তরঙ্গিনী পর্ব-২৯+৩০

0
386

#তরঙ্গিনী পর্ব-২৯

#আরশিয়া_জান্নাত

বিনা শ্রমে অর্জিত সম্পদের গুরুত্ব সবাই দিতে পারেনা। মানুষের কাছে সেটাই মহামূল্যবান যা সে কষ্ট করে অর্জন করে। আরাফ শুরু থেকেই রেবাকে ভালোবেসে, ওর মনের অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী ট্রিট করার চেষ্টা করেছে। হয়তো সেজন্যই রেবা তার ভালোবাসাকে Taken for granted ধরে নিয়েছে। সানজেনার বলা কথাগুলো তখন শুনতে খারাপ লাগলেও এখন যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে। আরাফ একপাক্ষীকভাবে সবসময় নিজেকে সংযত রেখেছে। ওর কষ্ট, রাগ, অভিমান, মন খারাপ, মেজাজ খারাপ কোনোকিছুই রেবার সামনে প্রকাশ করেনি। ওর কাছে রেবার কষ্টই সবচেয়ে বড়। রেবাকে সে এতোটাই ভালোবাসে ও ব্যতীত কোনো মেয়ের দিকে ঠিকমতো তাকায় না এখন। পাছে মন ভুলপথে চলে যায় যদি! মোহাচ্ছন্ন হয়ে না রেবাকে হারিয়ে বসে! আরাফ ভাবতো মেয়েরা লয়্যালিটি চায়, ভালোবাসা চায়, কেয়ার চায়। স্ত্রীকে রাগ দেখানো ক্রোধ দেখানো কাপুরুষত্ব। তাই তো সবসময় হাসিখুশি থেকেছে, ওকে বুঝতে দেয়নি রোজ কত সমস্যায় পড়তে হয়। ওর স্ত্রী অন্য কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পায় এটা যে কোনো পুরুষের জন্য সহজে মেনে নেওয়ার মতো না, এই ব্যাপারটাও তুড়ি মেরে এড়িয়ে গেছে। শুধুমাত্র রেবা যেন তার ভালোবাসাকে, তাদের পবিত্র সম্পর্কটাকে বোঝা না ভাবে তাই সে নিজের জৈবিক চাহিদাকে তুচ্ছ করেছে। তার মনেপ্রাণে বিশ্বাস ছিল রেবা একদিন এই স্যাক্রিফাইজগুলো বুঝবে, যেদিন বুঝবে সেদিন ওকে আরো বেশি ভালোবাসবে।
এখন মনে হচ্ছে ও সব ভুল করেছে। এমন করতে গিয়ে ও ছদ্মবেশী খেতাব পেয়ে বসেছে।
ওর ইনটেনশন সৎ হলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে এসব অতিরঞ্জিত!

এই পৃথিবীতে আসলে প্রকৃত ভালোবাসার মূল্য নেই। যে যতো ভালোবাসে সে ততোই কষ্ট পায়। আরাফ আর রেবার সম্পর্কে আরাফ কষ্ট পাচ্ছে। আর রেবা কষ্ট পায় তৌকিরের জন্য! আহারে জীবন!!!

“রেবা! আপনার প্রতি আমার প্রত্যাশা বেশি বলেই আজ এতো কষ্ট পাচ্ছি নাকি আপনি সত্যিই কষ্ট পাওয়ার মতো কাজ করেছেন বুঝতে পারছিনা। তবে ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করতে হলে দূরত্ব প্রয়োজন হয়, শূন্যতাই পারে মানুষটার উপস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করাতে। আপনি আপনার প্রাক্তনকে নিয়ে দুঃখবিলাসে এতোটাই মগ্ন হয়ে আছেন বর্তমানের মানুষটাকে দেখতেই পাচ্ছেন না। মুখে আমায় ভালোবাসি বললেও আপনার হৃদস্পন্দন থামে ঐ মানুষটাকে ভেবে,,,,”

স্যার? বড় ম্যাডাম কল দিয়েছে, আপনি কোথায় আছেন জিজ্ঞাসা করছে। কি বলবো?

