তারপর একদিন পর্ব-০৪

0
1

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৪
.
ঢাকায় আসার পর আরও দু’টো দিন কেটে গেছে। নির্ঝর ও সিতারার সম্পর্কটা একটুও উন্নতি হয় নি এই দু’টো দিনে। তবে ওদের কথপোকথনটা একটু বেড়েছে। নির্ঝরের কোন প্রয়োজনেই নিয়ম করে সিতারার ডাক পড়ে—এ্যাই মেয়ে! সিতারার বিরক্ত লাগে। ওকে তারা বলে ডাকার চেয়েও নির্ঝরের ‘এই মেয়ে! বলে ডাকায় বেশি বিরক্ত।
তখন রান্নাঘরেই কাজ করছিল সিতারা। নির্ঝর ক্লান্ত শরীরে অফিস থেকে ফিরেই ওর কাছে ঠান্ডা পানি চাইল। সিতারা শুনেও আজ সারা দিলো না, পানি নিয়ে গেল না নির্ঝরের করে। ছেলেটা আরও দু’বার ডাকার পর বিরক্ত হয়ে বেড়িয়েই এলো রুম ছেড়ে। সোজা রান্নাঘরে এসে, “এ্যাই মেয়ে, ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?”

বলতে বলতেই ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করল। এরপর ঢকঢক করে পানি পান করল অনেকটা। এদিকে সিতারা যেন শুনেও শুনল না নির্ঝরের কথা। সে মহা ব্যাস্ত ওর কাজে। নির্ঝর পানির বোতল হাতে নিয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে উঠল, “এই মেয়ে, কি সমস্যা? কিছু যে বলছি, শুনতে পাচ্ছ না?”

“আমাকে বলছেন?”

অবাক হবার ভান করে বলল সিতারা। নির্ঝরের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। বলল, “তুমি ছাড়া এ-বাসায় আর কে আছে?”

“আমিও তো সেটাই ভাবি। আমি ছাড়া আরও কেউ নেই, কিন্তু আপনি কাকে ডাকেন!”

“এই মেয়ে, তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছ?”

“উঁহু! আপনি আমায় নাম নিয়ে ডাকতে পারেন না! তবেই তো বুঝে যাই।”

চুপ করে গেল নির্ঝর। সত্যিই তো, মেয়েটাকে নাম নিয়ে ডাকলেই পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো মেয়েটার নাম ওর ঠিকঠাক মনে নেই। মনে আছে তারা! মেয়েটার নাম তারা নয়, সেটা বলেছিল ওকে। এরপর রাস্তার মাঝে নিজের নামটা একবার বলেছিল। সিয়ারা, না-কি সিতারা! ঠিকঠাক মনেও নেই নির্ঝরের। মস্তিষ্কে চাপ ফেলে মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটা। এর মাঝেই সিতারা ফের বলল, “এত সুন্দর নাম আমার, সিতারা! অথচ কেউ ডাকলোই না কখনো।”

সিতারার নামটা মনে পড়ল নির্ঝরের, পছন্দও হয়েছে ওর। গ্রামের মেয়েদেরও যে এমন সুন্দর নাম হয়, তা বোধহয় জানা ছিল না নির্ঝরের। কথা বাড়াল না ছেলেটা। বোতলের মুখ আটকে ফ্রিজে তা রাখতে রাখতে ছোট করে, “আচ্ছা, ডাকব।”

বলেই আর দাঁড়াল না, চলে গেল রান্নাঘর ছেড়ে। সিতারা ওর চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আচমকাই ওর মনটা খুশি হয়ে উঠল।
গত কয়েকদিনেই নির্ঝরের প্রতি সিতারার অদ্ভুত এক টান তৈরি হয়েছে যেন। সেই টান’টা ধীরে ধীরে বারতেও সময় নিচ্ছে না। এতে ওর শ্বাশুড়ির হাত কম না। রোজ নিয়ম করে ওকে ফোন করে, এরপর ছেলের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে অবগত করে থাকেন। ছেলের আশেপাশে থাকার জন্য নানান উপদেশও দেন। সিতারা একটু একটু করে মানারও চেষ্টা করে তা। তাতে যে কঠিন হৃদয়ের নির্ঝর কিঞ্চিৎ পরিমাণ সদয় হচ্ছে, তা ঠিকই বুঝল। তাতেই যেন বিস্তার হাসল সিতারা।

