাত্তা না দেওয়া ছেলেটাকেই। যে আমাদের কষ্ট দেয় তাদের প্রতিই আমাদের যত টান, যতো অনুভূতি। অথচ আমাদেরকে যে চায়, দিনরাত উজাড় করে ভালোবাসে তাদের প্রতি চাইলেও মন আনতে পারিনা। বড়জোর মায়ায় পড়ি!
আরাফ গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। সানজেনার কথাই কি তবে সত্যি? এজন্যই কি রেবা,,,,,,,
কোথায় ডুব দিলে?
নাহ বলো কি বলছিলে।
কালকে আমি চলে যাবো, আর কখনো বাংলাদেশে আসা হবেনা। আর আসলেও তোমাদের সঙ্গে দেখা হবেনা হয়তো। রেবা তোমায় ভালোবাসে কি না আমি জানিনা, তবে তুমি ওকে অনেক ভালোবাসো এটা আমি নিশ্চিত। আর সেজন্যই আমার ভীষণ পুড়ছে। আরাফ ভাইয়া আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, পছন্দের পরিধি কতটা হয়তো তুমি ভালোই জানো। ভয় পেও না, আমি তোমাদের মাঝে আর আসবোনা। জাস্ট কনফেস করছি। আমি চাই তুমি সুখে থাকো।
সানজেনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধরা গলায় বলল, আমার ভয় তোমার এই কঠিন ভালোবাসার মর্যাদা ও দিতে পারে কি না। আমি যদি কখনো সুযোগ পাই তোমার হাত ধরার, তবে সেটা ওয়েস্ট যেতে দিবোনা। Until then, আমি চুপ থাকবো। মাইন্ড ইট।
সানজেনা আরাফের কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করলো না।
আরাফ আকাশের দিকে ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলো। রেবা আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে পারেননি?এসব জাস্ট সম্পর্কের জোরে গড়ে ওঠা মায়া? আপনার কাছে আমি গোছানো পুরুষ তাই ভালোবাসা নেই? কিন্তু আমি গোছানো না রেবা, আমার অনেক দোষ আছে। যন্ত্রণায় আরাফের বুক ভার হয়ে যায়।
।
।
রুহি গাল ফুলিয়ে বলল, পিহু তুই বিয়ের পর এতো বদলে যাবি আমি কল্পনাও করিনাই।
কি করেছি আবার?
কি করেছিস? আসার পর থেকেই ফাহিমের এই ফাহিমের ঐ এসব বলে বলে কান পাকাচ্ছিস। কোথায় এতোদিন পর দেখা আমার কথা শুনবি জিজ্ঞাসা করবি তা না,,, তুই তো কলে পর্যন্ত আমার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলোস না। এতো পাষন্ড তুই!
তুই এতো রাগ করোস কেন? আমি কত বিজি থাকি জানোস? ঐখানে সবকিছু আমাকে দেখতে হয়। তার উপর নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে বসে থাকা যায় নাকি?
হুহ!
শুনেছিস একটা কথা?
কি?
কারিয়ান ভাইয়া আসছে,,,
কবে কখন?আমি জানিনা তো।
পিহু দোলনায় বসে বলল, এইতো কয়দিন পরেই আসবে। এরপর তুইও বিজি হয়ে যাবি। মন খারাপ করার সময়ই পাবিনা।
ঢং করিস না তো। উনি কি আর আমার কথা মনে রেখেছেন? এই পর্যন্ত আমাকে একটা টেক্সট পর্যন্ত করেনাই। কলেও কথা হয়েছে হাতে গণা কয়েকবার। আমার মনে হয়না তেমন কিছু হবে,,
সেটা আসলে বোঝা যাবে। দূর থেকে কিছু আঁচ করা যায়না।
হ্যাঁ রে ছোট ভাইয়ার খবর কি? সে কি এখনো নেঅওয়ার্কের বাইরে?
নাহ মাঝে একদিন কল করেছিল, পঞ্চগড় থেকে।
কবে ফিরবে বলেছে?
নাহ। ইচ্ছে হলেই একদিন হাজির হবে হয়তো।
ও না পারেও বটে। কেমন ভবঘুরে হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর কোনোকিছুই ওকে ঘরে ফেরার তাড়ায় ফেলে না।
মা বলে ওকে ধরে বিয়ে দিলেই ও আটকাবে। নয়তো এভাবেই ঘুরতে থাকবে।
ছোটভাইয়া এটা জানে বলেই আসেনা। কত বছর ওরে দেখিনা,,,
আসলেই, অনেক মিস করি ওকে।
রেবা বের হয়ে আরাফের খোঁজ করতে থাকে।ঐ সময় তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা একদম ঠিক হয় নি। অযথাই নিজের মন খারাপের ঝাঁজ তার উপর উঠিয়েছে। না তার এখুনি ক্ষমা চাওয়া উচিত!
সারাবাড়ি খুঁজেও আরাফকে যখন পাওয়া গেলনা রেবা তখন আরাফকে কল করে। কিন্তু আরাফ কল রিসিভ করলো না। রেবা লনে গিয়েও আরাফকে খুঁজে, সেখানেও আরাফ নেই। তবে সে গেল কোথায়? রাতে তো সচরাচর সে বাড়ির বাইরে যায় না। তবে আজ কোথায় গেল? সে কি রাগ করে কোথাও চলে গেল নাকি?
চলবে,,,