#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১১
.
“তুই আর কি বুঝবি বাসারের মর্ম? বিয়ের কয়েক মাস হলো, তবুও নিজের বাসর’টা বোধহয় করতে পারলি না। নিজে পারলি না বলে আমার বাসর’টাও হতে দিবি না, নির্ঝর?”
নির্ঝর বিষম খেলো, খুক খুক করে কেশে উঠল। কাশতে কাশতে তাকাল সিতারার দিকে। মেয়েটা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। এই মুহুর্তে এখান থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে। বাহানা দিতে বলল, “তরকারিটা বোধহয় হয়ে এসেছে। আমি দেখে আসছি।”
এরপর সেকেন্ডও সময় নষ্ট করে না। দ্রুত পায়ে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। শুভ আফসোস নিয়ে বলল, “দ্যাখ, মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেল। তোর কি মনে হয়, আমার বউকেও এমন মন খারাপ নিয়ে রাখব?”
“মুখটা বন্ধ করবে তুমি!”
নির্ঝর কিছু বলতে চাইলেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে নীলা। এমন কথায় মেয়েটা কিঞ্চিৎ লজ্জাও পায়। সেও রান্নাঘরের বাহানা নিয়ে সিতারার কাছে যায়। শুভ তাতে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বাকি দুই বন্ধুদের বলে, “তোরা যা এখনি, নির্ঝরের থেকে টাকা নিয়ে ফুল কিনে আন।”
“টাকা! আমি কেন টাকা দেব?”
কপাল কুঁচকে সুধাল নির্ঝর। শুভ বলল, “দ্যাখ নির্ঝর, এই সময় টাকাপয়সার সাশ্রয় খুব প্রয়োজন আমাদের। তোর ভরসায়, তোর বাসায় পালিয়ে এসেছি, দ্বায়িত্বও তো তোরই।”
“পারব না। তোর এসব ফালতু খরচে টাকা নষ্ট করতে পারব না আমি।”
“আমার বাসর তোর ফালতু মনে হলো? তুই কি বুঝবি বাসরের মর্ম? জ্বলজ্যান্ত এক বউ পেয়েও তো সেই ভাগ্যটা তোর হয় নি। তোর হয় নি বলে, আমার বাসরেও নজর দিবি শালা!”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে শুভ। সামান্য সময় নিয়ে ফের বলে, “ভেবেছিলাম, এই সুযোগে তোর ঘরও সাজিয়ে তোকে বাসরের সুযোগ করে দোবো। কিন্তু, তুই শ্লা বেইমান!”
“তোদের মতো সাজিয়ে, গুছিয়ে, প্লানিং করে বাসর করে না এই নির্ঝর তালুকদারের! যা করে, হঠাৎ করেই প্লানিং ছাড়া সবকিছু করে।”
ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা নিয়ে বলে নির্ঝর। শুভ হস বাকিরা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। হয়ত বোঝার চেষ্টা করে নির্ঝরের বলা কথাটার মানে। ওদের দেখে ঠোঁটের হাসিটা বিস্তার হয় নির্ঝরের। বলে উঠে, “আচ্ছা, দিচ্ছি আমি টাকা। আমার রুমও সাজাতে হবে না। তবে কিছু ফুল রাখতে ভুলে যাবি না।”
.
রাতের বেলা নিজেদের রুমে এসে অবাক হলো সিতারা। রুমে ঢুকতেই রজনীগন্ধার সুবাস এসে ধাক্কা লাগল নাকে। সাথে সাথে ওর নজর গেল টেবিলে থাকা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা দিকে। ফুলগুলো দেখে চনমনে হয়ে উঠল ওর মন, এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিতেও সময় নিলো না। এর মাঝেই রুমে এলো নির্ঝর। ফুল হাতে মগ্ন সিতারার দিকে একবার তাকিয়ে দরজা আটকে দিলো। দরজা আটকানোর শব্দেই ফিরে তাকাল। ওকে দেখেই ঠোঁটে বিস্তার হাসি নিয়ে সুধাল, “এতগুলো ফুল কে রেখেছে এখানে?”
“আমি রেখেছি। ওদের আনতে বলেছিলাম।”
“নীলা আপুদের রুমে রাখলেই পারতেন। প্রথমরাত তো আজ ওনাদের। আমাদের রুমে কেন রেখেছেন?”
“কেন, তোমার ভালো লাগে নি?”
“ও মা, ভালো লাগবে না কেন! ফুল দেখলে তো এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। সেখানে তো আমার প্রিয় ফুল। দেখুন না, গন্ধ শুঁকলেই কেমন মন ফুরফুরে হয়ে যায়।”
“রজনীগন্ধা তোমার প্রিয় ফুল?”