ড্রাইভার সাহেব আপনি একটা সিএনজি নিয়ে ফিরে যান। আর মাকে বলবেন আমি নানুর কাছে যাচ্ছি। কিছুদিন ওখানে থাকবো।

স্যার আমি নিয়ে যাচ্ছি সমস্যা নেই। আপনাকে একা এতো দূর ছাড়লে বড় সাহেব আমাকে আস্ত রাখবেন না।

আপনার ওয়াইফের যেকোনো সময় আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে। এই সময়ে আপনার ঢাকার বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। আপনি বরং আমাকে বাসস্ট্যান্ড এ পৌঁছে দিন, আমি বাসে করেই যাবো।

কিন্তু স্যার,,

আর কোনো কিন্তু নয় যা বলছি তাই করুন।

ড্রাইভার চুপচাপ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে গাড়ি চালাতে লাগলো।

ওদিকে রেবা চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারী করছে, মানুষটা যে কোথায় গেছে! ফোন ও ধরছেনা। চিন্তায় রেবার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যেন।

এমনসময় রেহানা ওর রুমে এসে বলল, রেবা?

জ্বি মা?

আরাফের খবর পেয়েছি। আমার পাগল ছেলে বুঝলি হুটহাট কি যে করে। তার ইচ্ছে হয়েছে নানীকে দেখার তাই কাউকে না বলেই চলে গেছে। আর চিন্তা করিস না ওর জন্য।

আচ্ছা!

একা ভয় লাগবে? রুহিকে বলবো আসতে?

না সমস্যা নেই। আমি পারবো একা থাকতে।

ঠিক আছে মা, ঘুমিয়ে পড়।

রেবা দরজা আটকে বেডের পাশে বসে পড়লো। আরাফ যে ওর উপর রাগ করেই চলে গেছে এটা বোঝার মতো বুদ্ধি তার আছে। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারছেনা একটু রাগ দেখিয়ে কথা বলায় এতো কষ্ট পাওয়ার কি আছে? মানুষের মনমেজাজ সবসময় তো এক থাকবেনা! এইটুকুতেই না বলে কোথাও চলে যাওয়া কেমন?
হঠাৎ রেবার মনে পড়লো আরাফ বলেছিল সে তার অতীত সম্পর্কে জানে, তৌকিরের নিউজ এখন সবাই জানলেও তৌকির যে তার প্রাক্তন এটা কি আরাফ কোনোভাবে জানে? তবে কি ও বুঝে ফেলেছে তৌকিরের জন্যই তার মুড অফ ছিল?
আরাফ সবসময় বলে অতীত নিয়ে তার আগ্রহ নেই কিন্তু বর্তমানে কেবল তাকেই রাখতে হবে,,,, তাহলে কি এজন্যই সে এতো রাগ করেছে? যে মানুষটা তার অনুপস্থিতিতেও অন্য কাউকে প্রশ্রয় দেয় না, সবসময় রেবাতে বিভোর থাকে। তার স্ত্রী হয়ে রেবা প্রাক্তনকে ভেবে মুষড়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল! এটা যদি আরাফ ভেবে থাকে তবে ওর মনে কেমন অনুভূতি হবে তা সে বেশ ভালোই জানে।
রেবা এসির নীচে বসে থেকেও অস্থিরভাবে ঘামতে লাগলো। এতোক্ষণ অন্য কারণে মন খারাপ থাকলেও চোখের পানি পড়তে লাগলো আরাফের কথা ভেবে। ওর মনে হতে লাগলো অনেক বড় একটা সমস্যা হয়ে গেছে,,,,


আরজুরা আজ চলে যাচ্ছে, তাই বাড়ির সবার ভীষণ মন খারাপ। আরজু মন খারাপ করে বলল, এমন দুটো ভাই পেয়েছি আমি যাওয়ার সময় কখনো কাছে থাকেনা। রেবা আমার মা-বাবা ভাইবোনকে আগলে রেখো বোন। আরাফ উপর থেকে শক্ত সাজলেও ভেতরে ও অনেক নরম। অল্পতেই কষ্ট পায়। ওর যত্ন করো কেমন?

আমার জন্য দোআ করবেন আপু, আমি যেন আপনার কথা রাখতে পারি।

মামানি শুনো, তোমরা কিন্তু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবা। ওকে? আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে তোমাকে দেখাবো। আমি তোমাকে অনেক মিস করবো।

রেবা ওকে কোলে তুলে বলল, আমিও তোমাকে অনেক মিস করবো। গুড গার্ল হয়ে থেকো কেমন?

