তারপর একদিন পর্ব-০৭

0
1

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৭
.
চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগী সিতারা। নির্ঝর কপাল কুঁচকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে—হঠাৎ কি হলো মেয়েটার! এই মেয়েটাকে ও কখনোই বুঝে উঠতে পারে না। এই ভালো, তো এই খারাপ। প্রতিক্রিয়া জানাল না নির্ঝর। তবে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, “দরকার আছে বলেই নিচ্ছি। দিতে বলেছি দিবে, এত কথা বাড়াচ্ছ কেন? আশ্চর্য!”

“কিন্তু, আপনার তো…”

“দ্যাখো সিতারা, তুমি না দিলে কিন্তু আপনি বাবাকে বলতে বাধ্য হবো—তোমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন জানিয়ে আমাকে জানাতে।”

এবার আর কথা বাড়াতে পারল না সিতারা। মুখ ভাঁজ করে বিড়বিড়িয়ে কিন্তু বলতে বলতে উঠে গেল টেবিল ছেড়ে। সামান্য পর এক কাগজে ওর রোল ও রেজিষ্ট্রেশন নাম্বর লিখে এনে নির্ঝরকে দিলো। নির্ঝর হাসল ওর কান্ডে। তবে সেই হাসিটা সিতারার নজরে মোটেও পড়ল না।

.
অফিস শেষে সিতারার এসএসসির রেজাল্ট শিট নিয়ে, হতভম্ব মুখে বাসায় ফিরল নির্ঝর। মূলত, মেয়েটার রেজাল্ট শিট তুলতেই ওর থেকে রোল, রেজিষ্ট্রেশন নাম্বর নিয়েছিল। কিন্তু সেটা দেখার পর যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছিল না। নির্ঝরের ধারণা ছিল—ওর জানা’টা বোধহয় ভুল। সিতারার কথা বলা, মুখের এক্সপ্রেশন, খারাপ স্টুডেন্ট বললেই মুখ ভার করা! এসবে ওর ধারণা হয়েছিল, সিতারা এসএসসিতে ফেইল নয়। তবে, ওর ধারণা ভুল। হ্যাঁ! এসএসসি ফেইল সিতারা।কিন্তু, তাতেই যেন হতভম্ব নির্ঝর। এ-ও কি সম্ভব? উত্তর পায় না ছেলেটা।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে সিতারার রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে আরও একবার দেখল। এর মাঝেই এক গ্লাস পানি নিয়ে উপস্থিত হলো সিতারা। নির্ঝরের দিকে তা বাড়িয়ে দিয়ে নিতেও বলল। কিন্তু নির্ঝরের মনোযোগ সম্পূর্ন ওর হাতের কাগজে। সিতারা তা খেয়াল করে সুধাল, “এটা কী?”

“আমিও তা ভাবছি, এটা কী?”

“মানে?”

মাথা তুলল নির্ঝর। সিতারার দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে, তোমার মার্কশীট! এটা কি-করে সম্ভব সিতারা?”

ব্যাপারটা বুঝতে পেয়ে সিতারা প্রত্যুত্তর করল না। বাড়িয়ে দেওয়া দাত গুটিয়ে নিয়ে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল। নির্ঝর আবারও বলল, “সব সাবজেক্টে এ+, অথচ ফোর সাবজেক্টে ফেইল? কীভাবে সম্ভব এটা?”

সিতারা কথা বলে না। নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রয়। কিঞ্চিৎ মেজাজ খুঁইয়ে নির্ঝর বলে, “কি হলো, কথা বলছ না কেন?”

“কী বলব?”

“কী বলবে মানে? ইংরেজি, ম্যাথ, সব সাবজেক্টে এত ভালো রেজাল্ট তোমার। সেই তুমি ফোর সাবজেক্ট কৃষিতে ফেল করো কেমনে!”

আবারও নিশ্চুপ সিতারা। নির্ঝর কিঞ্চিৎ ধমক দিয়েই ফের সুধাল, “আবারও চুপ করে আছ কেন? কথা বলো।”

“বলার মতো কি আছে যে বলব?”

“যেটা জিজ্ঞেস করছি, সেটার উত্তর দাও!”

“সামান্য এক ফেইল করাটা তো বড় বিষয় নয়। প্লিজ! আপনি আমাকে এসব বিষয়ে আর জিজ্ঞেস করবেন না।”

বলেই চলে যেতে নিলো সিতারা। নির্ঝর খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল। মেয়েটা ওর দিকে তাকাতেই বলল, “কোথাও যাবে না তুমি। বসো এখানে।”

সিতারা বসল না। নির্ঝর ফের কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে উঠল। হাতের গ্লাসটা ট্রি টেবিলে রেখে এবার বসল ও। সামান্য সময় নিয়ে নির্ঝর বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি তাতে তুমি মোটেও খারাপ স্টুডেন্ট নও। কিন্তু, ইজি এক সাবজেক্টে ফেইল কেন আসলো, এটাই ভাববার বিষয়।”

মেয়েটার নিশ্চুপ। নির্ঝর ওর কাঁধে হাত রাখল, গলার স্বর পরিবর্তন করে আদুরে কণ্ঠে বলল, “দ্যাখো সিতারা, আমরা একে-অপরকে ঠিকভাবে মেনে নিতে না পারলেও আমি তোমার হাসবেন্ড। সবকিছু জানার রাইট আছে আমার। বি ইজি!”