ঠোঁটে বিস্তার হাসি নিয়েই সিতারা একটা লেবু হাতে নিলো, সেটা কেটে নিয়ে চট করেই এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে ফেলল। এরপর সেটা নিয়ে চলে এলে রুমে। নির্ঝর তখন গায়ের ঘামে ভেজা শার্ট’টা খুলে, খাটে ফ্যানের নিচে বসে মোবাইল হাতে নিয়েছে। সিতারা ওর সামনে নিয়ে হাতের গ্লাস’টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নিন!”

নির্ঝর কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে সুধাল, “এটা কি?”

“লেবুর শরবত! খেয়ে নিন, আড়াম লাগবে।”

“এতক্ষণ শুধু পানি চাইলাম দিলে না, এখন হঠাৎ এত মেহেরবানী করে শরবত এনেছ কীজন্য?”

“ইচ্ছে হলো তাই।”

গ্লাসটা হাতে নিলো না নির্ঝর, তাকিয়ে থাকল। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করতে চাইল মেয়েটার মনোভাব। সিতারা বিরক্ত হলো। বিরক্তিমাখা কণ্ঠেই বলল, “খাবেন? নয়ত নিয়ে গেলাম কিন্তু..!”

কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো নির্ঝরের। সিতারার হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটা শেষও করল। এরপর গ্লাসটা ফের মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফের মোবাইল দেখায় মগ্ন হলো নির্ঝর। সিতারার ঠোঁটে আবারও হাসি ফুটে উঠল। নির্ঝরের দিকে একবার তাকিয়ে চলে এলে রুম ছেড়ে।

.
কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন, সেই আগের মতোই। নির্ঝর সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে বিকেলের লগ্নে, আর সিতারা একা বাসায় কাটায় দমবন্ধ করা পরিবেশে। এখানে টিভি নেই, যে টিভি দেখে সময় কাটাবে। সিতারার পড়াশোনাও নেই, নেই গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বইও। রান্নাবান্না ও ঘরের টুকটাক কাজের পর সময় কাটানোর কিছু নেই। সিতারা গিয়ে বসে থাকে বারান্দায়, ছয় তালা থেকে নিচে তাকিয়ে রাস্তার মানুষ দেখার চেষ্টায় থাকে। বারান্দায় বসে বসে আকাশের পানে তাকিয়ে নির্ঝর নামের গম্ভীর মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
বারান্দায় বসে বসে ওর আচমকা হওয়া ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছিল। হঠাৎই হালকা পেট ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠল যেন। হালকা পেট ব্যাথা থেকে ভারী হতেও সময় নিলো না। সিতারার হঠাৎ মনে পড়ল কিছু। পেট ব্যাথার উৎসর্গ মনে পড়তেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠল যেন। এরপর অস্থির চিত্তে বারান্দা থেকে উঠে এলো সিতারা।

