#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১০
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুমে বসে আছে অর্পন। গম্ভীর মুখে বসে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলছে। ইতিমধ্যে নিজের পরিচয় অর্পন প্রধান শিক্ষককে জানিয়েছে তবে সে যে পুলিশ এই কথা বাকিদের জানাতে নিষেধ করেছে। বাচ্চারা শুধু শুধু ভয় পেয়ে যাবে তাই। প্রধান শিক্ষক অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—“দেখুন স্যার, আপনি যার কথা বলছেন মেয়েটার নাম বকুল। মেয়েটা অনেক শান্তশিষ্ট আর খুবই ভালো। ওর ভাই ভাবির বিষয়টা এখনো কিছু জানে না, আমরা জানাইনি আর কি। তাই জানার পর কেমন রিয়্যেক্ট করবে বুঝতে পারছি না।”
তাদের কথার মাঝেই সেখানে উপস্থিত হয় তেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে। ভয়ে কাচুমাচু হয়ে প্রবেশ করে প্রধান শিক্ষকের রুমে। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাড়িয়ে পড়ে পেছনে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে স্বভাবগত দিক থেকে মেয়েটা বেশ শান্ত। অচেনা মানুষের মাঝে যে সহজ হতে পারছে না সেটা তার চেহারাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চেহারার গাম্ভীর্য লুকিয়ে ফেলে অর্পন। চেহারার ভঙ্গি স্বাভাবিক করে ধীর কন্ঠে ডাকে,
—“বকুল! এখানে আসো।”
অর্পনের ডাকে মাথা তুলে তাকায় বকুল। তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অর্পনের হাস্যজ্জল চেহারা। অর্পনের হাতের ইশারা বুঝতে পেরে কয়েক কদম এগিয়ে আসে। কাছে আসতেই অর্পন ইশারায় পাশের চেয়ারে বসতে বলে। বকুল প্রিন্সিপালের দিকে তাকালে সেও ইশারায় বসতে বলে। এই পর্যায়ে সাহস পায় বকুল। ধীরে সুস্থে অর্পনের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। অর্পন বকুলের সাথে সহজ হতে মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দেয়। আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—“কেমন আছো বকুল?”
বকুলের চোখে বিস্ময়। এই অচেনা লোক তার নাম জানলো কিভাবে সেটাই বকুল বুঝতে পারছে না। সন্দিহান কন্ঠে বকুল প্রশ্ন করে,
—“আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে? আমি তো আপনাকে চিনি না। তাহলে?”
মুচকি হাসে অর্পন। হেসে জবাব দেয়,
—“প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে তোমার নাম জেনেছি। তোমার পরিবারের বিষয়ে কিছু জানার ছিলো। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?”
—“কি প্রশ্ন?”
ছোট্ট একটা শ্বাস নেয় অর্পন। তারপর বলতে শুরু করে,
—“তোমার পরিবারের বিষয়ে বলো। মানে তোমার বাসা কোথায়? বাবা মা কোথায় থাকে? তুমি হোস্টেলে কেনো আছো? সব জানতে চাই।”
একটা ঢোক গেলে বকুল। তার কাছে সবকিছু গোলমেলে লাগছে। একজন অচেনা লোক তার পরিবারের বিষয়ে কেনো জানতে চাইছে। বকুল খুব করে চাইছে প্রশ্নটা করতে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না। যেখানে প্রিন্সিপাল স্যার চুপ আছেন তার মানে তিনি চাইছেন বকুল এই অচেনা ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তর দিক। সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বকুল বলতে শুরু করে,
—“আমার বাবা মা বেঁচে নেই। আমি ছোট থাকতে বাবা মারা যায় আর মা মারা গেছে ছয় বছর আগে। আমার পরিবারে শুধু ভাইয়া আর ভাবি আছে। কিন্তু তারা এখানে থাকে না। ভাইয়া চাকরির জন্য ঢাকায় থাকে আর আমি এখানে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করি। কিন্তু আপনারা এসব জানতে চাইছেন কেনো?”