চোখের কোণে অশ্রু জমা হয় সিতারার। এতগুলো বছর পর হঠাৎই যেন নিজের এক ছায়াতল খুঁজে পেল। বড্ড ভরসা করতে মন সায় দিলো এই মানুষটাকে। একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বলল, “জানেন, যার বাবা মা নেই—তার শখ আহ্লাদ নেই, স্বপ্ন নেই, ইচ্ছে নেই, আকাঙ্খা নেই! লেখাপড়া, সেটা তো অনেক দূর।”

“এভাবে বলছ কেন? তুমি…”

“আমার না অনেক স্বপ্ন ছিল! বাবা মায়ের দেখানো সেই স্বপ্ন, অনেক বড় কিছু হবার। কিন্তু… কিন্তু ওরা আমার সব স্বপ্ন একদিনেই ভেঙে ফেলেছে।”

“কার কথা বলছ তুমি?”

“আমার চাচী…”

হঠাৎ থেমে গেল সিতারা। বাবা মা হারা সেই অতীতগুলো মনে করতে না চাইলেও ভুলে যেতে পারে না। আজও চাইল না, কিন্তু মানসপটে ঠিকই ভেসে উঠল…

সিতারার বাবা এক এক্সিডেন্টে হঠাৎ মা’রা যাবার পর ওর মা হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ল। সিতারা তখন খুব ছোট, মাত্র ছয় বছর বয়স। মায়ের ছায়াও ওর খুব বেশিদিন কপালে ছিল না। সিতারার যখন বারো বছর বয়স, তখন ওর মাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। এরপর সিতারার দ্বায়িত্ব ওর চাচার উপরেই এসে গেল। খুব আদর ও ভালোও বাসতেন ওর চাচা। কিন্তু সিতারার চাচী খুব একটা সহ্যই করতে পেত না যেন মেয়েটাকে। তার এক কথা—আমার মেয়েটার আদরে ভাগ বসাতে ও এসেছে। চাচার জোরেই সিতারা পড়াশোনা এগিয়েছে। কিন্তু সেদিন, সিতারার শেষ পরীক্ষায় সুযোগটা পেয়ে ওকে নিচু দেখাতে বাড়িতেই আঁটকেই রাখে ওকে। এরপর যখন পরীক্ষার অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে যেতেই ওর চাচা আসে, তখনই চাচী নিজের বানোয়াট কথায় জড়িয়ে নেয় ওনাকে। স্ত্রী’র কথায় ওর চাচা বিশ্বাসও করে ফেলেন। এতটা বিশ্বাস নিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছে, আর ও তাদের বিশ্বাস ভাঙল বলে—সিতারার সাথে রাগারাগিও করেন। পাঠিয়ে দেন ওকে পরীক্ষার হলে। ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে যায়। নিয়ম তো আর সিতারার দুঃখ বুঝবে না। প্রায় দু’ঘন্টা পেরিয়ে যায়। অতটুকু সময়ে চাইলেও পুরো পরীক্ষা’টা দেওয়া সম্ভব হয় না। এরপর.. এরপর ফেইলের তকমাটা লেগেই যায় ওর।
সেদিনের পর শক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই ভেঙে যায় সিতারা, চুপচাপ হয়ে যায় অনেকটা। নিজের মতামতটুকুও প্রকাশ করতে পারে না। নির্ঝরের সাথে বিয়েটাও ছিল ওর প্রতি চাচার সেইদিনের রাগ থেকে। নয়ত সিতারার বিশ্বাস, চাচা ওকে কখনোই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতো না। নির্ঝরের সাথে ওর বিয়ের কথাটা জানার পর ওর চাচা তো বলেইছিল—পরের মেয়েকে আর বসে বসে খাওয়াতে পারব না। অনেক করেছি তার জন্য।

.
অতীত যেন বড্ড নাড়া দেয় সিতারার মনে। তবুও নিজেকে সামলাতে শিখেছে ও এতদিনে। যতই হোক, সেই মানুষগুলো তো ওর আপনজন, বাবা মা’হীন এত বছর খেয়াল তো রেখেছে ওর। নির্ঝরকে সবটা বলতে চাইল না তাই ও। এড়িয়ে যেতে আস্তে করে বলল, “নাহ্, কিছু না! সেদিন পরীক্ষা’টা খারাপ হয়েছিল, তাই..!”