“উমম্! প্রিয়ই। গন্ধ সুন্দর তো। শুঁকলেই কেমন শান্তি শান্তি লাগে।”
এগিয়ে এসে সিতারার কাছাকাছি দাঁড়ায় নির্ঝর। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে। ফের বলে, “ফুলের গন্ধ সুন্দর বলে তোমার পছন্দ! এটা কেমন কথা?”
“কেমন কথা আবার! গন্ধওয়ালা সব ফুলোই আমার ভালো লাগে। রজনীগন্ধা, বেলি, গন্ধরাজ সব ফুলই আমার পছন্দের।”
বলেই সামান্য থামে সিতারা। সম্পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আবারও বলে, “তবে হ্যাঁ! এই ফুলগুলোকে বিট করে আরও একটা গন্ধ আমার পছন্দের তালিকায় এসে গেছে। উম্! শুধু পছন্দ নয়, ভালোবেসেও ফেলেছি!”
কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকাল নির্ঝর। সিতারা মুচকি হেসে সুধাল, “জিজ্ঞেস করবেন না, কী সেটা?”
“বলো, শুনি!”
মুহুর্তেই ঠোঁটের হাসিটা লজ্জায় অদল হলো সিতারার। হাতের ফুলগুলো রেখে অতি নিকটে এলো নির্ঝরের। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরল ওকে। বুকে মুখ লুকিয়ে এক হাতে খামচে ধরল ছেলেটার টি-শার্ট। এরপর ধীরে ধীরে নিশ্বাস টেনে আস্তে করে বলল, “আপনি! আপনার শরীরে মিশে থাকা এই গন্ধ। যেটা এই ফুলের গন্ধকেও হার মানায় আমার কাছে। আর, আমি ভালোবেসে ফেলি, বার বার প্রেমে পড়ি।”
হেসে উঠল নির্ঝর। সে হাসির কোন শব্দ হলো না। দু’হাতে আগলে নিলো সিতারাকে। বিড়বিড়িয়ে বলল, “আমি যে তোমার স্মেলে ঠিক কতটা দূর্বল হয়ে পরি, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, সিতারা!”
.
অফিস থাকলেও সকালে কিছুটা বেলা করে উঠল নির্ঝর। ঘুমটায় ভাঙল দেরিতে। সকাল সকাল গোছল সেড়ে, একবারে ফ্রেশ হয়েই ডাইনিং রুমে এলো। সিতারা সকালেই উঠেছে। নির্ঝর উঠতে উঠতে ওর নাস্তা বানানো প্রায় হয়েই এসেছিল। সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল, ও আর নীলা মিলে। নির্ঝর ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসল এসে। শুভও ঠিক তখনই এলো। ওর পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে উঠল, “বিয়ে হলো আমার, বাসর রাত ছিল আমার, তুই কেন সকাল সকাল গোছল করেছিস? কাহিনী কী বন্ধু?”
হঠাৎ এমন কথায় গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল নির্ঝর। সামান্য সময় নিয়ে বলল, “অফিসে যেতে হবে না আমার! প্রতিদিন সকালে গোছল করি, এটা আর নতুন কি?”
“ওও আচ্ছা!”
এর মাঝেই সকালের নাস্তা গুলো এক এক করে নিয়ে এলো সিতারা ও নীলা। কাজের মাঝে পেঁচিয়ে রাখা ওড়না মাথা থেকে পড়ে গেল সিতারার। শুভ সিতারার ভেজা চুলগুলো খেয়াল করে নির্ঝরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুই না-হয় অফিসে যাবি! কিন্তু ভাবী.. ভাবীও কি তোর সাথে অফিসে যাবে? সে-ও দেখি তোর সাথে সঙ্গ দিয়ে গোছল সেড়ে ফেলেছে।”
সিতারা বেশ লজ্জা পেল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে নির্ঝরের দিকে তাকালো। ছেলেটাও তখন ওর দিকে তাকাল, মুচকি হাসল। তাতে যেন সিতারার লজ্জার মাত্রা দ্বিগুণ হলো। ব্যাপারটা বেশ খেয়াল করল নীলা। নির্ঝরের সাথে সিতারার সম্পর্কটা কতদূর পৌঁছে গেছে, সেটাও শুনছিল রান্না করতে করতে। শুভকে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে বলল, “শুভ, চুপ করবে তুমি! কোথায় কি বলতে হয়, সেটা কি জানো না তুমি?”