—“কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা তোমার ভাইয়া কি করে? মানে তার চাকরির বিষয়ে কিছু বলতে পারো?”
—“না, আমি তো এসব কিছু জানি না। বলতো মার্কেটিং করে কিন্তু বিস্তারিত কিছু শুনিনি।”
—“তোমার ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করো কিভাবে? ফোন আছে তোমার?”
বকুল যেনো ধীরে ধীরে সহজ হয়ে যাচ্ছে অর্পনের সাথে। নড়েচড়ে বসে জবাব দেয়,
—“আমার কাছে কোনো ফোন নেই। ভাইয়া যখন সময় পায় স্যারের কাছে ফোন দেয় তখন কথা বলি। আর ভাইয়া আমাকে বলেছে আমি এসএসসি পাস করার পর আমাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেবে।”
কথাগুলো বলার সময় আনন্দে চোখ মুখ চকচক করে ওঠে বকুলের। বাচ্চা মেয়েটা ভাইয়ের প্রতি ঠিক কতটা আশা নিয়ে বসে আছে। দুনিয়াটা বড্ড নিষ্ঠুর। মেয়েটা বাবা মা হারিয়ে একটা সম্বল আঁকড়ে ধরে বেচে আছে। হয়তো এই সম্বলটাও হারিয়ে ফেললো। ইভা তো কিছুদিন আগেই মা*রা গেছে। আর বাকি রইলো রুহুল তারও কোনো খবর নেই। কে জানে সে আদৌ বেঁচে আছে কি না। হয়তো বা স্ত্রীকে খু*ন করে নিজেই গা ঢাকা দিয়েছে। যা কিছু হতে পারে। কিন্তু সত্যিটা আসলে কি? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বকুলের দিকে তাকায় অর্পন। ভাইয়ের গল্প বলতে গিয়ে মেয়েটার আনন্দের যেনো বাঁধ মানছে না। বকুলের হাস্যজ্জল মুখ দেখে মলিন হাসে অর্পন। একটা ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলে,
—“ইভার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিলো?”
অর্পনের কথা শুনে চমকে ওঠে বকুল। চেহারায় তার আতঙ্কের ছাপ। আতঙ্কিত গলায় বলে,
—“ছিলো মানে?”
হুট করে কি বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্পন। তারপর কিছু একটা ভেবে বলে,
—“মানে এখানে থাকাকালীন সম্পর্ক কেমন ছিলো সেটা বলছিলাম। এখন তো এখানে থাকে না।”
—“এখনো ভালো সম্পর্ক আছে। ভাবির সাথে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। ভাবি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
—“আর তোমার ভাইয়া? সেও কি ইভাকে ভালোবাসে?”
অর্পনের কথা শুনে হো হো করে হেসে ফেলে বকুল। যেনো এই মাত্র তাকে কেউ অনেক বড় একটা জোকস শুনিয়েছে। হাসতে হাসতে বকুল বলে,
—“এটা কি জিজ্ঞেস করার মতো কথা হলো? ভাইয়া আর ভাবি ভালোবেসে বিয়ে করেছে। তাহলে ভালো তো বাসবেই। সে তো ভাবিকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। দেখুন না আমাকে এখানে রেখে ভাবিকে ঠিকই নিয়ে চলে গেছে।”
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে অর্পন। বকুলের এই প্রাণখোলা হাসি দেখে বড্ড কষ্ট হচ্ছে অর্পনের। বাচ্চা মেয়েটা যখন জানতে পারবে তার ভাবি আর বেঁচে নেই এবং তার ভাইয়াও নিখোঁজ তাহলে কিভাবে নিজেকে সামলাবে? মাথা ঘুরিয়ে রহিমের দিকে তাকায় অর্পন। সেও শুকনো মুখে বকুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই তার। অর্পন বকুলকে যেতে বলতেই সে উঠে রুম থেকে চলে যায়।