হু।

সবাই যখন আরজুদের দিকে ফোকাসড সানজেনা এসে রেবার সামনে দাঁড়ালো। ওর হাতে একটা বক্স দিয়ে হাগ করে বলল, তুমি এমন একজনকে পেয়েছ যার যোগ্য তুমি না। তবুও ফরচুন তোমার পক্ষে তাই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই! Sorry for harsh word but I don’t hesitate to say the truth. তার সঠিক যত্ন‌ নিও।

রেবা বাকরূদ্ধ হয়ে সানজেনার তিক্ত কথন হজম করলো।

আরাফের নানাবাড়ি দৌলতপুর এসে আরাফের মনটা বেশ তরতাজা হয়ে গেছে। ওর কাছে এই জায়গাটা সবসময়ই রিফ্রেশমেন্ট হিসেবে কাজ করে। যখনই তার ভীষণ ফ্রাস্টেশন হয় বা মানসিকভাবে কোনো সমস্যায় আটকা পড়ে নানীর কাছে এসে মন ঠিক করে। আরাফকে একা দেখে তার নানী হাতের লাঠিটা উঁচু করে বলল, তুই একা আইলি ক্যান আমার নাতবৌরে আনলি না?

আমি এসেছি তুমি খুশি হওনি নানী? মারতে লাঠি তুলছো?

নয়া বৌকে পাইয়া তো আমার কথা ভুইলা গেছস। এহন আবার ঢং মারাস। আগে কতবার আইতি আমারে দেখতে আর অহন?

আরাফ ওর নানীকে জড়িয়ে বললো, নানিগো তোমারে কত্ত মিস করি জানো? কিন্তু অফিসে কত কাজ, একটার পর একটা লেগেই আছে। তাই সময় করে আসতে পারিনা।

শুনো চান্দু, ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়। আমারে এসব বাহানা দিতে আইসো না। আমার চুল এমনে এমনে সাদা হয় নাই। এহন হাছা কইরা কও কি অশান্তি পাকাইয়া আইছো?

নানী, তুমিও না।

ঐ আরাফ খাড়া কই যাস।

পুকুরে যাই, গোসল দিমু।

আমার কথার জবাব দিলি না?

জবাব থাকলে তো দিতাম! নানীর বাড়িতে আইলে মানুষ মাথায় করে রাখে আর তুমি সাওয়াল জওয়াব লইয়া বইছো। এমন করবা জানলে আইতামই না। হুহ

ওরে এহন বর্ষার মৌসুম। ঘাটে অনেক পানি। একা যাইস না। বড় বৌ ও বড় বৌ সাবের রবি কেউ ঘরে নাই? ওগোরে কও আরাফের লগে পুষ্কুনিত যাইতো।

আরাফ সাতরে পুকুরের এপার থেকে ওপার গেলো, ইচ্ছেমতো সাতার কেটে শরীর মন ঠান্ডা করে দুপুরে খেতে বসলো। রহিমা বেগম তার পাতে এটা ওটা বেড়ে দিতে লাগলেন। আরাফ খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেল। ফোন চালু করলো না,,,

রেবার সারাটা রাত দিন গেল মন খারাপে। আরাফকে যতবার কল করেছে ফোন সুইচড অফ, রেবা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। রেবা আরাফকে কষ্ট দিতে চায়নি। ভুল তো মানুষেরই হয়। আরাফ কেন ওকে এতো কঠিন শাস্তি দিচ্ছে? এই বিষাদের আত্মগ্লানী নিয়ে ও বাঁচবে কিভাবে?
তৌকির নিজের অসাধু কার্যকলাপের জন্য জেলে গেছে, এ নিয়ে ওর কেন মন খারাপ হবে? আর হলেও ঐ নীচ মানুষটার জন্য আরাফের উপরই বা কেন রাগ ঝাড়বে? সব দোষ তার। সে অযথাই ভুল মানুষের জন্য আরাফকে হার্ট করেছে। এখন ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ারো সুযোগ পাচ্ছেনা। কি করবে এখন?
এভাবেই কেটে গেল চারদিন,,

চারদিন পর আরাফ যখন ফিরে এলো রেবার দেহে প্রাণ ফিরলো যেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে আরাফ বললো, রেবা আমার জন্য আদা চা নিয়ে আসুন, কয়েকদিনে বুকে ঠান্ডা বসে গেছে।

রেবা আনন্দিত হয়ে চা করতে চলে গেল। আরাফ ওর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে দেখে ওর বুক থেকে পাথরের বোঝা নামলো যেন।
চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে আরাফ বেলকনীতে দাঁড়িয়ে স্মোক করছে,,রেবা অবাক হয়ে বলল, আপনি স্মোক করেন?