“জানো নীলা, আমার তো মনে হচ্ছে এই ব্যাটা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। শুধু আমরাই ধরতে পারছি না।”
“তুমিই তো, না পাবারই কথা। এবার চুপচাপ নাস্তা শেষ করো।”
আর কথা বাড়াতে চাইল না শুভ, চুপচাপ খেতে থাকল। সিতারা ও নীলাও বসল খেতে। খাবার এক পর্যায়ে নীলা আবদার করে বসল—আজ বিকেলে ঘুরতে যাবে বাইরে। ওদের যেহেতু বিয়েটা হয়েই গেছে, তখন বাবার কাছে ধরা খাবারও ভয় নেই। নির্ঝরকেও বলে দিলো, অফিস থেকে যেন আজ তাড়াতাড়িই আাসায় ফিরে।
.
একের পর এক ফোনের অত্যাচারে তাড়াতাড়িই অফিস থেকে ফিরতে হলো নির্ঝরকে। নীলা যেহেতু বলেছে—সবাই ঘুরতে যাবে, তখন যাবেই। তাছাড়া সিতারাকে নিয়েও কখনো বেরুনো হয় নি ওর। আজ না-হয় মেয়েটাকেও একটু সময় দেওয়া যাবে।
সিতারার কথা ভাবনায় রেখেই অফিস থেকে দুপুরের পর ফিরল নির্ঝর। দুপুরের পর এলেও খাওয়া হয় নি আজ অফিসে। ক্লান্ত শরীরেই ডাইনিং রুমে এসে সোফায় গা এড়িয়ে দিলো। ওর পাশেই বসে মোবাইল টিপছিল শুভ। ওকে জিজ্ঞেস করল, “সিতারা কোথায়?”
“কোথায় আর থাকবে! তোদের রুমে।”
নির্ঝর সিতারা বলে ডেকে উঠল। শুভ বলল, “তোর সিতারাকে আর পাবি কোথায়! আমার নীলা তো তাকে কব্জা করে ফেলেছে।”
“মানে?”
“মানে, মেয়ে মানুষ মানেই সাজুগুজু, আর সাজুগুজু মানেই মেয়ে মানুষ। ঘুরতে যাবে বলে তারা এখন সাজতে বসেছে। আরও ঘন্টা দুয়েক যাক, তবেই না তোর সিতারার দেখা পাবি, বন্ধু।”
কপালে ভাঁজ ফেলে নির্ঝর। বলে উঠে, “কিন্তু সিতারা তো তেমন সাজে না। তাহলে ও… সিতারা!”
ফের ডেকে উঠল ও সিতারাকে। শুভ বলল, “নীলা তো সাজে। একবার যখন পকে পেয়েছে, তখন আর আর এত সহজে ছাড়বে না…”
“কখন এসেছেন আপনি? কিছু লাগবে?”
হঠাৎ সিতারার কণ্ঠস্বরে থেমে যায় শুভ। তাকায় ওদিকে। নির্ঝরও সিতারার কণ্ঠে সেদিকে তাকায়। তাকিয়েই যেন ওর সর্বনাশটা হয়। চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, থমকে দাঁড়িয়ে রয় সিতারার পানে তাকিয়ে। মুখ ফুটে আস্তে করে বলে উঠে, “সিতারা!”
নীল রঙের জর্জেটের মতো এক শাড়ি সিতারার পরনে। ফর্সা মুখখানায় জ্বলজ্বল করা নাকে নাকফুল, কানে মাঝারি সাইজের ঝুমকো, বড় বড় চোখে গাড়ো কাজল দেওয়া, উড়তে থাকা খোলা চুলের সিতারা যেন টানছে নির্ঝরকে। দৃষ্টি ফেরানোও যেন দ্বায় হয়ে উঠেছে ওর। মনে হচ্ছে, এখনি শ’খানেক চুমুতে ভড়িয়ে দিক মেয়েটাকে, নিবারণ করুক চুমু নামক তৃষ্ণার।
ভেবেই শুকনো ঢোক গিলল। কোন রকমে নিজেকে সামাল দিয়ে আস্তে করে বলল, “পানি!”
সিতারা বুঝল—মানুষটা পানি খাবে। না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। নির্ঝরের হাতে দিতেই তা ঢকঢক করে শেষ করল। এরপর গ্লাসটা সিতারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আস্তে করে, “রুমে এসো!”
বলেই আর সেখানে দাঁড়াল না ছেলেটা। দ্রুত পায়ে চলে গেল নিজেদের ঘরে।
.
.
চলবে….
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন… ]