বকুল চলে যেতেই অর্পন কিছুটা এগিয়ে এসে বসে টেবিলের দিকে। সাবধানতার সাথে প্রিন্সিপালকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“আপাতত বকুলকে কিছু জানানোর দরকার নেই। সময় হলে আমিই জানাবো। আপনারা মেয়েটার খেয়াল রাখবেন। আর ওর ভাইয়ের অবর্তমানে ওর সব খরচ খরচার দায়িত্ব আমার। সময় মতো টাকা পাঠিয়ে দেবো। এখন আসছি।”
প্রিন্সিপাল স্যার মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। কথা শেষে অর্পন রহিমকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।
_______________
ডক্টরের চেম্বারে বসে আছে দীপ্তি। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে। ডক্টর কিছু টেস্ট দিয়েছিলো সেগুলো করিয়ে রিপোর্টের জন্য বসে আছে। হসপিটালের লোকগুলো এতো ফাঁকিবাজ কেনো? এতো সময় লাগে রিপোর্ট দিতে। সজীবও ফোন কানে নিয়ে কোথাও চলে গেলো তারও আসার নাম নেই। মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে বসে থাকে দীপ্তি। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হয় সজীব। দীপ্তির কাছে এসেই তড়িঘড়ি করে বলে,
—“প্রাপ্তির কিছু একটা হয়েছে। ওকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। রিপোর্ট পরে নেবো এখন চলো।”
প্রাপ্তির কিছু হয়েছে কথাটা শুনতেই চমকে ওঠে দীপ্তি। কোনো কথা না বলে তড়িঘড়ি করে ছুটে চলে সজীবের সাথে। প্রাপ্তিকে যেই হসপিটালে নিয়ে এসেছে সেখানে এসে বাসার সবাইকে খুঁজতে থাকে। তখন সজীবের চোখে পড়ে ডক্টর সাগরকে। দেখা মাত্রই চিনে ফেলে সাগরকে। কাল বিলম্ব না করে উচ্চ স্বরে ডেকে ওঠে ডক্টর সাগর বলে।
এদিকে সাগর প্রাপ্তির খবর শুনে নিজের পেসেন্ট অন্য একজন ডক্টরকে দেখতে বলে নিজেই চলে এসেছে। অর্পনের কাছে প্রাপ্তি যে স্পেশাল কেউ সেটা সাগর খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। তাই অর্পনের অবর্তমানে প্রাপ্তির খেয়াল রাখা নিজের দায়িত্ব মনে করছে সাগর। যাওয়ার সময় পরিচিত কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় সাগর। সজীবকে দেখে এগিয়ে আসে । মুচকি হেসে বিনয়ের সাথে বলে,
—“মিস্টার সজীব রাইট!”
—“হ্যা, প্রাপ্তি কোথায় ডক্টর?”
—“সোজা গিয়ে ডানে যাবেন। প্রাপ্তি সামনের কেবিনেই আছে। আমিও সেখানেই যাচ্ছি।”
দীপ্তি আশেপাশে তাকিয়ে তার বাসার সবাইকে খুঁজছিলো। তখন সামনে থেকে পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে ভ্রু কুচকে যায়। সামনে তাকাতেই সাগরকে দেখে থমকে যায় দীপ্তি। পা দু’টো বরফের মতো জমে যায় তার। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সাগরের দিকে। যেনো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
এদিকে সজীবের যেনো ভীষণ তাড়া। সাগরের থেকে প্রাপ্তি কোথায় জেনে আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। “চলে দীপ্তি” এটুকু বলেই ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে যায় সামনে। কথায় ব্যস্ত থাকায় পাশে তাকায়নি সাগর। কিন্তু সজীবের মুখে দীপ্তি নামটা শুনে থমকে যায় । তড়িৎ গতিতে পাশে তাকাতেই চমকে ওঠে সাগর। সময় যেনো সেখানেই থেকে গেছে। দুজনের চোখেই বিস্ময়। যেনো চোখের সামনে দেখা দৃশ্য সত্যি মনে হচ্ছে না। এতো বছর পর দুজনের আবার দেখা হবে সেটা যেনো কেউ ভাবেনি। এটা কি সত্যি নাকি চোখের ভ্রুম?