হুম

এতোদিন তো একবারো দেখিনি?

দেখাইনি বলে দেখেন নি।

তবে আজ দেখাচ্ছেন কেন?

আমার বদঅভ্যাসগুলো জানাতে।

রেবা চায়ের কাপ রেখে বলল, বেশ, তা দিনে কয়টা লাগে আপনার?

বেশি না এ প্যাকেট…

সিরিয়াসলি! আপনি মারাত্মক স্মোকার! এটা ঠিক না আরাফ। এতো সিগারেট খেলে বাঁচবেন না তো,,

আমার মৃত্যুতে কারো কিছু যায় আসে?

এভাবে কেন বলছেন?

সত্যি শুনতে সবসময় কষ্ট হয় তবে সত্যি তো সত্যিই।

আরাফ আপনি আমার উপর রেগে আছেন? আমি সেদিনের জন্য স্যরি। আসলে,,

কৈফিয়ত শুনতে চাই না। আপনার ইচ্ছমতো বাঁচুন। আমি কিছু জানতে চাই না।

রেবা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আরাফের দিকে। এ কোন আরাফ? যে এতোদিন পর বাড়ি ফিরলো অথচ ওকে একটাবার জড়িয়ে ধরলো না, কথা বলার সময়ও তাকালো না ওর দিকে। রেবা তার অতীতের বাজে অভিজ্ঞতার ছায়া যেন আরাফের উপর দেখতে পাচ্ছে। তবে কি আরাফও বদলে যাচ্ছে যেভাবে তৌকির বদলে গিয়েছিল ওর ভালোবাসা পাওয়ার পর??
সব ছেলেই বুঝি মন হাসিল করার পর বদলে যায়?? আবেগ কৌতুহল সব মিশে যায়? রেবার চোখ ভরে আসতে চায় কিন্তু এই মুহূর্তে চোখের পানি দেখাতে চায় না সে। হাসিমুখে আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনাকে অনেক মিস করেছিলাম। একটা কলও দিলেন না কত টেনশন লেগেছিল জানেন?

আরাফ ওকে ছাড়িয়ে বলল, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, যা গলা ব্যথা আমার। গরম চা খেলেই যা একটু আরাম লাগে।

রেবা ভেতর ভেঙে গেল আরাফের এমন আচারণ দেখে। বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারলো না অভিমানে আরাফের বুক শক্ত হয়ে আছে, এই অভিমান গলানোর হাতিয়ার কেবল তার কাছেই আছে। যার ভালোবাসা বেশি তার অভিমানের কাঠিন্যও বেশি। কিন্তু রেবা আগেরজনের সাথে বর্তমানের জনের তালগোল মিলিয়ে ফেলছে। মনের মাঝে জমে উঠা অজানা শঙ্কায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রেবা আর এক মুহূর্ত রুমে রইলো না। সে আরাফের সামনে কাঁদতে চায় না। ওর চোখের পানিকে না পাছে “আর কিছু না পেরে কেঁদে হাসিল করা” বলে অভিহিত করে সেই ভয়ে রেবা অন্য জায়গায় গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিলো।

আরাফ দেওয়ালে জোরে ঘুসি মেরে নিজের রাগ কমালো। কাতর কন্ঠে বলল, রেবা! কেন আপনি আমায় তৌকিরের চেয়ে বেশি ভালোবাসলেন না? কেন আপনি তাকে ভুলতে পারছেন না? আমার ভালোবাসায় কি খামতি ছিল? আমার অভিমান বোঝার মতো ক্ষমতাও বুঝি আপনার হলোনা? এতোদিনে তবে একটুও চেনেননি আমায়?