নির্ঝর বেশ বুঝল ওর এড়িয়ে যাওয়াটা। তাই আর কথা বাড়াতে চাইল না। বলে উঠল, “আচ্ছা বেশ, মানলাম তোমার কথা। কিন্তু, এবার আমার কথাও তোমার মানতে হবে।”

প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকায় সিতারা। কি কথা মানার কথা বলতে চাইছে, সেটাই জানার আগ্রহ। নির্ঝর আবারও, “আমি বাবার সাথে কথা বলব, তোমার স্কুলে কি কি ফর্মালিটি করতে হবে সব করতে বলব। ফেইল সাবজেক্ট’টা আবার পরীক্ষা দেবে তুমি।”

বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। সিতারা অবাক কণ্ঠে সুধাল, “পরীক্ষা দেবো?”

“হ্যাঁ, দিবে! আর, এবার পাশও করতে হবে। তোমার কি মনে হয়, ইঞ্জিনিয়ারের ডিগ্রি নিয়ে আমার বউ’কে এসএসসি ফেইল বলে পরিচয় দেবো? উঁহু! কখনো না।”

এরপর আর দাঁড়াল না নির্ঝর। চলে গেল রুমে। এদিকে অবাকের ন্যায় বসে রইল সিতারা। কী বলে গেল মানুষটা? ভাবনায় ডুবল যেন। ভাবনার শেষে আঁটকে গেল—আমার বউ! কথাটায়। নিমিষেই অদল হলো ওর চেহারার, হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। নিজ মনেই বলে উঠল, “আমার সুন্দর মানুষ, আপনি ডুবেছেন সিতারার মায়ায়!”

.
পরেরদিন সকালে নির্ঝরের’ই ঘুম ভাঙল প্রথমে। সেদিনের মতো আজকেও সিতারাকে পেল নিজের বুকে। মেয়েটা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। যেন একটু ছাড় দিলেই কোথায় হারিয়ে যাবে। অজান্তেই মুচকি হাসল নির্ঝর। সামান্য নড়ে উঠতেই উপলব্ধি করল, সেও জড়িয়ে রেখে সিতারাকে। ওর হাত স্পর্শ করে আছে মেয়েটার উন্মুক্ত কোমরে। ওর শাড়িটা যে বরাবরের মতোই এলোমেলো, তা বুঝতে বাকি রইল না। কিঞ্চিৎ অস্বস্তির সাথে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো নির্ঝরের। খারাপ লাগল না, তবে ভালো লাগাটাও বুঝতে চাইল না। তবে সিতারার কোমর স্পর্শ করা হাতটা দৃঢ় হলো ওর অজান্তেই।

সেভাবেই সময় কাটল বেশকিছুক্ষণ! সিতারা সামান্য নড়েচড়ে উঠতেই নির্ঝর নিজেকে ধাতস্থ করে হাত সরিয়ে নিলো দ্রুত। যেন চুরি করে হাত রেখেছিল—এখন ধরা পড়ে যাবে সেই ভয়। কিন্তু, পরক্ষণেই খেয়াল এলো, ওর বুকের সাথে এখনও লেপ্টে আছে সিতারা। মেয়েটার চোখ বন্ধ, ঘুম ভাঙেনি এখনও। মুচকি হাসল নির্ঝর। আস্তে করে ডেকে উঠল, “সিতারা!”

সিতারা উঠল না, ঘুমও ভাঙল না। নির্ঝর এবার সামান্য ঝাঁকিয়ে ওকে ডাকল, “সিতারা, উঠো।”

সিতারা সামান্য নড়েচড়ে উঠে, নির্ঝরের বুকে মুখ ঘেঁষে ফের স্থির হয়ে যায়। ছেলেটা ওকে ফের ডেকে উঠে, “এ্যাই মেয়ে উঠো তো, নয়ত ছাড়ো আমাকে। উঠব আমি!”

সিতারা নড়েচড়ে উঠে, “উম্! ঘুমাতে দিন তো। রাতে একটুও ঘুম হয় নি।”

ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ওর। নির্ঝর বিরক্তির সুরে বলে, “সারারাত কি করেছ, যে ঘুম হয় নি? ছাড়ো তো আমাকে!”

“আপনাকে দেখেছি! আপনাকে দেখেছি বলেই তো ঘুম হয় নি।”

“আমাকে দেখেছ মানে?”

কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে সুধাল নির্ঝর। সিতারা আগের ন্যায় অস্পষ্ট সুরে বলল, “আপনাকে দেখতে ভালো লাগে, তাই দেখি! এখন ঘুমাতে দিন আমাকে।”

“এ্যাই মেয়ে! কিসব বলছ, হ্যাঁ? উঠো বলছি, ছাড়ো আমাকে।”

সিতারার ঘুম ভেঙে যায় এবার। পিটপিট চোখে তাকিয়ে নির্ঝরের বুকে হাতের ভর রেখে মাথা তুলে চায়। ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বরে সুধায়, “কী হয়েছে?”

.
.
চলবে…