এক ধ্যানে সাগরের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে দীপ্তি প্রশ্ন করে,
—“আ..আপনি?”
চোখের সাথে কণ্ঠেও বিস্ময়ের ছোঁয়া লেগেছে দীপ্তি। তিরতির করে কাঁপছে তার দুই ঠোঁট। চোখ দুটো ছলছল করছে নোনা জলে। যেনো পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে। সাগরের নজর দীপ্তির চোখে জায়গা করে নেওয়া অবাধ্য সেই নোনা জলের দিকে। আবার সেই চোখ, সেই মুখ, সেই অনুভূতি। এতো বছর পর আবার সামনে এলো কেনো? সাগরকে আবার এলোমেলো করে দিতে। এই মুখটা কি জানে, সে চোখের আড়াল হতেই ভেতর থেকে ভেঙে গেছিলো সাগর নামের এই মানুষটা। অন্ধকারকে আপন করে দুনিয়ার আলো থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলো নিজেকে। এই চোখ দুটো কি জানে, কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সাগর তার মায়ায়। মায়া কাটাতে না পেরে নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো সাগর। কত কষ্টে নিজেকে সামলেছে, ভাঙা মনের টুকরো গুলো কুড়িয়ে এক জায়গায় করেছে সাগর। কিন্তু আজও সেই টুকরো গুলো জোড়াতে পারেনি। কিভাবে জোড়াবে? জোড়ানোর মানুষটাই তো নেই।
পেছনে ঘুরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে সাগর। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। অভিমানেরা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে সাগরকে। কলিজায় মনে হচ্ছে কেউ ক্রমাগত ছুরি দিয়ে আঘাত করে চলেছে। এই মুখ তো সাগর আর দেখতে চায়নি। সে তো ভূলে যেতে চেয়েছিলো। তাহলে কেনো এসেছে সে? সাগরের মনের সেই পুরনো ক্ষত আবার জীবিত করতে। পোড়ানো কি কম হয়ে গেছিলো যে আবার পোড়াতে এসেছে।
সাগরকে চুপ থাকতে দেখে চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে দীপ্তির গালে। অপরাধবোধ দীপ্তি গলা চেপে ধরেছে। অপরাধী কন্ঠে দীপ্তি বলে,
—“এতো বছর পরে দেখা তবুও মুখ ঘুরিয়ে নিলেন? কথা বলবেন না?”
—“কেনো এসেছো এখানে?”
সাগরের শক্ত কন্ঠ শুনে চমকে ওঠে দীপ্তি। এ কেমন কন্ঠ? এ কেমন কথার ধরন? সাগর তো এতো কঠিন স্বরে কখনো কথা বলতো না। তার মন তো ছিলো তুলোর মতো নরম, অসম্ভব বিনয়ী। আঘাত মানুষকে ভেতর থেকে শক্ত করে দেয় আজ সেটা প্রমানিত। দীপ্তির দেয়া আঘাত সাগরের মতো নরম মেজাজের ছেলেকেও সর্বোচ্চ কঠিন বানিয়ে দিয়েছে। মনটা যে আর নরম নেই, সেটা এখন কংক্রিটের রুপ ধারণ করেছে। মাথা নিচু করে চোখ মুছে ফেলে দীপ্তি। অপরাধবোধ ভেতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মাথা নিচু রেখেই দীপ্তি অপরাধী কন্ঠে বলে,
—“জানতাম না আপনি এখানে আছেন। আমি তো প্রাপ্তির কাছে এসেছি।”
প্রাপ্তির নাম শুনতেই টনক নড়ে সাগরের। অতীতের পাতায় ডুবে গিয়ে নিজের বর্তমান অবস্থান ভূলে গেছিলো সে। নিজেকে সামলে নেয় সাগর। পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“প্রাপ্তি কি হয় আপনার?”