দুটো মানুষ দু’দিকে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। অথচ কেউই কাউকে নিজের মনের আসল কথা বলতে পারছেনা। আচ্ছা এবার কি রেবা পারবেনা আরাফের মান ভাঙ্গিয়ে বুঝিয়ে দিতে, তার তরঙ্গিনী এখন তাকে লক্ষ্য করেই বয়ে যাচ্ছে। অন্য মানুষটা এখন কেবল করুণার পাত্র হয়েই আছে, হৃদয়ের মণিকোঠায় তো আরাফের রাজত্ব। সেখানে আর কেউ নেই।

অবশ্যই পারবে, পারতে তাকে হবেই। সে তার সবটা দিয়েই চেষ্টা করবে, কারণ সে জানে আরাফ তাকে অনেক ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসার জোরেই রেবা তাকে জয় করবে। এবারের তপস্যা হবে রেবার!

চলবে,,,,

#তরঙ্গিনী পর্ব-৩০

#আরশিয়া_জান্নাত

আমি আপনাকে কতবার বলেছিলাম আরাফ, আপনি যেন না বদলান। তখন যেমন করে আমার যত্ন করতেন, আগলে রাখতেন সেভাবেই সবসময় রাখবেন। কিন্তু আপনি আমার কথা রাখেন নি। আপনি বদলে যাচ্ছেন,, আমি এজন্যই ভালোবাসতে ভয় পেতাম। আমি জানতাম আমি ভালোবাসতে শুরু করলেই সব বদলে যায়। তৌকিরও আমায় অনেক ভালোবাসতো, কত পাগলামী করতো। কিন্তু দিনশেষে অবহেলা ব্যতীত কিছুই দেয়নি। কিন্তু আপনি তো ওর মতো নন, তবে কেন আপনিও সেই পথেই এগোচ্ছেন?আমি মায়ায় পড়লেই কেন সবকিছু নির্মম হতে শুরু করবে? আমি আপনাকে নিজের স্বামী বলে মানতে শুরু করেছি, নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছি। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট আপনার। তবে এখন কেন এতো অবহেলা? আমিতো আপনাকে অবহেলা করিনি কখনো?মানছি শুরুতে ভালোবাসিনি কিন্তু ঘৃণাও তো করিনি আরাফ! আপনি আজকে আমায় এমনভাবে আলাদা করলেন যেন আমার স্পর্শ আপনার সহ্য হয়না,,আপনি স্মোকার এটা আমি জানতাম না। আপনি বললেন আপনি দেখাননি বলে জানিনি। তবে কি যা দেখিয়েছেন সব মিথ্যে ছিল? কোনটা সত্যি আরাফ? আগেরটা নাকি এখনের টা? আমায় কেন গোলকধাঁধায় ফেলছেন? আমি এসবে ভীষণ দূর্বল আরাফ, আমার কঠিন পরীক্ষা নেবেন না।
ছাদের রেলিং ঘেষে বসে রেবা কাঁদতে কাঁদতে এসব কথাই বলছিল। আজ বহুদিন পর তার এমন বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। শেষবার যেদিন কেঁদেছিল আরাফ তাকে বুকে আগলে রেখেছিল, অথচ আজ!
রেবা হাঁটুর ভাজে মাথা রেখেই অবিরাম কাঁদতে লাগলো।
ভালোবাসা মানেই যন্ত্রণা। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানে যন্ত্রণা আসবেই। তবে আমি এই যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হতে দিবো না। আপনার মান আমি ভাঙাবোই,,,

আরাফ সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে রেবাকে দেখে। রেবার কান্নায় ওর মন নরম হয়ে যায়। তবুও কাঠিন্য ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে।