নির্ঝর আজ অফিস থেকে ফিরল একটু দেরিতেই। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার লগ্নে। বাসার চাবি ওর কাছে থাকায় সিতারার গেট খুলতে হয় না। নির্ঝর বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমেই ঢুকল। সিতারা শুয়ে আছে খাটে। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। এই অসময়ে মেয়েটাকে ঘুমাতে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাকই হলো। নিজের ব্যাগটা রেখে, গায়ের শার্ট খুলে ওয়াশরুমে ঢুকল। ফ্রেশ হয়ে, যেন অর্ধ গোছল করেই বেড়িয়ে এলো। তোয়ালে দিয়ে চুল ও গা মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। এরপর মাঝে খাটে শুয়ে থাকা সিতারার পানে তাকাতে ভুলল না। সিতারা থেকে থেকে নড়েচড়ে উঠছে, কিন্তু বিছানা ছাড়ছে না। এ-সময়ে কাজ থাকলেও তা ফেলে রেখে মেয়েটা নামাজে দাঁড়ায়, কিন্তু আজ কি হলো? ভাবতে না চাইলেও ওর ভাবনায় এসে জেঁকে বসল কথাটা। ভাঁজ পড়ল কপালে। কিছু বলবে না বলবে করেও অজান্তেই ডেকে উঠল, “এই মেয়ে, আমার টি-শার্ট কোথায়?”

সিতারা কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠে। জবাব না দিয়ে ফের স্থির হয়ে যায়। নির্ঝরের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হয়। আবারও ডেকে উঠে, “সিতারা, টি-শার্ট কই আমার?”

“দেখেন, ওখানেই আছে তো।”

আস্তে করে বলে সিতারা। নির্ঝর টি-শার্ট না খুঁজে ওর দিকে ফিরে তাকায়। খাটের কাছে এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “পাচ্ছি না, উঠতে পারছ না তুমি?”

“একটু খুঁজে নিন না!”

“কি সমস্যা তোমার? ভর সন্ধ্যে বেলায় কাজে ফাঁকি দিয়ে এভাবে শুয়ে আছ কেন? খাব না আমি, খাওয়ার ব্যবস্থা করো।”

খানিকটা ধমকের স্বরেই বলে উঠল নির্ঝর। সিতারা নড়েচড়ে এবার সোজা হলো। চোখ-মুখ খিঁচে ছলছল করা চাহনিতে তাকাল, কান্না আটকে রাখার চেষ্টা। কিঞ্চিৎ চমকে উঠল নির্ঝর। কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করতে চাইলেও কোন এক সংকোচে করল না। কিন্তু মনের ভেতর আচমকাই এক অস্থিরতা কাজ করল নির্ঝরের। সিতারা আস্তে করে বলল, “আপনি এখন কিছু একটা খেয়ে নিন, আমি একটু পর উঠে রান্না করছি।”

নির্ঝর নীরবে সরে এলো। আলমারি থেকে টি-শার্ট নিয়ে গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে এলো রুম ছেড়ে। রান্নাঘর থেকে একটা আপেল নিলো, তা খেতে খেতে গিয়ে বসল ড্রয়িং রুমে।

.
প্রায় আধাঘন্টা সময় পেরিয়ে যায়, সিতারা বের হয় না রুমে ছেড়ে। এবার যেন নির্ঝরের ভাবনা দৃঢ় হয়, কপালে ভাঁজ ফেলে যায় রুমে। রুমে ঢুকে যখন সিতারার কোন সারা পেল না, তখন এগিয়ে গেল ওর কাছে। হাতের বাহু ধরে হালকা ঝাঁকি দিয়ে ডাকল, “সিতারা..!”

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সিতারা। চোখদুটো সবেই লেগে গিয়েছিল ঘুমে। নির্ঝর এবার বলেই ফেলল, “এই মেয়ে, কি হয়েছে?”

“কই? কিছু না তো।”

“তখন থেকে ডাকছি উঠছ না, আবার বলছ—কিছু না?”

