তারপর একদিন পর্ব-০৬

0
1

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৬
.
সেদিন বিকেলে সিতারাকে নিয়ে বেরুনোর কথা থাকলেও ব্যাপারটা ভুলে বসেছিল নির্ঝর। বেরুলো না বাসা থেকে। পরদিন সকালে গতকালের মতো পরিস্থিতিতে পড়ল নির্ঝর। সকালে নির্ঝরের ঘুম ভাঙল নিজের শরীরের সাথে কোন উষ্ণ আলিঙ্গনে। সামান্য নড়েচড়ে উঠতেই সেই উষ্ণ আলিঙ্গন দৃঢ় হলো। মিষ্টি এক মেয়েলি সুভাস নাকে এসে ধাক্কা লাগল ওর। পিটপিট করে চোখ মেলে চাইল নির্ঝর, ওর বুকে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থায় পেল সিতারাকে। এক হাতে ও আলতো করে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটাকে। সিতারাও ওর বুকে মুখ গুঁজে, এক হাতে খামচে ধরে রেখেছে ওর টি-শার্ট।
নির্ঝরের ঘুম ছুটে গেল মুহুর্তেই। উঠার জন্য সামান্য মাথা উঁচিয়ে সিতারার খামচে ধরা হাতটা ছাড়িয়ে নেবার জন্য ধরল, কিন্তু পারল না। ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই সিতারা নড়ে উঠল, গুঁজে রাখা মুখ ও নাক দ্বারা নির্ঝরের বুকে ঘষে বিড়াল ছানার মতো চুপ করে গেল। নির্ঝরের হৃৎস্পন্দন মুহুর্তেই অস্বাভাবিক উঠল। কি করবে ও বুঝতে না পেয়ে মেয়েটার ধরে রাখা হাত চেপে ধরল। টেনে টেনে দু’বার শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে গেল। সময় যেন কিছু মুহুর্তের জন্য সেখানেই থমকে গেল নির্ঝরের কাছে। এ-কেমন অনুভূতি? এ-কেমন অস্থিরতা? বুঝে পায় না ছেলেটা। শুধু অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ওকে।

সময় ঠিক কতটা পেরিয়ে গেল, হিসেব করল নির্ঝর। কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারল—এই মেয়েটার সঙ্গ পেয়ে আজ অফিস বোধহয় ঠিকই মিস করে ফেলবে। অচেতন মন না চাইলেও ও বাধ্য হলো। ডেকে উঠল সিতারাকে, “সিতারা! সিতারা শুনছ!”

মেয়েটা নড়েচড়ে উঠে। ঘুমের ঘোরেই ‘উম উম্!’ করে আওয়াজ তুলে নির্ঝরের বুকে নাক মুখ ঘেঁষে চুপ করে যায়। যেন, এত আড়ামের জায়গায় আড়ামের ঘুম ছেড়ে উঠতে নারাজ। অজান্তেই ছেলেটার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সামান্য সময় নিয়ে আবারও, “এ্যাই মেয়ে, উঠো। ছাড়ো আমাকে।”

মেয়েটার ধরে রাখা হাত টেনে একটু জোরেই বলল। ঘুম খানিকটা হালকা হলো সিতারার। ফের নড়েচড়ে উঠতেই নির্ঝর বলল, “উঠো বলছি, নয়ত ছাড়ো আমাকে। নিজের বালিশ, নিজের জায়গা ছেড়ে আমাকে কোলবালিশ বানিয়েছ কেন?”

এবার ঘুম ভেঙে যায় সিতারার, পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতে চায়, নিজেকে আবিষ্কার করে শক্তপোক্ত পুরুষালি বুকে। তৎক্ষনাৎ ঘুম পুরোপুরি ভাবে ছুটে যায় মেয়েটার, নির্ঝরের বুকেই সামান্য হাতের ভর দিয়ে মাথা তুলে চায়। ওর অতি নিকটে নির্ঝরের মুখখানা দেখে বড় বড় চোখ করে তাকাল। বলে উঠল, “আপনি?”