আরাফ অফিসের জন্য রেডি হয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, রেবা ওর পথ আটকে দাঁড়ায়।
আরাফ ভ্রু উঁচিয়ে বলে, কি?
রেবা ওর ঘাড় ধরে টেনে নিজের কপালে জোর করে চুমু নেয়। তারপর জড়িয়ে ধরে বলে, সাবধানে যাবেন, সাবধানে ফিরবেন। আর দুপুরে ঠিক টাইমে লাঞ্চ করবেন।
আরাফ ওর আচারণে খুশি হলেও প্রকাশ করেনা। বরং এমন ভাব করে যেন সে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে।
রেবা সেসব তোয়াক্কা না করেই আরাফের দুহাত টেনে নিজের পিঠে রাখলো। কিন্তু আরাফ সেটা সরিয়ে নিলো।
যতক্ষণ আরাফ বাসায় থাকে, রেবা ওর আশেপাশেই থাকে। আরাফ ওকে এড়িয়ে যেতে চাইলে ও জোর করে আরাফের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। রাতে ঘুমানোর সময় ইচ্ছে করে কাঁথা ফেলে দেয় যাতে আরাফ ওর গায়ে কাঁথা টেনে দেয়। আরাফের হাত টেনে‌ নিজের গালের নীচে রেখে ঘুমায়। যখন সে ল্যাপটপে ডুবে থাকে কতবার যে সামনে ঘুরঘুর করে, প্রশ্ন‌করে কথা বলতে চায়। কিন্তু আরাফের হু হা উত্তরে রেবা দমে যায়। একা একা আর কতক্ষণ কথা আগানো যায়? রেবার ভীষণ কষ্ট হয় আরাফের নির্লিপ্ততায়। যে মানুষটার যত্ন‌ আর মনোযোগ পেয়ে সে অভ্যস্ত, তার এড়িয়ে যাওয়া তাকে কতটা পীড়া দেয় বলা বাহুল্য। কবে যে এই মান অভিমান পর্বের সমাপ্তি ঘটবে!


দুপুরে সে আরাফের পছন্দমতো রান্না করে অফিসে নিয়ে গেল একসঙ্গে লাঞ্চ করবে ভেবে। আরাফ রেবা আসার খবর পেয়ে ইচ্ছে করে লাঞ্চ আওয়ারে মিটিং এ গেল। রেবা চুপচাপ ওর কেবিনে বসে রইলো দুই ঘন্টা। কিন্তু আরাফের কোনো খবর নেই। পরে অফিস সহকারী হানিফ বললো, ম্যাডাম স্যার ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে ফিল্ডে গেছেন ফিরতে দেরী হবে।

রেবা হেসে বলল, আপনি লাঞ্চ করেছেন?

না ম্যাডাম, সবার লাঞ্চ শেষে করি।

এইগুলো তাহলে আপনি খেয়ে নিন। আর আমার জন্য গাড়ি বের করতে বলুন।

ধন্যবাদ ম্যাডাম। কিন্তু ম্যাডাম আপনি লাঞ্চ করবেন না?

রেবা ঈষৎ হেসে বলল, আমি খেয়েই এসেছি।

রেবা বাসায় ফিরে নিজের ঘরে ঘুমাতে গেল।মনের কষ্টের সামনে ক্ষুধার তীব্রতা স্থান পেল না

আরাফ অফিসে ফিরে হানিফকে জিজ্ঞাসা করলো, রেবা লাঞ্চ করেছিলেন?

হানিফ বলল, না স্যার। উনি সব খাবার আমাকে দিয়ে চলে গেছেন আর বলেছেন উনি খেয়ে এসেছেন।

আচ্ছা যাও।

তারপর রুহিকে ফোন করে বলল, দুপুরে বাসায় কে কে ছিল আজ?

কেন আমি মা,চাচীরা! ভাবী তো তোমার সাথে লাঞ্চ করবে বলে চলে গিয়েছিল।

ওহ।

হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে?