“বললাম তো কিছু হয় নি। আপনি যান।”

“যান মানে? উঠে খাবার ব্যাবস্থা করো, জলদি।”

“উফ্! একদিন নিজে কিছু করে খেতে পারছেন না।”

কপাল কুঁচকে তাকায় নির্ঝর। সিতারার কথাটা যেন ইগোতে লাগল ওর। তারপরই নিজ মনে ভাবল—বিয়ে করেছে কি নিজে রান্না করে খাবার জন্য? উঁহু! মোটেও নয়। মেয়েটাকে আজকাল বড্ড ঢিল দিয়ে ফেলছে ও, এজন্যই বোধহয় এভাবে কথা বলছে। নির্ঝর এবার ধমকেই উঠল, “কি সমস্যা তোমার, বলতে পারছ না? না বলতে পারলে এখনি উঠো বিছানা ছেড়ে।”

“মেয়েলী সমস্যা! সব কথা কেন বলতে হবে আপনাকে? বোঝেন না? দেখছনই পেট ব্যাথায় বিছানা ছাড়তে পারছি না, তারপরও এত জ্বালাচ্ছেন কেন?”

সিতারাও কিঞ্চিৎ চেঁচিয়ে উঠল, খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলল কথাটা। নির্ঝর দমে গেল। বুঝল, মান্থলি পিরিয়ড চলছে সিতারার।
সাইন্সের স্টুডেন্ট হওয়ায় ও জানে—এ সময় অসহ্য রকমের পেট ব্যাথা হয়। নিজেকে এবার খানিকটা অপরাধী বলে মনে হলো নির্ঝরের। আস্তে করে নরম গলায় বলল, “আমাকে আগে বললে না কেন?”

কথাগুলো অনেকটা রাগের মাথায় বলে ফেলেছিল সিতারা। নির্ঝরের কথায় যেন উপলব্ধি হলো কি বলে ফেলেছে। কণ্ঠে খানিকটা ক্ষাদ নেমে বলল, “কেন, আগে বললে কি করতেন? এ-সব বিষয়ে আপনাকে কিছু বলারও অধিকার আছে বুঝি আমার?”

প্রত্যুত্তরে কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না নির্ঝর। সত্যিই তো, ওকে বলার মতো সেই অধিকার তো দেয়’ই নি মেয়েটাকে। তাহলে, আশাটা ছিল ওর কি-জন্য? নিশ্চুপ নির্ঝর। সিতারা শোয়া থেকে উঠে বসল। আবারও বলল, “আমি জানি আপনি আমায় পছন্দ করেন না, সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে মেনে নিতে চান না। আপনি মনেপ্রাণে চান—আমি যেন আপনার জীবন থেকে চলে যাই। সেখানে আপনার স্ত্রী’র অধিকার দেখাব’ই বা কি-করে। আমি এতটাও নির্লজ্জ নই!”

বলেই থামে সিতারা। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে ফের বলে, “কি হ্যাঁ! আমি আপনার বিয়ে করা বউ। এত সহজে আপনাকে ছাড়বও না। খ্যাত হই আর অশিক্ষিত, আমাকে নিয়েই আপনার সংসার করতে হবে।”

নির্ঝর অবাক হলো। অবাক হলো সিতারার সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলাতে। হঠাৎ ওর খেয়াল হলো—মেয়েটা খুব সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় গুছিয়ে কথা বলতে জানে। সেই প্রথম দিন থেকেই। গ্রামের মেয়ে হয়েও যে সুন্দর করে কথা বলতে জানে, তাতেই কিঞ্চিৎ অবাক ও। আগেও খেয়াল করেছে বিষয়টা, কিন্তু বলা হয় নি। একরাশ কৌতুহল নিয়ে আজকে বলেই ফেলল, “সিতারা, তুমি তো খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে জানো! এ্যাই মেয়ে, সত্যি করে বলো তো—তুমি কি সত্যিই এসএসসি ফেইল? আর পড়াশোনা করো নি?”

ভার মুখখানায় এবার এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল সিতারার। খিলখিল করে হেসেও উঠল। ঠোঁটে বিস্তার হাসি ফুটিয়েই বলল, “হ্যাঁ! এসএসসি ফেইল আমি। এরপর আর পড়াশোনাও হবে না। গতবছর ফেইল করলাম, এবছর বিয়ে হলো। এখন আমি মন দিয়ে সংসার করব আপনার সাথে।”

.
.
চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে…]

Photo edit by— Rafid Rahman