“তো? অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুঝি?”

কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বলে নির্ঝর। সিতারা থতমত খায়। বলে, “নাহ্ মানে, আপনিই তো থাকবেন। কিন্তু এভাবে…”

“এটা তো আমারও প্রশ্ন! নিজের বালিশ, নিজের জায়গা ছেড়ে আমাকে কোলবালিশ বানিয়েছ কেন?”

সিতারা নির্ঝরকে ছেড়ে উঠে বসল বিছানায়। ওর পাশাপাশি নির্ঝরও উঠে বসল৷ সিতারা বলতে লাগল, “আসলে আমি তো, ঘুমে…”

“ঘুম তো তোমার বাহানা মাত্র। প্রথমে আমার দাদীকে দখল করলে, এরপর আমার বাবা মা’কে দখল করলে, তারপর দখল করলে আমার রুম, আমার বিছানা, এখন আবার আমার বুক দখল করে ফেলছ। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এ্যাই মেয়ে, সত্যি করে বলো তো তোমার মতলবটা ঠিক কী?”

“আমার মতলবটা তো পুরো আপনাকেই দখল করা। কিন্তু, সেটা আর পারছি কই!”

আস্তে করেই বলল সিতারা। তবুও কথাটা ঠিকই নির্ঝরের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ওর হাসি পেল, কিন্তু চেপে যাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা। গম্ভীর আওয়াজ তুলে সুধাল, “কী বললে?”

“বললাম আপনি… নাহ্! মানে, আপনি অফিসে যাবেন না? ফ্রেশ হয়ে নিন।”

নির্ঝর প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। মুচকি হেসে নেমে গেল বিছানা থেকে, সোজা গিয়ে ঢুকল ওয়াশরুমে। এদিকে থম মেরে বিছানাতেই বসে রইল সিতারা। উঁহু! ওর নির্ঝরকে বলা কথাটায় নয়, ঘুমের ঘোরে করা কান্ডে। রোজ ঘুমানোর আগে নির্ঝরের অনেকটা কাছাকাছি ও ইচ্ছে করেই শোয়। ঘুমন্ত নির্ঝরকে দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে যায়, টেরও পায় না। কিন্তু আজ.. আজ কি-না ও মানুষটার বুক’টাই দখল করে ফেলল? ভেবেই যেন লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে উঠল। মুহুর্তেই আবার হেসেও ফেলল নির্ঝরের কথা ভেবে। ওর হাসিটা একদম নীরব, নিঃশব্দ আনন্দের। ভিতরে ভিতরে কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। তাও স্বীকার না করা এক অনুভব—নামহীন, অথচ গভীর! ঠোঁটে হাসির রেখা ধরে রেখেই সিতারা ওয়াশরুমের দরজার পানে তাকিয়ে বলে উঠল, “আমার সুন্দর মানুুষ!”

.
কয়েকটা দিন কেটে গেল নির্ঝর সিতারার সম্পর্কটা গভীর হতে হতে। নির্ঝর আগের চেয়ে সিতারার প্রতি খানিকটা নরম হলেও ওকে রাগ দেখিয়ে ধমক দেওয়াটা কমে নি। এতে মন খারাপ নেই মেয়েটার, বরং ভালোই উপভোগ করে মেয়েটা। এরপর নিজেও নির্ঝরকে ভরকে দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে।