নাহ রাজীব দুপুরে ফিরেছিল কি না জানতে জিজ্ঞাসা করছি।

আচ্ছা।

হুম রাখছি।

আরাফের নিজের উপর অনেক রাগ হলো। সে বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। রেবাকে কষ্ট দিয়ে না নিজে ভালো আছে, না রেবাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে। লাগবেনা এই ঘোড়ারডিমের দূরত্ব মান অভিমান। তার কাছে রেবার ভালো থাকাই মুখ্য। এই যে মেয়েটা অসহায়ের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বারবার আশপাশ ঘেষছে, কাছে আসতে চাইছে, ওর এটেনশন পেতে কত কি করছে। এসব উপেক্ষা করা কি আরাফের জন্য সহজ? আরাফ উপরে যতোই ডোন্ট কেয়ার মুডে থাকুক ভেতরে ভেতরে রেবার সাথের দূরত্বতা ওকেই বেশি পোড়াচ্ছে। আজকাল রেবা আনমনেই আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, আড়ালে কান্নাকাটি করে অথচ সবার সামনে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয়না ওদের মাঝে ঘটা সমস্যার খবর। আরাফ মনে মনে ভাবে ভালোবাসা তো গিভ এন্ড টেইক নিয়ম মানেনা। ভালোবাসা দিলেই ভালোবাসা পেতে হবে এমন কোথাও লেখা আছে? রেবা ওকে যদি ভালো নাও বাসে তাতেও কি, ও তো ভালোবাসে। আর ও ভালোবাসে মানেই রেবার দোষগুণ মিলেই ভালোবাসে। রেবার যত্নে ত্রুটি রাখা ও কখনোই বরদাশত করবে না। ওকে হ্যাপি রাখার যে পণ ও নিজেকে করেছে তা নষ্ট করবেনা।
আরাফ ফেরার পথে রেবার জন্য ওর ফেভারিট কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে নেয়। মেয়েটা দুপুরে খায়নি, কি জানি অভিমান করে আবার না খেয়ে বসে আছে কি না!
রুমে এসে আরাফ যা দেখে তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না,

রেবা! এ আপনি কি করছেন?

আরাফ চিৎকার করে দৌড়ে এসে রেবার হাত থেকে চাকু কেড়ে নেয়। ওকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করেই কান্না করে ফেলে।
আমি আপনাকে অনেক হার্ট করেছি তাই না?, সেজন্য আপনি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন! আপনি একটাবারও ভাবলেন না আপনার কিছু হলে আমার কি হতো? আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?আমার ভুল হয়ে গেছে রেবা আমি আর কখনো রাগ দেখিয়ে আপনাকে কষ্ট দিবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ আমি আরেকটু দেরী করলে কি হয়ে যেত আজ!

রেবা হতভম্ব হয়ে আরাফের কান্ড দেখছে। রেবার হঠাৎ মনে হলো, এই আরাফটাই আসল আরাফ, যে তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। তার উপর রাগ করে থাকতেই পারেনা।
রেবা আরাফের চোখ মুছে দিয়ে বলল, এমন মরা কান্না জুড়ে দিলেন কেন বলুন তো? ভালোমতো তাকিয়ে দেখুন আমিতো চাকু দিয়ে আপেল কাটতে যাচ্ছিলাম।

আরাফ ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু দেখে তো মনে হয়েছে আপনি হাত কাটতে,,,,,

আপনিও না! কিসব যে ভাবেন! আমি সুইসাইড করতে যাবো কেন?

আমি এতোকিছু জানিনা, আমার বুকটা ধড়ফড় করছে, আপনি এখানে চুপটি করে থাকুন তো। আমার বুক শান্ত হোক!

রেবা হেসে আরাফের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। যেন কত যুগ পর আরাফ ওকে আবার কাছে টানলো?
আরাফ ওর কপালে মাথায় এলোপাথারি চুমু খেয়ে বলল, আপনি এমন কেন রেবা? আমাকে কেন এতো কষ্ট দেন, আমি পারি না এতো কিছু সহ্য করতে। আপনি কি একজায়গায় স্থির থাকতে পারেন না?

আমি স্থিরই আছি আরাফ। আপনিই অস্থির হয়ে আছেন।

মোটেই না। আপনি একটুও স্থির নেই। না আপনি নিজে স্থির আছেন,না আমায় থাকতে দিচ্ছেন।

হুহ! সব দোষ এখন আমার?

জ্বি আপনারই।

আমি কি এতোই খারাপ? অনেক অপরাধী?

রেবা!

জ্বি

আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তাই না?

ব্যাপারটা তেমন নয় আরাফ! আমি সত্যি বলছি আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

তবে অতীত নিয়ে পড়ে আছেন কেন?