চমকে তাকায় দীপ্তি। সাগরের মুখে আপনি সম্বোধন শুনে এটুকু বুঝতে পারছে যে সাগর তাঁকে খুব সাবধানে এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। এখন তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবে এসবের জন্য দায়ী দীপ্তি নিজেই। একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে দীপ্তি বলে,
—“প্রাপ্তি আমার বোন। আমার মেজো বোন।”
—“আর ওই ছেলেটা।”
—“আমার স্বামী!”
চোখ বন্ধ করে ফেলে সাগর। দীপ্তির কথাটা সাগরের কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগছে। বহু বছর পুরনো ঘা আবার নতুন করে জেগে উঠেছে। একদম নতুন রুপে, নতুন যন্ত্রণার সাথে। তবে সাগর সেটা কাউক বুঝতে দেবে না। আড়াল করে রাখবে বরাবরের মতো। যেমন এতো বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে।
দীপ্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পেছনে ঘুরে যায় সাগর। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
—“চলুন আপনার বোনের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া আপনার স্বামী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
আবারো ছলছল করে ওঠে দীপ্তির চোখ। তবে এবার আর অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়তে দেয় না। খুব সপ্তপর্ণে নোনাজল গুলো লুকিয়ে ফেলে। মাথা নিচু করে চলতে থাকে সাগরের পিছু পিছু।
_________________
গার্লস স্কুল থেকে বেরিয়ে ফোনটা বের করে অর্পন। সারাদিনের ব্যস্ততায় ফোন হাতে নেয়ার সময় পায়নি। কে জানে ওদিকের কি খবর। ফোনটা হাতে নিতেই ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। ফোনের স্ক্রিনে সুজনের সতেরোটা মিসডকল উঠে আছে। কিন্তু সুজন এতো বার ফোন করেছে কেনো? ওদিকে আবার কিছু হয়নি তো। সাথে সাথে সুজনের নাম্বারে ডায়াল করে অর্পন। রিং হতেই রিসিভ করে সুজন। যেনো অর্পনের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো। ফোনটা রিসিভ করেই সুজন গড়গড় করে বলতে শুরু করে,
—“আপনাকে কতবার করে ফোন করছি স্যার আপনি ফোন তুলছেন না। জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম। আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার কিছু হয়নি তো?”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে থাকে সুজন। সুজনকে থামিয়ে দিয়ে অর্পন জবাব দেয়,
—“ব্যাস, এবার থামো। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। ফোন সাইলেন্ট হয়ে ছিলো বুঝতে পারিনি। এতবার ফোন দিয়েছিলে কেনো? ওদিকে সব ঠিক আছে তো?”
—“কিচ্ছু ঠিক নেই স্যার! প্রাপ্তি ম্যাডামের কিছু একটা হয়েছে। তাকে সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। আমি এখন সেখানেই আছি।”
প্রাপ্তিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে কথাটা শুনতেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে অর্পনের। হঠাৎ করেই হৃৎস্পন্দনের গতি যেনো বেড়ে গেছে। অজানা ভয় এসে ঘিরে ধরেছে অর্পনকে। চমকে উঠে অর্পন বলে,
—“হোয়াট! কি বলছো এসব? কি হয়েছে প্রাপ্তির?”
—“জানি না স্যার।”
—“আচ্ছা তুমি ওখানেই থাকো আমি আসছি।”
কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে তড়িঘড়ি করে গাড়িতে বসে পড়ে অর্পন। বুকের ভেতর যেনো দামামা বাজছে। এক অদৃশ্য তীর যেনো বুকে এসে বিঁধছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অর্পন যদি পারতো তাহলে বাতাসের সাথে চলে যেতো প্রাপ্তির কাছে। এই লম্বা সময়টা অর্পনের কাছে ভীষণ তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে সেটা অর্পন বেশ বুঝতে পারছে।
অর্পনের চিন্তিত মুখ দেখে রহিমও আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। অর্পন গাড়িতে উঠেই সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করে। এক একটা মিনিট সময় অর্পনের কাছে কয়েক ঘন্টা মনে হচ্ছে এখন।
চলবে?