এই তো গত কালের ঘটনা—দুপুরের পর কিছুতেই ওর শুয়ে বসে কাটাতে মন চাইছিল না সিতারার। ভাবল, ঘরের টুকটাক কাজ’ই না-হয় করুক। এরপর আর বসে না থেকে পুরাতন এক কাপড় নিয়ে রান্নাঘর ও ডাইনিং রুমের এটা-ওটা মুছতে লাগল। এরপর গেল ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুম পরিষ্কার করতেই ওর নজর পড়ল কর্ণার টেবিলে। যেখানে নির্ঝরের এক ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। সিতারা এগিয়ে গিয়ে ফ্রেম’টা হাতে নিয়ে মুচকি হাসল। এরপর হাতে থাকা কাপড়টা দিয়ে সযত্নে তা মুছল। সাদা শার্টে হাত গুটিয়ে রাখা কনুইয়ের মাঝামাঝিতে, শার্টের বোতামও বুক পর্যন্ত খোলা। চুলগুলো সেট করে সুন্দর করে আঁচড়ানো, হালকা চাপ দাড়িতে চোখে এক আলাদাই দ্যুতি খেলে গেছে যেন নির্ঝরের এই ছবিটায়। ছবিটা প্রথম দেখার পরেই ভয়াবহ রকমের ক্রাশ খেয়ে বসেছিল সিতারা। প্রেমে পড়তেও বোধহয় সময় নেয় নি। মানুষটার মতোই এই ছবিটাও ওর ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে।
সিতারা আলতো করে ছবিটায় হাত ছুঁয়ে, “আমার সুন্দর মানুষ, ঠিক এইভাবে বাধাহীনে কবে আপনাকে ছুঁতে পারব, বলন তো? একটু একটু করে এই গোটা আপনাকে কবে পাবো? কবে পুরো আপনাতে রাজত্ব করব আমি? এই কবে’টাই বা আসবে কবে? উফ্! ভাল্লাগে না..!”

বলেই ঠোঁটে বিস্তার হাসি ফুটিয়ে আনে মেয়েটা। ছবিটা রেখে দেয় তার নিজস্ব স্থানে। এরপর টেবিল কর্ণার’টা মুছতে মুছতে গুণ গুণ করে গেয়ে উঠে,

‘ওগো আমার সুন্দর মানুষ, একটা কথা শোন।
ওগো আমার সুন্দর মানুষ, একটা কথা শোন,
তুমি বিনা আমার তো নাই গতি কোনওও…
ওগো আমার সুন্দর মানুষ, একটা কথা শোন!

তুমি আমার জানের জান, করোনা অভিমান।
ভালেবেসে দিতে পারি তোমায় আমি এই প্রাণ..
দোহাই লাগে সুন্দর মানুষ একটা কথা মানো,
দোহাই লাগে সুন্দর মানুষ একটা কথা মানো..
তুমি বিনা আমার তো….’

“এসব কি গান? আমি না থাকলে কি সারাদিন এসব উল্টাপাল্টা গান নিয়েই থাকো! কি জান, অভিমান নিয়ে রেখেছ, হ্যাঁ?”

নির্ঝরের কথায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠে থেমে গেল সিতারা। পিছন ফিরে তাকিয়ে বুকে থু থু করে উঠল। আচমকা নির্ঝরের আগমনে ভয় পেয়েছে মেয়েটা খুব। অন্যদিন এমনটা হয় না। আজ গানের মাঝে নিজেকে ডুবে রেখেছিল বলেই বোধহয় ভয় পেল। হাতের কাপড়টা ফেলে এগিয়ে এলো সিতারা। বলল, “উফ্! এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়? কথা বলে আসবেন না!

“জান, প্রাণ, অভিমান নিয়ে ডুবে থাকলে ভয় তো পাবেই। আর আমাকে বলছ—কথা বলে আসতে!”

কিঞ্চিৎ ধমকের সুর নির্ঝরের কণ্ঠে। সিতারা ওর ধমক’কে পরোয়া না করে বলে উঠল, “সেই সব তো আপনিই। আপনাতে ডুবে আছি, আর আপনিই ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন?”

“এ্যাই মেয়ে, কী বললে তুমি?”