আরাফ আমি সেদিনের জন্য খুব দুঃখিত। আমার আপনার সঙ্গে ওমন বিহেভ করা ঠিক হয়নি। আসলে হুট করে এমন একটা নিউজ পেয়ে মন খারাপ এড়াতে পারিনি। আর আপনিও তখন এসে প্রশ্ন করেছেন পুরো ঝাঁজটা আপনার উপর গেছে। আমি সত্যিই মন থেকে সরি। তবে বিশ্বাস করুন আমি নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছি। ভুল মানুষের জন্য মায়া জমানো বন্ধ করে দিয়েছি। আমার সব অনুভূতি, মায়া আপনাকে ঘিরেই। আমায় আপনি দূরে ঠেলে দেবেন না প্লিজ। আমি জানি আপনার জায়গা থেকে আপনি ঠিক আছেন। আপনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো সেইম রিয়েক্ট করতাম। তবুও বলছি আমায় ক্ষমা করুন,,,আপনার অবজ্ঞা মুখ ফিরিয়ে নেওয়া আমার জন্য মৃত্যু সমতুল্য

স্যরি রেবা। আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি তাই না! কি করবো বলুন আমি মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। যাই হোক যা হবার হয়েছে সেসব বাদ দিন। ঐসব ধরে রেখে আর লাভ নেই। আপনার জন্য আপনার ফেভারিট বিরিয়ানি এনেছি, খেয়ে নিন।

রেবা মুখ ভার করে বলল, আমি খেতে পারবো না।

ওমা কেন?

১ সপ্তাহ ধরে আপনি আমায় খাইয়ে দেন‌নি। এখন সেটার শোধ দিন।

আরাফ বেসিনে হাত ধুয়ে বললো, সব হিসেব নিকেশ খাতায় তুলে রেখেছেন বুঝি?

জ্বি, একদম পাই পাই হিসেব তুলে রেখেছি। সব শোধ‌ নিবো। একটা কিছুও বাদ যাবেনা।

আচ্ছা সব শুনবো এবং শোধ করবো আগে খেয়ে নিন, দেখি হা করুন।

রেবা বেডের উপর পা তুলে আয়েস করে বসে আরাফের হাতে খেতে লাগলো। আরাফও রাজ্যের ফিরিস্তি খুলে এটা ওটা বলতে বলতে যত্নসহকারে তার প্রেয়সীকে খাইয়ে দিতে লাগলো। যেন কত কথা জমা পড়েছে এ কয়দিনে। রেবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আরাফের দিকে,,,,

আসলে স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারটাই অন্য রকম। এখানে যতো সমস্যাই থাকুক না কেন দিনশেষে একটা বিশেষ‌ রহমতে সব ঠিক হয়ে যায়। এখানে ইগো জিইয়ে রেখে বা অপরের প্রতি ক্ষোভ পুষে রাখা ঠিক না। একে অপরের প্রতি দয়াশীল হতে হয়,সুযোগ দিতে হয় শুধরে নেওয়ার। কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। একসঙ্গে থাকতে গেলে অনেককিছুই ঘটবে, তাই অভিমানের পাহাড় জমবার আগেই ভালোবেসে সব ঠিকঠাক করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটা কথা সবসময় মাথায় রাখা উচিত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরলে শয়তান সবচেয়ে বেশি খুশী হয় আর আল্লাহ দুঃখ পান।

🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸
রুহি বুঝের হবার পর থেকেই কারিয়ানকে পছন্দ করে। কিন্তু কারিয়ানের মনের খবর জানার কোনো উপায় নেই। কারিয়ান বরাবর শান্ত প্রকৃতির ছেলে, আর প্রয়োজনের বাইরে বিশেষ কথাও বলেনা। তাই রুহি আগ বাড়িয়ে কিছু বলার সাহসও পায়না। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ের কথা আকারে ইঙ্গিতে বহুবার উঠলেও নানান কারণে পরিষ্কার করে বলা হয়নি। তবে এবার কারিয়ানের বাবা কবির সাহেব যখন বলেছেন দেশে ফেরার পর একটা চূড়ান্ত ফয়সালা হবে তাই রুহির মনের অবস্থা ভীষণ উড়ু উড়ু। তবে কারিয়ানের মনের ভাব না জেনে রুহি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছেনা। দেখা গেল সবাই রাজী হলেও কারিয়ান বেঁকে বসলো। তখন রুহির কি হবে? তাই রুহি খুশিতে নাচতেও পারছেনা, আবার দুঃখীও হতে পারছেনা। সে মিশ্র অনুভূতির জোয়ারে ভেসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছে।

কবে যে ওরা আসবে??

চলবে,,,,