মুচকি হাসল সিতারা। নির্ঝরের এই একটুখানি অবাক হওয়া দ্বিগুণ করতে জবাবে বলল, “ভয় দেখিয়েছেন আপনি, সাংঘাতিক ভয় পেয়েছি আমি। নিন, এবার জড়িয়ে ধরুন, আমার ভয় কাটান।”

থতমত খায় নির্ঝর। সিতারা সামান্য এগিয়ে আসতেই দু’কদম পিছিয়ে যায়। সিতারা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে ফের বলে, “কি হলো? নিন, জড়িয়ে ধরুন।”

“সিতারা, কি শুরু করেছ তুমি, হ্যাঁ?”

“কি শুরু করেছি মানে! একটু জড়িয়ে ধরতেই তো বলেছি।”

“দ্যাখো, তুমি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছ।”

“আপনি দেখুন, আমাকে…”

“শ্যাট আপ! আর একদম কথা বাড়াবে না। পারলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো রুমে।”

বলেই গটগট করে রুমের দিকে হাঁটা ধরল নির্ঝর। সিতারা এবার শব্দ করেই গেয়ে উঠল,

‘কোরো না অবহেলা, দিয়ো না এত জ্বালা,
মরে গেলে বলো তোমায় কে পড়াবে মালা…
এখন থেকে মিলনের ক্ষণ শুধু তুমি গুণো,
তুমি বিনা আমার তো নাই গতি কোনওও
ওগো আমার সুন্দর মানুষ একটা কথা শোন,
ওগো আমার সুন্দর মানুষ একটা কথা শোন…’

নির্ঝর চোখমুখ কুঁচকে একবার পিছন ফিরে তাকাল। এরপর সোজা নিজের রুমে ঢুকে শব্দ করেই দরজা আটকে দিলো। সিতারা খিলখিল করে হেসে উঠল, গুণগুণ করে ফের গেয়ে উঠল,

‘ওগো আমার সুন্দর মানুষ একটা কথা শোন,
তুমি বিনা আমার তো নাই গতি কোনওও…!’

.
গতকালের কথা ভেবে হাসি ফুটে উঠেছে সিতারার ঠোঁটে। আজকাল বড্ড জ্বালাতে ইচ্ছে করে নির্ঝরকে। যেখানে গোটা মানুষটাই ওর, সেখানে একটু-আধটু মানুষরাকে জ্বালানো তো ওর অধিকার।
টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে সে-সব কথাই ভাবছিল সিতারা। এরমাঝেই নির্ঝর এলো একেবারে রেডি হয়ে। অফিসে বেরুবে ও। চেয়ারে বসতেই সিতারা খাবার দিলো ওর প্লেটে। নির্ঝর খাওয়া শুরু করল। সিতারার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তুমি খাবে না? বসো!”

মেয়েটা বসল। প্লেটে খাবার নিতেই নির্ঝর ওকে বলল, “তোমার এসএসসির রোল নাম্বর, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বর মনে আছে? মনে না থাকলে বাড়িতে ফোন করে জেনে নিও তো।”

“কেন? কি করবেন?”

“দরকার আছে। তুমি জেনে নিও।”

“তার দরকার নেই। মনে আছে আমার।”

“বাহ্, গুড! যতটা খারাপ ছাত্রী মনে করেছিলাম, ততটাও নও দেখি। নয়ত ফেইল করা স্টুডেন্টের কি রোল নাম্বর, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বর মনে থাকে!”

বলেই থামে নির্ঝর। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে ফের বলল, “আমার এখুনি লিখে দাও। দরকার আছে।”

এদিকে ভীষণ অপমানবোধ করল সিতারা। বছর বছর স্কুল ফাস্ট হওয়া মেয়েটা যখন ফেইল এর তকমা পায় তখন ভীষণ কষ্ট হয় ওর। কষ্ট হয় নিজের নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে না পারার জন্য।
সহসায় কিছু বলল না সিতারা। বোধহয় নিজের চাপা কষ্ট আরও চাপা দেবার চেষ্টা করল। এরপর প্রত্যুত্তরে আস্তে করে বলল, “নিতে হবে না। আমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নেবার মতো তো কোন দরকার দেখছি না আমি।”

.
.
চলবে…

[রি-চেক দেওয়া হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।]